ঘর ছাড়ার গান

কেরাসিন তো দ্যাশে মেলে না/ জামাই বিয়াই আইলে পরে/ সকাল করে খাওয়ায় তারে/ শুইতে নিয়া যায় উত্তরের ঘরে/ বলে, তাই তো, বাত্তি দিইতে পারলাম না/ কেরাসিন তো দ্যাশে মেলে না…

গান গেয়ে গেয়ে বাউলের দল আসে ভিক্ষা করতে। দেশের অবস্থা খারাপ। একদিকে স্বদেশি আন্দোলন। আরেকদিকে যুদ্ধ। কেরাসিনের মতোই অনেক জিনিস উধাও হয়ে গেছে বাজার থেকে। গেরস্তের ঘরে আলো বলতে রেড়ির তেলের প্রদীপ। নিত্যনতুন খবর গান হয়ে ফেরে বাউলদের মুখে মুখে।

চায়নার দাদারা কেউ স্বদেশি করে না। জ্ঞাতিদের একজন অবশ্য স্বদেশি হয়ে গ্রাম ছেড়েছে। তার খবর কেউ জানে না। তবে স্বদেশিদের ব্যবস্থাপনায় ছেলেদের কুস্তির আখড়া, মেয়েদের চরকা-কাটা এসব আছে।

চায়নার বড়দা, জ্যাঠামশাইয়ের বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় চাকরি করেন। সাহেবের মতো দেখতে। পোশাকও সাহেবদের মতোই। গড়গড় করে ইংরেজিতে কথা বলেন। সাহেব এবং সাহেবিয়ানা দুটোই তাঁর অতি প্রিয়। 

মেজদা, জ্যাঠামশাইয়ের মেজো ছেলে গ্র্যাজুয়েট। ব্যাংকে চাকরি করেন। আসানসোলে থাকেন।

চায়নার নিজের দাদা আইএ পাশ করে লেখাপড়া ছেড়ে এখন ব্যায়ামবীর। দেওঘরে রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে

ব্যায়াম-শিক্ষক।

দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। আইড়লের গ্রামের বাড়িতে এখন চায়না আর রেণুদির বিয়ের বাকি। গৌর-নিতাই যমজ ভাই – ইশকুলে পড়ে। ওদের মা, বাবা, জ্যাঠা আর জ্যাঠাইমা আছেন বাড়িতে। আর আছে বুড়ি পিসি।

একদিন কলকাতা থেকে বড়দা এলেন।  জানা গেল, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশ নাকি তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।

তাহলে কি বড়দা স্বদেশি হয়েছে?

মা-জ্যাঠাইমার কথা থেকে যেটুকু জানা গেল, মেধাবী ছাত্র, লেখাপড়া নিয়ে থেকেছে। চাকরি করছিল মন দিয়ে। ইংরেজদের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ছিল না। তাই বলে চোখের সামনে অন্যায় দেখে চুপ করে থাকার মানুষ সে নয়। রুখে উঠতেই এই বিপদ।

একটা লুকোচুরি খেলা শুরু হলো বাড়িতে। ফিসফিস করে কথা। বাইরের কেউ এলেই বাড়ির সীমানার বাইরে তাকে আটকে রাখতে হবে। জ্যাঠামশাই তো বাঘ! বারবাড়ির রোয়াকে বসে থাকেন। চোখ এড়িয়ে প্রাণীটিও উঠোন পেরোতে পারবে না।

বড়দা কিন্তু নিজের ঘরটির মধ্যেই থাকে সারাদিন। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমুখ দাড়ি, অবিন্যস্ত  চেহারায় কেমন যেন একটা কষ্ট মাখানো। তবু কী রূপবান! অবাক চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখে চায়না। আর কেউ এতটা সুন্দর নয়, ওদের ভাইবোনদের মধ্যে।

পুলিশ খুঁজছে বলেই এখানে লুকিয়ে রয়েছে বড়দা। কিন্তু ভয়ের লেশমাত্রও চেহারায় নেই। সবসময় যেন গভীর চিন্তামগ্ন। কেউ ডাকলে শুনতেই পায় না। জোরে ডাকলে বিরক্ত হয়।

চায়নার বাবা দোকান থেকে ফিরলে, মিটিং বসে বাড়িতে। বাবার সঙ্গে বড়দা আর জ্যাঠামশাই। তিনজনের মিটিং। আরো গম্ভীর আর চিন্তিত দেখায় বাবাকে। 

