চব্বিশ ঘণ্টা

ঠিক এই সময়টাতেই ওরা আসেন।

কেমন যেন বাঁধাধরা নিয়মের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। রোজা শুরু হবার কদিন পর থেকেই এমনটি হচ্ছে। ঠিক বলে কয়ে নয়। অলিখিত, অকথিত একটা প্যাটার্নের মতো। রোজ সন্ধ্যাবেলা ওঁরা এসে উপস্থিত হচ্ছেন সুশীলের দোকান ‘সংযোগ’-এ। বাবার বয়সী সব লোকজন। এঁদের কেউই আগন্তুক নয়। সবাই পরিচিত। প্রত্যেকেই এর আগেও দু-একবার এসেছেন এ দোকানে। কখনো ফোন করতে, কখনো ফ্যাক্স তুলে নিতে, কখনো দু পাতা ফটোকপি করাতে অথবা পাসপোর্টের ছবি তুলতে। কিন্তু এভাবে দলবেঁধে কখনো তাঁরা আসতেন না। তাছাড়া কোনো প্রয়োজনে বা বিশেষ কাজের জন্যেও আসছেন না তাঁরা।

ফটোকপির মেশিনে টোনার লাগাতে গিয়ে আজ এক বিচ্ছিরি কা- ঘটে গেল। দুই হাতের সবগুলো আঙুল তো বটেই, হাতের তালু থেকে শুরু করে কনুই পর্যন্ত শুকনো কালিতে একেবারে একাকার। কালিমাখা ন্যাকড়াটিতে হাত মুছতে মুছতেই সুশীল সম্ভাষণ জানায়। ধুতি-চাদর আর স্যান্ডেল পরা অমলেন্দু দে’র সঙ্গে একই সঙ্গে দোকানে ঢুকছেন প্যান্ট-শার্ট জুতো পরিহিত রমানাথ পোদ্দার। অমলেন্দু রাজনীতিতে আগের মতো সক্রিয় না থাকলেও জীবনযাত্রা, চলাফেরা বদলাননি খুব। সুশীল জানে এক্ষুনি অর্থাৎ ইফতারের সাইরেন বাজার আগেই উপস্থিত হবেন যোগেন ঘোষ। হয়তো পরিমল শর্মা, জগন্নাথ দাস অথবা ধীরেন চক্রবর্তী। ওঁরা আসেন। অনেকক্ষণ বসে থাকেন। চা সিগারেট খান। কখনো কখনো ফ্যাক্স করতে থাকা কামরুলকে সুশীলের অনুমতি নিয়ে পান কিনতে বাইরে পাঠিয়ে দেন কেউ। ওঁরা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। বাঁশখালীর ঘটনা নিয়ে আফসোস করেন, নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলেন। তারপরও সুশীলের মনে হয় আরো যেন কী বলার থেকে যায় তাঁদের। সুশীল বোধ করে এইসব মামুলি, সবার জানা কথাগুলো বলার জন্যেই একসঙ্গে দলবেঁধে ওঁরা আসেন না। কখনো কখনো কেউ সতর্ক অথবা অসতর্ক মুহূর্তে সুশীলকে সাবধান করে দেন, বলেন চারদিকে চোখ-কান খোলা রাখার জন্যে। সেতো সুশীল যথাসাধ্য করে আসছে। বেঁচে থাকার জন্যে কত কিছুই না করতে হচ্ছে তাকে। সুশীল ভাবে চোখ-কান খোলা না থাকলেই হয়তো ভালো হতো। আজকাল অনেক কিছুই সে আর দেখতে চায় না, শুনতে চায় না-অনেক ব্যাপার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হলেই হয়তো সে শান্তি পেত। বিশাল ভুঁড়ি আর একমাথা টাক নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হন জগন্নাথ দাস। কালো কোটটার সামনের বোতামগুলো খুলতে খুলতে কামরুলকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘কী হে, তুমি কি রোজা করছো নাকি আজ?’

‘হ,’ কামরুলের উত্তর।

 জগন্নাথ পকেট থেকে পাঁচটি টাকা বের করে কামরুলকে দেন ইফতার করার জন্যে।

 ‘যাও। দৌড়াও। সময় হইয়া যাইতাছে। কী কও তুমি সুশীল?’

