কোভিড ১৯-এ কবি ও অকবি

শুনেই চমকে ঘাড় ফেরালেন শিবেন্দু করগুপ্ত।

‘আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সুয্যি গেছে পাটে’।

বাঃ! পরের লাইনটা? মনে আছে? বলো দেখি!

পাল্লায় খদ্দেরের ঝিঙে মাপতে মাপতে লোকটার মাথা কাত। ঠোঁটে সলজ্জ হাসির ঝিলিক।

‘খুকু গ্যাছে জল আনতে পদ্মদিঘির ঘাটে।’

মুগ্ধ বিস্মিত, বাহ্! বাহ্! বাহ্! কয়েকটি অব্যয় প্রকাশ করে শিবেন্দু থলে হাতে এগোলেন। হৃদপিণ্ডে অজানা মোচড় এবং বুড়ো বয়সের চোখ বেয়ে সামান্য অশ্রু বিনাসামালেই গোঁফের দিকে গড়াবার উদ্যোগ। পাছে ডুকরে কেঁদেই ফেলেন, চারপাশের কেউ কেউ সন্দেহ করে মেটাল পেশেন্ট – শিবেন্দু চটপট মুছে নিলেন।

লঘু আনন্দে, বুকের চুপচাপ ভাবটা কেটে গেল। তাৎক্ষণিক হালকা বোধ হচ্ছে। মানুষের মধ্যে কার যে কী থাকে! ভাবলেন, ঈশ্বরীপুরের সুকুর আলী – আট কিলোমিটার সাইকেল ঠেঙিয়ে নিত্য সবজি বইতে হয় যাকে – মাঝবয়সী চেহারা, বিড়ি খায়, লাউ ঝিঙে কচু সজনে ডাঁটা নিয়ে বসে – সে কি না কত অতীতদিনের ভুলে যাওয়া ছড়াটি শুনিয়ে দিলো।

ফের শিবেন্দু দু-পা পিছিয়ে সুকুরের লাউটির দরদাম করবে ভেবেও সামনে এগোলেন। বিচিত্র মানুষের মধ্যে অধিকতর বৈচিত্র্যের কথা ভাবতে ভাবতে, খুকু নামে বালিকাটির নথদোলানো অপুষ্ট মুখটি ভেসে উঠল। কাঁখে মাটির কলসি। বাঁশঝাড়, ঝোপজঙ্গল, সরু পথ এবং প্রাচীন বাঁধানো ভাঙা ঘটলার একটি পুকুর। শাপলা ফুটে আছে চারপাশে। তবু পদ্মদিঘি নাম। শিবেন্দুর বুকের মধ্যে কীভাবে যেন বহু যুগ পেরিয়ে একটা দিন এসে হাজির। তাতে ভোরের উদয় হয়, বেলা বাড়ে, দুপুর ঝিমোতে থাকে এবং রাঙা স্বপন দেশের যে মেঘগুলো – কখন যেন পশ্চিম আকাশের তল্লাট জুড়ে জমতে জমতে, সুয্যি ঠাকুর ডুবে গেলে সন্ধ্যাপূর্ব একটি আলোহীনতা আঁচল পাতে। চারপাশে কেমন মলিন ব্যাকুলতা। আর মাটির ঘরের উঠোন পেরিয়ে সরু পথে খুকু চলে বাঁশবাগানে। তখন কি ঝিঁঝি ডাকতে থাকে? কোনো তুলসীতলায় শঙ্খের আওয়াজ? বা পুরনো কোনো মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান?

শিবেন্দু এগোলেই টের পান, তার মস্তিষ্কের অদেখা অজ্ঞাত সরু রক্তবাহী জালিকা বেয়ে শব্দগুলো হামাগুড়ি দিতে দিতে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি যেন কত দিন ভুলে ছিলেন এসব বিষয়। এখন চেনা-চেনা লাগছে। ব্যাটা সুকুর আলী কাকতালীয় টোকা দিয়ে শিবেন্দুকে আচমকা একটা মরচেধরা চাবি এগিয়ে দিলো। এটা কি রবীন্দ্রনাথের? না না, এ তো মনে হচ্ছে ‘হাসিখুশী’র ছড়া। যোগিন সরকারের। লাইনটা কি ‘আকাশ জুড়ে’ নাকি ‘আকাশ ঘিরে’? আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে! সংশয় জাগে।

সরি! ‘ঘিরে’ শব্দটি তো ওই ছড়াটার। একটু গুলিয়ে গেছল! স্মৃতি দুবলা হয়ে গেছে। আহা! যদি সুকুরের মতো হতাম! যত ভালো ভালো লাইন, মন কেমন করা কবিতা – শুনিয়ে পথেঘাটে মানুষকে কত আনন্দ দেওয়া যেত!

