চিনুয়া আচেবের উপন্যাস আত্মজিজ্ঞাসার আখ্যান

চিনুয়া আচেবের পাঁচটি উপন্যাসের প্রথমটি Things Fall Apart, এটি প্রকাশিত হয়েছে নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৮ সালে। No Longer at Ease (১৯৬০), Arrow of God (১৯৬৪) এবং  A  Man of the People (১৯৬৬) লেখা হয় স্বাধীনতা-উত্তর ষাটের দশকে। আর Anthills of the Savannah প্রকাশ পায় ১৯৮৭ সালে। উপন্যাসগুলো প্রকাশের সময় লক্ষ করলে এটি সহজেই অনুমেয় হয় যে, আচেবে সময়ের নাড়ি টিপে দেখেছেন, ঘটনা বিশেস্নষণ করেছেন রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে, সাক্ষী হয়েছেন দেশের ক্ষমতার পালাবদলের, সরকারের উত্থান-পতনের, জনগণের ব্যর্থতা ও হতাশার এবং ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্তথেকেই, তা তাঁর উপন্যাসগুলোর পরতে পরতে গেঁথে দিয়েছেন। সময়সচেতন লেখক হিসেবে দেখেছেন যে, আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম করেছেন স্পষ্টভাবেই ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে; কিন্তু তাদের তাড়িয়ে দিয়ে তদস্থানে কী কায়েম করতে চান তা তাঁরা নিজেরাই স্পষ্ট জানেন না। ফলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়, গোত্রবিবাদ উসকে যায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি বলে কিছু ঘটে না, সামাজিক ন্যায়বিচার অরণ্যে রোদন করে আর রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কম সচেতন সাধারণ জনতার আশা-আকাঙক্ষা নিমজ্জিত হয় নৈরাশ্যের অমানিশায় এবং তাদের দুর্বল প্রতিরোধ-প্রচেষ্টা উসকানি দেয় সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে। কাজেই ওত পেতে থাকা ক্ষমতালিপ্সু সামরিকজামত্মারা বারবার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। ছিনিয়ে নিয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এতকিছুর জন্য দায়ী কি শুধু ঔপনিবেশিকরা, নাকি অভ্যন্তরীণ নেতৃবৃন্দও? আত্মসমালোচনা বা আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা থেকেই এ-প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে এবং আচেবের অবস্থান এ-জায়গাতেই, যিনি ঔপনিবেশিকতাবিরোধী মনোভাবের জন্য বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত সেই চিনুয়া আচেবে তাঁর There was a country গ্রন্থটিতে নাইজার নদীর ভাটি অঞ্চলে ঔপনিবেশিকদের ফেলে যাওয়া নানা উপষঙ্গের ইতিবাচক দিক ও প্রাসঙ্গিকতার কথাও বলেছেন। এতে অনেক সমালোচক তাঁর ঔপনিবেশিকতাবিরোধী মনোভাব বা অবস্থান নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। ১৯৯০ সালে যখন আচেবে উলিস্নখিত গ্রন্থটি  প্রকাশ করেন, তখন তাঁর মাতৃভূমি নাইজেরিয়া সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তথাকথিত নির্বাচিত সরকার স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছরের মাথায় ব্যর্থ হয় এবং পরপর দুবার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নাইজেরিয়া সামরিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। নজিরবিহীন দুর্নীতি, নির্বাচনে অবাধ কারচুপি, স্থানীয় রাজনীতিকদের অসততা, অদক্ষতা ও জনগণের আশা-আকাঙক্ষার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধির ব্যর্থতা তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের পতন অনিবার্য করে তোলে।

