তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ

কৈশোরে মাঝেমধ্যে বর্ধমান শহরে যেতাম। মুসলিম লীগের দুজন নেতা আবুল হাশিম ও টকু সরকার, এদের কাছে। কলকাতায় দাঙ্গা যখন শুরু হলো, তখন আবুল হাশিমের অফিসে বসে অনেক নেতার কথাই শুনতাম। তার কাছেই মুজিব বলে এক যুবকের কথা শুনেছি। এই মুজিবই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় তাঁর কথা প্রথম জানতে পারি আমি। দেশভাগের পর ১৯৫৪ সালে আমি বাংলাদেশে আসি। তখনো শুনতে পাই তাঁর কথা।

কলেজের ছাত্র হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমরা তখন মওলানা ভাসানীর সমর্থক। পাকিস্তানকে সমর্থন করার কারণে আমরা ঠিক সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সমর্থন করতে পারি নাই তখন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নিয়ে আবির্ভূত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বলা যায়, একেবারে সঠিক সময়ে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা; ছাত্রদের এগারো দফাও এ-সময়ে ঘোষিত হলো।

ছয় দফাতে শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের ওপর। ছয়টি দফাতেই শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল। ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ভাসানীর প্রভাব কমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তখন প্রধান নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা সাংঘাতিকভাবে শোষিত জনগণ চাইছিল মুক্তি। ছয় দফা ও এগারো দফা তাদের মুক্তির পথ – শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন।

ধর্মের দোহাই দিয়ে কী করে অনেকখানি দূরত্বে অবস্থান করা দেশ-অঞ্চল একটি দেশ হয়ে থাকবে, সেটা আমাদের বোধগম্য হয়নি। ধর্ম এক হলেও এ দুটি অংশ – পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বৈপরীত্য ছিল ভাষা। ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। এ-দুটি অঞ্চলের মধ্যে কোনো মিলও ছিল না। এসব থেকে আলাদা রাষ্ট্র-কাঠামোর যে দাবি, সেটা সাধারণের মনের কথা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেতারের যে-জায়গায় আঘাত করলে সঠিক আওয়াজ উঠে আসে, বঙ্গবন্ধু করেছিলেন সেই কাজ।

শেখ সাহেবকে তখন দেখেছি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। তাঁর নেতৃত্বের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম; দাবি করব যে অংশীদারও ছিলাম। বিরাট ঝড় দেখা দিলে সবকিছু যেমন সামনে থেকে হেলে পড়ে; শেখ সাহেবের কথায় জনগণও সেভাবে হেলে পড়ল। আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল দেখা দিলো। জনগণ তাঁকেই নায়ক বলে মেনে নিল। তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলো। ’৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা দিলো তখন। ’৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিয়েছিল। ফলে ’৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই কথা সম্পূর্ণভাবে জনগণের মনের কথা ছিল। এরপরই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭৩ সালের গোড়ার দিককার কথা। ১০ মিনিটের মতো সামনাসামনি বসেছিলাম তাঁর। আর দূর থেকে দেখেছি বহুবার। বিশালদেহী সুপুরুষ এই মানুষটির উপস্থিতিতে কিছু একটা তৈরি হতো, যার মাধ্যমে তিনি সরাসরি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতেন।

১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। মহান এই মানুষটি বাংলাদেশ-সংক্রান্ত প্রায় সব আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। সেই মানুষটি আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছেন। এককথায় বলা চলে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের অঙ্কুরোদ্গমও হয়েছিল মূলত আজকের দিনেই। কারণ তাঁর আহ্বানে, তাঁর নেতৃত্বেই তো এসেছে স্বাধীনতা। সেদিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই আজকের দিনটি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিনই বটে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ আমি নিজ চোখে দেখেছি। কী নারকীয় তাণ্ডব, কত রক্ত, কত হত্যা, কত ত্যাগ; সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। অনেক কিছুর বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা, আজকের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। একজন পূর্ণাঙ্গ নেতার যত রকম গুণ থাকা দরকার, সেসব গুণ ছিল তাঁর মধ্যে। সরলমনে মানুষকে খুব সহজেই বিশ্বাস করতেন। আর এ-কারণেই তাঁকে অকালেই জীবন দিতে হয়েছিল। যাঁর নেতৃত্বে একটি দেশের অভ্যুদয়, তাঁকে দেশবিরোধীদের অস্ত্রে নির্মম হত্যার শিকার হতে হলো।

