পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

বিংশ শতাব্দী। ১৯৪৭ সাল। ১৪ আগস্টের মধ্যরাত। জন্ম হয় দুটি রাষ্ট্র – ভারত ও পাকিস্তান। একই সঙ্গে দেশ ভাগ ও স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ। পূর্ব বাংলায় এই প্রথম একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে। জেগে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি সচেতনতা। এই জনপদের মানুষ অনুভব করে ভোট তাদের একটি অমূল্য সম্পদ। এই ভোট নির্ণয় করে দেবে ভালো-মন্দের পার্থক্য। সে-সময় মুসলীম লীগের প্রতি এ-অঞ্চলের মানুষের এক ধরনের মুগ্ধতা ছিল। সবাই নিরন্তর সংগ্রাম করেছে একটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য। অথচ দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হলো স্বপ্নভঙ্গ, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ক্রমাগত দুঃশাসন, অত্যাচার, নির্যাতন। 

একে একে এলো ভাষা-আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিপুল বিজয়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়। এসব ঘটনা এ-অঞ্চলের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। নানা ঘটনা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে সময়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আপামর বাঙালির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন রেডিওতে ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছেন

সে-সময় দেশে ছয়টি বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। তখন ঢাকার বেতার কেন্দ্র ছিল শাহবাগে। নাম ছিল রেডিও পাকিস্তান। এর আগে ৪ মার্চ এই নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। ছয়টি বেতার কেন্দ্র থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়।

৭ মার্চ বিকেল ৩টা। শুরু হবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, যা শোনার অপেক্ষায় বাংলার লক্ষ-কোটি মানুষ। ঢাকা বেতারকর্মীদের উৎসাহের কমতি নেই। সরাসরি এ ভাষণ প্রচারের জন্য নেওয়া হয়েছে ব্যাপক আয়োজন। শাহবাগ বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ভাষণের ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছে। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে মঞ্চে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। মঞ্চের সমানে তখন গণমানুষের জনসমুদ্র। সেই সমুদ্রের গর্জন –

জয় বাংলা

জয় বঙ্গবন্ধু।

তোমার আমার ঠিকানা

পদ্মা মেঘনা যমুনা।

শেখ মুজিবের পথ ধর

বাংলাদেশে স্বাধীন কর।

বঙ্গবন্ধু দু-হাত তুলে বিশাল জনসমুদ্রকে তাঁর অপার ভালোবাসা জানালেন। ঠিক সে-সময় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো একটি ঘটনা ঘটে, যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না বেতার কেন্দ্রের কেউ। তখন মেজর সিদ্দিক সালিক ছিলেন সামরিক জান্তার গণমাধ্যম কর্মকর্তা। ডিউটি রুমে টেলিফোন বেজে ওঠে। কর্তব্যরত অফিসারকে ইংরেজিতে তিনি একটি বার্তা পড়ে শোনান। এর অর্থ হলো –    পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাষণ বেতারে প্রচার করা যাবে না। তখন আশরাফ-উজ-জামান ছিলেন বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি বেতারে প্রচারের জন্য তিনি তখন ছিলেন জনসভার মঞ্চে। দ্রুত তাঁকে হটলাইনে বার্তাটি পড়ে শোনান হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে আশরাফ-উজ-জামান তাঁকে বিষয়টি জানালেন।

সঙ্গে সঙ্গে বেতারকর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না।’ হটলাইনে আশরাফ-উজ-জামানের কাছ থেকে এই ঘোষণা শোনার পর বেতার কেন্দ্র থেকে সব কর্মচারী বেরিয়ে যান। তবে সেদিন জনসভামঞ্চে থাকা বেতারকর্মীরা একটি ছোট মেশিনে বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন।

এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন ভাষণের সমাপ্তি টেনেছিলেন।