কিন্তু এখানেও নিরাপদে থাকতে পারল না বড়দা। লুকিয়ে বাড়ি ছাড়ল এক রাতে। আইড়লের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে গেল আসানসোলে, ভাইয়ের বাসায়। কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকেও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তখন আবার বাড়িতে কান্নাকাটি। কেউ বুঝতেই পারছে না, বড়দা কোথাও লুকিয়ে আছে, নাকি ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

শোকের কম্বল মুড়ে বিছানা নিল গোটা বাড়ি। কারো মুখে কথা নেই, হাসি নেই। রান্নাঘরে পা দেন না জ্যাঠাইমা। তবু সকলেরই মনে মনে আশা, হঠাৎ কোনোদিন হাজির হবে বড়দা। খুশিতে ঝলমলে করে উঠবে বাড়ি।

এরই মধ্যে গুজব ছড়াল, বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন নেতাজি। আগেও একবার এমন রটেছিল, এবারে তাই খবরটাকে গুরুত্ব দিলো না কেউ। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই খবর এলো গুজব নয়, সত্যিই নেতাজি আর নেই। কিন্তু একটা মানুষ
দু-দুবার কী করে প্লেন অ্যাক্সিডেন্ট করে – ভেবে পায় না চায়না। ওর মতোই অবাক গোটা গ্রাম। তাই কেউ বিশ্বাস করে না খবরটা। ভাবে, নেতাজি ফিরে আসবেন ঠিক। দৈবশক্তি আছে তাঁর।

বড়দার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে চায়নারাও।

বড়দা না এলেও তার চিঠি এলো একদিন। নিজের বাবা-মাকে লেখেনি, লিখেছে বন্ধু সুহৃদ খুড়োমশাইকে। জানিয়েছে, সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ছেড়েছে। চলে যাচ্ছে হিমালয়ের দিকে। আর ফিরবে না। এই খবর তার বাবা-মাকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।

এটা কী হলো? সাহেব থেকে স্বদেশি। তারপর একেবারে সন্ন্যাস! বড়দা কি তবে পালিয়ে গেল? বিশ্বাস করতে মন চায় না। তবে চিঠির নির্দেশ পালন করলেন চায়নার বাবা। খবর শুনেই বিছানা নিলেন জ্যাঠাইমা। মারাও গেলেন। 

জ্যাঠামশাইয়ের সব রাগ এসে পড়ল নিজের ভাইয়ের ওপর। কথা বন্ধ। বাড়ি ভাগ হয়ে গেল। আলাদা হেঁশেলে নিরামিষ খাওয়া শুরু করলেন জ্যাঠামশাই। রান্নার ভার নিতে ডাক পড়ল রেণুদির।

জ্যাঠা বললেন, আমার রান্না করবি। তোর মাপের ভাত আর একখান তরকারি তোর জন্য বরাদ্দ।

তরকারি মানে ভালো কিছু নয়। জ্যাঠা বলেন, কপির তরকারি সবডা আমারে দিবি। তুই খাবি শিমরামুঠি দিয়া।

রান্না রেণুদিও বিশেষ শেখেনি। পিসিকে জিজ্ঞেস করে করে, করে। চাখতে ডাকে চায়নাকে। কিন্তু চায়নাকে ঘেঁষতে দেখলেই তেড়ে আসেন জ্যাঠামশাই।  আমারে ডাকবি। আমি দ্যাখব।

খাওয়া বেড়ে গেল জ্যাঠার। নিরামিষ, কিন্তু পাঁচপদ চাই। তেল-ঘি-মশলায় রগরগে করে রাঁধতে হবে। পরিমাণেও অনেক। বড় একবাটি দুধ দুপুরের খাওয়ার পাতে। আলাদা দু-সের দুধের পায়েস বানিয়ে বা ক্ষীর করে দিতে হবে রোজ রাতে। 

রোজ ক্ষীর করতে বসে কেঁদে ফেলে রেণুদি। জ্বাল দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। রাগ করে আটা গুলে ঘন করে দেয়।

সব সাজিয়ে খেতে বসে জ্যাঠা। শেষ করতে পারে না। আধখাওয়া খাবার রেণুদিদিকে বলে খেতে।