আজ ১৭ মার্চ, এই মানুষটির জন্ম। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়েই লেখা হয়েছিল একটি দেশের জন্মের ইতিহাস। এই দিনটিকে গোটা দেশের মানুষের পালন করা উচিত বলে মনে করি।

স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছেন তিনি

একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কারণে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ জেগে উঠেছে। বাঙালিকে তিনি একটি রাষ্ট্রের নাগরিক করে তুলেছেন।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পেছনে গৌরবময় আর বিচিত্র ইতিহাস রয়েছে। আমরা আজীবন লড়াই করেছি।

সাতচল্লিশের পর থেকে আমরা কখনো আপস করিনি। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করেছি আমরা। আমরা জানিয়েছি সেই সময়ে কীভাবে আমরা রাষ্ট্রের মধ্যে থাকতে চাই। সেই যে শুরু – একাত্তরে পেলাম সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র। জন্ম হলো বাংলাদেশের। এ-জন্মের নেতৃত্বে ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চে তিনি সেই ভাষণ না দিলে আজ যে আমাদের কী হতো।

আমাদেরকে যে কতভাবেই না আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে, দায়িত্ব নিয়ে, আপস না করে আমাদের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি খুব বেশি সময় পাননি। প্রায় চার বছরের মাথায় তাঁকে মেরে ফেলা হলো। আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে, আমরা তাঁর হত্যার বিচার করতে পেরেছি। আমরা হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়েছি। পৃথিবীতে অনেক দেশের মধ্যে বাংলাদেশও একটি দেশ, যে-দেশের জন্মাদাতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁরা এমন নেতা ছিলেন যাঁদের দেশের মানুষ ভালোবাসতেন। আমরা অন্য দেশের মানুষের মতো এমন শোকের অংশীদার। আমি এজন্যও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

চেতনায় বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জন্য চিরকালের গৌরব হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের জন্য যে-দীর্ঘ সংগ্রাম, তাতে যিনি প্রধান নায়ক ছিলেন, সবাইকে ছাপিয়ে যাঁর মাথা সারা পৃথিবীর লক্ষ্যগত হয়েছিল, সেই নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেই মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে একজন নেতার সব রকম গুণ ছিল। তাঁর মধ্যে যেটি ছিল না, সেটি হচ্ছে কূটবুদ্ধি। তিনি মানুষকে খুব সহজেই বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল।

‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি’

‘আমরা ইতিহাস পড়ুয়া জাতি নই। আমরা ইতিহাস পড়ি না, ইতিহাস লিখি না। বঙ্গবন্ধু হত্যার অত বছর পরও তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। অন্তত আমার চোখে এমন কিছু পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীটি সম্পূর্ণ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো।’

যে-নৃশংসতা কল্পনারও অতীত

আমরা যারা জীবনের অনেকটা পথ অতিক্রম করে বর্তমানে এসে পৌঁছেছি, তারাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি, ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৯-এর গণআন্দোলনের প্রভাব কতটা গভীর ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের ক্ষেত্রে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো জাতির কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গৃহীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে-বাংলাদেশ অর্জিত হলো, তারও মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পরে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ছয় দফা। ছাত্রদের এগারো দফাও এই সময়ে ঘোষিত হলো। ছয় দফাতে শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের ওপর। এই ছয়টি দফাতেই শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল। ছয় দফা আন্দোলন শুরু হবার পর ভাসানীর প্রভাব কমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তখন প্রধান নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা সাংঘাতিকভাবে শোষিত জনগণ চাইছিল মুক্তি। ছয় দফা এবং এগারো দফা তাদের মুক্তির পথ – শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন।