সুশীল সায় দিলে কামরুল ফ্যাক্স করা বন্ধ রেখে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে যায়।

এসময়টা এদিককার সব দোকানপাট একেবারে খালি হয়ে যায়। অনেক দোকান ইফতারের জন্যে শাটার টেনে বন্ধ করেও দেওয়া হয়। কে বলবে এক ঘণ্টা আগেও এ অঞ্চল মানুষে গিজগিজ করছিল? ইফতারের পরে আর আগের মতো জমে না। তবু আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত টুকিটাকি ব্যাবসা চলে। সুশীলও দোকান খোলা রাখে, কখনো নটা পর্যন্ত। ইফতারের পর রাস্তার ওপাশের ফোন-ফ্যাক্সের দোকানটি আর খোলে না। ফলে গ্রাহকের সংখ্যা এসময় একেবারে ফেলনা হয় না সুশীলের। আর তাছাড়া ঘরে ফেরার তাড়াটাই বা-কি? একমাত্র তমাল ছাড়া?

অমলেন্দু দে সুশীলকে কাছে ডেকে বসান। ফ্লাক্স থেকে ঢেলে সকলকে চা পরিবেশন করে সুশীল। রমানাথ পোদ্দার বলতে থাকেন, তিনি জানেন, এসময় এই জায়গায় ব্যাবসা-বাণিজ্য করা কত কঠিন। কত রকম মানুষকে তুষ্ট করে, কত জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ব্যাবসা দাঁড় করাতে হয়। তারপরও, অমলেন্দু দে বলেন, ঘর আর ব্যাবসাকে আলাদা রাখতে হয়। ব্যাবসার কাজে কতরকম লোকজন আসবে যাবে দোকানে। কিন্তু ঘর হলো আশ্রমের মতো। তাকে সব মালিন্য থেকে দূরে রাখতে হবে।

আর মাত্র চার-পাঁচটি রোজা বাকি রয়েছে। ওঁরা কি বুঝতে পেরেছেন এমন নিরবচ্ছিন্ন সময় আর পাবেন না এ দোকানে? তাই কি সব বলে ফেলতে চান আজ? যাবার আগে জগন্নাথ দাস সুশীলের পিঠে হাত রেখে মনে করিয়ে দেন সুশীলের বাবা কত জনপ্রিয়, কত শ্রদ্ধেয় স্কুল শিক্ষক ছিলেন এলাকায়।

‘শুধু কাম করলেই চলবে না। শুধু টাকা কামাই করলেই অইল না। ঘরে আরো সময় দাও। বউ পোলারে দেখ। ঘরে সুন্দরী বউ। সময়টা বড় খারাপ।’

ওঁরা সবাই চলে গেছেন এখন। দুটো চেয়ার, লম্বা টুলটা এখন একেবারে খালি। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। দু-একজন পথচারী দেখা দিতে শুরু করেছে আবার। সুশীল ফোন বুথ দুটোতে ঢুকে এখানে ওখানে পড়ে থাকা লোকজনের ফেলে যাওয়া ফোন নাম্বার অথবা এক সময়ের জরুরি কথাসহ চিরকুটগুলো তুলে ঘরের কোণে রাখা ময়লার বাক্সটিতে ফেলে। ক্যাসেটে নিচু শব্দে রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে দেয়। কামরুল এখনো ফেরেনি। সুশীল ফটোকপি মেশিনে এক পৃষ্ঠা ট্রায়াল কপি করে দেখে ঠিকমতো লেখাগুলো পড়া যায়   কি-না। কিছুক্ষণ আগে এক গ্রাহক এগারো পৃষ্ঠা কপি করে পাঁচ পৃষ্ঠার দাম দিয়ে চলে গেল। বলল, আবছা লেখা, পড়া যায় না। সুশীল নতুন করে কপি করে দেবার অঙ্গীকার করলেও ব্যস্ত গ্রাহক সময়ের অভাব জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। তারপরে টোনার লাগাতে শুরু করেছিল সুশীল। ফ্যাক্স মেশিনে ফ্যাক্স আসছে শব্দ করে। সেখানে চোখ ফেরাতেই প্রবল বিরক্তিতে ঠোঁটদুটিসহ চিবুকটি কুঁচকে যায় সুশীলের। কলিমুদ্দিনের নামে আসা এই ফ্যাক্স আসলে ফারুকের। এখুনি হয়তো আসবে ওরা ফ্যাক্স গ্রহণ করতে। সেই সঙ্গে আরো কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ফ্যাক্স আসছে। কতরকম কাজকর্ম আর ব্যাবসা যে রয়েছে ওদের! দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে।

ফ্যাক্স আসা এখনো শেষ হয়নি, উপস্থিত হলো দোকানে ফারুক, সুভাষ, জাহাঙ্গীর আর আলম।

‘কি দাদা! ফ্যাক্স আসছে কিছু?’