বেতারে কখনো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা না গেলে ট্রান্সমিটার বা প্রেরণকেন্দ্র থেকে তা করা সম্ভব। তখন সাভার ছিল ঢাকা বেতারের প্রেরণকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সেখান থেকেও অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধে শুরু হলো তোড়জোড়। ৪টা ৩০ মিনিটে ছিল বিকেলের অধিবেশন। তখন হাতে সময় ছিল মাত্র ১৫ মিনিট। অবশেষে ট্রাঙ্কলে সাভার ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিচালককে জানানো হলো তিনি যেন অধিবেশন শুরু না করেন। এভাবে অধিবেশন শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সম্প্রচার বন্ধ করা গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সাভারের কর্মীরা দ্রুত তাঁদের কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যান। এর ফলে ৭ মার্চের দুপুরের পর থেকে পাকিস্তানসহ সারা বিশ্ব জানতেই পারেনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তান সরকার। এই অঞ্চলের তৎকালীন সেনাপ্রধান রাও ফরমান আলীকে অবিলম্বে ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফরমান আলী রাত ১০টায় আঞ্চলিক পরিচালককে পেয়ে তাঁকে বেতার কেন্দ্র চালু করতে বলেন। কিন্তু পরিচালক জানান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করলে কোনো কর্মী বেতার কেন্দ্রে যাবেন না।

উপায় না পেয়ে ফরমান আলী তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলেন। পরিচালক তখন বলেন, রাতে সবাইকে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া অনেক কিছু ঠিকঠাক করতে হবে। এর থেকে ভালো হয় ভোর থেকে ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করলে। ফরমান আলী বাধ্য হয়ে তাও মেনে নিলেন।

১৯৭১ সালের ৮ মার্চ। সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একযোগে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় পূর্ব বাংলার সব বেতার কেন্দ্র – ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট ও খুলনা – থেকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে বসে নিজের ভাষণ শোনেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান।

২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন এর কেন্দ্রগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কখনো সম্পূর্ণ, কখনো নির্বাচিত অংশ প্রচার করা হতো। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অধিবেশনেও এ-ভাষণের সম্পূর্ণ অথবা নির্বাচিত অংশ প্রচার করা হতো। মূলত ৭ মার্চ থেকেই পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় বেতার কেন্দ্রগুলোর।

কালুরঘাটের দিনগুলো ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার স্টেশন। একাত্তরের ২৬ মার্চ এ-স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর এর নাম হয় ‘বাংলাদেশ বেতার।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর পশ্চিমা শাসকদের সঙ্গে ক্রমে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে বাংলার। ছলনা ও ষড়যন্ত্রের যুগপৎ জাল বিছায় ইয়াহিয়া খান ও তার। আসে ২৫ মার্চের কাল রাত। ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে চলে পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। রক্তে ভেসে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনসহ ঢাকার বহু স্থান; জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। গ্রেফতার করা হয় বাঙালির মুক্তির নায়ক বঙ্গবন্ধুকে। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলার, বাংলাদেশের। শত্রুদের প্রতিরোধের আহ্বান জানান বাঙালিদের প্রতি।

২৫ মার্চ রাতভর চলে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। ২৬ মার্চ ভোরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। অনেকে এ ঘোষণার লিফলেট হাতে পান। এটি ছিল একটি ইংরেজি সাইক্লোস্টাইল কপি। এর অনুবাদ করে আরো কপি করা হয়। দুপুর সোয়া ২টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান প্রথম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাদামতলী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পাঠ করেন।

চট্টগ্রাম বেতারে তখন কর্মরত ছিলেন লেখক-শিল্পী বেলাল মোহাম্মাদ, আবদুল্লাহ আল ফারুক ও ফটিকছড়ি কলেজের

সহ-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে এর পক্ষে দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তুলতে কী করা যায় ভাবনা থেকে তাঁরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন। তবে এতে নিরাপত্তা-ঝুঁকি ছিল। সৈয়দ আবদুল কাহ্হার ছিলেন তখন চট্টগ্রাম বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কাহ্হার জানান, কোনোভাবেই যেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা না হয়। কারণ যে-কোনো সময় আগ্রাবাদ ও বেতারের পতন হতে পারে। তার ওপর চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ সোয়াত ও বাবর। হঠাৎ বোমাবর্ষণ শুরু করতে পারে পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু বসে থাকার সময় নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেশসহ সারাবিশ্বের মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। তখনই তাঁদের মাথায় এলো বিকল্প ভাবনা।

