জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ

সামান্য একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কী করে তা সম্ভব হয়েছিল? আয়ু তো পেয়েছিলেন মাত্র ৫৪ বৎসর!

পাকিস্তান-আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আশা করেছিলেন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম আর উত্তর-পূর্ব অংশে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। জিন্নাহ শেষ মুহূর্তে মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাবের ‘স্টেট্স’ শব্দের বদলে ‘স্টেট’ সংশোধনী পাশ করিয়ে নিলেন। বাংলা ভাগ হবে। সোহরাওয়ার্দী-শরৎচন্দ্র বসু পাকিস্তান ও ভারতের বাইরে অখণ্ড বাংলা প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে দেন-দরবার করলেন। তাতে কোনো ফল হলো না। আসাম রয়ে যায় পাকিস্তানের বাইরে – শুধু সিলেট জেলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হলো। কর্মী হিসেবে সেখানেও ছুটলেন মুজিব। সিলেট এলো পাকিস্তানে। এদিকে পূর্ব বাংলায় ব্যবস্থাপক পরিষদে নতুন করে নেতা নির্বাচনের ব্যবস্থা হলো – পশ্চিম পাকিস্তানে তার প্রয়োজন হলো না। এই নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী হেরে গেলেন খাজা নাজিমউদ্দীনের কাছে। মুজিবের মনে হলো, পাকিস্তানের রাজনীতিতে চক্রান্তের সেই শুরু।

কর্মস্থল কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন মুজিব। কিছুকাল আস্থা রাখলেন মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি। তারপর বুঝে গেলেন এই সরকার জনবান্ধব নয়। তখন গঠন করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ – সরকারের আস্থাভাজন নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপক্ষে। ১৯৪৮ সালে প্রথম রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলেন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। পরের বছর আবার কারাগারে। তখনই গঠিত হলো পূর্ব বাংলার প্রথম বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক সংগঠন – কারাবাসী মুজিব হলেন তার দুই যুগ্ম-সম্পাদকের একজন।

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময়েও তিনি কারাবন্দি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লুকিয়ে-চুরিয়ে আন্দোলনের নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন, অনশন করেছেন যেসব দাবিতে তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি।

১৯৫৩ সালে মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অসাধারণ তাঁর সাংগঠনিক শক্তি। দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন, সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁর দলে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যাদেরকে কাছে পেয়েছেন, তাদের নামধাম তাঁর মুখস্থ। তখন থেকে দেশ বলতে তিনি পূর্ব বাংলাকেই বুঝেছেন আর তার জনগণকে – ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে – তাঁর আরাধ্য বলে জানছেন। আওয়ামী মুসলিম সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দিতে তিনি তখনই তৎপর। দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলছেন, এখন নয়, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে করা যাবে, নইলে সরকারদলীয়েরা এ-নিয়ে অপপ্রচারের সুযোগ পাবে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অপ্রত্যাশিত বিজয় লাভ করল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দিলো না। দেশের সংবিধান-রচনার লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠিত হলো পর বছর। তার একজন সদস্য হিসেবে মুজিব দাবি করলেন, দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলা যাবে না, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে পূর্ব বাংলা। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে স্বতন্ত্র নির্বাচনপ্রথার পরিবর্তে যে যুক্ত নির্বাচনপ্রথা প্রচলনের সুপারিশ করা হলো, তার পেছনেও মুজিবের প্রয়াস ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় সদস্য নিযুক্ত হলে দলীয় কাজে সময় দেবেন বলে অচিরে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। সংগঠনের জন্যে মন্ত্রিত্বত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল বলা চলে।

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল শেখ মুজিবের ধ্যানজ্ঞান। এ-বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের অনুকূল সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতালাভই অভীষ্ট বলে স্থির করেন। তিনি একসময়ে আগরতলা যান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করে ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে পাঠান। নেহরু তাঁকে আপাতত এ-ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন। এ-বিষয়ে তিনি কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, তা ঠিক জানা যায় না। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। একে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ এবং ‘আমাদের মুক্তি-সনদ’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সরকার এ-দাবি দমন করতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। শেখ মুজিবও এ-দাবির পক্ষে পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে সভা করতে থাকেন। এক জায়গায় সভা করার পর তিনি গ্রেপ্তার হন, জামিনে ছাড়া পেয়ে আরেক জায়গায় সভা করেন, আবার গ্রেপ্তার, জামিন ও সভা। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরো ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেন। এটাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করে। আসামিদের ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি রাখা হয় এবং তিন-সদস্যের এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার শুরু হয়। মামলার প্রতিদিনের বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকলে শেখ মুজিবের জনসমর্থন বাড়তে থাকে এবং আগরতলা মামলাকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করার দাবি প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। তখন ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এগারো দফার আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলে। এগারো দফার এক দফায় ছয় দফা মেনে নেওয়ার দাবি ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে গুলি করে হত্যা করা হলে প্রতিবাদে দেশ ফেটে পড়ে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনীতিকদের এক গোলটেবিল আহ্বান করেন এবং তাতে যোগদানের জন্যে মুজিবকে পেরোলে মুক্তিদানের প্রস্তাব দেন। মুজিব সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, আইয়ুবও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হন, শেখ মুজিব রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধুতে।

