বিষ্ণু দে-র কবিতা ও একটি আত্ম-অন্বেষণ

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিশ শতকে যেসব বাঙালি কবি একটা নতুন দিগন্তের অন্বেষণে নিমগ্ন হয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলা কাব‍্যভুবনে প্রবেশ ঘটে কবি বিষ্ণু দে-র। তাঁর আত্মগত স্পর্ধিত উচ্চারণে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল এক নতুন ডাইমেনশন। রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য মনন এবং স্বীয় প্রতিভার রসায়নে গড়ে উঠল এক নতুন কাব্যশরীর।

১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলের এক বনেদি পরিবারে বিষ্ণু দে-র জন্ম। পিতা অবিনাশচন্দ্র দে এবং মাতা মনোহারিণী দে। তাঁদের পরিবারের সকলেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত‌। বিষ্ণু দে-র বড় ঠাকুরদা শ‍্যামাচরণ দে ছিলেন ইংরেজ সরকারের প্রথম গেজেটেড অফিসার। ডেভিড হেয়ার ও বিদ‍্যাসাগর বিষ্ণু দে-র পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

বিষ্ণু দে-র জন্মকাল বিশ্ব-ইতিহাসে এক ক্রান্তিকালের সময়। ১৯০৫ থেকে শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে মধ‍্যবিত্ত শ্রেণি চলে আসে লাইমলাইটের কেন্দ্রে। ১৯১২ সালে সে-প্রয়াস পূর্ণতা পায়। এরই মধ্যে

১৯১৪-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যার অভিঘাতে সমস্ত পৃথিবী পরিণত হয় এক ‘Wasteland’-এ। মানুষের অস্তিবাদী চেতনায় দেখা দিলো ফাটল। চারিদিকে তখন নিরাপত্তার সংকট। এই অগ্নিগর্ভ ও পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে বিষ্ণু দে ১৯৩২ সালে লিখলেন উর্বশী ও আর্টেমিস কাব্যগ্রন্থ। এই কাব‍্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পলায়ন’, যেখানে ফুটে উঠেছে বিষ্ণু দে-র স্বাতন্ত্র্য। প্রেমের কেলাসনে যেখানে দেহই হয়ে উঠল প্রধান। এখানে হৃদয়ের অনিবার্যতা অনুপস্থিত। রোমান্টিক গোলাপ পরিণত হলো সাদামাটা শেফালিতে। ফলে বোহেমিয়ানিজমের জয়টিকা পরে চলেছে সে অনবরত স্থানাঙ্ক বদলের উদ্দেশ্যে। ‘উদ্যাপন’ কবিতাতেও সেই শরীরী প্রেমের সুর। যদিও এখানে পাওয়া যায় হালকা মনের ছোঁয়া। পৃথিবীর যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে প্রেমকে আড়াল করে‌ কবি

বলেছেন –

পৃথিবীর জনতার গ্লান

      স্পর্শ তো করেনি আমাদের

(উর্বশী ও আর্টেমিস, পৃ ২০, তদেব) 

‘উর্বশী’ কবিতাতেও প্রেমের অন্তহীনতার নয়, বরং সাময়িক সংকীর্ণতার মধ্যেই জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত এখানে  রবীন্দ্রনাথের চিত্রা কাব্যের ‘উর্বশী’ কবিতাটি উল্লেখযোগ্য। এ-কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উর্বশীর যে বিশ্বব‍্যাপী রূপের চিরন্তনত্ব নির্মাণ করেছেন; সেই ইটারনাল অনুভব বিষ্ণু দে-র কবিতায় কিন্তু অনুপস্থিত। অবশ্য কাব্যগ্রন্থের শেষ পর্যায়ে এসে কবি তাঁর ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কবিতায় দিক পরিবর্তনের প্রয়োজন। অনুভব করেছিলেন, কবিতার শরীরে ও ভাষায় আত্তীকৃত করতে হবে কোনো একক মানুষের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবসত্তায়। তাই তিনি লিখলেন –