পেঁচোয় ধরেছে। জ্যাঠার এঁটো খেতে তাই নিষেধ করেন মা। লুকিয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয় সেইসব খাবার।

জ্যাঠার ঘর থেকে আতপ চালের ভাতটুকু রেণুদিদি নিয়ে আসে ঠিকই, খায় না। পিসির জন্যে রাখা থাকে।

পরিবারের সকলের বড় পিসি। কুলীনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। নয় বছর বয়সে বিধবা। শ্বশুরবাড়ি যাননি কোনোদিন। জন্ম থেকে মানুষ করেছেন চায়নার বাবাকে। তারপর একে একে এ-বাড়ির সব বাচ্চাই পিসির আদরে মানুষ।

জ্যাঠার ঘরের ভাত পিসি খান, টের পেয়ে গেলেন জ্যাঠামশাই। চায়নাদের ভাঁড়ার থেকে একমুঠো সেদ্ধচাল নিয়ে গিয়ে মিশিয়ে দিলেন নিজের আতপ চালের মধ্যে। আমার তো নিষেধ নাই, শখ কইরা খাই। এইবার দেহি, ক্যাডায় ভাগ বসায়!

নিজের ভাইবোনকে এভাবেই শত্রু করে দিলেন জ্যাঠামশাই। সারাদিন একা একাই বকে যান। গালি দেন সবাইকে। যেন ওঁর সব সর্বনাশের মূলে ওঁর ভাই আর দিদি। যেন তারা পরামর্শ করে ওঁর ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছেন। কে জানে, মনে মনে সেটাই বিশ্বাস করেন কি না।

পিসি সবই দেখেন-শোনেন, আর ছড়া কাটেন। আবজালাম তিল, হলো নীল/ মনে করলাম খাব বসে, কপাল দোষে হলো গোয়ালঘষে।

কারো সঙ্গে কখনো ঝগড়া করে না পিসি। ছোট থেকেই জ্যাঠার মেজাজের মতো জ্যাঠাইমার মুখ শুনেছে চায়না।

ছোট-বড় কাউকেই বাদ দিতেন না। পিসির সব আদর-শাসনই ছড়ায় ছড়ায়।

গোয়ালঘষে আবার কী? জিজ্ঞেস করল চায়না।

পিসি বলে, চেনোস নাই অহনও! তয় আর চিন্যা কাইজ নাই।

মা বলে, কোনো জংলি-লতা হইব। 

মায়ের ব্যাখ্যা পছন্দ হয় না চায়নার। কেন যেন মনে হয়, শেষের বাক্যটা ভুল বলে পিসি। ওটা হয়তো, কপাল দোষে গেল গোয়াল ধসে হবে। কেননা, গোয়াল ধসে গরু মরে গেলে পণ্ড হয়ে যাবে পুরো চাষের কাজটাই।

এরই মধ্যে রেণুদিদির বিয়ের আয়োজন করছেন বাবা। যেন খুব তাড়া। যেন কিছু একটা প্রলয় আসার আগেই সেরে ফেলতে হবে সব কাজ। এমন কথাও একবার হলো, রেণু আর চায়না দুজনের বিয়েই একসঙ্গে সেরে ফেলা হবে।

কিন্তু চায়নার পাত্রের সন্ধান তখনো এসে পৌঁছেনি। এদিকে চাপ দিচ্ছে পাত্রপক্ষ। অগত্যা সেটাই মেনে নিলেন বাবা।

বিয়ের আয়োজনকে কেন্দ্র করেই একটা গোপন খবর প্রকাশ হয়ে পড়ল। পুত্রশোকে সব জমিজমা জলের দরে বেচে দিয়েছেন জ্যাঠামশাই। আর হাতের কাঁচা টাকা নিজে খেয়ে খরচা করেছেন দেদার।

কিন্তু, জমি তো দুই ভাইয়ের?

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলল, দেখাশোনা দাদাই করত। জানকী সরকারের কথামতো আমমোক্তারনামা লেখ্যা দিয়াছিলাম!

হা ভগবান! রেণুর বিয়ার ট্যাকা না হয় উনি দিলেন। কিন্তু হুদু তোমার দোকানের ভরসায় আমাগো চলব কী কইরা? আমার তো আরো একখান মাইয়া আছে!