১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর নাইজেরিয়া স্বাধীন হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে। সাধারণ জনতা আস্থা রাখে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর। কিন্তু  শিগগির তারা হতাশ হয়, যখন দেখে যে, তাদের রাজনীতিকরা বিদেশের ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়ছেন, বিদেশে বাড়ি কিনছেন আর স্থানীয় উৎপাদনমুখী সব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা গ্রহণ করেছে সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা ঠিকাদারির নামে। ফলে অচিরেই গণতন্ত্রের প্যারোডি নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হলো, যাতে স্থানীয় রাজনীতিকরা ভাঁড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নাইজেরীয় সরকারের সংজ্ঞা দাঁড়াল : নাইজেরীয় সরকার হলো ঠিকাদারদের সরকার, ঠিকাদারদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার এবং ঠিকাদারদের জন্য সরকার। এটি সত্যি সত্যি আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ ভাষণে’ উলিস্নখিত গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার সংজ্ঞারই প্যারোডি মাত্র। স্থানীয় রাজনীতিকগণ, যাঁদের কাছে জনগণ আশা করেছিল, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস ব্যবস্থা ও সার্বিক সচেতনতার আলোকে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন তাঁরাই সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত; তাদেরই উত্তরাধিকার বহন করছে। ফলে নয়া ঔপনিবেশিকতার একটা পাকাপোক্ত ভিত্তি স্বাধীনতা-উত্তর নাইজেরিয়ায় জেঁকে বসে। শুধু লোক পালটেছে, কিন্তু শাসননীতি একই রয়ে গেছে। নির্বাচনের নামে প্রহসন স্বাধীনতা-উত্তর নাইজেরিয়ায় এক অতিসাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় শুধু শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতির ওপর। গ্রামীণ অর্থনীতি, যা মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তা আদৌ কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। কৃষকও তখন ন্যাশনাল কেক বা রাষ্ট্রীয় সুবিধার একটু হলেও তা পাওয়ার আশায় ক্ষেতখামার ছেড়ে চলে আসতে থাকে শহরে। এখানে এসে নিপতিত হয় বেকারত্বের অমানিশায় আর বঞ্চনার গহবরে। গ্রামীণ অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়; বেড়ে যায় ধনী-গরিবের ব্যবধান। আকাশ-পাতাল। রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার জন্য জনগণের যে শিক্ষা ও মননের প্রশিক্ষণ দরকার তার কিছুই তারা পায় না তাদের নেতাদের কাছ থেকে। নেতারাও স্বাভাবিকভাবেই হতবিহবল জনগণের কাছ থেকে পায় না কোনো গঠনমূলক সমালোচনা। অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর নাইজেরিয়ার জনগণের নেতারা যেমন পারে না গণতান্ত্রিকভাবে সচেতন জনগণ তৈরি করতে, তেমনি জনগণও পারে না গঠনমূলক সমালোচনা করে সামর্থ্যবান নেতা তৈরি করতে। ব্যর্থতার পালস্না উভয় পক্ষেই সমান। কাজেই পরিস্থিতি ল-ভ-। সুযোগ নেয় সামরিক বাহিনী। এই যে রাজনৈতিক সরকারের ব্যর্থতা এবং গণতন্ত্রের অপঘাত – এর জন্য ঔপনিবেশিকতা ও নয়া ঔপনিবেশিকতা কতটা দায়ী? দায় কি শুধু বাইরের? ভেতরের দায় কতটুকু? এই আত্মজিজ্ঞাসার জায়গাতেই চিনুয়া আচেবের অবস্থান। তাঁর কাছেই যেতে হবে আমাদের। কারণ তিনি ছাড়া নাইজেরীয়দের গল্প, অবস্থা ও অবস্থান – সেটা সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটেই হোক আর রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই হোক – আর কেউ এতটা বিশেস্নষণী দৃষ্টিতে বর্ণনা করেননি।

চিনুয়া আচেবের Things Fall Apart প্রকাশিত হয় নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার দুই বছর আগেই, ১৯৫৮ সালে। আফ্রিকার সাহিত্য যে ইংরেজি ভাষায় লেখা যায়, তাও আবার স্থানীয় ইগবো ভাষার শব্দবিন্যাস ব্যবহার করে, তা দেখাতে আচেবে মুন্শিয়ানার পরিচয় দেন এ-উপন্যাসে। ইগবো প্রবাদপ্রবচন, কল্পচিত্র, ঐতিহ্য, আচরণ ও বিশ্বাস ব্যবস্থার প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাসযোগ্য ছবি তিনি অঙ্কন করেন এ-গ্রন্থে। আফ্রিকার পশ্চিমাকরণের প্রক্রিয়ায় পশ্চিমাদের দুরভিসন্ধির একটি প্রতি-বয়ান হিসেবে আচেবে সফলভাবে আফ্রিকানাইজেশন বা আফ্রিকাকে আফ্রিকীয়করণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। যদিও তাঁর আগেই কিছু আফ্রিকান লেখক ইংরেজিতে লেখালেখি শুরু করেন, তবু আচেবের Things Fall Apart প্রকাশনার মধ্য দিয়েই আফ্রিকার সাহিত্য বিশ্বপাঠক-হৃদয়ে মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠে। অ্যামোস তুতুওলা, পিটার আব্রাহাম্স, সল পস্নাটজি এবং সাইপ্রিয়ান একওয়েনসি ইংরেজি ভাষাকে আফ্রিকীয় সাহিত্যের মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু অচিরেই Things Fall Apart প্রকাশের মধ্যে দিয়েই আফ্রিকীয় সাহিত্য আফ্রিকা ও আফ্রিকার বাইরের মহাদেশসমূহে গুরুত্বপূর্ণ পাঠের বিষয় হয়ে ওঠে। এর কারণ হলো, আচেবের এ-উপন্যাস আফ্রিকাকে এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে ধারণ করে যে, পাঠক (তা আফ্রিকার ভেতরের হোক বা আফ্রিকার বাইরের হোক) এবং আফ্রিকার মধ্যে আচেবে এক অপরিহার্য সেতুবন্ধ হয়ে উঠেছেন।

তাঁর পরবর্তী আরো চারটি উপন্যাস – No Longer at Ease, Arrow of God, A Man of the People এবং Anthills of the Savannah আফ্রিকার ঔপনিবেশিক যুগ থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ বা নয়া ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত বিসত্মৃত ইতিহাসের বিশ্বস্তপ্রতিফলক। বিষয়বস্ত্ত ও নান্দনিকতার দিক থেকে আচেবের উপন্যাসগুলো ইউরোপীয় ও আফ্রিকীয় সংস্কৃতির সংশেস্নষণের ফলে উদ্ভূত টানাপড়েন, পরিচয়-সংকট, ‘আত্ম’ বা ‘নিজ’ কীভাবে ‘অপর’-এ পরিবর্তিত হচ্ছে – তার বহিরাঙ্গিক, অভ্যন্তরীণ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশেস্নষণ অত্যন্ত জোরালোভাবে এবং ইতিহাসের কাছে বিশ্বস্তথেকে উপস্থাপন করে।

