বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ২০২২

২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রান্সের প্যারিস সাচ্লে এবং ইকল্ পলিটেকনিকের অধ্যাপক আঁলা আসপেক্ট (Alain Aspect), যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ ক্লোজার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের গবেষj জন এফ ক্লোজার (John F. Clauser) এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থন সাইলিংগার (Anton Zeilinger) । রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাদের প্রেস রিলিজে উল্লেখ করে যে, for experiments with entangled photons, establishing the violation of Bell inequalities and pioneering quantum information science- -এর ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার এই তিন বিজ্ঞানী সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। উল্লেখ্য, আসপেক্ট ফ্রান্সের এজিন, ক্লোজার যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসাডেনা এবং সাইলিংগার অস্ট্রিয়ার রিড ইম ইনক্রাইস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

২০২২ সালে রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যারোলিন আর বেরতোজি (Carolyn R. Bertozzi), ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মরটেন মেলডল (Morten Meldal) এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপ রিসার্চের অধ্যাপক কে ব্যারি সার্পলেস (K. Barry Sharpless)। রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাদের প্রেস রিলিজে উল্লেখ করে যে, Ôfor the development of click chemistry and bioorthogonal chemistry’-র জন্য ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার এই তিন বিজ্ঞানী সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। উল্লেখ্য, বারতোজি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন, মেলডল ডেনমার্কের  কোপেনহেগেন এবং সার্পলেস যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

২০২২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবৃত্তে নোবেল পুরস্কার পান জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর ইভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজির গবেষক সান্তে পেবো (Srante Paabo)। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেমব্লি তাদের প্রেস রিলিজে উল্লেখ করে যে, Ôfor his discoveries concerning the genomes of extinct hominins and human evolutionÕ-এর জন্য সান্তে পেবোকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, সান্তে পেবো সুইডেনের স্টকহোম শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

পদার্থবিজ্ঞান

এ-বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার-স্বীকৃত গবেষণা সম্পর্কে জানতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কয়েকটি ধারণার ওপর প্রথমে আলোকপাত করা যাক। এ-ধারণাগুলো হলো – কোয়ান্টাম উপরিপাতন (superposition), কোয়ান্টাম অ-স্থানিকতা (non-locality), বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থা (entanglement) এবং বেল-এর অসমতা (Bell inequality)।

দুটি ঢেউয়ের উপরিপাতন বলতে  বোঝায়, একটি ঢেউ অপর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন ঢেউ সৃষ্টি হওয়া, যেমন পুকুরের পানিতে দুটি পাথর ফেললে দুটি ঢেউয়ের যে-অবস্থা হয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো কোনো কণাকে দেখা এবং পরিমাপ করার পূর্ব পর্যন্ত ওই কণা সম্ভাব্য সকল স্থান এবং অবস্থায় যুগ্মভাবে অবস্থান করতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় কোয়ান্টাম উপরিপাতন।

বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থা এবং কোয়ান্টাম অ-স্থানিকতা – এ দুটি নিয়ম একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী, যদি দুটি কণা কোনো পদার্থ থেকে নির্গত হয়, তাহলে ভরবেগের নিত্যতার সূত্র অনুযায়ী একটি কণার ভরবেগ অপর কণার ভরবেগের সমান এবং বিপরীত হবে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen interpretation) অনুযায়ী দুটি কণার কোনোটিই কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের পরিমাপ করা যায়। তবে একটি কণার ভরবেগ থেকে নির্ধারণ করা যাবে অপর কণার ভরবেগ। এখানে দুটি কণার মধ্যে দূরত্ব কোনো বাধা নয়। সৃষ্টি হচ্ছে অ-স্থানিকতা, যাকে আইনস্টাইন বলেছেন ÔSpoony action at a distanceÕ। দুটি কণার এই অবস্থাকে বলা হয় বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থা। উল্লেখ্য, ১৯৩৫ সালে আরভিন স্রোয়েডিংগার তাঁর প্রবন্ধ – (By the interaction the two representatives (or Ψ-functions) have become entangled.)-এ বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থার কথা প্রথম উল্লেখ করেন এইভাবে (By the interaction the two representatives (or Ψ-functions) have become entangled.)।

