বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ

অনুপম হাসান
সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ
অনুপম সেন
অবসর
ঢাকা, ২০১১
১০০ টাকা

সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ে বিস্তর লিখেছেন সুলেখক অনুপম সেন। বিশেষত সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে লেখক অনুপম সেনের স্বতন্ত্র তীক্ষ্ণ যুক্তিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সুধীমহলে বিশেষ আসনে তাঁকে উন্নীত করেছে। বর্তমান গ্রন্থ আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ অনুপম সেনের রচিত অন্যান্য গ্রন্থের প্রথাগত বিষয় ও ধারার চেয়ে স্বতন্ত্র। এখানে তিনি যে পাঁচটি প্রবন্ধের সন্নিবেশ করেছেন তার কেন্দ্রে রয়েছে ভাষা, বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক ইতিবৃত্ত; যার বাহ্যাবরণে লেখক সংস্থাপন করেছেন সমাজকে। ফলে অনুপম সেন তাঁর চিরচেনা ও পরিচিত সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি চিন্তার বাইরে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে তার সঙ্গে ভাষার সমস্যাকে জড়িয়ে যুক্তির চেয়ে আবেগী আলোচনায় মনোনিবেশ করেছেন এ-গ্রন্থের প্রবন্ধাবলিতে। এরপরও প্রবন্ধের নানামুখী আলোচনায় তথ্য-উপাত্ত এসেছে, তবে তা গৌণ বিবেচিত হয়েছে লেখকের ভাষা ও নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণের আবেগাপ্লুত অনুভূতির প্রকাশে। গ্রন্থের পাঁচটি প্রবন্ধের শিরোনাম  নিম্নরূপ :

এক. বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান : বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ভাষণ

দুই. জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলার প্রয়োগ

তিন. নিজের রাষ্ট্র, নিজের ভাষা

চার. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : বাঙালি চিরকাল তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে

পাঁচ. আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ

অনুপম সেনের আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ গ্রন্থে সন্নিবেশিত পাঁচটি প্রবন্ধের প্রথমটি হচ্ছে ‘বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান : বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ভাষণ’। এখানে লেখক অনুপম সেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পৃথিবীর বুকে যে বাঙালি জাতিসত্তার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড নিশ্চিত হয়েছিল তা খুবই উপরিস্তরে পর্যালোচনার মাধ্যমে জানিয়েছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তার সম্পর্ক নির্ণয় করে জাতিটির যে নিজস্ব স্বাধীন কোনো ভূখন্ড ছিল না দীর্ঘদিন, তা লেখক এতোটা সংক্ষেপে বলেছেন যে, ভাষা, জাতি, রাষ্ট্র এবং স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ পর্যবেক্ষণে সমন্বিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যেমন : ‘বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালেই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে বাঙালি নিজের জাতিসত্তাকে কয়েক হাজার বছর ধরে রূপ দেয়।’ (পৃ ১৩) বলার অবকাশ রাখে না যে, অনুপম সেনের এ বক্তব্য অভ্রান্ত তবে সে বক্তব্য অস্পষ্ট এবং খুব বেশি সাদামাটা। বাঙালির হাজার বছরব্যাপী সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অনেক বেশি ঐতিহাসিক তথ্যের সমাবেশ এখানে অনিবার্য ছিল, তা উপেক্ষা করা যায় না। এমনকি এ প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাঙলা উপন্যাসেও এর চেয়ে অনেক তথ্যের সমাবেশ লক্ষণীয়। তাছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যের যথেষ্ট ঋদ্ধ পর্যালোচনা রয়েছে মুহম্মদ হাবিবুর রহামনের গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থেও। এ-গ্রন্থে বিশ্বস্ত তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। তাছাড়া খ্যাতিমান পন্ডিত আহমদ শরীফ তাঁর বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য গ্রন্থে বাঙালি জাতির হাজার বছরব্যাপী বিকাশের মনোজ্ঞ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করেছেন। এসব গ্রন্থ অধ্যয়নের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেখক অনুপম সেন এ প্রবন্ধে বাঙালি, বাংলা ভাষা এবং বাঙালির স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি এতোটা সংক্ষেপ না করে আরো খানিকটা বিস্তৃত আলোচনা করলেই পারতেন। কারণ, এর প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি অনস্বীকার্য। নিচের উদাহরণটি থেকে বিষয়টি সম্পর্কে আরো স্পষ্ট হওয়া সম্ভব :

রাজসভার ভাষা ছিল সংস্কৃত, পালি বা ফার্সি […] তাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলা রাজ্য মাঝে মাঝে সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র কোনোদিন সৃষ্টি হয়নি ১৯৭১ সালের আগে। যেখানে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজের জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটিয়ে নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানব অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে নিজের রাষ্ট্রের সংবিধানে।  (পৃ ১৩-১৪)