বামপন্থি রাজনীতি তখন দুই ভাগে বিভক্ত। মস্কোপন্থি, যাদের নাম হলো সংশোধনপন্থি, আরেক দিকে হলো চীনপন্থি। ফলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। কিন্তু ছয় দফা সরাসরি জনগণকে সম্পৃক্ত করে ফেলল। প্রগতিপন্থিরা নানা সমালোচনা করেছেন। এখানে নানা সমস্যা রয়েছে, হয়তো সেটা সত্যি। কিন্তু প্রগতিপন্থিদের একটা কথা বুঝতে হবে – তীব্র সমালোচনা করলেই সমাজকাঠামো বদলায় না। দেশ তো এক ধরনের জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে তেইশ বছর ধরে। সে-কথা পরিষ্কার না করে বিপ্লবের ডাক দেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।

শোষণ থেকে মুক্তির জন্য রক্তাক্ত সংগ্রামে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানের অভাবটা লক্ষ করা যাচ্ছিল। এ-অভাবটা পূরণ করলেন শেখ মুজিব। মানুষ পাকিস্তানবিরোধী হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার প্রশ্নে নানা কথা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ছয় দফাটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হলো সবার কাছে। আর তখনই গড়ে উঠল আন্দোলন।

 শেখ সাহেবকে তখন দেখেছি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। তাঁর নেতৃত্বের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম : দাবি করব যে, অংশীদারও ছিলাম। বিরাট ঝড় দেখা দিলে সবকিছু যেমন সামনে থেকে হেলে পড়ে। শেখ সাহেবের কথায় জনগণও সেভাবে হেলে পড়ল। আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল দেখা দিলো। জনগণ তাঁকেই নায়ক বলে মেনে নিল। তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলো। ’৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা দিলো তখন। ’৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিয়েছিল। ফলে ’৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই কথা সম্পূর্ণভাবে জনগণের মনের কথা ছিল। এরপরই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে আটক করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির সময়টাতে দৃঢ়হস্তে আন্দোলনের হাল ধরলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদের মতো মহান, খাঁটি নেতা কম দেখা যায়। তাঁর হাতে চলে গেল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সরাসরি নেতৃত্ব। তিনি ভারতে চলে গেলেও নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়েছিল।

নয় মাসের যুদ্ধশেষে কাঙ্ক্ষিত বিজয় এলো। বিজয়শেষে অল্পদিনের মধ্যেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। এসে বাংলাদেশের হাল ধরেন। তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, সংস্কৃতির জগৎ ছিন্নভিন্ন, জনগণ নিঃস্ব; তাদের সামনে দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ যেন অপেক্ষা করছিল। বিজয়ের আনন্দে বাংলাদেশের মানুষ সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে দেশ পুনর্নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করে।

এর মধ্যে অনেক কাজ হলো, অনেক সমালোচনা হলো। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মোটামুটি স্থিতি আসতেই তো কয়েক বছর কেটে যাবে। আন্তর্জাতিক নানান শক্তি নতুন দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। আমাদের একটা সংবিধান তৈরি হলো। সেটা গ্রহণযোগ্যতাও পেল। তাতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্থান পেল।

দেশি-বিদেশি নানা শক্তি বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করা শুরু করল। চুয়াত্তরে একটা মন্বন্তর হলো, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রগুলো খুবই সক্রিয় হয়ে উঠল, তাজউদ্দীনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কে একটা ফাটল ধরল এবং দেশে বাকশাল গঠিত হলো।

এমন সব এলোমেলো ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, সবংশে নিহত হলেন। সেনাবাহিনীর একটা অংশ এই কাজ করল। আন্তর্জাতিক চক্র সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও শক্তি একরকম বিলুপ্ত হলো। পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘদিনের যে-অভ্যেস, সেনাবাহিনীর শাসন চালানো, ওই একই ঐতিহ্য বাংলাদেশও যেন গ্রহণ করল। তারপরে এই চল্লিশ বছর কীভাবে চলছে তার বর্ণনা আমার আর দেবার প্রয়োজন নেই।

বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে একজন পূর্ণাঙ্গ নেতার যত রকম গুণ থাকা দরকার সে-গুণগুলো ছিল।

