গল্পের গোলকধাঁধা

বছর পাঁচেক আগে শরাবনের বয়স যখন পঁচিশ, রবার্ট তুহিন রোজারিওর মুখে প্রভুভক্ত আর পরোপকারী কুকুরের গল্প শুনে শুনে তার মনে হয়েছিল, জীবনের একটি সম্ভাবনার বুঝি অকালমৃত্যু ঘটেছে। আর সেটি হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত অবস্থায় উঁচু বালিশে হেলান দিয়ে মৃত্যুবরণ করার, যা টিভি নাটকের দাদি-নানির বেলায় হামেশাই ঘটে থাকে। বিবাহিত রবার্ট তুহিন রোজারিও বনস্পতি বৃক্ষের মতো। যার গোড়ায় আজীবন জল ঢাললেও কদাচ বিয়ের ফুল ফোটানো যাবে না। উপরন্ত্ত পঁচিশ বছরের মেয়েটিকে রবার্ট উদাহরণ সহকারে বুঝিয়ে বলতো, শেষের সেদিন ভয়ংকর – এই অনিবার্যকে মেনে নিয়ে, বাকি জীবন পোষা কুকুর নিয়ে শরাবনকে একা কাটাতে হবে, যার জন্যে এখন থেকে তার প্রস্তুতি দরকার। সে-সময়ে অফিস সহকর্মীরা যখন-তখন কানের কাছে যে ভাঙা রেকর্ড বাজাতো, তা-ও ওই মৃত্যুসংক্রান্ত। এদের মনে হয়তো কাচ্চি বিরিয়ানি অথবা চাইনিজ খাওয়ার শখ অথচ মুখে বলতো, জ্ঞমিস শরাবন একা মানুষ, টাকা দিয়া কী করেন? কবরে কেউ ধনসম্পদ নিয়া যায় না – বুঝলেন!ঞ্চ তারপর গ্রামের বাড়িতে সাবুর প্রসঙ্গ যখন ওঠে, ততোদিনে আরো পাঁচ-পাঁচটি বছর খসে গিয়ে শরাবনের বয়স দাঁড়ায় ত্রিশ।

সে-সময়ে মেজ চাচার ছোট মেয়ে শরিফাকে খুব ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এটি বাড়ির শেষ বিয়ে। শরিফার বড় দুঞ্চভাইয়ের একজন সৌদিতে, আরেকজন দুবাই থাকে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে এক দুম্বা ছাড়া ভেড়ার লোমের কম্বল, প্রেসার কুকার, টেপ রেকর্ডার, জড়োয়া সেট আরো নানান কিছুতে গাড়ি বোঝাই করে তারা বাড়ি আসে। সেদিন আশপাশের দু-চার গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ে শুধু তাদের মালসামান দেখতে। দেখে দেখে তাদের আশ মেটে না। ট্রাক থেকে হাতে হাতে তারা সেসব জিনিস মাটিতে নামায়। কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায় মেজ চাচার আটচালা ঘরের বারান্দায়। তারপর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে নিজের কাঁধ থেকে রাখা অন্যের জিনিসপত্র। ততোক্ষণে মেজ চাচি দিশেহারা। তার বৃদ্ধ বাপের হজ করে ফিরতে তিনমাস লেগেছিল, তা-ও ঝোলায় করে এক বোতল জমজম কূপের পানি আর কয়েকটা শুকনো খোরমা খেজুর ছাড়া তিনি কিছুই আনতে পারেননি। অথচ তার ছেলেরা মাত্র দুই দিনে রাজ্যের জিনিসপত্র নিয়ে সেই একই দেশ থেকে চলে আসলো কীভাবে! তাতে কেয়ামতের আলামত ছাড়া চাচি ভালো কিছু দেখতে পেলেন না। কিন্ত্ত যতদিন না পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে, ততোদিন তো মানুষের অন্নের সংস্থান করতে হবে। অথচ ছেলেদের পাতে দেবার মতো ঘরে কোনো খাবারই নেই। এক পুত্রের তদারকিতে তিনি তড়িঘড়ি প্রেসার কুকারে মাংস চড়ালেন। মাংসের খুশবু ছোটার আগেই রান্নাঘরের হুইসেল শুনে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মেজ চাচা মুচকি হেসে টাকার বদলে দিরহাম ভাঙিয়ে বাজার করতে ছুটলেন। তাতেও তার তৃপ্তি হচ্ছিল না। বেহেস্তের শান-শওকত কপালগুণে জিন্দেগিতেও যে ভোগ করা সম্ভব, তা দেখানোর জন্যে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া লতায়-পাতায় জড়ানো সেসব আত্মীয়দের তিনি জড়ো করতে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন, যারা তাকে দিনের পর দিন চটের ব্যাগে করে চার আনার বেগুন, কলাপাতা মোড়া চ্যাপা শুঁটকি বা দুঞ্চফালি নোনা ইলিশ আর চার ছটাক সরিষার তেল বাজার করে ফিরতে দেখেছে। তখনো তিনি জানতেন না যে, তার দুর্দিনের সাক্ষী সব কালের গর্ভে বিলীন, পরলোকগত। তাদের কবরের ওপরের সোনালু আর কড়ই গাছ কেটে টেকসই তক্তা হয়। সোনার জলে ছাপা বিয়ের কার্ড নিয়ে পত্রবাহকরা তাই বিফল হয়ে আসছিল। জ্ঞাতিভাই, দুলাভাইদের বিলম্বিত মৃত্যুসংবাদে চাচা বিচলিত হলেন না । পত্রবাহকদের বলে দিলেন, মৃত আত্মীয়দের বংশের ছা-পোনা যারাই আছে, তাদের যেন দাওয়াত করা হয়। যাবতীয় রাহাখরচ তার।

বিয়ের দুদিন আগে অচেনা আত্মীয়তে বাড়িটা ভরে গেল। চাচি বৃদ্ধ মানুষ, নিজের নাতি-নাতনিদের চেহারাই যার মনে থাকে না, মেহমানদের খাওয়াতে বসে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, এমন কিছু পেটুক আত্মীয় আছে, যারা দিনে অন্তত দশবার ঘুরে-ফিরে খেতে বসে, যার জন্যে মুখচোরা লোকগুলো খাবার পাচ্ছে না, বারবার খাবারে টান পড়ে যাচ্ছে। চাচির বিস্মৃতিতে শরাবন কৌতুক বোধ করে। ত্রিশেও যার বিয়ে হয়নি, ছোট বোনের বিয়ের আসরে তার উপস্থিতিটাই বেমানান, উৎকট। লোকজন তাকে ছেড়ে তখন কথা কয় না। এই বিয়েটা অন্যরকম। সে এ বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্যক্রমে অচেনাদের দলে পড়ে গেছে। কিন্ত্ত শরাবনের গা-ঢাকা দেওয়ার ব্যাপারটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এতোগুলো মানুষ এক জায়গায়, একজন আরেকজনকে ঠিকমতো চিনে না, জানে না, বেশির ভাগেরই হাতে কোনো কাজ নেই, বলার মতো কমন কোনো বিষয় নেই, তাকে দুদিন ধরে চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ধীরে ধীরে তাদের সাবুর কথা মনে পড়ে। এরকম শুভ কাজে, বেঁচে থাকলে যে সাবুকে বাড়ির ত্রিসীমানায় ভিড়তে দেওয়া হতো না, তার ওপর দফায় দফায় সভা করে তারা সময় কাটাতে লাগলো। শরাবনও আড্ডার আসরের একজন। সহাস্যে সে তাতে শরিক হয়। যখন বুঝতে পারে, সমাজচ্যুত গরিব মহিলাটিকে নিয়ে গল্প ফাঁদলেও আসলে তার উদ্দেশে কথাগুলো বলা হচ্ছে, ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে – শরাবনের শৈশবস্মৃতি থেকে হেঁটে হেঁটে এক ভিক্ষুক নারী পাড়ি জমায় তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে…

 নাম সাবু কেন? সে কি খালি সাবু খায়? (শরাবনদের গাঁয়ের লোকেরা সাগুকে সাবু বলে, যা খেতে বিস্বাদ, জ্বর উঠলে ছেলে-বুড়ো সবাইকে এটা পথ্য হিসেবে গেলানো হয়)। অন্য সকল মহিলা যখন মা-দাদি-নানি হয়ে নিজের নাম খুইয়ে বসে আছে, শরাবনের মনে পড়ে – তখন গাঁয়ের একমাত্র স্বনামী নারী ছিল সাবু। তাকে নাম ধরে ডাকা বেয়াদবিও নয় যে, যার জন্য শিশুদের কান মলা খেতে হবে। কারণ সাবু গাঁয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি হওয়া সত্ত্বেও মান্য করার নিয়মগুলো তার বেলায় কার্যকর ছিল না।

একবার শরাবনদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় জ্ঞগ্রামঞ্চ রচনা এসেছিল। তা ছিল সিলেবাসের বাইরে। প্রশ্নপত্রের উলটো পিঠে আঁকি-বুকি করতে করতে শরাবন চারটি কলাগাছ আঁকে। গাছগুলো মানুষ ছাড়া কেমন খালি খালি। তাই খালি জায়গা ভরাট করতে সে গাছের ফাঁকে একজন মানুষ আঁকলো, যে অবিকল সাবুর মতো- কোলে ঝাঁকা নিয়ে ভিনগাঁ থেকে ভিক্ষা করে কলাগাছের নিচ দিয়ে বাড়ি ফিরছে। তাকে এগিয়ে নিতে আসছে যে, সে মানুষ না – একটা কালো ছায়া। বাংলা স্যার খাতা দেখার সময় ভিরমি খেলেন। গ্রামের জরুরি বিষয় যেমন পুষ্করিণী কটা, মক্তব বা পাঠশালার সংখ্যা কত, ফুটবল মাঠ আছে কি নেই – এসব বাদ দিয়ে শরাবনের রচনায় কলাগাছ আর সাবুকে নিয়ে বিস্তর এলোমেলো আর অপ্রাসঙ্গিক সব কথাবার্তা, যা তার বিবেচনায় বিপজ্জনক। কারণ বাংলা স্যার হাতেম আলি ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন ভালো। তাই তার আরেক নাম ছিল দিনকানা হাতেম আলি। (যে দিনদুপুরে চোখের সামনে মানুষ খুন হয়ে গেলেও দেখতে পায় না, অথচ ছাত্রছাত্রীর অন্ধকার ভবিষ্যৎ চোখ বুঁজে বলে দিতে পারে, সে দিনকানা নাতো কি?) শরাবনের রচনার ভগ্নাংশ পড়েই চান্দি গরম হয়ে ওঠে বাংলা স্যারের। তিনি ভাবেন, সাবু নামের মহিলাদের গ্রামে থাকতে দেওয়াই ঠিক নয়। তাদের চাল-চরিত্র কলেরা-বসন্তের চেয়েও ছোঁয়াচে। এই কিসিমের নারীরা জোয়ান-মর্দের বুদ্ধিনাশ করে আর সুবোধ বাচ্চাদের ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে অন্ধকার গর্তে ফালায়। তারপর তিনি কল চেপে মাথায় পানি দিয়ে, ঠান্ডা মাথায় ক্লাসে ঢুকে যথারীতি নাম ডেকে ডেকে পরীক্ষার খাতা বিলি করতে বসলেন। এক হাতে খাতা নিয়ে কিছু বলার আগেই ছাত্রছাত্রীরা আরেক হাত তার সামনে বাড়িয়ে ধরছিল। ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক উভয়ের ধারণা, মাধ্যমিকে বেত না-খেলে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। স্যার নম্বরের তারতম্য অনুযায়ী কখনো আস্তে, কখনো জোরে বেত মারছিলেন। শরাবনের পালা আসার সাথে সাথে সেও ডান হাতে খাতা নিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে দেয়। স্যার সাঁই-সাঁই করে মাথার ওপর বেত ঘোরাচ্ছেন, চোখ দুটিও তার লাটিমের মতো ঘুরছে, জ্ঞএইরে তোরা হক্কলে এক নজর চাইয়্যা দ্যাখ, সাবু কলা দিয়ে সাবু খায় আর উন্মে শরাবন তহুরা বেহেস্তের শরবতের বদলি বেত খাই-তা-ছেঞ্চ।

