ঊষর দিন ধূসর রাত
পাপড়ি রহমান – বেঙ্গল পাবলিকেশন্স
ঢাকা, ২০২৫ – ৫৬০ টাকা
নব্বইয়ের দশকের আলোচিত কথাকার পাপড়ি রহমান। চলতি বছর (২০২৫ সাল) বেরিয়েছে তাঁর নতুন উপন্যাস ঊষর দিন ধূসর রাত, প্রকাশক বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। উপন্যাসটি পড়ে মনে হলো, বাংলাদেশের উপন্যাসের বিষয় ও ভাষায় একটা বদল ঘটেছে। প্রেমসর্বস্ব নর-নারীর সম্পর্কের গল্প ফেঁদে একটা সিনেম্যাটিক কাহিনি তৈরি করার প্রথাগত ধারা থেকে সরে আসছেন ঔপন্যাসিকরা। এটা খুব ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বলে মনে করি।
পাপড়ি রহমানের পোড়া নদীর স্বপ্নপুরাণ (২০০৪), বয়ন (২০০৮), পালাটিয়া (২০১১), নদীধারা আবাসিক এলাকার (২০১৯) বিষয় ও পটভূমি ছিল অঞ্চলবিশেষের জনজীবন, বিলুপ্ত পেশা বা গড়ে ওঠা জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা। ঊষর দিন ধূসর রাতে দেখা যায়, পাপড়ি রহমান লিখেছেন নগর ও নাগরিক জীবন এবং বৈরী সময়ের বিরূপ বাস্তবতার মানুষদের নিয়ে। উপন্যাসের ‘প্রসঙ্গ-কথা’ (যদিও উপন্যাসের কোনো কৈফিয়ত বা গৌরচন্দ্রিকা থাকাকে আমি সংগত মনে করি না। কারণ সৃষ্টিশীল লেখক জগতের কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন, লেখক হবেন মুক্ত, স্বাধীন) প্রাক্কথনের শুরুর বাক্যটি এরকম – ‘পানস সাপের খপ্পরে পড়া হাড়গিলা পাখির আর্তচিৎকারে ভরে থাকা দিনগুলির মাঝে নতুন কোনো লেখার কথা ভাবতেই পারছিলাম না। চারপাশে নিশ্ছিদ্র আঁধার – তাতে ক্রমাগত ভাসন্ত-ডুবন্ত আমি! … নগর-জীবন নিয়ে লিখবার তাগিদ দিয়েছিলেন আমার প্রণম্য দুই শিক্ষক … উপন্যাসের চরিত্র-কবি সজল আহমদ। এই কবি চরিত্রের প্রয়োজনে কিছু কবিতার অন্বেষণে ছিলাম। কোথা পাই, কবি সোহেল হাসান গালিবকে বলতেই ও সানন্দে সম্মতি দিলো। এই উপন্যাসে ব্যবহৃত সমস্ত কবিতা এই কবির লেখা। … একটি কবিতা সৈয়দ শামসুল হকের অনুমোদিত।’ ঋণস্বীকারের প্রয়োজনে হয়তো লেখকের এই প্রাক্কথন। বোঝা যায়, ব্যক্তিগত এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ‘ঊষর’ (অনুর্বর) ‘ধূসর’ (পাংশু, বিবর্ণ) দিনরাত্রি যাপনের কঠিন বোঝার চাপের মধ্যে থেকে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে। কাহিনি-চরিত্রের মধ্যেও সেই বিরূপ সময়ের ছাপ স্পষ্ট।
উপন্যাসে লেখক প্রচুর রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। চরিত্রগুলোর মধ্যে দিনের রূপকে শেফালি-বাদল আর রাতের রূপকে মুম-সজল আহমদের কথা বলা হয়েছে। ভাষা-সংলাপেও রূপকের ব্যবহার চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক চিত্র প্রতীকায়িত করেছে। সকাল ও সন্ধ্যার আকাশ, মেঘের বিচিত্র রং, গাছ-পাতা-ফুল-পাখির রূপকাশ্রয়ে যে-বয়ানরীতি পাপড়ি রহমান প্রয়োগ করেছেন, তা চমৎকার।
উপন্যাসের উপরিভাগ ও ভেতরকাঠামো বিন্যাসের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের আঙ্গিকগত সচেতন পরিচর্যা প্রত্যাশা করেছিলাম; কিন্তু ঔপন্যাসিক সমান্তরালভাবে তিনটি কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে উপন্যাসের স্ট্রাকচার ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। ১.