বিষয়বস্ত্তর ভিত্তিতে আচেবের উপন্যাসগুলো দুভাগে বিভক্ত। এক অংশে অঙ্কিত হয়েছে ঔপনিবেশিকদের আগমনের আগের ইগবো সমাজকাঠামো, স্বদেশি ভাবনা, বিশ্বাস ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি, অপর অংশে অঙ্কিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ও স্থানীয়দের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ও এর প্রভাবে স্থানীয়দের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা হারানোর যাতনা এবং বিশৃঙ্খলার ছবি যার প্রভাবে ঔপনিবেশিকদের প্রস্থানের পরও স্থানীয় ব্যবস্থাসমূহের ব্যর্থতার স্রোত প্রবহমান থাকে।

ঔপনিবেশিকদের আগমনে আফ্রিকীয় সমাজ বদলাতে থাকে দ্রম্নত। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে এরা স্থানীয় সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করে কুসংস্কার হিসেবে। সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয় পশ্চিমারা। তারা এলিমিনেশন বা উৎখাতে বিশ্বাসী। কিন্তু স্থানীয়রা নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেবে কেন? গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। স্থানীয়দের দিক থেকে এই প্রতিরোধের পুরোটাই শারীরিক শক্তিমত্তাভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। ফলে স্থানীয়রা পেরে ওঠে না। এই অসফল প্রতিরোধের যথার্থ ছবি অঙ্কন করা হয়েছে Things Fall Apart  -এর ওকোনকো চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তার শরীরে শক্তি আছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে পরাসেত্মর মাথা কেটে নিয়ে আসে। অ্যামলিঞ্জ নামে দুর্দমনীয় কুসিত্মগিরকে সে ধরাশায়ী করে আশপাশের নয়টি গ্রামের মধ্যে অদ্বিতীয় বীরপুরুষের খ্যাতি লাভ করেছে। নারীসুলভ ও কপর্দকহীন পিতার সমত্মান হওয়া সত্ত্বেও সে শূন্য থেকে পূর্ণ গোলার অধিকারী হয়েছে। তিনজন স্ত্রীর ভরণপোষণ করে সে। কিন্তু ঔপনিবেশিকদের দুর্দমনীয় প্রসার ও কর্মকা–র বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ঔপনিবেশিক সমস্যাকে ইন্টেলেকচুয়ালাইজ না করে করেছে ইমোশনালাইজ। এ ছাড়া তার অন্য কিছু করার সামর্থ্যও নেই। গ্রামের যারা মিশনারিদের পক্ষাবলম্বন করছিল, তাদের ফেরানোর মতো জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থানও তার নেই। এমনকি তার ছেলে নোয়ীকেও সে ফেরাতে পারেনি। স্ত্রীকে সপ্তাহের পবিত্র দিনে প্রহার করে ঐতিহ্যও ভঙ্গ করেছে। তার বন্ধু ওবিয়েরিকার পরামর্শ উপেক্ষা করে পালক পুত্র ইকেমুফুনাকে হত্যা করে প্রমাণ করেছে যে, তার কাছে ঐতিহ্য মানবিকতার ঊর্ধ্বে। এমনসব স্ববিরোধিতার চরম পরিণতিতে সে করেছে আত্মহত্যা। তার আত্মহননকে ট্র্যাজেডি বলা বেশ কঠিনই, তার পতন করুণা ও ভীতির উদ্রেক করে না সেভাবে, যেভাবে গ্রিক নাটকের বীরেরা করে থাকে। এভাবে এ-উপন্যাসে আচেবে আফ্রিকীয় সমাজের পরাজয়ের চিত্রই অঙ্কন করেছেন। এই পরাজয় ঔপনিবেশিক প্রপঞ্চের কাছে এবং নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতার কাছে।

আচেবে বেশ জোরালোভাবেই তাঁর প্রভাবশালী প্রবন্ধ ‘The Role of the Writer in a New Nation’-এ উলেস্নখ করেছেন যে, আফ্রিকীয়রা প্রথমবারের মতো ইউরোপীয়দের কাছ থেকে   সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে শুনেছে তা নয়। আসলে তাদের নিজেদেরই আছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। যদি তাই হয়, তবে কেন তার ওকোনকো ব্যর্থ হলো পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। এর উত্তর আচেবে দিয়েছেন আত্মসমালোচকের ভূমিকা গ্রহণ করে। আফ্রিকীয়রা নিজেরাই যে শতধাবিভক্ত ছিল তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে, তাও আচেবে দেখিয়েছেন। ওকোনকোর বন্ধু ওবিয়েরিকাকে অঙ্কন করা হয়েছে গ্রিক নাটকের কোরাসের অনুকরণে। সে ওকোনকোর সমালোচনা করে। ওকোনকো যখন  কোর্টের সংবাদবাহককে হত্যা করে, তখন যারা কিছুক্ষণ আগেও তার সঙ্গে আছে বলে সমস্বরে ঘোষণা করেছিল, তাদের ঘটনাস্থল ত্যাগ বা পলায়ন আফ্রিকীয় সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ বিভেদ বা বিচ্ছেদের চিত্রই অঙ্কন করে। তাহলে ওকোনকোর আত্মহত্যা কি তার এই উপলব্ধির দ্বারা ত্বরান্বিত হয়েছিল? সম্ভবত সেটা প্রধানতম কারণ না হলেও অন্যতম প্রধান কারণ। এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের ‘বিভাজন করো, শাসন করো’ – নীতির বাস্তবায়নের রসদ জোগায়।