মানুষের অরণ্যের মাঝে আমি বিদেশী পথিক

মুখোমুখি কথা বলি – চোখে লাগে অটল প্রাচীর‌।

বিদেশী পথিক আমি এসেছি কি বিধাতার ভুলে

পৃথিবীর সভাগৃহে, বুঝি নাকো ভাষা যে এদের।

(উর্বশী ও আর্টেমিস, পৃ ৪২)

১৯৩৮-এ রচিত চোরাবালি কাব‍্যগ্রন্থের ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতাটি আধুনিক কবিতার এক উল্লেখযোগ্য দিকদর্শন। ১৯৩৫ সালে তিনি এই কবিতাটি লেখেন। কবি তখন অর্থাৎ ওই বছরের জানুয়ারি মাসের চার-পাঁচ তারিখে রিউম‍্যাটিক ফিভারে শয‍্যাগত। আগের রাতে তাঁর জ্বরের ঘোর কেটে গেছে। ভোরের দিকে আচ্ছন্ন অবস্থায় কবি কাগজ-কলম চাইলেন এবং এক ঝোঁকে কবিতাটির প্রথমার্ধ সম্পন্ন করেন। এরপর ঘুম থেকে উঠে বাকি অংশটি শেষ করেন। এই কবিতাটির রচনার ইতিহাসটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবির অবচেতন মনে এই কবিতাটি রচনার যে-পূর্বপ্রস্তুতি চলছিল, যা তাঁর চৈতন্যে এক ঝোঁকেই কবিতার অর্ধেক শরীরের প্রকাশ ঘটে এবং ‘ঘোড়সওয়ার’ কোলরিজের ‘কুবলাখানে’র মতোই‌ হয়ে ওঠে ড্রিম পোয়েমের সমগোত্রীয়। উর্বশী ও আর্টেমিস কাব্যগ্রন্থে কবির হৃদয় যে-বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছে, সেই নিঃসঙ্গ পথেই আগমন ঘটেছে ঘোড়সওয়ারের। কবির ক্লান্ত-রিক্ত চৈতন্যে এনেছে সে এক অন্য গতির স্রোত। বিপ্লবের মুক্তিমন্ত্র ও সংগ্রামের জয়ডঙ্কা যেন খণ্ডিত কবিকে অখণ্ড করে তুলেছে। তাই পূর্ববর্তী কবিতার ছন্দের গতি আর পরিলক্ষিত হয়নি। এখানেই ধরা পড়ে তাঁর মানসিকতার পালাবদল। তিনি লিখলেন –

জনসমুদ্রে জেগেছে জোয়ার

হৃদয়ে আমার চড়া।

চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি –

কোথায় ঘোড়সওয়ার?

(চোরাবালি, পৃ ৪৫, তদেব)

‘ওফেলিয়া’ কবিতাতেও কবির সেই অখণ্ড সত্তার আত্মপ্রকাশ। কবি এখানে তাঁর প্রেমিকাকে আর ‘নেব‍্যুলা চোখ’ ফিরিয়ে দিতে বলেন না। বরং বলেন –

রন্ধ্রহীন আর্তনাদে এ আঁধার হেডিসের মতো

হৃদয় ধরেছে চেপে। বহ্নিতর দিক্ দীপশিখা।

তুলে, ছিঁড়ে দাও জীবনের কৃষ্ণ যবনিকা।

(চোরাবালি, পৃ ৪৭‌, তদেব)

কবির এই মেটামরফোসিসেই জীবনের দলিল নির্ঝরের স্বপ্ন‍ভঙ্গ।

১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয় পূর্বলেখ কাব‍্যগ্রন্থ।  এই গ্রন্থে ২১টি স্বীয় কবিতা ও ১৯টি অনূদিত কবিতা আছে। গ্রন্থটি তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে  উৎসর্গ করেছিলেন। পূর্বলেখ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, উর্বশী ও আর্টেমিস এবং চোরাবালির পর পূর্বলেখ কাব্যগ্রন্থটি একটি নতুন ধাপ, বাঁকবদল। এ-কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কিত এক সংবেদী চৈতনে‍্যর প্রকাশরূপ পরিলক্ষিত হয়। কবিতাগুলোতে রাজনৈতিক উচ্চারণ কিন্তু সমষ্টিবদ্ধ নয়, এককের স্বগতোক্তি। তাই ‘মুদ্রারাক্ষস’ কবিতায় রাজনীতি ও ‘গণেশ ঘেঁষা পেশা’র একত্র সহাবস্থান কবিকে বিষণ্ন করেছে। এই অসুস্থতা থেকে তিনি মুখ ফেরাতে চেয়েছেন কারণ রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলোয় মানুষের কথা অপেক্ষা লাভ-লোকসানের অঙ্কটা বড় হয়েছিল। এই মুখ-ফেরানোর মধ্যে কবির রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পরিলক্ষিত হয়। ‘১৯৩৭ স্পেন’ নামক কবিতায় আছে স্পেনের গৃহযুদ্ধের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত টীকাভাষ‍্য‌। ঐতিহাসিক ল‍্যাংসাম এই গৃহযুদ্ধকে ‘Little World War’ বলে উল্লেখ করেন। যুদ্ধে দশ লাখ স্পেনবাসী নিহত হন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে এই গৃহযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাই তিনি লেখেন –

চাচা-র আপন প্রাণ বাঁচানোর ক্ষেত্রে

শিং ভেঙে মেশে স্বার্থে শত্রু মিত্র।

(পূর্বলেখ, পৃ ১৩২, কবিতা সমগ্র-১, বিষ্ণু দে)

‘জন্মাষ্টমী’ কবিতায় নগরায়ণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল এক ব‍্যক্তিমননের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এ-কবিতায় উপস্থাপিত নগরের চিত্রায়ণ সমান্তরাল নয়, বরং অসংলগ্ন। কবিতার শুরুতে বেটোফেনের নরম সিম্ফনি নিছক আলংকারিক হিসেবে থাকলেও ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সিঁড়ি বেয়ে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ মননকে পরিস্ফুট করেছেন –

হে মৈত্রয়, আত্মীয় সোদর

সেই সুর, মেগে

অগমর্ষী জনতার উদগীথ মুখর

এ কুৎসিত জীবনের ক্লৈব‍্যগামী স্বার্থপর ব‍্যর্থতা জানাই,

কুম্ভীরক তাই।

(পূর্বলেখ, পৃ ১৪০, তদেব)

এ-কবিতার শরীর জুড়ে কবির অনুভববিশ্বে কলির কৃষ্ণাবতার আগমনের জন্য আবিভআব প্রাথনা। ধনতন্ত্রের কংসবধের স্বপ্নে প্রতীক্ষার প্রহরযাপন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে কলকাতায় ফ‍্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীদের সংগঠন তৈরি হয়। এই সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন বিষ্ণু দে ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সংগঠনের প্রকাশনা হিসেবে ১৯৪২ সালে বিষ্ণু দে-র কাব‍্যগ্রন্থ বাইশে জুন প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে ১৩টি কবিতার মধ্যে ‘জনযুদ্ধ’ বাদে ১২টি কবিতা এবং আরো ৩২টি সহযোগে মোট ৪৪টি কবিতাসহ সাত ভাই চম্পা প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনাকে যেন এক বিন্দুতে  সম্পৃক্ত করেছেন। আসলে স্বপ্নই বিপ্লবের চালিকাশক্তি। তাই এই কাব্যের অবয়বও সেই স্বপ্নেরই। ‘লোকশিল্প ও বাবুসমাজ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন – ‘নবযুগ নির্মাণে তাই আমাদের দেশজ সংস্কৃতি বৃহত্তর অর্থেই আমাদের সহায়।’

‘ফেদেরিকা গারথিয়া লোরকার ছায়ায়’ নামক কবিতায় কবি শয্যার ওপর জীবনের সহজ-স্বাভাবিক মৃত্যু প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু কবিতার ক্লাইম্যাক্সে বোঝা যায়, সমাজসচেতন কবির কাছে মৃত্যু অন্য তাৎপর্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নয় সেই অপঘাতে