শেফালি-বাদলের তিক্ত, অসহ্যকর দাম্পত্য সম্পর্ক অর্থাৎ প্রথম সন্তান তুহিন জন্মের পর – ‘তুহিন তখন শেফালির পিঠে আর মাহিন পেটে। ঢাকায় পড়াশুনা করবে বলে কিশোরী চম্পা এসেছে শেফালির কাছে। ভাই জোবায়ের কাউন্দিয়া থেকে চম্পাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। বোনের কাছে থেকে মেয়েটা মানুষ হোক। … সেই অন্ধকারেও সন্তর্পণে বিছানা ছাড়ল বাদল। শেফালির কাঁচা ঘুম টুটে যায়। চোখ মেলে তাকায়, কই যাচ্ছে বাদল এত রাতে? মুহূর্তে শেফালি শিকারি বিড়াল হয়ে ওঠে। … বাদল আলগোছে খুলে ফেলে চম্পার ঘরের দরোজা। চিৎ হয়ে শোয়া – সফেদ ফলের মতো গোলাকার স্তন। … বাদলের কোন হাতটা বেশি নড়ছে? ডান নাকি বাঁ। লুঙ্গির ভেতর … ‘এই ঘরে আসছ কেন তুমি? কেন আসছ? কী করতাছ?’ এতসব প্রশ্নের জবাব কি আছে বাদলের কাছে? … শেফালি দুই হাতে প্রাণপণে ঘুষি চালায় নিজের পেটে। … বিশ্বাসঘাতকের সন্তানের মা সে আর হতে চায় না। … একটা আর্তচিৎকারে চিতাবাঘের মতো অন্ধকার টুকরো টুকরো হয়ে লুটিয়ে পড়ে।’ (পাপড়ি, ২০২৫ : ৮৭) সেদিনই ভেঙে গিয়েছিল শেফালি-বাদলের সংসার। তারপরও অকথ্য অত্যাচার, অফিস থেকে ফিরতে বিলম্ব হলে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করে সন্তান-সামাজিকতার ভয়ে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল শেফালি। ছেলেরা একটু বড় হলে, তুহিন নিজেই বলে – ‘মা, এত অপমান সহ্য হয় না, তারচেয়ে তোমরা আলাদা হয়ে যাও, বাবার থেকে ডিভোর্স নাও।’ একদিন সত্যি শেফালি তুহিন, মাহিনকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যায়। কিন্তু গোলাপি বাড়িটার কথা ভুলতে পারে না সে। কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের ফ্ল্যাটে ওঠার পরও বারান্দা থেকে দেখে দুটো বাচ্চা – জেহিন আর রাহিন। তাদের মায়ের নাম পারুল কিন্তু শেফালি ডাকত শিশিরকণা। বাসার কাজের বুয়া জাহানারাকে সঙ্গে নিয়ে দু-একবার সে গিয়েছিল ওই বাসায়। একবার গিয়ে দেখে শিশিরকণার চোখে আঘাতের চিহ্ন; কিন্তু কীভাবে আঘাত পেয়েছে – শিশিরকণা বলে না। শেফালি বুঝতে পারে, স্বামীরূপী কুৎসিত কাপুরুষের নির্যাতনের চিহ্ন। একদিন ভোরে দেখে গোলাপি বাড়িতে অজস্র লোক, পুলিশ এসেছে। মাহিনকে দরজা ধাক্কা দিয়ে পাঠায় ঘটনা কী জানতে। মাহিন এসে বলে, ওই চারতলার মহিলা আত্মহত্যা করেছে; সে একা নয়, বাচ্চা দুটোর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারপর মহিলা সুইসাইড করেছে। পুলিশ এরকমই বলছে। – ‘ভুল শুনেছিস। ওর নাম পারুল না, ওর নাম শেফালি। আমি ডাকতাম শিশিরকণা।’ পুলিশ লাশ নামাতে নামাতে বলল, ‘কী সংঘাতিক মহিলা। নইলে নিজে তো মরে গেছে, বাচ্চা দুটোরেও মেরে ফেলে? … ওর হাজব্যান্ড পারুল পারুল বলে কান্তাছে।’ … ‘ভুল শুনেছিস। ওর নাম পারুল না, ওর নাম শেফালি।’ … ‘আম্মা, তুমি কী বলতেছ, বুঝতেছ? সবাই বলছে উনার নাম পারুল আর তুমি বলতেছ শেফালি?’ সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে – ‘শেফালি মেয়েটা শেষমেশ আত্মহত্যা করল? ক্যান ও এমন করল?’ … একেবারে চোখের সামনে দ্বিতীয় শেফালির মৃত্যু দেখল সে। দ্বিতীয় শেফালি জেহিন ও রাহিনকে নিয়ে কোথায় অন্তর্লীন হলো? প্রথম শেফালি জোড়াতালির জীবন নিয়ে দিব্যি বেঁচে রইলো।’ (পাপড়ি ২১০২৫ : ২০২-২১১) আসলে সুইসাইড করা পারুল কি বাদলের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল? বা সেই স্বামী নামক কুপুরুষের অত্যাচার, নিত্যনিপীড়ন, অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহননে জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছে? তুহিন, মাহিনের মা শেফালি ওই নিপীড়িত নারীর জায়গায় বসিয়ে নিজেই ফেলে আসা ভীতসন্ত্রস্ত জীবনকে কল্পনা করে অতঙ্কে চিৎকার করে কেঁদেছিল? এই রহস্য ঔপন্যাসিক স্পষ্ট করেননি। আমার মনে হয়, গোলাপি রঙের বাড়িটা রূপক চরিত্র আর সেই পারুল আসলে শেফালির আনকনশাস মাইন্ড। ‘স্টিম অব আনকনশাস’ বা চেতনাপ্রবাহ এটা নয়, চেতনাপ্রবাহরীতিতে বহির্বাস্তবের ঘটনা এবং ব্যক্তির মনোজগতের চিন্তা সমান্তরালভাবে ঘটে। এখানে শেফালির মধ্যে সেরকম ঘটতে দেখা যায় না। শেফালির ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, আতঙ্ক-শিহরিত ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া। যদিও উপন্যাসের বর্ণনায় মা-বাবার তিক্ত দাম্পত্য জীবন, দুই অসহায় শিশুর শৈশব, পরে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকার সময় দরজা বন্ধ করে থাকা, মদ খাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত তুহিনের কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া মা শেফালির পোড়াজীবনের ধোঁয়ার মতো শহরের আকাশ ধূসর হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় কাহিনি হচ্ছে মুমু-কবি সজল-টুলকির প্রেম নামক রিরংসার কাহিনি। মুমু আর টুলকি দুই বান্ধবী মিলে ‘ধরিত্রী’ নামে অনলাইনে টাঙ্গাইলের শাড়ির ব্যবসা করে। টাঙ্গাইল থেকে অরিজিনাল শাড়ির কালেকশন করা হয় বলে এ-শাড়ির ব্যাপক চাহিদা, ব্যবসাও বেশ জমে ওঠে। মুমু উত্তরায় নিজেদের একটা ফ্ল্যাটে একা থাকে। তার পরিবারের অন্যরা কানাডাপ্রবাসী। তার মা কানাডা থেকে বারবার ফোন করে – তুই কানাডা চলে আয়, নাহলে বাংলাদেশে তোর পছন্দমতো কোনো ছেলেকে বিয়ে করে সংসার শুরু কর। এভাবে একা থাকিস না। কিন্তু মুমু সে-কথা গায়ে মাখে না। চুটিয়ে প্রেম করছে কবি সজল