ইতিহাসসচেতন লেখক হিসেবে আচেবে তাঁর Things Fall Apart উপন্যাসে পিতৃতান্ত্রিকতার ক্ষয়িষ্ণু রূপও তুলে ধরতে  ভোলেননি। ওকোনকো যে পিতৃতান্ত্রিক অবস্থান উপভোগ করতে আত্মপ্রসাদ উপলব্ধি করে তা যে বহুলাংশেই সংকটাপন্ন, তা সে উপলব্ধি করেছে অনেক পরে। সে কঠোরতাকে পিতৃতান্ত্রিকতার সমার্থক মনে করে। সে মনে করে, কঠোরতা হলো পুরুষের গুণ, আর দয়া, মমতা, মার্জনা হলো নারীর গুণ। সে আপন চরিত্রকে ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’ এই দুই মাপকাঠিতে ভাগ করতে গিয়ে মানবতা বা মানবিকতার বিষয়টা সম্পূর্ণরূপেই বিস্মৃত হয়েছে। তাই সে বুঝতে পারেনি যে, তার  দ্বিতীয় স্ত্রী একওয়েফি কোন শক্তির প্রভাবে তার প্রথম স্বামীর সংসার ত্যাগ করে তার প্রেমিক ওকোনকোর ঘরে চলে এসেছে এবং তার স্ত্রী হিসেবে সংসারধর্ম পালন করছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে গিয়ে একওয়েফির এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাহসী এবং এটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে এক প্রতি-প্রপঞ্চ তৈরির ক্ষেত্রও প্রস্ত্তত করে। যে ওকোনকো সর্বদা ‘আগবালা’ বা ‘নারীসুলভ’ হওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্তথাকে, তার পক্ষে তার স্ত্রীর এহেন কাজের মর্মার্থ বা Female power বা নারীশক্তির গূঢ় অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এটিও তাকে তার অপরিহার্য পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। তার অবিবেচক কঠোরতাই তাকে ইকেমেফুনাকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর তার ছেলে নোয়ীর ধর্মান্তরিত হওয়ার পেছনে এ-হত্যাকা- তার মনস্তত্ত্বে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে তা উপলব্ধি করতেও ওকোনকো পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।

এসব ব্যর্থতার মাঝে থেকে ওকোনকো একটা ইউটোপিয়া বা কল্পরাজ্য তৈরি করেছে, যেখানে সে নিজেকে ভাবে সর্বেসর্বা। এই ভাবনা যখন কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন সে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। তবে তা জ্ঞানতাত্ত্বিক বা যুক্তিনির্ভর নয়; শারীরিক শক্তিনির্ভর। আর তখনই বাধে বিপত্তি। পশ্চিমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঔপনিবেশিক কর্মকা–র বিরুদ্ধে স্থানীয়দের শারীরিক শক্তিনির্ভর প্রতিরোধ খুবই দুর্বল। স্থানীয়দের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল তৈরির রসদও আছে ঔপনিবেশিকদের। তাদের ভাষা আছে, বর্ণমালা আছে। সাহিত্যও আছে এবং তা শুধু মৌখিক নয়, লৈখিকও। কিন্তু ওকোনকোর শুধু বন্দুক আছে, যার সে অপব্যবহারও করেছে। ইজিউডুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ওকোনকোর বন্দুক থেকেই ছুটে চলা বুলেট প্রাণ হরণ করে এক ষোলো বছর বয়সী কিশোরের। সেই কিশোর ইজিউডুরই পুত্র। স্বগোত্রীয়কে হত্যার অপরাধে তাকে সেই রাতেই স্ব-নির্বাসনে যেতে হয় সপরিবারে পাশের গ্রাম মুবামত্মায়। দীর্ঘ সাত বছর কাটাতে হয় সেখানে। সাত বছর পর ফিরে এসে ওকোনকো যা দেখল তাতে তার স্বপ্নরাজ্য ভেঙে পড়ল। তার নিজ সমত্মান নোয়ী এখন একজন লেখাপড়া জানা খ্রিষ্টান। পিতৃপক্ষ ত্যাগ করে পিতার শত্রম্নর পক্ষাবলম্বন করেছে। অনেকেই তাদের সমত্মানদের মিশনারি স্কুলে পাঠায়। কেউ কেউ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। ওকোনকো মানতে পারে না। ওকোনকো সময় ও পরিবর্তন উভয়েরই বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এই দাঁড়ানোর শক্তির উৎস তার আবেগ, বিবেক নয়। স্বভাবতই পরাজয় নিশ্চিত। ওকোনকো ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে ঐতিহ্য ভেঙেছে বেশি। ইজিউডুর সমত্মানকে হত্যা করে সে ঐতিহ্য ভেঙেছে। পবিত্র সপ্তাহে স্ত্রীকে প্রহার করে নিজের ঐতিহ্যেরই বিরুদ্ধে গেছে। ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে ইকেমেফুনাকে হত্যা করেছে। ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। সর্বশেষ, আত্মহত্যা করে সে তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরুদ্ধ কাজই করেছে। ঐতিহ্য তাকে অস্পৃশ্য ঘোষণা করেছে। তার জন্য প্রথাসিদ্ধ কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হবে না, যেহেতু সে ‘কুকুরের মৃত্যু’ বরণ করেছে।