 ক্লাসরুমের মতো বিয়ে বাড়ির, আড্ডায় হাসির রোল পড়ে। শরাবন ভেবেছিল, সাবুকে ছেড়ে এবার তার চেনা-অচেনা আত্মীয়রা হাতেম আলি স্যারকে নিয়ে পড়বে। স্যার যে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, শরাব মানে হচ্ছে শরবত, বেহেস্তের এক প্রকার তরল পানীয়বিশেষ, যা আবার রুআফজার মতো টকটকে লাল, ইরান-তুরান থেকে আগত, প্রতিটা মুসলমানের এমন নেয়ামত পান করা সুন্নত – এ নিয়ে কিঞ্চিৎ অধিক হাসাহাসি চলতে পারতো অন্তত। কিন্ত্ত শরাবন যতই এদিক-ওদিক করুক, ভবি ভুলবার নয়। সাবুর নারীজন্মের ব্যর্থতা ও সফলতার ওপর তারা নানান দিক থেকে আলো ফেলতে শুরু করে। তাদের হাতে ছিল অঢেল সময়। বিয়েবাড়ির প্রস্তুতি সম্পন্ন। শহরের বাবুর্চিরা পোলাও-মাংসের ডেকচি নামিয়ে নিভা চুলার চারদিকে বসে বিড়ি ফুঁকছে। থালা-বাসন-চিলমচি সব রেডি। ভেতর বাড়িতে সফুরা আর আলিজানের নেতৃত্বে গাঁয়ের মেয়েরা দুদলে ভাগ হয়ে বিয়ের গীত গাইছে। বাহির বাড়িতে বাজছে কলের গান। অথচ নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, বিশ ভরি সোনা, ফ্রিজ, টিভি, প্রেসার কুকার, মটর সাইকেল, ভেড়ার লোমের কম্বল ইত্যাদি যৌতুক দেবার প্রলোভন সত্ত্বেও শরিফার বিয়ের বরযাত্রীর টিকির দেখা নেই। মেজ চাচা হাতের লাঠি নাচিয়ে ঘর-বাহির করছেন। মৃত আত্মীয়ের সন্তান-সন্ততির সামনে তার আরেক প্রস্থ অপমান। এ তো রোজ চার আনার বেগুন, চ্যাপা শুঁটকি বাজার করার চেয়েও খারাপ।

সফুরার দল গাইছে :

কিত্তাত বিদাই আরশি গো পড়শি

কিত্তাত বিদাই বেওয়াই

কিত্তাত বিদাই কাজী মোল্লা গো-ও-ও ভাইছাব

কিত্তাত বিদাই জামাই

জবাব আসে আলিজানের দলের কাছ থেকে :

পানের বিদাই আরশি গো পড়শি

টেহার বিদাই বেওয়াই

সালমের বিদাই কাজী মোল্লা গো-ও-ও ভাইছাব

কইন্যার বিদাই জামাই

চাচার মনে হলো, গানে গানে তাকে নিয়ে মশকরা করা হচ্ছে। কত বড় আস্পর্ধা যে, পাড়ার গরিব-গুরবো মেয়ের দল বাড়ির মুরুব্বিরে বলছে ভাইসাব! চাচির বারণ সত্ত্বেও কেবল লাঠি ঘুরিয়ে তিনি বাড়ি থেকে তাদের ধুর-ধুর করে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর সমান জোসে চললেন অন্দরমহল ছেড়ে বাহির বাড়ির দিকে। সেখানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান চলছিলো- জ্ঞগাছের পাতা আলোর ঝিকিমিকি আমায় চমকে দাও-দাও দাও দাও/ আমার মন মানে না/ দেরি আর সয় না।ঞ্চ চাচার লাঠির এক বাড়িতে গান গেল বন্ধ হয়ে। তাতে আড্ডার মৌতাত বাড়লো বৈ কমলো না।

 ছোটবেলায় গুটি বসন্ত হয়ে বড় বড় খানাখন্দে সাবুর মুখ ভরে যায়। যৌবন পার হয়ে যাচ্ছে অথচ বিয়ে হচ্ছে না। বাপ-চাচারা অধৈর্য হয়ে তার এক বিবাহিতা সুন্দরী ফুফুকে দেখিয়ে বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেললেন। সাবু ঘোমটার আড়ালে গুটি বসন্তের দাগে ভরা মুখ নিয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। প্রথম যে মহিলা নববধূর ঘোমটা খোলে, সে নাকি এক ঝলক দেখেই অজ্ঞান হয়ে উঠানে পড়ে গিয়েছিল। সেই রাতেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়ের শাড়ি-গহনা গা থেকে খুলে রেখে, ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। সাবু তখনও পথঘাট ভালো চেনে না। পথে ঘুরে ঘুরে বাপের বাড়ি ফিরে আসতে তার এগারো দিন লেগে গিয়েছিল। বিয়ে বাড়ির আড্ডায় এমন একজনও নেই, যে সাবুকে স্বামী-পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেঁড়া কাপড় পরে বাপের বাড়ি ফিরতে না দেখেছে। এসব শোনা কথা। তাই সন্দেহ থাকেই। সাবুর গল্পের আরেকটা বয়ান হচ্ছে, গুটি বসন্তের দাগ-টাগ আরো পরের ব্যাপার, আসলে স্বামীর বাড়িতে সাবুর একটি মেয়ে হয়েছিল। আঁতুড়ঘরে স্তন চাপা পড়ে বাচ্চাটা যখন মারা যায়, সাবু তখন অঘোর ঘুমে। পরদিন স্বামীর বাড়ির লোকেরা মেয়েকে কবর দিয়ে মাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। তবে সেবারও বাপের বাড়ি ফিরে আসতে সাবুর এগারো দিন লেগেছিল। গল্পের তৃতীয় বয়ানেও এগারো দিন বলবৎ থাকে। উপরন্ত্ত তাতে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাখ্যান। খানাখন্দভরা মুখের জন্যই হোক কিংবা স্তন চাপা পড়ে মেয়ের মৃত্যুর কারণেও হতে পারে, সাবু যখন এগারো দিন পর বাপের বাড়ি ফিরে আসে, তখন সে একা ছিল না। তার সাথে ছিল ভিনগাঁয়ের এক নাগর। সে সাবুর পেছন পেছন এগারো দিনে এগারো বার নিজের গ্রাম প্রদক্ষিণ করে হেমায়েতপুর গ্রামে হাজির হয়। এসে দাবি করে যে, সাত পাক ঘুরলে হিন্দুদের যেখানে বিয়ে হয়ে যায়, সে তো আরো চারবার বেশি ঘুরেছে, সাবু তার বিবাহিতা স্ত্রী। এই বলে গাঁয়ের মুরুব্বিদের সে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কিন্ত্ত তারা তো হিন্দু না, মুসলমান। মুসলমানের বিয়েতে সাক্ষী লাগে, কলমা পড়তে হয়, সামর্থ্য অনুযায়ী লোকজন ডেকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে হয়। সাবুর বাপ-চাচারা বিয়ের প্রথম দুটি শর্তে রাজি, তবে এক মেয়ের জন্য দুবার টাকা খরচ করে লোক খাওয়াতে তারা রাজি নয়। মুরুব্বিরা বিয়ে পড়ানো স্থগিত রেখে গালাগাল দিতে দিতে যার যার বাড়ি চলে যান। সাবু পেছন পেছন এগারো পাক ঘোরা লোকটার সাথে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করে। তাতে করে সমাজে তাদের জলচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, দোররা, পাথর ছোড়া বা জুতা মারা – এসব হয়নি। তবে বাপ-চাচাদের মৃত্যুর পর সাবুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ভাইয়েরা ফের সমাজে ওঠে। গল্পটা এতোটাই বাস্তবসম্মত ও আশ্চর্যজনক যে, আড্ডায় শ্রোতারা সাবুর নাগরের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে যায়। কাহিনীকার নিজেও গল্পের শেষ জানে না। এ অবস্থায় লোকটাকে মেরে ফেলা সে সমীচীন মনে করে। তার ভাষ্যমতে, কলেরায় মৃত্যু হয় সাবুর প্রেমিকের। গাঁয়ের বারোয়ারি গোরস্তানের ছাদনাতলায় তার কবর। সাবু বাড়ির কলাগাছগুলোর মতো যতœ নিতো কবরটার। রোজ সকালে ভিক্ষায় বেরুনোর আগে পানির বদনি হাতে তাকে কবরখোলার দিকে যেতে দেখেছে অনেকে। এ ঘটনার আরেকটি বয়ান হচ্ছে, সাবু আর তার প্রেমিক একসাথে থাকতে শুরু করেছে কি করেনি, খবর পেয়ে লোকটার স্ত্রী গাঁয়ে এসে হাজির হয়। মহিলা ছিল দজ্জাল প্রকৃতির। সে গলায় গামছা বেঁধে স্বামীকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

 শেষোক্ত বয়ান অনুযায়ী প্রেমিক বেহাত হয়ে গেলেও সাবুর হাতে বড় অঙ্কের টাকা আসে। তা খোরপোষ আর দেনমোহর বাবদও হতে পারে, অথবা পৈতৃক জমি বেচেও সে পেয়ে থাকতে পারে, যা শরিফার বিয়ের আসরের একজন ছাড়া আর কেউ সঠিক জানে না। যিনি জানেন, তিনি শরাবনের সম্পর্কে বোন হলেও বয়সের দিকে মেজ চাচির সমান, নাম জৈতুন বিবি। বরযাত্রী দেরি করে আসাটা যে বিয়ের রেওয়াজ, আদ্যিকাল থেকে এ নিয়ম চলে আসছে, তা জনে জনে বোঝাতে জৈতুন বিবি আসর ছেড়ে উঠে গেছেন। তার জন্য তরুণ আড্ডাবাজরা অপেক্ষা করে না। কারণ যে উপায়েই অর্থপ্রাপ্তি ঘটুক না কেন, সাবু তখন গাঁয়ের সর্বাপেক্ষা ধনী রমণী। থাকতোও রানির হালে। তিন তিন জন দাসী তার। একজন চুল আঁচড়ে দেয় তো আরেকজন নখ কাটে, পরের জন ঘরবাড়ি সাজায়। সৎ লোকেরা বাড়ি বয়ে উপদেশ দিয়ে যেতেন, জ্ঞদেখ রে সাবু, রাজার ধনও বইস্যা খাইলে ফুরায়ে যায়, তুই এক অভাইগ্যা নারী, সাতকুলে কেউ নাই তোর (সাবুর বাপ-মা ততোদিনে গত হয়েছেন), বুঝে-শুনে চল, না-হয় শ্যাষকালে পানিতে পড়বি।ঞ্চ সাবু পানিতে পড়ার তোয়াক্কা না করে দিনমান চৌকির ওপর বসে থাকে। এমনকি তাদের হিতোপদেশ কানে তোলার প্রয়োজন মনে করে না। তবে তার নানান সময়ের কথাবার্তা জোড়া দিলে মানেটা দাঁড়ায় এরকম যে, টাকা ফুরোলে তিন দাসীকে বিদায় করে দিয়ে সে ঘরের অর্গল তুলে দেবে। দুনিয়ার মানুষ জিন্দা সাবুকে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না।