কিছুটা পথ এগোতেই দেখলেন বাজারে পুলিশের গাড়ি, দু-দুটো গার্ডরেলের বাধা, চার চাকা, বাইক বা সাইকেল – কিছুই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কেবল পায়ে হাঁটা মানুষই পিচ রাস্তার ধারের বাজারে যাবে। তাদের সংখ্যাটিও সংক্রমণের ভয়ে কম। একটু প্রৌঢ়ত্বের ছাপ থাকলে তো পরিচিত চোখাচোখিতে মনে হবে ঘরের বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার সমান।

‘রোজই বাজারে বেরুচ্ছেন?’

মানে ঠিক … অভ্যাসটি এখনো …

‘এ-বয়সে বেরোনোটা ঠিক না দাদা!’ ‘ষাট প্লাসদেরই ডেঞ্জার!’ ‘এখন তো পাড়ায় পাড়ায় মাছ-সবজি পর্যন্ত হেঁকে যাচ্ছে!’

সকলেরই নাক-মুখ জুড়ে কাপড়বন্ধনী। চলতি নাম ‘মাস্ক’। সকলে সকলকেই সন্দেহ করছে, ও-ব্যাটা নির্ঘাৎ শরীরে ক্যারি করছে। যতটা ছায়া না মাড়ানো যায় মানুষটার। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স।

অথচ শিবেন্দু এ-পরিস্থিতিতে বিশ-পঁচিশ দিন ধরে রোজই বেরোচ্ছেন। আর রোজই এখানে এলে শুনতে হবে প্রশাসনের ক্যাসেটবন্দি কণ্ঠ।

মানুষ তো আর চাল-ডাল-মাছ-সবজি অনেক মজুত রাখতে পারে না। বাজারে আসতেই হয়। দেখবেন আপনারা ভিড় করবেন না। দূরে দূরে দাঁড়ান যেন ঘাড়ে কারো নিশ্বাস না পড়ে। দূরত্ব বজায় রাখবেন। জানবেন এ-রোগ মানুষের নিশ্বাস ও টাচ লাগলে সংক্রমিত হয়।

যথারীতি মাস্ক পরবেন, স্যানিটাইজার বা সাবান জলে ঘনঘন হাত ধুয়ে ফেলবেন। অযথা আতঙ্কিত হবেন না।

এখন বাজারের চেহারাটা পুরনো দিনের মতো নয়। মাছের পাকা স্থান বন্ধ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওজন করে কেটেকুটে চলে যায়। সমস্ত পরিবহন লকডাউন, লোকাল পুকুর, খাল-বিল থেকে যেটুকু সাপ্লাই আসে! আবারো শিবেন্দুর কানে বেজে উঠল :

ঘাড়ে যেন নিশ্বাস না পড়ে। দূরে দূরে দাঁড়ান। এ রোগটা জানবেন মানুষের ছোঁয়াছুঁয়িতে সংক্রমিত হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। অযথা আতঙ্কিত হবেন না।         

উৎসাহী ভলান্টিয়ারদের মুখে আচ্ছাদন, হাতে গ্লাভস, সঙ্গে খাটো লাঠি। দু-চারটে রিকশাওয়ালা নিষিদ্ধ ওত পেতে খদ্দেরের আশায় লুকোচুরিতে তাড়া খাচ্ছে। কখনো বা মাডগার্ডে লাঠিপেটা, কখনো বা রে-রে দৌড়ে এসে চাকার পাম্প খুলে দেওয়া।

ঘাড়ে যেন নিশ্বাস … টাচে সংক্রমিত … অযথা আতঙ্কিত হবেন না।

… নিঃশ্বাস … সংক্রমিত … অযথা আতঙ্কিত হবেন না।

… মনে রাখবেন এ রোগ …

টানা এ-কদিন শিবেন্দু বাজারে পুলিশের গাড়িটার পাশ দিয়ে ঢুকে পড়লেই ‘সংক্রমিত’ আর ‘আতঙ্কিত হবেন না’ শুনতে পাচ্ছেন। তখনই কড়া রোদে – যদিও সকাল সাড়ে আট কি নটা তখন – নির্দেশ আছে এগারোটার মধ্যেই কেনাবেচার পাততাড়ি গুটানো বাধ্যতামূলক – তার ঢোলা পাঞ্জাবিটা ভিজতে ভিজতে পিঠে লেপটে থাকে।

পরিচিতি কেউ কেউ বন্ধুতামূলক সন্দেহে তাকায়। কেউ আবার ঘনিষ্ঠ সাজতে চায়, ‘এ-বয়সে রোজ রোজ শিবদা কেন বেরুচ্ছেন বলুন তো!’ কেউ আবার শোনায়, ‘দুজনের তো সংসার মশাই, রোজই বাজার লাগে?’