মায়ের গলায় হাহাকার, কেঁপে উঠেছে চায়না। মা-বাবার গোপন আলোচনা আচমকাই শুনে ফেলেছে ও। ভয়ের চোটে ছুটে পালাচ্ছে এখন। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? এই বাড়ি এই উঠোনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। আর ওর পেছনে ধেয়ে আসছে গোরা সৈন্যের মতো ভয়ের দঙ্গল। ঘিরে ফেলছে ওকে।

দূরে হেঁটে যাচ্ছেন নেড়া-মাথা গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসী।

কাতর চোখে চেয়ে আছে চায়না। দাদা, দাদা গো, তোমার লগে নিয়া চলো আমারে।

কিন্তু ওর ভয়কাতর ডাক পৌঁছল না সন্ন্যাসীর কানে। ফিরেও তাকালেন না উনি।

রেণুদিদির বিয়ে হয়ে গেল, আর অশৌচ শুরু হলো চায়নাদের বাড়িতে। ওর শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়াটুকুর জন্যেই বোধহয় অপেক্ষা করে ছিলেন জ্যাঠামশাই।

অশৌচ কাটিয়ে লোকজন ফিরে গেল। বাড়ি খালি। মা, পিসি আর চায়না। ভাই দুটো ইশকুলে যায়। বাবা যায় দোকানে।

পিসি যায় পাড়া বেড়াতে। সংগ্রহ করে আনেন খবর। ইংরেজরা নাকি দেশ ছেড়ে চলে যাবে। সেইসঙ্গে একটা নতুন শব্দ ‘রায়ট’।

গ্রামকে গ্রাম ঘর জ্বালিয়ে মানুষ মেরে তাণ্ডব করছে মুসলমানরা। আর তার বদলা নিতে কলকাতা শহরে হিন্দুরা খুন করছে মুসলমানদের।

প্রথম যুদ্ধটা ছিল ইংরেজদের সঙ্গে। যুদ্ধ করত স্বদেশিরা। তারপর আরো একটা যুদ্ধ লাগল, যখন বাজার থেকে চাল, ডাল, তেল সব ভ্যানিশ হয়ে গেল। আর মাথার ওপর পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যারোপ্লেনের ছোটাছুটি, এলোমেলোভাবে নানাদিক থেকে। সেই যুদ্ধটা এখন এসে ঢুকেছে গ্রামের ভেতর। এমনকি চায়নাদের ঘরের ভেতরেও।

চায়নার বাবা আর জ্যাঠা পরস্পর শত্রু হয়ে গেল। এরকম কেন হয়? একজন ভুল বোঝে, তার জের পোহাতে হয় বাকিদের।

একটা পোস্টকার্ড এসে পৌঁছল চায়নার বাবার কাছে। ব্রহ্মানন্দ স্বামী নামে কোনো সাধুজি লিখেছেন সেই চিঠি। কী লেখা আছে  চিঠিতে, চায়না জানে না। তবে, হাতের লেখা মিলিয়ে বাবাই জানাল, এ-চিঠি আসলে লিখেছে ওদের সেই সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া বড়দা।

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল চায়নার। এত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, খবর তাহলে এলো! কিন্তু এত বড় খবরে কোনো হেলদোল নেই পিসি আর মায়ের! বাবাও কেমন নিরুত্তাপ।

পিসি শুধু বললেন, আইবে কইছে?

বাবা জানালেন, পরিচয় গোপন রাখসে যহন, এহনি আইব না। দ্যাহা যাক, দ্যাশ স্বাধীন অইলে হয়তো …

পিসি বলেন, যেমন কন্যা র‌্যাবতী/ তেমন পাত্র গদাহাতী। আওনে আর কাইজ নাই। যদু বংশ ধ্বংস হইয়া গ্যাল, সাধু হইছেন বলরাম। 

পিসির এসব রাগের কথা। আশার বুদবুদ জমতে থাকে চায়নার মনে। স্বাধীনতা কেমন? সবকিছু আবার আগের মতো সুন্দর ঝলমলে হয়ে যাবে?

