জীবনানন্দ : অমঙ্গলের কবি

ফয়সাল শাহ্রিয়ার

‘Everything that is dark has duende’

– Federico Garcia Lorca

‘Do I dare?’ : T. S. Eliot

‘আমরা তো তিমির বিনাশী/ হতে চাই/ আমরা তো তিমির বিনাশী।’

– জীবনানন্দ দাশ

‘জ্যোৎসণায়, তবু সে দেখিল/ কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙ্গে গেলো তার?/ অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল-লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।’

– জীবনানন্দ দাশ

রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার সর্বাধিক খ্যাত পঙ্ক্তিত্রয়, সম্ভবত, এবং কবি জীবনানন্দ দাশের জন্য অশনিসংকেতস্বরূপ। ‘আট বছর আগের একদিন’ (ওই কিংবদন্তিখ্যাত পঙ্ক্তিত্রয় যে-কবিতার অংশ) কবিতাটি বিগত শতাব্দীর মধ্যত্রিশের দশকে বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল; পরে তা মহাপৃথিবী গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তী আট দশকে ওই কবিতাটি (এবং মুষ্টিমেয় সমধর্মী অন্য কিছু কবিতা) জীবনানন্দের কবি-পরিচয়কে দুর্ভাগ্যজনকরূপে চিহ্নিত করেছে।

বিশ^াস করার সংগত কারণ রয়েছে যে, বাংলা ভাষার অন্য কোনো কবিতায় ‘আট বছর আগের একদিনের’ মতো বৈশি^ক অমঙ্গলবোধ তীব্র কাব্যরূপ লাভ করেনি। কিন্তু কবিতাটি আদৌ প্রক্ষিপ্ত নয়। নিকটবর্তী সময়ে জীবনানন্দ দাশ কিছু সমধর্মী কবিতা (‘অন্ধকার’, ‘আদিম দেবতারা’, ‘শীতরাত’) রচনা করেন, যেখানে এক গভীর অমঙ্গলবোধ কবিতার কেন্দ্রে বিরাজমান। সমসাময়িক (অথবা পরবর্তী) বাংলা কবিতায় অন্য কোনো কবির কবিতায় বৈশি^ক অমঙ্গলের ধারণা অত তীব্ররূপে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু পরবর্তী আট দশকে ওই পরিচয় জীবনানন্দ দাশের জন্য একটি দায়ে পরিণত হয়েছে।

অস্বীকার করা দুঃসাধ্য যে, জীবনানন্দ-পূর্ববর্তী বাংলা কবিতায় ‘অমঙ্গলের ধারণা’ আদৌ কোনো যুক্তিগ্রাহ্য রূপে প্রকাশিত হয়নি। সংঘর্ষ নয়, সঙ্গতিই ছিল সেখানে প্রধান সুর। যদিও আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ বৈশি^ক অমঙ্গলের তাৎপর্য প্রসঙ্গে সম্যকরূপে সচেতন ছিলেন (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ); কিন্তু পরবর্তীকালে একই গ্রন্থে অন্যত্র তিনি স্বীকার করেছেন যে, তা রবীন্দ্রকাব্যের মূল সুর নয়, তা আদৌ অস্বাভাবিকও ছিল না।

