বিদীর্ণ দর্পণ

ঢাকা টু লন্ডনের ফ্লাইটগুলি সব সময়ই যাত্রীবোঝাই থাকে। আজ পর্যন্ত যতবার এই ফ্লাইটে উঠেছি, ততবারই সেই একই চিত্র – ফ্লাইট কানায় কানায় পূর্ণ। তাই আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম ফ্লাইট ছাড়ার আগমুহূর্তেও আমার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে। সম্ভবত সারা ফ্লাইটে এই একটি সিটই এখন পর্যন্ত বেদখল আছে। কেবিন ক্রুরা ব্যস্ত হয়ে সবকিছু দেখে নিচ্ছে ঠিক আছে কি না। কাউকে সিট বেল্ট শক্ত করে বেঁধে নিতে বলছে তো কাউকে বলছে হাতব্যাগটা সামনের সিটের নিচে চালান করে দিতে। এক যাত্রী তার সিটটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসে ছিল। একজন ক্রু নিজেই সেই সিটটা হেলানো অবস্থা থেকে আপ-রাইট করে দিলো। এমন সময় একটা অ্যানাউন্সমেন্ট হলো। জানালো, একজন যাত্রী এখনো প্লেনে ওঠেননি, তিনি উঠলেই ফ্লাইট অল্প সময়ের মধ্যেই ছেড়ে যাবে।

আমি সামনের সিটের পকেট থেকে ফ্লাইট ম্যাগাজিনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। এমন সময় দেখি আমার পাশের সিটে একজন ভদ্রমহিলা এসে বসলেন। মনে হলো তিনিই সেই যাত্রী যার কথা একটু আগে বলা হয়েছিল। সিটে বসার পরও তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে বেশ তড়িঘড়ি করে বিমানে উঠেছেন তিনি। হওয়ারই কথা। শেষ মুহূর্তে বোর্ডিং করার যে কি টেনশন সে অভিজ্ঞতা আমারও এর আগে দু-একবার হয়েছে। একবার তো আমি ডাবলিন থেকে ফ্লাইট মিসও করে ফেলেছিলাম।

সিটে বসার পর ভদ্রমহিলা পাশ ফিরে আমার দিকে তাকালেন। আমিও তার দিকে তাকিয়ে ভদ্রতা করে একটু হাসলাম। জবাবে তিনিও একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘দৌড়ে দৌড়ে প্লেনে উঠতে হয়েছে। ট্রাফিকে আটকে পড়েছিলাম।’ এমনভাবে তিনি কথাগুলো বললেন যেন কেউ তার কাছে কৈফিয়ত চেয়েছে দেরি করে প্লেনে ওঠার জন্য।

প্লেন ছেড়ে দিয়েছে। টেক-অফ করার সামান্য একটু পর পাশ ফিরে দেখি ভদ্রমহিলা চোখ বুঁজে আছেন। সম্ভবত তিনি ভয় পাচ্ছেন। আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো এই প্রথম প্লেনে উঠেছেন অথবা খুব বেশি একটা আকাশভ্রমণ করেন না। যাঁরা প্রথম প্রথম প্লেনে ভ্রমণ করেন তাঁদের অনেকের মধ্যেই একটা ভয় কাজ করে। তবে বহুবার প্লেনে উঠেছেন এমন মানুষকেও দেখেছি সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। ইংরেজিতে এটাকে বলে অ্যারোফোবিয়া। এই ভদ্রমহিলাও হয়তো অ্যারোফোবিয়ায় আক্রান্ত।

সকালের ফ্লাইট হওয়াতে ভোররাতে উঠে বাসা থেকে রওনা দিতে হয়েছে। তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্লেনে উঠলে আবার আমার খুব ঘুম পায়। রাতের ফ্লাইট হলে তো আমি এক ঘুমে সারা পথ পাড়ি দিতে পারি। চোখ খুলে দেখি ভদ্রমহিলা একটা বই পড়ছেন। চোখে গোল্ডেন রিমের চশমা। ভালো করে তার মুখের দিকে তাকালাম। বয়স প্রায় আমার সমানই হবে বলে মনে হচ্ছে। লম্বা চুল খোঁপা করে বাঁধা। গায়ের রং ফর্সা, চেহারায় একটা অসম্ভব মাধুর্য আছে। দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না অল্প বয়সে তিনি কতটা রূপবতী ছিলেন। পরনের হালকা রঙের শাড়ির সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্য ও মাধুর্য খুব ভালোভাবে মানিয়ে গেছে।

আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি এটা বোধহয় তিনি টের পেয়েছেন। বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু করে হাসলেন। আমি বললাম, ‘এই যে দেখেন, একই সঙ্গে পাশাপাশি যাচ্ছি, অথচ পরিচয়টাই হলো না। আমার নাম লায়লা।’

উনি বললেন, ‘আমার নাম শামিমা।’

‘আপনি কি লন্ডনে থাকেন, না বেড়াতে যাচ্ছেন?’

‘না, লন্ডনে থাকি না। ছেলের কাছে যাচ্ছি। আপনি?’

‘আমি লন্ডনেই থাকি। বাবা-মাকে দেখতে এসেছিলাম দু-সপ্তাহের জন্য। আজ ফিরে যাচ্ছি।’

‘ও, আচ্ছা।’

কিছুক্ষণ আমাদের কথাবার্তা চলার পর মনে হলো আমাদের দুজনের মধ্যে অনেকটাই সখ্য হয়ে গেল। দেখা যায়, কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে খুব অল্প সময়েই কারো মিলে যায়, আর কারো কারো সঙ্গে হয়তো প্রতিনিয়ত দেখা হয়, কথা হয়, কিন্তু কোনো দিনই সেভাবে মেলে না। এর মধ্যেই কিভাবে যে তিন-চার ঘণ্টা কেটে গেল টেরই পেলাম না। কত কিছু নিয়ে যে কথা হলো, দেশ নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে, গান নিয়ে, বই নিয়ে, লন্ডনের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া নিয়ে, ঢাকার গরম আর ট্রাফিক নিয়ে, আরো কত কি। শামিমাকে আমার এতটাই ভালো লেগে গেল যে তাঁকে আমার লন্ডনের বাসার ঠিকানা দিয়ে বললাম, ‘আমার বাসায় আসবেন, অবশ্যই আসবেন।’

‘আচ্ছা, চেষ্টা করবো।’

‘না, না, চেষ্টা করলে হবে না। অবশ্যই আসতে হবে। দরকার হলে আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো। আচ্ছা, লন্ডনে উঠছেন

কোথায়? ছেলের বাসায়?’

‘না, আমার ছেলের নিজের বাসা নেই। ও মাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। একটা এক রুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। ওখানেই থাকবো।’

‘ও আচ্ছা। তা তো ভালোই। কত দিন থাকবেন?’

‘বেশি দিন থাকার ইচ্ছা নেই। ছেলে বলেছে কমপক্ষে তিন মাস থাকতে। কিন্তু মনে হয় না এক মাসের বেশি থাকবো। এক মাসের বেশি ছুটি নিতে পারিনি কলেজ থেকে। আর এখানে কাজ তো তেমন নেই। রায়ানের কনভোকেশন দেখতেই তো আসা। ওটা হয়ে গেলে আর কাজ কী।’

‘আপনার ছেলের নাম বুঝি রায়ান?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার ছেলেমেয়ে কয়টি?’

‘ওই একটিই, আপনার?’

‘আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। আমার ছেলেটাও দুই বছর হলো ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। আর মেয়েটা এবার গ্রেড ইলেভেন এ।’

‘বাহ, বেশ চমৎকার।’

‘ও আচ্ছা, আপনাকে তো

জিজ্ঞেস করাই হয়নি, এয়ারপোর্টে কে আপনাকে রিসিভ করতে আসবে?’

‘রায়ান আসবে। ও না এলে তো আমার মনে হয় আমি ওর বাসাই খুঁজে বের করতে পারবো না। লন্ডন এত বড় শহর, আর আমি তো এই প্রথম যাচ্ছি।’ বলেই হেসে দিলেন শামিমা।

‘এক কাজ করতে পারেন। আপনার ছেলে যদি ড্রাইভ না করে, আমিও আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।’

‘আপনাকে নিতে কেউ আসবে?’

‘আসবে না মানে? আমি যতবারই আসি, আমার হাজবেন্ডের অবশ্যই আসা চাই চাই। আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে না এলে আমি ওর জান ভাজা ভাজা করে ফেলবো না। আচ্ছা, আপনার হাজবেন্ড আসেননি কেন ছেলের কনভোকেশনে?’ প্রশ্নটা করতেই শামিমার মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। মাথাটা একটু নিচু করে চুপ করে রইলেন। আমার মনে হলো, প্রশ্নটা করে আমি ভালো করিনি। এটা হয়তো তাঁর জন্য খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে গেছে।

এরপর মিনিট দশেক আর কোনো কথা হলো না। এর মধ্যে কেবিন ক্রুরা খাবার দিয়ে গেছে। দেখি শামিমা খাবার না খেয়ে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু মুখে তুলছে। তাঁকে দেখে আমি নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম। কী কারণে যে এমন একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে গেলাম আমি।        