‘না, না শিবুদা, তেমন জরুরি হলে হপ্তায় একদিন আসবেন।’

পথঘাটে লোক নেই, টায়ার ছোটে না, সারসার দোকানগুলির শাটার ফেলা, অদ্ভুত, অদূষিত, অমলিন বাতাসের জন্য বহু ঊর্ধ্বের আকাশ স্পষ্ট নীলা যেন, কত যুগ ধরে এই নীলত্ব লজ্জায় মুখ লুকানো থাকত। তাই, বেলা দশটার রোদে কে যেন অজস্র তরোয়ালের ঝকঝকে ধার মাখিয়ে রেখেছে।

উপরন্তু, কবি শিবেন্দু করগুপ্ত ছাতা নেন না। অভ্যেস নেই। ছাতার আড়াল যেন মুক্তিকে হত্যা করে। সূর্যের অজস্র দান সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তেজ লাগে যদিও, রোদের দাপটও কড়া বোধহয় কখনো কখনো, মাথা একটু-আধটু ঝিমঝিমও করে বটে। শিবেন্দু করগুপ্ত খোলামেলায় অপার আনন্দ পান। কবি মানুষ তো! … দুপুরের রোদকে জ্যোৎস্না মনে হয়!

শিবেন্দু এমন খোঁচাতে আঘাত পান না। ব্যঙ্গটুকুর মধ্যে একটা যেন স্বীকৃতি লুকিয়ে আছে। অথচ, পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন ধরে পরিস্থিতি সে-স্বীকৃতিটুকুকে ঘষে, ডলে, থেঁতলা করে ছিঁড়ে নিয়ে, কোনো একটা বুড়ো মানুষে দাগিয়ে রেখেছে সত্তর প্লাসের সিনিয়র সিটিজেন, যে কি না এইসব ব্যাধির আক্রমণে খুবই ভার্নারেবল, অথচ দেখো, বাজারে বেরোবার শখ। বাইরের মানুষের চোখে কবি শিবেন্দু এখন একজন ছিটিয়াল সিনিয়র নাগরিক ছাড়া কিছু নয়। অন্তত ফ্ল্যাটের মানুষজন তাই ভাবছে।

তবে খোঁচা কিংবা জ্ঞান-দেওয়া পাবলিকরা টের পায়নি, তিন-চারদিন আগে তিনি নিজের কিচেনে স্ত্রী নীলিমাকে একটু হলেই খুন করে ফেলতেন। এমনকি, পাঁচতলা কমপ্লেক্সটির অন্যান্য ফ্যামিলিদের কাছেও ঘটনাটি অনুদ্ঘাটিত। হত্যার গোপন প্রবণতা।

সেই যে সুকুর আলীর মুখ থেকে শোনার পর, কল্পনার ছায়াঘেরা প্রতিচ্ছবিগুলোয় যে সহজতা বোধ করেছিলেন –    ভাবছিলেন সামান্য শব্দের ক্ষমতার কথা, কখন কীভাবে অজ্ঞাত সোনার কাঠির ছোঁয়ায় বুকের বন্ধ দরজা খুলে দিতে পারে –    বাজারফেরত পথের শেষে চারতলায় উঠে বেলডোর বাজিয়ে ঢুকে সব হারিয়ে ফেললেন।

মাছ জ্যান্ত ছিল কি না, সবজিওয়ালা কোন কৌশলে জোগান বজায় রাখছে, হ্যানত্যান – এসব নিয়ে নীলিমার কৌতূহল নেই। বরং বিরক্তি প্রকাশ করে, রোজ রোজ বেরোবার কী আছে? লোকজন ঠারেঠোরে বলছে! দোরগোড়ায় তো ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক। বরং অনেক সকালেই রান্নাবান্না শেষ করা চলে। এই বয়সে নীলিমারও এতো বেলা অবধি ওভেনের তাপ সহ্য হয় না। এখন উপরন্তু বাইরের কাজের মহিলাটিকে ঘরে ঢোকানো নিষেধ।

