ছায়াখানি দিয়ে ছাওয়া হাসনাতভাই

একজন অসাধারণ ব্যক্তি, সাহিত্যিক, কবি, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক, সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা চলে গেলেন। আমাদের হাসনাতভাই।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং পরে বন্ধুত্ব ১৯৬৮ সাল থেকে। অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন হাসনাতভাই। গুণী, অমায়িক, বিনয়ী। ওঁর প্রচুর অবদান সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, নেপথ্যে অনেক কাজ করে গেছেন। নিজের কৃতিত্ব কোনো দিন নেননি, কাজটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আমি ভালোভাবে জেনেছি।

একাত্তরে বিজয়ের পর, জানুয়ারিতে যেদিন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় খুললো, এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল সবাই। বিজয়ের আনন্দ তো প্রবলভাবে ছিল, কিন্তু একটা থমথমে ভাব ছিল চারদিকে। অনেক শিক্ষক, অনেক ছাত্রছাত্রী আর কখনো ফিরে আসবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা সবাই তো নিজেদের কতজনকে হারিয়েছি, সেই ব্যথা তো ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় বসানো স্পিকারে শোনা যাচ্ছিল মুক্তির কথা, বিজয়ের কথা, যাঁদের হারিয়েছি তাঁদের কথা, কবিতা, গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত, প্রার্থনা ও ভক্তিমূলক গান, যাঁরা আর ফিরে আসবেন না, তাঁদের স্মরণে নিবেদন। এসব শুনে অনেকে তখন বলেছিলেন, মনের আর প্রাণের শান্তির জন্য এ-এক সুন্দর ও সার্থক প্রচেষ্টা ছিল। দেশে ও বিদেশে অনেক জায়গায় লেখা হয়েছিল সেই দিনটির কথা। এই পুরো আয়োজন হাসনাতভাইয়ের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় হয়েছিল। সেদিনের আগের সন্ধ্যায় হাসনাতভাই লিখতে বসেছিলেন, লেখা শেষ করতে করতে অনেক রাত, শেষ করেই তিনি আমার ওখানে চলে এলেন। দুটো রিল টু রিল টেপরেকর্ডার আর একটা রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে আমরা বসেছিলাম। তিনি লেখাটা পড়তে থাকলেন, আবৃত্তি হলো, সঙ্গে কোনো সময় সারেঙ্গি, কোনো সময় এস্রাজ, কোনো সময় বাঁশি, কোনো সময় সেতারের ঝালা ব্যাকগ্রাউন্ডে যোগ করা হলো। অনেক গান যুক্ত হলো। স্ক্রিপ্টের জন্য বেশ কিছু গান দরকার ছিল, তখনি গানগুলো গেয়ে রেকর্ড করা হলো। কতগুলো পুরনো রেকর্ড করা গান যোগ করা হলো।

কাজ শেষ করতে করতে সকাল আটটা বেজে গেল। আমরা রেকর্ডিং ও টেপরেকর্ডার নিয়ে কলাভবনে পৌঁছলাম। সারাদিন বারবার করে টেপ বাজলো। হাসনাতভাই কোনো সময় কোনো জায়গায় জাহির করেননি, এই সুন্দর কাজটার পেছনে তিনি ছিলেন, কেউ সেটা লেখেওনি, খুব কম লোকই সেটা জানে।

হাসনাতভাইয়ের পরিকল্পনা ও গ্রন্থনায়, গীতিনাট্য লাল গোলাপের জন্য ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়। এক প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী নাচের অংশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমার ওপর ভার ছিল গানের দিকটা দেখার। ১৯৭২-এর এপ্রিল মাসে ‘মৈত্রী মেলা’, কলকাতায় বড় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল দুই বাংলার কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও শিল্পীদের নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিশাল দল অংশ নিয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে লাল গোলাপের জন্য আবার মঞ্চস্থ হয়। অত্যন্ত সুন্দর হয়েছিল পরিবেশনা। দেশের ও কলকাতার খবরের কাগজে প্রশংসার ছড়াছড়ি, সাক্ষাৎকার নিয়েছিল কয়েকজনের। এক পত্রিকায় একজন বিশেষ অংশগ্রহণকারীর নাম নিয়ে হেডলাইন ছাপা হয়েছিল, ‘তিনি বেঁচে থাকবেন লাল গোলাপের জন্য।’ কোনো জায়গায় লেখা হয়নি গীতিনাট্যটি হাসনাতভাইয়ের রচনা, নাট্যরূপ দেওয়া এবং নির্দেশনা তাঁর। হাসনাত ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কেন নিজের কথা প্রকাশ করেন না। তিনি আমাকে বললেন, সুন্দর একটা পরিবেশনা মঞ্চে আনা গেল, দর্শকরা ভালো একটা আয়োজন দেখল, এটাই তো আসল। কেউ যদি এর কৃতিত্ব নেয়, নিক না!