১৯৬৪ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের পদার্থবিদ জন স্টুয়ার্ট বেল একটি পরীক্ষার প্রস্তাব করেন, যা দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থায় একটি কণা অপর কণার সঙ্গে আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে যোগাযোগ করে কি না। বেল ধারণা করেন যে, একজোড়া ইলেকট্রনের একটির ঘূর্ণন (spin) যদি উপর দিকে হয় এবং অপর ইলেকট্রনের ঘূর্ণন যদি নিচের দিকে হয়, তাহলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী দুটি ইলেকট্রনকে পরিমাপ করার পূর্ব পর্যন্ত সেগুলি উপরিপাতন অবস্থায় থাকে অর্থাৎ যে-কোনো একটি ইলেকট্রনের ঘূর্ণন উপর দিকে অথবা নিচের দিকে থাকবে। কিন্তু একটি ইলেকট্রনকে পরিমাপ করার সঙ্গে সঙ্গে বলা

হবে অপর ইলেকট্রনের ঘূর্ণন কোন দিকে। বেল এ-বিষয়ে  একটি সূত্র বের করেন, যাকে বলা হয় বেল-এর অসমতা। এই সূত্র অনুসারে বলা যায়, যদি বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থায় দুটি কণা না থাকে, তাহলে একটি কণার সঙ্গে অপর কণার ঘূর্ণনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সম্ভাব্যতা কতটুকু। গাণিতিকভাবে

বেল-এর পরিসংখ্যানগত বিন্যাস প্রমাণ করে যে, বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থায় বিদ্যমান দুটি কণার মধ্যে যুগপৎ সম্পর্ক রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বেল-এর অসমতা লঙ্ঘিত হওয়া মানে হচ্ছে দুটি কণার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের মান অধিক শক্তিশালী, অর্থাৎ তারা বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থায় অবস্থান করছে। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন প্রশ্ন তোলেন যে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কীভাবে দুই বা তার অধিক কণা দূরবর্তী অবস্থানে

থাকলেও বিজড়িত অবস্থায় থাকে। আইনস্টাইন মনে করেন, এই বিজড়িত অবস্থায় বিদ্যমান কণার মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক, তাতে কোনো গুপ্তচলক (hidden veriable) রয়েছে, যে চলক পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করে। একে পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন-পডলস্কি-রোজেন প্যারাডক্স (EPR Paradox) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বেল-এর তত্ত্বকে বিশিষ্ট পদার্থবিদ ফ্রিজফ কাপরা (Fritzof Capra) সমর্থন করেন এবং বলেন যে, বেল-এর গাণিতিক তত্ত্ব প্রমাণ করে, এই মহাবিশ^ Ôfundamentally interconnectedÕ। 

 জন বেলের গাণিতিক ধারণাকে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণের জন্য জন ক্লোজার একটি ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তাব করেন। ১৯৭২ সালে ক্লোজার ও তাঁর ছাত্র একটি যন্ত্র তৈরি করেন এবং তাতে ব্যবহার করেন ক্যালসিয়ামের পরমাণু (চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই পরমাণুকে বিশেষ আলোয় প্রজ¦লিত করে এ থেকে বিজড়িত ফোটন কণা নিঃসরণ করেন। অতঃপর অনেকগুলি পরিমাপ সম্পন্ন করে ক্লোজার দেখান যে, তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বেল-এর অসমতাকে লঙ্ঘন করে। ক্লোজারের পরীক্ষায় কিছু সমস্যা লক্ষ করা যায়। যেমন পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বিন্যাস পরীক্ষালব্ধ ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। বাস্তবে যদি তাই হয়, তাহলে আইনস্টাইন-প্রস্তাবিত গুপ্তচালকের প্রভাব থেকে যায়। সে-সময় ফ্রান্সে কর্মরত পিএইচ.ডি গবেষক আঁলা আসপেক্ট ক্লোজার কর্তৃক ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির নতুন বিন্যাস প্রস্তাব করেন (চিত্র দ্রষ্টব্য)। আসপেক্ট নতুন উপায়ে পরমাণুকে উত্তেজিত করে এটি থেকে অধিক পরিমাণে বিজড়িত ফোটন কণা নিঃসরণ করেন। আসপেক্ট তাঁর পরীক্ষার বিন্যাস নানাভাবে পরিবর্তন করে দেখেন, এই বিন্যাস পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে কি না। আসপেক্টের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রমাণ করে যে, Ôaction at a distanceÕ বাস্তবসম্মত এবং কোয়ান্টাম ধর্ম স্থানিক নিয়ম মেনে চলে না, বরং এই ধর্ম অস্থানিকতাকে সমর্থন করে। সাইলিংগার নব্বইয়ের দশকে আরো উন্নতমানের পরীক্ষার বিন্যাস ব্যবহার করেন। সাইলিংগারের গবেষক দল একটি বিশেষ কেলাসের ওপর লেজাররশ্মি ব্যবহার করে বিজড়িত ফোটন তৈরি করেন (চিত্র দ্রষ্টব্য)। তারপর পরীক্ষার বিন্যাসকে নানাভাবে পরিবর্তন করেন সম্ভাবনাশ্রয়ী সংখ্যা (Random number) ব্যবহার করে। সাইলিংগারের কাজ থেকে আমরা কোয়ান্টাম দূরবাহন (Teleportation)-এর ধারণা পাই। সাইলিংগার দেখান যে, যদি বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থায় দুটি কণা বিপরীত দিকে ধাবিত হয় এবং তার মধ্যে একটি কণা তৃতীয় আরেকটি কণার সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে এই শেষোক্ত দুটি কণার মধ্যে বিজড়িত অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় তৃতীয় কণা তার নিজস্ব সত্তাকে হারায়; কিন্তু তার মধ্যে তথ্য সরবরাহ হয়। এই পদ্ধতি অনুযায়ী একটি স্থান বা পদ্ধতি থেকে আরেকটি স্থান বা পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম তথ্যের আদান-প্রদান সম্ভব হয়েছে।

