দিকনির্দেশনামূলক বঙ্গবন্ধুর বাণীগুচ্ছ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – বাংলাদেশের জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজের লেখা ডায়েরি নিয়ে তিনটি গ্রন্থ – অসমাপ্ত আত্মজীবনী, আমার দেখা নয়া চীন ও কারাগারের রোজনামচা। এসব গ্রন্থে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর বয়ানে তাঁর জীবনের অসমাপ্ত কিন্তু প্রামাণ্য ছবি।

তাঁর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ এদেশবাসীকে উদ্দীপিত করেছিল স্বাধীনতার জন্য। তবে শুধু ৭ই মার্চে নয়, বিভিন্ন সময়ে গণমানুষের নেতা শেখ মুজিবের ভাষণ ও বক্তব্য গেঁথে আছে বাঙালির হৃদয়ে, যেগুলিতে ফুটে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উন্নয়নের পরিকল্পনা, সমাজ ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ভাবনা, সর্বোপরি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।

বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের দিকনির্দেশনামূলক উক্তির সংকলন বঙ্গবন্ধুর উক্তি সংগ্রহ। উক্তিগুলির সংগ্রাহক ও সংকলক মুন্শী শাহাবুদ্দীন আহমেদ। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর সহস্রাধিক উক্তি সংকলিত হয়েছে। শেষদিকে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি।

শেখ মুজিবুর রহমানের ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাংলাদেশ। এই দেশকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করতে, বিশে^র দরবারে আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি – এমন প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম ও কর্মোদ্যোগে তাঁর নামটিই সবার আগে উচ্চারিত হয়। সেসব বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে গ্রন্থভুক্ত উক্তিসমূহে।

বঙ্গবন্ধু বরাবরই ছিলেন কৃষক ও কৃষিবান্ধব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন কৃষকদের
সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভাগ্যোন্নয়ন এবং কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের ওপর। তাঁর বিভিন্ন ভাষণ-বক্তৃতায়ও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষিব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানের জায়গীরদারী, জমিদারী, সরদারী প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তিসাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাস জমি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বণ্টন করতে হবে। কৃষিব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে’ (পৃ ১৬৩)।

পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে যে সাময়িক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তা প্রশমিত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর। অস্থিরতার সেই আগুনে ঘি ঢালছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। বঙ্গবন্ধু সে-সময় স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এর মধ্যে কোনো হাঙ্কি-পাঙ্কি নাই। এ বাংলায় শোষকদের মাথা তুলতে দেওয়া হবে না’ (পৃ ১৬৩)।

যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলেমিশে বাঙালিদের অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাদের অনেককেই দেশের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তারাই পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুবিরোধী শক্তিকে উস্কানি দিচ্ছিল। বিষয়টি নজর এড়িয়ে যায়নি তাঁর। দেশবাসীকে সাবধান করে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমাপ্রাপ্ত কিছু লোক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন, তারা সকলেই এদেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভোগ করবেন’ (পৃ ১৪১)।

এই ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য উক্তিতেও বারবার এসেছে। যেমন তিনি আরো বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতি হচ্ছে – চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। সে ষড়যন্ত্রের এখনো অবসান হয়নি। কিন্তু বাঙালি রক্ত দিতে শিখেছে। তাই এখন আর কেউ তাদেরকে থামাতে পারবে না। এবার বাঙালি বিশে^ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। ৬-দফা ও ১১-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, জনতা এবার অধিকার আদায়ে কামিয়াব হবে’ (পৃ ১৮৬)। ধারণা করা যায়, এটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেকার উক্তি।

রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিচ্ছন্ন ও চলমান রাখার জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন। প্রশাসকরা যেন কোনোভাবেই তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহারে উৎসাহী না হন, জনগণই যে দেশের মূল ভিত্তি ও কর্তা – বঙ্গবন্ধু  সে-বিষয়ে বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট – আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। মেন্টালিটি আমাদের চেইঞ্জ করতে হবে। আর যাদের পয়সায় আমাদের সংসার চলে, যাদের পয়সায় রাষ্ট্র চলে, যাদের পয়সায় আজ আমাদের এসেম্বলি চলে, যাদের পয়সায় আমরা গাড়ি চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রোল খরচ করি, আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম? সেটাই আজ বড়ো জিনিস’ (পৃ ২২৪)। বঙ্গবন্ধুর এ-উক্তি, বলা নিষ্প্রয়োজন, বাংলাদেশকে নিয়েই।

