দুটি কালান্তক বুলেটের আঘাতে নির্বাপিত কবিজীবন

এক

লাতিন আমেরিকার কবি ও কবিতা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনায় দেলমিরা আগুস্তিনি অর্থাৎ আমাদের আজকের কবিকে পাওয়া মুশকিল হবে। লাতিন আমেরিকায় কবিতার প্রধান দেশগুলির (যেমন আর্হেন্তিনা, চিলে, কুবা অথবা মেহিকোর) কোনো একটির তিনি নাগরিক বা অধিবাসী নন। হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবলো নেরুদা, নিকোলাস গ্যিয়েন অথবা অক্তাবিও পাসের মতন মহান কবিদের পাশাপাশি তাঁর নাম উচ্চারিত হতে শুনবেন না সুধী পাঠক। তাঁর জন্মশতবর্ষে (১৯৮৬) অথবা মৃত্যুশতবর্ষে (২০১৪) কোনো মহতী সভা আয়োজিত হয়নি – প্রকাশিত হয়নি কোনো বিশেষ সংকলন। সবচেয়ে বড় কথা – দু-দুটি কালান্তক বুলেট তাঁর জীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে – তাঁর ২৮তম জন্মদিনে পৌঁছাতে তখনো সাড়ে তিন মাস বাকি।

অসংখ্য কবি ও লেখকের রক্তাক্ত মৃতদেহে আকীর্ণ বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাস – সুকান্ত ভট্টাচার্য, সোমেন চন্দ, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, জীবনানন্দ দাশ। ‘গুরিসাবা’ জাহাজে মেহিকো সিটি থেকে ন্যু ইয়র্কে ফেরার পথে, এক নাবিককে যৌন প্রেম নিবেদনের পর ব্যর্থ হয়ে মেহিকো উপসাগরের নীল জলে ঝাঁপ দেন ৩২ বছর বয়েসি হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২)। প্রথম মহাযুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৩৮ বছর বয়সী ফরাসি কবি গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার (১৮৮০-১৯১৮)। ফ্র্যাংকোর জেলখানায় যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত মিগেল আর্নান্দেসের (১৯১০-৪২) মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়, ৩১ বছর বয়সে। ‘অশ্রুর প্রাচীর’ নামক কুখ্যাত দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে (১৮১৮-১৯৩৬) গুলি করে মারে ফ্র্যাংকোর ভাড়াটে গুণ্ডারা। ৪৯ বছর বয়সে স্যেন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন রুমেনীয় কবি পাউল সেলান (১৯২০-৭০)। মস্কো শহরে নিজের সঙ্গে রুশ রুলেত খেলতে খেলতে প্রাণ দিলেন ভ­াদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০)। হোটেলের ঘরে কলমের কালি ছিল না বলে নিজের রক্ত দিয়ে আত্মহত্যার সনদ লিখলেন সের্গেই এসেনিন (১৮৮৫-১৯২৫); সাইবেরিয়ার ব্লাডিভস্টক শহরের কাছে ‘ভিতোরায়া রেচকা’(দ্বিতীয় নদী) ট্রানজিট ক্যাম্পে অজ্ঞাত অসুখের প্রকোপে চলে গেলেন ওসিপ ম্যানডেলস্টাম (১৮৯১-১৯৩৮)। তালিকা বাড়িয়ে আর লাভ নেই – অকালমৃত্যু, আত্মহত্যা আর গুপ্তহত্যায় পীড়িত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর কবিপ্রতিভা।