ক্লোজার, আসপেক্ট এবং সাইলিংগারের গবেষণালব্ধ ফলাফল বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম তথ্য সংরক্ষণ এবং  কোয়ান্টাম তথ্যগুপ্তকরণ (encryption)-এর কাজে ব্যবহারের প্রাথমিক ধারা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মহাশূূন্যে কোয়ান্টাম তথ্যের আদান-প্রদান সম্ভব হয়েছে। আমরা প্রথম কোয়ান্টাম বিপ্লব থেকে ট্রানজিস্টর এবং লেজার রশ্মি পেয়েছি। বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থার আবিষ্কারকে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি বিপ্লবের পরবর্তী ধাপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

রসায়নবিজ্ঞান

আমরা জানি, একটি অণু অপর অণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে নতুন যৌগিক পদার্থের অণু তৈরি করতে পারে। কিন্তু কোনো জটিল যৌগিক পদার্থের অণু তৈরি করতে হলে অনেকগুলি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই বিভিন্ন ধাপের বিক্রিয়ায় নানা ধরনের উপজাত (byproduct) তৈরি হয়। এই উপজাতকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে না সরালে মূল উপাদানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। সার্পলেস এবং মেলডল এই সমস্যার সমাধানকল্পে ‘ক্লিক রসায়ন’ নামে এক নতুন ধারণা উপস্থাপন করেন। এখানে ‘ক্লিক’ শব্দকে দুটি অণুর ‘পরস্পর মানিয়ে চলা’ অর্থে ব্যবহার করা হয়। ক্লিক বিক্রিয়া রসায়নবিজ্ঞানে ক্রিয়ামূলক বিক্রিয়ার একটি পদ্ধতি।

সার্পলেস, যিনি এ-বছর দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পেলেন, তিনি লক্ষ করেন যে, রসায়নবিজ্ঞানে কার্বন পরমাণুর মধ্যে বন্ধন সর্বত্র দেখা যায়। বিশেষ করে সমস্ত জৈব অণুর মধ্যে এই বন্ধন বিদ্যমান। লক্ষ করা যায়, শিল্পক্ষেত্রে একটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে অপর কার্বন পরমাণুর বন্ধন সৃষ্টি করতে প্রয়োজন হয় সক্রিয়ন (Activiton) শক্তি। কিন্তু এই সক্রিয়ন অবস্থা থেকে উপজাত তৈরি হয়। সার্পলেস লক্ষ করেন, যদি নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন পরমাণুর বন্ধনকে জৈব অণুর মধ্যে স্থাপিত করা হয়, তাহলে শিল্পক্ষেত্রে উপজাত তৈরির সমস্যাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। ২০০১ সালে সার্পলেস একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে সার্পলেস ক্লিক বিক্রিয়ার নানা পদ্ধতির উল্লেখ করেন। তার মধ্যে অন্যতম পদ্ধতি হলো, যে-কোনো বিক্রিয়া অক্সিজেন এবং পানির উপস্থিতিতে হতে হবে, কারণ এ-ধরনের দ্রবণ পরিবেশবান্ধব।