ব্রহ্মানন্দ স্বামী আসবেন এই বাড়িতে। চোখ বুজে সেই দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করে ও। মনের মধ্যে জেগে ওঠে নেড়া-মাথা স্বামী বিবেকানন্দের মুখ! আর চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে জল।  

রেণুদির বিয়ের পরে এক সকালে নৌকো করে দোকানে যাচ্ছিলেন চায়নার বাবা। তখন দেখে ওদেরই জমির পাট কাটছে অচেনা লোকজন। সেখানেই জানকী সরকারকে দেখে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, তিনিই কিনে নিয়েছেন ওদের পাটের জমি। অথচ চাষের শুরুতে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বাবা! তখন কিন্তু চায়নার বাবার তত্ত্বাবধানে আগের লোকজনই কাজ করেছিল।

এই গোপনীয়তায় আরো ভেঙে পড়লেন বাবা। এভাবেই যেন গোপনে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে চলেছে গ্রামে।

হরি তোমার অপার লীলা/ জানে না কোনো যোগী ঋষি/ কারে হাসাও কারে কাঁদাও/ কারে কর বনবাসী।

বাউলরা এখনো আসে। ওরা কি অন্তর্যামী! কেমন অদ্ভুতভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে যায় ওদের গানগুলি।

গ্রামটা হিন্দুদের হলেও বাজারটা হিন্দু-মুসলমান সকলের। বাজারের মাঠেই বসে হাট। হাটের পাশে খাল। রোজ খাল পার হয়ে বাজারের দোকানে যান চায়নার বাবা। বাজারের পেছনদিকে মুসলমানপাড়া। অন্য জিনিসের সঙ্গে মুরগি, ছাগল, মাংস খাবার নাংলা গরুও বিক্রি হয় বাজারে। মুসলমানদের এখনকার দাবি, বাজারে পাঁঠা কাটা হলে, গরু কাটাও চলবে।

তাই মাংসের দোকানই উঠে গেল বাজার থেকে। গরু, ছাগল, মুরগি বিক্রি হতে লাগল আগের মতোই।

শুরুটা হলো এভাবেই। গভীর রাতে কোনো কোনো দিন ভয়-জাগানো বুক-কাঁপানো ধ্বনি শোনা যায়। অনেক দূর থেকে ভেসে আসে সেই শব্দ।

আচমকাই এক রাতে চুরি হয়ে গেল চায়নার বাবার দোকানে। আগের দিনই মজুদ হয়েছিল সরকারি রেশনের সামগ্রী। অনেক টাকার জিনিস। আগের ক্ষমতা আর নেই, ক্ষতিপূরণের টাকা মেটাতে পারলেন না চায়নার বাবা। ডিলারশিপ বাতিল হয়ে গেল।

এটা যে পরিকল্পনামাফিক শত্রুতা, বুঝতে পারল সবাই। বাজারে আরো দোকান আছে হিন্দুদের। অতএব মিটিং বসল গ্রামে, হিন্দুদের একাট্টা হতে হবে।

রাত-পাহারা শুরু হলো পাড়ায় পাড়ায়। ভাঙা দোকানে রাতে শোয়া শুরু করেছেন বাবা। তাই চায়নার নাবালক ভাই দুটোই যায় এ-বাড়ির প্রতিনিধি হয়ে। লম্বা লম্বা দুটো লাঠি ঠক ঠক করে ছোট্ট ছোট্ট দুটো মানুষ যায় পাহারাদারি করতে।

নিশুতি রাত, ভয় করবে না তোদের? জিজ্ঞেস করে চায়না।

জবাবে পিসির সামনে গিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে দুজনে বলে, সায়রেই শয্যা, নিশিতে আর ভয় কী।

পিসির বলা ছড়াটাই ফিরে পিসিকে শোনানো হলো। কিন্তু মানে তো বোঝে না, তাই শিশিরের জায়গায় নিশিতে বসিয়ে নিয়েছে। 

ফোকলা মুখে হেসে ফেলেন পিসি। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন দুটোকে। বলেন, এই জগাই মাধাই থাকতে আমাগো আর কুনও বয় (ভয়) নাই।

মুখ আড়াল করে আঁচলে চোখ মোছেন মা।

বেত গাছ, শীতলপাটির গাছ বিক্রির সামান্য আয়টুকুও এখন হেলাফেলার নয়। এমনই পড়তি অবস্থা সংসারের। পুকুরে রুই, কাতলা, কালবাউশ, মৃগেল অনেক আছে। জাল ফেলে সেই মাছও তুলে বিক্রি হয়। বর্ষার সময় চিতল, বোয়ালও ঢুকে পড়ে পুকুরে।

একদিন একটা ছেঁড়া জামা পরে ইশকুলে গেছে গৌর। পাড়ায় কেউ বলেছে, ছ্যামরা, তর জামাখান যে ছিঁড়া?