প্রায় প্রতিটি বেতার কেন্দ্রের একটা ইমার্জেন্সি স্টুডিও থাকে। তখন কালুর ঘাটে ছিল চট্টগ্রাম বেতারের এরকম একটি স্টুডিও, যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে ছিল। বেলাল মোহাম্মাদসহ সবাই তখন কালুর ঘাট স্টুডিও থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওনা হন কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিওর দিকে। ২৬ মার্চ সারাদিন কাটে গভীর দুশ্চিন্তায়। কালুরঘাট পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু কীভাবে শুরু করা হবে বেতারের কার্যক্রম, কী নাম হবে –    এর কোনো কিছুই ঠিক নেই। অবশেষে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও বেলাল মোহাম্মদ ইমার্জেন্সি স্টুডিওর একটা নাম দেন –    ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।’

প্রাথমিক প্রস্তুতিশেষে ওইদিন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে কালুরঘাট স্টুডিও থেকে প্রথম যে বাক্যটি ভেসে আসে তা হলো – ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সেদিনের সেই কণ্ঠ ছিল ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপের। অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তিলাওয়াত করেন চট্টগ্রামের গীতিকার ও কবি আবদুস সালাম। এরপর তিনি বলেন, ‘… প্রিয় বাংলার বীর জননীর বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্ব লোভীদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে জানমাল কোরবানি দিচ্ছি। কোরআন কারিমের ভাষায় তাঁরা মৃত নহে অমর। দেশবাসী ভাইবোনেরা, আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম করছি। জয় বাংলা।’ ওই অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন – বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আনোয়ার আলী, ঘোষক কাজী হোসনে আরা, ফজল হোসেন ও সুলতান-উল-আলম। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন এমএ হান্নান এবং ডা. আবু জাফর।

সেই অনুষ্ঠানে এমএ হান্নানসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবারো পাঠ করেন। ইংরেজি খবর পড়েন আবদুল্লাহ আল ফারুক। এ-অধিবেশনের সময় ছিল প্রায় ৩০ মিনিট। প্রকৌশলী মুসলিম খান, দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মুসা ও মেকানিক আবদুস শুকুর দিয়েছিলেন সার্বিক কারিগরি সহায়তা। 

চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট। কালুরঘাট স্টুডিও ব্যবহারের সময় ওই ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাই ব্যবহার করা হয়। পরদিন সকাল ৭টায় পরবর্তী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ হয়।

এরই মধ্যে জরুরি হয়ে পড়ে বেতারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তখন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পটিয়ায় ছিলেন। ২৭ মার্চ বেতারের নিরাপত্তার জন্য বেলাল মোহাম্মাদ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি তিন লরি সৈন্য পাঠিয়ে বেতার কেন্দ্রে পাহারার ব্যবস্থা করেন। নিজেও কয়েকজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে সেখানে যান। ওইদিনই তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। উল্লেখ্য, ২৬ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তবে যেহেতু মেজর জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন তাই তাঁর ঘোষণাপত্র পাঠটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ ও সময়োপযোগী ছিল বলে মনে করা হয়। এর কারণ, হানাদার বাহিনী সে-সময় নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। এমন পরিস্থিতিতে একজন বাঙালি মেজরের কণ্ঠ সবাইকে আশ্বস্ত করেছিল যে, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির নিজস্ব সামরিক বাহিনী আছে।