আসলে ওকোনকোর আদ্যপান্ত সংগ্রামটিই শেস্নষে ভরা। ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রামে সে শেস্নষাত্মকভাবে ঐতিহ্যকেই সংকটে ফেলে দিয়েছে। আর এই সংকটের সিঁড়ি বেয়েই উঠে এসেছে ঔপনিবেশিকতার কুশীলবরা এবং জেঁকে বসেছে স্থানীয়দের সংস্কৃতি, ভাষা ও ভাবনার জগতে। ধ্বংস করেছে অভ্যন্তরীণ ঐক্য, তৈরি করেছে বিশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের কাছে আফ্রিকাকে উপস্থাপন করেছে এমন এক পরিচয়হীন সত্তা হিসেবে, যার উদ্ধারকর্তা হিসেবে ঔপনিবেশিকরা নিজেদের হাজির করেছে দুরভিসন্ধির সব রূপ ও রং মেখে। আফ্রিকার আখ্যান তৈরি করে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা ঠিক রেখে, Things Fall Apart-এর ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের মতো, যার চোখে ওকোনকোদের সবাই প্রিমিটিভ বা বন্য, যাদের নিজেদের নেই কোনো সভ্যতা, কোনো শিক্ষা, কোনো পরিচয়! কি নগ্ন রাজনীতি!

আচেবের দ্বিতীয় উপন্যাস No Longer at Ease প্রথম উপন্যাসের কাহিনিরই extension বা বর্ধিতাংশ। এ-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওবি Things Fall Apart-এর প্রধান চরিত্র ওকোনকোর নাতি। উয়োমুয়োফিয়া প্রগ্রেসিভ ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় ইংল্যান্ডে যায় আইন বিষয় নিয়ে পড়তে; কিন্তু পড়ে সে ইংরেজি সাহিত্য। চার বছর পরে ফিরে আসে ম্যাকলের মিমিক ম্যান বা ইংরেজ অনুকরণে পুরোদস্ত্তর নকল মানুষ হিসেবে। সে মূলত ইগবো কিন্তু লেখাপড়া, পোশাক-আশাক এবং এমনকি ক্লারার সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে ঔপনিবেশিকদের মানসিকতার বাঁধা ছকে। তার বাবা ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। গির্জায় যায় নিয়মিত। গির্জার ভাতায় সংসার চালায়; কিন্তু অতীত-ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্নে সে ইগবো। তাই তার ছেলে ক্লারাকে বিয়ে করুক এবং এতে জাত নষ্ট হোক তা সে হতে দেবে না। তার মা মৃত্যুশয্যায় ছেলেকে কঠোরভাবে নিষেধ করে ক্লারাকে বিয়ে করতে। কারণ সে Osu বা অজাত। ওবি নিজেও খ্রিষ্টান, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কেতাদুরস্তভদ্রলোক; কিন্তু পড়ে গেছে দ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্ব তার স্থানীয় সংস্কৃতি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যে। এই দুটোর কোনোটাই সে না পারে ছাড়তে, না পারে শক্ত করে ধরতে। নানান টানাপড়েনে স্কলারশিপ বোর্ডের চাকরিতে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে। সম্মুখীন হয় বিচারের। ঘুষ গ্রহণের বিচার হয়তো করা সম্ভব আদালতের মাধ্যমে; কিন্তু ঔপনিবেশিকদের শিক্ষায় শিক্ষিত উঠতি স্থানীয় বুর্জোয়া শ্রেণির পোশাক-আশাক, ভাষা-ভাবনা, চেতনা ও সাহেবি হালচাল অনুকরণের যে মনস্তাত্ত্বিক লিপ্ততা তার বিচার বা রোধ কীভাবে সম্ভব? এই আকাঙক্ষার প্রেষণা তো ভেতরেই উদ্ভূত। বাহিরকে দোষারোপ করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সম্পর্ক যখন একপক্ষীয় হয়, তখন অন্যপক্ষের জন্য তা নিপীড়নে রূপ নেয়। সেখান থেকে তখন প্রতিশোধপরায়ণতার জন্ম হয়। সম্পর্ক হয় তেতো। কিন্তু পশ্চিম যে শুধু ওবির ওপর চেপে বসেছে, তা নয়। ওবিও কিন্তু পশ্চিমকে accomodate করেছে। মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু তার বড় ত্রম্নটি হলো, সে তার সীমাবদ্ধতা ভুলে  গেছে। ইয়োজিন ও নেইলের Hairy Ape নাটকের ইয়াংকের মতো। গরিলার খাঁচায় ঢুকে তাকে আলিঙ্গন করার মতো। কিন্তু গরিলার পালটা আলিঙ্গনের ধকল সামলানোর শারীরিক সামর্থ্য তার তো নেই। এই সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে তার কোনো ভাবনাও নেই। স্বভাবতই মিথস্ক্রিয়া পরিণত হয় নিপীড়নে। পরিণতিতে ইয়াংকে ভবলীলা সাঙ্গ করতে হয়।