দুই

স্থানীয়, ভূমিজ (এবং অনেকদিন আগেই নিশ্চিহ্ন) ‘গুয়ারানি’ ভাষায় ‘উরু’ একটি স্থানীয় পাখির নাম – এক প্রজাতির বনমোরগ। এস্পানার দস্যুরা যখন এখানে উপনিবেশ স্থাপন করতে আসে, তারা এই অঞ্চলের নদীটির নাম শোনে, ‘উরুগুয়াই’-  ‘গুয়াই’ মানে নদী। তারা ভুল করে নদীটির নাম দেয় ‘রিও দেল উরুগুয়াই’ অর্থাৎ ‘পাখি নদী’। এই নদীর অববাহিকায় ছোট দেশ উরুগুয়াই। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে সুরিনামের পরেই দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ এই উরুগুয়াই।

দেশটি জনবিরল – পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণ আকারের (৬৮ হাজার বর্গমাইল) দেশটিতে বাস করে মেট্রোপলিটন কলকাতার এক-পঞ্চমাংশ মানুষ (৩২ লাখ)। প্রতি বর্গমাইল এলাকায় বাস করেন ৫০ জনেরও কম মানুষ – জনসংখ্যার ঘনত্বে পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে ১৯৮তম। জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাস করেন (১৮ লাখ) রাজধানী মন্তিভিদিও অথবা তার আশেপাশে।

সংস্কৃতিমুখর মন্তিভিদিও শহরটি প্লাতা নদীর ধারে – প্লাতা নদীর অন্য তীরে, খানিকটা পশ্চিমে আর্হেন্তিনার বুয়েনাস আইরেস শহর – সেখানে কবিতার মশাল জ¦ললে তার উষ্ণতা এসে লাগে নদীর ওপারে মন্তিভিদিওতে। মাঝেমধ্যে সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা লেগে থাকলেও দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো – নিয়মিত সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান রয়েছে দুটি শহরের মধ্যে। একই ভাষায় কবিতা লেখেন দুই শহরের মানুষ – এক দেশের কবিসভায় হাজির হন অন্যদেশের মানুষ – সীমান্ত কোনো বাধার সৃষ্টি করে না।

এই মন্তিভিদিও শহরে কবি দেলমিরা আগুস্তিনির জন্ম অক্টোবর ২৪, ১৮৮৬। বাবার পরিবার ইতালি থেকে সেখানে অভিবাসী হয়েছিলেন বহুকাল আগে; মায়ের জন্ম এক জার্মান বংশে, তাঁরা আরো সাম্প্রতিক অভিবাসী। পরিবারটি সমৃদ্ধ এবং সংস্কৃতিমনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে উরুগুয়াই দেশটি ছিল লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা – সেখানে চালু ছিল গণতন্ত্র, প্রসার ছিল শিক্ষাব্যবস্থার, নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম; শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে দেশটি ছিল অগ্রসর – এবং তাদের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিলেন সম্মানীয় বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা।

লাতিন আমেরিকার ‘মোদার্নিসমো’সাহিত্য-আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন রুবেন দারিও (১৮৬৭-১৯১৬) ও তাঁর সতীর্থরা – দেলমিরা সেই আন্দোলনের প্রথম মহিলা শরিক। তাঁর এক দশক আগে উরুগুয়াইতেই মারিয়া ইউহেনিয়া বাজ ফেরেইরা (১৮৭৫-১৯২৪) যুক্ত হন এই আন্দোলনের সঙ্গে, কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভার গভীরতা এবং ব্যাপ্তি দুটোই ছিল সীমাবদ্ধ। দেলমিরার সাফল্যের পরে তাঁকে অনুসরণ করবেন হুয়ানা দে ইবারবাউরাউয়ের (১৮৯২-১৯৭৯) মতন আরো অনেকে – তাঁরা খুঁজে নেবেন নিজেদের পথ প্রশংসায় ও জনপ্রিয়তায় এবং কখনোই ভুলবেন না তাঁদের অকালমৃতা বড় দিদিকে। হুয়ানা তাঁকে অভিধা দেবেন ‘পুণ্যশ্লোক সন্ত’।