২৮ মার্চ লে. শমশের মোবিন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তাতে সমর্থন জানিয়ে অনুরোধ করেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং সবার সম্মতিতে তা গৃহীতও হয়। সেদিন দুপুরের অধিবেশন থেকে শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। সেদিন থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ হয়ে যায় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত একটি গান তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত – ‘জয় বাংলা বাংলার জয়।’ প্রথম দিকে গানটি বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে প্রচার করা হতো। ২৯ মার্চ থেকে অনুষ্ঠানের শুরু ও শেষে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের সূচনা অংশ বাজানো হতো। এছাড়া যে-কোনো অনুষ্ঠানশেষে শোনা যেত – ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তখনই একটি জাতিকে সাহায্য করেন, যখন সে জাতি নিজেকে সাহায্য করে।’ পবিত্র কোরআনের এই বাণী সংযোজনের চিন্তা এসেছিল বেলাল মোহাম্মাদের মাথা থেকে।

২৮ মার্চ থেকে বেলাল মোহাম্মাদসহ সবাই ট্রান্সমিটার ভবনে থাকা শুরু করেন। এই বেতার কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় অনেকে যুক্ত হয়েছেন। আবার চলেও গেছেন। অবশ্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সদস্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। তাঁদের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। সে-সময় পাশের গ্রাম থেকে তাঁদের জন্য খাবার আসত। এখানে মোহরা নামে একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামে ছিল দুই ভাই সেকান্দার হায়াত খান ও হারুন অর রশিদ খান। সর্বস্ব দিয়ে তাঁরা সে-সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকে সহযোগিতা করেন। এসব মানুষের কথা ভুলে যাওয়ার নয়।

শুরুতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বেতারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। তখন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের কর্মী ও স্থানীয় অধিবাসীরা মিলে অত্যন্ত সাহসী এক পদক্ষেপ নেন, গঠন করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। তবে ৩০ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে কালুরঘাটের এই কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেয়। এই হামলায় কেউ হতাহত না হলেও বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় নানা উদ্দীপনা ও দেশপ্রেমমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে উৎসাহ ও সাহস জুগিয়ে গেছে এই বেতার কেন্দ্র। এর কল্যাণে দেশ ও বহির্বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বের কথা জানতে পেরেছেন, জানিয়েছেন সহমর্মিতা ও সমর্থন।

গুঁড়িয়ে দিয়েছিল হানাদারের বিজয় অহংকার, দেখিয়েছিল যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এক অনন্য ঘটনা। মানুষের মননজগতে আলোড়ন তুলে সবাইকে এক সূত্রে গেঁথেছিল বেতার। ইথারে ভেসে আসা মুক্তির বাণী প্রতিনিয়ত সবার প্রাণে জাগিয়েছিল মুক্তির আলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল যুদ্ধকালীন প্রচারমাধ্যম। সময়ের সর্বপ্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা মনে করেছিল তারা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবে। তাদের প্রতিরোধ করার কেউ নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রথম প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তাদের বিজয় অহংকার। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার প্রথম থেকেই ছিল হানাদারদের আঘাতের লক্ষ্য।

১৯৭১ সালে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া তখনো লাগেনি বাংলায়। সময়ের খবর পাওয়া যেত না সময়ে। গ্রামাঞ্চলে পত্রিকা যেত প্রায় একদিন পর। সে-সময় মানুষের মধ্যে দ্রুত খবর পৌঁছানোর মাধ্যম ছিল রেডিও বা বেতারযন্ত্র। ২৫ মার্চের বর্বরতার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রচার চালাচ্ছিল – দেশকে অস্থিতিশীল করতে সক্রিয় দেশদ্রোহীরা। কিন্তু তা হতে দেয়নি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। দেশের সীমা ছাড়িয়ে দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানি শাসকদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সম্প্রচার করেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণা প্রচারের পরপরই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু সংবাদমাধ্যম এই খবর প্রচার করেছিল। তারা বলেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান ‘এক গুপ্ত বেতার’ বা ‘একটি গোপন বেতার’ কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন ইত্যাদি। সেদিনের সেই ‘গুপ্ত’ বা ‘গোপন’ বেতারই হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সে-সময় এই সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি প্রশাসন। অন্যদিকে বাঙালির মনে ডালপালা মেলেছিল স্বাধীন দেশের স্বপ্ন।

