শেফালী বেগমের বাস বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, রোহিতপুর গ্রামে। গ্রামের ভেতর সরু গলির শেষ মাথায় দোচালা টিনের ঘর। ঘরের সামনেই একটা কদমগাছ, বর্ষাকালে সাদা ফুলে ভরে যায়। সকালের হাওয়া নদীর কোল ঘেঁষে আসে; কখনো কচুরিপানার পাতায় জমে থাকা শিশিরের গন্ধ নিয়ে, কখনোবা ভেজা কাদামাটির। এই গন্ধ তার ভালো লাগে, আবার কষ্টও দেয়। কারণ এই নদীই তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, জীবন সবসময় নদীর মতো বয়ে যায় না – কখনো থেমেও যায়।
বিয়ের নয় বছরের মাথায় স্বামী চলে যায়। এক অগ্রহায়ণ মাসের দুপুরে ঠিক যেমনি সে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই একদিন চলে গেল। কেউ বলে, বিয়ে করে অন্য কোথাও সংসার পেতেছে; কেউ বলে, মাছধরার ট্রলারে করে নদীতে যাওয়ার পর আর ফেরেনি। শেফালী এসব শোনে, কিন্তু উত্তর দেয় না। বুকের ভেতরে কষ্ট জমে, তবু মুখে হাসি ধরে রাখে। কারণ ঘরে দুটি ছোট মুখ আছে – সিয়াম আর পুষ্পিতা।
সিয়াম একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা, বাবায় আর আইবো না?’
শেফালী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘না রে, বাপেরা মাঝে মইধ্যে রাসত্মা হারাইয়া ফালায়। তুই লেখাপড়া কর, আমি আছি।’
‘আমি আছি’ – তার এই ছোট্ট কথাতেই লুকিয়েছিল সন্তানদের সমস্ত নির্ভরতা।
সিয়াম তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ত, এখন ফাইভে; পুষ্পিতা এখনো স্কুলে যায় না। শেফালী প্রথম প্রথম ভেঙে পড়েছিল। অনেক কান্নাকাটি করেছিল, লুকিয়ে, রাতে – সন্তানদের ঘুম ভাঙতে না দিয়ে। পরে বুঝেছে – যে চলে গেছে, সে আর ফিরবে না। হয়তো তার জীবনে শেফালীর প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই জগৎসংসারে শেফালীর প্রয়োজন ফুরায় না। ছোট ছোট দুটি সন্তান তার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।
একদিন আঙুল ধরে পুষ্পিতা জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আইজকা ভাত রানবা না?’
শেফালীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ শুকিয়ে গেল। সে জানল, কান্না করে বেঁচে থাকা যায় না। বাঁচতে হলে লড়াই করতে হয়। সস্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েই বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি তৈরি হয় তার। সেই শক্তিই তাকে ঠেলে নিয়ে যায় টিকে থাকার লড়াইয়ে। শুরু হয় টিফিন ক্যারিয়ারে করে রান্না করা খাবার বিক্রির কাজ।
শুরুটা সহজ ছিল না – কানের দুল জোড়া বিক্রি করে পাওয়া সামান্য পুঁজি। নিজের ঘরে ছোট চুলায় রান্না, ঝড়বৃষ্টি বা তীব্র তাপদাহ – সবকিছুর সঙ্গেই যুদ্ধ করতে হয়েছে। তবে তার আর কোনো পথও খোলা ছিল না।
প্রথমদিকে প্রতিবেশীরা সমালোচনা করত, ‘মাইয়া মাইনষের আবার ব্যবসা! বাজারে বাজারে হাঁইটা টিফিনবাডিতে ভাত বেচবো – সমাজে মুখ দেখাইবো ক্যামনে?’
শেফালী এসব শুনেও চুপ করে থাকত।
প্রতিদিন ভোরে তার যুদ্ধ শুরু হয়। অন্ধকারে যখন গ্রামটা আধো ঘুমে ডুবে থাকে, শেফালী তখন ঘুম থেকে উঠে চুল বাঁধে। উঠান ঝাড়ু দেয়, ঘর গোছায়, নাসত্মার আয়োজন করে। বাচ্চারা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে যায়। সিয়াম হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে, আর পুষ্পিতা মায়ের পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। কাজ করতে করতেই তার নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়া লাগে শেফালীর।
টুকরি হাতে বের হতে গেলে প্রায়ই পুষ্পিতা বলে ওঠে, ‘মা, এতো হবরে কই যাও?’
‘বাজারে যামু, মা। রান্না বসাইতে হইবো না! তুমি যাও, খেলো।’
‘মা, তাড়াতাড়ি আইসো।’ বলেই কদমগাছটার দিকে দৌড় দেয় সে।
তার মনে হয়, এই ছোট মুখ দুটিই তার শক্তির উৎস।
কোমরে টাকা গুঁজে বাজারের পথে পা বাড়ায় শেফালী। হাতে খালি টুকরি, শরীরে ও কোমরে ওড়না শক্ত করে বাঁধা। বাজারের গলিপথে ভেজা মাটি, মাছের আঁশটে গন্ধ আর কাকের ডাক মিশে থাকে। সে সবার সঙ্গে দরদাম করে, ‘ভাই, আলু কত করে?’
‘পঞ্চাশ ট্যাকা।’
‘এত ক্যান? পঁয়তাল্লিশ ট্যাকা রাহেন – আমি তো রেগুলার আহি।’
বাজার শেষে ভারী টুকরি মাথায় নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। ঘামে ভিজে যায় শরীর, কিন্তু সে পাত্তা দেয় না। মনে মনে ভাবে – মানুষের জীবনও বাজারের মতো, প্রতিদিন দরদাম চলে।
বাড়ি এসে সেই ঘামে ভেজা শরীরেই চুলায় আগুন জ্বালায়। এক হাঁড়িতে ফুটতে থাকে ভাত, অন্যটাতে মাছের তরকারি, ডিমের ঝোল। সময় ফুরিয়ে আসে দ্রুত।
সিয়াম ততক্ষণে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। কোনোদিন মায়ের কাছে এসে বায়না ধরে, ‘মা, আইজকা টিফিনে ডিম নিমু না, মাছের সালুন নিমু।’
শেফালী হেসে উত্তর দেয়, ‘হ বাবা, নিও। তোমার লিগা মাছ বাড়াইয়া রাখছি।’
সকাল ১১টার মধ্যে টিফিন ক্যারিয়ারগুলোতে খাবার ভরে টুকরিতে সাজিয়ে নেয়। তারপর মাথায় গামছার বিড়া দিয়ে টুকরি মাথায় নেয়। পুষ্পিতা তখনো মায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, তুমারে আইজকা হরান লাগতাছে।’
শেফালী মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘কাম করলে তো মা হরান লাগবোই। তুমি যেদিন বড় হইয়া চাকরি করবা, হেদিন থিকা আমি আর কাম করমু না।’
ছোট্ট মেয়েটাকে একলা ঘরে রেখে খোলামোড়া লঞ্চঘাটের দিকে পা চালায় সে। ঘাটে পৌঁছালে প্রথমেই কানে আসে হকারদের হাকডাক – ‘পান, সিগারেট, ঝালমুড়ি!’ কোথাও আবার ভাঙা লাউডস্পিকারে লোকগানের সুর ভেসে আসে। এই সময়ে মানুষের ভিড় বেশি থাকে, বেশিরভাগেরই গন্তব্য চকবাজার। কেউ হয়তো
দোকান-মালিক, কেউ কর্মচারী, কেউবা যাবে মোকামে।
লঞ্চে ওঠার জন্য সবাই দৌড়ঝাঁপ করে। এই ভিড় ঠেলে এগোনো শেফালীর কাছে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। দুই হাতে মাথায় রাখা টিফিন ক্যারিয়ারের টুকরি ধরে এগোতে হয় তাকে। কখনো গায়ে ধাক্কা লাগে, কখনো ঝগড়া শুনতে হয় – কখনো করতেও হয়।