জীবনে কোনো দিন স্কুলে যাননি দেলমিরা – তবে শিক্ষায় খামতি ছিল না। প্রথমে মায়ের কাছে অক্ষর পরিচয় ও প্রাথমিক শিক্ষা, তার পরে বাড়িতে শিক্ষক-শিক্ষিকা রেখে ফরাসি, পিয়ানোবাদন, ছবি আঁকা, সূচিশিল্প প্রভৃতি শেখা – ধনী, অভিজাত পরিবারের গৃহবধূ হতে যা যা প্রয়োজন। পিয়ানোতে তিনি ভীষণভাবে সফল – অল্পবয়সেই শিখে নিলেন বাখ, বেটোফেন, শোপ্যাঁর সংগীতের রহস্য – শিক্ষকেরা মা-বাবাকে পরামর্শ দিলেন তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্যে ইউরোপে পাঠানো হোক।

তিন

এদিকে বয়স দশ ছোঁয়ার আগেই আপন মনে কবিতা লিখতে শুরু করেন দেলমিরা – বন্ধুবান্ধব ছিল না, মেয়েলি খেলাধুলায় আগ্রহ তো ছিলই না; মা-বাবার সঙ্গে হাঁটতে যেতেন পার্কে আর পড়তেন অজস্র বইপত্তর। একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন পিয়ানো বা ছবি আঁকায় সময় দেবেন না আর, কেবল লেখাই হবে তাঁর জীবনের সম্বল। ১৯০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পঞ্চদশী কবির প্রথম কবিতা – ‘কবিতা!’ প্রকাশিত হলো ‘লাল ও সাদা’ (রোহো ই ব্লাংকো) নামে একটি ছোটকাগজে। এইভাবে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা; মাস দুই পরে ‘প্রভাত’ (লা আলবোরাদা) নামক জনপ্রিয়, সচিত্র সাপ্তাহিক সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হলো তাঁর কবিতা ‘গোধূলি’ (‘ক্রেপুসকুলো) – পরবর্তী তেরো মাসে আরো ষোলোটি কবিতা প্রকাশিত হবে এই সাময়িক পত্রে – নতুন শতাব্দীতে তিনি উরুগুয়াইর জনপ্রিয় কিশোরী কবি।

ঠিক একই সময়ে মন্তিবিদিওর সুশীল সমাজে ঘটছিল আমূল পরিবর্তন এবং প্রগতিশীল সংস্কার। দেশের রাষ্ট্রপতি দন হোসে বাতলে ই অরদোনেসেন (১৮৫৬-১৯২৯) শাসনকালে শ্রমিকদের নানান সুযোগ-সুবিধা (দিনে আট ঘণ্টা কাজ, বেকার ভাতা), নারী শিক্ষা ও নারীর সমানাধিকার নিয়ে নতুন আইন হলো। এই নবীন যুগের নবীন কবি দেলমিরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে খুঁজে নিলেন নিজের পথ। কৈশোর ও বয়ঃসন্ধির সময়ে লেখা কবিতাগুলি প্রকাশিত হলো ১৯০৭ সালে ‘শুভ্রপুস্তক [ভঙ্গুর, (এল লিব্রো ব্লাংকো [ফ্রাজিল]) – কবির বয়স তখন একুশ। পুরো কাব্যগ্রন্থের একটাই মূলসুর – যৌন কামনাময় প্রেম। কবিতায় নারীর রূপের বর্ণনা থাকে; তিনি বর্ণনা করলেন পুরুষের রূপ – গ্রিক পুরাণের প্রেমের দেবতা ‘ইরস’তাঁর আরাধ্য। যেমন ‘অন্য এক বংশলতা’ (‘ওস্ত্রা এসতিরপে) কবিতায় –

এখানে শায়িত আমি, কামনায় তপ্ত কুঞ্জে,

উপ্ত বীজের পরিচর্যায় সেই স্থলে জন্ম নিতে পারে

অন্য এক বংশলতা – পাগলামিতে অনন্য, মহান!