চট্টগ্রামের পর কলকাতার বালিগঞ্জে একটি ছোট্ট দোতলা বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। সে-সময় ছিল একটি মাত্র স্টুডিও। পরে রেকর্ডিংয়ের জন্য আরো একটি কক্ষ খালি করা হয়। তবে এগুলোর কোনোটাই পেশাদার স্টুডিও ছিল না। ঘাটতি ছিল শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ড্রাম, গিটারসহ অনেক কিছুরই। অবশ্য ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নেন বেতারের কর্মীবাহিনী। বেতারের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই এখানেই থাকতেন। গভীর রাত পর্যন্ত রেকর্ডিংসহ অন্যান্য কাজ করতেন। তারপর কাজশেষে চাদর বিছিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়তেন মেঝেতেই।

স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম দিকের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ‘চরমপত্র’ – বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা, ‘অগ্নিশিখা’ – মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান, ‘জাগরণী’ – উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান, ইংরেজি ও বাংলা খবর ইত্যাদি। পরে আরো যোগ হয় : বিশ্বজনমত, ইংরেজি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রাম, ১০ মিনিটের উর্দু অনুষ্ঠান, বিশেষ কথিকা, বঙ্গবন্ধুর বাণী, ‘জল্লাদের দরবার’ –    ইয়াহিয়া ও তার দোসরদের নিয়ে ব্যঙ্গ নাটিকা, ‘দৃষ্টিপাত’ –  বিশেষ পর্যালোচনা, রাজনৈতিক মঞ্চ, ‘সোনার বাংলা’, পল্লির শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান, ‘কাঠগড়ায় আসামি’, ‘পিন্ডির প্রলাপ’, ‘রণাঙ্গনের চিঠি’, ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’, ‘ওরা রক্তবীজ’ –  শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান, ‘প্রতিধ্বনি’ প্রভৃতি।

শুধু যুদ্ধের ক্ষেত্রেই অসাধারণ ভূমিকা না, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ জাতিকে দিয়েছে অমূল্য সম্পদ। কালজয়ী সব দেশাত্মবোধক গান উপহার দিয়েছে এই কেন্দ্র। দুই বাংলার খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় সব লেখক, সুরকার ও শিল্পী দরদ দিয়ে এ-গানগুলো রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। এ-কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলো বাঙালিদের জন্য এক অনন্য সম্পদ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন-সংকেত হিসেবেও ব্যবহার হতো।

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট

পাকিস্তানি সামরিক সরকার ছিল চরম মিথ্যাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী। ২৫ মার্চ গণহত্যার আগে বিদেশি সাংবাদিকদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। সংবাদ প্রকাশের ওপর ছিল সামরিক আইনের বিধিনিষেধ। সে-সময় পাকিস্তানি শাসকদের  নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধে নামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে যায়।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিবাহিনী গঠনের ঘোষণা প্রথম প্রচারিত হয় এই বেতার কেন্দ্র থেকে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে পরে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। মূলত এসব প্রচারের জন্য শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের খবর শুনলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়বে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সরকার বারবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশ করে যাচ্ছিল, কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার তা অস্বীকার করছিল অব্যাহতভাবে। বেতার থেকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তিনি বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে আছেন। তিনি সরকার গঠন করেছেন। সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এতে পাকিস্তানিরা হতাশ ও বাঙালিরা উদ্দীপিত হচ্ছিল। অবশেষে ২৮ মার্চ পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সচিত্র খবর প্রকাশ করে সংবাদপত্রে।

১৯৭১-এ টিক্কা খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক। তখন বেলাল মোহাম্মাদ চট্টগ্রামের বাটালী রোডে মুশতারী লজে থাকতেন। এটি ডাক্তার শফি ও বেগম মুশতারী শফির বাড়ি। সেদিন ছিল ২৮ মার্চ। বেলাল মোহাম্মাদ খবর পেলেন টিক্কা খান মারা গেছেন। সত্যি-মিথ্যা কোনো কিছু না ভেবেই টিক্কা খান ও তার সঙ্গীদের নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে দিলেন তিনি। সে-সময় সেটা ছিল এক দারুণ খবর! চারদিকে হইচই পড়ে গেল। প্রভাবশালী বিদেশি গণমাধ্যমও এ-খবরে প্রভাবিত হয়েছিল। এসব খবরে পাকিস্তানিরা দমে যায়। কার্যত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বোঝাতে চেয়েছিল যে, বাঙালিরা তোমাদের (হানাদারদের) নাকানিচুবানি খাওয়াবে। পরে টিক্কা খান নিজে বেতারে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তিনি মারা যাননি।