আহমেদের সঙ্গে – দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ। দারুণ সব কবিতা লিখে মুমুর মনকে ভরিয়ে তোলে সজল। রাত কাটায় মুমুর ফ্ল্যাটে, রাতে মুমুর দেহটাই হয়ে ওঠে সজলের কবিতার খাতা। সজলকে অনেকবার বিয়ের কথা বলেছে মুমু; কিন্তু সজল বিয়ের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন। বিয়ে করে সে মুমুর দায়িত্ব নিতে চায় না। দিন কাটলেও রাতে মুমু অস্থির, বুভুক্ষু হয়ে ওঠে। সজল এলে সে আদিম খেলায় মেতে ওঠে। খালি ফ্ল্যাটে অবাধ মেলামেশার ফলে মুমু প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা মুমু সজলকে জানায়; কিন্তু সজল নির্বিকার। জগৎ-সংসার সম্পর্কে অনাসক্ত না হলে বুঝি কবিতা লেখা যায় না? ‘গেট শিওর’ স্ট্রিপে প্রমাণ মেলে। ‘টারমিনেক্স’ অ্যাবরশন ড্রাগ। ‘এক কবির প্রেমিকা মুমু – প্রেমিকের সামনে টারমিনেক্স ট্যাবলেট। জামরঙা বর্ডার দেওয়া সাদাটে বক্স, যার ভিতরে রয়েছে মুমুর প্রাণ-ভোমরা। অচিরেই এই ভোমরার ডানা দুটি ছিঁড়ে ফেলবে মুমু। অ্যাবরশনের যন্ত্রণায় নীল, জরায়ু থেকে রক্তাপ্লুত হয়ে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে ‘শিশুপ্রাণ’। ডাক্তার বলেছিল, ‘প্রথম সন্তান অ্যাবরশন করলে, পরে বাচ্চা নাও হতে পারে!’ ডাক্তার তো জানে না, মুমু আর সজলের সম্পর্কটা কী? … এই দেহের ভেতরই জন্ম নিয়েছিল এক প্রাণ। সে জীবনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে মুমু। জীবনহত্যাকারী মুমু। খুনি।’ (পৃ ১২৮) ফলে শরীরী কমনীয়তা হারায় মুমু। এর ফাঁকে টুলকির সঙ্গে সজল আদিম খেলায় মেতে ওঠে। ‘কেন এত হাসে টুলকি? কেন এত হাসে সজল?’ মুমু বুঝতে পারে, সজলের আকর্ষণ এখন টুলকির দিকে। তারপর একদিন টুলকিও নিজের নারীত্বের বড় সম্পদ হারিয়ে মুমুর ফ্ল্যাটে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কবি সজল আহমেদ নিখোঁজ, তার ফোন বন্ধ, বাসায় তালা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, সজল অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছে। টুলকি ফোনের স্ক্রিনে মুমুকে দেখায়, কবি সজল আহমেদের বিয়ের ছবি। প্রেম, কাম, রিরংসায় প্রতারিত হয়ে দুই নারীর ভেতর জ¦লে ওঠে ঈর্ষার আগুন। মুমু উত্তরায় থানায় গিয়ে সজলের নামে একটা অভিযোগ করলে কিছুদিন পর পুলিশ সজলের সন্ধান পায় এবং সজল ও মুমুকে একই সময় থানায় আসতে বলে। নির্দিষ্ট সময় মুমু হাজির হলেও সজল হাজির হয় না। পরে একদিন মুমু পথের মধ্যে স্ত্রীসহ সজলকে পায় এবং পেয়ে নিজের রাগ-ক্ষোভ সামলাতে পারে না। লোকসম্মুখেই সজলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে – ‘তোর লজ্জা করে