১৮১৫ সালে অনুষ্ঠিত ভিয়েনা কংগ্রেসের মাধ্যমে ইউরোপে (এবং সমগ্র বিশে^) পরবর্তী শতাব্দীকালের জন্য যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য স্থাপিত হয়, রবীন্দ্রনাথের (এবং সমসাময়িক অন্যান্য বাঙালি কবির) সাহিত্যকর্ম তার প্রেক্ষাপটেই বিচার্য। ওই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রথম (এবং প্রধান) স্তম্ভ ছিল বিশ^ব্যাপী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের সার্বিক প্রাধান্যের প্রশ্নাতীত স্বীকৃতি। ওই ইউরোপীয় প্রাধান্যের বিপরীত পিঠে ছিল এশীয় সভ্যতাসমূহের প্রশ্নহীন পরাজয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে ওই বৈশি^ক ভারসাম্যের লক্ষণীয় পরিবর্তনের কোনো উলেস্নখযোগ্য সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী ওই ভারসাম্যের যুগে ফলিতবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধিত্বমূলক অধিকাংশ কবিতাই প্রথম মহাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ওই বৈশি^ক ভারসাম্যের যুগে রচিত। বৈশি^ক অমঙ্গলের ধারণা তখন কোনো ব্যক্তির কাছেই (নিটশে প্রমুখ আপাতঃউন্মাদ, অসামাজিক ব্যক্তি ছাড়া) উলেস্নখযোগ্য তাৎপর্যধারীরূপে প্রতীয়মান হয়নি। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর শেষ জন্মদিনে পঠিত প্রবন্ধে (যা পরবর্তীকালে সভ্যতার সংকট রূপে প্রকাশিত হয়) তাঁর সুদূর যৌবনে ইউরোপীয় সভ্যতার সার্বিক মঙ্গলময়তা প্রসঙ্গে তাঁর সপ্রশংস মুগ্ধতার কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। ওই মঙ্গলময় ভারসাম্যের সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে ঔপনিবেশীয় সংগতির ধারণাও প্রতিফলিত হয়। অমঙ্গলের ছায়া সেখানে ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট।

ভিয়েনা কংগ্রেস-পরবর্তী ওই পাশ্চাত্য-প্রভাবিত বৈশি^ক ভারসাম্যের অবসান ঘটে প্রথম বিশ^যুদ্ধের ফলে। প্রাচ্যদেশীয় প্রজাকুল বিমূঢ় বিস্ময়ে অবলোকন করে যে, তাদের শে^তাঙ্গ শাসকেরা এক কুরুক্ষেত্রসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত, যাতে তাদের ভাগ্যও নির্ধারিত হচ্ছে।

প্রথম মহাযুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিসমূহের অকল্পনীয় শক্তিক্ষয়ের ফলে ১৯১৮ সালে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভারসাম্যের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পরে বৈশি^ক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ধীর কিন্তু নিশ্চিত গতিতে আটলান্টিকের অপর তীরে স্থানান্তরিত হয়। ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে যে
নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তা যে কত স্বল্পস্থায়ী, বিশের দশকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্য-ইউরোপের দুর্বল গণতন্ত্রের ভিত্তিতে শেষ আঘাত আসে ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দার মাধ্যমে। উদার গণতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের দুর্বল বাধা অপসারণ করে ১৯৩৩ সালে নাৎসি দল জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করে। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অপর একটি মহাযুদ্ধ ছাড়া ইউরোপে নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন সম্ভব নয়। ১৯৩৬-৩৯-এর স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ ছিল স্পষ্টত আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রাথমিক মহড়া মাত্র।

ইতোমধ্যে সদ্য-শিল্পায়িত জাপান ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়া অধিকার করে। পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে জাপান চীনের মূল ভূখ- আক্রমণের মাধ্যমে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূচনা করে। জাপানের মূল লক্ষ্য স্পষ্টতই সুদূরপ্রসারী ছিল।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের জনগণ দীর্ঘকালব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনের পরে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শক্তির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা উপলব্ধি করে। উপনিবেশসমূহের ওপরে ব্রিটিশ সামরিক শক্তির মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা ছিল ওই দুর্বলতার অন্যতম মাত্রা। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের জনগণ সবিস্ময়ে লক্ষ করে যে, তাদের আরাধ্য ইউরোপীয় দেবতার পদযুগল নিতান্তই কাদামাটির তৈরি। ফলে প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলনের সূচনা যা দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপস্নব ওই গণআন্দোলনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

ত্রিশের দশকের শুরু থেকেই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দ্বিতীয় একটি মহাযুদ্ধ ছাড়া ইউরোপ ও এশিয়ায় নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন আর সম্ভব নয়। কিন্তু অনিবার্য ওই মহাযুদ্ধের সময়সীমা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশি^ক ভারসাম্যের রূপরেখা, উভয়ই ছিল নিশ্চিতরূপে অনিশ্চিত। তবে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী ও ঔপনিবেশিক, উভয় শক্তিই মানসিকরূপে প্রস্ত্তত ছিল।