শুধু বাংলায় নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকায় প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন হয়েছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব খবর প্রচার হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে এ বেতার। কারণ স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিনিয়ত জানাতে থাকে, বিশ্বজনমত পাকিস্তানের পক্ষে নেই।       পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাদের সমর্থন করছে না।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাহসী উচ্চারণ, প্রতিবাদী ও সংগ্রামী অনুষ্ঠানমালা ভেঙে দেয় শত্রুর মনোবল, নিশ্চিত করে তাদের পরাজয়। সেদিন লেখক-শিল্পী-কলাকুশলীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন। বাঙালি সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর সদস্য, আনসার, মুক্তিবাহিনী ও পূর্ব বাংলার আপামর সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতীকী অর্থে যদি মনে করা হয় সবাই মিলে একটা ফ্রন্ট, তাহলে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হলো বাংলাদেশ সৃষ্টির মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট, অর্থাৎ দ্বিতীয় ফ্রন্ট। অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ১২তম ফ্রন্ট বা ১২তম সেক্টর বলেও উল্লেখ করেছেন।

পৃথিবীর গণমাধ্যম …

২৫ মার্চের মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সে-সময়ে এটা ইপিআরের ওয়্যারলেসের মধ্যমে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। এ-খবর ২৭ মার্চ বিশ্বের অনেক পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় প্রকাশ হয়।

বিবিসির বরাতে কলকাতা থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্র জানায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’

ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারাবিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।

দিল্লির দি স্টেটসম্যান :  ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ : ২৭ মার্চ ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান : শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন, তা প্রকাশিত হয়।

গার্ডিয়ান : ২৭ মার্চ প্রকাশিত খবর – ‘২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দি ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’

নিউইয়র্ক টাইমস : শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়েছিল। পাশেই বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিব আটক’।

হেরাল্ড, বুয়েনস আয়ারস, আর্জেন্টিনা : ২৭ মার্চ প্রকাশিত – ‘বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব’।

এপি : ‘ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল’ জারি করেন ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’

দি আইরিশ টাইমস : পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে ছিল শেখ মুজিবের ছবি।

রয়টার্স, দিল্লি : ‘১০ হাজার মানুষ নিহত ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে।’

ব্যাংকক পোস্ট : ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’

দ্য এইজ, অস্ট্রেলিয়া : ২৭ মার্চ প্রকাশিত  –  ‘ঢাকা ব্রেকস উইথ পাকিস্তান’ শীর্ষক প্রতিবেদন উল্লেখ করে, ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছে, তারা আর করাচি প্রশাসনের সঙ্গে নেই। দ্য এইজ আরো জানায়, ভারতের রেডিও প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে গতকাল বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। … বেতার কেন্দ্রটি নিজেদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে অভিহিত করেছে।

দ্য লন্ডন টাইমস : ২৭ মার্চ প্রকাশিত, শেখ মুজিবুর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করায় প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে।

দ্য বোস্টন গ্লোব, যুক্তরাষ্ট্র : ২৭ মার্চ প্রকাশিত, ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হতে গৃহযুদ্ধ শুরু।’

এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি, যা প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।

১ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘… বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান …।’

১৯৭১-এ পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর ছড়িয়ে দিতে বেতারমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এক দুপুরে বাংলার মাটিতে প্রথম বিমান হামলা