‘আসছে।’

সুশীল ব্যস্ততার ভান করে। রেজিস্ট্রি বইটি মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। কলমটা নিয়ে এখানে ওখানে দাগ দিচ্ছে।

‘চা টা কিছু অইব? দাদার মনে হয় মেজাজটা ভালো নাই আজ?’ সুভাষের কণ্ঠস্বর টের পায় সুশীল চোখ না তুলেই।

একজন গিয়ে ফ্যাক্সের পৃষ্ঠাগুলো তুলে নিল। পয়সা দেবার প্রশ্নই আসে না ওদের। ফলে পৃষ্ঠাসংখ্যা জেনে লাভ নেই সুশীলের।

‘একটা ফোন করন লাগব।’ জাহাঙ্গীর বলে। ওদের জন্য সুশীলকে কানেকশন দিয়ে দিতে হয় না, বুথের ভেতরও সাধারণত ঢোকে না ওরা। সুশীলের ডেস্কের ওপর রাখা টেলিফোন থেকেই সরাসরি ফোন করে। তবে অন্য লোকজন দোকানে থাকলে অথবা দূরের কোনো শহরে জরুরি কাজে ফোন করতে হলে সাধারণত বুথে ঢোকে ওরা। জাহাঙ্গীর এক লম্বা লিস্ট দিয়ে যাচ্ছে টেলিফোনে ‘সতেরোটা মহিষ, একশটা গরু, বাহান্নটা খাসি …।’

সুশীল জানে সংখ্যাটা জরুরি হলেও, পশুগুলোর নাম সবই সাংকেতিক। এই টেলিফোনের নির্দেশ অন্যপারে ভিন্ন তর্জমায় পৌঁছে যাচ্ছে সরাসরি। কার সর্বনাশ করার পরিকল্পনা করছে ওরা কে জানে? অথচ করছে সুশীলের দোকানে বসে, তার টেলিফোনের মাধ্যমেই। কামরুল ঘরে ঢোকে দ্রুত পায়ে।

ওদের কারো দিকে না তাকিয়ে সুশীল প্রশ্ন করে, ‘তোমরা জানো সরস্বতীর বেণী ধরে রাস্তায় কে টান দিয়েছিল কাল?’

ওরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পরে সমস্বরে জানায়, ওদের কেউ নয়। তবে ব্যাপারটা ওদেরও কানে এসেছে। খোঁজখবর নিয়ে দেখবে। উচিত শিক্ষা দিয়ে দেবে অপরাধীকে। আজ বোধহয় সুশীলেরও সাহস বেড়ে গিয়েছে। ওর গলা একবারও কাঁপে না, বলে, ‘কিন্তু আমি যে শুনলাম তোমাদের মিলটনই এ কাজ করেছে?’

ওরা সমস্বরে প্রতিবাদ করে। সুশীল কী বলবে ভেবে পায় না। স্কুলেপড়া চৌদ্দ-পনেরো বছরের কচি মেয়েগুলো পর্যন্ত ওদের হাত থেকে নিস্তার পায় না আজকাল।

‘কে কইল আপনারে এই কথা? কন। এক্কেবারে ফাইড়া ফালামু।’ ফারুক উত্তেজিত।চায়ের জন্যে আর পীড়াপীড়ি করে না ওরা। চটপট বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অপসৃয়মাণ চার রতেœর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুশীল। ফারুকের গায়ে ঝকঝকে নতুন কালো চামড়ার কোট। এটা নিশ্চয়ই আজকেরই অর্জন!

বাশার সাহেব অনেকগুলো মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সুশীলের দোকানে ঢোকেন। থেলাসেমিয়াই হয়েছে তাঁর একমাত্র মেয়ের। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। এ কাগজগুলো কলকাতায় এক ডাক্তারের অফিসে পাঠাতে হবে ফ্যাক্স করে। রোগী যাবার আগেই কাগজপত্রগুলো দেখতে চেয়েছেন ডাক্তার। বাশার সাহেব জানেন না বিভিন্ন সাইজের কাগজগুলো আদৌ ফ্যাক্স করে পাঠানো সম্ভব কি-না। সুশীল তাকে নিশ্চিন্ত করে চেয়ারে বসায়। আগে ফটোকপি মেশিনে বড়মাপের কাগজগুলোকে সংক্ষিপ্ত আকারে এনে কপি করে নেয়। তারপর একে একে ওগুলোকে ফ্যাক্স করে। মাঝে মাঝে লাইন কেটে যায়। আবার ডায়াল করে সুশীল। বাশার সাহেব কন্যার অসুস্থতায় বড়ই কাতর। সুশীল তাকে বোঝাতে চায়, উন্নত চিকিৎসায় দিতি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।

