ফরিদা পারভীন বাংলাদেশের সংগীত-সংস্কৃতির ইতিহাসে এক বহুমাত্রিক প্রতিভার নাম। বাংলাদেশের আপামর মানুষ একদিকে যেমন তাঁকে  লালনসংগীত শিল্পী হিসেবেও মান্য করেন, অন্যদিকে দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী হিসেবে গণ্য করেন। তবে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি লালনসংগীতের শিল্পী হিসেবেই অধিক পরিচয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু এমন পরিচয়ের বাইরে তাঁর আগ্রহ ও সংগীত-সাধনার জীবনের আরো বহুমাত্রিক প্রতিভার দ্যুতি জনপ্রিয়তার আড়ালে রয়ে গেছে। যেমন তিনি মহর্ষি মনোমোহন দত্তের বেশ কিছু
মলয়া-সংগীত পরিবেশন করেছেন। এমনকি তাঁর পরিবেশনায় ‘সাবির গীতি’ নামে সাবির আহমেদ চৌধুরীর গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশের তথ্যও জানা যায়।
লালনসংগীতের সুরবাণীকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নিজের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি’। এই প্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীদের তিনি নিজেই লালনসংগীতের প্রশিক্ষণ দিতেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগীত-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এতসব পরিচয়ের মধ্যে তিনি লালনসংগীত পরিবেশনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক এবং চলচ্চিত্রে অন্তক্ত তাঁর গাওয়া আধুনিক গানের জন্য ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এ-ধরনের দুটি জাতীয় পদক ও পুরস্কার তিনি অর্জন করেছিলেন কুষ্টিয়ার মতো একটি শহরে অবস্থান নিয়ে ও সংগীত-সাধনার মাধ্যমে। আঞ্চলিক পর্যায়ে সংগীত-সাধনার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, স্বীকৃতি অর্জন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্মৃতিলাভের এ-ধরনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে খুবই বিরল। ফরিদা পারভীন সেই বিরলদের মধ্যে অগ্রগণ্য। যদিও তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে তথা বিগত ২২-২৩ বছর রাজধানী ঢাকায় বসবাস করতেন, কিন্তু তাঁর ঢাকার সংগীতজীবনের ভিত্তিমূল কুষ্টিয়ার সংগীত-সাধনায় উজ্জ্বল হয়েছিল। কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালে তিনি আবু জাফরের বাণী ও সুরে আধুনিক গানের অডিও অ্যালবাম ‘আমি ধূপের মতো’, ‘নিন্দার কাঁটা’, ‘কিশোর বউ’ এবং দেশের গানের অ্যালবাম ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ প্রভৃতিতে সংগীত পরিবেশন করেন।
এক
ফরিদা পারভীনের জীবনে সংগীতের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল জন্মসূত্রে মাতৃক্রোড়ে মাতৃস্তন্য পান করতে করতে। আজীবন তিনি সেই স্মৃতি লালন ও বহন করতেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম যখন আমার ভেতর সুরটা যায়, আমার মায়ের দুধ খাই তখন। সে সময় আমার সেন্স একটু একটু কাজ করত। আমি কিন্তু অনেক বড় হয়েও আমার মায়ের দুধ খেয়েছি। এক মেয়ে ছিলাম, ঘুম পাড়ানোর সময় মায়ের দুধ খেতাম, আর মা গান করত। মায়ের সেই সুরটাই আমার ভেতর রয়ে গেছে, সেই সুরটা এখনো আমি ভুলতে পারি না। তখনকার হিন্দি গান, লতাজির অনেক গান মা গাইত। সিনেমা দেখত তো খুব, তখনকার সিনেমার ওইসব গান গাইত। আমার মায়ের কিন্তু খুব ভালো গানের সুর।’ এক্ষেত্রে বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মাতৃস্তন্য পানের সময় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সুর ফরিদা পারভীনকে গভীরভাবে সংগীত-সাধনায় দীক্ষিত করে দেয়। পরে তিনি সংগীতের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি গ্রহণ করেন মাগুরা জেলায় ওসত্মাদ কমল চক্রবর্তীর কাছ থেকে। সেটা ১৯৫৭-৫৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা, তখন ফরিদা মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে। এরপর তিনি একে একে কুষ্টিয়ার ওসত্মাদ ইব্রাহিম, ওসত্মাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণির কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। একটানা প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতে শিক্ষাগ্রহণ ও চর্চার পর তিনি কুষ্টিয়ার ওসত্মাদ আবদুল কাদের ও মেহেরপুরের মীর মোজাফফর আলীর কাছে নজরুলসংগীতের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, স্বরলিপির আশ্রয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার শিক্ষা পেয়েছিলেন ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছে। সংগীত-সাধনায় তিনি প্রথম স্বীকৃতি অর্জন করেন ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। সে-বছর তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীত শিল্পী নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার পাশাপাশি নজরুলসংগীত পরিবেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম লালনসংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন গুরু মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে। তাঁর কাছ থেকে শেখা লালন সাঁইয়ের নামে প্রচলিত ‘সত্য বল্ সুপথে চল্’ গানটি পরিবেশনের মাধ্যমেই ফরিদা লালনসংগীত শিল্পী হিসেবে পরিচয় লাভ করেন।
একথার প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের একটি প্রকাশনায়। প্রকাশনার একটি পৃষ্ঠার ওপরের দিকে সংগীতসাগর খোদাবক্স সাঁইয়ের ছবির পাশে মুদ্রিত আছে : ‘বাউল গানের মরমী শিল্পী এই খোদাবক্স বিশ্বাস। সুরের রাজ্যে তিনি তন্ময় সারাক্ষণ। গাইতে গাইতে যাঁকে কাঁদতেও দেখেছি বহুবার।’ একটি পৃষ্ঠার নিচের দিকে ফরিদা পারভীনের একটি ছবির পাশে মুদ্রিত আছে : ‘ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস-প্রযোজিত জাতীয় অনুষ্ঠান ‘রংধনু’র প্রথম জনপ্রিয় গান – ‘সত্য বল্ সুপথে চল্ ওরে আমার মন।’ শিল্পী : উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতীক ফরিদা পারভীন।’ এতে প্রমাণিত হয় ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদা পারভীনের পরিবেশিত ‘সত্য বল্ সুপথে চল্ ওরে আমার মন’ গানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং তিনি সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এরপর থেকে ফরিদা পারভীন বিশেষভাবে মনোযোগ দেন লালনসংগীত চর্চায়। বিশেষ করে প্রায় নিয়মিতভাবে মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে থেকে লালন সাঁইয়ের গানের প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুন মকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর তিনি সংগীতসাগর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, গোলাম ইয়াসিন শাহ ও আব্দুল করিম শাহের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে লালনসংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। জানা যায়, শেষ পর্বে তিনি মলয়া-সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত সাধক শিল্পী চন্দন আচার্যের কাছ থেকে।
ফরিদা পারভীনের সংগীতগুরুদের তালিকা বেশ দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। শুধু তাই নয়, তাঁর গুরুদের প্রায় প্রত্যেকই প্রামিত্মক পর্যায়ে সংগীতসাধক। ফরিদা পারভীন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর প্রত্যেক গুরুর কথা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এতে করে বাংলাদেশের সংগীত-সংস্কৃতির ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। লক্ষণীয় বিষয়, তাঁর সংগীতগুরুদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের হিন্দু, মুসলমান, বাউল-ফকির সাধকদের স্থান রয়েছে। তিনি প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাঁর গুরুদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন এবং সমান মর্যাদা দিতেন। বাংলাদেশের সংগীতশিল্পীদের মধ্যে এত বৈচিত্র্যময় সংগীতশিক্ষা অন্য কেউ পেয়েছেন কি না আমাদের জানা নেই।