আচেবের ওবি ভবলীলা সাঙ্গ করে না; কিন্তু আহত হয়। তার ধ্যান-ধারণাগুলো হয় ক্ষতবিক্ষত। ধর্ম আর ঐতিহ্য যে ভিন্ন দুটি উপকরণ এবং এ দুয়ের মধ্যে যে পরেরটিই বেশি শক্তিধর তা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে, যখন সে তার কাছ থেকে ক্লারাকে বিয়ে করার সম্মতি আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার মায়ের কাছেও সে এটিই শেখে। যখন শেখে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আসলে ‘He suffers from a sense of divided loyalty…’ (Mukherjee 95). এই দ্বিধাবিভক্ত মনস্তত্ত্ব ওবির পরাজয় অপরিহার্য করে তোলে।

‘ইউমুয়োফিয়া প্রগ্রেসিভ ইউনিয়নের’ সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব কিন্তু    সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের জায়গাতেই। আসলে, ধর্ম বাইরে থেকে চাপানো যায়। শিক্ষা বা ভাষাও চাপানো যায়। কিন্তু ঐতিহ্য তো রাতারাতি তৈরি হয় না। এটি বছর, যুগ, শতাব্দী ও সহস্রাব্দ ধরে তৈরি হয় এবং একটা জাতি বা সম্প্রদায়ের পরিচয়ের প্রধানতম স্মারক হিসেবে কাজ করে। ঐতিহ্য বদলে গেলে বা হারিয়ে গেলে তো পরিচয়ও হারিয়ে যায়। এই বোধের অভাবই ওবির ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ।

ওবির বাবা আইজাক ওকোনকো একজন নিবেদিতপ্রাণ খ্রিষ্টান। তার গির্জার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ঔপনিবেশিকদের শিক্ষায় সমত্মানকে শিক্ষাদানের আগ্রহ এতটাই একনিষ্ঠ যে, ওবি ইগবো লোককাহিনি পর্যন্ত শোনেনি বা জানে না। আইজাক তার ছেলেকে পুরোপুরিভাবেই পশ্চিমা শিক্ষা দিয়েছেন, এতটাই পশ্চিম-ঘনিষ্ঠভাবে যে, তিনি তাঁর ছেলেকে প্রত্যক্ষভাবেই নিজস্ব ও স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তাই ওবি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে স্কুলেও, আবার ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েও। মাতৃভূমির জন্য তার মন পোড়ায়। স্বদেশি কারো সঙ্গে দেখা হলে ইগবো ভাষায় কথা বলে। রোমাঞ্চিত বোধ করে। ইংল্যান্ডে তার স্বদেশি কেউ যদি ইগবো ভাষায় কথা না বলে ইংরেজি বলে, তবে সে লজ্জিত বোধ করে। ওবির মধ্যকার এ আত্মবৈপরীত্যও তাকে অস্বসিত্মতে ফেলেছে। সে পর্যুদস্তহয়েছে আত্মপরিচয় নির্মাণের সংগ্রামে। তার বাবা আইজাকও পরাস্তহয়েছে। ছেলেকে না পেরেছে ঔপনিবেশিকদের ছাঁচে তৈরি করতে, না পেরেছে আত্মপরিচয়ের শিকড় আঁকড়ে রাখতে। ওবির মা ঘর-গেরস্তালির পরিবেশে ধারণ করেছে ঔপনিবেশকিদের ধর্ম-প্রথা কিন্তু মনস্তত্ত্বে লালন করেছে ইগবো সংস্কার। দুয়ের মাঝে এ এক বিশাল ফাটল। এই ফাটলের মাঝেই পড়ে পরাজয় ঘটেছে ওবির। পরাজয় ঘটেছে তার বাবা ও মায়ের। আর এ-পরাজয়ের গহবর থেকেই উত্থান হয়েছে ঔপনিবেশিকতার প্রতি দাসত্বের প্রবণতার।

আচেবের Arrow of God প্রকাশ পায় ১৯৬৪ সালে, ঔপনিবেশিকোত্তর নাইজেরিয়ার গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা যখন নানান সংকটের মধ্য দিয়ে অপমৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে ১৯৬৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট বিশের দশকে। ইজুলু ছয়টা ইগবো গ্রামের প্রধান ধর্মযাজক। আপাতত মনে হয়, তার সংঘাত ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে এবং খ্রিষ্টান মিশনারির বিরুদ্ধে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, এ-সংঘাত ইগবো সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ ডামাডোলের অনিবার্য বহিঃপ্রকাশও বটে। এই সংঘাতের কেন্দ্রে আছে ক্ষমতার বাসনা। ইজুলু চেয়েছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা তার গোত্রের ওপর। কিন্তু ব্যাপক অর্থে, এই সংঘাত তো শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়। এই সংঘাত কিন্তু ব্যক্তির ভেতরের সঙ্গে বাইরের, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, ঐতিহ্যের সঙ্গে অপরিহার্য পরিবর্তনের।