না, আমার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে আরেক মহিলার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে? কুত্তার বাচ্চা, তুই ওরে বলিস নাই আমি তোর কে? না বলেই বিয়ে করেছিস? … এত ফ্রটগিরি ক্যান করলি তুই? বেজন্মা, ফকিন্নির পুত। একদিন তুই এই বিট্রের ফল পাবি। পাবিই। …’ মুমু ‘থু, ওয়াক থু’ বলে একদলা থুতু তার দিকে নিক্ষেপ করে। কিন্তু দূরত্বে থাকায় থুতুটা সজলের গায়ে পড়ে না।’ (পাপড়ি ২০২৫ : ২০৪-৫) কিন্তু ছাতিম গাছের সুঘ্রাণ মুমুর পিছু ছাড়ে না। ‘তেলেসমাতি আর প্রলোভন। ধোঁকাবাজি আর গরিমা। লোভ আর লালসা – এসবের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আকাশচারী ইমারত। যত দিন গেছে এ-শহরের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ বেড়েছে। … মুমু দেখেছে – ও তো পথ নয়, ও হলো নদী। অশ্রুনদী।’ (পাপড়ি ২০২৫ : ২২৯) তৃতীয় কাহিনি হচ্ছে বকুল এবং দৈনিক বিভাবসু পত্রিকার সম্পাদক আল মোসাদ্দেকের গোপন প্রণয়। বকুল বিএ পাশ করা কাউন্দিয়া গ্রামের মেয়ে। বড় ভাই জাফর, আসগরের একরোখা শাসন, নিয়মের বেড়াজালে আটকাপড়া জীবন অসহ্য লাগে। গ্রাম্য প্রেমিক রাহাত বড়জোর বাজারে একটা দোকান দিয়ে জীবন চালাতে চায়। তার সঙ্গে বকুল জীবন কল্পনা করতে পারে না। একরাতে মা মালিহা খাতুনের দুইপদ গহনা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা শহরের সৎফুপু শেফালির কাদেরাবাদ হাউজিং ফ্ল্যাটে ওঠে। বকুলের এই হঠাৎ আসাকে শেফালি সহজভাবে নেয় না। কারণ, ইতঃপূর্বে বকুলের বোন চম্পাকে এনে তার সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই শেফালি গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে – ‘জরুরি কোনো কাজে এসেছিস? কাজ থাকলে থাকতে পারিস দুই-একদিন।’ … ‘ফুপু আমি একটা কাজ পেলেই চলে যাব।’ ‘কাজ? ঢাকা শহরে কাজ আর টাকা দুইটাই হাওয়ায় ওড়ে – এরকম ভাবিস নাকি তোরা?’ (পাপাড়ি ২০২৫ : ৬০) পরে অবশ্য বকুল ‘নিবেদিকা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে’ জায়গা করে নেয়। তার চাকরি হয় দৈনিক বিভাবসু পত্রিকায়। এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক মোসাদ্দেকই তাকে চাকরিটা দেয়। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে বকুল মা মালিহা খাতুনের জন্য একটা শাড়ি কুরিয়ারে পাঠায়; কিন্তু ভাই জাফর তা ফেরত পাঠালে বকুল খুবই দুঃখ পায়। রাজধানীতে আসার পর কাউন্দিয়া গ্রামের প্রতি কোনো টান অনুভব করেনি বকুল। কিন্তু মা-বাবার কথা সে ভুলতে পারে না। মা মালিহা খাতুন একবার খুব অসুস্থ হলে বাবা জোবায়ের বকুলকে খবর দেয়। মধ্যরাতে খবর পেয়ে বকুল নদী পার হয়ে ছুটে আসে বাড়ি। অসুস্থ মায়ের সঙ্গে শুয়ে ছিল সে; কিন্তু বড়ভাই জাফর এসেই ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়ে কেন আবার ফিরে এলো, তাদের মানসম্মানের কথা একবার কেন ভাবলো না?’ এই বলে ‘জাফর ডান হাত তুলে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় বকুলের গালে। বকুলকে মারধর করে। ‘পালাইয়া গিয়ে আবার আইছে ক্যান?’ বাবা জোবায়ের তখন বলে – ‘আমিই আইতে কইছি ওরে। তুমাগো যেমন দাবি আছে, বকুলের কি নাই? ওরও বাড়ি কি এইডা না?’ এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা নিয়ে বকুল ফিরে আসে ঢাকায়।
আসা-যাওয়ার পথে বোরকাপরা এক মহিলাকে দেখে কিন্তু কে এই মহিলা? কেনই বা তাকে ফলো করছে? বকুল কিছুই বুঝতে পারে না। একই অফিসে কাজ করতে গিয়ে আল মোসাদ্দেক বকুলের প্রেমে পড়ে। যদিও মোসাদ্দেক বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক, দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান বেশ, তবু মোসাদ্দেকের কেয়ারিং, তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, হোটেলে লাঞ্চ-ডিনারের ফাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। মোসাদ্দেক আগের বউয়ের সঙ্গে ডিভোর্সপত্র দেখায়। বলে – ‘বুঝলা বকুল, আমার কোনো পরিবার নাই, আমি হইলাম পাখি। আমি হইলাম দামাল বাতাস। খালি উড়ি আর ঘুরি। ঘুরি আর উড়ি।’ (পাপড়ি ২০২৫ : ১৫৯) বকুলকে বিয়ে করে মোসাদ্দেক একটা ফ্ল্যাটে ওঠে। বিয়ের অল্পকিছুদিন পরেই মোসাদ্দেকের হাবভাব পাল্টে যায়। কখনো সে রাতে ফেরে না, কাজ আছে বলে বকুলকে এড়িয়ে যায়। এক সকালে বকুল অফিসে গিয়ে শুনতে পায়, মোসাদ্দেক হার্ট অ্যাটাক হয়ে হাসপাতালে আছে। বকুল ছুটে যায় হাসপাতালে, গিয়ে দেখে সেখানে তার আগের স্ত্রী-সন্তানরা আছে। বোরকাপরা সেই মহিলাই তার স্ত্রী। বকুলের চোখে পুরো জীবনটাই ধূসর হয়ে ওঠে। ঢাকা শহরে নারী-নিগ্রহ, নারীদের বঞ্চনার গল্প যেন ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
উপন্যাসের আখ্যান (ঘটনা পরম্পরা) বিন্যাসে শিথিলতা আছে। তিনটি কাহিনি সমান্তরাল বর্ণনা করতে গিয়ে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। হয়তো ঔপন্যাসিকের মূল প্রকল্প ছিল নগর ও নাগরিক জীবনকে তুলে ধরা; কিন্তু ঢাকার নাগরিক জীবন কি সেই অর্থে কাহিনিতে উঠে এসেছে? অর্থাৎ কাহিনি সুগঠিত নয়, উল্লম্ফনধর্মিতা আছে। শেফালি-মুমু-টুলকি-বকুল এই নারীদের অন্তর্জীবনের নির্মম বাস্তবতাই উপন্যাসের মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। নারী চরিত্রের যেরকম আত্মবিশ্লেষণ আছে, পুরুষ চরিত্রের আত্ম-উন্মোচন সেভাবে ঘটেনি। আর পুরুষগুলো যেন ষণ্ড, প্রতারক, নারী-নিপীড়ক, রিরংসায় কাতর!