এই শেষোক্ত বয়ানে সাবুর গুটি বসন্ত হয় তখন, যখন তার টাকা ফুরিয়ে তলায় লেগে গেছে, কিন্ত্ত তিন দাসীকে তখনো বিদায় করা হয়নি। মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে প্রথমা দাসী দেখে, চুলের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য লাল বর্ণের চক্ষু তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। সে তেলের বাটি মাচাংয়ের ওপর রেখে পুকুরে সাত ডুব দিয়ে ভিজা কাপড়ে পালিয়ে যায়। একে তো পরনের কাপড় ভিজা- টপটপ করে তা থেকে পানি ঝরছে, তার ওপর অনেক দিন বাড়ি থেকে পুকুরঘাট পর্যন্তই তার হাঁটাচলা। দ্রুত পা চালাতে গিয়ে দাসী হাঁপিয়ে ওঠে, ভেজা শাড়ি তার পা দুটিকে জোঁকের মতো কামড়ে ধরে, পায়ের গোড়ালি টনটন করে ব্যথায়। হেমায়েতপুর ছাড়ার আগেই সূর্য অস্ত যায়। তার বাড়ি আরো দুটি গ্রাম পর। মাঝখানে সুন্দরীর জলা। তেপান্তরের মাঠ। একেবারে সুনসান। হঠাৎ দড়িছাড়া একটা বকনা বাছুর তার লগ লয়। নিরীহ প্রাণী এমনে হেঁটে হেঁটে তাকে এগিয়ে দিতে আসছে হয়তো। প্রথমা দাসীর হঠাৎ মনে হয়, কোন গাইয়ের দড়িছাড়া বাছুর, এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ তার পেছন পেছন চলে যাচ্ছে, বেচারা যদি পথ চিনে গোয়ালে ফিরতে না পারে, দুষ্টু লোকেরা তাকে খোঁয়াড়ে দিবে। সে ক্ষেতের বেড়ার জিংলা তুলে বাছুরটাকে হুশহাস করে তাড়া দেয়। নিরীহ বাছুর ধূর্ত শিয়ালের বেশ ধরে চোখের নিমিষে শূন্যে উবে যায়। তারপর প্রথমা দাসী কী করে নিজ বাড়ির উঠোন পর্যন্ত যেতে পেরেছিল, সে আর তার খোদা জানে। লোকজন ধরাধরি করে ঘরে তুলে তার মুখের ওপর কুপি ধরে দেখে, সে ভুরভুরিয়ে গাঁজলা ছাড়ছে। শরীরটা কাঁপছে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো। হাতের তালুভর্তি লাল লাল চোখ নিয়ে দুদিনের জ্বরে দাসীটি যখন মারা যায়, সাবু তখন মৃত্যুশয্যায়। বাকি দুজন দাসীও ততোদিনে লাপাত্তা। সেসময়ে দরজার ফাঁক দিয়ে রোজ এক বদনি পানি তার ঘরের ভেতর ঠেলে দিতো আত্মীয়রা। এদিকে কাফনের কাপড়ও কেনা হয়ে গেছে। কিন্ত্ত ওষুধ-পথ্য ছাড়া শুধু পানি খেয়ে সাবু মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে টানা বিশ দিন। তারপর নিজেই হামা দিয়ে ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসে, ততোদিনে দুনিয়া বদলে গেছে। টাকা নেই, দাসী নেই, কুৎসিত মুখ। যে আত্মীয়রা তার কালরোগের চিকিৎসা করানো দূরে থাক, এক গেলাশ পানি-পড়া পর্যন্ত খাওয়ায়নি, সে পণ করে, জীবনেও তাদের চৌকাঠ মারাবে না। তার তখন ভূতপূর্ব নাগরের কথা মনে পড়ে। আড্ডার শেষ ভাষ্যমতে, লোকটি যদি মরে গিয়ে না থাকে, তাহলে নিজের গাঁয়ে বউয়ের সাথে আছে। সেদিনই অনিশ্চিত পথে শুরু হয় সাবুর জীবনের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ অভিযান। এগারো বার প্রদক্ষিণ করে যাকে সাথে নিয়ে একদিন সে বাড়ি ফিরেছিল, তাকে পুনরায় পাবার আশায় সেই গ্রামের চারদিকে চরকির মতো ঘুরতে থাকে সে।

এ যেন রিলে রেস। সাবুর পথ চলার খড়ের মশালটা ম্যাজিকের মতো চলে আসে শরাবনের হাতে। তবে এবারের স্থান হেমায়েতপুর আর তার আশেপাশের গ্রাম নয় – এইটা ঢাকা শহর।

রবার্ট তুহিন রোজারিও ঢাকা শহরের আধুনিক পুরুষ। সে রোজ শুক্রবার দুপুরে টেনিস খেলতে বেরিয়ে, না-খেলে উপরন্ত্ত কেন রাত করে বাড়ি ফিরে – বউ জানতেও পারে না। তবে শরাবনের কাছে সে কিছু লুকোয় না। কারণ সে তার বিবাহিত স্ত্রী নয়, বান্ধবী। শরাবন ভবিষ্যতের কথা জানতে চাইলে রবার্ট তাকে ঈশপের গল্প শোনায়। সে প্রতিবার মোরগ আর কুকুরের গল্পটাই বলে। এক মোরগের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে এক কুকুরের। তারা দুজন দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা যখন গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, তখন রাত। মোরগ গাছের ডালে উঠে গেল ঘুমাতে আর কুকুরটা গাছের গোড়ার খোঁদলে শোবার আয়োজন করলো। পরদিন ভোর হওয়ার আগেই অভ্যাসবশত কোঁকর-কো করে ডেকে উঠলো মোরগ। সেই ডাক শুনে গাছের তলায় হাজির হলো এক শিয়াল। জ্ঞভাই মোরগঞ্চ সামনের দুপায়ে ভর দিয়ে ল্যাটা মেরে বসে শিয়াল তার প্রশংসা করে, কি সুন্দর গলা তোমার, একবার নিচে নেমে আসো তো। তোমার সাথে মন ভরে কোলাকুলি করি! মোরগ বলে, না, নিচে আমার দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। হে আগে ঘুম থেকে উঠুক। উঠে দরজা খুলে দিক। তবে আমি গাছ থেকে নামবো। শিয়াল যেই না কুকুরকে জাগালো, দারোয়ান লাফিয়ে উঠে শিয়ালের ঘাড় কামড়ে ধরলো। দেখলে কুকুর কেমন উপকারী! গল্প শেষ করে রবার্ট শরাবনকে বলে, তুমি কুকুর পালতে পারো, সে মোরগটার মতো তোমারও দেখ-ভাল করবে। এ তো গল্প, নীতিগল্প। বাস্তব অনেক কঠিন – শরাবন এ কথা বললে রবার্ট তাকে একটা বাস্তব গল্প শোনায়। যদিও তা বাংলাদেশের নয়, জাপানের। টোকিওর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকার নাম সিনজিকো। সেখানে একদিন এক মহিলা কুকুর সাথে করে বাজার করতে এসেছে। শখ মিটিয়ে দামি দামি জিনিসে সে ব্যাগ ভর্তি করে ফেললো। ফেরার সময় মহিলা লম্বা চেন ধরে হিল পায়ে টুকটুক করে হাঁটছে, সামনে কুকুরটা কামড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার শপিং ব্যাগ। দেখলে কুকুর কতো উপকারী! রবার্ট জাপানের গল্পশেষে বলে, জ্ঞজাপানি মহিলার মতো তোমার কুলির কাজও সে করে দেবে।ঞ্চ

এদেশের রাস্তায় আকছার কুকুর পাওয়া যায়। আর টাকা খরচা করলে মানুষ-দারোয়ান, মানুষ-কুলি গ-ায় গ-ায় মেলে। শরাবন বলে, তার দরকার একজন সঙ্গীর, মানুষ সঙ্গীর। যে তার সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে। কুকুরের মতো নয়, সত্যিকারের একজন মানুষ হিসেবে। সত্যিকারের মানুষও সঙ্গী হিসেবে কুকুরের চেয়ে খারাপ। শেষমেশ রবার্ট তাকে জানিয়ে দেয়। তবে সে কুকুরের সাথে না থেকে স্ত্রীর সাথে থাকছে কেন? থাকছে কারণ সারমেয় সম্পর্কিত বোধোদয় তার নতুন। আগে জানলে সে বিয়ের শৃঙ্খলে জড়াতো না।

শরাবনের চাচাতো বোন শরিফার বিয়ের বরযাত্রী আসতে দেরি হওয়ায় সেদিন বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবার খুব টেনশন। সন্ধ্যারাতের পোলাও মাঝরাতে ভিজে উঠেছে। দইয়ের হাঁড়ির ঢাকনা খুলতে কারো সাহস হচ্ছে না। ডজনখানেক হ্যাজাক ঘন ঘন পাম্প করে জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছিল। বিয়ের গেট সাজানো হয়েছিল দু পাশে চারটা কলাগাছ পুঁতে, মাথার ওপর বাঁশের খোপ খোপ চাটাইয়ের গায়ে নিমের ডাল ছড়িয়ে দিয়ে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে টানা সুতলির গায়ে ময়দার লেই দিয়ে সাঁটানো ত্রিভুজাকৃতির রঙ-বেরঙের কাগজ। বরযাত্রীর বিলম্ব দেখে শিশিরসিক্ত কাগজগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঘুড়ি বানাতে বসে গেল পাড়ার দুরন্ত ছেলেরা। বরের গেট ধরার লম্বা বেঞ্চিটাও কে যেন অভিমান করে সরিয়ে ফেলেছে। চেনা-অচেনা বোনেরা হাতে অঢেল সময় পেয়ে সাবুর কাহিনীর ডালপালায় বিচরণ শুরু করে। শরিফার প্রতি কারো খেয়াল নেই। মেজ চাচার লাঠির ঘায়ে জ্ঞগাছের পাতা আলোর ঝিকিমিকি … আমার মন মানে না/ দেরি আর সয় নাঞ্চ গান থেমে যেতেই বেচারি ডুকরে কেঁদে উঠলো। হাতের মেন্দির আলপনা, গায়ের হলুদ-মেথির ঝাঁঝালো ঘ্রাণ সব বৃথা। যার জন্য এতসব, তার দেখা নেই। কাঁদতে কাঁদতে শরিফা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর বাকি আধখানা রাতে তার জীবনে যা যা ঘটে, তা তা স্বপ্নের চেয়েও অবিশ্বাস্য। তাকে দুবাই মার্কেটের বালা-চুড়ি, বাজুবন্দ, কণ্ঠহার, কানের দুল, টিকলি-টায়রা, হীরের নাকফুল দিয়ে সাজানো হলো। বিয়ে পড়াতে আসা কাজী সাহেবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সে কবুল বললো। আয়নায় অদেখা পুরুষটির মুখ দেখলো নিজের ঝলমলে অচেনা মুখের পাশে। সে তাকে চামচে করে মিষ্টি খাওয়ালো। ভোর হওয়ার আগেই ঘরে বর-বউ রেখে সবাই চলে যাওয়ার পর, লোকটা ঠোঁটে চুমু খেতে বাধা পেয়ে ব্লাউজের ওপর দিয়ে স্তন দুটি তার মোচড়ালো। তারপর শেরওয়ানির হাতা গুটিয়ে শাড়ির কুচির ভেতর দিয়ে প্রথমে আঙুল ও পরে শক্ত জিনিসটা ঢুকিয়ে দিলো তার গোপন অঙ্গে। পরদিন ছোপ ছোপ রত্ত্কের আলপনা আঁকা সাদা চাদর – যা পতাকার মতো পবিত্র, উঠোনের তারে পতপত করে উড়ছিল।

রবার্ট কাঁচা হলুদ আর মেন্দির ঝাঁঝালো ঘ্রাণে উত্থিত হয়। পাঁচ বছর ধরে তাদের সম্পর্ক, দিনদুপুরে উদোম হতে শরাবনের এখনো আপত্তি। রবার্ট আজকাল আর জোরাজুরি করে না, তবু কপট রাগে বলে, চাচাতো বোনের বিয়েতে গিয়ে তুমি আরো গাঁইয়্যা হয়ে ফিরেছো। এ শুধু বলার জন্য। মুখ বুঁজে শরীর নাড়াচাড়া অসভ্যতা হয়। কিন্ত্ত শরাবন আজ হাঁটু দিয়ে রবার্টের কোমর জড়ানোর সময় কথাটাও পেঁচিয়ে ধরে। তারপর কথার পিঠে কথা চড়ে। তারা জামাকাপড় পরা থাকলেও, তাদের এতোদিনের না-বলা কথাগুলো উলঙ্গ হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে-