বৈশি^ক ইতিহাসে দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময় ছিল অতুলনীয় তাৎপর্যবাহী, সামাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের দ্রম্নত অবক্ষয়ের সমান্তরালে তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নে অব্যাহত ছিল একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থাসম্পর্কিত পরীক্ষা। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ছিল, আক্ষরিক অর্থেই, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।

রবীন্দ্র-পরবর্তী বাঙালি কবিদের প্রথম প্রজন্ম যুদ্ধান্তর্বর্তীকালীন এ অস্থির, অনিশ্চিত সময়েই বেড়ে ওঠেন। ফলে মৃত্যুকে ‘শ্যামসম’ রূপে বিবেচনা করা তাঁদের জন্য ছিল প্রায় অসম্ভব। বিশেষত বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রির সঙ্গে সাদামাটা চাকরির যে নিশ্চিত সম্পর্কের ওপর বাঙালি ইংরেজিশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্ভরশীল ছিল,  ত্রিশের দশকের বিশ^ব্যাপী মন্দা তাতে গভীরভাবে আঘাত করে। ফলে ত্রিশের দশকের বাঙালি কবিরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হন। বাস্তব অর্থে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালীন বৈষয়িক বাস্তবতার কোনো সাদৃশ্য ছিল না।

স্বভাবতই অমঙ্গলবোধ ত্রিশের দশকের বাঙালি কবিদের কাছে কোনো বিমূর্ত বিষয় ছিল না। তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, উভয় ভবিষ্যৎই তখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। মোহিতলাল মজুমদার উপলব্ধি করতে না পারলেও তাঁরা বুঝতে পারছিলেন যে, প্রথম মহাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী উচ্চবর্ণ বাঙালি মধ্যবিত্তের নিশ্চিত, নিস্তব্ধ জীবনের পুনরাবৃত্তি আর কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। গভীর অমঙ্গলবোধ ছিল ওই অনিশ্চয়তার স্বাভাবিক পরিণাম।

ত্রিশের দশকের সব বাঙালি কবিই অবশ্য প্রায়-অবশ্যম্ভাবী ওই অমঙ্গলবোধ দ্বারা সমভাবে আক্রান্ত হননি। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পৃথকরূপে বিচার্য। বুদ্ধদেব বসু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার মৌলিক বিশ^াসসমূহের প্রতি তাঁর আস্থায় অবিচল থাকেন। কিন্তু বিষ্ণু দে মার্কসবাদে তাঁর আস্থা স্থাপন করেন, যা ত্রিশের দশকে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক।

আপাতদৃষ্টিতে ত্রিশের দশকের বাঙালি কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশই বৈশি^ক অমঙ্গলবোধ দ্বারা সর্বাধিক গভীরভাবে চিহ্নিত। জীবনানন্দ দাশের প্রথম পর্যায়ের কবিতায় (‘ঝরা পালক’) সত্যেন্দ্র-নজরুলের প্রভাব প্রসঙ্গে গভীর মতৈক্য বিরাজমান। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ (ধূসর পা-ুলিপি, ১৯৩৬) থেকেই জীবনানন্দ দাশ তাঁর নিজস্ব কাব্যিক কণ্ঠস্বর খুঁজে পান। ধূসর পা-ুলিপির অধিকাংশ কবিতাই দক্ষিণ বঙ্গের শীতার্ত নিজস্ব নরম ভূগোলের প্রতি জীবনানন্দের গভীর মমত্ববোধ দ্বারা চিহ্নিত। তার সমান্তরালে রয়েছে জীবনানন্দের কিংবদন্তিখ্যাত মৃত্যুচেতনা। প্রকৃতপক্ষে ধূসর পা-ুলিপির কাল থেকেই জীবনানন্দের অমঙ্গলবোধবিষয়ক কিংবদন্তির জন্ম। তাঁর মৃত্যুর ছয় দশক পরেও এ কিংবদন্তি সমরূপে শক্তিশালী।

জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিজীবনের প্রারম্ভ থেকেই সজনীকান্ত প্রমুখের বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। অধিকতর দুর্ভাগ্য এই যে, তাঁর পক্ষের মানুষেরাও তাঁকে আংশিকরূপে চিহ্নিত করেছেন মাত্র। দীর্ঘকাল আগে বুদ্ধদেব বসু তাঁকে নির্জনতম কবিরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, ওই পরিচয় তাঁর জন্য সর্বদা সুখকর হয়নি।

অন্য সমালোচকরাও তাঁকে বিভিন্নভাবে কোটরাবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। ওইসব প্রয়াস প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ সম্যকরূপে সচেতন ছিলেন। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ গ্রন্থ জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতার কিংবদন্তিখ্যাত মুখবন্ধে জীবনানন্দ স্বয়ং সমালোচকদের ওইসব প্রয়াসের কথা উলেস্নখ করেছেন। কিন্তু মুখবন্ধের মধ্যপর্যায়ে তিনি উলেস্নখ করেছেন যে, ওইসব পৃথক পরিচয়ে আংশিক সত্য নিহিত রয়েছে মাত্র, পূর্ণাঙ্গ বাস্তবতা নয়।

কিন্তু মৃত্যুর ছয় দশক পরে জীবনানন্দ দাশের অমঙ্গলময় পরিচয় তাঁর অন্যসব পরিচয়কে অনায়াসে অতিক্রম করে গেছে। তাঁর ওই পরিচয়ের ভিত্তি স্থাপনে বামপন্থী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ১৯৫২ সালে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সিগনেট সংস্করণের রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরে অবিভক্ত সিপিআই-এর মুখপত্র পরিচয় পত্রিকায় জীবনানন্দ প্রসঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এক কিংবদন্তিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিশুদ্ধ চলিস্নশ দশকীয় ভঙ্গিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ওই নিবন্ধের বক্তব্য প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথমত, বিংশ শতাব্দীর দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের ফলে সমগ্র মনুষ্য সমাজের সামনে সামগ্রিক উন্নয়নের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জীবনানন্দ দাশ (এবং তাঁর কবিতা) দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের ওই নতুন মানবিক সম্ভাবনাকে নির্লিপ্তরূপে উপেক্ষা করেছেন। সুনির্দিষ্টরূপে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঐতিহাসিক প্রগতির ধারণা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দ দাশের কবিতা গতিহীনতার শব্দরূপ মাত্র।

নিঃসন্দেহে বিগত শতাব্দীর দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নে সামাজিক কাঠামোর পূর্বপরিকল্পিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পরিচালিত হয়েছিল, যদিও এর সুফল সম্ভবত বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওই পদ্ধতি পরবর্তীকালে ত্রিশের দশকের মহামন্দার সময় প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জওহরলাল নেহ্রম্ন ভারতবর্ষে অনুসরণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, নেহ্রম্ন-প্রবর্তিত সোভিয়েট ধাঁচের পাঁচসালা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভারতের পরবর্তী অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি স্থাপিত হয়।

কিন্তু সাময়িক সাফল্যের উলস্নাসে (যা হয়তো চলিস্নশ-পঞ্চাশের দশকে সম্পূর্ণরূপে অস্বাভাবিকও ছিল না) সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সমাজতন্ত্র একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায় মাত্র, তার শুরু কিংবা শেষ নয়। স্বয়ং কার্ল মার্কস তাঁর তরুণ বয়সের রচনায় সুনির্দিষ্টরূপে সমাজতন্ত্র-পূর্ববর্তী সমাজকাঠামোর বিভিন্ন পর্যায়ের (দাসপ্রথা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ) উলেস্নখ করেছেন। ভস্নাদিমির লেনিন তাঁর রচনায় সমাজতন্ত্রকে সাম্যবাদ-পূর্ববর্তী এক দুরূহ অধ্যায়রূপে উলেস্নখ করেছেন। মার্কসের বিভিন্ন গ্রন্থে পুঁজিবাদ-পূর্ববর্তী বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার সুস্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাময়িক উলস্নাসের প্রভাবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, মানবসভ্যতার ইতিহাস কোনোক্রমেই সরলরৈখিক প্রগতির ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সামগ্রিক বিবেচনায় ঐতিহাসিক প্রগতির ধারণা গ্রহণযোগ্য হলেও সাময়িক ঐতিহাসিক পশ্চাদপসরণের বাস্তবতাও অনস্বীকার্য।  অন্যথায় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে মধ্য, নিকট-প্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপে মঙ্গোল বাহিনীর সামরিক-রাজনৈতিক সাফল্য ব্যাখ্যাতীত রয়ে যায়।

