বাঙালির জীবনে একুশের দ্যুতি

একুশ মূলত একটি নিরীহ সংখ্যা। নানা মানুষের কাছে এর নানা তাৎপর্য। যেসব জ্যোতিষী সংখ্যানির্ভর ভাগ্যগণনার চর্চা করেন তাঁদের কাছেও নিশ্চয়ই এর পৃথক একটি ইঙ্গিত রয়েছে, যেমন রয়েছে অন্যান্য সংখ্যারও। কিন্তু সেসব ইঙ্গিতের তাৎপর্য ছাপিয়ে বাঙালির ভাবজগতে ও কর্মজগতে এই সংখ্যাটির যে গুরুত্ব ও আবেদন, তার তাৎপর্য ও প্রভাব নিশ্চয়ই অনেক বেশি ব্যাপক ও গভীর। স্বীকার করতে হয়, একুশের এই তাৎপর্য বাঙালি জাতির জীবনে সৃষ্টি হয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই এবং তা নিঃসন্দেহে প্রথমত রাজনৈতিক ইতিহাস দ্বারা নির্ধারিত। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার যে-আশা পূর্ব বাংলার মানুষ করেছিল তা অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশবাদী আচরণে। এ আচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা ও বাঙালির জীবনচর্চার প্রতি তাদের বিরুদ্ধ মনোভাবে। ডাকটিকিটে ও মানি-অর্ডার ফরমে উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হলেও বাংলা ব্যবহৃত হতো না বলে সাধারণ মানুষের কাজে অসুবিধা হতো; কিন্তু পাকিস্তান সরকার তার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করে বরং নিজেদের অন্যায়কে শাসকের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। পূর্ব বাংলার মানুষের পক্ষে পাকিস্তানি শাসকদের এ মনোভাব মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। কারণ এ ছিল যেমন তাদের অধিকারের প্রশ্ন, তেমনি আত্মমর্যাদারও প্রশ্ন। অন্যদিকে পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহার যে ন্যায্য সে-কথা এমনকি গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদ্যরাও মেনে নিতে চাননি সেদিন। তাঁদের এ নেতিবাচক মনোভাব ও পাকিস্তানি শাসকদের জবরদস্তিমূলক কর্মকা- নীরবে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না বলেই পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুবসমাজ সেদিন ভাষা-আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। বাহ্যত সরকারি কর্মকাণ্ডে ও বিবেচনায় মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিই একুশের আন্দোলনের সূচনাবিন্দুরূপে কাজ করলেও এই দাবি উত্থাপনের পেছনে বাংলার সাধারণ মানুষের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের বিষয়টিই যে মুখ্য ছিল তা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এজন্যই শাসকগোষ্ঠী ভাষা-আন্দোলনকে যেমন সর্বপ্রয়াসে বানচাল করার চেষ্টা করেছিল, তেমনি পরবর্র্তীকালে ভাষা-আন্দোলনের প্রতীকী নির্মাণ শহিদমিনারকেও সহ্য করতে পারেনি। তাই বাঙালির যে-কোনো আন্দোলনকে নস্যাৎ করার সকল পদক্ষেপেই শহিদমিনার হয়েছে তাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। কেন্দ্রীয় শহিদমিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে তাই তাদের ক্রোধের ও হিংস্রতার প্রতিফলন ঘটেছে অনিবার্যভাবেই। কিন্তু ভাঙা বা অসমাপ্ত শহিদমিনারও যে বাঙালির প্রতিরোধ-চেতনাকে পূর্ণভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারে সে-কথা হয়তো পাকিস্তানি শাসকদের জানা ছিল না।

দুই
আজ, বায়ান্নর সেই রক্তঝরা দিনগুলির পর অনেকখানি সময় পার হয়ে এসেও আমরা যে একুশের কথা বলি, একুশের তাৎপর্যের কথা বলি, একুশের চেতনার কথা বলি – সে সম্ভবত একুশের শক্তিকে আজো আমরা নিরন্তর অনুভব করি বলেই। একুশের বড় শক্তি এখানে যে – সে নিজেকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়েছে, অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে আত্মশক্তির বিকাশের দিকে অগ্রসর হয়েছে, নতুনতর ভাবসম্পদ আত্মস্থ করার পথে আমাদের সার্বিকভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে। সেজন্যই একুশ বায়ান্নকে অতিক্রম করে উনসত্তরকে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিল, একাত্তরকে সম্ভব করতে সামর্থ হয়েছিল।
