নবজাতককে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখার ফালি কাপড় তুষারশুভ্র ফালি কাপড় দিয়ে নবজাতককে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাতৃগর্ভ নিশ্চয়ই আরামদায়ক আঁটসাঁট জায়গা হয়ে থাকবে, নার্স নবজাতককে তাই ফালি কাপড়ে বেশ টানটান করে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নেয়। যাতে এই অনমেত্ম ওর অভিক্ষপ্ত হওয়ার আকস্মিক ধাক্কাটা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।
সদ্য জন্মলাভ করে, এইমাত্র শ্বাস নিতে শুরু করেছে যে, সে ফুসফুসে পরিপূর্ণ করে নিল বাতাস। নবজাতক জানে না সে কে, আচমকা কোথায় চলে এসেছে, আর হঠাৎ করে চারদিকে এ কী শুরু হয়ে গেল! জীবজগতের সকল নবজাতকের মধ্যে ও যেন সবচেয়ে অসহায়, সবচেয়ে বেশি প্রতিরক্ষাহীন – সদ্যজাত মুরগির ছানা থেকেও।
রক্তক্ষরণে বিবর্ণ-পাণ্ডুর মুখে, নারী ক্রন্দনরত সেই বাচ্চার দিকে তাকায়। হতবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায়, সে ফালি কাপড়ে মোড়ানো সন্তানকে নিজ কোলে তুলে নেয়। যে-নারীর কাছে শিশুর এই কান্না থামানোর উপায় এখনো অজানা। যে-নারী এই তো মাত্র কিছুক্ষণ আগেও ভয়ানক যন্ত্রণাকর প্রসব-বেদনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে বাচ্চাটা তখন কান্না থামিয়ে দিলো। চুপচাপ হয়ে গেল। কোনো একটা গন্ধের কারণে ব্যাপারটা ঘটে থাকবে। অথবা ওরা দুজন এখনো সংযুক্ত হয়ে আছে। দেখতে না পাওয়া কালো দুটো চোখ ঘুরে নারীর মুখের ওপর নিবদ্ধ হয়, নারীর স্বরের দিকে স্থির হয়। নতুন যে জীবন শুরু হয়েছে, সে-সম্পর্কে অনবগত থেকেই ওরা দুজন এখনো সংযুক্ত হয়ে আছে। রক্তের গন্ধের মধ্যে, নীরব প্রবহমানতায়। দুটো শরীরের মধ্যে তখন ব্যবধান শুধু পেঁচানো একফালি কাপড়ের শ্বেতশুভ্রতা।
নবজাতকের পোশাক
আমার মায়ের প্রথম সন্তান – আমাকে বলা হয়েছিল – তার জন্মের দুই ঘণ্টারও কম সময়ে মারা গিয়েছিল।
আমাকে বলা হয়েছিল যে, সেই সন্তান কন্যাসন্তান ছিল; যার মুখটা ছিল সাদা অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালের পিঠার মতো ফর্সা। সে যদিও একেবারে ক্ষুদ্রাকায় ছিল, তখনো দুই মাসের অপরিণত, তবু তার হাত-পা-শরীর, চোখ-নাক-মুখ সবকিছু বেশ ভালোভাবে গঠিত ছিল। মা আমাকে বলেছিল, ‘আমি কোনোদিন সে-কথা ভুলতে পারবো না; যে মুহূর্তে ও ওর কালো চোখ দুটো খুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে ছিল!’
আমার বাবা-মা সে-সময়ে একটা গ্রামের বিচ্ছিন্ন একটা বাসায় থাকতো। বাবা যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতো, সেটার কাছাকাছি। মায়ের প্রসবের তারিখ তখনো অনেক দূর; তাই একদিন সকালে যখন তার জরায়ুর ‘পানি’ ভাঙলো, মা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল। বাসায়, কি আশপাশে, তখন কেউ ছিল না। গ্রামের একমাত্র ফোনটা বাসস্টপের সঙ্গে অবস্থিত ছোট একটা দোকানের – বাসা থেকে ২০ মিনিটের পথ। আরো ছয় ঘণ্টার আগে বাবা স্কুল থেকে ফিরবে না।
শীতের শুরুর দিক; বছরের প্রথম তুষারপাতের সময়। আমার বাইশ বছর বয়সী মা হামাগুড়ি দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটা কাঁচি জীবাণুমুক্ত করার জন্য কিছুটা পানি ফুটালো। অসহায়ভাবে তার সেলাই বাক্স হাতড়ে হাতড়ে মা এক টুকরো সাদা কাপড় পেল। ওতে নবজাতকের ছোট্ট একটা জামা হয়ে যাবে। প্রসব-যন্ত্রণায়, জরায়ুর সংকোচনে যন্ত্রণাদগ্ধ ও ভীষণ ভীত মা অনবরত অশ্রুজলের মধ্যেও অটল হাতে সুই চালিয়ে গেল। ছোট্ট সেই পোশাক তৈরি করা শেষে, মা একটা পাতলা কাঁথা পেল, যেটা দিয়ে নবজাতককে পেঁচিয়ে রাখা যাবে। ব্যথা বারবার ফিরে ফিরে আসায় মা দাঁতে দাঁত পিষে থাকলো। প্রতিবার ব্যথা ওঠার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমে আসছে; দুর্মর যন্ত্রণা আরো তীব্র-তীক্ষ্ন হয়ে উঠছে।
শেষ পর্যন্ত মা প্রসব করলো। একা হাতে নাড়ি কাটলো। এরপর রক্তে মাখামাখি ছোট্ট সেই শরীরটাকে সদ্য তৈরি করা পোশাক পরিয়ে নিল। আর গোঙানি-কান্নারত ছোট্ট ‘টুকরো’কে দু-হাতে কোলে তুলে নিল। পাতলা ফিসফিসানো কণ্ঠে, বারবার মা মন্ত্রজপের মতো বিড়বিড়িয়ে বলে চললো, ‘ঈশ্বরের দোহাই, মরে যেও না!’
এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর, নবজাতকের শক্ত করে আঁটা চোখের পাতা আচমকা খুলে গেল। আমার মায়ের চোখ তার সন্তানের চোখে মিলতেই ওর ঠোঁট দুটো পিটপিট করতে শুরু করলো, কুঁকড়ে যেতে লাগলো। ‘ঈশ্বরের দোহাই, মরে যেও না!’
আরেক ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ও মরে গেল। ওরা দুজন রান্নাঘরের মেঝেতে শুয়েছিল। মা একপাশে কাত হয়ে তার বুকের সঙ্গে মৃত সন্তানকে আলতো চেপে ধরে আছে; অনুভব করছে সেই শীতলতা, যা তার সন্তানের দেহে প্রবেশ করেছে। সেই হিম, যাতে আস্তে আস্তে ওর হাড় অবধি ডুবে যাচ্ছে। কান্নার শব্দহীন, স্তব্ধ চারপাশ।
স্তন্য
বাইশ বছর বয়সী মহিলাটি বাসায় একা শুয়ে আছে। শনিবার সকাল। মৌসুমের প্রথম তুষারকণা তখনো ঘাসের ডগায় ডগায় লেগে-লেপ্টে আছে। এক হাতে কোদাল আর হাতে মাত্র গতকাল জন্ম নেওয়া শিশুটাকে চেপে ধরে, তার পঁচিশ বছর বয়সী স্বামী পর্বত বেয়ে ওপরে উঠছে – সন্তানকে কবর দেওয়ার জন্য।
মহিলার ফোলা ফোলা চোখ ঠিকমতো খুলছে না। শরীরের কলকব্জাগুলো, হাড়ের গাঁটগুলো অত্যন্ত ব্যথাতুর। ফুলে ওঠা আঙুলের গিঁটগুলো জ্বলুনি-ব্যথায় কাতর।
আর ঠিক তখন, প্রথমবারের মতো সে তার বুকে উষ্ণ এক বান অনুভব করে! সে উঠে বসে; অপটুভাবে নিজ স্তন চেপে ধরে। প্রথমে পানি পানি, হলুদাভ ফোঁটারক্ষীণধারা; তারপর মসৃণ-পেলব ধারায় সাদা দুধ!