অমলেন্দু দে আর জগন্নাথ দাসের কথাগুলো ঘুরেফিরে কানে বাজছে। অবুঝ শিশু সুশীল নয়। সে জানে, টের পাচ্ছে কী তাঁরা বলতে চাইছেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কামরুলকে ডেকে সুশীল জানায় আজ তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করে দেবে। সব যন্ত্রপাতি বন্ধ করতে বলে কামরুলকে।

ঝটপট সবকিছু বন্ধ করে কামরুলকে ভেতরে রেখে শাটার টেনে দেয় সুশীল। কামরুল দোকানেই ঘুমায়। ভেতর থেকে বন্ধ করা পেছনের দরজা দিয়ে প্রয়োজনে বাইরে যেতে পারে সে। তালা লাগিয়ে চাবিটা পকেটে ভরতে ভরতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় সুশীল। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই থমকে যায়। চোখে পড়ে দুটি মোটর সাইকেল পাশাপাশি দাঁড় করানো ঘরের ঠিক সামনেই। এ হোন্ডাদুটো অতি পরিচিত সুশীলের। শুধু সুশীলের নয়, এ অঞ্চলের সকলেরই। সারাদিন শহরময় ঘুরে বেড়ায় এরা। সুশীল একবার ভাবে দোকানে ফিরে যায়। পরে মনে হয়, না, এভাবে পালিয়ে বেড়িয়ে লাভ নেই। নিঃশব্দে চাবি লাগিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে সুশীল। ওরা তিনজন সারি সারি সোফাতে বসে আছে। আর ফারুক একা বড় চেয়ারটিতে, যেখানে সুশীল সবসময় বসে টেলিভিশন দেখে। তপতীর কপালে বড় লাল টিপ, ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক। গোলাপি রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি পরে স্টেরিও কেবিনেটটির কোনায় দুই হাতের ওপর বুকে চাপ দিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ব্লাউজের বড় গলার ফাঁক দিয়ে উদ্ভাসিত বক্ষসম্ভার। ওদের সকলের মুখেই উল্লসিত হাসি। মনে হচ্ছে কোনো মজাদার গল্পে মেতেছিল ওরা। সুশীলকে ঘরে ঢুকতে দেখে তপতী সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যরা যে যেখানে বসেছিল সেখানেই বসে থাকে।

‘দাদার শরীর খারাপ নাকি? তাড়াতাড়ি চইল্যা আইলেন?’ জাহাঙ্গীর চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে। জাহাঙ্গীরের কথার কোনো জবাব দেয় না সুশীল।

খালি চায়ের কাপ আর চানাচুর বিস্কুটসহ প্লেটগুলো কফি-টেবিলে ছড়ানো ছেটানো। সুশীল সোজা ভেতরের শোবার ঘরে চলে যায়। ছেলেটা বই সামনে রেখে চুপচাপ ছোট্ট টেলিভিশনটাতে ছবি দেখছে। সুশীল দেখে তমাল তার সেই প্রিয় হরিণছানার ছবিটাই দেখছে আবার ভিসিআর-এ। এ ছবি কতবার সে দেখল তার হিসাব নেই। স্কুল থেকে এসে জামাকাপড় পর্যন্ত বদলায়নি তমাল। চুলগুলোও এলোমেলো। ছেলের পাশে এসে বসে সুশীল।

‘খেয়েছ তমাল?’

ঘাড় কাত করে তমাল জানায় সে খেয়েছে।

‘স্কুলে কী হলো আজ?’

‘ক্লাস হলো।’ সুশীল ছেলের দিকে ভালো করে তাকায়। আট বছরের তমাল। কথা বলতে এত আলসেমি কেন তার?

‘হোমওয়ার্ক করেছ?’