কেবিন ক্রুরা খাবার ট্রে নিয়ে গেল। আমি দুঃখিত হয়ে বললাম, ‘আমি খুব সরি।’

‘আপনি কেন সরি হতে যাবেন। সরি বলার মতো কিছু তো বলেননি আপনি।’

আমি জানি শামিমা এটা ভদ্রতা করেই বলছেন। আমাদের সমাজে ও পরিবারে কত মানুষেরই তো স্পর্শকাতর কত কিছু আছে। তারা হয়তো চায় না তাদের মনের ওই স্পর্শকাতরতা নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করুক। তারা চায় না, কেউ তাদের ওই দগদগে ঘায়ে খোঁচা দিয়ে সেটাকে আরো বীভৎস ক্ষতে পরিণত করুক। কিংবা তারা হয়তো ওসব কষ্ট ভুলে থাকতে চায়। আমার মতো কেউ যখন ভুল করে বা জেনে সেই কষ্টটাকে জাগিয়ে দেয়, তখন তারা নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলে।

শামিমা মাথা নিচু করে রইলেন। দেখলাম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের এক কোনা মুছলেন। তিনি কি কাঁদছেন? মুখটা আমার দিকে থেকে একটু বাঁ-দিকে ফিরে থাকাতে ঠিক দেখলাম না তিনি কাঁদছেন কি না। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলো না, অনেক কষ্টে তিনি কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছেন।

আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে চুপ হয়ে থাকলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। একসময় শামিমা বললেন, ‘আমার স্বামী নেই। কোনোদিন ছিলও না।’

বুঝতে পারলাম না শামিমা কি আমার সঙ্গে কথা বলছেন, না নিজের সঙ্গে। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন তিনি। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার স্বামী ছিল না কোনোদিন।’ লক্ষ করলাম তাঁর চোখে-মুখে বেদনার ছাপ অতিক্রম করে সেখানে একটা ঘৃণার আভাস জেগে উঠেছে। আমার মনে হচ্ছে, তিনি নিজের কথা বলে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করছেন।

আমি বললাম, ‘তাহলে আপনার ছেলে …। ’

‘হ্যাঁ, আমার ছেলে। ও আমারই ছেলে। আমার গর্ভেই ওর জন্ম।’ একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র ছাত্রের প্রেমে পড়লাম আমি। সেও এগিয়ে এলো। খুব ভালো ছাত্র ছিল সে। আমি মাস্টার্স পাশ করার পর ঠিক করলাম আমরা বিয়ে করবো। আমাদের দুজনের পরিবারেও আমাদের সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে গেল। বিয়েতে কারো কোনো আপত্তি ছিল না। এরই মাঝে ও হঠাৎ করে বলল বিদেশে একটা ইউনিভার্সিটিতে ওর স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এক মাসের মধ্যেই চলে যেতে হবে। তার কয়েকদিন পর আবিষ্কার করলাম, আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছি। ওকে বললাম, পারিবারিকভাবে না হলেও দুজনে মিলে বিয়ে করে ফেলি। তাতে বিয়েটাও হয়ে যাবে আর প্রেগন্যান্সির বিষয়টা নিয়েও কারো মধ্যে কোনো সন্দেহ জাগবে না; কিন্তু ও রাজি হলো না। হয়তো আমার প্রেগন্যান্সিটাকে ও সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছিল। তাছাড়া স্কলারশিপ পেয়ে হয়তো ওর মানসিকতাও বদলে গিয়েছিল। আমি জানতাম, ওর জীবনে ওপরে ওঠার উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল। হয়তো ও এখন আমাকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে বাধা হিসেবে দেখা শুরু করেছে। একদিন হঠাৎ করে ও সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো আমার সঙ্গে। তারপর লোকমুখে শুনলাম সে বিদেশে চলে গেছে।’ বোতল থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে আবার শুরু করলেন শামিমা, ‘কিছুদিনের মধ্যে বাড়ির সবাই জেনে গেল আমি প্রেগন্যান্ট। লোকলজ্জার ভয়ে মা আমাকে নিয়ে উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহরে চলে গেলেন। সেখানেই রায়ানের জন্ম হলো। আমি আর বহুদিন ঢাকায় আসিনি। এক কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানেই সতেরো-আঠারো বছর কাটিয়ে দিলাম। তারপর এলাম ঢাকায়, তাও ছেলের ভালো কলেজে পড়াশোনার জন্য। ইন্টারমিডিয়েটের পর রায়ান লন্ডনে পড়ালেখার সুযোগ পেল। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে ওকে এখানে পাঠিয়েছি। আর ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। এখন আর মনে কোনো দুখ নেই।’ আবারো শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোনাটা মুছলেন শামিমা।

শামিমার কথা শুনতে শুনতে মনটা ভারি হয়ে এলো আমার। মাথাটা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। মুখে সহানুভূতি দেখানোটা আমার কাছে মেকি বলে মনে হলো। আলতো করে তাঁর হাতের ওপর নিজের একটা হাত রাখলাম। আর কিই বা করতে পারি আমি। শুধু মনে হলো, ভালোবাসার নামে যে লোকটা শামিমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাকে সামনে পেলে কিছু কঠিন কথা বলে দিতাম। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সে কোথায় আছে এখন জানেন?’