ইজুলু নিজে একজন ব্যক্তি, কিন্তু নিজেকে সমাজের চাইতে বেশি শক্তিধর ভেবেছে। সে মুখোশনৃত্যের নটরাজ হয়ে মুখোশ পরেছে। ঢাকতে চেয়েছে ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা মুখোশের আড়ালে। কিন্তু তা খসে পড়েছে। বিতর্কিত জমি ওকপেরিকে দিয়ে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত তার সম্প্রদায়ের কাউকে খুশি করেনি। এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে তার নিজেরই সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সে উলুর পূজারি। কিন্তু পৃথিবীর হালচাল কোথায় যাচ্ছে তা বোঝার জন্য চোখ-কান খোলা রাখায় বিশ্বাসী। এক ছেলেকে মিশনারিদের স্কুলেও পাঠিয়েছে। ঔপনিবেশিকদের জ্ঞান ও ক্ষমতার মূলমন্ত্র শিখতে হয়েছে তাকে চোখ ও কান খোলা রেখে; কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সে সমাজ পরিবর্তনে সমাজকাঠামো পরিবর্তনের ব্যাপারে উৎসুক; কিন্তু উলুর পরিবর্তন বা তার ক্ষমতার পরিবর্তন মেনে নেওয়ার পক্ষে নয়। উমুয়ারোর ছয়টি গ্রামকে সে একত্রিত করেছে এক সুতায়। এই সুতাটিই হলো তার দেবতা উলু। পরাক্রমশালী। কিন্তু সে পারেনি নিজেদের মধ্যকার ভাঙন ঠেকাতে।

ইদিমিলির পূজারি ইজিদিমিলির সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চরমে। প্রভাবশালী নওকা ইজিদিমিলির পক্ষ নেয়। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে, যখন ইজুলুর ছেলে ওদুচির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ‘অজগর’ হত্যার চেষ্টা করার জন্য। এই অজগর ইদিমিলির পবিত্র প্রতীক। কাজেই খবর পৌঁছে যায় ইজিদিমিলির কাছে। সে চায় ইজুলু তার সমত্মানের এহেন ধৃষ্টতার বিচার করবে। কিন্তু ইজুলু বিচার করে না। এতে দ্বন্দ্ব আরো তীব্র ও প্রকাশ্য রূপ নেয়। নিজ গোত্রের মধ্যেও ইজুলুর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শাসক হিসেবে হয়ে পড়ে দুর্বল।

তার এই দুর্বল হয়ে পড়ার প্রক্রিয়া তো শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, যখন ওকপেরির সঙ্গে একখ- জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধলে সে উমুয়ারোর পক্ষে রায় না দিয়ে তা দেয় ওকপেরির পক্ষে। নিজের লোকদের কাছেই সে আস্থা হারায়। এ রায় প্রদানের পশ্চাতে হয়তো তার অবচেতন মনে ঔপনিবেশিকদের প্রতিনিধি উইন্টার বটমকে খুশি করার বাসনাও উপ্ত ছিল। এ বাসনাও তাকে দুর্বল করেছে। তাই উইন্টার বটমের পরোক্ষ শাসক হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে যখন সে হাজতে বন্দি ছিল তখন তার গোত্রের কেউই এগিয়ে যায়নি তাকে উদ্ধারে। এই ঘটনা স্থানীয়দের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভাজনের চিত্র তুলে ধরে, যা ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মারাত্মক দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণও নির্দেশ করে। ইজুলুর সবিশেষ প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা, তাও আবার স্বজাতিরই ওপর ব্যর্থ হয়েছে। সে ইয়াম খায়নি। ফসল ঘরে তোলার উৎসবের সূচনাও করেনি। তাই বলে তার স্বজাতির লোকজন বসেও থাকেনি। তারা অপেক্ষাকৃত কম কঠোর ও উদারপন্থী ঔপনিবেশিকদের কাছে ছুটে গেছে। ইজুলুর ক্ষমতা ধূলিস্যাৎ হয়েছে। অপর পক্ষে, ঔপনিবেশিকদের অবস্থান স্থানীয়দের মধ্যে আরো দৃঢ় হয়েছে।