জীবনানন্দ দাশের বিরুদ্ধে কালপ্রবাহকে উপেক্ষার অভিযোগ প্রকৃতপক্ষে দুর্বোধ্য। ত্রিশের দশকের বাঙালি কবিদের মধ্যে সম্ভবত তাঁর কবিতাতেই কালচেতনা সর্বাধিক স্পষ্টরূপ ধারণ করেছে। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ ইত্যাদি কবিতায় যে শুধু খ্রিষ্ট-পূর্ববর্তী বিভিন্ন সভ্যতার জীবনযাপন প্রতিফলিত হয়েছে তা-ই নয়, ত্রিশের দশকের মধ্যপর্যায়ে রচিত (এবং তাঁর মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত) রূপসী বাংলার কবিতাসমূহে জীবনানন্দ কালচেতনার এক ভিন্ন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। রূপসী বাংলার কবিতাসমূহের বিরুদ্ধে প্রায়শই নিশ্চলতার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দের ওই গ্রন্থে সপ্তদশ শতাব্দীর ক্রান্তিকালীন বঙ্গভূমির চিত্রই বিধৃত হয়েছে, যা এক অর্থে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পৃথিবীর সমতুল্য। বিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদ-প্রভাবিত বঙ্গদেশের বিপরীতে জীবনানন্দ দাশ স্থাপন করেছেন সপ্তদশ শতাব্দীর ক্রান্তিকালীন বঙ্গদেশকে। তাঁর পক্ষপাতিত্বের দিকও সুস্পষ্ট। কালের প্রবহমানতা সম্পর্কে অজ্ঞ কোনো কবির পক্ষে ওই পক্ষপাতিত্ব আদৌ সম্ভব নয়।

ইতিহসে সম্পর্কে অজ্ঞতার ওই অভিযোগ থেকেই কিংবদন্তিখ্যাত জীবনানন্দীয় অমঙ্গলবোধসংক্রান্ত অভিযোগের উৎপত্তি। জীবনানন্দের জীবনযাপন এবং কবিতায় প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীকালীন উচ্চবর্ণ বাঙালির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাই প্রতিফলিত হয়েছে। জীবনানন্দ ছিলেন সর্বাংশে ইংরেজশাসিত বঙ্গদেশীয় সমাজের অংশ। পশ্চিমা শিক্ষানির্ভর ওই শ্রেণির সদস্য জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত-সামাজিক ভাগ্য গভীরতম অর্থে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দায় জীবনানন্দের কর্মজীবনও প্রভাবিত হয়। শেষ ১৯২০ ও প্রথম ১৯৩০-এর দশকে তাঁর বেকারজীবন প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। পরবর্তীকালে মধ্য-ত্রিশের দশকে তিনি বরিশালে ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্থিতি লাভ করেন। এর সমান্তরালে বিশ-ত্রিশের দশকের জাতীয়তাবাদী-সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও দ্রম্নত পরিবর্তিত হতে থাকে। ওই পরিবর্তনের ছায়া থেকে দুর্গম বরিশালের ইংরেজি সাহিত্যের এক অধ্যাপকও মুক্ত ছিলেন না। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালকে তৎকালীন ভারতবর্ষীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চিহ্ন সুস্পষ্ট। অনৈতিহাসিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত ওই কবি ত্রিশের দশকের চীন-জাপান যুদ্ধের পটভূমিতে অনুভব করেন, ‘তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে/ বিনষ্ট হতেছে সাংহাই’ (গোধূলিসন্ধির নৃত্য, ১৯৩৮ সালে পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত)। স্মরণযোগ্য, জীবনানন্দ দাশ তখন বরিশাল বি. এম. কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে কর্মরত। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাঁর সংযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন দি স্টেটসম্যান পত্রিকা।

প্রকৃতপক্ষে ‘অমঙ্গলের কবি’ হিসেবে জীবনানন্দ দাশের খ্যাতি মুষ্টিমেয় কয়েকটি কবিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত (‘অন্ধকার’, ‘আদিম দেবতারা’, ‘আট বছর আগের একদিন’ ইত্যাদি)। লক্ষণীয়, উক্ত প্রায় সব কবিতাই ত্রিশের দশকের শেষার্ধে রচিত এবং বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রায় সমগ্র এশিয়া-আফ্রিকা তখন ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের পদানত। ইউরোপ তখন নাৎসি জার্মানির উত্থানে বিপর্যস্ত। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিজয় অনিবার্যরূপে দেখা দিয়েছে। সমগ্র ইউরোপ তখন অনুভব করছে যে, বিশ্ব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দ্বারপ্রামেত্ম উপনীত। ওই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সাময়িক অমঙ্গলবোধ সম্ভবত আদৌ অস্বাভাবিক ছিল না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকরূপে ওইসব মুষ্টিমেয় কবিতার খণ্ডত বাস্তবতাকে ছাপিয়ে উঠেছে তাদের শৈল্পিক উৎকর্ষ। পুরনো পাঠক অবহিত আছেন যে, ‘রাত্রি’ অথবা, ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় চিত্রকল্পের যে বৈচিত্র্য অথবা অনুপ্রাসায়নে যাথার্থ পরিলক্ষিত হয়, জীবনানন্দ নিজেও সম্ভবত পরবর্তী জীবনে তা অতিক্রম করতে পারেননি; রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতায় তা অতুলনীয়। স্বাভাবিকভাবেই, পাঠক-সমালোচকরা অনায়াসে বিস্মৃত হন যে স্বল্পকাল পরে রচিত (এবং ১৯৪৩-সালে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত) ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ ঘোষণা করেন যে, ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী/ হ’তে চাই/ আমরা তো তিমিরবিনাশী।’ লক্ষণীয়, ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব সীমামেত্ম প্রবেশোদ্যত জাপানি বাহিনী অথবা চলিস্নশের দশকের মহাদুর্ভিক্ষ তাঁকে ওই উচ্চারণ থেকে বিরত করতে পারেনি।

প্রকৃতপক্ষে, জনপ্রিয় ধারণার বিপরীতে, ত্রিশের দশকের শেষ পর্যায়ে রচিত, গভীর অমঙ্গলবোধে আচ্ছন্ন ওইসব কবিতা আদৌ জীবনানন্দ দাশের প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা নয়। বরং স্বল্প-পরবর্তী সময়ে রচিত ‘বিস্ময়’ কবিতার উচ্চারণে (‘কোথাও নতুন দিন রয়ে গেছে নাকি’) নিঃসন্দেহে জীবনানন্দ দাশের পরিণত পর্যায়ের কবিতার সূচনা পরিলক্ষিত হয়। ওই পর্ব সংশয় দ্বারা চিহ্নিত (যে-সংশয় প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীর কালতিলক), কিন্তু তা আশাময় গন্তব্যের দিকে প্রবহমান। ওই পর্বের প্রারম্ভে জীবনানন্দ দ্বিধাগ্রস্ত (‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে এইখানে/ শুয়ে আছে কি না’)। কিন্তু মধ্যযুগীয় ইউরোপের পরে সম্পূর্ণ  দ্বিধামুক্ত কাব্যিক উচ্চারণের আর সুযোগ আছে কি?