রবার্ট কি বউয়ের সাথেও ঠিক এভাবে যৌনত্র্কিয়া করে? হ্যাঁ ঠিক এইভাবে। কাপড় খোলা না-খোলা সমান। এছাড়া ছোট ছেলেটা চার বছরের হলেও মা-বাবার সাথে এখনো এক খাটে ঘুমায়। বিছানায় পেসাব করে, রাতে তিন বার জেগে ওঠে। রবার্ট আর তার স্ত্রী সপ্তাহে কবার যৌনত্র্কিয়া করে? তিন থেকে চার বার। আর শরাবনের সাথে শোয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, বউকে মিথ্যা বলতে হয়। উভয়ের সাথে যৌনত্র্কিয়ায় রবার্ট কি সমান আনন্দ পায়? একদম সমান সমান। বেশিও নয় কমও নয়। চার জন নারীর সাথে এক এবং অভিন্ন আচরণ করার মতো মুসলমান ধর্মমতে সে একজন আদর্শ পুরুষ। যদিও রবার্ট তুহিন রোজারিও জন্মসূত্রে একজন খ্রিষ্টান। শরাবন হাঁটুর এক ধাক্কায় রবার্টকে ফেলে দিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। দুঃখে-অপমানে সে তখন দিশেহারা। মেক্সির বোতামগুলো যে লাগানো হয়নি, সেদিকে তার খেয়াল নেই। স্পষ্ট দিবালোকে চোখের ওপর পর্দানসীন নারীর আধখোলা বুক, অথচ তা থেকে সরে গিয়ে তার অগ্নিমূর্তি শুধু পুরুষটির নজরে পড়ে। তারপর সে দেখতে পায় খোলা দরজাটা। রবার্ট বিছানা থেকে নেমে ধীরে সুস্থে আন্ডারওয়ারের ওপর টেনিস স্যুট চাপায়। ম্যাচ বাক্স ঠুকে ঠুকে সিগারেট ধরায়। তারপর একগাল ধোঁয়া ছেড়ে খোলা দরজা ডিঙ্গিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে যায়।

সাবুর নাগরকে বাড়ি এসে বউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যতই খা-ান্নি হোক, নারী তো! শরাবনের সম্পর্কে বোন হলেও বয়সের দিক দিয়ে যে মেজ চাচির সমান, সেই জৈতুন বিবির ভাষ্যমতে, সেদিন সাবুদের উঠোনে হেমায়েতপুর গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছিল। বাড়িতে লোক আর ধরে না। মানুষের পাড়ায় বাড়ির পাশের চষা ক্ষেতগুলো সমান হয়ে যায়। মাটিতে মানুষ, গাছের ডালে মানুষ। গরুর দড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নাগর গোয়াল ঘরে বন্দি হলো। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শত কণ্ঠে চিৎকার করছে তার বউ। সাবুর নামে দুই বিঘে জমি লিখে দিয়ে তবে স্বামী-স্ত্রী সেদিন হেমায়েতপুরের গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছিল। অথচ এখন শরাবন জানালার পাশে দাঁড়ালে দেখতে পেতো, স্ত্রীর কাছে রবার্টের স্বেচ্ছায় অবাধ প্রত্যাবর্তন। শুধু রাস্তার এক নেড়ি কুকুর লেজ নেড়ে নেড়ে তোষামোদী ভঙ্গিতে তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে এ গলিতে যার বিচরণ, সেই পুরুষটিকে যে করেই হোক সে ফিরিয়ে আনবে – এই তার অভিপ্রায়। শরাবন মেঝেতে দাঁড়ানো প্রস্তরমূর্তি। রবার্ট পেছন ঘুরে কুকুরটিকে একবার তাড়া দিয়েই গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একদিন যায়, দুদিন যায়, এভাবে সপ্তাহ ঘুরে গেছে। শুক্রবারের টেনিস স্যুট পড়ে রবার্ট তুহিন রোজারিও আর আসে না। অপেক্ষা করতে করতে শরাবনের গায়ে জ্বর ওঠে। গুটি বসন্ত দেশ থেকে উজাড় হয়ে গেছে। তা-না হলে তার বসন্তই হতো। খালি বাড়ি, মুখে পথ্য তুলে দেওয়ার লোক নেই। হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে সে বাথরুমের কলের নিচে বসে মুখ হাঁ করে ট্যাপের পানি খায়। নিজের মাথায় নিজে পানি ঢালে। কপালে জলপট্টি দেয়। এভাবে নিজের শুশ্রূষা নিজে করে, ট্যাপের পানি খেয়ে খেয়ে শরাবন এক সপ্তাহ বেঁচে রইলো। এবার রবার্টকে তার খোঁজার পালা।

মুখে দগদগে বসন্তের ঘা নিয়ে এক নারী গাঁয়ের পথে ঘুরে বেড়ায়। শাড়ির আঁচলে তার মুখম-ল ঢাকা। কঠিন অসুখের ফলে পা দুটি দুর্বল। ফাল্গুন-চৈত্র মাস। মাতালের মতো টলোমলো পায়ে সে হাঁটে। গাছের শুকনো ঝরাপাতা উড়ে তার পায়ে পায়ে। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফাটার উপক্রম হয়। সে পানা পুকুরের তলায় নেমে আঁজলা ভরে পানি খায়। তীরে চাষামতো এক লোক। কাঁধে লাঙ্গল। হাতে গরু হাঁকানোর পাঁচন। জ্ঞকে গো তুমি? কোন গেরামে বাড়ি? বাপের নাম কি?ঞ্চ সাবু নিচ থেকে যার গলা শোনে, তাকে মধ্য দুপুরের রোদের বিপরীতে ছায়ার মতো কালো দেখায়। কালো ছায়ার সাথে আবার কথা কি। সাবুর হাত দুটি ফের ঠান্ডা পানি মুখের কাছে তোলে। জ্ঞপচা পানি খাইয়্যো না গো বিডি। খাইলে মরবা। এ গাঁয়ে কলেরা লাগছে।ঞ্চ বলতে বলতে লোকটা তীর বেয়ে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে আসে। সাবু মুখের ওপর লম্বা করে ঘোমটা দেয়। তারপর কথাবার্তা সে যা বলে সব কাপড়ের তলা থেকে। লোকটা কয়েক বিঘত দূরে থাকতে সে বলে, জ্ঞবাবা আমার বসন্ত অইছিল। এ বড় কঠিন রোগ গো বাজান। এ ধরলে পর যমে-মানুষে টানাটানি …ঞ্চ কথার মাঝখানে আঁচল সরে গিয়ে তার কুৎসিত মুখটা বেরিয়ে পড়ে। যা দেখে লোকটা পানা পুকুরে লাঙ্গল-লাঠি ফেলে দে দৌড়।

আরেক বয়ানে আছে, সাবু লোকটাকে বলে, জ্ঞএ গেরামের নাম কি বাজান? আমি অশিখ্যিত মানুষ, বাপে নেহাপড়া হিকায় নাই। এইহানো কি তারা মিয়ার পোলা মজনু মিয়ার বাড়ি?ঞ্চ তারা মিয়া নামে পাঁচজন লোক আছে এই গ্রামে। তাদের তিনজনের ছেলের নাম মজনু মিয়া। কোন মজনু মিয়ার কথা ভিনগাঁয়ের বিডি জানতে চায়, যার বাপের নাম তারা মিয়া? সাবুর মুখে কথা সরে না। হেমায়েতপুর গাঁয়ে যে দেওয়ানা হয়ে চলে গিয়েছিল এক পথভোলা নারীর পাছে পাছে, তারপর স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকলেও কলমা পড়ে যার সাথে তার শাদি হয় নাই, সেই পুরুষ মানুষটার খোঁজখবর করতে আসতে পারে এমন এক নারী, যে তার স্ত্রী নয়? এ এমন এক ঘোরেল প্যাঁচ, যার টানে মাথার ঘোমটা আপনা থেকেই খসে পড়ে। মুখ ফুটে বলতে হয় না, জ্ঞহে বাপ আমার বসন্ত অইছিল। আমি কলেরারে ডরাই না। আমারে পেড ভইর্যা পানা পুকুরের পানি খাইতে দেও।ঞ্চ লোকটা নারীর মুখ দেখে ভয়ে এক দৌড়ে পালায় লাঙ্গল-লাঠি পানা পুকুরে ফেলে দিয়ে।

সাবুর বসন্ত রোগটা যেন ছায়াছবির থিম মিউজিক, বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে ঘুরেফিরে হাজির হয়। যেমন ছোটবেলায় এ রোগ যদি তার হয়ে থাকে, সেই কাহিনীতেই একজন চাষামতো লোক থাকবে। যার বাপের নাম তারা মিয়া, নিজের নাম মজনু মিয়া। সে সাবুকে গাঁয়ের চারদিকে এলোপাতারি ঘুরতে দেখে ভাবে, এ এক বাউন্ডুলে নারী। স্বামীর বাইত থাইক্যা বিহানবেলা পলাই আসছে। এহন কোন পথে বাইত যাইতে অইবো – ধারণা নাই। তাকে বাগে আনার জন্য সে বিড়ালের ইঁদুর ধরার মতো তক্কে তক্কে থাকে। এদিকে সাবুর মুখটা বসন্তের দাগে ভরা, কুৎসিত। স্বামীর বাড়ি থেকে বিয়ের রাতে তাড়িয়ে দিলে লজ্জায় ঘেন্নায় ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে সে পথে পথে ঘোরে। বাড়ি ফেরার পথ তার চেনা আছে ঠিকই, তবে যে বাপ-ভাইয়ের চিটিংয়ের জন্য সে আজ রাস্তায়, তাদের কাছে ফিরতে তার রুচি হয় না। তখন ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে দেখে এক লোক, যার চোখ দুটি ইঁদুর-শিকারি বিড়ালের মতো। তখন পুরুষটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর বড় সাধ জাগে তার মনে। এদিকে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে লোকটা বিড়ালের কেরামতির কথা ভুলে গিয়ে নারীর মুখ না দেখেই প্রেমে পড়ে। এ এমন এক প্রেম, বউ গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে নেওয়ার আগ পর্যন্ত সে কাঁঠালের আঠার মতো সেঁটে ছিল।

ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে শরাবন হাঁটে। চৈত্রের খাঁখাঁ দুপুর। চিরচিরিয়ে মাটি পুড়ছে। আকাশটা যেন গনগনে চুলার ওপর টগবগিয়ে ফোটা ভাতের ডেকচি, যা আবার আল্লাহতায়লা মাথার ওপর উপুড় করে ধরে আছেন পাপী-তাপীদের শাস্তি দেবার জন্যে। এ এলাকায় একটা গাছ থাকলেও বোঝা যেতো, এক ফোঁটাও যে বাতাস নেই, যাতে করে গাছের পাতা ঝিরঝির শব্দে নড়ে উঠতে পারে, ঝরা পাতা পায়ে পায়ে নাচতে পারে। কিন্ত্ত শরাবন না তাকিয়েও আন্দাজ করে, একটা লোক ছায়ার মতো তার পেছন পেছন হাঁটছে। এ নেহায়েত বোকামি যে, শরাবন রবার্টের বাড়ির নম্বর জানে না। অফিসে যাওয়ারও যো নেই। সেটি এক সময়ে ছিল শরাবনেরও অফিস। রবার্ট তুহিন রোজারিও তার প্রাক্তন বস। বেশিরভাগ সহকর্মী পূর্ব-পরিচিত। এমন জায়গায় যাবে সে কোন মুখে? সে রবার্টের বিবাহিত স্ত্রী না, আত্মীয়? এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো টগবগে ভাতের ডেকচি মাথায় করে হাশরের মাঠের দিকে ছুটতে ছুটতে!