এদিকে ডেনমার্কে মেলডল ওষুধ প্রস্তুতকারী দ্রব্য নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। তাঁদের একটি গবেষণার বিষয় ছিল অ্যালকাইন এবং এমাইল হ্যালাইডের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো। এই বিক্রিয়ায় কপার বা প্যালেডিয়াম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মেলডল যখন বিক্রিয়ার পাত্রে কী উৎপাদন হলো তা বিশ্লেষণ করেন, তখন তিনি লক্ষ করেন যে, অ্যালকাইন এজাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ট্রাইজল (Triazole) তৈরি হয়েছে (এই বিক্রিয়া চিত্র : ৪ দ্রষ্টব্য)। মেলডল এ থেকে ধারণা করেন যে, কপার আয়ন বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। মেলডল এবং সার্পলেস সম্পূর্ণ পৃথকভাবে বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ করে কপার প্রভাবিত বিক্রিয়ার গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। উভয়েই সম্মত হন যে, এটি একটি আদর্শ ক্লিক বিনিময়। কারণ, এখানে একটি অণু আরেকটি অণুকে কপার আয়নের উপস্থিতিতে ‘লুফে নেয়’(Snap)। তাঁদের গবেষণা থেকে পাওয়া গেল যে, যদি রসায়নবিদরা দুটি হাফ অণুকে সংযুক্ত করতে চান, তাহলে একটি অণুতে এজাইড (Azide) এবং অপর অণুতে অ্যালকাইন (Alkyne) স্থাপন করলে কণার আয়নের উপস্থিতিতে মূল দুটি  অণু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হবে। বর্তমানে ক্লিক বিক্রিয়ার ধারণা ব্যবহার করে নতুন নতুন পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

নব্বইয়ের দশকে বারতোজি জীবরসায়ন এবং অণুুজীববিদ্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেন, বিভিন্ন জিন এবং প্রোটিন নিয়ে কাজ হলেও গ্লাইকেনস (Glycans) এবং এই শ্রেণিভুক্ত রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এই শ্রেণির জটিল কার্বোহাইড্রেট অনাক্রম্য কোষে কীভাবে কাজ করে, তা তখন বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। বারতোজি ধারণা করেন যে, তিনি ক্লিক বিক্রিয়ার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে জীবকোষের অভ্যন্তরে গ্লাইকেনস কীভাবে কাজ করে তা জানতে পারবেন। কিন্তু ক্লিক বিক্রিয়ায় যে কপার আয়ন ব্যবহার করা হয় তা জীবকোষের জন্য উপযোগী নয়। কারণ কপার জীবকোষের জন্য বিষাক্ত। এক্ষেত্রে বারতোজি বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান যে, যদি অ্যালকাইনকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো বৃত্তাকার রাসায়নিক গঠনের মধ্যে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে তা থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হবে তা দ্বারা বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব। ২০০৪ সালে বারতোজি এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং তাঁর পদ্ধতিকে বলা হয় ‘A Strain-Promoted [3+2] Azide−Alkyne CycloadditionÕ (চিত্র : ৫ দ্রষ্টব্য)। বারকোজি দেখান যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে জীবকোষের অভ্যন্তরে গ্লাইকেনস কীভাবে কাজ করে তা জানা এবং এই অণুকে অনুসরণ করে তার ক্রিয়াকলাপের একটি মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব। এই অনুসরণের কাজে বারতোজি ব্যবহার করেন প্রতিপ্রভা সৃষ্টিকারী অণু। বারতোজির এই বিক্রিয়াকে বলা যায় জীব অভিলাম্বিক বিক্রিয়া (Bio-orthogonal)। ক্লিক বিক্রিয়া এবং জীব অভিলাম্বিক বিক্রিয়া রসায়নবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এই পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে নতুন নতুন পদ্ধতি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন ওষুধের দ্রব্য, যেমন ক্যান্সার প্রতিরোধকারী ওষুধ এবং শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃহৎ অণু তৈরির ক্ষেত্রে এই দুই বিক্রিয়ার পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবৃত্ত