উপন্যাসের ভাষা ব্যবহারে লেখক ব্যঞ্জনারীতি প্রয়োগ করেছেন। উপমা, চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী। এখানে সম্পর্কের টানাপড়েন, জটিলতা, পারস্পরিক আসক্তি-অনাসক্তি এবং মনোজগতের নানা বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় ব্যবহৃত কবিতাগুলোর রূপকধর্মিতায়। এখানে প্রেমের চেয়ে দেহের, দেহের চেয়ে ভোগের নিরীক্ষা করেছেন লেখক।
তোমার মুখের দিকে ফিরে তাকালেই যদি সব
বোঝা যেত, কাঠবিড়ালির পিছে পিছে এতদূর
আসবার মানেই ছিল না। থাকতাম চুপচাপ
অর্জুন ফুলের মতো সম্ভ্রান্ত যোনির কাছে বসে
এ-উপন্যাসে যে-কবিতাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে,
নারী-পুরুষের রিলেশন, মনস্তত্ত্ব, রহস্যময় চেতনাজগৎকে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে। নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে সেটার অন্য বিশ্লেষণ হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তা অব্যাখ্যাত, জটিল ও অমীমাংসিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে ভাবা যায়। ঔপন্যাসিকের মনে দর্শন-চিন্তা উঁকি দেয় – ‘এই পলিমাটিতে জন্মায় অতীত বৃক্ষ। এই বৃক্ষে দুই ধরনের ফলই ফলে – সুখের এবং দুঃখের ফল। সুখের ফল আর দুঃখের ফল দুইটাই জীবিত মানুষদের খেতে হয়। না খেয়ে উপায় নাই। এই দুনিয়ার এমন রীতি। … এই ফলের নাম মৃত্যুফল। তুমি খেতে না চাইলেও এই ফলই একদিন তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’ (পাপড়ি ২০২৫ : ১৫৮) জীবনের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অজস্র রূপময় ইমেজ। যেমন – ‘ভালোবাসা হলো কাঁচা ডিমের ভেতরে থাকা হলদেরঙা কুসুমের মতো। সামান্য নড়ে উঠল কী, অমনি অন্যজন তা টের পেয়ে যায়।’ এ-জায়গায় ঔপন্যাসিকের অসাধারণ সৃজনশীল কল্পনাপ্রবণতাকে প্রশংসা করতেই হয়। তুহিন হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে শেফালি ভাত রান্না করার সময় একমুঠ চাল বেশি দিত। তার ধারণা, তুহিন যদি কোনো মধ্যরাতে ফিরে আসে, তখন ক্ষুধার্ত ছেলেটার জন্য ভাত পাবে কোথায়? আর তুহিন যেরকম ছেলে, ভাতের অপেক্ষা না করে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে। শেফালির অপেক্ষা শেষ হয় না, কারণ তুহিন রাজনীতিসচেতন ছিল, দেশে চলমান ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিত। তাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে তুহিন গুমের শিকার হয়। বহিঃস্থ বাস্তব নয়, বর্ণিত বাস্তবকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই উপন্যাসত্ব। এ-উপন্যাসে ঢাকা শহরের চলমান বাস্তবতাকে ধারণ করা হয়েছে এবং সেটাই ঔপন্যাসিকের উদ্দেশ্য ছিল। জীবনকে খুলেমেলে ধরতে গিয়ে কি যৌনতা একটু বেশি হয়ে গেছে? ‘বাসায় ফিরে প্যাকেট খুলে শেফালি বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। ডিল্ড – সিলিকন পুরুষাঙ্গ! রুলি এটা ওকে দিতে পারলো?’ (পাপড়ি ২০২৫ : ১৭৩) ‘টেক্সট’ এবং ‘কনটেক্সট’-এর মধ্যে সৌন্দর্য সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। আবেগ উৎপাদনের ওপর ভর করে ভোক্তার জন্য বিনোদন সৃষ্টি আর্ট হতে পারে না। আশার কথা, পাপড়ি রহমান জীবনবোধ ও আর্টের দিকে সমান দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.