কাজল রশীদ শাহীন
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে/ নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু/ শুধু তুমি,/ আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে/ পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান/ বিব্রত বাংলায়,/ বজ্রে বজ্রে বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার। (শহীদ কাদরী, ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’)।
মার্কিন ভূমে বাস করেও যে-কবি চুম্বন পৌঁছে দিতে চেয়েছেন বাংলায়, তাঁকে উত্তর প্রজন্মের কোনো কবি যখন ‘পাখিজীবনের কবি শহীদ কাদরী’ শিরোপা দেন, তখন আমরা হই যতটা না বিস্মিত, তার চেয়ে অধিক হই মুগ্ধ ও গর্বিত। অবশ্য, এ-গর্বে নেই কোনো দাম্ভিকতা, আছে শহীদ কাদরীকে আবিষ্কার ও এষণার প্রতি যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর বাঞ্ছা। রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার অমেয় বাণীতে স্নাত হয়ে কীভাবে সোনা ফলিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের কবি ও কথাকার মিলটন রহমান। তুমি বলেছিলে, ‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।’ কবি শহীদ কাদরী ইহজাগতিকতার সংজ্ঞায়নে অতীত হলেও তিনি বর্তমান। তিনি কাজ করে যাচ্ছেন গোপনে গোপনে। এ-কারণে শহীদের দেশত্যাগ কিংবা স্বেচ্ছানির্বাসন যেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কবিতা সৃজনে, তেমনি তাঁর দেহান্তরও কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় বা যবনিকা ঘটাতে পারেনি, পারে না। কারণ শহীদ ‘অতীত’ হলেও গোপনে গোপনে তাঁর রয়েছে প্রবল উপস্থিতি। নতুন কবির নতুন কবিতা নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি আছেন, থাকবেন কাব্যের ললিত ভুবনে। এ-কারণেই মিলটন রহমান শহীদ কাদরীকে বলেছেন, ‘পাখিজীবনের কবি শহীদ কাদরী’। তাঁর যুক্তিটা হলো, ‘আমি মূলত বলতে চেয়েছি নতুন কোনো কবিতা রচনা না করার ভেতর দিয়ে কবি কীভাবে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি একজন কবি সবসময় কবিতা রচনা করেন। এমনকি কবি মৃত্যুর পরেও কবিতা রচনা করেন। অনেকেই বলে থাকেন শহীদ কাদরী প্রবাস জীবনে তেমন কোন কবিতা রচনা করেননি। এ-কথাটিকে আমি ভুল প্রমাণ করেছি। বলেছি তিনি কখনো কাব্য রচনা থেকে বিরত থাকেননি। এটি গভীর নিরীক্ষণের বিষয়।’ শহীদ কাদরীকে নিয়ে এরকম নতুন ভাষ্য দাঁড় করিয়েছেন মিলটন রহমান কবি শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থে।
বিচিত্র, কৌতূহলোদ্দীপক ও নয়াভাষে সমৃদ্ধ সব প্রবন্ধের সমাহার ঘটেছে উপর্যুক্ত প্রবন্ধগ্রন্থে, যা নবীন-প্রবীণ সবাইকে জোগাবে ভাবনার খোরাক। প্রবন্ধগুলো হলো, ক. জাদুর বংশীবাদক মার্কেজ, খ. তখন টেড হিউজ অন্য নারী শয্যায় ছিলেন, গ. তীব্র সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথের স্ট্রে বার্ডসের চায়না অনুবাদ, ঘ. নীলপদ্মের উদ্যান জিংকি বয়েস, ঙ. অনন্ত যাত্রার কবি আবুল হাসান, চ. পাখিজীবনের কবি শহীদ কাদরী, ছ. দীর্ঘ সহবাসের জিয়ল জখম, জ. তান্ত্রিক হুমায়ুন আজাদ।
প্রবন্ধকার বর্তমানের প্রবন্ধসাহিত্যের যে প্রচল প্রবাহ (দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া) সে-পথে হাঁটেননি মোটে। প্রতিটি প্রবন্ধেই নতুন কিছু বলার, নতুন যুক্তি তুলে ধরার, নতুন প্রবণতা ধরার চেষ্টা করেছেন। ফলে, পাঠকের জন্য প্রতিটি প্রবন্ধপাঠ সময় অপচয় না হয়ে বিষয়ান্তরে যেতে জোগাবে অভীপ্সা। ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণে মিলটন রহমান মননশীল সাহিত্যে যে প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছেন, তা সৃজনশীল যে কারো জন্য হতে পারে শস্নাঘার বিষয়।
মার্কেজকে নিয়ে লেখার নিশ্চয় অন্ত নেই। তাহলে মিলটনের লেখাই-বা কেন, আর এই লেখা পাঠ জরুরিই বা কেন? জরুরি এই কারণে যে, প্রবন্ধকার এখানে নতুন কিছু বলেছেন, নতুন ভাবনা আহরণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি মার্কেজের জাদুবাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছেন এবং জাদুবাস্তবতার ব্যবহারে মার্কেজের স্বকীয়তা ও ব্যতিক্রমী দিক চিহ্নিত করেছেন।