বর্তমানে যে-মানবগোষ্ঠী পৃথিবীতে আছে তাদের নৃতাত্ত্বিক নাম প্রত্নমানুষ (Homosapien)। এই প্রত্নমানুষ এলো কোথা থেকে? প্রত্নমানুষ এবং অন্যান্য মানবসদৃশ প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সান্তে পেবোর গবেষণার বিষয় হলো এই প্রশ্নসমূহের উত্তর খুঁজে বের করা।

এক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রত্নমানুষ প্রায় তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকায় প্রথম দেখা যায়। অন্যদিকে  নিয়ানডারথাল মানুষ চার লাখ বছর থেকে ত্রিশ হাজার বছর পর্যন্ত ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় শনাক্ত করা হয়। তারপর তাদের বিলুপ্তি ঘটে। প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে প্রত্নমানুষ আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পরিযায়ী (migrated) হয়। এই অবস্থায় ইউরেশিয়া অঞ্চলে হাজার বছর ধরে প্রত্নমানুষ ও নিয়ানডারথাল মানুষের সহাবস্থান ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান আধুনিক প্রত্নমানুষের সঙ্গে বিলুপ্ত নিয়ানডারথাল মানুষের জিনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য প্রয়োজন বিলুপ্ত নিয়ানডারথালদের নমুনা সংগ্রহ করে তাদের ডিএনএ’র অনুক্রম বিশ্লেষণ করা। সান্তে পেবো আধুনিক জিনপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিএনএ’র অনুক্রম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ডিএনএ’র অবক্ষয় এবং ডিএনএ দূষিত হয়েছে। পেবো লক্ষ করেন, একটি কোষের দুটি অংশে ডিএনএ থাকে। কোষের একটি অংশে রয়েছে নিউক্লিয়ার ডিএনএ এবং অপর অংশে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ (Mitochondrial)। মাইটোকনড্রিয়াল অংশে রয়েছে ষোলো হাজার পাঁচশো জিনোম, কিন্তু নিউক্লিয়ার অংশে রয়েছে তিনশো কোটি জিনোম। সুতরাং মাইটোকনড্রিয়ায় ডিএনএ’র তুলনায় নিউক্লিয়ার ডিএনএতে জিনেটিক তথ্য বেশি সংরক্ষিত।

১৯৯০ সালে মিউনিখ বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণা করার সময় পেবো উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রায় চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো অস্থি থেকে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করেন। এই বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, বর্তমান প্রত্নমানুষের ডিএনএ’র সঙ্গে নিয়ানডারথালদের ডিএনএ’র পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ’র পরিমাণ কম, সেহেতু তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণও কম। তাই পেবো নিউক্লিয়ার ডিএনএ’র অনুক্রম বিশ্লেষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

পেবো প্রথমে জার্মানির নিয়ানডারথাল উপত্যকা থেকে প্রাপ্ত বিলুপ্ত প্রজাতির ডিএনএ’র অনুক্রম বিশ্লেষণ করেন। তারপর দক্ষিণ সাইবেরিয়ার ডেনিসভা  (Denisova) অঞ্চলের  একটি গুহা (cave) থেকে প্রাপ্ত অস্থির ডিএনএ অণুক্রম বিশ্লেষণ করেন। ডিএনএ অনুক্রমের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে পেবো দেখান যে, ডেনিসভার ডিএনএ’র অনুক্রম অন্য নিয়ানডারথালদের অণুক্রম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং এই বিশ্লেষণ থেকে জানা গেল যে, মানব বিবর্তনের ইতিহাসে প্রত্নমানুষ ও নিয়ানডারথালের সঙ্গে আরো একটি জনগোষ্ঠী ছিল, যাদের বলা হলো ডেনিসভা। লক্ষ করা যায় যে, বর্তমান প্রত্নমানুষের মধ্যে ডেনিসভার ডিএনএ রয়েছে। অর্থাৎ প্রত্নমানুষের সঙ্গে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসভার জিনের সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্নবিদ্যা এবং জীবাশ্মবিদ্যা এ-আবিষ্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পেবো পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, ডেনিসভা এবং নিয়ানডারথাল মানুষের জিনের সঙ্গে প্রত্নমানুষের জিনের মিশ্রণ ঘটেছে।