যেমনে কপাল তেমনে, বলে গটগটিয়ে চলে এসেছে গৌর। ঘরে এসে সেই গল্প করছে আর পেট ধরে হেসে গড়িয়ে পড়ছে নিতাই। চায়না তাড়াতাড়ি জামাটা টেনে নিয়ে বসে, রিফু করে দিলো। 

শ্রাবণের ধারা কাটাতে রেণুদিদি এসেছে বাপের বাড়ি। অনেকদিন পরে সেটুকুই যা আনন্দ। কিন্তু ওর গা-ভরা গয়না দেখে ভয় পায় মা। দিনকাল যে খুব খারাপ।

ঘটা করে কালীপুজো হয় চায়নাদের বারবাড়িতে। গত কয়েক বছরে আয়োজন ছোট হলেও পাঁঠা বলি হয়েছে। সেই বলির ভারী খাঁড়াটা তুলে নিয়ে এলো রেণুদিদি। আসুক তোদেহি, মরতেই যদি হয়, মাইরা তবে মরুম।

রেণুদিদিকে দেখে সাহসী হয়ে ওঠে চায়নাও। ওই খাঁড়া মাথার কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে দুই বোন।

কিন্তু বহু মানুষের হই-হল্লা আর ভয়-জাগানো ধ্বনি ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসে। একটা কিছু জবাব না দিলে যে কোনোদিন আচমকা হামলা করবে ওরা। নানা দিকের রায়টের খবর গ্রামে পৌঁছোচ্ছে রোজ।

পাকা ছাতওয়ালা দোতলা বাড়ি গ্রামে একটাই। মালিকপক্ষ কলকাতায় থাকে বলে, ফাঁকা পড়ে বাড়িটা। সেই বাড়িতেই একরাতে জড়ো হলো গ্রামের মেয়ে, বউ, বৃদ্ধ আর শিশুরা। পুরুষেরা যেমন পাহারা দিতে যায়, গেছে। কাঠকয়লা, ঘুঁটে চাপা দিয়ে গোয়ালঘরে লুকানো হয়েছে চাল। বাসন-কোসন ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে পানাপুকুরে। নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে রেখে সবাই এসে উঠেছে ওই বাড়িতে।

মাঝরাতে দূরাগত বুক-কাঁপানো ধ্বনি শোনা যেতেই সকলে মিলে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল বন্দে মাতরম। পরিত্রাহী চেঁচিয়ে চলেছে সবাই। ভয়ের চোটে বিকৃত স্বর।

এমনই ভয়ংকর হয়ে উঠল সেই ধ্বনি, প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়েছে শত্রুপক্ষ। পাহারায় থাকা ছেলের দল পরেরদিন জানাল, গ্রামে হামলার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিল ওরা। ভয় পেয়ে ঝুপঝাপ করে খালে পড়েছে কিছু গুন্ডা। বাকিরা পালিয়েছে। চারপাশে রটে গেল, বাইরে থেকে লোক এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই গ্রামে।

এরপর কিছুদিনের জন্যে শান্ত হয়ে গেল পরিস্থিতি। তারপরেই স্বাধীন হলো ভারতবর্ষ। কিন্তু চায়নারা থেকে গেল পাকিস্তানে।

আর ঝুঁকি নিতে চাইলেন না চায়নার বাবা। রেণুদিদির ভাশুর ওকে নিয়ে গেলেন। ওঁদের এক ভাই আসামে ডাক্তারি করেন। বাড়ির মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে সেখানে।

দেওঘরে রামকৃষ্ণ মিশন ইশকুলের ব্যায়াম-শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছে চায়নার দাদা। চল্লিশ টাকা মাইনে। থাকা-খাওয়া ফ্রি।

কিন্তু বাবার জরুরি চিঠি পেয়ে, পরিবারের দায়িত্ব নিতেই সেই চাকরি ছেড়ে রাতারাতি রেলের চাকরিতে জয়েন করতে হলো দাদাকে। সত্তর টাকা মাইনে, রেশন, কোয়ার্টার ফ্রি।