‘করেছি।’

যত দ্রুত আর অল্প কথায় উত্তর দেওয়া যায় ততই যেন ভালো তার। আসলে কথা কম বলতে বলতে এখন আর ও বলতেই চায় না কিছু।

ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ‘জামদানি ঘর’ লেখা শাড়ির বাক্সটি আগের জায়গাতেই পড়ে আছে। সুশীল বাক্সের ঢাকনাটি ঈষৎ ফাঁক করে দেখে ভেতরে গাঢ় নীলের ওপর সাদা ও সোনালি বুটির জামদানি শাড়িটি ঠিকই শোভা পাচ্ছে।

ওদের বিদায় দিয়ে আরো কিছুক্ষণ পর ধীর পায়ে শোবার ঘরে ঢোকে তপতী।

তমাল তখনো ছবি দেখছে। সুশীল শাড়ির বাক্সটি হাতে নিয়ে তপতীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।

‘এটা আজো ফেরত দিলে না? তুমি বলেছিলে দেবে।’

‘এটা ফেরত দিতে গেলে ফারুক তুলকালাম করবে।’

‘আমি জানতাম তুমি পারবে না।’ সুশীল তপতীর মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে, ‘এ শাড়ি কখনো পরো না তুমি।’ তপতী কাছে এসে দাঁড়ায়। তপতীর ঠোঁটের লিপস্টিক সর্বত্র একই রকম গাঢ় নয়। চা-চানাচুর খেতে খেতেই হয়তো কোথাও কোথাও হাল্কা হয়ে এসেছে। ওর বাঁ ঠোঁটের ঠিক ওপরটাতে নাকের নিচে ছোট্ট একটা জায়গায় লিপস্টিক থেবড়ে গেছে মনে করে সুশীল হাত বোলায়। অর্ধগোলাকার একটা লাল দাগ। কিন্তু না, সুশীলের তর্জনীর ডগায় রং উঠে আসে না। সুশীল আরো কাছে সরে আসে স্ত্রীর। আরো জোরে ঘষা দেয় ঠোঁটের ওপরকার টকটকে লাল জায়গাটিতে। জন্মদাগের মতো চামড়ার সাথে মিশে আছে সেই রক্তাভ লাল। একটুও মোছে না। সুশীল জামদানি শাড়ির বাক্সটি দিয়ে প্রবল জোরে দুই তিনবার আঘাত করে ড্রেসিং টেবিলটার ওপর। তমাল ভয় পেয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। নিচু গলায় তপতী বলতে থাকে, চান করার সময় কলের মুখটা লেগে ঠোঁটে ব্যথা পেয়েছিল সে। সে কথার কোনো উত্তর আসে না।

সুশীল বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কল ছেড়ে দেয়।খাবার টেবিলে অন্যান্য দিনের মতো জোর করে স্বামীর পাতে এটা ওটা তুলে দেয় তপতী। কাঁচামরিচ, আচারের বৈয়াম পাশে রাখতেও ভোলে না। ‘লাউ-চিংড়ি তুমি পছন্দ করো, আরেকটু নাও না!’ আবদার করে তপতী। সুশীল হাসে।

‘মুখি কচু দিয়ে ইলিশ মাছ-এ তো এ বাড়িতে কখনো হতো না। এটা কার পছন্দ?’ তপতী চুপ করে থাকে।

সুশীল হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে।

‘শোভা! শোভা!’

 কাজের মেয়ে শোভা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে খাবার ঘরে আসে।

‘আজ এ বাড়িতে আর কে ভাত খেয়েছে?’

শোভা কথার উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘বুঝেছি। তুই যা।’

তপতী শুতে আসার আগেই আজ বিছানায় এসেছে সুশীল। মুখে গলায় পন্ডস্ ক্রিম মাখাতে মাখাতে মশারির নিচে ঢোকে তপতী। ওপাশ ফিরে শুয়েছিল সুশীল। তপতী বেড সুইচ দিয়ে লাইট নেভাবার পরও সুশীল এপাশ হয় না। একটুও নড়াচড়া না করে শুয়ে থাকে সুশীল।

‘ওমুখ করেই শুয়ে থাকবে? তুমি তো জানো, তুমি না ধরলে আমার ঘুম আসে না।’ আহ্লাদী গলায় কথা বলতে বলতে স্বামীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তপতী।

তপতীকে অচেনা লাগছে সুশীলের। এপাশ ফিরে আলতোভাবে একটা হাত রাখে স্ত্রীর পিঠে।

‘ওটা তো একটি পুরনো অভ্যেস তপতী। দুদিনেই কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের গোটা জীবনের চেহারাটা কি হয়েছে দেখতে পাচ্ছ?’

