বাংলাদেশের গৌরব বিশ্বনেতা শেখ মুজিবুর রহমান

আমাদের সৌভাগ্য যে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমাদের এই দেশে গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক বিশ্ব মহানায়ক জন্মগ্রহণ করেন।গোপালগঞ্জ ইতোমধ্যে মহকুমা থেকে উন্নীত হয়ে জেলাতে পরিণত হয়েছে।ব্রিটিশ সরকার এদেশে আসার আগে অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের আগে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন জাতি-উপজাতি এখানে বসবাস করতে আসে। তবে একটি বিশেষ বিষয় হলো যে, যাঁরাই এদেশে আগমন করেন তাঁরাই এদেশটাকে নিজেদের বলে গ্রহণ করে নেন।এ-বিষয়ে আমরা বিশেষভাবে মুঘল সম্রাট বাবরের কথাটি মনে করতে পারি।বাবর ছিলেন মধ্যপ্রাচের সমরকন্দের একটি গ্রাম ফারগানার অধিবাসী এবং সেখানকার রাজবংশের মানুষ।অল্প বয়সেই তিনি রাজ্যচ্যুত হন এবং কৈশোর থেকে তিনি তাঁর রাজ্যটি পুনর্দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য কখনো স্থায়ীভাবে সফল হয়নি।তাঁর সৌভাগ্য ছিল যে, পারস্যের সম্রাট তাঁকে তাঁর রাজ্যে আশ্রয় প্রদান করেন।তিনি মুলতান, লাহোর থেকে পূর্ব এবং দক্ষিণে দিল্লি, আগ্রা এবং মধ্যভারতের কতিপয় মুসলমান রাজ্য দখল করেন। তিনি পারস্য থেকে পশ্চিমে ও দক্ষিণে ভারতের সিন্ধু, মুলতান ও পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তার করে অবশেষে দিল্লি ও আগ্রাতে এসে ভারতেই একটি বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করলেন।

দিল্লিতে তাঁর ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তিনি তাঁর সব সহকর্মীকে ডেকে একটি দরবার বসালেন।সেখানে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আপনাদের ডেকেছি এজন্য যে, আমার মনে হয় ফারগানা রাজ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন ভাবনার প্রয়োজন।আমরা হিন্দুস্তানে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছি, এইটিই হোক আমাদের নতুন দেশ।এই দেশটিকে আমরা সমৃদ্ধ করে তুলবো, আর পেছনে তাকাবো না।’

মুসলমানরা অবশ্য ভারতবর্ষে সম্রাট বাবরের অনেক আগেই আস্তানা স্থাপন করেন এবং সেটা শুরু হয় ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে এবং এই সাম্রাজ্যটি ক্রমে ক্রমে মুঘল সম্রাট আলমগীর-আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৫৯-১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে হয়ে ওঠে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র।সম্রাট বাবর যে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ১৫২৬ সালে সেই সাম্রাজ্যটি ২৩০ বছর পরে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া নামক একটি কোম্পানি গ্রেট ব্রিটেনের নামে শাসন করে একশ বছর।এবং পরবর্তী নব্বই বছর লন্ডনের ব্রিটিশ সরকার দেশটির শাসনভার গ্রহণ করে। এই একটি সময়েই ১৯০ বছর ভারতবর্ষ একটি বৈদেশিক শক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখি যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত যে শক্তি কোনো দেশকে শাসন করে তাদের ধর্মই হয় সেই দেশের রাজধর্ম এবং তারা দেশের সকল নাগরিককে নিজেদের ধর্মে জোর করে ধর্মান্তরিত করে।এই ঐতিহাসিক ধারা কিন্তু মুসলমানরা কখনো অনুসরণ করেননি। ইসলাম ধর্মের গৌরবযুগের পৃথিবীতে উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকা ছিল না।যেখানেই মুসলমানরা তখন রাজত্ব করে সেই এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা সর্বত্রই তারা শাসক হিসেবে তাদের ধর্ম প্রচার করেনি। ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন স্বতন্ত্র একটি গোষ্ঠী, যাঁরা ছিলেন ধর্মপ্রচারক এবং সুফি নেতৃবৃন্দ।সে-কারণেই আমরা দেখতে পাই যে, যেখানে মুসলমানরা রাজত্ব করেছেন সেখানে তাঁরা খুব কম সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন।ভারতীয় উপমহাদেশেই এর সবেচেয় বড় প্রমাণ পাওয়া যায়।এই উপমহাদেশে ৭১২ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার পঞ্চাশ বছর মুসলমান সাম্রাজ্য বহাল থাকলেও উপমহাদেশে মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠী হিসেবেই অবস্থান করেন।

যাহোক, আমরা যদি শুধু আমাদের দেশটি অর্থাৎ বাংলাদেশের দিকে নজর দিতে চাই তাহলে দেখবো যে, এই দেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে জনবসতি শুরু হয়।এই দেশে তখন অস্ট্রোলয়েড জনগোষ্ঠী আগমন করে এবং এখানকার দ্রাবিড়, অহম, কাশ্মিরী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হয় এবং সত্যিকার অর্থেই ভারতবর্ষ হয় একটি বহুজাতিক সংমিশ্রণের দেশ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Melting pot of various ethnic groups।এটা কিন্তু অন্যান্য দেশ যেখানে বহুজাতিক সংমিশ্রণে হয়েছে, বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ কর্তৃত্বকালে, তার মতো নয়।ব্রিটিশ কর্তৃত্বকালে ethnic groups স্বতন্ত্রভাবে থেকে যায়; কিছু কিছু সংমিশ্রণ অবশ্যই রয়েছে।আমাদের উপমহাদেশের আর একটি বিশেষত্ব হলো যে, আমাদের এই এলাকায়ই সম্ভবত ধান প্রথম আবিষ্কৃত হয় এবং ধানের চাষই হয় আমাদের জীবন এবং রোজগারের উৎস।খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে আর্যরা সর্বত্র বিস্তৃত হতে থাকলো, তখন দেখা গেল যে, আর্যরা চাষকার্যে অত্যন্ত দক্ষ।আমরা এজন্য দেখি যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় শাসকগোষ্ঠী চাষবাসের উন্নতির জন্য আর্য ও ব্রাহ্মণদের আদর করে ডেকে নিয়ে আসেন।মুসলমানরা সম্ভবত প্রথম জনগোষ্ঠী যারা মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।তার আগে পেগানদের মূর্তি এবং বিশেষ বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ বিধাতার আসন দখল করে ছিল।Peganism অবশ্যি পরবর্তীকালে নিজেদের সংশোধন করে বলতে থাকে যে, এই বিভিন্ন দেবমূর্তিই হলো বিধাতার বিভিন্ন আকারে মানুষের কাছে দর্শন দেবার গৃহীত পদ্ধতি।

আমার প্রবন্ধটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।সুতরাং আমার এখন সেখানে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ একটি বিশিষ্ট পরিবারে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পূর্বপুরুষরা একসময় এখানকার বড় জমিদার ছিলেন; কিন্তু তাঁর জন্ম হয় একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে।তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর এবং গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন।তবে তাঁদের সম্পদ ছিল জমিজমা।শেখ লুৎফর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী মোসাম্মৎ সায়েরা খাতুন চার কন্যা এবং দুই ছেলের জন্মদান করেন।আমাদের বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান।তাঁর চেয়ে বড় ছিলেন দুই বোন : মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম এবং মোসাম্মৎ আছিয়া বেগম।বঙ্গবন্ধুর পরেই ছিলেন তাঁর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের এবং তারপরেই ছিলেন আরো দুই বোন মোসাম্মৎ হেলেন এবং মোসাম্মৎ লাইলি।বঙ্গবন্ধুর নামকরণ করেন তাঁর নানা আবুল মজিদ এবং তাঁকে খোকা বলে ডাকা হতো।বঙ্গবন্ধু প্রথমে মাদারীপুর গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন ১৯২৭ সালে।তবে দু-বছর পরেই তাঁর আব্বা তাঁকে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেন।সেখান থেকে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন।এই স্কুলের তখন ভালো হিসেবে সুনাম ছিল।বঙ্গবন্ধু সাত বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে চার বছর স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।এছাড়া অল্প বয়সেই তিনি চোখের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং সেজন্য তখন কলকাতায় বিখ্যাত চক্ষুবিশারদ ডা. তোসাদ্দক আহমদের কাছে যান।বেরিবেরি এবং চক্ষুরোগের কারণে তাঁর লেখাপড়া তেমন চলেনি এবং তাঁর ছাত্রজীবনের কয়েকটি বছর নষ্ট হয়ে যায়।তবে কৈশোরে বঙ্গবন্ধু অন্য ছাত্রদের মতোই লেখাপাড়া, খেলাধুলা এবং অন্যান্য পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত ছাত্রদের কার্যক্রমে অংশ নিতেন।অল্প বয়সেই তিনি সংগঠকের ভূমিকা খুব ভালোভাবেই পালন করতে পারতেন এবং কিশোরদের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।লেখাপড়ায় পেছনে পড়ে যাওয়ায় ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি হলেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।১৯৪২ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং তার পরেই তিনি কলকাতায় চলে গেলেন উচ্চশিক্ষার জন্য ইসলামিয়া কলেজে (এই ইসলামিয়া কলেজ বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ নামে পরিচিত)।তাঁর নেতৃত্বের গুণে তিনি একজন প্রসিদ্ধ ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।তখন তাঁর ভূমিকা ছিল যে, তিনি ছাত্রনেতা ঠিক করে দিতেন, নিজে কোনো পদ গ্রহণ করতেন না।তাঁর বন্ধুবান্ধব কিন্তু সে-সুযোগ তাঁকে দিলেন না।তাঁরা তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বিনা নির্বাচনে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করলেন।এবং এই পদটিতে তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন।১৯৪৭ সালে তিনি স্নাতক হলেন এবং দেশবিভাগের সময়েই ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় চলে এলেন।এখানে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র হলেন।কিন্তু এই ছাত্রত্ব ছিল মাত্র কয়েকদিনের।ঢাকায় ১৯৪৭ সালের শেষ দিকেই পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের কর্মকাণ্ডে পূর্ব বাংলায় ভাষা-আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং ১৯৪৮ সালের মার্চে বিষয়টি গুরুতর হয়ে ওঠে।ফজলুর রহমান ছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের রাজনীতিবিদ।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই রাজনীতিতে পদার্পণ করেন এবং তাঁর আগ্রহ ও কর্মব্যস্ততা তাঁকে ওকালতি বা সংসার করা থেকে বহুদিন দূরে রাখে।বেশি বয়সে তিনি বিয়ে করেন এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের উর্দুভাষী মহিলা।