’৭৫-এর ঘটনা গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত

১৯৭১-এর ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো। হাজার হাজার বছরের এত বড় অর্জন, আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই বাঙালির জন্য চিরকালের গৌরব হয়ে থাকবে। সেই বাংলাদেশের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম, তাতে যিনি প্রধান নায়ক ছিলেন, সবাইকে ছাপিয়ে যাঁর মাথা সারা পৃথিবীর লক্ষ্যগত হয়েছিল, সেই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমরা যাঁরা অনেকটা পথ অতিক্রম করে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছি, তারাই হয়তো মর্মে মর্মে জানব, ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৯ ইত্যাদি গণ-আন্দোলনের ভূমিকা কতটা ছিল বাংলাদেশ অর্জনের ক্ষেত্রে। যেখানে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানই শেষ পর্যন্ত পুরো জাতির নেতা হিসেবে জনগণের কাছে গৃহীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ অর্জিত হলো, তার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ।

সংবিধান রচিত হয়, সংবিধান অনুযায়ী দেশের নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। রাষ্ট্রীয় কয়েকটি মূল স্তম্ভ চিহ্নিত হয়। আমার মতে, আর কিছু হোক আর না হোক, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময় বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন। দেশের চেহারা কী রূপ নেবে, তখনো জাতির পুরোপুরি জানা নেই। তখন মানুষ আশা-নিরাশায় দুলছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাত্মক নেতৃত্বে দেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন। তখনই তিনি সপরিবারে নিহত হলেন। মনে হলো যেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গোড়া ছেঁটে ভূপাতিত করা হলো। সেনাবাহিনী ক্ষমতায় এলো এবং সেই স্বৈরশাসক দেড়-দশক ধরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। আমার মতে, স্বৈরশাসকের এই উত্থান এবং নির্মীয়মাণ গণতন্ত্রের মুখ থুবড়ে পড়া – এই দুটোরই সূত্রপাত হলো ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনার পর।

পারিবারিক ক্ষতির কথা আমি তুলছি না – সেটা অপূরণীয়। স্বৈরশাসন যারা প্রতিষ্ঠা করবেন, তারা মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিদায় করে দিয়ে, শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু তো নয়, পরিবারের নারী-শিশু-আত্মীয়-স্বজন কেউ বাদ পড়ল না। এমন নৃশংসতা বাংলাদেশে ঘটতে পারে, তা আমাদের কল্পনারও অতীত। এখন জানি, দেশের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অবশ্যই বিদেশি মদদ যুক্ত হয়েছিল। ’৭৫-এর ঘটনা এজন্যই যেমন দুঃখজনক, শোকাবহ, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাতও বটে।

এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর আর কোথাও সংঘটিত হয়নি

আমাদের এই বাংলাদেশে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে শুধু মার্চ মাস বলে আর কোনো কিছু নেই। তার আগে চিরকালের জন্যেই আগুনে গরম একটা বিশ্লেষণ দিয়ে বলছি রক্তঝরা মার্চ। এখন যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব তারা সবাই এই মাসটির কথা মনে করতে পারবেন। এই মাসেই বাঙালি শুধু বিদ্রোহীই হয়নি, দেশকে স্বাধীন করবার জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ে। আমরা জানি ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং নিরস্ত্র মানুষদের অকাতরে হত্যা করে, অগ্নিসংযোগে দেশটাকে ছারখার করে দিতে চেয়েছিল। লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও হত্যার এমন এক বিভীষিকা শুরু করেছিল যে যা পৃথিবীব্যাপী মহাযুদ্ধেও এরকম দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। দুই বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল; কিন্তু আমরা জানি, গত শতাব্দীতে ’৭১ সালের ২৫শে মার্চ একমাত্র ঢাকা শহরেই কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, অগ্নিসংযোগ করে ছারখার করে দেবার চেষ্টা করেছিল। এরূপ বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত আর কোথাও সংঘটিত হয়নি। আধুনিক মারণাস্ত্রের নির্বিচার প্রয়োগে ঢাকার পথঘাট মানুষের রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আমাদের স্মরণে পৃথিবীতে গণহত্যার যত বিবরণ আসে তার কোনোটির সঙ্গেই একাত্তর সালের মার্চ মাসের তুলনা করা যায় না। তারপর থেকে গোটা বাংলাদেশেই শুরু হয়ে যায় অকথ্য গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের ঘটনা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বাঙালি জাতি প্রতিরোধে একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