হাসনাতভাই সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ছিলেন, ওঁর সঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ পেয়েছিলাম। কাছে থেকে তাঁকে দেখেছিলাম। একদিন তিনি হাতে লেখা একটা কাগজ আমাকে দিয়েছিলেন। একটা কবিতা? না, তিনি বললেন, পরিচয় সাহিত্য-পত্রে প্রকাশিত, We Shall Overcome Some Day…’ গানটার অনুবাদ, সিদ্ধেশ্বর সেনের করা। তখনি কাজে লেগে গিয়েছিলাম। গানের কথা তো পেলাম, সুর কোথায় পাবো? তখন তো আর গুগল, ইন্টারনেট, ইউটিউব ছিল না। যতদূর মনে পড়ে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পিট সিগারের রেকর্ড শুনে গানের সুরটা তুললাম। অনূদিত বাংলা শব্দগুলো ঢুকিয়ে গানটা নিজে গাইলাম, সংস্কৃতি সংসদের গানের দলকে শিখিয়ে কোরাসে পরিবেশন করলাম অনেক অনুষ্ঠানে। প্রথমবারের মতো গানটা গীত হলো আমাদের দেশে। এই গান কিন্তু তখনো ভূপেন হাজারিকা বা কলকাতা ইয়ুথ কয়ার গায়নি। গানটা আমি পরবর্তীকালে দেশে ও বিদেশে গেয়েছি। একবার লুসাকায়, তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা সাউথ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) কালাচারাল গ্রুপকে নিয়ে এক অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম। এক স্তবক বাংলায় গাই, এএনসি কোয়ার্টেট ইংরেজিতে হারমোনাইজ করে গায়, একসঙ্গেও গায়। গানটা যখনি যেখানে গেয়েছি, হাসনাতভাইয়ের কথা স্মরণ করেছি, বলেছি। তিনি সেটা জানতেন, কিন্তু কোথাও বলেননি আমাদের দেশে গানটা তিনি এনেছিলেন। হাসনাতভাইকে গুণী ব্যক্তিরা কীভাবে দেখতেন তার একটা প্রকাশ আমি দেখেছি। একাত্তরের ডিসেম্বরে বিজয়ের পর, একদিন হাসনাতভাই আমাকে বললেন, ইকবাল, আপনি তো পাকিস্তান আর্মির প্রিজনার অব ওয়ার হিসেবে ক্যান্টনমেন্ট ও সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ছিলেন, মুক্তি পেলেন বিজয়ের পর। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কেমন ছিলাম, কীভাবে থাকতাম, এসব আপনাকে দেখাব। আমাকে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, কবি বিষ্ণু দে, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন বসু প্রমুখ। প্রতিটি স্থানে একই প্রকাশ দেখলাম, তরুণ হাসনাতভাইয়ের প্রতি ওঁদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। সত্যিকার অর্থে আমরা যাঁদের গুণী বলে মান্য করি, তাঁরা ঠিকই আরেক গুণীকে চিনতে পারেন, যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে জানেন।

বহুদিন ধরে আমি দেশের বাইরে থাকি, প্রায় প্রতিবছরই দেশে যাওয়া হয়। এমন কখনো হয়নি যে আমি দেশে গিয়েছি আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি বা তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো হয়নি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রতি মাসে অন্তত একবার ফোনে কথা হতো। আমরা তো সবাই জীবনভর ভালোমন্দ সময়ের ভিতর দিয়ে পার হয়েছি। ওঁর বেলায়ও ব্যতিক্রম ঘটেনি। একসঙ্গে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম … মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে’ লাইনগুলো বলতাম। ১৯৬৮তে যে হাসনাতভাইকে দেখেছিলাম, ২০২০ সালেও সেই একই উদার, স্বচ্ছ মনের ভালো মানুষটাকে পেয়েছি। হাসনাতভাই, আমার এক পরম বন্ধু, তাঁকে হারালাম।
জেনেভা থেকে, ৪ ডিসেম্বর ২০২০।