‘আমি কী করব? তুমিই তো ওদের ঘরে নিয়ে এলে। ভয়ে আমি ওদের সামনে পর্যন্ত যেতে চাইতাম না। তুমিই তো জোর করলে।’

কথাটা সত্য। সুশীলই জোর করে তপতীকে বাইরের ঘরে ওদের সামনে নিয়ে এসেছিল। চা করে খাওয়াতে বলেছিল ওদের। সুশীলের মনে হয়েছিল, ওরাও আশ্বাস দিয়েছিল, ওদের কাজকর্ম যা-ই হোক, সুশীলদের কোনো ক্ষতি ওরা করবে না। তাছাড়া ওদের খুশি রাখাটা তখন জরুরি মনে হয়েছিল সুশীলের। মস্তবড় ভুলটা সে নিজেই করেছে। এখন তপতীকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ‘আমার কথা তুমি ভাবো না আমি জানি তপতী, কিন্তু লোকে কী বলে, কী ভাবে আমাকে? ওরাই বা কী চোখে দেখে আমায়!’ সুশীল টের পায় তপতী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীরভাবে একই লয়ে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিচ্ছে তপতী। সুশীল পাশ ফিরে শোয়। ঘুম আর হয়তো আসবে না আজ রাতে।

আধো ঘুমে আধো জাগরণে রাত্রি কেটে গেল। ভোর রাতে উঠে একটা ঘুমের বড়ি খেলো সুশীল। ভোর বেলা দু চোখ ভরে ঘুম এল তার। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কত কি স্বপ্ন দেখল! যখন ঘুম ভাঙল বেলা দশটা বেজে গেছে। চোখ খুলে প্রথমেই মনে হলো হয়তো সবকিছু স্বপ্ন। যা কিছু ভাবছে সে, তা হয়তো প্রকৃতই ঘটছে না। তপতী øান সেরে ভেজা লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে শোবার ঘরে চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। শীতেও সিলিং ফ্যানটা চলছে মন্থর গতিতে। সুশীলের আজ বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তবুও একসময় নিজেকে একত্র করে শয্যা ছেড়ে উঠে বসল সুশীল। বাথরুমে অযথা বেশি সময় নিল। প্রায় নিঃশব্দে খাবার খেয়ে প্রতিদিনকার মতো টিফিন ক্যারিয়ারটা তপতীর হাত থেকে নিয়ে সাইকেলের দিকে যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, তমাল স্কুলে যাবার আগে ঘুম ভাঙেনি এমন আর কখনো হয়নি আগে। এত ঘুমও জমা ছিল এই শরীরে! এখনো শরীরটা ঢিস-ঢিস করছে। পারলে আরো খানিকটা ঘুমিয়ে নিত সুশীল। তপতীর ঠোঁটের ওপর লাল দাগ এখন কালচে। সুশীল রওনা হওয়ার পরও তপতী প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। এমন দিনও ছিল, সুশীল প্রথম যখন দোকান নেয়, সকালে কাজে যাবার সময় যতদূর দেখা যায় তপতী এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত সুশীলকে। হাত নাড়াত সুশীলও সাইকেল থেকে, পেছনে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখত তপতীকে। একসময় হাত তুলে তপতীকে ঘরে যেতে বলত। সে আর এমন বেশিদিনের কথা নয়। আজ সুশীল তপতীকে ঘরে যেতে ইশারা করেনি। যদিও বাঁক নেবার আগে পেছন ফিরে তাকিয়ে তপতীকে দেখেছিল একবার ঠিকই।