ওই বছর এপ্রিল মাসের মধ্যেই শুরু হয় গণযুদ্ধ। এলোমেলোভাবে প্রতিরোধ অল্পদিনের মধ্যেই সংগঠিত রূপ নিল এবং গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে গেলেন বাঙালি সাধারণ মানুষ। তাদের সংখ্যা আমাদের জানা নেই। আমার তো মনে হয় প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ সকলেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়, কেউ সংগ্রামী সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। আমরা যারা সেই সময়টা প্রত্যক্ষ করেছি, আমার নিজেরই এই কথাটা মনে হয় যে, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ কোনো না কোনোভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, ঐক্যবদ্ধ জাতির এই কঠিন মূর্তি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

মোটামুটি মার্চ মাস ধরে তারা আমাদের রক্ত ঝরিয়েছে একথা ঠিক কিন্তু এর কিছু পরেই পাল্টা প্রতিরোধ এবং প্রতি আক্রমণ শুরু হয়ে দিয়েছিল। আমি এরকম সমগ্র জনসাধারণের পক্ষ থেকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সহযোগিতা, ঐক্য প্রত্যক্ষ করেছি তাতে মনে হয় সমগ্র বাঙালি জাতি নিশ্ছিদ্র এবং নিরেট একটা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়েও পড়েছিল এবং এই দুর্বার ঐক্য তৈরি হতে তিন-চার মাসের বেশি সময় লাগেনি এবং মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে দেখা যায়। আমরা নিজেরাই তা অর্জন করেছি। পাশের দেশ ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে এমনকি যৌথ বাহিনীও গঠিত হয়েছে। আমরা সবাই জানি ’৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মানচিত্রে পৃথিবীতে স্থায়ী জায়গা করে নেয়।

১৫ই আগস্ট : মৃত্যুর শাসন যখন অকার্যকর

মানুষ, রাজনীতি, বাংলাদেশ এইসব মিলিয়েই তো বঙ্গবন্ধুর জীবন তন্নতন্নভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। তা না হলে আমাদের শ্রদ্ধাবোধটাও যেমন গতানুগতিক হয়ে যায়, আর প্রকৃত বঙ্গবন্ধু তেমনি অনেকটাই আড়ালেই থেকে যান। প্রশংসা-অপ্রশংসার ঊর্ধ্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান, তারপর বাংলাদেশ এসবের ইতিহাস একসঙ্গে লিখতে গেলে যাঁদের নাম আসবে তাঁদের প্রধান একজন বলে বঙ্গবন্ধুকেই গণ্য করতে হবে। তিনি খুব বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তবে মানুষই তো ছিলেন। সে জন্যে তাঁর সমগ্র কর্মকাণ্ডের নির্মোহ বিচার ও বিশ্লেষণ না করতে পারলে আমাদের শ্রদ্ধার ভিত্তি যেমন শক্ত হয় না, তেমনি যারা তাঁকে পছন্দ করেন না তারা অনেক অবান্তর কথা লিখে থাকেন।

আমার এখন মনে হয়, বাংলাদেশের এটা সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। ইতিহাসের জায়গা থেকে এই আত্মজীবনীর যতটুকু অংশ প্রকাশিত হয়েছে তাতেই বঙ্গবন্ধুর একটা দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশে চিরজীবী হবেই হবে। এ সমস্ত কথা আমি কোনো আবেগের জায়গা থেকে বলছি না। যে ভালোবাসায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়, দোষ-গুণ কিছুতেই চোখে পড়ে না, আমি সেই জায়গা থেকে কথা বলছি না বলতে চাইও না।