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ। শুরুটা অন্যান্য দিনের মতোই। বেলাল মোহাম্মাদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, রাশিদুল হোসেন, আ. ম. শারফুজ্জামানসহ তাঁদের দল তখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। যে যার কাজে ব্যস্ত। দুপুরের অধিবেশন শেষ। প্রস্তুতি চলছে বিকেলের।

বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার ভবনে সবাই ব্যস্ত। বিদেশি খবর সংগ্রহের জন্য আ. ম. শারফুজ্জামান, মোস্তফা আনোয়ারসহ কয়েকজন গেলেন রিসিভিং সেন্টারে। সে-সময় ট্রান্সমিটার ও রিসিভিং সেন্টার ছিল আলাদা। দুপুর আনুমানিক ২টা। হঠাৎ বিমানের আওয়াজ। রিসিভিং সেন্টার থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন সবাই। দুটি বিমান ট্রান্সমিটার ভবনের ওপরের আকাশে চক্কর দিচ্ছে।

হানাদার বাহিনী তখনো চট্টগ্রাম দখল করতে পারেনি। সবাই মনে করছেন বাঙালি কোনো বৈমানিক। তাঁরা বরং বিমানকে ইশারা করে তাদের অবস্থান জানাচ্ছিলেন। বিমান দুটি তখন ট্রান্সমিটার ভবনের ওপর দিয়ে কয়েকবার সামনে-পেছনে করল। তারপর চক্কর দিয়ে চলে গেল।

বেতার কেন্দ্রে কর্মরত সবাই হতবাক। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না কী হলো। সবার তখন একমাত্র ভাবনা – বিমান দুটি চলে গেল কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই মাথার ওপর ভয়ংকর শব্দ। দুটি বিমানই ফিরে এসেছে। এবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুদিক থেকে মেশিনগানের অবিরাম গুলি ছুড়তে ছুড়তে ট্রান্সমিটার ভবনের খুব কাছে চলে এসেছে বিমান দুটি।

সবাই আতঙ্কিত হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলেন। সে-সময় ট্রান্সমিটার ভবনের কাছে সেনাবাহিনীর পরিখা ছিল। সেখানে বাঙালি সেনারা অবস্থান করছিলেন। অনেকে সৈনিকদের ওপর লাফিয়ে পড়েন। কেউ কেউ এদিক-সেদিক চলে যান। এদিকে বাঙালি সেনারাও বিমানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিলেন। কিন্তু মানুষের গাদাগাদিতে রাইফেল লোড করতে পারছিলেন না। একটু বিরতি দিয়ে বিমান দুটি কয়েক দফা বোমাবর্ষণ করল।

 এদিকে বিরতির ফাঁকে অনেকে আরো দূরে আশ্রয় নিলেন। বোমা বর্ষণশেষে বিমান দুটি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ট্রান্সমিটারের আশপাশে দু-একজনকে দেখা গেল। অন্যরাও ধীরে-সুস্থে, ভয়ে ভয়ে বেতার কেন্দ্রের দিকে আসতে লাগলেন। সবার মধ্যে প্রচণ্ড ভয়, আতঙ্ক, উত্তেজনা। এটা ছিল স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম বিমান হামলা, লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পাকিস্তানি শাসকদের ধারণা ছিল, এ বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ করে দিতে পারলে বাঙালি মনোবল অনেকখানি গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এ যেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘শেষ হইয়াও যেন হইল না শেষ …’

৩০ মার্চ বিমান হামলার পর ৩১ মার্চ বেতারকর্মীরা কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে এসে চেষ্টা করলেন তা চালু করতে। কিন্তু বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওয়্যারিং সম্পূর্ণ বিকল। তাই কিছুতেই কিছু হলো না। মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে। এদিকে হানাদার বাহিনী প্রায় চট্টগ্রামে এসে গেছে। তখন সিদ্ধান্ত হয় এই এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার দিয়েই আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তবে এবার কালুরঘাটে নয়, পটিয়া থেকে। কিন্তু সে সময় এই এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার তুলে নিয়ে যাওয়া ছিল অনেক কঠিন কাজ। হারুন-অর-রশীদ নামে বেলাল মোহাম্মাদের দলের একজন এ-দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান ছাড়া এ-কাজ কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। বেতারের লোক ছিলেন মাত্র দুজন – সহকারী টেকনিশিয়ান আমিনুর রহমান ও মেকানিক আবদুশ শুকুর আর ছিলেন মোহরা গ্রামের আবু তাহের চৌধুরী। সবাই মিলে শেষ পর্যন্ত এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার পটিয়ায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