দেশটি চিন্তাভাবনায় সমসময়ের তুলনায় প্রগতিশীল হলেও ধর্মে গোঁড়া ক্যাথলিক – দেলমিরার কবিতা তাঁদের গভীর ধর্মভাবনা এবং তীক্ষè নীতিবোধের দেয়ালে ধাক্কা দিলো – তাঁর কবিতার বাঁধনছাড়া কামনা-বাসনাকে মন্তিভিদিওর অভিজাত সমাজের কাছে মনে হলো অপবিত্র, অশ্লীল এবং শালীনতার সীমা লঙ্ঘনকারী। প্রথমদিকে তাঁকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন জানিয়েছিলেন রুবেন দারিও এবং উরুগুয়াইর অগ্রজ কবি হুলিও হেরেরা ই রেইসিগ (১৮৭৫-১৯১০); শেষোক্তজন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন ‘সতীত্ব এবং যৌনতাড়না’ (‘এল পুদোর, লা কাচনদেস) নামে – ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সমাজের মতন বিংশ শতাব্দীর মন্তিবিদিওতেও অভিজাত বংশের রমণীরা বহিরঙ্গে সতীত্বের পরাকাষ্ঠা দেখান, কিন্তু অন্দরমহলের গোপনে পরিচালিত হয় তাঁদের যৌন ফ্যান্টাসির পাশবিক চরিতার্থতা। প্রকাশ্যে তীব্র সমালোচনা হলেও গোপনে তাঁর পাঠিকার সংখ্যা বাড়লো।

১৯১০ সালে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রভাতসংগীত’ (কানতোস দে লা মানিয়ানা) – এই গ্রন্থেও তাঁর চিন্তন এবং প্রকাশভঙ্গি বিষণ্ন এবং আবেগতাড়িত। যৌনতার অনুশীলনে, উদ্যাপনে এবং উদ্ভাবনে নারী পুরুষের সমান এবং প্রতিদ্বন্দ্বী – আজ থেকে একশ বছরের বেশি আগে এমন প্রকাশ্য উচ্চারণ করার সাহস এবং বুকের পাটা দেখিয়েছিলেন তিনি। আর্হেন্তিনার প্রাবন্ধিক সিলভিয়া মলয় (১৯৩৮- ) এই গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ÔAgustini’s sexuality is something that needs to be said, to be inscribed, not as a whimper of a woman vanquished, that gets lost is the wind, but as a triumphant, terrible cry of pleasure.Õ আমি এই গ্রন্থের তিনটি কবিতা এখানে অনুবাদ করেছি – ‘ডানাগুলো’, ‘তুমি যখন ঘুমন্ত’ এবং ‘অনির্বচনীয়’।

প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া নির্বাচিত কবিতার সঙ্গে বেশ কিছু নতুন রচনা যুক্ত করে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়

তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শূন্য পানপাত্র’ (লস কালিসেস বাকিওস)। ওই একই বছরের ১৪ আগস্ট তাঁর বিবাহ এনরিকে হোব রেইসের (১৮৮৫-১৯১৪) সঙ্গে – কীভাবে তাঁদের প্রথম পরিচয় ঘটে তা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। মানুষটি ধনীর সন্তান – শৌখিন এবং আবেগপ্রবণ; মৃত্যুর পরে তাঁর কক্ষে পাওয়া যায় আটটি মহার্ঘ্য টুপি এবং ৪২টি সুদৃশ্য নেকটাই। যতদূর জানা যায়, তাঁর পরিবারের ছিল আরবি ঘোড়া আমদানির রমরমা ব্যবসা।

চার

আগুস্তিনি-রেইস দম্পতির প্রেম, বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তথ্য অপ্রতুল; রেইস মানুষটি ছিলেন বেশ চড়া মেজাজের এবং নিয়ন্ত্রণকারী। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে – সেখানে সমবেত অভ্যাগতদের সামনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করতে থাকেন বিয়ের নথিপত্রে স্বাক্ষর করা ঠিক হবে কি না।