কারখানায়, গার্ডারচূড়ায়, ক্রেনে, মাস্তুলে, ফানেলে

হাপর, ফার্ণেসে, মৃত্যু জীবনের প্রসারিত হাতে

সার্থক সে মৃত্যু।

(সাত ভাই চম্পা, পৃ ১৬৮, কবিতা সমগ্র-এক ,বিষ্ণু দে)

তেমনি ‘পল এলুয়ারের অনুসরণে’ নামক কবিতার প্রেমিকা এবং স্বাধীনতাকে এক বিন্দুতে সমীকৃত করেছেন তিনি। দেশভাগের ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছেন সন্দীপের চর নামক কাব‍্যগ্রন্থ, যেখানে তিনি একবুক যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বলেছেন, – ‘আজকে সবাই প্রতিবেশী ভাই, হে প্রকৃতি; ভুলে যাই।/ জীবনের মরণের হারে বাঁধা জীবনের ছবি।’ (সন্দীপের চর, পৃ ১৯১, তদেব)

‘সূর্যের দেশে মনুষ্যত্বে কিছু অভাব’ কবিকে প্রশ্নাতুর করে তোলে  ‘ক‍্যাসান্ডা’ কবিতায়। দিন আনা দিন খাওয়া জীবনে অভ‍্যস্ত হয়েও কেন যে যুদ্ধ আমাদের গৃহশান্তিকে বিনষ্ট করে কবি তার কোনো উপযুক্ত কারণ খুঁজে পান না। কিন্তু হতাশা-সংকট যন্ত্রণার বিন্দুতে এ-কাব্যগ্রন্থ শেষ হয় না, বরং রচিত হয় হতাশা থেকে আশার উত্তরণে। এই লেখাচিত্রই রূপায়িত হয়েছে সন্দীপের চরে।

এলিয়টীয় চৈতন্যের আলোকে বিষ্ণু দে অনুভব করেছিলেন, বাংলা কাব্যের মুক্তির ছাড়পত্র রচিত হবে ঐতিহ্যের অন্বেষায়। এলিয়টের তাৎপর্য বিশ্লেষণে তিনি তাই বলেন, ‘নৈরাশে‍্যর পোড়া মাঠে এলিয়ট দেখলেন/ নৈর্ব‍্যক্তিকতার আরো গভীর শিকড়ের/ প্রয়োজন, এবং ভাবলেন তার সহায় হবে ভাবদুর্গের মধ্যেই/ মৃত্তিকা সন্ধানে।’ (‘এলিয়ট’, সাহিত্যের ভবিষ্যৎ, পৃ ১১৬, বিষ্ণু দে)

এলিয়টের অনুসরণে বিষ্ণু দে-র কাব্যে ‘জলে’র চিত্রকল্প এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এলিয়টের The Wasteland  কাব‍্যগ্রন্থে ‘ÔHere is no water but only rock/ Rock and no water and the sandy roadÕ – এই পঙ্ক্তির অবস্থানবৃত্তে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু দে লিখলেন –

তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া

তোমারই ঘাটের কাছে

ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে ঘাটে বাগানে বাগানে।

জল দাও আমার শিকড়ে।

(অন্বিষ্ট, পৃ ২৯৯)

নাম রেখেছি কোমল গান্ধার কাব‍্যগ্রন্থের নাম রবীন্দ্রনাথের কাব‍্যপঙ্ক্তি থেকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এ-কাব্যে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের অবক্ষয়িত সমাজব‍্যবস্থা, দাঙ্গার রক্তপাতের চিহ্ন মুদ্রিত হয়েছে।

নেকড়ের হন্যেয় দেশ ছিন্নভিন্ন, সন্দেহ ও ভয়

কলুষ ছড়ায় দুই হাতে, গায় শৃগালে বাহবা।

তবুও আকাশ ছায় আমাদের মুক্তি উচ্চৈঃশ্রবা

মানুষ দুর্জয়।

(নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, পৃ ১৩, কবিতা সমগ্র দুই, বিষ্ণু দে)

১৯৬৩-তে প্রকাশিত স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ কাব‍্যগ্রন্থে বতর্মান ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে কবি বিগত অতীত আর অনাগত ভবিষ্যৎকে যেন একসূত্রে গ্রথিত করেছেন। এ-কাব্যগ্রন্থে একশর বেশি কবিতায় কালের মাপকাঠিতে বিষ্ণু দে স্বদেশ ও বিশ্বের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকতার পরস্পরবিরোধী অথচ পারস্পরিক সমন্বিত ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র অন্বেষায় রত হয়েছেন। কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা। আধুনিককালের সমুজ্জ্বল স্বদেশপ্রেম কবিতায় পরিণত হয়েছে। সভ‍্যতার অন্তঃসারশূন‍্যতাকে প্রকট করে তিনি লিখলেন – 

বিবাহের সকলই প্রস্তুত,

এমনকী বরযাত্রী এসে গেছে, শুধু বর নেই।

(স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ, পৃ ২২৭, তদেব)

তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮) কাব‍্যগ্রন্থের নামকরণেই বিষ্ণু দে-র অন্তস্থিত প্রশ্নটির সুর এবং নেতিবাচক উত্তরটি ধরা পড়ে। অর্থাৎ কবি যেন বলতে চান, রবীন্দ্রনাথ কেবল পঁচিশের অষ্টপ্রহরে সীমায়িত হতে পারেন না। তাঁকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আনুষ্ঠানিকতা থেকে সরে আসতে হবে, করতে হবে প্রকৃত আত্তীকরণ। তবেই সমাজের বৃত্তে প্রবাহিত হবে দখিনা বাতাস। তাই তিনি এই ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর অসুস্থ বলয়ে রবীন্দ্রনাথের সত‍্যসুন্দরের রেজারেকশন চেয়ে লিখলেন –

তোমার আকাশ দাও, কবি দাও

দীর্ঘ আশি বছরের

আমাদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও

সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো।

(তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, পৃ ১৬৪)

অর্থাৎ বিশ্ব-পরিভ্রমণ সেরে কবি তাঁর আপন ভূখণ্ডের ওপরেই খুঁজে পেতে চেয়েছেন শান্তির নীড়। ‘এ দেশ’ কবিতায় তিনি আপন অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশকে ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি উপাচার দিয়ে তাই পুজো করেছেন – 

এদেশ আমার চেনা দেশ

আমারই আপন সত্তা, অফুরন্ত-এর গাছে ঘাসে

আমার চোখের মুক্তি, প্রত‍্যহ টিলায় আনাগোনা।

সুতরাং এ-কথাট সুস্পষ্ট যে, বিষ্ণু দে-র প্রেক্ষণভূমি অবস্থিত হয়েছে দেশীয় মৃত্তিকার ওপর, কিন্তু তার প্রেক্ষণবিন্দু ছিল ওই অতলান্তিকের ওপর। তবুও খণ্ডবিশ্বের মাঝেই তিনি সন্ধান করেছেন শাশ্বত বোধিবৃক্ষ। তাই এলিয়ট, এলুয়ারের আবেগকে ছেড়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর শরণ রবীন্দ্রবিশ্বের উদ্দেশে। তাই বিশ্ব-পরিভ্রমণে ক্লান্ত, অভিজ্ঞ পথিকের হৃদস্পন্দনে বাজে আজো তাঁর ঘরে ফেরার গান –

হয়তো বা নিরুপায়

হয়তো বা বিচ্ছিন্নে যন্ত্রণাই বতর্মানের ইতিহাস

বালিচড়া মরা নদী জলহীন পায়ে পা

অথচ বৈশাখী হাওয়া বাংলার সমুদ্রের

আমার মুকুলে ফল

রাশি রাশি বেলমল্লিকায়

বাগানে বিরল আজ কালেরই বাগান।

(অন্বিষ্ট, পৃ ২৯৫, কবিতা সমগ্র-এক, বিষ্ণু দে)

তথ্যসূত্র

১. বিষ্ণু দে’র শ্রেষ্ঠ কবিতা, নাভানা সংস্করণ। ২. পূর্বলেখ, কবিতা সমগ্র-এক, আনন্দ পাবলিশার্স।