শামিমা বললেন, ‘লন্ডনে পড়তে এসেছিল। লোকের কাছে শুনেছি এখনো লন্ডনেই আছে। বেশ নামডাক আছে।’

প্লেন ল্যান্ড করেছে। আমরা দুজনেই একসঙ্গে লাগেজ কালেক্ট করে অ্যারাইভালের দিকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমার স্বামী ফোন করলো। বলল, সে পার্কিংয়ে অপেক্ষা করছে। কতক্ষণ পড়ে আমাকে পিকআপ করতে হবে জিজ্ঞাসা করলো। বললাম, ‘দশ মিনিট পরে এসো।’ 

 শামিমা আমার পাশে পাশে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আমার ছেলে কীভাবে আমাকে খুঁজে পাবে। আমার তো ফোনে রোমিং নেই।’

বললাম, ‘কোনো অসুবিধা নেই। অ্যারাইভালেই ও ওয়েট করে আছে। একটু পরেই দেখতে পাবেন। আর বেশি ভিড়ের কারণে না দেখলে আমার ফোন থেকে ওকে কল করবো।’

অ্যারাইভালে যেখানে লোকজন অপেক্ষা করে তার কাছাকাছি যেতেই কে যেন ডাকল ‘মা’ বলে। শামিমা বলল, ‘রায়ানের গলা।’ বলেই তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে তাঁর ছেলেকে খুঁজতে লাগলেন। রেলিংয়ের ওপাশ থেকে একটা হাত ওপরে তুলে নাড়াতে লাগলো। শামিমাও হাত তুলে বললেন, ‘রায়ান, এই যে। আমি এখানে।’

ছেলেটা একরকম রেলিং টপকে জোর কদমে তার মায়ের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি একটু ভালো করে তার দিকে তাকাতেই আমার হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে যেতে লাগল। এই ছেলেকে আমি জীবনে এর আগে কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে সে আমার অনেক চেনা কেউ। কেন এমন মনে হচ্ছে, সেটা বুঝতে দশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগলো না। এই সেই চেহারা, হাঁটার ভঙ্গিও সেই একই রকম। এমনকি ছেলেটার শারীরিক উচ্চতাও ঠিক তার মতো। আজ থেকে তেইশ বছর আগে যে যুবকটির সঙ্গে আমার এই লন্ডনে বিয়ে হয়েছিল, সেই মুকিতকে এখন রায়ানের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলে দুজনকে একই মানুষ বলে মনে হবে।

‘আমি এখন আসি তাহলে, আবার দেখা হবে।’ বললেন শামিমা। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। ততক্ষণে আমি হাতব্যাগটা ফ্লোরে নামিয়ে রেখেছি। এই ছোট একটা ব্যাগকেও এখন আমার পাহাড়ের মতো ভারি মনে হচ্ছে। আমি কোনো এক ঘোরের মধ্যে আছি মনে হচ্ছে। সামনের সবকিছুকে আবছা ছায়ার মতো মনে হচ্ছে। শামিমা তাঁর ছেলেকে নিয়ে অ্যারাইভাল থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। আমি জোরে চিৎকার করে ডাকলাম, ‘শামিমা।’ আমার ডাক শুনে তিনি ফিরে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে ডেকেছেন?’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। তারপর তাকে সেই প্রশ্নটি করার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম। বললাম, ‘শামিমা, ওই লোকটা, মানে রায়ানের বাবার নাম কি মুকিত?’

আমার প্রশ্ন শুনে শামিমা কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, ‘কী হবে আর নাম জেনে। আসি।’

শামিমা হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। কিন্তু আমি তাঁর চোখ দেখে উত্তরটা জেনে নিয়েছি। সব প্রশ্নের সহজ-সরল উত্তরের প্রয়োজনটাই বা কি! আমি নিজেও হয়তো চাইনি দীর্ঘ তেইশ বছর যে ঝকঝকে দর্পণে নিজেকে দেখে অভ্যস্ত সেটা শামিমার ছোট একটা উত্তরের ঝড়ে বিদীর্ণ হয়ে যাক।