যুদ্ধ শেষ হলে ব্রিজের সামনের খোলা জায়গায় টুকরিটা রেখে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ে। সেখান থেকে চোখ রাখে টিফিন ক্যারিয়ারগুলোর দিকে। বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে যখন লঞ্চ চলে, তখন শেফালীর মনে হয়, নদীই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধে। নদীর বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। ঢেউয়ে টলমল করা দূরের ডিঙি নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, যে-কোনো সময় ডুবে যাবে, কিন্তু যায় না। ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছায়।
এই সময়ে যারা লঞ্চে চড়ে সোয়ারীঘাট যায়, তারা অনেকেই শেফালীকে চেনে। অনেকেই তার থেকে মাসিক হিসাবে টিফিন ক্যারিয়ার নেয়। তেমনই একজন আল-আমিন কসমেটিকসের ম্যানেজার সোহরাব হোসেন। ভালো মানুষ। দেখা হলেই হাসি দিয়ে কথা বলেন। আজ ভেতরে বসার জায়গা না পেয়ে ডেকে দাঁড়িয়েছিলেন। শেফালীকে দেখেই হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী শেফালী বেগম, আইজকাও এত তাড়াতাড়ি? রানলা কহন?’
শেফালী হেসে বলে, ‘কী করুম ভাই, তাড়াতাড়িই তো করতে হয়।’
দুপুরের আগেই তাকে পৌঁছাতে হয় সোয়ারীঘাটে। সূর্যের আলোয় বুড়িগঙ্গার কালচে পানি তখন ঝিলমিল করে। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছালে লোকজনের হইচই আরো বেড়ে যায়। হকাররা চিৎকার করে – ‘মোবাইল কাভার, চার্জার, হেডফোন!’
গরমে ঘামে ভিজে যায় শরীর, কিন্তু হাতে সময় নেই। তাকে যেতে হবে চকবাজার – টিফিন ক্যারিয়ারগুলো যার যার দোকানে পৌঁছে দিতে হবে। চকবাজারের দোকান-মালিক আর কর্মচারীদের সঙ্গে তার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কেউ মাসিক হিসাবে খায়, কেউ নগদ টাকায় কেনে, কেউ মাঝেমাঝে প্রশংসাও করে – বলে, ‘আপার হাতের রান্না ভালো, ঘরের মতো।’
শুনে শেফালী হাসে, তার কষ্ট সার্থক মনে হয়।
খাওয়া শেষে টিফিন ক্যারিয়ারগুলো সংগ্রহ করতে করতে সেই বিকেল। চকবাজার থেকে সোয়ারীঘাটে ফেরার পথে টিফিন ক্যারিয়ারগুলো হালকা থাকে, অথচ শেফালীর শরীর হয়ে পড়ে ভারী। হাঁটতে হাঁটতে হাড়ভাঙা খাটুনির বোঝা জমে ওঠে তার শরীরে, তবু আশ্চর্যজনকভাবে ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারে না।
এমন করেই নিঃশব্দে গড়িয়ে যায় শেফালীর প্রতিটি দিন।
দুই
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড গরমে লঞ্চের ডেকে বসে আছে শেফালী বেগম, সোয়ারীঘাট থেকে ফিরছে সে। সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই। আকাশের অবস্থাও ভালো মনে হচ্ছে না – যে-কোনো সময় ঝড় আসতে পারে। প্রতিদিনের মতো ব্রিজের সামনের খোলা জায়গায় তার টুকরিটা রাখা। খালি টিফিন ক্যারিয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু যেন থমকে দাঁড়ালো সে। জীবনযুদ্ধে নিজেকে ক্লান্ত মনে হলো।
মনে পড়ল, একদিন এক আত্মীয় বলেছিল, ‘শেফালী, তুই আবার সংসার কর। জীবনডা একা ক্যামনে কাডাবি? এ্যামনে কষ্ট কইরা কয়দিন চলবি?’