অসাম্প্রদায়িক সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সঙ্কল্পবদ্ধ বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, পাকিস্তান আমলে এবং পাকিস্তানিদের শাসন তিরোহিত হওয়ার পরও তাদের প্রেতাত্মা ভর করে আছে স্বাধীন দেশে। ধর্মের আবরণে তারা নিজেদের মুড়ে রেখেছিল, জনগণকে দিচ্ছিল ভুল বার্তা। এতে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছিল। সে-সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ সেøাগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না’ (পৃ ২২৮)। আফসোসের বিষয়, তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই দিনেও সে অবস্থার অবসান এখনো হয়নি।

দেশে দুর্নীতি-বিস্তারে প্রশাসনযন্ত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে কখনোই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। তাই তিনি প্রথমেই নিজের প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে মনস্থ করেছিলেন। তাঁর উক্তিতে তা দৃষ্ট হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আপনাদের খাছিলৎ পরিবর্তন করুন। মনে রাখবেন, আপনারা যাদের উপর ডাণ্ডা ঘুরান, সেইসব দরিদ্র মানুষের টাকায়ই আপনাদের সংসার চলে। আপনারা দুর্নীতি পরিহার করুন’ (পৃ ২২৮-২২৯)। তবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ক্ষমতা-পরিচালনার স্বল্প সময়ে এতে সফল হতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। এ-উক্তির মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর যে অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে তাতে তাঁর সমগ্র জীবনদৃষ্টির পরিচয় মেলে।

বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে তরুণ প্রজন্ম। এক্ষেত্রে তরুণদের নিজের পূর্বপুরুষ, দেশের ইতিহাস জানতে হবে, বুঝতে হবে – এমনটাই মনে করতেন তিনি। কারণ ইতিহাস-ভুলে-যাওয়া বা না-জানা প্রজন্ম কখনোই দেশের প্রতি টান অনুভব করবে না – এটা স্পষ্ট। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে না সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না’ (পৃ ২৩৬)।

শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু সবসময়ই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বিশেষ করে দেশে নারী শিক্ষার বিস্তারে তাঁর নিরন্তর ভাবনা ছিল। শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে – এ-কথাটা বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই ছাত্রসমাজকে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মানুষ হতে হবে। ছাত্র সমাজের লেখাপড়া করতে হবে। লেখাপড়া করে মানুষ হতে হবে। জনগণ টাকা দেয় ছাত্রগণকে মানুষ হবার জন্য। সে মানুষ হতে হবে – আমরা যেন পশু না হই। লেখাপড়া শিখে আমরা যেন মানুষ হই। কী পার্থক্য আছে জানোয়ারের সাথে আর আমার সাথে?’ (পৃ ৩১১)।

এমনি বিভিন্ন উক্তিতে ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক ভাবনার চিত্রটি। তিনি কী চেয়েছিলেন, কীভাবে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন তাঁর পরিকল্পনাগুলি, কোন কোন বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর ও পরবর্তীকালে – সেসব বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায় উক্তিসমূহ পড়ে গেলে।

বইটি পড়ার সময় মনে হয়েছে কিছু বিষয়ে লেখকের আরো কিছু কাজ করার অবকাশ রয়েছে। যেমন – বইটির ১০ নম্বর থেকে শুরু করে ৩৮৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত উক্তিগুলি ছাপা হয়েছে। কিছু উক্তির সঙ্গে প্রসঙ্গ সময়ের উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমনটি নেই। যদি সময় ধরে, মানে খ্রিষ্টাব্দ অনুসারে ও বক্তব্য প্রদানের প্রসঙ্গ অনুসারে উক্তিগুলি বিন্যস্ত করা হতো তাহলে পাঠক সহজেই বুঝতে পারতেন বঙ্গবন্ধু কোন সময়ে ও কোন পরিপ্রেক্ষিতে কী বলেছেন। এতে অন্তত একটা ক্রমানুসারে এগোনো যেতো এবং বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও স্বপ্ন-সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে নবীন প্রজন্মের জন্য আরো সুবিধাজনক হতো।

এছাড়া কোন সভা বা আলোচনায় বঙ্গবন্ধু উক্তিগুলি করেছেন তারও একটা তথ্যনির্দেশ থাকলে ভালো হতো। এ-কাজগুলি করা গেলে বইটির মান আরো উচ্চতায় পৌঁছাত বলে মনে হয়। আশা করছি, পরবর্তী সংস্করণ অথবা মুদ্রণের আগে এ-বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন গ্রন্থকার। বইটির জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই।