নীলনির্জনে : ছন্দের গদ্য, না গদ্যের ছন্দপ্রাপ্তি

‘কবিতা, কল্পনালতা’য় আমি বিশ্বাস করি না। যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি, অর্থাৎ চোখ-কান-স্পর্শ কি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের যোগাযোগ তৈরি হয়নি তাকে নিয়ে আমি লিখতে পারি না। আমি এমন কোনো মানুষের মুখ আঁকবার চেষ্টা করিনি যা আমার মাথা থেকে বেরিয়েছে। আমি শুধু আমার সামনে যে লোকটাকে দেখেছি, তার মুখটাকেই ধরবার চেষ্টা করেছি। সে ছাড়া আর

কেউ আমাকে নাড়া দিতে পারে না।’

২০০৬-এর বইয়ের দেশের (এপ্রিল-জুন) একটি সাক্ষাৎকারে এমনই এক বাস্তবানুগ মন্তব্য করেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তুলে ধরেছিলেন তাঁর আজীবনের সাহিত্যসাধনার মন্ত্রটিকে। তাঁর বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্মে নতুনত্বের ছোঁয়াচ পাঠকমনকে এক নিবিড়তা দান করে। কবিতামাত্রই তাঁর কাছে অতিকথন কিংবা অনুভূতির প্রগলভতা নয়। স্বল্পভাষ্যে, শব্দপ্রয়োগের সপ্রতিভতায় নীরেন্দ্রনাথ কবিতাকে করে তুলেছিলেন স্মার্ট এবং আধুনিক। কখনো আখ্যান, আবার কখনো নাট্যধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে কবিতার শরীর জুড়ে তিনি আজীবন এক নিরীক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই নিরীক্ষাই ছিল জীবনব্যাপী তাঁর কাব্যসাধনার মূলধন।

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর, ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় এসে সেন্ট পলস কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫১-তে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। প্রথমে কেবল বার্তা বিভাগের দায়িত্ব নিলেও পরবর্তীকালে তিনি ‘রবিবাসরীয়’ এবং তারও পরে সম্পাদকীয় বিভাগের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। আনন্দমেলার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার ভার তিনি বহুদিন সামলেছেন। উল্লেখ্য, এই পত্রিকার জন্যই নীরেন্দ্রনাথ, ছোটদের জনপ্রিয় কমিক্স ‘টিনটিনে’র বাংলা অনুবাদ করেন। বলা বাহুল্য, পেশাগত জীবন এবং কবিসত্তাকে সারাজীবন এক সুদক্ষ ভারসাম্যে নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনি।

১৯৪০ সাল থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে।

১৯৫৪-তে প্রকাশিত হয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নীলনির্জনে। পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ অন্ধকার বারান্দা (১৯৬০), নীরক্ত করবী (১৯৬৫), কলকাতার যীশু (১৯৬৯), উলঙ্গ রাজা (১৯৭১), পাগলা ঘণ্টি (১৯৮০), জঙ্গলে এক উন্মাদিনী (১৯৮৯) প্রভৃতি। নীরেন্দ্রনাথের কবিতা একেবারেই স্বতন্ত্র ঘরানার। চলিস্নশের বামপন্থী উজ্জীবনের দশকেও, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। তাঁর কবিতা নিতান্ত আত্মগতও নয়। নিজস্ব শৈলী বজায় রেখে, সরল চিত্রকল্পে, দৈনন্দিন যাপনের টুকরো টুকরো উপাদানকে তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় করে তুললেন। কবিতার কী ও কেন গ্রন্থে তিনি লিখছেন, ‘কবিতা আসলে শব্দ নয়, বরং শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণপনা। ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয়। … অথবা বলতে পারি, কবিতা আসলে ভাষার একটি স্তর, কবিতা বলে গণ্য হতে হলে আমাদের ভাবনার শব্দ-রূপকে যে-স্তরে উত্তীর্ণ হতে হবেই; আবার, অন্যদিকে, গদ্য রচনাও যে-স্তরকে মাঝে-মাঝে স্পর্শ করে যায়।’ কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এই গদ্যকেই তিনি মান্যতা দিয়ে এসেছেন। তাই ছন্দ-নিরীক্ষা তাঁর কাব্যে তেমনভাবে চোখে পড়ে না। আসলে কবিতা মানেই তাঁর কাছে অহেতুক সেন্টিমেন্টাল কিছু ভারী শব্দপ্রয়োগ নয়। আর ঠিক সেই কারণেই নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কাব্য-সন্তান (নীলনির্জনে) জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা কবিতা জগতে এক নতুন দিকের উন্মোচন ঘটেছিল। কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সারাজীবন মানুষের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। কবিতার শরীর জুড়ে অক্ষরে অক্ষর গেঁথে তিনি আজীবন মানুষের সাধনা করে গেছেন। এতখানি নিষ্ঠা যে শিল্পীর মূলধন, তাঁর কবিতায় অন্যান্য অলংকরণ কেবল অতিরিক্ত নয়, বাহুল্যও বটে। কাব্যরচনা শুধু তাঁর কাছে শখ নয়। সমাজের যে-শ্রেণির সমস্যার কথা কবিতায় তুলে ধরা হচ্ছে, সর্বাগ্রে তাদের সুখ-দুঃখের শরিক হতে হবে কবিকে। নতুবা সেসব কবিতা কেবল শখের সাহিত্যের গ–তেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এই বিশ্বাসেই দীক্ষক্ষত ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। গদ্যছন্দের নিখুঁত প্রয়োগে, মুখের ভাষাকেই যিনি কবিতার আশ্রয় করে তুলতে চেয়েছিলেন, তাঁর কাব্যে ছন্দ-চাতুর্য আশা করলে, যেন কিছুটা অবিচার করা হয় কবির প্রতি।

নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ নীলনির্জনে এক অর্থে মাইলস্টোন। শব্দপ্রয়োগের ছুঁতমার্গ কিংবা জটিল চিত্রকল্পের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে এসে, এই প্রথম বাংলা কবিতা গদ্যছন্দে নিজেকে মেলে ধরল পাঠকের সামনে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দই ছিলেন সাহিত্যজগতে তাঁর প্রেরণা। ১৯৯২ সালে অন্তরীপ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার তিন জগত ১. কৃত্তিবাস, কাশীরাম, ২. রবীন্দ্রনাথ, ৩. জীবনানন্দ। এরই মধ্য দিয়ে ছিল নিজের পথ করে নেওয়া। বেরিয়ে আসতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে একটা ইচ্ছে ছিল সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলব, কিন্তু সংস্কৃতের উত্তরাধিকারও ছাড়ব না। কোনো শব্দই বর্জনীয় নয়, সব শব্দই ব্রাহ্মণ …।’ বোঝা যায়, প্রবীণের প্রতি কি অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ আর নবীনের প্রতি এক অপার স্নেহের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর হৃদয়ে। অনুকরণ না করে, কেবল অনুসরণের মধ্য দিয়েও যে গতপ্রজন্মের সঙ্গে সংলগ্ন থাকা যায়, নীরেন্দ্রনাথ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

নীলনির্জনে কাব্যের ‘ধ্বংসের আগে’ কবিতায় তাঁর অপরাজিত শিল্পিত মনের আভাস পাওয়া যায়। পৃথিবীর এক একটা রাত্রি যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে, সেই পাশবিক যাপনের ভেতরেও শিল্পীমনীষার প্রতি নিশ্ছিদ্র বিশ্বাস রেখেছেন কবি। সেই শিল্পিত মনীষা, মুমূর্ষুর ওষ্ঠেও জাগিয়ে তোলে জীবনের গান। জীবনের প্রতি কোনো এক রহস্যময় বিশ্বাস থেকে মৃত্যুর অতলে তলিয়ে যেতে যেতেও মানুষ একবার ফিরে চায় জীবনের দিকে। নীরেন্দ্রনাথ লিখছেন :

কেননা আমি তো শিল্পী। যে-মন্ত্রে সমস্ত হাহাকার

ব্যর্থ হয়, মজ্জামাংস জোড়া লাগে ছিন্নভিন্ন হাড়ে,

যে-মন্ত্রে উজ্জ্বল রক্ত নেমে আসে অস্থি-র পাহাড়ে,

প্রাণের রক্তিম ফুল ফুটে ওঠে মৃত্যুহীন গাছে,

সে-মন্ত্র আমার জানা, – তাই মৃত্যু হানো যতবার

যে জানে প্রাণের মন্ত্র, কতটুকু মৃত্যু তার কাছে।

নীরেন্দ্রনাথের বহুশ্রম্নত এক উক্তি মনে পড়ে যায়, ‘কবিতাই আমার

মাতৃভাষা’। আসলে মাতৃভাষার ভেতর যে-অনর্গলতা মিশে আছে, তা তো ঠিক গুরুগম্ভীর শব্দবাণী নয়; সে তো এমনই এক মাধুর্যমিশ্রিত অথচ দৃঢ় উচ্চারণ, যা একেবারে অন্তরের গহিন থেকে উঠে আসে। কবি তো মাতৃভাষা বলতে সেই অনর্গল উচ্চারণকেই বোঝাতে চেয়েছেন। কবিতাও তাঁর কাছে সেই স্বতঃস্ফূর্ত দৃঢ় উচ্চারণ।