পেবোর আবিষ্কার থেকে একটি বিষয় জানা যায় যে, কীভাবে কালের বিবর্তনে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ী হয়েছিল (চিত্র ৬ দ্রষ্টব্য)। যেমন প্রত্নমানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়া অঞ্চলে পরিযায়ী হওয়ার আগে থেকেই ওই অঞ্চলে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসভা মানুষ বসবাস করত।

মানুষের মধ্যে অনাক্রম্যতা এবং সহনশীলতার পার্থক্যের কারণ পেবোর গবেষণা থেকে জানা যায়। যেমন বর্তমানে তিব্বতের অধিবাসীরা অত্যন্ত উচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করতে পারে, কারণ তাদের মধ্যে ডেনিসভার জিন রয়েছে। তাছাড়া নিয়ানডারথালদের জিনের পার্থক্যের কারণে প্রত্নমানুষের মধ্যে  অনাক্রম্যতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

উপসংহার

এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার-স্বীকৃত গবেষণা কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম তথ্য সংরক্ষণ এবং মহাশূন্য গবেষণার কাজে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে। আসপেক্ট, ক্লোজার এবং সাইলিংগার কর্তৃক বিজড়িত কোয়ান্টাম অবস্থার আবিষ্কার আগামী দিনে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান রাখবে বলে ধারণা করা যায়। রসায়নবিজ্ঞানে সার্পলেস, মেলডল এবং বারকোজির আবিষ্কার ক্রিয়ামূলক রসায়নের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তাঁদের আবিষ্কার নতুন নতুন পদার্থ তৈরি এবং ঔষধশিল্পে ইতোমধ্যে বৃহৎ অণু তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। এ-বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার-স্বীকৃত সান্তে পেবোর গবেষণা মানুষের বিবর্তনের নতুন ইতিহাস উন্মোচন করেছে। পেবোর গবেষণা থেকে জানা গেল, আধুনিক প্রত্নমানুষের সঙ্গে নিয়ানডারথাল এবং ডেনিসভার জিনের সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক থেকে মানুষের শারীরবৃত্ত সম্পর্কেও নতুন তথ্য জানা গেল। এই নোবেল পুরস্কার-স্বীকৃত গবেষণা আগামীদিনে আরো নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

সহায়ক তথ্যপঞ্জি ও চিত্রঋণ

পদার্থবিজ্ঞান

১.        The Royal SwedishAcademy of Sciences — Press Relese. The Nobel Prize in Physics 2022 (dated 4 Oct 2022).

 ২.      The Royal Swedish Academy of Science, ‘for experiments with entangled photons, establishing the violation of Bell inequalities and pioneering quantum information science’, The Nobel Committee of Physics, Stockholm.

৩.       E. Schrödinger. Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Vol. 31, p 555 (1935).

চিত্রঋণ

চিত্র ১-৩ Johan Jarnestad (The Royal  

Swedish Academy of Sciences.)

চিত্র : আঁলা আসপেক্ট : Balzan. org

জন ক্লোজার এবং সাইলিংগার : উইকিপিডিয়া

রসায়নবিজ্ঞান

১.        The Royal Swedish Academy of Sciences — Press Relese. The Nobel Prize in Chemistry 2022 (dated  5 October 2022).

২.       The Nobel Committee for Chemistry,  Click  Chemistry and Bio-orthogonal Chemistry; Scientific Background, Sweden.

চিত্রঋণ

চিত্র ৪ : Johan Jarnestad (The Royal Swedish  
               Academy of Science.)

চিত্র :

বারতোজি : স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়

মেলডল : কোপেনহেগেন বিশ^বিদ্যালয়

সার্পলেস : রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি

চিত্র ৫ : Procional Nat. Academy Sci, USA (2007)

চিকিৎসাবিজ্ঞান

১.    The Nobel Assembly at the Karolinska Institutet Press Release 2022, Nobel Prize in Physiology or Medicine. (3 October 2022).

২.       G. Karlsson Hedestam and A. Wedell, Scientific Background : ‘for his discoveries concerning the genomes of extinct hominins and human evolution.’

         The Nobel Assembly at Karolinska Institutet, Sweden.

চিত্রঋণ

চিত্র ৬ : The Nobel Assembly at Karolinska Institutet.

চিত্র : সান্তে পেবো : উইকিপিডিয়া