পটিয়ায় আনার পর দেখা গেল কিছু যন্ত্রপাতি কালুরঘাট কেন্দ্রে রয়ে গেছে। এসব যন্ত্রপাতি না হলে বেতার চালু করা সম্ভব নয়। তখন রাশেদুল হাসান ও শারফুজ্জামান আবার কালুরঘাটে গিয়ে ফেলে আসা অন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এতকিছুর পরও পটিয়ায় বেতার কেন্দ্র চালু করা গেল না। এছাড়া এখানে উর্দুভাষী লোকজনও ছিলেন যাদের বিশ্বাস করা সহজ ছিল না। সবমিলিয়ে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা পটিয়ায় ছিলেন। এদিকে প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছিল। পাকিস্তানিরা অনেক বেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে জড়ো হচ্ছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে পটিয়ায় বেতার কেন্দ্র চালু করা অসম্ভব। যে-কোনো দিন হানাদাররা এখানেও চলে আসতে পারে। কালুরঘাটের মতো এখানেও বিমান হামলা হতে পারে।

পটিয়ার কাছেই ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এ সীমান্ত-লাগোয়া বাংলাদেশের রামগড় থানা। পটিয়া থেকে ট্রান্সমিটারটি রামগড় সীমান্তে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকায় যাওয়াই নিরাপদ ছিল। শেষটায় পটিয়া থকে সবাই রামগড়ের উদ্দেশে রওনা হন। 

পটিয়া কিন্তু বিমান হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে আরো একবার বিমান হামলা হয়েছিল। তবে সে-হামলা কালুরঘাটে ছিল না। এ হামলা ছিল পটিয়ায়। ১৭ এপ্রিল বেতারকর্মীরা কেউ পটিয়ায় ছিলেন না। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা পটিয়ায় ছিলেন। এর আগেই কোনোভাবে হয়তো হানাদাররা তাঁদের পটিয়ায় অবস্থানের কথা জেনে গিয়েছিল। তবে তারা যখন হামলা চালায় তখন পটিয়াতে কোনো বেতারকর্মী ছিলেন না।

যে কোনো যুদ্ধের সাধারণত তিনটি পর্যায় থাকে। প্রথমে সব গুছিয়ে নিতে হয়। তারপর বিদ্রোহ। চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধ। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রথমে বিদ্রোহ করতে হয়েছে। পরে সংগঠিত হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতেও কেউ জানত না যে ২৬ মার্চ বিদ্রোহ করতে হবে।। যুদ্ধের সময় সাধারণত কিছুটা সত্যকে আড়াল করতে হয়। যুদ্ধের এটা এক অলিখিত নিয়ম। এক্ষেত্রে প্রথমে আঘাতটাই আসে সত্যের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদেরও এ-ধরনের কৌশল নিতে হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য হলো নিজেদের উজ্জীবিত রাখা, পক্ষান্তরে শত্রুর মনোবল ভেঙে দেওয়া। এজন্যই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে  সেদিন বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সুস্থ আছেন। তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আছেন।। এমনও বলা হয়েছিল, তাঁর কথা বেতারে শোনা যাবে। সে-সময় টিক্কা খানের মৃত্যুসংবাদ প্রচারও ছিল কৌশল। পাকিস্তানি শাসকদের প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। একই সঙ্গে এদেশবাসীর মনে স্বাধীনতার স্বপ্নটাকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছিল এই বেতার কেন্দ্র। বহুবার একে স্তব্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে হানাদার বাহিনী, কিন্তু পারেনি। উল্টো আরো তীক্ষ্ণ, তীব্র হয়েছে এর কণ্ঠস্বর। তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।