কেবল অমত্ম্যমিলই তো ছন্দ নয়। বিশ্বপ্রকৃতিতে ঘটমান

যে-কোনো কিছুরই একপ্রকার নিজস্ব ছন্দ থাকে। তেমনই মানুষের হৃদয়-ভাবনারও এক ধরনের ছন্দ রয়েছে। ‘শেষ প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি লিখছেন :

… সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছল

নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা

রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিয়ো,

অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিয়ো

আর কিছু নয়, আলোর ভালবাসা।

‘আশা’ আর ‘ভালোবাসা’ শব্দ দুটি এখানে অমত্ম্যমিল তৈরি করলেও, এ যেন ঠিক তথাকথিত ছন্দোবদ্ধ কবিতা নয়। এর ভেতর যেন এক গভীর মগ্নতার ইঙ্গিত লুক্কায়িত রয়েছে। আবার মিশে আছে এক সহজিয়া প্রণয়ার্তি। রবীন্দ্রকবিতার তন্ময়তা কিংবা জীবনানন্দের কাব্যের চেতনাপ্রবাহরীতিকে অতিক্রম করে এ যেন এক ভিন্নতর আত্মমগ্নতা। সেই অর্থে ঠিক আত্মমগ্নতাও নয়। হয়তো নিজের কথা বলতে বলতেই, বিশ্বজনীনতায় মিশে যাওয়ার ব্যাকুল আর্তি। নীরেন্দ্রনাথের কবিতা এইভাবেই বাঙালি পাঠককে বিন্দুতেই সিন্ধু দর্শন করালো।

সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার যে দুর্বোধ্য আকর্ষণ, তা বারবারই ধরা পড়েছে তাঁর কবিতায়। শিল্প ও শিল্পীর অন্দরের প্রণয়-উপাখ্যানের এক

মান-অভিমানের ছবি পাওয়া যায়, নীলনির্জনের একটি কবিতায়। তিনি লিখছেন :

আরো কত কাল এ-ভাবে কলম ঠেলতে হবে বলো,

আরো কত কাল সন্ধ্যাসকাল লেখা-লেখা খেলা খেলতে বলো?

কবিতার নাম ‘পূর্বরাগ’। প্রেম যখন ‘অনুরাগে’ পৌঁছেনি, যখন তা পূর্বরাগেই আবদ্ধ, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে তৃষ্ণার্ত প্রেমিক যে-অধীরতা নিয়ে তার প্রেমাস্পদের জন্য অপেক্ষা করে, ঠিক সে-অধীরতাই যেন লক্ষ করা যায় কবির ভেতর। কবিতা তাঁর কাছে নবোঢ়া প্রেমিকা, যার সঙ্গে মুহূর্তের সাক্ষাতেও সার্থক হয় কবিজন্ম। কবি ও কাব্যের অন্দরের রসায়নটিকে এমন করেই দেখতেন নীরেন্দ্রনাথ।

ইতিহাস-চেতনাও তাঁর কবিতায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে। ‘তৈমুর’ শীর্ষক কবিতায় তিনি তৈমুরকে মৃত্যুর সূচক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে তিনি লিখছেন, ‘… ভয়বিহবল মনের সমস্ত কপাট বন্ধ, এসে পড়ে কখন তৈমুর।’ সমকালীন যাপনের খ- খ- সমস্যা থেকে শুরু করে বৃহত্তর রাজনৈতিক ব্যাধি, কোনোকিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। তবে প্রত্যক্ষভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ, তাঁর কবিতাকে কখনো আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন প্রেমে। হয়তো সেই প্রেমের পরিণতি সর্বদা সুখকর নয়। হয়তো সত্যপ্রেমের সেই কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পরিশুদ্ধ হয় মানবজন্ম। সেই যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে পুড়তেই আত্মশুদ্ধি ঘটে মানুষের। এই বিশ্বাসের অতল থেকেই হয়তো উঠে আসে ‘আকাঙ্ক্ষা তাকে’ কবিতাটির শেষ কয়েকটি লাইন :