মাথার এক হাত ওপর সূর্য যখন আসমান থেকে নেমে আসবে, তখন কোনো বিরিক্ষ থাকবে না আমজনতার মাথায় ছায়া দান করবার জইন্যে। তারা দুনিয়ার আত্মীয়দের খুঁজে বেড়াবে দুনিয়ার বাইরে এক আজব দুনিয়ায়। হাঁটতে হাঁটতে সাবুর চোখ ফেটে কান্না আসে – মাবুদ, হাশরের মাঠ কিমুন, আমি জানি না, তয় দুনিয়ায় তুমি আমারে তা দেহাই দিলা। দয়া করো পরওয়ার্দিগার, হের কাছে আমি জমি চাই না, টেকা-পয়সা চাই না, কালবসন্তে ধরলে যে দয়াল আত্মীয়-কুটুমরা ডাক্তার-কবিরাজ দিয়া চিকিৎসা করায় না, হেই দুঃখের কথাটা আমি তারে একবার ভেঙ্গে বলতে চাই।

কত কথা থাকে, লক্ষ লক্ষ কথা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গাছের পাতা আলো ঝিকিমিকি বাড়ি মেরে থামিয়ে দিলেও শরিফার কানে তা গুনগুন বাজে। কান্নার আড়ালে আমার মন মানে না, দেরি আর সয় না, সে ব্যাকুল হয়ে গায়। কান্নার পরও কিছু বাকি থাকে। বুক তোলপাড় করা কষ্টের নিশ্বাস যে বাতাসে মিলায়, তা-ও গতিছাড়া নয়। সেখানে তরঙ্গের পর তরঙ্গ ফোটে সাগরের ঢেউয়ের মতো। রবার্ট যে দু বছর আগে শরাবনকে অসুখী নারী বলেছিল এর জবাব তাকে দেয়া হয়নি। কে সুখী নারী? মিসেস মারিনা রোজারিও – রবার্টের স্ত্রী? যে পাঁচ বছরেও জানতে পারেনি, তার স্বামী টেনিস খেলতে দুপুরে বেরিয়ে কেন রাত করে বাড়ি ফেরে।

জ্ঞএমুন লাটিমের মতো যে ঘুরতেছেন, আপনে আসলে কারে খোঁজেন? তার বাড়ির নম্বর কত? নাম কি?ঞ্চ ছায়াটা এক টানে কথাগুলো বলে। শরাবন তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে, সে একজন বেকার যুবক। গায়ে ময়লা শার্ট, পরনের প্যান্ট ভাঁজ খাওয়া। হাতে যে মোবাইল ধরা আছে, যথাসময়ে বিল পরিশোধ করতে না-পারায় এর লাইন কাটা গেছে।

 সে যা-ই হোক, রবার্টের পরিচয় শরাবন কী দেবে? নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে লোকটা বলবে হয়তো, জ্ঞঅহ্ ডানিয়েলের আব্বা! চিনবো না আবার! এ এলাকায় খিরিস্টান ঘর তো গোনা একটা। ডানিয়েলের আব্বা রোজ শুক্রবার টেনিস খেলতে যায়। হ্যারে পাড়ার ছেলে-বুড়ো সব্বাই চিনে। লোকটার যা ফুটানি, খিরিস্টান তো! আপনে মুসলমান না? আমি কিন্ত্ত মুসলমান।ঞ্চ

পায়ে হেঁটে বাড়ি চিনতে সুবিধে। নেমপ্লেট ধীরে সুস্থে পড়ে এগোনো যায়। খ্রিষ্টানরা কবরের গায়ে নাম-ধাম, জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ লিখে রাখলেও বাড়ির নেমপ্লেটে হয়তো লেখা থাকবে মি: রবার্ট তুহিন রোজারিও অ্যান্ড মিসেস মারিনা রোজারিও। আর কিছু না। রোজারিও পরিবার আজ ছুটির দিনে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়েছে। সাহেবের হাই ব্লাডপ্রেসার ধরা পড়ার পর শুক্রবার তিনি আর টেনিস খেলতে যান না। ডাক্তারের নির্দেশে খেলাধুলা সব তার বন্ধ। মিসেস মারিনা রোজারিও এখন সার্বক্ষণিক স্বামীর দেখভাল করছেন। রবার্ট আড়চোখে তাকায় স্ত্রীর দিকে। বয়স চল্লিশও হয়নি, এরই মধ্যে কম্বলের মতো ভাঁজ পড়েছে পেটে। থুতনিটা ফোলা ব্যাঙের মতো। মুখে কালো কালো মেচেতার দাগ। সুস্থ হলেই স্ত্রীকে সে বলবে সপ্তাহে দুদিন অন্তত সোনারগাঁয়ে গিয়ে সুইমিং করতে। গায়ের ত্বক ফেরানোর জন্য দরকার কাঁচা হলুদ বাটায় অলিভওয়েল মিশিয়ে হালকা ম্যাসেজ। মেন্দির রস দিয়ে চুল রাঙানো তার আবশ্যক, তাতে সাদা চুল লালের তলে ঢাকা পড়ে। ডাক্তারও আশাবাদী- মি: রোজারিও প্রেসারের ওষুধ ছাড়াই আরোগ্য লাভ করবেন অচিরেই। কারণ অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে তার রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল, যা ক্ষণস্থায়ী।

রবার্টের শিয়রে বসে যে নারী এখন স্বামীর শুশ্রূষা করছে, শরাবন তার সাথে নিজের জীবন বদলাতে যে চায় না, তা ব্যাখ্যা করে না বললে দুনিয়ার বিবাহিত-অবিবাহিত কোনো পুরুষ বিশ্বাস করবে না। উপরন্ত্ত রবার্ট তাকে ভুল বুঝে বসে আছে। শরাবন অসুখী নারী। মিসেস রবার্ট সুখী। অসুখী মানুষ সুখী মানুষের সাথে জীবন অদল-বদল করতে তো চাইবেই, সুযোগ পাচ্ছে না তাই করছে না। এই ভেবে সে আরো অসুখী হচ্ছে। রবার্টের কথাটার মোক্ষম জবাব দিতে না পারলে শরাবন কবরে গিয়েও শান্তি পাবে না। পথে ঘুরতে ঘুরতে শেষবারের মতো রবার্টকে বলার অনেক কথাই তার রোদে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুকনো পাতার মতো কালো কালো ছাই বাতাসে ওড়ে।  

 রোজ ঘরে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শরাবন একটার পর একটা সিগারেট জ্বালায়। তখনো গলিপথের দিকে তার চোখ – যেদিক দিয়ে রবার্ট চলে গেছে, মন চাইলে সেই পথে আবার ফিরে আসতে পারে। রাত বাড়তে বাড়তে পাড়াটা যখন নিঃশব্দ আর নির্জন, তখন হাতে এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে সাবু ঘরে ঢোকে। দুজন পথশ্রান্ত নারী এবার মুখোমুখি। তাদের মাঝখানের সময় এক ক্ষিপ্ত নদী, দুকূল ভাসিয়ে চলে গেছে বহুদূর, দুই পাড়ের জনপদেরও আজ আর নাম-নিশানা নেই। তারা বাতাসে কান পেতে হারিয়ে যাওয়া মানুষের পদধ্বনি শোনে। শরাবন টলতে টলতে যখন বিছানায় যায়, সাবু তখনো জানালার পাশে। রাতের নিদ্রা যেন ছেঁড়া জাল, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে মাছের মতো অনায়াসে সাঁতার কাটে। অন্ধকারে জেগে উঠে ঘরে আর কেউ নেই মনে হলে শরাবন ভাবে, সাবু বাথরুমের কলের তলায় বসে জল খাচ্ছে। তার আধো ঘুম, আধো স্বপ্নে সাবু বাথরুম থেকে ফিরে এসে ফিসফিস করে বলে, জ্ঞতোমারে লইয়্যা আমি একটা রচনা লেখবো, গেরাম রচনা।ঞ্চ শরাবন হাতেম আলি স্যারের বেত খাওয়ার ভয় দেখালেও সে কথা শোনে না। স্লেট-পেন্সিল নিয়ে রচনা লিখতে বসে যায়। কাকের ছা বকের ছায়ের মতো তার হস্তাক্ষর। একটা শব্দ লিখতেই রাতের এক প্রহর পার। স্লেটে থুথু ছিটিয়ে আঁচল দিয়ে ঘষে ঘষে আবার সে লিখতে শুরু করে। শরাবন তা দেখে হাসে।

জ্ঞএ্যালো বোবা নাকি? কথা কয় না ক্যান? আবার দেখি মিটিমিটি হাসে!ঞ্চ লোকটা এমন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে যে, সে হয়তো রবার্টের ভাড়া করা গোয়েন্দা বা রিমান্ডের পুলিশ। গুপ্তঘাতকও হতে পারে। শরাবনকে বাড়াবাড়ি করতে দেখলে রবার্ট হয়তো তাকে গুম করে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে। খুন-খারাবি করে হলেও সংসারের পবিত্রতা রক্ষা করা এখন তার কর্তব্য। তবে লোকটা গোয়েন্দা, গুপ্তঘাতক বা রিমান্ডের পুলিশ যা-ই হোক, ভদ্রতার ধার ধারছে না। রবার্ট ভদ্রলোক ছিল। ভদ্রলোকেরা শরাবনের দুচক্ষের বিষ। সে লোকটাকে অভদ্র হতে দেয়। তার আশকারা পেয়ে লোকটা পেছন থেকে সামনে চলে আসে। তার গায়ের ঝাপটায় মাথা থেকে শরাবনের ওড়না খসে পড়ে। যদি বউ সাজো গো / আরো সুন্দর লাগবে গো – সিনেমার গান গাইতে গাইতে নায়ক এগিয়ে গেলে শরাবন চলার গতি কমিয়ে ফেলে। আশ্চর্য যে লোকটা নির্ভুলভাবে যাচ্ছে তার বাড়ির দিকে। সে জানে নাকি শরাবন কোথায় থাকে? তবে চেনার উপায় তার একটাই, যদি সে গত কয়েকদিন তাকে গোয়েন্দার মতো ফলো করে থেকে থাকে।

শরাবন নিজের বাড়ির বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই পথ বদল করে অন্য একটা গলিতে ঢোকে। একের পর এক ভুল পথে সে এগোয়। এগিয়ে-পিছিয়ে আরেকটা অচেনা গলিতে প্রবেশ করে। সাত সাতটি শুক্রবার পথে পথে ঘুরে অবশেষে সাবুর অভিযানের ফাঁদে পা দিয়েছে সে। পুরুষকে যাচাই করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। একটি গ্রাম এগারো দিনে এগারো বার প্রদক্ষিণ করে সাবু তার নাগরের মনের টান জহুরির মতো পরখ করেছিল। ভালোবাসা আর মাধ্যাকর্ষণের শক্তি কাছাকাছি। সাবু যেন বলতে চায়, বৃত্তটা ভেঙে যে বেরিয়ে যাবে, সে যতই প্রেমের ভাব করুক আসলে সে প্রেমিক না। তবে এ গোলকধাঁধায় যে পুরুষ একবার পা দিয়েছে তার আর নিস্তার নেই। ঘুরে ফিরে প্রেমিকার কাছে তাকে আসতেই হয়েছে। শরাবন পেছন ফিরে দেখে বেকার লোকটা নেই। মাধ্যাকর্ষণের বৃত্ত ভেঙে সে সটকে পড়েছে। সারাদিন পেছন পেছন ঘুরঘুর করলেও সে আসলে তার প্রেমিক ছিল না – সাবুর তরিকা অনুযায়ী। কিন্ত্ত কে এই সাবু? জনশ্রুতিতে এক ব্যর্থ নারী। যার স্বামী ছিল না, সন্তান ছিল না, সম্পদ ছিল না। যার বিষয়ে রচনা লিখে শরাবন মাধ্যমিকে কম নম্বর পেয়েছিল, উপরন্ত্ত পেয়েছিলো হাতেম আলি স্যারের বেত্রাঘাতে।