প্রেমেপড়া যুবতীর সংগত উচ্ছ্বাসের রীতিমতো অভাব সেখানে। পরিবারের সদস্যরাও অবাক হয়েছিলেন সদ্য মফস্বল থেকে শহরে আসা এই যুবকের সঙ্গে তাঁর আকস্মিক ঘনিষ্ঠতার কারণে। কিন্তু যোগ্য পাত্র বলে তাঁর সবকিছু মেনে নেন। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরে এসেও স্বামীগৃহে যেতে অনিচ্ছা – শেষ পর্যন্ত মা-বাবা তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করান। প্রেম ও কামনা যাঁর কবিতার মূলমন্ত্র, রক্তমাংসের প্রেমিকের প্রতি তাঁর এই ব্যবহারে তাঁর মানসিক দ্বন্দ্বই প্রকাশ পায়।

বিয়ের ঠিক এক মাস বাইশ দিন পরে তিনি স্বামীকে ছেড়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসেন; মায়ের প্রশ্নের উত্তরে কেবল বলেন, ‘এমন চূড়ান্ত অশ্লীলতা অসহ্য লাগে আমার।’ আদালতে দরখাস্ত পেশ করেন সম্পর্কচ্ছেদের (সেপারেশন) জন্যে, কিন্তু বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্যে নয় (ডিভোর্স)। অভিযোগ : স্বামীর অভদ্রজনোচিত আচরণ। গবেষকেরা এখনো আলোচনা করে যান তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে – হয়তো রেইসের প্রভুত্বমূলক ব্যবহার মেনে নিতে পারেননি আগুস্তিনি; হয়তো জনপ্রিয় কবির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে হীনমন্যতায় ভুগতেন রেইস। সত্যি কথাটা  এখন আর জানা সম্ভব নয়।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – বিবাহিত সম্পর্ক ছেদ হলেও তাঁদের সম্পর্ক ছেদ হলো না। রেইস থাকতেন এক বোর্ডিং হাউসে – আগুস্তিনি নিয়মিত সেখানে যাওয়া-আসা করতেন বাড়িতে লুকিয়ে, অনেক সময় রাতও কাটাতেন সেখানে; তাঁর বাড়িওয়ালি পরে পুলিশের কাছে সেই তথ্য জানিয়ে বলেন যে, স্বামীসকাশে স্ত্রীর আগমনে তিনি অন্যায় কিছু দ্যাখেননি। ডিসেম্বর ১৯১৩ থেকে জুন ১৯১৪ পর্যন্ত এইভাবেই কাটে তাঁদের যুগলজীবন। তারপর এসে পড়ে সেই শোচনীয় দিন – জুলাই ৬, ১৯১৪।

রেইস ডেকে পাঠান আগুস্তিনিকে – জানান যে, তিনি চিরকালের মতন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আর্হেন্তিনা – সেখানে গিয়ে তিনি চেষ্টা করবেন প্রেয়সীকে ভুলে থাকার; কিন্তু একবার শেষ দেখা করতে চান তাঁর সঙ্গে। আগুস্তিনি রাজি হন – তার পরের ঘটনা সকলের জানা – যদিও পটভূমি আবৃত গভীর রহস্যে। রেইস নিজের পিস্তল থেকে দুটি গুলি করেন আগুস্তিনির মস্তিষ্কে, তারপর আরো দুটি গুলি নিজের মস্তিষ্কে – পুলিশ এসে দেখে দুটি রক্তাক্ত মৃতদেহ পাশাপাশি শায়িত। রেইস হত্যা করেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে অথবা দুজনের মধ্যে হয়েছিল কোনো আত্মহত্যার চুক্তি? কবির প্রথম দিকের রচনা ‘অন্তরঙ্গ’ (‘ইনতিমা) কবিতায় কী তারই ইঙ্গিত রয়েছে –