পরিণত জীবনানন্দ দাশ জানান, ‘সে সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ/ কারা তবু কাছে চলে এলো’ (‘অনেক নদীর জল’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা)। পরবর্তীতে তিনি জানান, ‘কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল/ রয়ে গেছে’।

এই পর্বে জীবনানন্দ ক্রমশ আশার পথে পদচারণা শুরু করেন : ‘হয়তো বা ক্রমে আরো আলো/ পাওয়া যাবে বাহিরে হৃদয়ে;/ মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির, ব্যক্তির ক্ষয়ে’। ওই আশাবাদের উৎস কী? ‘যে প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।’, জানান জীবনানন্দ।

পরিণত জীবনানন্দের সংশয়াচ্ছন্ন আশাবাদের স্পষ্টতম প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় ‘মহাত্মা গান্ধী’ কবিতায় ‘অনেক রাত্রির শেষে তারপর এই পৃথিবীকে/ ভালো বলে মনে হয়, সময়ের অমেয় আঁধারে/ জ্যোতির তারণকণা আসে,/ গভীর নারীর চেয়ে অধিক গভীরতর ভাবে/ পৃথিবীর পতিতকে ভালোবাসে’। মহাত্মা গান্ধী ‘তাই/ সকলেরই হৃদয়ের ’পরে এসে নগ্ন হাত রাখে;/ আমরাও আলো পাই -’। জীবনানন্দ আরো জানান, ‘আজ এই শতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধীর সচ্ছলতা/ এ রকম প্রিয় এক প্রতিভাদীপন এনে সকলের প্রাণ/ শতকের আঁধারের মাঝখানে কোনো স্থিরতর/ নির্দেশের দিকে রেখে গেছে;/ রেখে চলে গেছে – ব’লে গেছে : শান্তি এই, সত্য এই’। জীবনানন্দ তাঁর আস্থার কথা জানান আমাদের, ‘হয়তো বা মানবের সমাজের শেষ পরিণতি গস্নানি নয়;/ হয়তো বা মৃত্যু নেই, প্রেম আছে, শান্তি আছে, মানুষের অগ্রসর আছে’। পরিশেষে জীবনানন্দ দাশ মৃত্যু নয়, ‘আলো সহিষ্ণুতা স্থিরতার জয়’ ঘোষণা করেন। এভাবে জীবনানন্দ বিশের দশকে ‘দেশবন্ধু’ (চিত্তরঞ্জন দাশে) যাত্রা শুরু করে অবশেষে ‘মহাত্মা গান্ধী’তে পরিণতি লাভ করেন।

তবু পাঠক-সমালোচকের মন পড়ে থাকে ‘আট বছর আগের একদিনের’ অজ্ঞাতপরিচয় আত্মহত্যাকারীর প্রতি। অনস্বীকার্য বাস্তবতা এই যে, জীবনানন্দ নিজেও সম্ভবত ত্রিশের দশকের শেষ পর্যায়ে রচিত অমঙ্গলবোধ-আচ্ছন্ন ওই মুষ্টিমেয় কবিতাসমূহের শৈল্পিক উৎকর্ষ পরবর্তীকালে আর অতিক্রম করতে পারেননি। তাছাড়া নিঃসন্দেহে রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতায় সমতুল্য কোনো অমঙ্গলবোধ-আশ্রয়ী কবিতা আর নেই। কিন্তু মুষ্টিমেয় ওই কবিতাসমূহ আমাদের জীবনানন্দের পরবর্তী প্রবণতার প্রতি সুবিচার করা থেকে বিরত রাখে।

পরিণত পর্যায়ে জীবনানন্দ সম্ভবত সংশয়াচ্ছন্ন, দ্বিধাগ্রস্ত এক আশাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, গভীরতর কোনো অন্ধকারের দিকে নয়। কিন্তু ওই প্রবণতাকে উপলব্ধি করতে হলে সম্ভবত আমাদের বুদ্ধদেব বসু-সৃষ্ট জীবনানন্দের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পূর্বাশার জীবনানন্দের ওপর দৃষ্টি আবদ্ধ করতে হবে। অনস্বীকার্য বাস্তবতা এই যে, পরিণত জীবনানন্দের চিত্রকল্পসমূহ ক্রমশ গদ্যধর্মী হয়ে ওঠে, কিন্তু তাতে জীবনানন্দের কাব্যক্রমে তাদের গুরুত্ব হ্রাস পায় না। বরং পরিণত জীবনানন্দের রসাস্বাদনে মনোনিবেশ করলে আমরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে সমর্থ হই যে, শার্ল বোদলেয়ারের কোনো পূর্বদেশীয় অনুসারী নন, বরং জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রকৃত অর্থে সংশয়াচ্ছন্ন এক আশাবাদী। r