এরই মধ্যে, কর্তব্য হিসেবে এক কাপ চা আসে। কবি শিবেন্দুর সূক্ষ্ম স্নায়ু ধরে ফেলে চায়না ক্লে-র পাত্রটি যেন টেবিলে অপ্রীতির ঠক্ শব্দ করল। আবেগহীন রুটিন-কর্তব্যটুকুর বুঝ দেয়। শিবেন্দু করগুপ্তের মাথার তালুর রক্তে একটুখানি বেড়ালের

আঁচড় লাগে। কাপটি তুলে ঠোঁটে ঠেকাতে মনে হয়, সাতশো টাকা কিলো চায়ের পরিপূর্ণ ফ্লেভারটি নিংড়ে বার করা হয়নি।

শান্তভাবেই শিবেন্দু জানতে চাইলেন, কতক্ষণ ভিজিয়ে রেখেছিলে?

ভেজানোর বিলাসিতায় নীলিমা যা উত্তর দিলো, দ্বিতীয়বার বেড়ালের আঁচড়। তবে শিবেন্দু আর বিষয়টি এগোতে দিলেন না। আত্মরতিতে চেষ্টা করলেন ‘পদ্মদিঘি’ শব্দটির নতুন কোনো ব্যঞ্জনা তৈরি করতে, যখন সত্যিই সূর্যের অস্তাচলের পথে আকাশে মেঘ জমলে মৃদু ঘোর শুরু হয়। অবশ্য এখন আর সুকুরের মুখে ছড়াটি শুনবার প্রাথমিক বিহ্বলতা নেই। পানাপুকুরে ঢিল পড়বার টুপ শব্দের কিছু পর যেমন ঘটে থাকে।

কবি শিবেন্দু করগুপ্ত প্লাস্টিক চেয়ারটা টেনে ব্যালকনিতে। ভেতরে ধোঁয়ার মতো বুকের চাপটি অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল। রুমের চার দেয়ালের ঘেরে, সীমাবদ্ধ স্পেসে মানুষের কেন দম আটকে আসে না? তাই তো, তিনি ছিটকে এখন ব্যালকনিতে। সামনে তাকিয়ে রাখেন চোখদুটিকে, যেখানে ইদানীং হাইরাইজ বিল্ডিং গজালেও টপকে খানিকটা দূরের আভাস মেটানো সম্ভব। কংক্রিটের ঘেরাটোপে ডুবে থাকতে হয় না। ইদানীং শিবেন্দুর উদ্বেগের কারণ হয় এটাই, যখনই টের পান এরপর কী নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যাবে? নিরেট একটা সময়ের পাঁচিল নাকের সামনে ঠেলে ওঠা এবং উঠতে উঠতে সবকিছু আনন্দকে গলা টিপে ধরে। সকালের আলো শুরু হলেই দ্রুত সংবাদপত্রে চোখ বোলানো,

প্রাতঃকৃত্যাদির মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার পর, একমাত্র প্রেরণা বাজারটি। তা সেরে ফিরে আসার পর, টুকটাক এটা-ওটার পরও চাপা উদ্বেগ, এখন কী করবে! এগারোটা-বারোটা – একটা-দুটো – সেই দীর্ঘ গ্রীষ্মের ছটার আগে তো নিচে নামার উপায় নেই।

তবু তো শিবেন্দু দুপুরে ঘুমোন না, ঘরে ঢোকেন না, খেয়েই দুপুর-হাওয়ায় আরাম কেদারাটিকে টেনে ব্যালকনিতে। নীলিমার অস্বস্তি। এ-শরীরে কি কাব্য করলে চলবে?

অবুঝ স্বামীটির কাণ্ডকারখানায় ঘর থেকে বিছানার চাদরটি এনে দৃষ্টিসুখের গ্রিলটায় ঝুলিয়ে দিলো। আজ সে কমজোরি, থলথলে হয়ে গিয়ে প্রচুর অসুখের ওপর নির্ভর হলেও, হাসপাতালে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় জানে, দুপুরের গরম বাতাস সরাসরি শরীরে লাগা ওর পক্ষে অনুকূল নয়।

এভাবে দৃষ্টি আটকে দেওয়ায়, শিবেন্দু পালটা জেদ দেখিয়ে সরিয়ে দেন না বটে, ভয়ংকর ফুঁসতে থাকেন চুপটি করে।           যখন-তখন ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ! নিজেকে নিজের মতো থাকবার অধিকারের ওপর চড়াও। চাপা ব্যাপ্ত অন্ধ পৌরুষের ধোঁয়া মস্তিষ্কের জালিকা ধরে সচল হতে থাকে। বুকের মধ্যে দুর্বল একটা ধক্ধকানি।