একইভাবে আচেবের A Man of the People উপন্যাসও আত্মসমালোচনার আখ্যান। ঔপনিবেশিকদের প্রস্থানের পর স্থানীয়রা কীভাবে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের নিজস্ব প্রপঞ্চ তৈরি করতে তার উত্তর পাওয়া যায় এ-উপন্যাসে। ঔপনিবেশিকরা চলে গেছে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬০ সালে নাইজেরিয়া থেকে। কিন্তু মাত্র ছয় বছর পরেই ১৯৬৬ সালে পরপর দুবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এটি গণতন্ত্রের ব্যর্থতারই অপরিহার্য ফল। লাগামহীন দুর্নীতি, ভোটব্যবস্থায় জালিয়াতি, স্থানীয় রাজনীতিকদের ঔপনিবেশিকদের ফেলা যাওয়া এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা, স্থানীয় সম্পদের ইজারা দেওয়া – তাও আবার সাবেক ঔপনিবেশিকদের কাছেই এবং সর্বোপরি স্থানীয় সাধারণ মানুষেরও রাজনৈতিক অসচেতনতা নাইজেরিয়াকে অপরিহার্যভাবেই সামরিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। এখানে ব্যর্থতা একপক্ষীয় নয়, দ্বিপক্ষীয়। এখানে নেতারা যেমন ব্যর্থ হয় সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে, তেমনি সাধারণ মানুষও ব্যর্থ হয় তাদের রাজনৈতিক নেতাদের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে রাখতে। ফলে, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে নয়, ঔপনিবেশিকতার উত্থান পর্ব এই দুপক্ষের ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। আচেবে এই চিত্রই দেখিয়েছেন ওই উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এদের একজন হলো নানগা, যিনি প্রথমদিকে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। বর্তমানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রী, আগাগোড়াই যিনি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। অপরজন হলো তারই প্রাক্তন ছাত্র ওডিলি। নীতি-নৈতিকতায় প্রখর হলেও ব্যর্থ হয় নানগার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনমত তৈরি করতে। উভয় পক্ষের ব্যর্থতায় অপরিহার্যভাবেই উপন্যাসের শেষে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অঙ্কিত হয়েছে।

আচেবের Anthills of the Savannah প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তাঁর  A Man of the People  প্রকাশের দীর্ঘ একুশ বছর পরে। এ বছরই বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় উপন্যাসটি। উপন্যাসের ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয় পশ্চিম আফ্রিকার কাল্পনিক কাংগান রাষ্ট্রে। তিন বন্ধু স্যাম, ক্রিস ও ইকেম সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করেছে। স্যামের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান যন্ত্র। ক্রিস সরকারের তথ্য কমিশনের প্রধান। আর ইকেম সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং সরকারের সমালোচক। স্ত্ততি তো উপভোগ করা যায়। সমালোচনা তো সহ্যই করা যায় না। ঘটনাপ্রবাহের একপর্যায়ে ইকেম খুন হয়। ক্রিসও খুন হয়। তাঁর আত্মোপলব্ধি ও লিখনীর মাধ্যমে সরকার পতন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরিশেষে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্যামের পতন ও মৃত্যু ঘটে। এই উপন্যাসের কল্পিত কাংগান রাষ্ট্র নাইজেরিয়াই স্বাধীনতা-উত্তর সরকারসমূহের (তা গণতান্ত্রিকই হোক আর সামরিকই হোক) ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে।

পৃথিবীর অনেক দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক আধিপত্যমুক্ত হয়। এগুলোর অনেকগুলোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চর্চা ও লালন করে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দিকে সফলভাবে অগ্রসর হয়েছে ও হচ্ছে। আর কিছু দেশ নয়া-ঔপনিবেশিকতার চোরাবালিতে আটকে আছে। আজো কি নাইজেরিয়া পেরেছে একটি জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা বা National culture-এর ধারণা তৈরি করতে? এ প্রসঙ্গে Tony E. Afejuku বলেন : ‘We have our diverse ethnical cultures, but because of who we rightly are, our multi-ethnical standpoints have not sowed (and are not sowing) in us a sense of a national culture’. এ-কাজটি করতে পেরেছে ভারত। বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির মহাসমারোহ বিরাজ করলেও ভারত সবাইকে জাতীয় সংস্কৃতির, ভাষার ও জাতীয়তাবোধের একই সুতায় গেঁথে ফেলতে পেরেছে সফলভাবে। নাইজেরিয়া পারেনি। স্থানীয় অনেক ভাষা থাকলেও লিঙ্গুয়াফ্রাংকা হিসেবে ঔপনিবেশিকদের ইংরেজিকেই বেছে নিয়েছে। এটিও তো স্বাধীনতা-উত্তর নাইজেরিয়ার অন্যতম বড় ব্যর্থতা। এর জন্য দায় কি শুধুই ঔপনিবেশিকদের, তাদের রেখে যাওয়া ব্যবস্থার, নাকি স্থানীয়দেরও, তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিভাজন, অব্যবস্থাপনা ও নিজস্ব প্রপঞ্চ তৈরির ব্যর্থতাও? আমার মনে হয়, আচেবে এ-জায়গাটাতেই তাঁর পাঠককে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে আহবান জানিয়েছেন।

 

তথ্যসূত্র

‘Language, Literature and Decolonization of Nigeria’s Political Culture’, Tony E. Afejuku, In Palavar : Procedings of the Forum for the scholars of African studies (vol. iv), Edited by Debarati Chakraborti and Kunal Chattopadhyay, Jadavpur University, 2016, Kolkata.

‘From Subordination to Emancipation : A study of the Second sex in Chinua Achebe’s No Longer of Ease’, Kalapi Sen Mukherjee, in Chinua Achebe perspectives, The Book World, 2009, Kolkata.