একইভাবে তিনি যখন টেড হিউজের কথা বলছেন, তখন টেড হিউজের তুলনামূলকভাবে কম জানা কিংবা অজ্ঞাত দিক উন্মোচনের প্রয়াস চালিয়েছেন। নামকরণে আমরা প্রবন্ধটিতে ব্যক্তিমানসের উপস্থিতি দেখলেও তার ভেতরপাঠ কিন্তু শুধু ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। টেড হিউজ ও সিলভিয়া পvথের কবিতা নিয়েও কথা বলেছেন, আর সিলভিয়া পvথের আত্মহত্যার সময় টেড হিউজের অবস্থান নিরূপণ করেছেন মননশীলতার শর্ত ও দাবির প্রতি বিনত থেকেই।
স্ট্রে বার্ডসের চায়না অনুবাদকের অভিজ্ঞতা, অনুবাদের দুর্বলতা ও চীনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি উপলব্ধ করতে হলে এই প্রবন্ধপাঠ জরুরি। বিশেষ করে অনুবাদক ফ্যাং টাংয়ের রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটি, যাতে সাহিত্যমনস্ক ও সাহিত্য-কারবারি উভয়ের জন্যই রয়েছে বিবিধ চিমত্মার রসদ।
নোবেল বিজয়ী লেখক সেটলানা আলেক্সিয়ভিসের এ জিংকি বয়েস উপন্যাস নিয়ে আলোচনাটাও চিত্তগ্রাহী। রিপোর্টিংধর্মী এ-উপন্যাসে প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন সাংবাদিকের দৃষ্টি যখন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টি হয়ে ওঠে তখন তাঁর সৃষ্টিতে যোগ হয় কেমন মাত্রা।
আবুল হাসানকে যাঁরা পাঠ করেন কারণে-অকারণে তাঁদের জন্য তাঁকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটি পাঠের দাবি রাখে বিশেষভাবে। কারণ আবুল হাসানের কবিতায় যে স্বর তা যে একই সময়ে অন্যত্রও প্রতিভাত হয়েছে তা উন্মোচন করেছেন প্রবন্ধকার। ফলে, এই প্রবন্ধে আবুল হাসানের বিশ্বভ্রমণের গীত অন্বেষণের পাশাপাশি তাঁর দর্শনের উচ্চকিত স্বরূপ হয়েছে আলোকিত।
শহীদ কাদরীর প্রবন্ধ নিয়ে আগেই বলেছি। দীর্ঘ সহবাসের জিয়ল জখম কবি শামীম আজাদের কাব্যগ্রন্থ জিয়ল জখম নিয়ে রচিত প্রবন্ধ। এটি বই নিয়ে আলোচনা হলেও তা হয়নি, ফ্ল্যাপসর্বস্ব ও সূচিপত্র তুলে ধরার অচল প্রয়াস। তিনি আস্তএকটি প্রবন্ধই লিখেছেন, যার পরতে রয়েছে শামীম আজাদের কবিতার খোলনলচে ধরে ধরে অবলোকন ও মর্মার্থ উদ্ধারের গবেষণার প্রয়াস।
তান্ত্রিক হুমায়ুন আজাদ একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা হলেও তাঁর জ্যোতির্ময়তাকে নতুন আলোয় উদ্ভাসনের চেষ্টা প্রশংসিত ও ধন্যবাদার্হ।
মোট আটটি প্রবন্ধের সমাহার ঘটেছে এই বইয়ে, যার প্রতিটিই স্বতন্ত্র বই হওয়ার দাবি রাখে। এই স্বতন্ত্রতা না হওয়ায় মিলটন রহমানের প্রবন্ধ যেভাবে ভাবনা উদ্রেককারী হয়েছে, সেভাবে পরিণত নয়। এ-কারণে বক্তব্য শেষাবধি থিতু হতে পারেনি, যা হলে প্রবন্ধসাহিত্য হতো আরো ঋদ্ধ, সম্পদমান ও উৎকর্ষবাহী।
প্রবন্ধগ্রন্থটি পাঠে স্পষ্টত যে, এটির সম্পাদয়ন কর্মটি হয়নি বা হলেও নয় সুচারু। বেশকিছু ভুল শুধু পীড়াদায়ক নয় নিবিড় পাঠের ক্ষেত্রে বিরক্তি উদ্রেকের শামিল। এসব এড়ানো নয় মোটেই জটিল ও অসম্ভব কর্ম, যদি তাতে যুক্ত হয় আন্তরিকতা ও পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতার চ্যালেঞ্জ। আগামীর মতো প্রকাশনীর কাছে এ প্রত্যাশা নিশ্চয় নয় অতিরিক্ত ও আকাশকুসুম কল্পনার ফানুস।
গ্রন্থনামে শহীদ কাদরীর সঙ্গে কবি শব্দটা কি জরুরি ও অপরিহার্য? শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ নাম হওয়া কি ছিল না যুক্তিযুক্ত ও নন্দনযোগ্য?
মিলটন রহমান কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিণত। আলোচ্যগ্রন্থ তাঁর পরিচিতরূপকে করেছে অলংকৃত। সৃজন ও মননে তিনি যে অশ্ব রেখেছেন ধাবমান, তা আরো গতিশীল হবে, কবি শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থে সেই পদছাপ সমুজ্জ্বলতায় রয়েছে দীপ্যমান। শহীদ কাদরীকে নতুন ভাষ্য দেওয়ার এই প্রয়াস আরো বাঙ্ময় হোক নব সৃষ্টির ব্যঞ্জনায়, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদের ডালিতে রইল সে-প্রত্যয় ও হিরণ্ময় প্রত্যাশা।