আমার প্রেম তো তুমি জানো, চলো চলে যাই,

অনেক অনেক দূরে ফুল হয়ে ফুটে ওঠা রাতে;

যেখানে মানব ভয়ে ভীত, সেখানে মানব অন্যমনে

নিরন্তর জীবনকে দ্যাখে, শোনে, অনুভবে জানে।

চলো এই রাতে আমরা রাতের গভীরে গিয়ে ঢুকি

যেখানে প্রতিধ্বনি হয় না আমার গায়ে লেগে,

নিশীথ পুষ্পের মতো কামনা, কোমলতায় শায়িত

নিজেকে ধরবো মেলে তোমার পৌরুষ অঙ্গে নিতে।

রেইস কর্তৃত্ব বিস্তারকারী মানুষ, কিন্তু আগুস্তিনি অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার মানুষ নন। অতএব গভীর প্রেম ও কামনা থাকলেও যৌথজীবন যাপন তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। অনেক সমসাময়িক মানুষের মতে, স্ত্রীর কবিখ্যাতির জন্যে হীনমন্যতায় ভুগতেন রেইস। কবিতার মতন জীবন এই কবির, আবার কবিতার মতন মৃত্যুও। তাঁর ২৭ বছরের জীবন ছিল কবিতা আর মৃত্যু, ছিল কামনা-বাসনার আগুন, ছিল আবেগের আতিশয্য। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকে সমালোচকেরা তুলনা করেছেন উল্কার সঙ্গে। অনুজা কবি আলফনসিনা স্তর্নি (১৮৯২-১৯৩৮) তাঁর জীবনকে তুলনা করেছেন আগ্নেয়গিরি থেকে উঠে আসা জ¦লন্ত অগ্নিশিখার সঙ্গে। কবির মৃত্যুর ঠিক ১০৮ বছর পরে, আসুন তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ি বাংলা অনুবাদে –

ডানাগুলো

দেলমিরা আগুস্তিনি

দুটো ডানা ছিল আমার একদা …

হ্যাঁ, দুটো!

দুটো ডানা,

হ্যাঁ, সত্যি সত্যি ছিল নীল আকাশে

দুটো নক্ষত্রের ভিত্তিভূমির মতন।

দুটো ডানা

জীবনের, মরণের, স্বপ্ন কল্পনার

সব অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

দুটো ডানা

আন্দোলিত, উজ্জ্বল নক্ষত্রের উড়ন্ত পালের মতন ঝলকায়,

দুটো ডানা

যেন দুটো নভোমণ্ডল

তাদের ঝড়, প্রশান্তি আর নক্ষত্রপুঞ্জ সমেত।

ডানাগুলোর স্বর্গীয় শোভা মনে পড়ে তোমার?

তাদের সংগীতের সোনালি ঐকতান,

তাদের অনির্বচনীয় উজ্জ্বল রঙে

রামধনুর অন্তহীন সব মণিমুক্তা ছড়ানো –

তবে নতুন একটা রামধনু,

ঝলমলে এবং স্বর্গীয় –

যাতে ভবিষ্যতের নিখুঁত চোখজোড়া

(যে চোখের মণিতে আলোর পরিপূর্ণ ঝলক)

মাতবে তাদের উড়ানের অর্চনায়।

জ¦লন্ত, বুভুক্ষু, অদ্বিতীয় উড়ান,

বৈকুণ্ঠকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে এতদিন,

অকালে ঘুম ভাঙিয়েছে সূর্যের, উল্কার আর ঝড়ের,

কেড়েছে তাদের দীপ্তি আর পূর্ণতা

জন্ম দিয়েছে বজ্রবিদ্যুৎ আর নতুন নক্ষত্রের :