আমাদের ভুললে চলবে না, যাঁদেরকে জাতি বা বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের দ্রষ্টা বলা যায়, তাঁদের অনেককেই অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে নিতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত স্রষ্টা আব্রাহাম লিংকন স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগ পাননি। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ভারতের মহাত্মা গান্ধীকে স্বাধীন ভারতবর্ষের স্রষ্টাদের একজন বলা হয়। তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, জাতির বা রাষ্ট্রের স্রষ্টাজনক সব থেকে উচ্চ স্থান যাঁর জন্য বরাদ্দ থাকে, তাঁকেই আর স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগ দেয়া হয় না।

এই একই ঘটনা ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর বেলায়। বর্ণনাতীত হিংস্রতার সঙ্গে তাঁকে সপরিবারে আত্মীয়-স্বজনসহ নিধন করা হয়েছিল। ঠিক তার পরদিন থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অকাল পতন হয়ে যায়। যা আমরা কখনোই গ্রহণ করবো না, বাঙালি জাতি কখনোই যা করতে রাজি হয়নি, মাথা নোয়ায়নি। ভাষা আন্দোলন, ষাটের ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা ঘোষণার দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শত উৎপীড়নেও বন্ধ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করেছে। বাংলাদেশব্যাপী গণ-উত্থান ঘটেছে। তারপরই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে গড়ে তুলেছে গণ-আন্দোলন।

এই কলঙ্ক অমোচনীয়

ইতিহাসের এক অদ্ভুত চক্র দেখা যায়, একটি রাষ্ট্রের যিনি গোড়াপত্তন করলেন, নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করলেন, সেই রাষ্ট্রেরই কেউ না কেউ সেই মহানায়ককে নৃশংসভাবে হত্যা করল। আগস্ট মাসের শুরু থেকেই দৈনিক কাগজগুলোতে শোকের মাস বলে একটি আলাদা কলাম বের হচ্ছে। ইতিহাসের যে-চক্রের কথা বলছিলাম। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো, ভারতের হিসাবে ১৫ আগস্ট, পাকিস্তানের হিসাবে ১৪ আগস্ট। ভারতে যাকে বাপুজি সম্বোধন করা হতো সেই মহাত্মা গান্ধী-স্বাধীনতার এক বছর পরই উগ্র জাতীয়তাবাদী মানুষের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলেন। এই ঘটনা সারা ভারতবাসীর জন্য মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল; কিন্তু ঠিকই ঘটে গেল। আর যে-দিনটাতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো, ভাগ হলো, সেই ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের মহানায়ক, যাঁর হাতে একটি নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটল, তাঁকে পঁচাত্তর সালের পনের আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হতে হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরে মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যেই তিনি এই রাষ্ট্রের শুধু গোড়াপত্তনই নয়, তাকে উত্তুঙ্গ মহিমায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব করে উঠতে পেরেছিলেন; কিন্তু জাতি তার দাম দিল তাঁরই প্রাণহরণ করে। আমাদের এই বাংলাদেশ চিরকাল স্থায়ী হবেই আর এই কলঙ্কচিহ্নও চিরকালই তার গায়ে লেগে থাকবে। এই আশীর্বাদ ও অভিশাপ আমরা ভোগ করতে বাধ্য। মনে থাকবে অভিশাপের কথাই বেশি। মনে পড়বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বক্তৃতা। তিনি বলেছিলেন, ‘আর যদি একটি গুলি চলে, … তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে তার প্রতিরোধ করবে। আমরা তোমাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, তবু বাংলাদেশ স্বাধীন করেই ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ এই বক্তৃতার মাত্র আড়াই সপ্তাহ পরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে দিলেন। পাকিস্তানিরা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক বছর আটকে রাখে বটে। কিন্তু তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করতে সাহস পায়নি বা সাহস করেনি। আর আমরা নিজেদেরকে কী বলবো জানি না, তিনি ফিরে আসার চার বছরের মধ্যেই তাঁকে নিহত হতে দেখলাম। সমগ্র জাতি এই অপরাধ করেনি, যারা করেছে তারা চিহ্নিত হয়েছে এবং কেউ কেউ শাস্তিও পেয়েছে; কিন্তু তারা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমরা সেজন্য ১৫ আগস্টকে শুধু যে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করবো তাই নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সমস্ত বিশ্বাসঘাতকদের সমূলে উৎপাটন করার সংকল্পও গ্রহণ করবো।