… তারপর যখন সে প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে,

শোকের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে

প্রেম তাকে দিল সান্তবনা, দিল

স্বয়ংশান্তি তৃপ্তির ঘর।

কবিতা তাঁর কাছে সহজতার নামান্তর। তাই কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্যকে তিনি কোনোদিনই সমর্থন করেননি। রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চাকে পাথেয় করলেও, তাঁর সঙ্গে মতবিরোধও ছিল

নীরেন্দ্রনাথের। অন্তরীপ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে (১৯৯২) তিনি বলছেন, ‘পোয়েটিক ডিকশন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটা ভাল লাগে না … সজনে ফুল, মুরগি কবিতায় চলবে না, কেননা রান্নাঘর এদের জাত মেরে রেখেছে। এটা ভাল লাগে না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বাঁশবন’ না লিখে ‘বেণুবন’ লেখাই ভাল।’ কথাটা মানি না। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো লিখছেন, ‘ডাহিনে বাঁশবন হেলায় শাখা’। কই, কবিতার তো তাতে জাত যায়নি।’ আজীবন ঠিক এতটাই ‘স্পেসিফিক’ ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় শব্দবিন্যাস, তাঁর কাছে একটি সুদক্ষ কৌশল। একটি আপাত শান্ত কবিতার নিরুপদ্রব পরিবেশে অপ্রত্যাশিত কিছু শব্দ গেঁথে দিয়ে কবি যেন আচমকা কশাঘাত করেন পাঠকের মস্তিষ্কে। ‘তৈমুর’ কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘রাজপথে ছিন্ন শব, ভগ্নদ্বার প্রাসাদে কুটিরে/ নির্জন বীভৎস শান্তি।’ কবিতাটির শুরুতেই মৃত্যুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধ্বংসপথযাত্রী এক শান্ত নগরীর ছবি ফুটে ওঠে পাঠকের চোখের সামনে। কিন্তু কবির কাজ তো ধ্বংসের বিবরণ দেওয়া নয়, তার জন্য তো রয়েছে ইতিহাসগ্রন্থ। সেই ধ্বংসের যন্ত্রণাটুকু সাধারণ মানুষের ভেতর চাড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কবির কাঁধে। আর তাই নগরীর শান্ত পরিবেশের বিধ্বস্ততা বোঝাতে ‘শান্তি’ শব্দের বিশেষণস্বরূপ তিনি প্রয়োগ করলেন ‘বীভৎস’ শব্দটি। এই শব্দটিই নগরীর আপাত শান্ত পরিবেশের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা পৈশাচিক ইতিহাসের ইঙ্গিত বহন করছে।

নীরেন্দ্রনাথের কবিতা সুসংহত, এলায়িত নয়। বিষয়কেন্দ্রিকতা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নীলনির্জনের অধিকাংশ কবিতা দুই স্তবক সমন্বিত। দুই স্তবকবিশিষ্ট কবিতাগুলোর কয়েকটি কবিতায় তিনি নিজের একটি বিশেষ প্রিয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। প্রথম স্তবকের শেষ পঙ্ক্তি এবং দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম পঙ্ক্তিতে তিনি অমত্ম্যমিল ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীকালে নীরেন্দ্রনাথের বহু কবিতার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগ আমাদের চোখে পড়ে। বস্ত্তত কবিতা তাঁর যাপনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আর ঠিক সে-কারণেই আমৃত্যু কবিতা নিয়ে তিনি এতখানি সফলভাবে গবেষণা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। জীবনসায়াহ্নে এসে তাঁর নাকি প্রিয়তম শখ হয়ে উঠেছিল নতুন কবিদের কবিতা শোনা। নতুন কবিদের কবিতা তাঁর কাছে ছিল একরাশ সতেজ স্নিগ্ধ বাতাসের মতো। কবিতার প্রতি এতখানি উৎসর্জন ছিল বলেই হয়তো জন্ম হয়েছিল ‘স্বপ্নকোরক’-এর মতো কবিতা। কবির

হৃদয়-নিংড়ানো বিশ্বাস থেকেই সেই কবিতায় চুইয়ে পড়েছে অদ্ভুত কিছু অক্ষরমালা :

সে এক পরম শিল্পী। সংশয়-দ্বিধার অন্ধকারে

সে-ই বারে বারে

আলোকবর্তিকা জ্বালে, দুঃখ তার পায়ে মাথা কোটে,

তারই তো চুম্বনে ফুল ফোটে,

সে-ই তো প্রাণের বন্যা ঢালে

তুঙ্গভদ্রা, গঙ্গায় কি ভাকরা-নাঙাল।

সে এক আশ্চর্য কবি, পাথরের গায়ে

সে-ই ব্রহ্মকমল ফোটায়।