শেফালী মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার তো সংসার আছেই। সিয়াম আর পুষ্পিতা – ওরাই আমার সব।’
তার মনে এখনো সেই দৃঢ়তা আছে, তবে মনের গভীরে ভয়ও আছে – ‘যদি কোনোদিন এই শরীর পইড়া যায়, তখন আমার বাচ্চাগুলারে কে দ্যাখবো?’
হঠাৎ হুইসেল শুনে তার খেয়াল হলো, লঞ্চ খোলামোড়া ঘাটে চলে এসেছে।
ঘাটে নামতেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো – কালবৈশাখি ঝড়। শেফালী ভয় পেল, নিজের জন্য নয়, ঘরে একলা থাকা সন্তানদের জন্য।
লোকজন দৌড়ঝাঁপ শুরু করল, বাতাসে কারো কারো ছাতা উড়ে গেল। নামার সময় ভিড়ের ধাক্কা লেগে মাথায় রাখা টুকরি থেকে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিচে পড়ে গেল। মুহূর্তের জন্য শেফালীর বুক কেঁপে উঠল – এই টিফিন ক্যারিয়ার শুধু স্টিলের তৈরি কয়েকটা বাটি নয়, তার বেঁচে থাকার হাতিয়ার। নিচে তাকালো সে, নদীর কিনারায় পড়েছে – যে-কোনো সময় ঢেউ এসে তলিয়ে নিয়ে যাবে!
লোকজন বলল, ‘যাউকগা আপা, একটা বাটিই তো! আগে নিজে বাঁচেন।’
কিন্তু শেফালী দমল না, ভিড় ঠেলে দৌড়ে নামলো। ঘাটে বাঁধা ভেজা পিচ্ছিল নৌকায় উঠে হাত বাড়িয়ে টিফিন ক্যারিয়ারটা টেনে তুলল। যখন ওপরে এসে দাঁড়ালো তখন তার কপালে ঘাম, কিন্তু চেহারায় বিজয়ের হাসি।
মুহূর্তের জন্য সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
খোলামোড়া ঘাট থেকে তার বাড়ি প্রায় বিশ মিনিটের পথ। শেফালী ক্লান্ত শরীরে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে ঝড় কমে এসে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
এদিকে মায়ের পথ চেয়ে সিয়াম আর পুষ্পিতা বসেছিল। হঠাৎ দেখল, বৃষ্টিতে টুকরি মাথায় তাদের মা আসছে, মুখে সেই চেনা হাসি।
মাকে দেখেই সিয়াম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল, সঙ্গে পুষ্পিতাও।
সিয়াম বলল, ‘মা, আইজকা তোমার দেরি দেইখ্যা ভয় পায়া গেছিলাম – যে তুফান আইছিল!’
শেফালী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কিসের বাবা, রোজ আমি কত্ত ঝড় সামলাই – এই ঝড় তো কিছুই না।’
শুনে সিয়াম হাসে। শেফালীর সমস্ত ক্লান্তি মুহূর্তে মিলিয়ে যায় সন্তানের হাসিতে।
সেই রাতে পুষ্পিতা মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল, পাশে সিয়ামও। টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। শেফালী সন্তানদের মাথায় হাত রেখে ভাবল, ‘জীবন যতই কঠিন হোক, থামা যাবে না। নদী যেমন বয়ে চলে, তাকেও তেমন এগিয়ে যেতে হবে।’ সন্তানদের শান্ত নিশ্বাস শুনতে শুনতে শেফালী বালিশে হেলান দিলো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে, আকাশে নতুন চাঁদ উঠেছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.