 যে চাষামতো লোকটা কাঁধের জোয়াল পানা পুকুরে ফেলে চলে গিয়েছিল, সে খানিক বাদে ফিরে আসে। ফিরে এসে বলে, জ্ঞবিডি গো, তুমি এ পানি খাইয়্যো না। খাইলে কলেরায় মরবা।ঞ্চ সাবু পানি খেতে খেতে বলে, জ্ঞনা আমি খাইমু খাইমু।ঞ্চ লোকটা যত মানা করে, সাবু ততো বেশি করে পানা পুকুরের পানি খায়। পানি খাওয়া শেষ করে সে পুকুরের পাড় বেয়ে তীরে ওঠে। লোকটাও তার পেছন পেছন ওঠে। চৈত্র মাসের রোদে মাথায় বায়ু চড়ে গেছে। সাবু যদিও তখন আর পানা পুকুরের পানি খাচ্ছে না, লোকটা ঘ্যানঘ্যান করে তাকে পানি খেতে বারণ করে। সাবুর তখন লোকটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর সাধ হয়। এবারও সে গাঁয়ের চারপাশে এগারো পাক ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে লোকটার কাঁধ থেকে জোয়াল খসে পড়ে, পাঁচনটা তার পানা পুকুরেই খোয়া গেছে, হালের বলদ দুটিকে সে পথে হারায়, অবশেষে হারিয়ে ফেলে নিজেকেই। সাবু পেছন ফিরে ছায়া দেখে, কোনো মানুষ দেখে না। তখন ভয়ে তার গা ছমছম করে। জ্ঞএ্যালো আর না, যথেষ্ট অইছেঞ্চ- সাবু বিরক্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরে। রাতে ঘরের দুয়ারে খচরমচর – এ হুলা বিলাইডা না হয় চোর। সাবু বটি হাতে দুয়ার খুলতেই হুলাটা মানুষের গলায় বলে ওঠে, জ্ঞআগো বিডি আমি, তুমি পানা পুকুরের পানি খাইয়্যো না গো। গেরামে কলেরা লাগছে।ঞ্চ সাবু বটি নামিয়ে জ্ঞনা, আমি খাইমু, খাইমুঞ্চ বলে লোকটাকে ঘরে তুলে নেয়।

শরাবন ঘরে ঢুকে জানালার ধারে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে কি ধরায়নি ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। বেলের সুইচ হুলো-বিড়ালের নাগালের বাইরে। তার দুয়ারে যে, সে গুপ্তঘাতক, গোয়েন্দা, রিমান্ডের পুলিশ কি যা-ই হোক – বিড়াল না, মানুষ। দরজা খুলতেই মানুষটা জিজ্ঞেস করে, আপনে সারাদিন কারে খোঁজেন?

জ্ঞকাউরে না।ঞ্চ শরাবন মানুষটাকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয়।

এ-ও কলমা পড়ে তার স্বামী হয় না। তবে এবার সাবু বনের হরিণীর মতো সতর্ক। প্রথমবারের ভুল সে আর দ্বিতীয়বার করে না। লোকটাকে নিয়ে কাকপক্ষীর অগোচরে উঠে যায় ধান-পাটক্ষেতের শেষপ্রান্তের ছাড়াবাড়িতে। তারপর থেকে সে সকাল সকাল ভিনগাঁয়ে চলে যেতো ভিক্ষা করতে আর লোকটা পাহারা দিতো তার ঘরবাড়ি। সে ছিল কালোছায়ার মতো। তাই গাঁয়ের লোকেরা চেষ্টা করেও তাকে কোনোদিন ধরতে পারেনি। এভাবে থাকতে থাকতে যৌবনশেষে তারা একদিন বৃদ্ধ হলো। তারপর লোকটা হঠাৎ মারা গেল কলেরা হয়ে। গাঁয়ের বারোয়ারি গোরস্তানের ছাদনাতলায় যার কবর, সে সাবুর দ্বিতীয় নাগর। ক্ষ

নিজের কাঁধ থেকে রাখা অন্যের জিনিসপত্র। ততোক্ষণে মেজ চাচি দিশেহারা। তার বৃদ্ধ বাপের হজ করে ফিরতে তিনমাস লেগেছিল, তা-ও ঝোলায় করে এক বোতল জমজম কূপের পানি আর কয়েকটা শুকনো খোরমা খেজুর ছাড়া তিনি কিছুই আনতে পারেননি। অথচ তার ছেলেরা মাত্র দুই দিনে রাজ্যের জিনিসপত্র নিয়ে সেই একই দেশ থেকে চলে আসলো কীভাবে! তাতে কেয়ামতের আলামত ছাড়া চাচি ভালো কিছু দেখতে পেলেন না। কিন্ত্ত যতদিন না পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে, ততোদিন তো মানুষের অন্নের সংস্থান করতে হবে। অথচ ছেলেদের পাতে দেবার মতো ঘরে কোনো খাবারই নেই। এক পুত্রের তদারকিতে তিনি তড়িঘড়ি প্রেসার কুকারে মাংস চড়ালেন। মাংসের খুশবু ছোটার আগেই রান্নাঘরের হুইসেল শুনে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মেজ চাচা মুচকি হেসে টাকার বদলে দিরহাম ভাঙিয়ে বাজার করতে ছুটলেন। তাতেও তার তৃপ্তি হচ্ছিল না। বেহেস্তের শান-শওকত কপালগুণে জিন্দেগিতেও যে ভোগ করা সম্ভব, তা দেখানোর জন্যে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া লতায়-পাতায় জড়ানো সেসব আত্মীয়দের তিনি জড়ো করতে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন, যারা তাকে দিনের পর অচেনা বোনেরা হাতে অঢেল সময় পেয়ে সাবুর কাহিনীর ডালপালায় বিচরণ শুরু করে। শরিফার প্রতি কারো খেয়াল নেই। মেজ চাচার লাঠির ঘায়ে জ্ঞগাছের পাতা আলোর ঝিকিমিকি … আমার মন মানে না/ দেরি আর সয় নাঞ্চ গান থেমে যেতেই বেচারি ডুকরে কেঁদে উঠলো। হাতের মেন্দির আলপনা, গায়ের হলুদ-মেথির ঝাঁঝালো ঘ্রাণ সব বৃথা। যার জন্য এতসব, তার দেখা নেই। কাঁদতে কাঁদতে শরিফা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর বাকি আধখানা রাতে তার জীবনে যা যা ঘটে, তা তা স্বপ্নের চেয়েও অবিশ্বাস্য। তাকে দুবাই মার্কেটের বালা-চুড়ি, বাজুবন্দ, কণ্ঠহার, কানের দুল, টিকলি-টায়রা, হীরের নাকফুল দিয়ে সাজানো হলো। বিয়ে পড়াতে আসা কাজী সাহেবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সে কবুল বললো। আয়নায় অদেখা পুরুষটির মুখ দেখলো নিজের ঝলমলে অচেনা মুখের পাশে। সে তাকে চামচে করে মিষ্টি খাওয়ালো। ভোর হওয়ার আগেই ঘরে বর-বউ রেখে সবাই চলে যাওয়ার পর, লোকটা ঠোঁটে চুমু খেতে বাধা পেয়ে ব্লাউজের ওপর দিয়ে স্তন দুটি তার মোচড়ালো। তারপর শেরওয়ানির হাতা গুটিয়ে শাড়ির কুচির ভেতর দিয়ে প্রথমে আঙুল ও পরে শক্ত জিনিসটা ঢুকিয়ে দিলো তার গোপন অঙ্গে। পরদিন ছোপ ছোপ রত্ত্কের আলপনা আঁকা সাদা চাদর – যা পতাকার মতো পবিত্র, উঠোনের তারে পতপত করে উড়ছিল।

রবার্ট কাঁচা হলুদ আর মেন্দির ঝাঁঝালো ঘ্রাণে উত্থিত হয়। পাঁচ বছর ধরে তাদের সম্পর্ক, দিনদুপুরে উদোম হতে শরাবনের এখনো আপত্তি। রবার্ট আজকাল আর জোরাজুরি করে না, তবু কপট রাগে বলে, চাচাতো বোনের বিয়েতে গিয়ে তুমি আরো গাঁইয়্যা হয়ে ফিরেছো। এ শুধু বলার জন্য। মুখ বুঁজে শরীর নাড়াচাড়া অসভ্যতা হয়। কিন্ত্ত শরাবন আজ হাঁটু দিয়ে রবার্টের কোমর জড়ানোর সময় কথাটাও পেঁচিয়ে ধরে। তারপর কথার পিঠে কথা চড়ে। তারা জামাকাপড় পরা থাকলেও, তাদের এতোদিনের না-বলা কথাগুলো উলঙ্গ হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে-

রবার্ট কি বউয়ের সাথেও ঠিক এভাবে যৌনত্র্কিয়া করে? হ্যাঁ ঠিক এইভাবে। কাপড় খোলা না-খোলা সমান। এছাড়া ছোট ছেলেটা চার বছরের হলেও মা-বাবার সাথে এখনো এক খাটে ঘুমায়। বিছানায় পেসাব করে, রাতে তিন বার জেগে ওঠে। রবার্ট আর তার স্ত্রী সপ্তাহে কবার যৌনত্র্কিয়া করে? তিন থেকে চার বার। আর শরাবনের সাথে শোয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, বউকে মিথ্যা বলতে হয়। উভয়ের সাথে যৌনত্র্কিয়ায় রবার্ট কি সমান আনন্দ পায়? একদম সমান সমান। বেশিও নয় কমও নয়। চার জন নারীর সাথে এক এবং অভিন্ন আচরণ করার মতো মুসলমান ধর্মমতে সে একজন আদর্শ পুরুষ। যদিও রবার্ট তুহিন রোজারিও জন্মসূত্রে একজন খ্রিষ্টান। শরাবন হাঁটুর এক ধাক্কায় রবার্টকে ফেলে দিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। দুঃখে-অপমানে সে তখন দিশেহারা। মেক্সির বোতামগুলো যে লাগানো হয়নি, সেদিকে তার খেয়াল নেই। স্পষ্ট দিবালোকে চোখের ওপর পর্দানসীন নারীর আধখোলা বুক, অথচ তা থেকে সরে গিয়ে তার অগ্নিমূর্তি শুধু পুরুষটির নজরে পড়ে। তারপর সে দেখতে পায় খোলা দরজাটা। রবার্ট বিছানা থেকে নেমে ধীরে সুস্থে আন্ডারওয়ারের ওপর টেনিস স্যুট চাপায়। ম্যাচ বাক্স ঠুকে ঠুকে সিগারেট ধরায়। তারপর একগাল ধোঁয়া ছেড়ে খোলা দরজা ডিঙ্গিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে যায়।

সাবুর নাগরকে বাড়ি এসে বউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যতই খা-ান্নি হোক, নারী তো! শরাবনের সম্পর্কে বোন হলেও বয়সের দিক দিয়ে যে মেজ চাচির সমান, সেই জৈতুন বিবির ভাষ্যমতে, সেদিন সাবুদের উঠোনে হেমায়েতপুর গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছিল। বাড়িতে লোক আর ধরে না। মানুষের পাড়ায় বাড়ির পাশের চষা ক্ষেতগুলো সমান হয়ে যায়। মাটিতে মানুষ, গাছের ডালে মানুষ। গরুর দড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নাগর গোয়াল ঘরে বন্দি হলো। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শত কণ্ঠে চিৎকার করছে তার বউ। সাবুর নামে দুই বিঘে জমি লিখে দিয়ে তবে স্বামী-স্ত্রী সেদিন হেমায়েতপুরের গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছিল। অথচ এখন শরাবন জানালার পাশে দাঁড়ালে দেখতে পেতো, স্ত্রীর কাছে রবার্টের স্বেচ্ছায় অবাধ প্রত্যাবর্তন। শুধু রাস্তার এক নেড়ি কুকুর লেজ নেড়ে নেড়ে তোষামোদী ভঙ্গিতে তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে এ গলিতে যার বিচরণ, সেই পুরুষটিকে যে করেই হোক সে ফিরিয়ে আনবে – এই তার অভিপ্রায়। শরাবন মেঝেতে দাঁড়ানো প্রস্তরমূর্তি। রবার্ট পেছন ঘুরে কুকুরটিকে একবার তাড়া দিয়েই গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একদিন যায়, দুদিন যায়, এভাবে সপ্তাহ ঘুরে গেছে। শুক্রবারের টেনিস স্যুট পড়ে রবার্ট তুহিন রোজারিও আর আসে না। অপেক্ষা করতে করতে শরাবনের গায়ে জ্বর ওঠে। গুটি বসন্ত দেশ থেকে উজাড় হয়ে গেছে। তা-না হলে তার বসন্তই হতো। খালি বাড়ি, মুখে পথ্য তুলে দেওয়ার লোক নেই। হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে সে বাথরুমের কলের নিচে বসে মুখ হাঁ করে ট্যাপের পানি খায়। নিজের মাথায় নিজে পানি ঢালে। কপালে জলপট্টি দেয়। এভাবে নিজের শুশ্রূষা নিজে করে, ট্যাপের পানি খেয়ে খেয়ে শরাবন এক সপ্তাহ বেঁচে রইলো। এবার রবার্টকে তার খোঁজার পালা।