বশিরউদ্দিন রোডে ঢুকতেই সুশীল টের পায় এ অঞ্চলে ইলেকট্রিসিটি নেই। কতক্ষণ ধরে নেই বলা শক্ত। তবে লোকজনের ঢিলেঢালা ভাব, দোকান কর্মচারীদের বারান্দায় বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডার নমুনা দেখে মনে হচ্ছে বেশ খানিকক্ষণই বাতি নেই এধারটিতে। ‘সংযোগে’র সামনে যখন সাইকেল থেকে নামল সুশীল, তখন দোকানের সামনে বারান্দায় বসানো দুটো চেয়ারের একটা খালি। আরেকটাতে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। মাথায় পাকা চুলগুলো কিঞ্চিৎ এলোমেলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাছে আসতে চিনতে পারল সুশীল। মিহির রায়। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কামরুল। মিহির রায় জানান আমেরিকায় একটি ফ্যাক্স করতে এসেছিলেন। তার ভাইপো নির্মল মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু দলিল এই বইটি থেকে ফটোকপি করে পাঠাতে বলেছে, কলেজের কী পেপার লিখতে হবে। বলেই হাতের মোটা বইটি উঁচিয়ে ধরে দেখান সুশীলকে। সেটা করতেই এসেছিলেন। এখন বিদ্যুৎ আসার অপেক্ষায় বসে আছেন। পাশের চেয়ারটিতে বসে পড়ে সুশীল। ‘কেমন আছেন কাকাবাবু?’ অনেকদিন পর দেখা মিহির রায়ের সঙ্গে। কথাটির জন্যে যেন প্রস্তুত হয়েছিলেন মিহির রায়। জানান, ভালো আছেন, খুবই ভালো আছেন তিনি। কন্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন কলকাতা। মা-বাপ মরা একমাত্র ভাইপোকে পাঠিয়েছেন আমেরিকায় পড়তে। তার জন্যে অবশ্য বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন দুই বুড়োবুড়ি ভাড়া বাড়িতে মহাশান্তিতে আছেন। মিহির রায় হাসেন। শিশুর মতো শব্দ করে হেসে বলেন, ‘এদেশে মেয়ে আর জায়গা- জমি না থাকলে খুব শান্তিতে থাকা যায়। বুঝলে তো বাবা, কোনো ঝামেলা নেই আর। খুব ভালো আছি।’

মিহির রায় কথা বলছেন আর অবিরত দুই পা ও হাঁটু নাড়াচ্ছেন অনিয়ন্ত্রিতভাবে। আসলেই কি খুব ভালো আছেন এককালের চৌকস উকিল মিহির রায়? সুশীলের অদম্য ইচ্ছা হয় মিহির রায়ের চলন্ত হাঁটু-দুটোকে দুই হাতে ধরে থামিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যান্য অনেক ইচ্ছার মতো এ ইচ্ছাটিও কার্যকর হয় না। সুশীল শুধু বুঝতে চেষ্টা করে কন্যাকে আর পুত্রসম ভ্রাতুষ্পুত্রকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কত শান্তিতে বসবাস করছেন মিহির রায়। বৃদ্ধের মাথাভর্তি সাদা লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে। পান খাওয়া লালচে দাঁতে ভরা হাসি হেসে বলেন, ‘একটু চা খেতে পারলে বেশ হতো। তাও তো সম্ভব না।’

মিহির রায়ের ধুলোয় ভরা স্যান্ডেলে আর ঈষৎ মলিন পায়জামা-পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে সুশীল ভাবে কর্মজীবন শেষ হয়ে গেলে মানুষ কি এমনি করে নিজের সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়ে?

‘ভেতরে আসুন কাকাবাবু। চায়ের ব্যবস্থা করা যাবে।’

সুশীলের দেওয়া লাল চা শেষ হতে না হতেই কারেন্ট এল। মিহির রায়ের আনা মুক্তিযুদ্ধের ওপর বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো নিজেই ফটোকপি করে দিল সুশীল। তারপর সেগুলো বহু যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত ফ্যাক্স করা হলো আমেরিকায়।

এসময়ে অন্যান্য দিন ব্যাবসা-বাণিজ্য মোটামুটি জমে যায়। কিন্তু আজ তেমন গ্রাহকের আনাগোনা নেই। ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া অন্যতম কারণ হবে হয়তো। হাতে সময় পাওয়ায় জমানো কাজগুলোই আজ শেষ করছে সুশীল। দুপুরের পর কিছু লোকজন আসতে শুরু করে। বেলা দুটোর দিকে ভট্-ভট্ আওয়াজ করতে করতে সেই পরিচিত মোটর সাইকেল এসে থামল ‘সংযোগ’-এর সামনে। দুটো নয়, একটা মোটর সাইকেল আজ। সাইকেল থেকে নামল কালা ফারুক আর সুভাষ। জুতোর মচমচ আওয়াজ করতে করতে দোকানে ঢুকল ওরা। ‘নমস্কার দাদা,’ ফারুকের সহাস্য সম্ভাষণ।

সুশীল চোখ তুলে তাকিয়ে একবার মাথা ঝাঁকায়। সম্ভাষণের দ্রুত উত্তর। ফারুকের গায়ে সেই কালো চামড়ার কোট। সুভাষ পড়েছে লাল টি-শার্ট। ‘দর্পনা সিমেনা হলে আইজ হুমায়ূন আহমেদের একটা সামাজিক সিনেমা দেখাইতাছে। খুবই নাকি ভালো। বৌদিরে লইয়া যাইতাছি সিনেমা দেখাইতে। মাহফুজাও যাইতাছে বৌদির লগে। আপনে তো ব্যস্ত। জানি যাইতে পারবেন না।’ ফারুক কেমন লাজুক লাজুক মুখ করে কথাগুলো বলে।