সে
আমি কল্পনা করি – ওই স্তন্যপানের জন্য সে বেঁচে আছে।
আমি ভাবি – তার একগুঁয়ে, জেদি শ্বাস-প্রশ্বাসকে; স্তনবোঁটার প্রতি অস্ফুট বাঙ্ময় হয়ে থাকা ছোট্ট দুটো ঠোঁট।
ওর মাতৃস্তন্য ছাড়ার পরের দিনগুলোর কথা কল্পনা করি; জাউভাত খেয়ে বেড়ে উঠছে। আর একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠে সকল সংকট, সকল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েও এগিয়ে চলেছে।
আমি কল্পনা করি, মৃত্যু প্রতিবার ওর ঠিক পেছনে থেকেও ঠোকর খেয়ে চলেছে; আর সে দৃঢ় পদক্ষপে এগিয়ে চলেছে … সামনে।
‘মরে যেও না। ঈশ্বরের দোহাই, মরে যেও না!’
শব্দগুলো ওর শরীরে-বুননে-অস্তিত্বে প্রোথিত হয়ে থাকায়, ওটাই ওর জীবনের রক্ষাকবচ।
আর, আমার পরিবর্তে ওর এখানে আসাকে কল্পনা করি।
কৌতূহলোদ্দীপকভাবে সুপরিচিত, এই অন্তরঙ্গ শহরে; যার জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে ওর মরা-বাঁচার মিল আছে।
তোমার দু-চোখ
তোমার দু-চোখ দিয়ে যখন দেখি, সবকিছু অন্যরকমভাবে দেখি আমি। তোমার শরীর হয়ে যখন হাঁটি, সে-হাঁটা একেবারেই অন্যরকম।
তোমাকে আমি পরিচ্ছন্ন সব জিনিস দেখাতে চাইতাম। এসব পাশব-নিষ্ঠুরতা, দুঃখ-ব্যথা, হতাশা-নিরাশা, আবর্জনা-কলুষতা ও ব্যর্থতা-যন্ত্রণার আগেকার যেসব পরিচ্ছন্ন জিনিস শুধু তোমার জন্য ছিল। সকল কিছুর ঊর্ধ্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যেসব জিনিস।
কিন্তু আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, ব্যাপারটা তেমন করে ঘটেনি। বারবার আমি তোমার চোখে চোখ রেখেছি; যেন গভীর কালো কোনো আয়নায় একটা প্রতিবিম্ব, একটা আকার খুঁজে চলেছি।
‘সে সময়ে যদি আমরা একটা শহরে বাস করতাম!’ শৈশবে আমার মাকে একথা অনেকবার বলতে শুনেছি। ‘একটা অ্যাম্বুলেন্স যদি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতো! ওরা যদি মেয়েটাকে একটা ইনকিউবিটরে রাখতে পারতো … চালের পিঠার মতো আমার ছোট্ট বাবুটা!’
তখনকার দিনের এক নতুন জিনিস – ইনকিউবিটর।
তুমি যদি শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু বন্ধ না করতে! তাতে করে আমার জীবনের বদলে পুরোটা জীবন তুমিই পেতে। আমার তাহলে আর কোনোভাবে জন্মই হতো না।
তোমার নিজস্ব দু-চোখ আর শরীর নিয়ে, অন্ধকার সেই আয়নাকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, যদি এতটুকু অনুমতি শুধু পেতে – দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার!
কাফন
‘তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে কী করেছিলে … মেয়েশিশুটাকে?’
যে-রাতে প্রথমবারের মতো বাবাকে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম – তখন আমি কিশোরী বয়স প্রায় পেরিয়ে গিয়েছি। আর তখনো পঞ্চাশ না-পেরুনো আমার বাবা, উত্তর দেওয়ার আগে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে ছিল।
‘ওকে একটা সাদা কাফনে মুড়ে, পর্বতের ওখানটায় নিয়ে গিয়ে কবর দিয়ে এসেছি।’
‘একা একা!’