মুখে দগদগে বসন্তের ঘা নিয়ে এক নারী গাঁয়ের পথে ঘুরে বেড়ায়। শাড়ির আঁচলে তার মুখম-ল ঢাকা। কঠিন অসুখের ফলে পা দুটি দুর্বল। ফাল্গুন-চৈত্র মাস। মাতালের মতো টলোমলো পায়ে সে হাঁটে। গাছের শুকনো ঝরাপাতা উড়ে তার পায়ে পায়ে। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফাটার উপক্রম হয়। সে পানা পুকুরের তলায় নেমে আঁজলা ভরে পানি খায়। তীরে চাষামতো এক লোক। কাঁধে লাঙ্গল। হাতে গরু হাঁকানোর পাঁচন। জ্ঞকে গো তুমি? কোন গেরামে বাড়ি? বাপের নাম কি?ঞ্চ সাবু নিচ থেকে যার গলা শোনে, তাকে মধ্য দুপুরের রোদের বিপরীতে ছায়ার মতো কালো দেখায়। কালো ছায়ার সাথে আবার কথা কি। সাবুর হাত দুটি ফের ঠান্ডা পানি মুখের কাছে তোলে। জ্ঞপচা পানি খাইয়্যো না গো বিডি। খাইলে মরবা। এ গাঁয়ে কলেরা লাগছে।ঞ্চ বলতে বলতে লোকটা তীর বেয়ে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে আসে। সাবু মুখের ওপর লম্বা করে ঘোমটা দেয়। তারপর কথাবার্তা সে যা বলে সব কাপড়ের তলা থেকে। লোকটা কয়েক বিঘত দূরে থাকতে সে বলে, জ্ঞবাবা আমার বসন্ত অইছিল। এ বড় কঠিন রোগ গো বাজান। এ ধরলে পর যমে-মানুষে টানাটানি …ঞ্চ কথার মাঝখানে আঁচল সরে গিয়ে তার কুৎসিত মুখটা বেরিয়ে পড়ে। যা দেখে লোকটা পানা পুকুরে লাঙ্গল-লাঠি ফেলে দে দৌড়।

আরেক বয়ানে আছে, সাবু লোকটাকে বলে, জ্ঞএ গেরামের নাম কি বাজান? আমি অশিখ্যিত মানুষ, বাপে নেহাপড়া হিকায় নাই। এইহানো কি তারা মিয়ার পোলা মজনু মিয়ার বাড়ি?ঞ্চ তারা মিয়া নামে পাঁচজন লোক আছে এই গ্রামে। তাদের তিনজনের ছেলের নাম মজনু মিয়া। কোন মজনু মিয়ার কথা ভিনগাঁয়ের বিডি জানতে চায়, যার বাপের নাম তারা মিয়া? সাবুর মুখে কথা সরে না। হেমায়েতপুর গাঁয়ে যে দেওয়ানা হয়ে চলে গিয়েছিল

এক পথভোলা নারীর পাছে পাছে, তারপর স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকলেও কলমা পড়ে যার সাথে তার শাদি হয় নাই, সেই পুরুষ মানুষটার খোঁজখবর করতে আসতে পারে এমন এক নারী, যে তার স্ত্রী নয়? এ এমন এক ঘোরেল প্যাঁচ, যার টানে মাথার ঘোমটা আপনা থেকেই খসে পড়ে। মুখ ফুটে বলতে হয় না, জ্ঞহে বাপ আমার বসন্ত অইছিল। আমি কলেরারে ডরাই না। আমারে পেড ভইর্যা পানা পুকুরের পানি খাইতে দেও।ঞ্চ লোকটা নারীর মুখ দেখে ভয়ে এক দৌড়ে পালায় লাঙ্গল-লাঠি পানা পুকুরে ফেলে দিয়ে।

সাবুর বসন্ত রোগটা যেন ছায়াছবির থিম মিউজিক, বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে ঘুরেফিরে হাজির হয়। যেমন ছোটবেলায় এ রোগ যদি তার হয়ে থাকে, সেই কাহিনীতেই একজন চাষামতো লোক থাকবে। যার বাপের নাম তারা মিয়া, নিজের নাম মজনু মিয়া। সে সাবুকে গাঁয়ের চারদিকে এলোপাতারি ঘুরতে দেখে ভাবে, এ এক বাউন্ডুলে নারী। স্বামীর বাইত থাইক্যা বিহানবেলা পলাই আসছে। এহন কোন পথে বাইত যাইতে অইবো – ধারণা নাই। তাকে বাগে আনার জন্য সে বিড়ালের ইঁদুর ধরার মতো তক্কে তক্কে থাকে। এদিকে সাবুর মুখটা বসন্তের দাগে ভরা, কুৎসিত। স্বামীর বাড়ি থেকে বিয়ের রাতে তাড়িয়ে দিলে লজ্জায় ঘেন্নায় ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে সে পথে পথে ঘোরে। বাড়ি ফেরার পথ তার চেনা আছে ঠিকই, তবে যে বাপ-ভাইয়ের চিটিংয়ের জন্য সে আজ রাস্তায়, তাদের কাছে ফিরতে তার রুচি হয় না। তখন ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে দেখে এক লোক, যার চোখ দুটি ইঁদুর-শিকারি বিড়ালের মতো। তখন পুরুষটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর বড় সাধ জাগে তার মনে। এদিকে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে লোকটা বিড়ালের কেরামতির কথা ভুলে গিয়ে নারীর মুখ না দেখেই প্রেমে পড়ে। এ এমন এক প্রেম, বউ গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে নেওয়ার আগ পর্যন্ত সে কাঁঠালের আঠার মতো সেঁটে ছিল।

ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে শরাবন হাঁটে। চৈত্রের খাঁখাঁ দুপুর। চিরচিরিয়ে মাটি পুড়ছে। আকাশটা যেন গনগনে চুলার ওপর টগবগিয়ে ফোটা ভাতের ডেকচি, যা আবার আল্লাহতায়লা মাথার ওপর উপুড় করে ধরে আছেন পাপী-তাপীদের শাস্তি দেবার জন্যে। এ এলাকায় একটা গাছ থাকলেও বোঝা যেতো, এক ফোঁটাও যে বাতাস নেই, যাতে করে গাছের পাতা ঝিরঝির শব্দে নড়ে উঠতে পারে, ঝরা পাতা পায়ে পায়ে নাচতে পারে। কিন্ত্ত শরাবন না তাকিয়েও আন্দাজ করে, একটা লোক ছায়ার মতো তার পেছন পেছন হাঁটছে। এ নেহায়েত বোকামি যে, শরাবন রবার্টের বাড়ির নম্বর জানে না। অফিসে যাওয়ারও যো নেই। সেটি এক সময়ে ছিল শরাবনেরও অফিস। রবার্ট তুহিন রোজারিও তার প্রাক্তন বস। বেশিরভাগ সহকর্মী পূর্ব-পরিচিত। এমন জায়গায় যাবে সে কোন মুখে? সে রবার্টের বিবাহিত স্ত্রী না, আত্মীয়? এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো টগবগে ভাতের ডেকচি মাথায় করে হাশরের মাঠের দিকে ছুটতে ছুটতে!

মাথার এক হাত ওপর সূর্য যখন আসমান থেকে নেমে আসবে, তখন কোনো বিরিক্ষ থাকবে না আমজনতার মাথায় ছায়া দান করবার জইন্যে। তারা দুনিয়ার আত্মীয়দের খুঁজে বেড়াবে দুনিয়ার বাইরে এক আজব দুনিয়ায়। হাঁটতে হাঁটতে সাবুর চোখ ফেটে কান্না আসে – মাবুদ, হাশরের মাঠ কিমুন, আমি জানি না, তয় দুনিয়ায় তুমি আমারে তা দেহাই দিলা। দয়া করো পরওয়ার্দিগার, হের কাছে আমি জমি চাই না, টেকা-পয়সা চাই না, কালবসন্তে ধরলে যে দয়াল আত্মীয়-কুটুমরা ডাক্তার-কবিরাজ দিয়া চিকিৎসা করায় না, হেই দুঃখের কথাটা আমি তারে একবার ভেঙ্গে বলতে চাই।

কত কথা থাকে, লক্ষ লক্ষ কথা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গাছের পাতা আলো ঝিকিমিকি বাড়ি মেরে থামিয়ে দিলেও শরিফার কানে তা গুনগুন বাজে। কান্নার আড়ালে আমার মন মানে না, দেরি আর সয় না, সে ব্যাকুল হয়ে গায়। কান্নার পরও কিছু বাকি থাকে। বুক তোলপাড় করা কষ্টের নিশ্বাস যে বাতাসে মিলায়, তা-ও গতিছাড়া নয়। সেখানে তরঙ্গের পর তরঙ্গ ফোটে সাগরের ঢেউয়ের মতো। রবার্ট যে দু বছর আগে শরাবনকে অসুখী নারী বলেছিল এর জবাব তাকে দেয়া হয়নি। কে সুখী নারী? মিসেস মারিনা রোজারিও – রবার্টের স্ত্রী? যে পাঁচ বছরেও জানতে পারেনি, তার স্বামী টেনিস খেলতে দুপুরে বেরিয়ে কেন রাত করে বাড়ি ফেরে।

জ্ঞএমুন লাটিমের মতো যে ঘুরতেছেন, আপনে আসলে কারে খোঁজেন? তার বাড়ির নম্বর কত? নাম কি?ঞ্চ ছায়াটা এক টানে কথাগুলো বলে। শরাবন তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে, সে একজন বেকার যুবক। গায়ে ময়লা শার্ট, পরনের প্যান্ট ভাঁজ খাওয়া। হাতে যে মোবাইল ধরা আছে, যথাসময়ে বিল পরিশোধ করতে না-পারায় এর লাইন কাটা গেছে।

 সে যা-ই হোক, রবার্টের পরিচয় শরাবন কী দেবে? নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে লোকটা বলবে হয়তো, জ্ঞঅহ্ ডানিয়েলের আব্বা! চিনবো না আবার! এ এলাকায় খিরিস্টান ঘর তো গোনা একটা। ডানিয়েলের আব্বা রোজ শুক্রবার টেনিস খেলতে যায়। হ্যারে পাড়ার ছেলে-বুড়ো সব্বাই চিনে। লোকটার যা ফুটানি, খিরিস্টান তো! আপনে মুসলমান না? আমি কিন্ত্ত মুসলমান।ঞ্চ