 সুশীল সামনের দরজার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা রিকশা। আর রিকশার ওপর চোখ ধাঁধানো নীল রঙের ওপর সাদা-সোনালি বুটির জামদানি শাড়ি। চুপচাপ বসে আছে তপতী। পাশে গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মাহফুজা। সুশীলের মনে হয় এ দৃশ্য বাস্তব নয়। তবু একবার ফারুকের দিকে একবার রিকশার দিকে তাকায় সে। কিছু বলে না।

একটু অপেক্ষা করার পর রিকশা থেকে নেমে দোকানে ঢোকে তপতী ও মাহফুজা। তপতীর কপালে নীল লম্বাটে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক। ওরা দুজন এদিকেই এগিয়ে আসছে।

কামরুল ঘরের ওপার থেকে ডাকছে সুশীলকে। ফটোকপি মেশিনটা আবার জ্যাম হয়ে গেছে। কামরুল কিছুতেই হদিস করতে পারছে না কোথায় আটকে আছে কাগজ। অথচ কাস্টমার অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

দরজার ঠিক ভেতরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ফারুক আর সুভাষ পরস্পরকে ঘুসি মারার মসকরা করছে আর হেসে হেসে নিচু স্বরে কী যেন বলছে, সুশীল শুনতে পারছে না। প্রায় আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষারত অন্য গ্রাহক তার সাতক্ষীরার লাইনটি আজ আদৌ পাওয়া যাবে কি-না জানতে চাইছে। জানালার পাশে এসে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়েছে গাঢ় নীল আর গোলাপি বিস্ময়।

সুশীল কাচের দরজা দিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকায়। অপেক্ষারত খালি রিকশাটির পাশে এসে থেমেছে একটা ঠেলাগাড়ি। বিশাল দুই চাকার সেই ঠেলাগাড়ির ওপর বাঁশ আর হোগলাপাতার পাটাতনটির এক ধার কাত করে বারান্দায় নামানো। ইস্টার্ন পেপার্সের তাজুল আর বাদল ধরাধরি করে কাগজের বাক্সগুলো নামাচ্ছে সেখান থেকে। এখুনি এই বাক্সগুলো সুশীলের দোকানে প্রবেশ করবে। আর মূর্তির মতো তাজুল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না সুশীল ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা বের করে দেয় তাকে। কামরুল আবারো ডাকে সুশীলকে। এবার সুশীল উঠে দাঁড়ায়। ফটোকপি মেশিনটির কাছে গিয়ে যন্ত্রটির ভেতর ঝুঁকে পড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কী খুঁজতে থাকে। প্রতিটি কম্পার্টমেন্ট একে একে খুলে দেখতে থাকে কোথায় জটলাটা বেঁধেছে। কিছু খুঁজে না পেয়ে আরো ভেতরে হাত দেয় সে। লিগ্যাল সাইজের কাগজের ট্রের ওপরের এক কোনাতেই ছেঁড়া কাগজটা শক্ত হয়ে আটকে আছে। টেনে বের করতে গিয়ে হাতে আবার কালি লেগে যায় সুশীলের। তবু শক্ত করে টান দেয় কাগজটা। ফুলহাতা শার্টের হাতার ডগাতেও কালি লেগে যায়। অনেক কষ্টে পেছনের দিকে দুটো আঙুল গলিয়ে এবড়োখেবড়ো কালিমাখা কাগজটি টেনে বের করতে গেলে খানিকটা ছেঁড়া অংশ কেবল চলে আসে সুশীলের হাতে। বাকি অংশ তখনো কঠিনভাবে আটকে থাকে ট্রের ছাদে। একেবারে পেছন দিকের অন্ধকারে শেষ টুকরোটি বের করার কসরত করতে গিয়ে থাক থাক করে রাখা ধবধবে সাদা কাগজগুলোর ওপরটাতেও কালি লেপ্টে দিতে থাকে সুশীল। ময়লা মোছার ন্যাকড়াটা দরকার। আটকে থাকা ছেঁড়া কাগজের অংশটুকু টানতে টানতে পরিচিত ন্যাকড়াটা খুঁজে বেড়ায় সুশীল।