নীলিমা অবশ্য মানুষটার মধ্যে এতোসব প্রতিক্রিয়া টের পায় না। নির্দোষ ভাবনায়, ফিরে কাঠের দরজাটা বন্ধ করে, হালকাভাবে এসিটা চালিয়ে একটু বাদেই নাক ডাকতে থাকে। ব্যালকনিতে শোনা যায়। তখন শিবেন্দু বুক আলোড়িত করে কতগুলো অশ্লীল শব্দ উগড়ে দিতে গিয়েও গিলে নিলেন। সামান্য অনুশোচনায় ধিক্কার উঠল নিজের শিক্ষা-রুচির প্রতি।

ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হামলা ভাবছি কেন, হয়তো আমার শারীরিক কল্যাণে ও টানিয়ে দিয়েছে। রয়ে-সয়ে, আমাকে বলে করতে পারত যদিও। এ-অবস্থায় ঘরবন্দি হয়ে সৌজন্যটুকু বজায় রাখতে পারেনি। ছিঃ! ছিঃ! নীলিমা যদি শুনতে পেত শব্দের বিশেষণগুলো? পরস্পর এতো ঘনিষ্ঠ জীবন কাটিয়েও আমার বুকের জলে এতো কুৎসিত শব্দ ডুবে ছিল?

বিকেল হয়ে গেছে, একটু বোধহয় তন্দ্রা এসেছিল। শিবেন্দু টের পেলেন, নীলিমা বিকেলে ঘুমতৃপ্ত উঠে এসে এক গ্লাস ঘরে পাতা দইয়ের শরবত এনেছে। শরীরটা ঠান্ডা হবে। এখন আর চা খেও না! খুবই আন্তরিক গলায় নীলিমা বলে। শিবেন্দু চুপ। তৃষিত গলায় গেলাসটি যেন বিপুল শান্তির। তখনই চোখদুটো জলে ভরে উঠল – নিজেকে খুবই হীন বোধ হতে থাকে।

এই বিপরীত মানসিক পরিবর্তন শিবেন্দুর ইদানীংকালের নতুন ব্যাধি। বীজাকারে বুকের মধ্যে বহুদিন ধরেই সুপ্ত। তবে, লকডাউনের প্রথম পর্ব পেরিয়ে, দেখা যায় উত্তেজনা প্রশমিত হতেই, সামান্য তুচ্ছ বিষয়েই হোক, শিবেন্দু কেঁদে ফেলেন নিঃশব্দে। অহং পরাজয় মানে।

এই তো গত হপ্তায়, গোড়ালির যন্ত্রণায় বাজার কিংবা বিকেল ঢলে গেলে, ফাঁকে চুরি করে আজন্ম পরিচিত ডেয়ারির মাথায় পাক খেয়ে একটু মুক্তি নিতে যেতে পারেননি।

নীলিমাই ম্যানেজ দিয়েছিল সব। চারতলা থেকে নেমে ভ্যানওয়ালার কাছে মাছ, ফুটে বসা ছোকড়াদের কাছে দুধ, শরবতি লেবু বা কলা আর মুড়ি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে বলত, দিব্যি চলে যাবে! কেন যে তুমি রোজ রোজ বাজারে যেতে চাও।

কেন যাই, যদি তা বুঝতে! লঘু মুডে শিবেন্দু জবাবটি অব্যক্ত বুকে লেপটেই রাখেন। জিভ-ছাড়া করেন না। সন্ধ্যার পর, নীলিমার রুমের দরজাটা খুলে একবার ব্যালকনি, ফের ঘর – মনে মনে আন্দাজে দূরত্বটুকু মেপে হিসাব করেন পঞ্চাশ বারে মোট কতটা হাঁটা হলো। একশ বারে? নীলিমা তার বিছানায় বসে সুমুখের টিভিতে চোখ রেখে বুঁদ।

হঠাৎ ঘাড়টা ঘুরিয়েই ‘বন্ধ করো!’ ‘বন্ধ করো!’ ‘মশা ঢুকছে!’ এমন ন্যাড়াভাবে, দ্রুততায় হুকুমের মর্জিতে বেজে উঠল, শিবেন্দুর মনে হলো বুড়ো চাকরটাকে গিন্নিমা ঝাপটা দিচ্ছেন। তালুটা ঝনাৎ করতেই তিনি কী ভাষায় উত্তরটা ফিরিয়ে দেবেন হিসাব পেলেন না। পৌরুষ কি তার এতোটাই মূল্যহীন হয়ে গেছে?