পায়ে হেঁটে বাড়ি চিনতে সুবিধে। নেমপ্লেট ধীরে সুস্থে পড়ে এগোনো যায়। খ্রিষ্টানরা কবরের গায়ে নাম-ধাম, জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ লিখে রাখলেও বাড়ির নেমপ্লেটে হয়তো লেখা থাকবে মি: রবার্ট তুহিন রোজারিও অ্যান্ড মিসেস মারিনা রোজারিও। আর কিছু না। রোজারিও পরিবার আজ ছুটির দিনে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়েছে। সাহেবের হাই ব্লাডপ্রেসার ধরা পড়ার পর শুক্রবার তিনি আর টেনিস খেলতে যান না। ডাক্তারের নির্দেশে খেলাধুলা সব তার বন্ধ। মিসেস মারিনা রোজারিও এখন সার্বক্ষণিক স্বামীর দেখভাল করছেন। রবার্ট আড়চোখে তাকায় স্ত্রীর দিকে। বয়স চল্লিশও হয়নি, এরই মধ্যে কম্বলের মতো ভাঁজ পড়েছে পেটে। থুতনিটা ফোলা ব্যাঙের মতো। মুখে কালো কালো মেচেতার দাগ। সুস্থ হলেই স্ত্রীকে সে বলবে সপ্তাহে দুদিন অন্তত সোনারগাঁয়ে গিয়ে সুইমিং করতে। গায়ের ত্বক ফেরানোর জন্য দরকার কাঁচা হলুদ বাটায় অলিভওয়েল মিশিয়ে হালকা ম্যাসেজ। মেন্দির রস দিয়ে চুল রাঙানো তার আবশ্যক, তাতে সাদা চুল লালের তলে ঢাকা পড়ে। ডাক্তারও আশাবাদী- মি: রোজারিও প্রেসারের ওষুধ ছাড়াই আরোগ্য লাভ করবেন অচিরেই। কারণ অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে তার রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল, যা ক্ষণস্থায়ী।

রবার্টের শিয়রে বসে যে নারী এখন স্বামীর শুশ্রূষা করছে, শরাবন তার সাথে নিজের জীবন বদলাতে যে চায় না, তা ব্যাখ্যা করে না বললে দুনিয়ার বিবাহিত-অবিবাহিত কোনো পুরুষ বিশ্বাস করবে না। উপরন্ত্ত রবার্ট তাকে ভুল বুঝে বসে আছে। শরাবন অসুখী নারী। মিসেস রবার্ট সুখী। অসুখী মানুষ সুখী মানুষের সাথে জীবন অদল-বদল করতে তো চাইবেই, সুযোগ পাচ্ছে না তাই করছে না। এই ভেবে সে আরো অসুখী হচ্ছে। রবার্টের কথাটার মোক্ষম জবাব দিতে না পারলে শরাবন কবরে গিয়েও শান্তি পাবে না। পথে ঘুরতে ঘুরতে শেষবারের মতো রবার্টকে বলার অনেক কথাই তার রোদে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুকনো পাতার মতো কালো কালো ছাই বাতাসে ওড়ে।  

 রোজ ঘরে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শরাবন একটার পর একটা সিগারেট জ্বালায়। তখনো গলিপথের দিকে তার চোখ – যেদিক দিয়ে রবার্ট চলে গেছে, মন চাইলে সেই পথে আবার ফিরে আসতে পারে। রাত বাড়তে বাড়তে পাড়াটা যখন নিঃশব্দ আর নির্জন, তখন হাতে এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে সাবু ঘরে ঢোকে। দুজন পথশ্রান্ত নারী এবার মুখোমুখি। তাদের মাঝখানের সময় এক ক্ষিপ্ত নদী, দুকূল ভাসিয়ে চলে গেছে বহুদূর, দুই পাড়ের জনপদেরও আজ আর নাম-নিশানা নেই। তারা বাতাসে কান পেতে হারিয়ে যাওয়া মানুষের পদধ্বনি শোনে। শরাবন টলতে টলতে যখন বিছানায় যায়, সাবু তখনো জানালার পাশে। রাতের নিদ্রা যেন ছেঁড়া জাল, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে মাছের মতো অনায়াসে সাঁতার কাটে। অন্ধকারে জেগে উঠে ঘরে আর কেউ নেই মনে হলে শরাবন ভাবে, সাবু বাথরুমের কলের তলায় বসে জল খাচ্ছে। তার আধো ঘুম, আধো স্বপ্নে সাবু বাথরুম থেকে ফিরে এসে ফিসফিস করে বলে, জ্ঞতোমারে লইয়্যা আমি একটা রচনা লেখবো, গেরাম রচনা।ঞ্চ শরাবন হাতেম আলি স্যারের বেত খাওয়ার ভয় দেখালেও সে কথা শোনে না। স্লেট-পেন্সিল নিয়ে রচনা লিখতে বসে যায়। কাকের ছা বকের ছায়ের মতো তার হস্তাক্ষর। একটা শব্দ লিখতেই রাতের এক প্রহর পার। স্লেটে থুথু ছিটিয়ে আঁচল দিয়ে ঘষে ঘষে আবার সে লিখতে শুরু করে। শরাবন তা দেখে হাসে।

জ্ঞএ্যালো বোবা নাকি? কথা কয় না ক্যান? আবার দেখি মিটিমিটি হাসে!ঞ্চ লোকটা এমন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে যে, সে হয়তো রবার্টের ভাড়া করা গোয়েন্দা বা রিমান্ডের পুলিশ। গুপ্তঘাতকও হতে পারে। শরাবনকে বাড়াবাড়ি করতে দেখলে রবার্ট হয়তো তাকে গুম করে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে। খুন-খারাবি করে হলেও সংসারের পবিত্রতা রক্ষা করা এখন তার কর্তব্য। তবে লোকটা গোয়েন্দা, গুপ্তঘাতক বা রিমান্ডের পুলিশ যা-ই হোক, ভদ্রতার ধার ধারছে না। রবার্ট ভদ্রলোক ছিল। ভদ্রলোকেরা শরাবনের দুচক্ষের বিষ। সে লোকটাকে অভদ্র হতে দেয়। তার আশকারা পেয়ে লোকটা পেছন থেকে সামনে চলে আসে। তার গায়ের ঝাপটায় মাথা থেকে শরাবনের ওড়না খসে পড়ে। যদি বউ সাজো গো / আরো সুন্দর লাগবে গো – সিনেমার গান গাইতে গাইতে নায়ক এগিয়ে গেলে শরাবন চলার গতি কমিয়ে ফেলে। আশ্চর্য যে লোকটা নির্ভুলভাবে যাচ্ছে তার বাড়ির দিকে। সে জানে নাকি শরাবন কোথায় থাকে? তবে চেনার উপায় তার একটাই, যদি সে গত কয়েকদিন তাকে গোয়েন্দার মতো ফলো করে থেকে থাকে।

শরাবন নিজের বাড়ির বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই পথ বদল করে অন্য একটা গলিতে ঢোকে। একের পর এক ভুল পথে সে এগোয়। এগিয়ে-পিছিয়ে আরেকটা অচেনা গলিতে প্রবেশ করে। সাত সাতটি শুক্রবার পথে পথে ঘুরে অবশেষে সাবুর অভিযানের ফাঁদে পা দিয়েছে সে। পুরুষকে যাচাই করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। একটি গ্রাম এগারো দিনে এগারো বার প্রদক্ষিণ করে সাবু তার নাগরের মনের টান জহুরির মতো পরখ করেছিল। ভালোবাসা আর মাধ্যাকর্ষণের শক্তি কাছাকাছি। সাবু যেন বলতে চায়, বৃত্তটা ভেঙে যে বেরিয়ে যাবে, সে যতই প্রেমের ভাব করুক আসলে সে প্রেমিক না। তবে এ গোলকধাঁধায় যে পুরুষ একবার পা দিয়েছে তার আর নিস্তার নেই। ঘুরে ফিরে প্রেমিকার কাছে তাকে আসতেই হয়েছে। শরাবন পেছন ফিরে দেখে বেকার লোকটা নেই। মাধ্যাকর্ষণের বৃত্ত ভেঙে সে সটকে পড়েছে। সারাদিন পেছন পেছন ঘুরঘুর করলেও সে আসলে তার প্রেমিক ছিল না – সাবুর তরিকা অনুযায়ী। কিন্ত্ত কে এই সাবু? জনশ্রুতিতে এক ব্যর্থ নারী। যার স্বামী ছিল না, সন্তান ছিল না, সম্পদ ছিল না। যার বিষয়ে রচনা লিখে শরাবন মাধ্যমিকে কম নম্বর পেয়েছিল, উপরন্ত্ত পেয়েছিলো হাতেম আলি স্যারের বেত্রাঘাতে।

 যে চাষামতো লোকটা কাঁধের জোয়াল পানা পুকুরে ফেলে চলে গিয়েছিল, সে খানিক বাদে ফিরে আসে। ফিরে এসে বলে, জ্ঞবিডি গো, তুমি এ পানি খাইয়্যো না। খাইলে কলেরায় মরবা।ঞ্চ সাবু পানি খেতে খেতে বলে, জ্ঞনা আমি খাইমু খাইমু।ঞ্চ লোকটা যত মানা করে, সাবু ততো বেশি করে পানা পুকুরের পানি খায়। পানি খাওয়া শেষ করে সে পুকুরের পাড় বেয়ে তীরে ওঠে। লোকটাও তার পেছন পেছন ওঠে। চৈত্র মাসের রোদে মাথায় বায়ু চড়ে গেছে। সাবু যদিও তখন আর পানা পুকুরের পানি খাচ্ছে না, লোকটা ঘ্যানঘ্যান করে তাকে পানি খেতে বারণ করে। সাবুর তখন লোকটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর সাধ হয়। এবারও সে গাঁয়ের চারপাশে এগারো পাক ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে লোকটার কাঁধ থেকে জোয়াল খসে পড়ে, পাঁচনটা তার পানা পুকুরেই খোয়া গেছে, হালের বলদ দুটিকে সে পথে হারায়, অবশেষে হারিয়ে ফেলে নিজেকেই। সাবু পেছন ফিরে ছায়া দেখে, কোনো মানুষ দেখে না। তখন ভয়ে তার গা ছমছম করে। জ্ঞএ্যালো আর না, যথেষ্ট অইছেঞ্চ- সাবু বিরক্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরে। রাতে ঘরের দুয়ারে খচরমচর – এ হুলা বিলাইডা না হয় চোর। সাবু বটি হাতে দুয়ার খুলতেই হুলাটা মানুষের গলায় বলে ওঠে, জ্ঞআগো বিডি আমি, তুমি পানা পুকুরের পানি খাইয়্যো না গো। গেরামে কলেরা লাগছে।ঞ্চ সাবু বটি নামিয়ে জ্ঞনা, আমি খাইমু, খাইমুঞ্চ বলে লোকটাকে ঘরে তুলে নেয়।

শরাবন ঘরে ঢুকে জানালার ধারে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে কি ধরায়নি ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। বেলের সুইচ হুলো-বিড়ালের নাগালের বাইরে। তার দুয়ারে যে, সে গুপ্তঘাতক, গোয়েন্দা, রিমান্ডের পুলিশ কি যা-ই হোক – বিড়াল না, মানুষ। দরজা খুলতেই মানুষটা জিজ্ঞেস করে, আপনে সারাদিন কারে খোঁজেন?

জ্ঞকাউরে না।ঞ্চ শরাবন মানুষটাকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয়। এ-ও কলমা পড়ে তার স্বামী হয় না। তবে এবার সাবু বনের হরিণীর মতো সতর্ক। প্রথমবারের ভুল সে আর দ্বিতীয়বার করে না। লোকটাকে নিয়ে কাকপক্ষীর অগোচরে উঠে যায় ধান-পাটক্ষেতের শেষপ্রান্তের ছাড়াবাড়িতে। তারপর থেকে সে সকাল সকাল ভিনগাঁয়ে চলে যেতো ভিক্ষা করতে আর লোকটা পাহারা দিতো তার ঘরবাড়ি। সে ছিল কালোছায়ার মতো। তাই গাঁয়ের লোকেরা চেষ্টা করেও তাকে কোনোদিন ধরতে পারেনি। এভাবে থাকতে থাকতে যৌবনশেষে তারা একদিন বৃদ্ধ হলো। তারপর লোকটা হঠাৎ মারা গেল কলেরা হয়ে। গাঁয়ের বারোয়ারি গোরস্তানের ছাদনাতলায় যার কবর, সে সাবুর দ্বিতীয় নাগর