পাল, সেন ও মোগল আমলে বাংলা যে স্বাধীন ছিল না এসব কথা লেখক এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের তথ্যগত সংযোগ প্রতিস্থাপনের সূত্রটি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ, বাঙালি স্বাধীন ছিল না – একথা লেখকের বক্তব্যে স্পষ্ট হলেও বাঙালি জাতির পরাধীনতার ব্যাপারটি এখানে সংযোগ সূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, উপরিস্তরের এ জাতীয় গৌরচন্দ্রিকার মধ্য দিয়ে লেখক প্রবেশ করেছেন একাত্তর-পরবর্তী সময় এবং নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান প্রসঙ্গে। সংবিধান এবং রাষ্ট্রের ব্যাপারে অনুপম সেনের প্রাজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। ফলে প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে লেখক বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধান এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অনিবার্য অনুপুঙ্খ যৌক্তিক সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রবন্ধের পরবর্তী পর্যালোচনার চুলচেরা বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময়।

অনুপম সেন ‘জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলার প্রয়োগ’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে মন্ময় ভঙ্গিতে ভাষার সঙ্গে জাতিগত উন্নয়ন, অগ্রগতির ব্যাপারটি তাৎপর্যময়ভাবে জড়িত, তা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রবন্ধটি আবেগপ্রধান হলেও বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, রাষ্ট্রীয় উন্নতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়কে এ লেখায় যৌক্তিক পরম্পরায় বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেছেন। এ প্রবন্ধে লেখক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন বাঙালির ইংরেজিপ্রীতি, ইংরেজিচর্চার প্রতি অধিক আগ্রহী-উৎসুক হওয়া প্রসঙ্গে। তিনি যথার্থই লিখেছেন : ‘আমাদের বিদ্বৎসমাজের বেশ বড় একটা অংশ ভাবেন, কেবলমাত্র ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে, ইংরেজি শিখলেই আমরা উন্নত রাষ্ট্র হতে পারবো, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করবো।’ (পৃ ২৩) বাঙালি সমাজে এই ভ্রান্ত ধারণা ক্রমশ শিকড় বিস্তার করেছে। বায়ান্ন সালে ভাষার জন্য বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করার পরও বিগত অর্ধশতাব্দীব্যাপী বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই অর্থে তেমন কোনো চর্চা হয়নি। বরং বিগত এক-দুই দশক থেকে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে প্রায় সবক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। বিশেষত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা উপেক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য শুভকর নয়। পৃথিবীর যে কোনো উন্নত জাতির কথাই বলা হোক না কেন, তারা তাদের নিজের ভাষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং বাঙালি জাতিকেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আত্মনিবেদনের জন্য নিজস্ব ভাষায় বিদ্যার্জনের বিকল্প নেই। এজন্যে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আশু প্রয়োজন।

লেখক অনুপম সেন গ্রন্থের নাম শীর্ষক ‘আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধটিতে বিশদ ও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক পরিচয় ও ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে। মোট দশটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত দীর্ঘ এ আলোচনায় লেখক বাঙালি জাতির সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যালোচনাসাপেক্ষে বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদ প্রভাবিত অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব আগামীতে কতটা মারাত্মক হয়ে উঠবে তা অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। এ প্রবন্ধে বাঙালি সমাজের ভবিষ্যৎ যতোটা সুচারু পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন লেখক তা বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে করেননি। এর কারণ অবশ্য আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, অনুপম সেন লেখক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি বিষয়ে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, বলা যায় সিদ্ধহস্ত ঠিক ততোটা নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় পারেননি। গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধটিতেও আমার বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন :

[…] জাতিসত্তা হিসেবে বাঙালির বয়স কয়েক হাজার বছর। এখানে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির আগমনের ফলে, নানা বর্ণ ও জাতির মিশ্রণে বাঙালি একটা মিশ্র জাতিসত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। ককেশীয়, ভোটচিন, অস্ট্রিক, নিগ্রোইড ইত্যাদি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর   মিশ্রণেই বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে এই ভূখন্ডে। […] পুন্ড্র, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গৌড়, হরিকেল ইত্যাদি নাম যেমন জনপদের তেমনি বিভিন্ন কৌম বা উপজাতির। আজ এসব কৌমের আলাদা পরিচয় আর নেই। এরা সবাই এক হয়ে মিশে গিয়ে বাঙালি নাম নিয়েছে, বাঙালি হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। (পৃ ৩৮-৩৯)