১৯৪৭ সালের শেষ লগ্নে তিনি পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে করাচিতে সম্মেলন করেন এবং সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব বিবেচিত হয়।এই কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ, যারা তখন সংখ্যায় ছিল পাকিস্তানের ৬৩ শতাংশ, তারা বললো যে, বাংলা ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে হবে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।বঙ্গবন্ধু ঢাকায় নতুন হলেও কলকাতাতে প্রসিদ্ধ ছাত্রনেতা ছিলেন।ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের আগেই তাঁর একটি ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন।তিনি তখনই নিশ্চিত হয়ে যান যে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার দুই অংশ নিয়ে একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।তখনই তাঁরা পূর্বাঞ্চলে বংসাম (বাংলা ও আসাম) নিয়ে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের চিন্তা করেন।তাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি পূর্ব বাংলায় তখনকার অবস্থা বিবেচনা করে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’গঠন করেন।তিনি তখনই জানিয়ে দেন, তিনি জাতীয় রাজনীতি করবেন বলে ছাত্রলীগের কোনো পদাধিকারী হবেন না।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পরেই শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন।মন্ত্রী ফজলুর রহমান জানালেন, তিনি উর্দুকে লিংগুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহারের কথা বলেছেন।কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দেখা গেল যে, গণপরিষদের যে অধিবেশনটি আহ্বান করা হলো সেখানে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, পার্লামেন্টে শুধু ইংরেজি এবং উর্দুতে কথা বলা যাবে। কুমিল্লার গণপরিষদ-সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব করলেন যে, এই বক্তৃতার ভাষার তালিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা যোগ করা হোক।এই দাবির সমর্থনেই শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন।১১ মার্চে প্রতিবাদ শোভাযাত্রা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো আরো অনেকের সঙ্গে।এদিকে কদিন পরেই ছিল পাকিস্তানের স্রষ্টা ও গভর্নর-জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ঢাকায় প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।এই সফরের প্রাক্কালে ছাত্রদের সঙ্গে বিরোধ মোটেই কাম্য মনে না করে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপনে মনোযোগ দিলেন।বন্দি বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে সমঝোতা হলো এবং বঙ্গবন্ধুও ১৬ মার্চে মুক্তি পেলেন।জিন্নাহর সফরকালে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা মোটেই সুখকর ছিল না।যাই হোক তার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি আন্দোলনে সমর্থন দিলেন।আন্দোলনের তীব্রতা রুখে দেবার লক্ষ্যেই কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলো।বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রকে বহিষ্কারও করলো, এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু।কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললো এবং কর্তৃপক্ষ বহিষ্কৃত ছাত্রদের জানালো যে, যাঁরা এইসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করার মুচলেকা দেবে তাঁদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা হবে।এখানে সবাই মুচলেকা দিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন যে, তিনি নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ন্যায়দাবি সমর্থন করেছেন, তিনি কোনোমতেই মুচলেকা দেবেন না।তাই ১৯৪৮ সালের মে-মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিন্ন হয়।

বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টে খুবই ব্যথিত হতেন।মানুষের মধ্যে অসমতা তিনি কোনোমতেই গ্রহণ করতে পারতেন না।একসময় তাঁর এলাকায় অনেক লোকের অনাহারে দিন কাটাতে হয়।তিনি এটি সহ্য করতে পারলেন না এবং নিজেদের গোলাঘর উন্মুক্ত করে সবাইকে সেখান থেকে ধান নিয়ে যেতে সুযোগ করে দেন।এই চিন্তাধারা থেকেই তিনি সারাটি জীবন মানুষের দুঃখ-কষ্ট বিমোচন এবং মানুষের অসমতা দূরীকরণে নিজেকে নিবেদিত করেন।‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন তখনই তাঁর মনে প্রোথিত হয় এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের (অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের) জন্য তাঁর স্লোগান হয় ‘সোনার বাংলা’গড়ে তোলা। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে তিনি সবসময়ই বলতেন, ‘আমার আছে মাটি, আর আমার আছে মানুষ।আমার মাটি উর্বরা এবং আমার মানুষ কর্মঠ – এই দুয়ের সংমিশ্রণে এইটিই হবে সোনার বাংলা। আমি সেই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চাই। বস্তুতই আমরা সেই পথেই আছি।অন্তত গত বিশ বছর ধরেই আমরা সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছি এবং আমার মনে হয় যে, আরো বছর-দুয়েক আমরা সেই পথেই নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যাব।

আমাদের দেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয় গত নব্বইয়ের দশকের পূর্বলগ্নে এবং এইটিই দ্রুতগতিসম্পন্ন হতে থাকে ১৯৯৬ সাল থেকে।এইক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন মোটামুটিভাবে আওয়ামী লীগের শাসনকালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।আমার খুব ভালো লাগে মানুষ যখন বলেন যে, বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং আওয়ামী শাসন সমার্থক।বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করেই আমরা আমাদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তি করেছি ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ’।আমাদের উন্নয়নকৌশলের মূলমন্ত্র হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্রমাগত দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ এবং এইক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য লক্ষণীয়।২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা ছিল ৩১ শতাংশ।২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটা নেমে হয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশের মতো।একইসঙ্গে অতিদরিদ্রের সংখ্যা এখন মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।অবশ্য, আমরা যদি জনসংখ্যা বিচার করি তাহলে দেখবো যে, এখনো ৩ কোটি মানুষ দরিদ্র রয়েছেন।এত বৃহৎ জনসংখ্যাকে আমাদের দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।তবে সুখের বিষয় হলো যে, আমরা এক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দক্ষ জাতি।আমাদের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এই বছরে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ – ৮ শতাংশের বেশি। এবং মনে হয় যে, আগামী তিনটি বছর আমরা এই প্রবৃদ্ধির হার পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ হিসেবেই ধরে রাখতে পারবো।মানবজাতি সবাই মিলে ২০১৫ সালে জাতিসংঘে অঙ্গীকার করেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূরীভূত করা হবে।আর কেউই অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে না।এই অঙ্গীকার আমরা একটি নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছি।এবং আমার বিশ্বাস আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের অন্তত পাঁচ বছর আগেই অর্জন করবো।এখন থেকে আগামী ছয় বছরে ২০২০-২০২৫-এর মধ্যেই আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে সমর্থ হবো।

এ-সঙ্গে অবশ্য বলে রাখা ভালো যে, দারিদ্র্য বিমোচন মানে এই নয় যে, দেশে কোনো গরিব লোক থাকবে না।কিছু গরিব লোক সব সমাজেই অবস্থান করে – তারা হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সী একা লোকজন, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সী বিধবা মহিলা।আরো কিছু লোক আছে যারা অসমর্থ এবং অক্ষম, যেমন প্রতিবন্ধী গোষ্ঠী।এই ধরনের লোক বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে কম হলো মালয়েশিয়ায়, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ। আমেরিকায় এই দরিদ্র লোকের সংখ্যা হলো ১৪ শতাংশ।আমরা নির্ধারণ করেছি যে, আমাদের সংখ্যাটি হবে ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে।এদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সামাজিক বিনিয়োগের প্রয়োজন।এক্ষেত্রেও আমাদের রেকর্ড খুবই ভালো।আমাদের বার্ষিক বাজেট হলো আমাদের জাতীয় সম্পদের মাত্র ১৫ শতাংশ।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় সম্পদের ২ শতাংশ আমরা সামাজিক সহায়তায় বিনিয়োগ করি।আমাদের অবশ্যই বাজেটের আয়তন এবং সামাজিক বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে।আমি মনে করি যে, আমরা জাতি হিসেবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে, জাতীয় সঞ্চয়-হারকে আমাদের ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।আমাদের জাতীয় সঞ্চয়ের বর্তমান হার হলো জাতীয় আয়ের ১১ থেকে ১২ শতাংশ।পৃথিবীর মধ্যে জাতীয় সঞ্চয়ের হার আমাদের দেশে প্রায় সর্বনিম্নে অবস্থিত।আমাদের প্রতিবেশী নেপালের জাতীয় সঞ্চয়ের হার আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।আমার মনে হয় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে আমাদের বর্তমানে যে লজ্জাকর জাতীয় সঞ্চয়ের হার ১০ দশমিক ৯ শতাংশে আছে সেখান থেকে আমরা এই সঞ্চয়কে ১৪ শতাংশে উন্নীত করার উচ্চাভিলাষ গ্রহণ করতে পারি।আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে এইটি সম্ভব করে তুলতে পারি।আমাদের কৃতিত্বের রেকর্ড যদি রোমন্থন করি তাহলে আমার মনে পড়ে সিলেটের সন্তান সৈয়দ উল্লাহ ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে বিলেত গমন করেন তাঁর পিতা এবং চাচা হন্তা লর্ড লিন্ডসেকে হত্যা করতে।লর্ড লিন্ডসে ১৭৭২ সালে সিলেটে প্রথম ব্রিটিশ কালেক্টর হিসেবে তাঁর বাপ-চাচাকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।বিলেতে পৌঁছে অনেক কষ্ট করে পদব্রজে, ঘোড়াগাড়ি চড়ে সৈয়দ উল্লাহ অবশেষে এডিনবরা সিটিতে পৌঁছেন এবং সেখানে একটি বাজারে জ্ঞান হারিয়ে শয্যাশায়ী হন।ঠিক সেই সময় লর্ড লিন্ডসে ওই বাজারে উপস্থিত ছিলেন।তিনি জ্ঞানহারা লোকটিকে দেখেই চিনলেন যে, সে ভারতীয়।তাই তিনি তাঁকে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং সেবা-শুশ্রূষা করে তাঁকে ভালো করে তুললেন।তার পরে তিনি দেখলেন যে, তিনি কয়েকদিন ধরেই অভুক্ত এবং তাঁর জন্য রান্না শুরু করলেন।সৈয়দ উল্লাহ তখন তাঁকে বললেন যে, আমি খুব ভালো পাচক।এবং বললেন যে, আমিই তোমার রান্নাটি করি এবং এই দায়িত্বটি তিনি নিজেই প্রায় জোর করে নিয়ে নিলেন।রান্নার জন্য তিনি তাঁর ঝুড়ি থেকে পোটলা বের করলেন এবং সেখান থেকে কিছু মসলা নিয়ে উপাদেয় স্যুপ বানালেন এবং তারপর তিনি লর্ড লিন্ডসেকে বললেন যে, আসুন আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে আহার করি।লর্ড লিন্ডসের পরিবার কিন্তু এই আমন্ত্রণটি গ্রহণ করলেন না।তাঁরা এই লোকটিকে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।সুতরাং লর্ড লিন্ডসে একাই বসে সৈয়দ উল্লাহর সঙ্গে আহার করলেন এবং আহারটি হলো খুবই তৃপ্তিজনক।সৈয়দ উল্লাহ অতঃপর লর্ড লিন্ডসেকে জানালেন যে, তিনি এই লর্ডকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে চান।লর্ড লিন্ডসে তখন তাঁকে বললেন যে, কাহিনিটা যেমনভাবে সৈয়দ উল্লাহ জেনেছেন আসলে সেটা তো ঠিক না-ও হতে পারে।তিনি বললেন যে, এমন তো হতে পারে যে লর্ড লিন্ডসে আসলেই কোনো হন্তা নন এবং পিস্তল যখন তিনি আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করেন তখন ভুলবশত হাদি ও মাহদি ভ্রাতৃদ্বয় নিহত হন।তিনি তারপর জানালেন যে, তিনিই লর্ড লিন্ডসে এবং তিনি মোটেই হত্যা করতে পিস্তল ব্যবহার করেননি।শুধু ভয় দেখিয়ে আত্মরক্ষা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পিস্তল চালাতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না বলে তাঁর গুলিতে হাদি ও মাহদি নিহত হন।সৈয়দ উল্লাহ সারা কাহিনি শুনে তাঁর প্রতিজ্ঞা থেকে সরে গিয়ে লর্ড লিন্ডসের বিশ্বস্ত সহচর ও পাচক হিসেবে সারাজীবন এডিনবরাতেই যাপন করেন।

আমার মূল প্রবন্ধে এখন ফিরে আসছি।আগেই বলেছি যে, বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকেই ছিলেন খুব সাহসী এবং দৃঢ়চেতা।তিনি ন্যায় এবং সত্যের পক্ষে সব সময়ই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন।কৈশোরেই তিনি তাঁর এই মনোবৃত্তির জন্য পুলিশের শত্রু হয়ে যান।কৈশোরে তিনি পুলিশের হাতে দুই-দুইবার গ্রেফতার হন।অবশ্য, স্বল্প সময়েই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জেলখানার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ওই কৈশোর থেকেই তাঁর পঞ্চান্ন বছর বয়স পর্যন্ত বহাল থাকে।পাকিস্তান আমলে ২৩ বছরের মধ্যে ১৩টি বছরই তিনি জেলে অতিবাহিত করেন।একমাত্র বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে আর তাঁকে জেলে যেতে হয়নি।

১৯৭৫ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (ডুকসু) আজীবনের সদস্যপদ প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তাঁকে সেই সম্মাননাটি গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।বঙ্গবন্ধু সেই আমন্ত্রণটি সাগ্রহে গ্রহণ করেন।সারা মহানগরে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য আয়োজন নিয়ে সবাই ব্যস্ত এবং মহানগরে সাজসাজ রব বিরাজিত।তখন একটি ষড়যন্ত্রকারী দেশশত্রু গোষ্ঠী পাকিস্তান ও লিবিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের ব্যবস্থা করে।তাদের দলটি ছিল কতিপয় সেনা কর্মকর্তা এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদ নিয়ে গঠিত।কয়েকজন সেনা অফিসার মেজর রশীদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম ও মেজর নূর তাদের অধীনস্থ কিছু সৈন্যকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে, যেখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব বাড়ি, সেদিকে ধাবিত হয়।সেখানে পৌঁছে ভোররাতেই তারা তাঁর বাড়িটি আক্রমণ করে সেখানে নিয়োজিত সামান্য পুলিশ ও সেনাসদস্যদের হত্যা করে বা হটিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দ্বিতলের দিকে অগ্রসর হয়।হইচই শুনে এবং গোলাগুলির আওয়াজে বঙ্গবন্ধু তাঁর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেন।তাঁকে কথা বলার সময় না দিয়েই মেজর নূর হোসেন তার স্টেনগান দিয়ে তাঁকে হত্যা করে।তারপর মেজর ফারুক আর রশীদ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওই বাড়িতে অবস্থানকারী সকলকে হত্যা করে।তাদের কাছে মিনতি করেও দশ বছরের শিশু শেখ রাসেল এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।

এই হন্তাদের আমরা অবশ্যি কিছুদিন পরে হলেও বিচার করে শাস্তি দিয়েছি।তাদের দাম্ভিক নেতা ফারুক রহমান ফাঁসিকষ্ঠে ঝুলেছে।এছাড়া বাকি ১৭ জন নানা শাস্তি পায়।তাদের মধ্যে এখন জীবিত আছে মাত্র তিনজন দেশশত্রু।যে লোকটি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে সে নূর হোসেন আছে কানাডায়।এছাড়া মেজর ডালিম যে বাংলাদেশ রেডিওতে এই দুষ্কর্মটি ঘোষণা করে সে আছে পাকিস্তানে এবং তৃতীয় লোক যে কর্নেল ফারুকের সঙ্গে নেতৃত্বে ছিল আব্দুর রশিদ সেও আছে পাকিস্তানে।তারা সম্ভবত কখনো পাকিস্তান থেকে বাইরে যায় না।মেজর নূরকে দেশে আনবার জন্য আমাদের পররাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয় কানাডার সঙ্গে বর্তমানে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।আরেকজন পলাতক কিছুদিন আগে বিদেশে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।তাদের বিচার করে এবং শাস্তিদান করে আমরা অন্ততপক্ষে জাতীয়ভাবে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে সমর্থ হয়েছি।

আমি বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতার কথা বলছিলাম। ১৯৪৮ সালে গোপালগঞ্জে তদানীন্তন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এবং তাঁর সঙ্গে সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভ্রমণে যান।বঙ্গবন্ধু ঠিক করলেন যে, তাঁদের সামনে তিনি তাঁদের অসুবিধার কথা তুলে ধরবেন এবং তার প্রতিকার চাইবেন।সেই উদ্দেশ্যে একদল ছাত্রকে নিয়ে যে রাস্তায় অতিথিরা আসবেন সেই রাস্তায় দলবেঁধে তিনি দাঁড়ালেন।মহান অতিথিরা কিশোরদের এই সমাবেশের কাছে এলে তাদের কথা শুনতে লাগলেন।বঙ্গবন্ধু বললেন যে, তাঁরা যে হোস্টেলে থাকেন সেটা বসবাসের অযোগ্য এবং বৃষ্টি হলে তাঁরা একেবারে ভিজে যান।তিনি দাবি করেন যে, এই হোস্টেলের সংস্কার অপরিহার্য।তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎ মন্ত্রীবর্গ ১২০০ টাকা অনুদান দিয়ে এই হোস্টেলের সংস্কারের ব্যবস্থা করেন।তবে এই ঘটনার অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রতিফল হয় যে, বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর সারাজীবনের শিষ্যত্ব।সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক এবং আজীবন তিনি তাঁর অনুসারী ছিলেন।১৯৬৩ সালে এই মহান নেতা যখন বৈরুতে একটি হোটেলে ইন্তেকাল করেন তখন বঙ্গবন্ধু সেখানে ছুটে যান তাঁকে নিয়ে আসার জন্য এবং তাঁর জন্য ঢাকায় একটি অতিবৃহৎ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।বঙ্গবন্ধুর সৎসাহস এবং সত্যবাদিতার আর একটি উদাহরণ আমি এখানে দিতে চাই।আমরা জানি যে, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে গুজরাট সীমানায় ভারতীয় সীমানা প্রহরীদের সঙ্গে গুলিবিনিময় করে গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় কিছু এলাকা ভারতের কাছ থেকে দখল পায়।এতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো কাশ্মির সীমান্তে কিছু গোলমালের সৃষ্টি করেন।তাঁর ধারণা ছিল যে, তাঁর এই উদ্যোগে কাশ্মিরের মুসলমান অধিবাসীরা যোগ দেবেন।কিন্তু বস্তুতপক্ষে কাশ্মিরের অধিবাসীরা এই উদ্যোগটি মোটেই পছন্দ করলেন না।এবং পাকিস্তানের উদ্যোগটি প্রতিহত করতে ভারত সেখানে ব্যবস্থা নেয়।তার ফলে একটি স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।এই যুদ্ধে পাকিস্তান কিংবা ভারত কাউকেই কোনো বৃহৎ শক্তি সমর্থন দিতে বিরত থাকে।বরং তারা এই দুই দেশে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।ভারতের তবু কিছু জাতীয় জ্বালানি সম্পদ ছিল, পাকিস্তানের জ্বালানি সম্পদ ছিল নামেমাত্র। দু-দলই জ্বালানির অভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যর্থ হয় এবং ১৭ দিনের মধ্যেই যুদ্ধটি বন্ধ করে দেয়।এই যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে পশ্চিমের দেশগুলো কোনো পক্ষকেই সাহায্য করতে রাজি ছিল না।অবশেষে রাশিয়া তাসখন্দে যুদ্ধবিরতির জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে পাকিস্তান এবং ভারতকে আমন্ত্রণ জানায়।তাসখন্দ সম্মেলনেই ১৯৬৫ সালে যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পন্ন হয়।লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন।চুক্তি সম্পাদনের অব্যবহিত পরেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইহধাম পরিত্যাগ করেন।

জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সহজেই বুঝতে পারলেন যে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটি নিতান্তই অহেতুক একটি বোকামি কাজ ছিল। তাই তাঁরা সারা পাকিস্তানব্যাপী তাঁদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সভা-সমিতি করতে থাকেন। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সম্ভবত ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এই সম্বন্ধে আলোচনার জন্য একটি সুধীসমাজের সভার আয়োজন করেন।এই সভায় বঙ্গবন্ধুও আমন্ত্রিত হন।বঙ্গবন্ধু সেখানে তাঁর বক্তব্যে একটি মন্তব্য করেন যে, দুই লাখ কাশ্মিরীর জন্য ৬৫০ লাখ বাঙালির দুশ্চিন্তার কোনো হিসাব না দিয়েই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন সেটা নিতান্তই ভ্রান্ত ছিল।কারণ, পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা সেই সময় জানতো না যে, কখন ভারত তাদের গ্রাস করবে।বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির জবাব আইয়ুব খান তখন দিলেন না।কিন্তু কিছুদিন পরে ভুট্টো এর জবাব দিলেন।তিনি জানালেন যে, পাকিস্তান অবশ্য পূর্ব বাংলার বিষয়টি বিবেচনা করে পোল্যান্ডে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার ব্যবস্থা করে যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে না। এই ব্যাখ্যা অবশ্য বঙ্গবন্ধু মেনে নিলেন না। তিনি মন্তব্য করলেন যে, ১৭ দিন বাঙালিরা যে আতঙ্কের মধ্যে থাকলো তা প্রশমনের কোনো ব্যবস্থাই তো পাকিস্তান করেনি এবং পোল্যান্ডে সম্পাদিত মৌখিক চুক্তি তো জানবার সুযোগও তাদের ছিল না। সুতরাং তারা তো ১৭ দিনই মহাআতঙ্কে দিন কাটায়। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায় যে, আইয়ুব খানের ১০ বছরের রাজত্বকালে এইটি হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর প্রথম মোলাকাত। কিন্তু এর পরে পরেই আইয়ুব খানের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার প্রায় দুই বছর পরে রাষ্ট্রদ্রোহের আগরতলা মামলা শুরু করা হয়।১৯৬৬ সালের জুন মাস থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। আইয়ুব খান যখন সর্বশেষে ঠিক করলেন যে, তিনি পদত্যাগ করবেন, তখনই তিনি নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোলটেবিলে বসতে রাজি হন।এই গোলটেবিল বৈঠক অবশ্য পাকিস্তানের প্রধান সেনানায়ক আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অচিরেই বানচাল করে দিলেন এবং প্রায় এক বছরের জন্য সব রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিলেন।

এখন আমরা সকলেই জানি যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগেই নিশ্চিত ছিলেন যে, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান একত্রে কখনো থাকবে না।তাদের একটি ঘনিষ্ঠ মহল এই সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিল যে, এই সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান অচিরেই তাদের সম্পর্ক কাটতে বাধ্য হবে।সেজন্যই যখন ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করে, তখন বঙ্গবন্ধু তাতে জোর সমর্থন প্রদান করেন।এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের বর্তমান পাকিস্তান এলাকাকে নিয়ে একটি স্বশাসিত প্রদেশ স্থাপন, পূর্বে আসাম এবং বাংলাদেশকে নিয়ে আর একটি প্রদেশ স্থাপন এবং ভারতের বাকি অংশকে নিয়ে আর একটি প্রদেশ স্থাপন।এই প্রস্তাব যদিও কংগ্রেস এবং মুসিলম লীগ গ্রহণ করে; কিন্তু শেষ মুহূর্তে পণ্ডিত নেহরুর একটি ঘোষণাই সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। পণ্ডিত নেহরু ঘোষণা করেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী পরিষদে কংগ্রেস কোনো সমঝোতা বিবেচনা না করে উন্মুক্ত মনে অংশগ্রহণ করবে। তাঁর এই ঘোষণার ফলে শাসনতন্ত্র পরিষদের কোনো অধিবেশনই আর সম্ভব হলো না।

দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন।তবুও আওয়ামী লীগ তাঁকে প্রতিষ্ঠানের একজন যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে।সে-সময় যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে বেইমান খোন্দকার মোশতাকও ছিল।অবশ্য, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৯৫৩ সালেই হারিয়ে যান এবং আওয়ামী লীগ তখন বঙ্গবন্ধুকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করে।তিনি এই পদে প্রায় তিন বছর অবস্থান করেন এবং এই সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য হিসেবে পুনর্গঠিত গণপরিষদের এবং ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য হন।১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রথম যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তাতে তিনি মন্ত্রী নিযুক্ত হন।শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সেই মন্ত্রিসভা মাত্র এক মাসেই বরখাস্ত হয়।বেশ কিছুদিন পরে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু আবারো মন্ত্রী নিযুক্ত হন।কিন্তু এই পদে তিনি বেশিদিন থাকলেন না।তিনি মন্ত্রী পদ ছেড়ে দিয়ে তৃণমূলে দলগঠনে মনোনিবেশ করলেন।আমার মনে পড়ে যে, তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর কুমিল্লায় দলের কাজে ভ্রমণে আসেন এবং তখন সরকারের (অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের) অনুমতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে সার্কিট হাউসে যাই।আমি সরকারি চাকরি (সিএসপি) নেবার পরেই এই প্রথমবারের মতো তাঁর সঙ্গে দেখা করি।আমি যে চাকরি নিয়েছি সেই খবরটি তিনি জানতেন এবং আমাকে বললেন যে, দেশসেবা সরকারি চাকরির প্রথম লক্ষ্য।সেই লক্ষ্যটার দিকে নজর দিতে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন।আমার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন যে, ক্ষমতা জনগণের ঠিকই কিন্তু তারা তা জানে না এবং তা প্রয়োগ করে না।সেজন্যেই আমি জনগণকে সংগঠিত করার জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়েছি।

এই একটি বছর তিনি সারাদেশ চষে বেড়ান এবং একটি স্বতন্ত্র বাংলাদেশের ধারণা তখনই জনমনে গভীরভাবে উপ্ত হয়।তাই আমরা বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রচারক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর আর একটি কৃতিত্ব হলো যে, তিনি এই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই রাষ্ট্রটির কাঠামো এবং আইনকানুন সবকিছুই প্রস্তুত করেন।বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরে মোট ৫৯৩টি আইন পাশ হয় এবং এখানেও আমরা দেখতে পাই যে, এমন কোনো বিষয় নেই যা তাঁর চিন্তাজগতের বাইরে ছিল।যেমন ধরুন – সমুদ্র আইনের বিবেচনা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের পরে ১৯৭৬ সালে এবং সেই আলোচনা চূড়ান্ত হয় ১৯৮৪ সালে।কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই আইনটি পাশ করেন ১৯৭৪ সালে এবং যখন এই আইনটি আমরা সংশোধন করলাম ২০১৪ সালে তখন দেখা গেল যে, এর কোনো ব্যাপক সংশোধনের প্রয়োজন নেই; সামান্য কিছু সংশোধন করেই আমরা আইনটিকে যুগোপযোগী করে তুললাম।এরকম কর্মকাণ্ড বা এরকম চিন্তাভাবনা শুধু মহামানবরাই করতে পারেন।তাঁরা এই পৃথিবীতে একান্ত ক্ষণজন্মা এবং খুবই নির্দিষ্ট।প্রাগৈতিহাসিক যুগের হেমুরাভি, মধ্যযুগের জাস্টিনিয়ান এঁদের মতোই মহানায়ক ছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের গৌরব শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি শুধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না, তিনি শুধু আমাদের সংবিধানটি প্রণয়ন করেননি, তিনি চারটি মহা-আদর্শের একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নেন। জাতীয়তাবাদ, ইহজাগতিকতা (ধর্মনিরপেক্ষতা), গণতন্ত্র এবং সামাজিক সমতা হলো এই রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই তিনটি কাজ করার পরেও তিনি আর একটি চতুর্থ কাজ সম্পন্ন করে যান।তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের একটি সেতুবন্ধন করে যান।গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের একটি সংহত সমন্বয় করতে গেলে মানুষের সকলের উদ্যোগ এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।মানুষকে বেছে নিতে হবে যে, সাময়িক ত্যাগের বিনিময়ে তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা পাবেন। আমি মনে করি যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা আমাদের একটি সৌভাগ্য। আমি নিজের ব্যাপারে মনে করি যে, তাঁর সঙ্গে সরকারের একজন সচিব হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া, তাঁর সঙ্গে কৈশোরে পরিচয় লাভ করা এবং ছাত্রজীবনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুযোগ পাওয়া নিতান্তই একটি সৌভাগ্যের বিষয়।এর সঙ্গে যোগ করবো যে, পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী তাঁর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার যে-সুযোগটি গত দুটি দশকে পেয়েছি সেইটি আমার সৌভাগ্যের আর একটি মাত্রা।‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’গঠনে সামান্য অংশগ্রহণটাকে আমি নেহায়েত সৌভাগ্য মনে করি।**