নতুন রাষ্ট্রপতি আবার সামরিক শাসন জারি করেন, তবে একজন এক ভোটের ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। এ-নির্বাচনকে মুজিব ছয় দফার পক্ষে গণভোট বলে আখ্যা দেন। আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা-হস্তান্তর করতে কিংবা সংবিধান-প্রণয়নে মুজিবকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে অস্বীকার করে। মুজিবের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, তা সারাবিশ্বকে চমকে দেয়। সেনানিবাস ছাড়া দেশে আর সবকিছুই পরিচালিত হয় তাঁর নির্দেশে। এরই মধ্যে মুজিব ধৈর্য ধরে আলোচনা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে, তাঁর বৈরী রাজনীতিবিদ ভুট্টোর সঙ্গে। তাঁর ওপর দেশে চাপ বাড়ছিল একপক্ষীয় স্বাধীনতা-ঘোষণার জন্যে। ৭ই মার্চ রেসকোর্সের বিপুল জনসমাবেশে তিনি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাই দেন, যদিও তা ঠিক একপক্ষীয় স্বাধীনতা-ঘোষণা ছিল না। তাঁর সেদিনের বক্তৃতা এখন বিশ্ব-ঐতিহ্যের অন্তর্গত।

আলোচনা অসমাপ্ত রেখে ইয়াহিয়া খান সদলবলে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানে ফিরে যান গোপনে আর সেই রাতেই নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নেমে আসে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সহকর্মী ও অনুসারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতের সাহায্যে সে-যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৬ই ডিসেম্বরে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ে এবং বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।

বঙ্গবন্ধু দেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। কিন্তু সময়টা আর আগের মতো ছিল না। বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা দেশে, মানুষের প্রাপ্তির আশা ও লোভ আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল। দক্ষ জনবল ছিল না। তবু এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন চমৎকার একটি সংবিধান ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন করেছেন, দেশের মধ্যে ভিটেমাটি-ছাড়া প্রায় অনুরূপসংখ্যক মানুষকেও পুনর্বাসিত করতে হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবকিছু নতুন করে গড়ে তুলতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ফসল ভালো হলো না, খাদ্য সাহায্যের জাহাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে নিল। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়। পরের বছর সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বঙ্গবন্ধু একে বলেন সাময়িক ব্যবস্থা। সে-ব্যবস্থার ফল কী হবে, তা জানবার সময় পাওয়া যায়নি। তার আগেই ঘাতকের নির্মম আঘাত তাঁকে ছিনিয়ে নিল আমাদের থেকে।

পাকিস্তানিরা দুবার বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। একবার যখন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সেনানিবাসে বন্দি। তিনি বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন। তখনই পেছন থেকে তাঁকে গুলি করে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। সে-কথাটা তাঁকে এক সামরিক-কর্মকর্তা জানিয়ে দিলে মুজিব সতর্ক হয়ে যান। দ্বিতীয়বার পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। তাঁর প্রকোষ্ঠের সামনে তাঁকে দেখিয়েই কবর খোঁড়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর কারারক্ষীদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁর লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে-বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, একটু বেশিই ভালোবাসতেন, তারা যে তাঁর কোনো ক্ষতি করবে, তা ভাবতে পারেননি তিনি। বিশ্বাসঘাতক কতরকম হয়! দেশদ্রোহী বাংলাভাষীরাই পাকিস্তানের প্রার্থিত কাজ সম্পন্ন করে গর্ব করে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে, হ্যাঁ, তারাই হত্যা করেছে তাঁকে। ইতিহাস থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সে-প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। সগৌরবে নিজের আসনে আসীন তিনি, আসীন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। জয় হোক তাঁর।