দূরে থাকা একান্ত আপন মনের মানুষ

পরিচয়ের প্রথম থেকেই অনুভব করতাম, হাসনাতভাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর পুরো নাম আবুল হাসনাত। লেখালেখি করতেন মাহমুদ আল জামান নামে। আমি তখন ছাত্র ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের, যার তৎকালীন নাম ছিল ঢাকা কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস। আমার ঠিক উলটো ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি। মার্জিত, গোছালো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। জ্ঞানীও ছিলেন। অন্যদিকে আমি ছিলাম অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন, মূর্খ আর শিক্ষার অভাব।

আমার আঁকা ছবি তিনি প্রথম থেকেই খুব ভালোবাসতেন ও পছন্দ করতেন। আমার আঁকা কালো জলরঙে দেখতে ভীষণ ময়লা জেলেপাড়ার ছবিগুলো সেই সময় তিনি খুব পছন্দ করেছিলেন। ছবি আঁকতে গিয়ে তৃপ্তি না পাওয়ায় অসন্তুষ্টির কারণে অনেকবার ওয়াশ দিতে দিতে ছবিগুলো কালো করে ফেলতাম। সম্ভবত এ-কারণে তাঁর কাছে এই ছবিগুলো আরো বেশি ভালো লেগেছিল।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা বলি। তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম চারুকলার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরতেন সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। তাঁকে দেখে মনে হতো সেই সময়কার স্বদেশি আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তখন থেকে দেখতাম, প্রায়ই তিনি চারুকলায় আসতেন। সঙ্গে থাকতেন মতিউর রহমান, মানে আমাদের মতিভাই। এছাড়াও সঙ্গে থাকতেন মফিদুল হক। তাঁরা আসতেন রফিকুন নবী স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। দূর থেকে দেখতাম আর ভাবতাম তাঁরা বেশ জ্ঞানী ও ভদ্র মানুষ। এভাবেই তাঁদের দেখতে খুব ভালো লাগত। তাঁরা আমার উলটো চরিত্রের মানুষ মনে হলেও তাঁদের মধ্যে অনেক গুণ ছিল বলে আমার মনে হতো। স্বপ্নেও ভাবিনি যে, তাঁদের সঙ্গ পাবো, তাঁদের কাছে যেতে পারব।

এর মধ্যেই দিন দিন আমি আমার ছবি আঁকার সাধনায় নিমগ্ন হলাম। কালক্রমে সৌভাগ্যবশত আমি তাঁদের আদরের পাত্র হলাম, বিশেষ করে হাসনাত ও মতিভাইয়ের সঙ্গে। অনেকদিন থেকে খেয়াল করেছি, শিল্প-সমালোচনা বিষয়ক লেখায় হাসনাতভাই মূর্ত বা বিমূর্ত ছবির ক্ষেত্রে খুব নিখুঁত বিশ্লেষণ করতেন। এমনকি লেখায় তিনি যে টার্ম ব্যবহার করতেন তা শিল্পী ও সমঝদার ছাড়া আর কারো পক্ষে তেমন অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই, বরং আজ সম্মানিত বোধ করছি, ১৯৮০ সালে এগ টেম্পেরায় লালন নিয়ে আমার একক প্রদর্শনী সম্পর্কে তিনি যথাযথ মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছেন।

কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের পর হতে আমাকে তিনি অনেক ভালো ভালো লেখার অলংকরণ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যেহেতু আমি অলংকরণ করতে অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই সেগুলো আমার ছবির মতো করেই এঁকেছি। সেই ছবিগুলো তিনি সযত্নে রেখে দিতেন।

এবার আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে চাই। যার জন্য আমি তাঁর আরো ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। তখনো চারুকলার ছাত্র আমি। ১৯৬৯ সালে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর হাসনাতভাই ও মতিভাই আর চিত্রশিল্পীদের উদ্যোগে এক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেখান থেকে অনেকেই চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেছিলেন। চিত্রকর্ম  বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থে কেনা চাল, কাপড় ও অন্যান্য উপকরণ নিয়ে একটি দল গিয়েছিল চট্টগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করতে। এ-দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওয়াহিদুল হক, আবুল হাসনাত, তারেক আহসান এবং সিদ্দিকুর রহমান খান। আমাকে এবং আমার সহপাঠী প্রিয় বন্ধু শিল্পী বীরেন সোমকে ওই উদ্যোগে সহযোগিতা করতে কর্মী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। কারণ তখন আমরা ছিলাম তরুণ, সবল ও কর্মঠ।

আমরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ত্রাণ বিতরণ করেছিলাম। এর মধ্যেই ছিল পুলিশের উপদ্রব। তৎকালীন পাকিস্তানে আইয়ুব খান আমলের আইন-কানুনবিরোধী মতাবলম্বীরা ছিলেন পুলিশের লক্ষ্য। ওই সময় এত ভারি ভারি চালের বস্তা কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া আর অল্প আহার এবং রাতে ঘুমাতাম এক স্কুলকক্ষে ছাত্রদের বসার বেঞ্চে। সেখানে ছিল ছারপোকার তীব্র জ্বালাতন। সহ্য করতে না পেরে ঘুমিয়েছি স্কুলের বারান্দায়। শুয়ে থাকার সময় আমাদের পাশ দিয়ে লাইন ধরে ছারপোকা যেত। চট্টগ্রামে ঠিক কতদিন ছিলাম আজ আর মনে নেই। সেই সময়ে আমার সুযোগ হয়েছিল হাসনাতভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করার। একসঙ্গে মানুষকে সাহায্য করা, একসঙ্গে সমুদ্র দেখা, একসঙ্গে ঢাকায় ফেরা। জীবনে প্রথমবার সমুদ্র দেখেছিলাম হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে।

একটা কথা আজো মনে আছে। মনে থাকারই কথা। চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা আমি একদমই বুঝতাম না। ত্রাণ নেওয়ার সময় তারা ঘরের চালের টিনকে ‘টইন’ আর ভাতের চালকে ‘চইল’ বলত। একদিন এক গ্রামের স্কুলের শিক্ষক উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে ত্রাণ কেনার টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরে আমি বললাম, চিত্রপ্রদর্শনী থেকে চিত্রকর্ম বিক্রি করার অর্থ দিয়ে। এটা শুনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় না বলে আমার বোঝার সুবিধার্থে সাধু ভাষায় বললেন, ‘চিত্র বিক্রয়লব্ধ অর্থ! উত্তম প্রচেষ্টা বটে।’ যখন আমার এই কথা মনে হয়, তখনই হাসনাতভাইয়ের কথা মনে পড়ে।

তাঁর সঙ্গে শেষ দিনগুলোর কথা মনে হলে চোখে জল চলে আসে। ২০১৮ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী আমাকে সুযোগ করে দেন হাসনাতভাইয়ের প্রতিকৃতি আঁকতে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিকৃতিটি করতে হবে। এত পটু শিল্পী নই আমি। ছবি আঁকতে আমার অনেক অনেক সময় লাগে। লুভা আপা বললেন, অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিকৃতিটি আঁকতে হবে। আমার কাণ্ডারির কাছে অনুরোধ করে আশীর্বাদ চাইলাম যেন ছবিটি অল্প সময়ের মধ্যে আঁকা শেষ হয়। একই সঙ্গে চিন্তা ছিল, ছবিটি যেন আমার মনের মতো আঁকতে পারি। যখন ছবিটি আঁকা শুরু করলাম, প্রতি মুহূর্তে হাসনাতভাইয়ের মুখের আলোকচিত্র দেখতাম আর হাসনাতভাইকে অনুভব করতাম।

হাসনাতভাই স্মরণে এই লেখাটি যখন লিখছি, ভাবছি আমার মতো মূর্খের কলমের কালিতে কীভাবে কালি ও কলমের সম্পাদক প্রিয় হাসনাতভাইকে নিয়ে লিখব, কীভাবে তাঁকে উপস্থাপন করব কিংবা কীভাবে তাঁর সম্পর্কে সবাইকে জানাব। ক্যানভাসে-তুলিতে তাঁর প্রতিকৃতি আঁকার সুযোগ পেয়েছি বলে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ভীষণ প্রচারবিমুখ ছিলেন। প্রতিকৃতিটির আলোকচিত্র ফেসবুকে প্রকাশের অনুমতি চাওয়ায় তিনি রাজি হননি। আমার অনেক অনুরোধের পর তিনি রাজি হয়েছিলেন। যেহেতু তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। হাসনাতভাইয়ের চিরবিদায়ের পর তাঁর একমাত্র কন্যা দিঠি হাসনাত প্রতিকৃতিটি দিয়ে ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার করেছে। এতে তাঁর প্রতি সম্মান এবং আমার প্রতি ভালোবাসা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে। পরিশেষে বলি, আমার লেখায় কোনো ভুল হয়ে থাকলে সবার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। হাসনাতভাই, যেখানে থাকেন, ভালো থাকেন। আপনার প্রিয় শহিদ কবীর।