বাঙালির জাতিগত নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এভাবে প্রদান করেছেন লেখক অনুপম সেন। বলার অবকাশ রাখে না যে, একটি জাতির ঐতিহাসিক পরিচয়, বিশেষত সেই জাতিগোষ্ঠী যদি বাঙালি হয় (যে জাতির রক্তে মিশেছে নানা বর্ণ, গোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষ; যারা ইতিহাসে শংকর জাতি হিসেবে পরিচিত) তাদের জাতিগত পরিচয় আরো স্পষ্টতর হওয়ার এবং তথ্যনির্ভর তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। উপরন্তু প্রবন্ধের প্রথম পাঁচটি পরিচ্ছেদজুড়ে বাঙালি জাতির প্রাচীন ও মধ্যযুগের ঐতিহাসিক পরিচয়ও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং উপরিস্তরের। এ আলোচনা আরো ব্যাপক, গভীরতর ও তাৎপর্যময় হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ থেকে লেখক বাঙালি জাতির সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়নের অভিঘাত অনুসন্ধান করতে গিয়ে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :

[…] আমাদের বাঙালি সত্তাকে রক্ষা করতে হলে, আমাদের আদি-অন্তে বাঙালি হতে হলে বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসন বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আমাদের মানস পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ঠেকাতে হবে। এদের মূল উদ্দেশ্য জীবনকে পণ্যাশ্রয় করা, পণ্যে পরিণত করা; অবশ্য তা থেকে ফেরার চেষ্টাও চলছে আজ বিশ্বব্যাপী। বারবার পুঁজির বিপন্নতার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ নিজেই তার দৌর্বল্যকে বিশ্বের নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষের কাছে তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছে। এরই মধ্য দিয়ে দেশে দেশে এই সত্য ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে, পণ্য নয়, মানুষের যা প্রয়োজন, মানুষ তা নিজেকে পণ্যে পরিণত করে পারে না। পণ্যের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। পণ্যকে তার বশে আনতে  হবে। (পৃ ৬১)

অনুপম সেন বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ এবং মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বরূপ উদ্ঘাটন করে এখানে শুধু বাঙালি নয়, পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ করণীয় সম্বন্ধে অসাধারণ ও যৌক্তিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।

এ-গ্রন্থের ‘নিজের রাষ্ট্র, নিজের ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে অত্যন্ত গোছানো এবং তাৎপর্যমন্ডিত বিশ্লেষণে ঋদ্ধ। এখানে লেখক অনুপম সেন ইতিহাসের কথাগুলোই সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বে বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণাবয়ব বিকাশ ঘটেনি। কারণ, দেশ স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই বাঙালি একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বাকৃতি পায়। ১৯৭১ সালের আগে পাল, সেন, সুলতানি, তুর্কি কিংবা নবাবি আমলে অসম্পূর্ণ অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ পেলেও কখনো বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করেনি। লেখকের বক্তব্য নিম্নরূপ :

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাঙালির জন্য বাংলা কখনো একক রাষ্ট্রভাষা ছিল না। ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য বাঙালি প্রাণ দিয়েছিল তার ফলে পরবর্তীকালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হয়, একক রাষ্ট্রভাষা হয়নি। রাষ্ট্রের সব মানুষের মননের একমাত্র বাহন হয়নি। (পৃ ২৬)

লেখক অনুপম সেন এ-প্রবন্ধে ১৭৫৭ সালের পরাজয় থেকেই শুধু নয়, হাজার বছরব্যাপী বাঙালি জাতিসত্তার পরাধীনতার ইতিকথা উপস্থাপন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান নির্দেশ করেছেন। প্রবন্ধের পরিণামে জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ফলে বাঙালি স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যেমন নিজেদের জন্য একটি দেশ পেয়েছিল তেমনি সেই দেশের স্বীকৃত ভাষা হিসেবে বাংলা স্থান করে নিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সামগ্রিক মুক্তি অর্জিত হয়।

বাঙালি ও বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : বাঙালি চিরকাল তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখক মন্ময় ভঙ্গিতে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান গবেষক আবদুল করিমের কীর্তিগাথা নিয়ে স্মৃতিমূলক রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ রচনায় লেখক ভক্তের আসনে থেকে পন্ডিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তবে আলোচনায় তিনি সাহিত্যবিশারদকে আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করে বলতে চেয়েছেন, বাংলা ভাষাচর্চায় মুসলমানদের অবদানও যথেষ্ট। সেই অবদান মুসলমানদের থাকলেও তা উপেক্ষিত। কিন্তু সাহিত্যবিশারদের আবিষ্কারে প্রতীয়মান হয়েছেম বাঙালি মুসলমানরা কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত আবিষ্কার করার জন্য চিরদিন বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী তাঁর নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

লেখক অনুপম সেন সামগ্রিকভাবে আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ গ্রন্থে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতির আত্মবিস্মৃত অবস্থার পরিবর্তন কামনা করেছেন। ত্রুটি-বিচ্যুতি, তথ্য-উপাত্তের অভাব থাকলেও গ্রন্থটি যাঁরা নিজেদের বাঙালি হিসেবে দাবি করেন, তাঁদের পাঠ করা উচিত। পরিশেষে পাঠকমহলে গ্রন্থটি সমাদৃত হওয়ার প্রত্যাশা করছি।