পৃথিবীতে

ছড়িয়েছে যথেষ্ট তাপ এবং ছায়া –

এমনকী, যাতে কেউ কল্পনা করে নিতে পারে

দুরধিগম্য ‘সীমানাকে’ছাড়িয়ে যাবার কথা।

একদিন আমি যখন আলোড়িত আর

বিচিত্রভাবে নিঃশেষিত

শুয়ে আছি ধরিত্রীর বুকে,

ঘুম এসে যায় অরণ্যের গভীর, নরম গালিচায় …

স্বপ্ন দেখি স্বর্গীয় সব বৈভবের।

ভাবি, তোমার মুখের হাসি

ভাঙিয়েছে আমার সুখনিদ্রা …

কিন্তু ছুঁতে গিয়ে খুঁজে পাই না ডানা দুটো!

আমার ডানা দুটো …

আমি দেখি … চোখের সামনে

গলে যাচ্ছে তারা –

আমার দুই বাহুর ফাঁকে –

ঠিক যেমন গলে বরফ!

[মূল কবিতার নাম ‘লাস আলাস’। দুটি ইংরেজি অনুবাদ এলিজাবেথ গর্ডন এবং আলেহান্দ্রো কাসেরেসের।]

তুমি যখন ঘুমন্ত …

দেলমিরা আগুস্তিনি

আমার দু-হাতের অঞ্জলিতে মহার্ঘ্য মণিমুক্তোর মতন

ঝকঝকে তোমার শীর্ষ; তাকে কল্পনা করে নিই

দামি গয়নার বাক্সে, এবং আলো থেকে আলো,

আর ছায়া থেকে ছায়ায়, আমি চেটে খাই তার সৌন্দর্য।

দুঃখকে ফিল্টার করে নিয়ে, হয়তো

তোমার দু-চোখে জমা হয় জীবন,

স্বপ্ন দেখি … গভীর দুটো ফুলদানিতে

মর্মর পুষ্পের মতন শোভা পায় তোমার মস্তক।

তোমার কপালে যখন চাঁদের আলোর শুভ্রতায়,

নিস্তরঙ্গ হ্রদের অতল থেকে নীরব এক দৈত্য হয়ে,

উঠে আসে বিশাল, নিঃশব্দ স্বপ্নেরা …

আহ! ভয় লাগে তোমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে…

তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে গোপন জীবন … জানি না

কোন রাতচরা, গোপন, অজানা জগতের তুলনা

                                              সেখানে …

[মূল কবিতার নাম ‘তু দরমিয়াস’, ইংরেজি অনুবাদ আলেহান্দ্রো কাসেরেস]

অনির্বচনীয়

দেলমিরা আগুস্তিনি

অপূর্ব আভাসে মরে যাই … এ কিন্তু জীবন নয়

যে আমাকে মারে … প্রেমও তা নয়, এমন কী মৃত্যুও;

যে চিন্তা আমাকে মারে, ক্ষতের মুখের মতো বোবা …

তুমি কি পেয়েছো এক অনির্বচনীয় ব্যথা, যেন

বিশাল চিন্তন কোনো গেড়েছে শিকড় আজ তোমার সত্তায়,

খেয়েছে চৈতন্য আর স্থূল দেহ, ফুর হয়ে ফুটতে দেবে না

                                                                           আর তাকে?

শে^তবামনের মতো এক নক্ষত্রকে, কখনো কী অনুভব

করেছ অন্তরে, দেয় না সে কোনো আলো, শুষে নেয়

                                          অনন্ত সত্তাকে?

শহিদত্বের চূড়া! … তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া আজীবন

বাঁধন-ছেঁড়া ও বন্ধ্যা, বিয়োগান্ত বীজগুলি তার

শ^াপদ দন্তের ধারে বিদ্ধ করে শরীর তোমার!