নীলিমা অতশত তলিয়ে বলেনি। ফের টিভির স্ক্রিনে বুঁদ।

শিবেন্দু কাঁপা গলায় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, ‘মর্জি তো হাঁটাচলা করব … গার্জেনগিরি? … খুব খারাপ হবে বলে দিলাম!’

এবার নীলিমা একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে, ‘ঘরভর্তি মশা! … কামড়াচ্ছে … বলা যাবে না?’

‘না -!’ একটু চেঁচিয়ে শিবেন্দু বর্ণটিকে লম্বা করে টেনে আনলেন।

‘আমি বলব!’ আর তখনই নীলিমা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি।

‘বলবি? বলবি তুই! দ্যাখ!’

ছুটে গিয়ে কিচেন থেকে আলু-পটোল কাটার ছুরিটা এনে, আঙুল কাঁপা অবস্থায় গলায় ঠেকাতেই নীলিমা বিস্ময়ে থ। দৃষ্টি বিস্ফারিত। তাতে যতটুকু ভয়, ঘৃণার পরিমাণ বেশি। ছোটলোকের মতো এতোদিনের মানুষটা মুখোশ খসিয়ে বউকে তুই-তোকারি করল?

আর উত্তেজিত শিবেন্দু নীলিমার চুপসে যাওয়াকে মনে করল ভয় পেয়েছে। পৌরুষের কাছে ঢিট্ হয়েছে।

‘দেবো শেষ করে!’ আস্তে মেজাজ গুটিয়ে শিবেন্দু কিচেনে ফেরেন। ছুড়ে মারার একটা ধাতব শব্দ ওঠে। কল খুলে ঘাড়ে জল লাগান। নীলিমা একই অবস্থায় বসে থাকে কিছুক্ষণ।

পরদিন থেকে এ-ফ্ল্যাটে বাজার হয়, চায়ের কাপ আসে, রাঁধাবাড়া হয়, অহেতুক শব্দ তুলে পরিবেশনও চলে – কথা নেই কোনো পক্ষে। এমনকি, রাত দশটার খবর দেখতে নিয়মিত শিবেন্দু যে নীলিমার খাটে বসত – তাও বন্ধ। কেউ কাউকে সম্বোধন জানায় না অথচ রোজকার নানান দাবি পরস্পরের মিটে যাচ্ছে। শিবেন্দু খেয়ে উঠেই নিজের রুমে চলে আসেন, মশারি টানান। ফের পরদিন এলে বিছানাটা তুলে ফেলেন। উঁকি দিলেই দেখতে পান টেবিলে নীরব চা-ভর্তি পেয়ালাটি, কখনো ঢাকা টিফিন। অথচ, সমস্তটা দিন রুমে নীরবতা গুনগুন করে। কেবল জেগে থাকে একটা খেসারত।

তিনদিন পর, সন্ধ্যায় শিবেন্দু তার রুমে আচমকা ভাঙা ভাঙা কেঁদে ফেললেন। শিশুর মতো ভঙ্গি অথচ একটা বুড়ো মানুষের অবয়বে।

থতমত খেয়ে নীলিমা এ-ঘরে ঢুকে বলে, ‘কী? কী হলো?’

শিবেন্দু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে বলেন, ‘আমি একজন পেশেন্ট হয়ে গেছি। … টের পাচ্ছো না?’

নীলিমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে, নিঃশব্দে নিজের রুমে চোখের কোনা দুটো মুছল।

পরদিন থেকে পুরনো ছন্দে দুই সদস্যের সংসারটি। এবং শিবেন্দু বারে বারে আফসোস করেছেন আর চিন্তা করছেন, ইতর শব্দগুলো মানুষের বুকের কোন গুহার জলে ডুবে থাকে? শিক্ষাদীক্ষার কী মানে হয়? ক্রমে সিদ্ধান্তে আসেন, মানুষ রুচিকে যতই স্যানিটাইজ করুক শব্দের ভাইরাস বুকের পাঁকে লুকিয়ে থাকবেই।

আজ সাড়ে পাঁচটার পর তিনি নীলিমাকে জানিয়েই নেমে পড়লেন। মুখে আচ্ছাদন এবং পকেটে সরল মামুলি মোবাইলটি। ওটি সর্বদাই সহচর হয়ে থাকে শিবেন্দুরা, না থাকলে গভীর অস্বস্তি – কী যেন অরক্ষিত রয়ে গেছে। এখন শিবেন্দু খানিকটা সময় ডেয়ারির মাঠটায় চুরি করে পায়চারি সারবেন। মুক্ত আকাশ, দৃষ্টি ধেয়ে যাওয়া একটা দূরত্ব এবং মিঠে বাতাস ইত্যাদিতে গৃহবন্দির রুদ্ধ চাপ খানিকটা শিথিল ও স্নিগ্ধ হয়।

এখন লকডাউনে পুলিশের জিপ খুব তৎপর। কোথাও মোতায়েন করা হয়। লোকজনের সামান্য ইঙ্গিত পেলেই তাড়া দেয়, যান! যান! অনাবশ্যক বেরুবেন না।

তথাকথিত ভদ্দরজনরা এখনো মাঠে ঢুকবার কথা ভাবতেই পারে না। ওই গাঁজাখোর, চুল্লুখোর, রিকশাওয়ালা, ভ্যান-ঠ্যালা বা ফুটের দোকানদার বা ইতিউতি সাপ্লাই দিয়ে যারা রুজি জোটায় – এখন যারা নির্জলা বেকার – তাদের দলবল কেউ কেউ মাঠে এসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে বিকেল পড়লে। এখন চারপাশের আড়ালে চলতে থাকা নেশার পথগুলো বন্ধ। আয় নেই। মানুষগুলি যেন খরা মাটির ঘাস। পুলিশের হানা, হঠাৎ জিপ হাজির নিয়ে খুবই সজাগ এবং তৎপর।

শিবেন্দু চুরি করে একটু রিস্ক নিয়েই। এই মুক্তিটুকুর লোভে ঝুঁকির নেশায় থাকেন। টুকটুক করে হেঁটে এসে, এধার-ওধার ভ্যান আছে কি না জেনে মাঠে নামেন।

হাঁটেন, হাওয়া খান। একটা টলটলে পুকুরের ধারঘেঁষে দাঁড়ান। ছোট ছোট কুচি ঢেউ, বিকেলের বাতাস, জলজ লতাগুল্মের গন্ধ, ছোট ছোট মাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্লাস, ও-পাড় ছাড়িয়ে গবাদিপশুর জন্য দু-তিন হাত লম্বা ঘাসের চাষ। ঝাড়ালো একটা বটগাছ। মাথায় ধ্বজা বাঁধা। পুলিশের কাছে খবর ওখানে লকডাউনে শুকনো নেশার লেনদেন ঘটছে। লকডাউনে সবই অফিসিয়ালি বন্ধ, তবু নেশাখোরগুলো মায়া ছাড়তে পারে না।

বিকেলে সেই থোক থোক বসে থাকে, টুকটাক বটগাছটার উদ্দেশে ঘাসের জঙ্গলে হারিয়েও যায়, আবার ‘ভ্যান ঢুকেছে’ জানিয়ে চটপট হাওয়া হয়ে যায়।

শিবেন্দু অবিশ্যি ঘন বিকেলে জিপের ফেরে পড়েননি। তাছাড়া, শিবেন্দুর বয়সসীমার কেউই গলিতে বেরোতে চায় না, ডেয়ারির মাঠ তো দূর-অস্ত।

কখনো মাঠে ঢুকবার চার মাথার মোড়টাতেই ভ্যান মোতায়েন হয়ে যায়। লোক এগোয় না আর।

আজ শিবেন্দু গলির মুখেই বড় রাস্তাটায় একঝাঁক পাকাবিচির ছেলেপুলেকে হাসতে হাসতে ‘পুলিশ!’ ‘পুলিশ!’ বলে ছুট দিতে দেখেন। ওরা রাস্তার ধারে স্তূপীকৃত পাইপের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছিল। চলন্ত জিপ হঠাৎ থেমে গিয়ে কয়েকটাকে ঘা লাগায়। বাকিরা দুদ্দাড় ছুট।

শিবেন্দু একটু ভয় পেলেন। গুটিগুটি এগিয়ে দেখলেন বড় রাস্তাটা আগাগোড়া খাঁ-খাঁ। ফ্লায়িং জিপ, ডিউটি শেষ করার পথে ছোকড়াদের চমকে দিয়েছে।

উনি গুটিগুটি মাঠের উদ্দেশে। এভাবেই নিষিদ্ধ পরিবেশে হেঁটে শিবেন্দু সামান্য মুক্তি চুরি করে আনেন। কবিমন একটু শান্ত হয়।

রাস্তায় সব বন্ধ, কয়েকটা অষুধের দোকান খোলা কেবল। মাঠে ঢুকে পড়ার আগে কালী, শীতলা, মনসা ইত্যাদির প্রাচীন একটা মন্দির আছে। বহু মানুষ সকাল-বিকেল এ-পথে চোখ বন্ধ করে বুকে হাত ঠেকায়। কোনো বৃদ্ধ যদি বিকেলে বেরিয়ে একটু নমস্কার জানাতে পথে নামে, তাকে লকডাউন লঙ্ঘন বলা চলবে না। এটাও অত্যাবশ্যকীয়। যদি প্রশাসন নেহাৎ কৈফিয়ত চায়, বলবেন একটু নমস্কার করতে বেরিয়েছেন। আর ঠিক তখনই ঘুরে এসে জিপটা ঘ্যাচ করে পেছনে।

মুখ বাড়িয়ে ইয়ং অফিসারটি বলে, ‘রাস্তায় থাকবেন না প্লিজ! এটা বেআইনি জানেন না?’  শিবেন্দু থতমত খেয়ে বললেন, ‘না স্যার, মানে আমি একটু …’

‘কেন? কেন বার হলেন? চেহারায় তো বুড়ো ভাম …  ভার্নারেবল … জানেন না?’

শিবেন্দুর আঁতে ঘা লাগে।

তড়িঘড়ি, ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি!’

‘আপনি মিথ্যে বলছেন!’

শিবেন্দু আরো ঘাবড়ান এবং সুগার, প্রেসারের রোগী হিসেবে ওষুধের দোকানে যাওয়াটা যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, আইনের প্রশ্ন তোলেন।

গাড়িটা চলেই যেত। হঠাৎ অফিসারটি নেমে বললেন, ‘সঙ্গে আপনার প্রেসক্রিপশন আছে?’ শিবেন্দুর আক্কেল গুড়ুম। ‘না, মানে স্যার, নিয়মিত খাই তো ওষুধগুলো … ফুরিয়ে যেতে …’

‘সঙ্গে মানিব্যাগ কিংবা কার্ড নিয়ে বেরিয়েছেন? … দেখাবেন?’

তড়িঘড়ি শিবেন্দু হাতজোড় করলেন।

‘সরি! মিথ্যে বলছি। … আসলে, কালীমন্দিরে একটু মাথা ঠেকাতে যাচ্ছিলাম।’

অফিসারটি নরম হাসি দিলেন।

‘চেহারায় তো ভদ্দরলোক দেখছি। … ক্রিমিনালদের মতো মিথ্যে বলে যাচ্ছেন? … সরকার বারবার সাবধান করছে … বিপদটাকে হালকাভাবে নিচ্ছেন?’

ধমকের সুরে ‘ফিরে যান’ বলতেই শিবেন্দু অ্যাবাউট টার্ন। পাশের দু-একটা ব্যালকনি থেকে অনেকগুলো মুখ বিস্ময়ে রঙ্গ উপভোগ করছিল।

আজ তুলনায় সন্ধ্যার একটু আগেই শিবেন্দু ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখেন, নীলিমা সবে কিচেনে চায়ের জন্য ঢুকেছে। সোফায় বসে, টিভিতে চোখ রেখে, পাশে ছাইদানিটি সাজিয়ে শিবেন্দু করগুপ্ত একটি সিগারেট ধরালেন। টেনশন বাড়লে কচিৎ ধূমপানের অভ্যাসটি চালু রাখতে হয় এখনো। নীলিমা কাপ হাতে, স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আজ এতো তাড়াতাড়ি? কদ্দুর গেছলে?’

একটু ভেবে শিবেন্দুর জবাব, ‘কেন ডেয়ারির মাঠ!’ চা খেতে খেতে নীলিমা জানতে চায়, ‘পুলিশ কিছু বলে না?’

শিবেন্দু নীলিমাকে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ‘আমি আমার মতো থাকব, ওদের বলার কী?’

স্বাভাবিক চা খেতে খেতে, প্রতিদিনের ডেয়ারি মাঠের পশ্চিমকোণের দূর হাইরাইজ ফ্ল্যাটগুলোর টপে হেলানো আকাশটায় বিচ্ছিন্ন মেঘের লালিমাগুলো কল্পনায় এখন মস্তিষ্কের রন্ধ্র ধরে রক্তে ঢুকে সুয্যির পাটে যাওয়ার কথা মনে করাল শিবেন্দুকে। কিছু অপমানের জ্বালাও।

যাপনক্রিয়ায় যার যার স্বাধীনতা নিয়ে নীলিমা নিরুত্তর। পেশেন্ট হিসেবে স্বামীর প্রতি সতর্ক। বিপ্রতীপ কোনো মত ব্যক্ত করে না। নীলিমার নীরবতায় শিবেন্দু ক্রমশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। যেন চোরাবালিতে অসহায় দাঁড়িয়ে।