দুই
ফরিদা পারভীনের অন্যতম সংগীতগুরু লালনপন্থী সাধক কবি ও সংগীতসাগর খোদাবক্স সাঁইয়ের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে পর্যন্ত লালনসংগীত চর্চা মূলত লালনপন্থীদের মধ্যে সীমায়িত ছিল। খোদাবক্স সাঁই বলেছেন, কৈশোরে তিনি যখন লালনপন্থী সাধকদের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে লালনের গান শিখতে আগ্রহী হন তখন ফকির-সাধকগণ তাঁকে দীক্ষা না নিলে লালন সাঁইয়ের গানের শিক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানান। অগত্যা খোদাবক্স সাঁই লালনপন্থী সাধক সুকচাঁদ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে লালন সাঁইয়ের গানের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এতে প্রমাণিত হয়, পূর্বে ফকিরি ধারায় লালনপন্থায় দীক্ষা গ্রহণ ছাড়া লালনসংগীত পরিবেশনের ঐতিহ্য ছিল না। খুব সম্ভবত দু-একটি ব্যতিক্রম ভিন্ন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লালনপন্থীদের সাধুসঙ্গ ও ফকিরি ধারায় দীক্ষিত সাধক শিল্পীরাই লালনসংগীত পরিবেশনের ঐতিহ্য সচল রেখেছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কুষ্টিয়াতে ফরিদা পারভীনকে তাঁর পিতা দেলোয়ার হোসেন, পিতার বন্ধু মকছেদ আলী সাঁই ও পারিবারিকভাবে পরিচিত অন্য কয়েকজন লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশন করতে অনুরোধ জানালে ফরিদা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওই ফকির-ফাকরার গান তিনি করবেন না’। এতেও লালন সাঁইয়ের গানের ঐতিহ্যের সেকালের চালচিত্র লভ্য। পরে অবশ্য অনেকের অনুরোধে ফরিদা পারভীন মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছ থেকে ‘সত্য বল্ সুপথে চল্’ গানটির তালিম নিয়ে ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের আখড়ায় অনুষ্ঠিত একটি উৎসবে পরিবেশন করেন। গানটি পরিবেশনের পর দর্শক-শ্রোতাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তাঁকে লালন সাঁইয়ের গানের প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে তোলে। সেই আকর্ষণ থেকে তিনি একটির পর একটি লালনসংগীতের সুরবাণী কণ্ঠে তুলে নেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গাওয়া লালন সাঁইয়ের গান নিয়ে ‘অচিন পাখি’ নামে একটি লংপ্লে রেকর্ড বের হয়। পরবর্তীকালে যথাক্রমে ডন কোম্পানি থেকে ‘লালনগীতি’, সারগাম থেকে ‘লালনের গান’ নামে অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। লালনসংগীতের শিল্পী হিসেবে তাঁর স্থায়ী পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় উপর্যুক্ত তিনটি অ্যালবাম পরপর প্রকাশের পর। এক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, তিনি লালন সাঁইয়ের সাধনসংগীতকে লালনপন্থী সাধকদের সাধুসঙ্গ ও গুরুবাদী ধারায় দীক্ষিত গুরু-শিষ্যদের মধ্যে পরিবেশনের ঐতিহ্যিক পরিমণ্ডলের গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। সাধুগুরুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ লালনসংগীতকে তিনি আপামর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এতে সাধনসংগীতে বর্ণিত সাধনার কথাগুলো ফরিদার কণ্ঠগুণে সর্বসাধারণের শ্রবণ-চিত্তের সুধা হয়ে প্রকাশ পেল, সাধনা-সংগীতের আসর থেকে ফরিদার গীত লালন সাঁইয়ের গানগুলো প্রচারমাধ্যম ও সংগীত-ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোগে বিনোদনধর্মী সংগীতের আসরে প্রবেশ করলো। এক্ষেত্রে তিনি সাধনসংগীত পরিবেশনার ঐতিহ্যিক রীতিতেও কিছু পরিবর্তন সংঘটন করেছেন; যেমন ফরিদা পারভীনের পরিবেশিত অধিকাংশ লালনসংগীতের বাণীতে দেখা যায়, গানের প্রচলিত রীতি-আদর্শের কিছু পরিবর্তন, তিনি লালনের অধিকাংশ গানের বাণীর বিন্যাস থেকে দ্বিতীয় পঙ্ক্তি দিয়ে গান শুরু করেছেন, ফলে প্রথম পঙ্ক্তি চলে গেছে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে। এতে লালনের গানের বাণী বিন্যাসক্রমের ব্যতিক্রমী গায়কী সৃষ্টি হয়েছে, যা পরবর্তীকালে সকল গায়ক অনুসরণ করে চলেছেন, এমনকি লালনপন্থী সাধকেরাও ফরিদার গায়কীকে মান্য করেছেন। শুধু তাই নয়, লালন সাঁইজির গানকে তিনি সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তুলতে অথবা তাঁর নিজের গায়ন-আঙ্গিকে গ্রহণ করতে গিয়ে লালনের রচিত গানের বাণীর মধ্যে কিছু অতিরিক্ত শব্দ সংযোজন করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু শব্দ বর্জন করেছেন। যেমন, লালনের বিখ্যাত একটি গানের বাণীর প্রথম স্তবকের শেষ দুটি পঙ্ক্তি ‘আমার বা[ড়ির কাছে আরশিনগর/ ‘এক পড়শি বসত করে’র পরিবর্তে তিনি ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর/ সেথা এক পড়শি বসত করে/ একঘর পড়শি বসত করে’ গেয়েছেন। এক্ষেত্রে পঙ্ক্তি দুটি থেকে তিনি প্রথমে ‘আমার’ শব্দটি বর্জিত হয়েছে এবং ‘সেথা’ ও ‘ঘর’ শব্দটি দুটি অতিরিক্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একই গানের প্রথম পঙ্ক্তি ‘আমি একদিনো না দেখিলাম তারে’ থেকে তিনি ‘আমি’ শব্দটিও বর্জন করেছেন।
কখনো লালন সাঁইয়ের গানে আঞ্চলিকতার আবহ সৃষ্টি করতে গিয়ে যেমন লালন সাঁইয়ের গানের পাণ্ডুলিপিতে লভ্য প্রমিত শব্দের আঞ্চলিক রূপ প্রয়োগ করেছেন, তেমনি গানকে শিক্ষিত জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে আঞ্চলিক শব্দের পরিবর্তে শব্দের নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছেন। যেমন ফরিদা পারভীন লালনের ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ গানের ‘গ্রাম বেড়ে’র পরিবর্তে ‘গিরাম বেড়ে’; ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’ গানে ‘ও নামে রহিবে ক্ষতি’র পরিবর্তে ‘ওই নামে রবে অখ্যাতি’ প্রয়োগ করেছেন। আসলে, ফরিদার গান পরিবেশনের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় লালনের গান বোধগম্যতার ভিন্ন মর্মে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
কেউ যদি অ্যাকাডেমিক গবেষণার দৃষ্টিতে ফরিদা পারভীনের পরিবেশিত লালনের গানকে বিশ্লেষণ করতে যান এবং লালন-শিষ্যদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তুলনা করতে উদ্যত হন তখন স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন। এর কারণ, ফরিদার সামনে লালনের গানের কোনো প্রামাণ্য পাঠ ছিল না, তিনি বিভিন্ন সাধকের কাছ থেকে গানের নানা ধরনের পাঠ-পাঠান্তর হয়তো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, আর ভেতর থেকে নিজের গাওয়ার উপযোগী একটি পাঠ নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। যে-পাঠ অনেকটা স্বতন্ত্র এবং ফরিদা পারভীনের নিজস্ব গায়ন-পদ্ধতিতে পরিবেশনের উপযোগী। এই রীতিতে ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র একতারা, দোতারা, আনন্দলহরি, ঢোল, মৃদঙ্গ অনেকটা দূরে চলে গেল, তার স্থানে বেহালা, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, এমনকি ইলেকট্রনিক কি-বোর্ড, অক্টোপ্যাড ইত্যাদি অধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। আমরা লক্ষ করেছি, লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীন এমন একটি স্বতন্ত্রধারার সৃষ্টি করেছেন পরবর্তীকালের শিল্পী যা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন। ফলে, লালনের গানের ফকিরি পরিবেশনের ধারা প্রচারমাধ্যমে তো বটেই নাগরিক মঞ্চেও তেমন গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সমর্থ হয়নি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.