সে-বছরও মাঠভরা কাশফুল। বাতাস আমোদিত করে ফুটেছে শিউলি। জলে পাপড়ি মেলেছে পদ্মেরা। চায়নাদের বাড়িতে পুজোয় নতুন কাপড় হলো না কারো। কাপড়ই নেই বাজারে। কোনোকিছুই নেই। বাংলাদেশের সর্বত্রই নাকি এমনই অবস্থা। দুটো দুর্গাপুজো গ্রামে। একটা জমিদারের বাড়ি, অন্যটা আরেক জ্ঞাতির বাড়িতে। জমিদার খবর পাঠিয়েছেন, তাঁরা আসবেন না। এবার থেকে দুর্গাপুজো তাদের কলকাতার বাড়িতেই হবে। অন্ধ কেদার চক্রবর্তী নমো নমো করে পুজোর আয়োজন করলেন গ্রামের বাড়িতে, অন্যবাড়ির পুজোটাও হচ্ছে।

বিজয়া দশমীর দিন পাশের গ্রামের পুরোহিতবাড়ি থেকে ঠাকুরকে উৎসর্গ করা, কোরা লালপাড় সাদা খোলের দুটো শাড়ি এনে দিলেন পিসি। সেই শাড়ি সম্বল করে ছোট ভাইদুটোর হাত ধরে পরেরদিন সকাল দশটার সময় দাদার সঙ্গে বাড়ি ছাড়ল চায়না।

কেবল মিনতি আর তিলকীই কিছু বুঝছে না। বাড়ির পোষা এই কুকুর আর বেড়াল ভাইবোনের মতো ওদের বাড়িতে রয়েছে এতকাল। কালো কুচকুচে কুকুরের কপালে একটা সাদা তিলক। তাই ওর নাম তিলকী। নাম ধরে ডাকলেই ভুক করে সাড়া দেয়। রোজ এঁটো কাঁটা দিয়ে ভাত মেখে খেতে দেওয়া হয় ওকে। বারান্দার সিঁড়ির ধাপে একটা ধামা রাখা থাকে। তার ভেতরে বস্তা পেতে শোবার বন্দোবস্ত তিলকীর। খাওয়া হলেই ওর মধ্যে গোল হয়ে ঢুকে পড়ে। আর ও শুলেই মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ে মিনতি। কালো কুকুরের মাঝে সাদা বেড়াল। 

মিনতির বরাদ্দ মাছভাত। কিন্তু চুরি করে না কক্ষণো। দরকারে ওকে মাছ-পাহারায় রেখে উঠে যায় ঘরের লোক। ও থাকলে কাক আসে না। তিলকী কখনো ঘরে ঢোকে না। মিনতির সর্বত্র যাতায়াত।

চায়নারা দলবেঁধে কোথাও গেলেই সঙ্গ নেওয়া তিলকীর বরাবরের অভ্যাস। স্বভাব।

উত্তরপাড়ায় ছোট পিসির বাড়ি যেতে বর্ষাকালে নৌকো লাগত। নৌকো করে ওরা রওনা দিয়েছে। খানিক যেতে দেখা গেল তিলকী আসছে জল সাঁতরে। ওকে তুলে নেওয়া হলো নৌকোয়। তর্জনী তুলে শাসানো হলো, কোণে বইয়া রও, গা ঝাড়বি না। বাধ্য ছেলের মতো বসে রইল তিলকী। গা ঝাড়া দিলেই তো সকলের গায়ে ছিটবে সেই জল। এদিকে শীতে কাঁপছে। তবু গা ঝাড়া দিলো না। আবার পিসির বাড়িতেও একটা কুকুর আছে। তিলকীকে দেখলেই ঝগড়া বাধাবে। তাই ওকে বলা হলো, নৌকায় রইবি। লক্ষ্মী হয়ে নৌকাতেই বসে থাকল তিলকী।

এবারেও নৌকার পেছনে সাঁতরাতে সাঁতরাতে আসছে, কখন ওরা ওকে নৌকোয় তুলে নেবে, সেই আশায়।

গৌর-নিতাই কেবল কাঁদছে আর বলছে, ফিইরা যা ফিইরা যা, আসিস না আমাগো লগে। আমরা চইলা যাইতে আছি।

চায়নার চোখে জল নেই। কারো সামনে কাঁদতে পারে না ও।