‘হ্যাঁ, তাই। একা একা।’
মেয়েটার ছোট্ট পোশাক ওর কাফন হয়ে গিয়েছিল। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে-মুড়িয়ে রাখা কাপড়ের পুঁটলি হয়ে উঠেছিল ওর কফিন।
বাবা শুতে চলে যাওয়ার পর, নিজ-ঘরে যাওয়ার আগে আমি পানি পান করার জন্য একটু দাঁড়ালাম; আর
শক্ত-কুঁজো দুই কাঁধ সোজা করে নিলাম। এরপর হাত দিয়ে বুকের ঠিক মধ্যখানের হাড় চেপে ধরে, একটা গভীর শ্বাস টেনে নিলাম।
অন্নি
আমি ভাবতাম – আমার যদি একটা বড় বোন (অন্নি) থাকতো, তাহলে কেমন হতো। একটা বড় বোন, যে লম্বায় আমার থেকেও এক হাত উঁচু। একজন অন্নি, যে আমাকে তার হালকা তুলো-ওঠা সোয়েটারগুলো দিয়ে দিত;
অতি-সামান্য দাগপড়া চামড়ার দামি জুতাগুলো দিয়ে দিত।
আমাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়লে, যে অন্নি কোট পরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওষুধের দোকানে ছুটতো। একজন অন্নি, যে তার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমায় বকতো : ‘তোকে নিঃশব্দে হাঁটতে হবে, একেবারে নিঃশব্দে!’ একজন অন্নি, যে আমার অংকের ওয়ার্কবুকে অংকগুলো কষে দিত, সমীকরণগুলো লিখে দিত। ‘আরে, এ তো খুবই সোজা! তুই অকারণ বেশি বেশি ভাবছিস!’ বলতে বলতে, চোখ-মুখ কুঁচকে দ্রুত হাতে সমীকরণের সমাধান করে ফেলতো।
একজন অন্নি, যে আমার পায়ে তীক্ষ্ন-ধারালো কিছু ঢুকে গেলে, আগে আমাকে শান্ত হয়ে বসতে বলতো। এরপর প্রদীপটা কাছে এগিয়ে এনে, একটা সুই দিয়ে অত্যন্ত যত্নসহকারে পা থেকে সুঁচালো বস্তু বের করে আনতো। তার আগে, সুইটাকে গ্যাসের আগুনে তাপিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিত।
একজন অন্নি, যে অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা আমার কাছে এগিয়ে এসে বলতো : ‘ওসব করার কোনো প্রয়োজন নেই; অকারণ একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছে।’ এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বেখাপ্পা ওক্ষণস্থায়ী একটা আলিঙ্গন করে নিয়ে বলতো : ‘উঠে পড়, ভালোর জন্য বলছি; চল একসঙ্গে খাবো।’
ঠান্ডা একটা হাত আমার মুখজুড়ে ঘোরাফেরা করলো। পরমুহূর্তে, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওর কাঁধ দূরে সরে গেল।
হান ক্যাং : দক্ষিণ কোরিয়ান ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাস The Vegetarian-এর জন্য তিনি ২০১৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর লেখাকে ‘তীব্র কাব্যিক গদ্য, যা ইতিহাসের ট্র্যাজেডির মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং মানবজীবনের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করে’ উল্লেখ করে ২০২৪ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে সুইডিশ অ্যাকাডেমি। হান ক্যাং-এর অন্যতম বহুলপঠিত বই Human Acts। তিনি অনেক ছোটগল্প ও অণুগল্পও লিখেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, হান ক্যাং আধুনিক কোরিয়ান সাহিত্যের এক প্রতীকী কণ্ঠস্বর, যিনি মানুষের দেহ, আত্মা এবং
সমাজ-রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলোকে কাব্যিক ভাষায় প্রকাশে সচেষ্ট।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.