একদিন তুমি তাকে বিলোপ করার পরে খুঁজে পাবে ফুল

অলৌকিক আর অলঙ্ঘিত … আহ, তার চেয়ে বড় কিছু নেই

ঈশ^রের মস্তকটি দু-হাতের পুণ্যে ধরে রাখা।

[মূল কবিতার নাম ‘লো ইনেফবেল’। ইংরেজি অনুবাদ কার্ল কার্চওয়ে এবং আলেহান্দ্রো কাসেরেস।]

আধ্যাত্মিক দিনলিপি

দেলমিরা আগুস্তিনি

আমার চৈতন্য এক হ্রদ;

হ্রদ, এক স্বর্গীয় পেয়ালা

শান্ত নিশীথে ওই নক্ষত্রপুঞ্জের নীড়,

পাখির, ফুলের আর ধরিত্রীর পেয়ালা

রাজহংসের আর মানবসত্তারও।

১। আমার চৈতন্যে এক হ্রদ ছিল …

                আমার চৈতন্য এক ঝর্নাধারা

                বাগান যেখানে গান গায়; গোলাপেরা লজ্জায় রক্তিম

                আকাশে ওড়ে তাদের সাংগীতিক ডানা;

                দিনের স্বর্ণালংকারে

                খোদাই করে মণিমুক্তা গানের ছন্দে তালে।

২। আমার চৈতন্যে এক হ্রদ ছিল …

                আমার চৈতন্য এক নদী

                স্ফটিকের দীর্ঘ আলিঙ্গনে বয়ে যায়

                রেশমি ত্বকে তার

                হীরকের প্রশান্তিময় পথ।

৩। আমার চৈতন্যে এক নদী ছিল …

                আমার চৈতন্য এক স্রোতস্বিনী।

                এক ঝলমলে সুরলহরীর আচ্ছাদন তার গায়ে,

                সেই অন্তহীন আড়ালকে

                সরায় এক বিষণ্ন গম্বুজ,

                কামনায় গিলে ফেলে তাকে।

৪। আমার চৈতন্যে ছিল এক স্রোতস্বিনী …

                আমার চৈতন্যে পুরো একটা সাগর,

                অতল গহ্বরে শয়তানের উগরে দেওয়া নয় :

                সে এক মুক্তাখচিত প্রাসাদ, মায়াবিনীরা

                                          অপেক্ষায় সেখানে,

                সব উপকূলের জন্যে দরজা খোলা,

                সেখানে দুর্লভ প্রেমের অন্তহীন পদচারণা …

                একটা লিলিফুলও ডুববে না সেখানে।

৫।          আমার চৈতন্যে ছিল এক সাগর …

                আমার চৈতন্যে এক জলাভূমি;

                ক্রন্দন রেখে যায় বেদনা,

                ধরিত্রী রেখে যায় অমঙ্গল,

                কেউ মনে রাখে না আজ সেখানে স্ফটিকের উপস্থিতি;

                সে জানে না কুহকিনী, গোলাপ অথবা ঐকতানের কথা;

                দিবসের স্বর্ণালংকারে খোদিত হয় না নতুন মণিমুক্তা…

                কান্নার স্রোতে বেদনা আর অশুভ পৃথিবীময় …

৬।          আমার চৈতন্য এক জলাভূমি;

                কোথায় পাবো সেই চৈতন্য, যার তমসাচ্ছন্ন

                কেন্দ্রস্থল থেকে উঠে আসবে

                বিশাল স্ফটিকসম বীজ?

[মূল কবিতার নাম ‘দিয়ারিও এস্পিরিতুয়াল’। ইংরেজি অনুবাদ আলেহান্দ্রো কাসেরেস।]

তথ্যসূত্র

১. Selected Poetry of Delmira Agustini: Poetics of Eros’ edited and translated by Alejandro Caceres; Southern Illinois University Press; 2003.

২. Modern Women Poets of Spanish America by Sidonia Carmen Rosenbaum; Hispanic institute; 1945.

৩. Delmira Agustini, Sexual Seduction, and Vampiric Conquest by  Cathy L. Jrade, Yale University Press; 2012.