আমরা জানি যে, মাতভাষা যে-কোনো জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার ও নিজেদের অস্তিত্বকে ক্রমবিকিরণশীল করে তোলার এক প্রধান অবলম্বন। আমাদের জীবনে, ব্যক্তিগত ও জাতীয়, একুশের এই ভূমিকা যে নানাভাবে সতত ক্রিয়াশীল সে-কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মনে হয়, বাইরের ও ভেতরের তথা মনোজগতের সংকট – এই উভয় সংকটকালেই আমরা একুশের সেই চেতনার কাছে ছুটে যাই, যে-চেতনা ফল্গুধারার মতো নিরন্তর বহমান, – সে আমরা বাইরে অনুভব কিংবা স্বীকার করি বা না করি। বলতে পারি, ভাষার অধিকারের শর্তকে ছাড়িয়ে তা আমাদের কর্মজগৎ ও ভাবজগতের মূলকে প্রতি মুহূর্তে স্পর্শ করে চলেছে। তাই একুশ আজ আমাদের চেতনাজগতের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনকে শুধু ঋদ্ধই করে না, সেইসঙ্গে আমাদের ভাবজগৎকেও নাড়া দেয়।তিন
একুশের চেতনা বা একুশের তাৎপর্য বলে একটি কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। সম্ভবত এর দ্বারা আমরা জীবনে শ্রেয়োবোধের দিকটিকেই নির্দেশ করি। এই শ্রেয়োবোধের আকাক্সক্ষা আমাদের তাড়িত করে বলেই আমরা মহত্তর ও বৃহত্তর কল্যাণবোধ অর্জনের চেষ্টা করি এবং এমন এক রাষ্ট্রীয় সেবাকাঠামো ও সামাজিক ব্যবস্থা সম্ভব করার কথা চিন্তা করি, যা সর্ব অর্থেই মানবিক হতে পারে। বস্তুত একুশ আমাদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি বলেই আমরা একুশের সংগ্রাম ও অর্জনকে আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ বলে মনে করি বা মনে করতে বাধ্য হই। তবে একুশ অনেক সময় আমাদের কাছ থেকে তার প্রাপ্যও দাবি করে বইকি। কিন্তু সহজ ভাবনায় কিছুতেই ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, আমাদের কাছ থেকে একুশের প্রাপ্য কী। যদি মনে করা যায় যে, একুশের ইতিহাস আমরা স্মরণ করব, একুশের সংগ্রাম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে বাঙালির সকল মহৎ অর্জনকে আমাদের সার্বজনিক সম্পদরূপে গ্রহণ করব – তাহলে এর একটা ভাবজাগতিক অর্থ দাঁড়িয়ে যায় বৈকি। আবার বস্তুজাগতিক অর্থে যদি সে প্রাপ্য নির্ধারণের কথা ভাবি, তাহলে বলতে হয় – আমরা এমন এক সমাজকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাব যে-সমাজে সকল মানুষ তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদার নিশ্চয়তা পাবে। আর ন্যূনতম চাহিদাই বা বলি কেন, বলতে পারি – সকল মানুষ পাবে সুস্থ, সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা। একুশ থেকে শুরু করে সেই লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছানোই তো হওয়া উচিত আমাদের অন্বিষ্ট।
স্বীকার করতে দ্বিধা থাকা ঠিক নয় যে, আত্মশক্তি ও আত্মিক শক্তির সূচনা ও বিকাশের ক্ষেত্রে একুশের একটি স্থির ভূমিকা আমাদের জীবনচর্চার প্রয়াসে দৃশ্য ও অদৃশ্যভাবে সক্রিয় থাকছে। এই সক্রিয়তা একদিকে যেমন ইতিহাস-কাঠামোর দ্বারা নির্দিষ্ট, অন্যদিকে তেমনি আত্মিক শক্তি অর্জনের আকাক্সক্ষা দ্বারা সূচিত ও উজ্জীবিত। সাধারণভাবে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের প্রতি মুহূর্তে এই ভূমিকার কথা আমরা নিশ্চয়ই তেমন সচেতনভাবে মনে রাখি না কিংবা মনে রাখার তেমন কোনো কারণও নিয়ত সৃষ্টি হয় না; কিন্তু আমাদের সামষ্টিক জীবনের সচলতা ও লক্ষ্য-নির্দিষ্টতার কথা যদি কখনো সচেতনভাবে নির্দেশ করার কথা ভাবি, তাহলে তার আন্তরপ্রেরণা সত্যই অনুভব করতে হয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, বাঙালি মন ও বাঙালি জীবনই এই প্রেরণা সৃষ্টির আদি উৎস, ইতিহাস তাকে যথার্থ একটি নির্দিষ্টতায় স্থাপন করেছে ভাষা-আন্দোলনের সূত্রে। এই নির্দিষ্টতা কোনোভাবেই নিষ্ক্রিয় অবস্থানের নিশ্চলতা নয় – সে-কথা মনে রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরও।