বৈপরীত্য ও দ্বৈতচেতনার কবি জীবনানন্দ

আহমদ রফিক

রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক যুগের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে দীপ্তিমান। সে-বৈশিষ্ট্য খুবই চোখ-ধাঁধানো, পাঠককে নাড়া দেওয়ার মতো শক্তিমান। কিন্তু তা শুরুতে কিছুটা হলেও নেতিবাচক। মূলত তা কবিতায় জীবনানন্দীয় ক্রিয়াপদের সাধুরূপ ব্যবহার ও অনুরূপ একাধিক কারণে।

‘আসিতেছে’ ‘যাইতেছে’ ‘ছড়াতেছে’ ‘হাঁটিতেছি’ ‘লড়িয়াছে’ ‘উড়িতেছে’ ‘ডাকিতেছে’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদে আধুনিকতার গায়ে আপাত ঝাঁকুনি দিয়ে মনোযোগী পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে এই প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কারণ পাশাপাশি বিপরীত ধারার আধুনিক চেহারার সংক্ষিপ্ত ক্রিয়াপদ ও অনুরূপ শব্দের ব্যবহারও যথেষ্ট, বরং অধিক। কেন পূর্বোক্ত ব্যবহার তা নিয়ে ভাবতে গেলে মতভেদ কম হবে না। এমন এক অনুরূপ ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনানন্দ কি বাংলা কবিতার প্রচলিত ও অভ্যস্ত সংস্কার ভেঙে সচেতনভাবে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, নাকি এসবই তাঁর অন্তর্লীন কাব্যচিমত্মার অভিনবত্ব-প্রয়াস? এ-ক্ষেত্রে বিদেশি কবিতা কি তাঁকে প্রভাবিত করেছে? করে থাকলে তার মাত্রা কতটুকু? তা কি তাঁর কবিতার হাড়মজ্জায় প্রবেশ করেছিল?

এ-জাতীয় বিচিত্র সম্ভাবনাগুলো, বা জীবনানন্দের কবিতায় পাশ্চাত্য আধুনিকতার প্রভাব ও প্রকাশ বা কথিত পরাবাস্তবতার সার্থক প্রতিফলনাদি বিবেচনার মধ্যেও আমার মনে হয়, কবি জীবনানন্দের নিজস্বতা, তাঁর গ্রামীণ প্রাকৃত রূপৈশ্বর্যমগ্নতা, তাঁর কাব্যের অন্তর্নিহিত সংগীতময়তা ইত্যাদি বহুকিছু মিলেই এই বৈচিত্র্য-বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে, যা একান্তভাবেই জীবনানন্দীয়। তাঁর সমকালীন বা নিকট পূর্বসূরিদের কবিতায় সে প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলে না। বিষয়ে ও প্রকরণে উভয় ক্ষেত্রেই জীবনানন্দের কবিতা অভিনবত্বে একান্তভাবেই আপন।

ক্লান্তি, অপরিমেয় ক্লান্তি ও মৃত্যুর অন্ধকার, সেই সঙ্গে ইন্দ্রিয় চেতনা ও আলোর পিপাসা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে জীবন-মৃত্যুর বিস্ময় সত্ত্বেও বিশদ বিচারে প্রাকরণিক অভিনবত্বই মনে হয় জীবনানন্দীয় কাব্যবৈশিষ্ট্যের পরম বিস্ময়। পশ্চিমা অবক্ষয়, নান্দনিক ও জাগতিক – এলিয়ট বা ইয়েটস, যদি ‘ক্ষয়ের ব্যাপ্তিতে’ তাঁকে প্রভাবিত করেই থাকে, উপনিবেশ ভারতে, বিশেষত বঙ্গে তো বিশের শতকের প্রথমার্ধ সাহিত্য বিচারে নতুন করে জেগে ওঠার নান্দনিক সময়, বিশের দশক থেকে যার সূচনা – নজরুল ও জীবনানন্দে, ভিন্ন চরিত্রে। সেক্ষেত্রে জীবনানন্দের কবিতা হতাশা-প্রধান হবে কেন? এমন প্রশ্ন বা ভাবনা গভীর বিশেস্নষণের দাবি রাখে। রাখে সময় ও ইতিহাস চেতনার হাত ধরে। বিশেষত এ-কারণে যে, জীবনানন্দ যেমন নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা ও চিত্ররূপময়তার কবি হিসেবে বহু-আলোচিত তেমনি পরিচিত, অতীব পরিচিত সময় ও ইতিহাস চেতনার কবি হিসেবে। আবার বিমূর্ত বোধের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়জ বাসনা বা শরীরী চেতনা তাঁর কবিতার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয়। সেখানে ‘নারী’ একাধিক অভিধায় চিহ্নিত।

বিশ থেকে চলিস্নশ, এ-সময় পর্বে বাংলা কবিতার নতুন এক জাগরণ, প্রগতিশীলতায় নতুন এক নান্দনিক জাগরণের চেষ্টায়। এতে অংশ নিয়েছেন জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিগণ, যাঁরা রচনার সময় বিচারে জীবনানন্দের সমকালীন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, দিনেশ দাস, অরুণ মিত্র বা উত্তরসূরি সুভাষ-সুকান্ত প্রমুখ চলিস্নশি কবিগণ।

তবু জীবনানন্দ সেখানে একা, আপন ‘বোধ’ বা ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়ে সম্পূর্ণ একা ও নিঃসঙ্গ, যদিও শেষদিকে এসে জীবন ও আলোর আকাঙক্ষা নিয়ে সমষ্টিগত কাব্যভুবনের একান্তে উপস্থিত। এর কারণ যতটা পাশ্চাত্য প্রভাব, অতটাই সম্ভবত পরিবেশ বাস্তবতা ও তাঁর নিজস্ব বোধের প্রভাব। প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষ এবং নারীকে ভিন্নভাবে দেখার এক নিঃসঙ্গ প্রবণতা।

এই যে বিষয়গত বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা তাঁর কাব্যিক প্রতিফলনে, যে-অভিনবত্বের কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, বিশেষত প্রকরণে, ক্রিয়াপদ ও শব্দের ব্যবহারে, তেমনি তা দেখা যায় তাঁর কবিতায় অন্তিমপর্ব পর্যন্ত। সেখানে শব্দ, বাক্যবন্ধ, বাক্যাংশ বা পঙ্ক্তিরও অভিনব পৌনঃপুনিকতা একান্তভাবে জীবনানন্দীয়, অন্যত্র দেখা যায় না।

বিচিত্র এবং কিছুটা অদ্ভুতও পুনরুক্তিমূলক ব্যবহার যেমন : ‘উড়িতেছি – উড়িতেছি – …/ বৈতরণী – বৈতরণী – শান্তি দেয় – শান্তি – শান্তি – ঘুম-ঘুম-ঘুম -’। কিংবা ভিন্ন তাৎপর্যে : ‘একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড় বাগানে’ ইত্যাদি।

একই ধারায় ভিন্ন উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে :

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল

অনেক কমলা রঙের রোদ।

এবং এর সঙ্গী পঙ্ক্তিগুলো। শেষদিকে এই প্রবণতার আধিক্য। বহুউদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে একই শব্দের বহুল পুনরুক্তি : ‘স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে – ব্যবহৃত – ব্যবহৃত – ব্যবহৃত – ব্যবহৃত হয়ে ব্যবহৃত – ব্যবহৃত -’ ইত্যাদি।

এ-কবিতাটি বহু সমালোচিত সমাপ্তির কারণে।

আবার ভিন্ন বার্তা ‘তিমির বিনাশী’র আকাঙক্ষায়। জীবন ও আলো নিয়ে। কবির আরেক বৈশিষ্ট্য জীবন-মৃত্যু, প্রেম-অপ্রেমকে একই মুঠোয় নিয়ে বহু শব্দে দলিত-মথিত করা।

 

দুই

জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে উলিস্নখিত অতিসংক্ষিপ্ত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কাব্যসৃষ্টির বহুমাত্রিক পরিচয় নিতে গেলে দেখা যায়, শুরুতে তিনি বাঙালি শিক্ষিত সমাজের এলিট শ্রেণিতে, এমনকি জনাকয় ব্যতিক্রম বাদে কবিকুলেও তিনি উপেক্ষেত, কোথাও কোথাও সমালোচিত। এর কারণ দুর্বোধ্য নয়। তাঁর অভিনব শব্দ-ব্যবহার, সাধু-চলিতের মিশ্রণ, কখনো রুক্ষ শব্দের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি সমকালীন অনেকের কাছে। বিশেষ করে সম্পাদক-লেখক-অধ্যাপক-সমালোচক প্রমুখের বিচারে। এঁদের উদ্দেশেই বোধহয় সাতটি তারার তিমির পর্বে জীবনানন্দ ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি লিখে তাঁর তিক্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দের কবিতা বিচার আংশিক হতে বাধ্য। কারণ তুলনায় অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা কম নয়, বরং কিছুটা বেশিই হবে। তবু প্রকাশিত গ্রন্থের পর্ব বিচার গুরুত্ব বহন করে প্রভেদ ও ভিন্নতার কারণে। সে-হিসেবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালকের কবিতা তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্যের আভাসটুকু রেখে শেষ হয়ে গেছে। সেখানে রাবীন্দ্রিক শব্দাবলির প্রভাব যথেষ্ট।

ঝরা পালকের প্রথম কবিতাটিতেই এ-দ্বৈতরূপ পরিস্ফুট। যেমন :

আমি কবি – সেই কবি, –

আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি।

এখানে তাঁর কবি হিসেবে আত্মপ্রত্যয় স্পষ্ট, রাবীন্দ্রিক প্রভাবের পাশে – ‘আঁখি’, ‘হেরি’, ‘আনমনা’, ‘পানে’ প্রভৃতি শব্দের বিপরীতে ‘সেই কবি’ শব্দযুগল ধূসর পান্ডুলিপির ‘সেই পুরোহিত’কে স্মরণ করিয়ে দেবে। এমন অনেক উদাহরণ তুলে ধরা যাবে ঝরা পালকের কবিতাগুলো থেকে। পরবর্তী কাব্যসৃষ্টি থেকে ভিন্ন, আধো-পরিস্ফুট স্বাতন্ত্র্যের এই কাব্যগ্রন্থটি জীবনানন্দের কাব্যসৃষ্টিতে তাঁর কাব্যগ্রন্থ পরিক্রমায় প্রথম পর্ব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬) থেকে আপন বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত কবি জীবনানন্দ দাশ; যেমন বিষয়গত তেমনি প্রকরণগত স্বাতন্ত্র্যে, বৈশিষ্ট্যে, বৈচিত্র্যে। তা বিশেষভাবে শব্দের নতুনত্বে, উপমা ও চিত্রকল্পের অভিনবত্বে। সেই সঙ্গে প্রেম, প্রকৃতি, নর, নারী এবং সমাজ ও সংস্কৃতির চরিত্র ব্যাখ্যায়। বৈপরীত্য এক্ষেত্রে প্রধান।

এখানে কবিতার প্রধান সুর যেমন প্রেম-অপ্রেমের অনুভূতি প্রকাশে ও ব্যর্থ প্রেমের তিক্ত হতাশা প্রকাশে, তেমনি স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বহন করে নিজস্ব শব্দভুবন তৈরিতে, যা পরবর্তীকালে জীবনানন্দীয় কাব্যভাষা ও শব্দাবলি হিসেবে কবি ও পাঠকের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে, সমাদৃত হয়েছে।

প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘নির্জন স্বাক্ষর’ আপন স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট। তেমন আধুনিক কবির প্রত্যয়ে ‘মাঠের গল্প’, ‘মেঠো চাঁদ’ তির্যক গুরুত্ব অর্জন করেছে। শুরুতেই প্রেমের তিক্ত নান্দীপাঠের পরই বিচিত্র ও বিপরীতধর্মী প্রাকৃত অনুষঙ্গ তৈরি করে ওই ব্যর্থতা ও ক্ষোভের প্রতীকী প্রতিফলন ঘটিয়ে নান্দনিক সান্তবনার প্রকাশে।

আধুনিক কবি, আধুনিক প্রাকরণিক দক্ষতার পাশ্চাত্য-চেতনার কবির ‘মাঠের গল্প’ নিয়ে – ‘মেঠো চাঁদ’ ও পেঁচা পরিক্রমা শেষে আবার সেই ব্যর্থ প্রেমের কথকতা – পঁচিশ বছর পরে – জীবনানন্দের ভাষায়ই বলা চলে – ‘এ প্রেম ভুলিবার নয়’। তাই একের পর এক অবক্ষয়ের প্রতীকী অনুষঙ্গ রচনা।

দিকে-দিকে, – চড়ুয়ের ভাঙা বাসা…

পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা – কড়কড়।

শসা ফুল – দু-একটা নষ্ট শাদা শসা, –

মাকড়ের ছেঁড়া জাল, – শুকনো মাকড়সা

লতায় পাতায় : –

অবক্ষয়ের একটি পূর্ণ ছবি, চিত্রশিল্পীর আঁকা ক্যানভাসও বলা চলে; এখানে তা শব্দশিল্পী জীবনানন্দের কলমে আঁকা। এরপর ‘কার্তিক মাঠের চাঁদ’ নিয়ে অনুরূপ কথা। এই কাব্যবৃত্তে ‘পেঁচা’র উপস্থিতিও মাঠ ও ফসলের অনুষঙ্গে এবং আকাশ নদীর প্রেক্ষাপটে, বিস্ময়কর হিমশীতের রাতে, বলা বাহুল্য হেমন্তে :

মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে

জেগেছিল অঘ্রানের রাতে

এই পাখি।

শুরুতেই প্রাকৃত পরিবেশে জীবনানন্দ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেন হেমন্তের কবিরূপে। মাঠের গল্পেও অপ্রাপ্তি ও নেতিবাদের প্রাধান্য। রাতের পৃথিবীতে তাঁর পুরনো উপলব্ধি :

তবু আমি পেয়েছি যে টের

কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের

কোনো সাধ!

ঘুরেফিরে ইচ্ছাকল্পনায় সাধ মেটানো, কখনো তিক্ত অভিশাপের সুরে ক্ষোভ ঝাড়া – জীবনানন্দীয় প্রেমবিষয়ক কবিতার বৈশিষ্ট্য – নানা প্রতীকে, নানা অনুষঙ্গ রচনায় যেখানে প্রকৃতির প্রাধান্য। হেমন্ত-প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের এ এক অদ্ভুত কাব্যবিলাস! কেউ বলতে পারেন, এ হচ্ছে প্রাকৃত অনুষঙ্গ সাক্ষী রেখে কবির হৃদয়বেদনায় আত্মপ্রকাশ।

কবিতা সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্বে তথা মূল পর্বেই সজীব সবুজের পরিবর্তে ধূসর পান্ডুলিপিতে ব্যর্থ প্রেমের সেত্মাত্র রচনা, তাও মেঠো চাঁদ আর নদী, মাঠ ও পাখি ও প্রাণিকুলের সঙ্গী হয়ে হেমন্তের পাতা ঝরার প্রতীকে। এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে কবির জীবন-ভাষ্য, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ঘিরে নান্দনিক জীবনদর্শনের সূত্রাবলি।

এখানে রয়েছে বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্যে কবির শৈল্পিক দর্শন, জীবনদর্শনেরও প্রতিরূপ অদ্ভুত উপলব্ধির প্রকাশে যা কবির ভাষায় দুর্বোধ্য এক ‘বোধ’, যা কবি-চেতনার একাকিত্বের উৎস। সেই বহুজনকথিত জীবনানন্দীয় পুনরুক্তির তাৎপর্যময় প্রকাশ। এই বোধ একান্তভাবেই জীবনানন্দীয়, যা থেকে সৃষ্ট জীবনানন্দের বহুউদ্ধৃত ‘বিপন্ন বিস্ময়’ ও মৃত্যুচেতনা, বস্তুত তা জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে ঋদ্ধ।

পূর্বোক্ত বোধের হাত ধরেই জীবনানন্দের স্বতন্ত্র ধারার কাব্যসৃষ্টি, তাঁর জৈবনিক উপলব্ধিও বটে। মর্গে পৌঁছনোর পূর্বধারা হিসেবে জীবনধৃত বিষাদ ও নৈঃসঙ্গ্যবোধ, তাঁর ভাষায় একাকিত্বও যা পুনরুক্তিতে বিশিষ্ট :

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আত্মোপলব্ধি ও আত্মানুসন্ধানের এমন আত্মবিশেস্নষণে ও আত্মউদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে কবিজীবনের আত্মঅন্বেষা রূপ পায় এমন এক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তে যা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক :

তবু কেন এমন একাকী?

তবু আমি এমন একাকী?

বলতে হয়, সিদ্ধান্ত নয় প্রশ্নবিদ্ধ আত্মবিচার। তাই প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তিশেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন, কখনো বিস্ময়সূচক চিহ্ন, কথকতার প্রশ্নমালার জের ধরে সেমিকোলনের পর সেমিকোলনের সারি, যেন এক অন্তহীন যাত্রা। তেমনি রাশি রাশি ড্যাশ চিহ্নে কী ভাবনার প্রকাশ তা কবিই ভালো বলতে পারবেন।

জীবনানন্দের কাব্যকথকতার আরেক বৈশিষ্ট্য বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত শব্দ বা বাক্যবন্ধের আতিশয্য এবং প্রশ্ন-মানসিকতা, তদুপরি সেই সূত্রে সংহত, সংক্ষিপ্ত বয়ান, যা এককালে পাঠক একদিকে অভিনব, অন্যদিকে দুর্বোধ্য না হলেও সহজবোধ্য নয় বলে মনে করেছে। সাতটি তারার তিমিরে পৌঁছে কোথাও কোথাও দুর্বোধ্যতা তো আছেই, আছে অগ্রন্থিত কবিতায় সর্বাধিক মাত্রায়।

ব্যর্থ প্রেমের বিচ্ছেদ-বয়ান ‘অনেক আকাশ’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটিতে উপমা, তুলনা ও প্রাকরণিক বৈচিত্র্য নিয়ে বিচ্ছিন্নতা বোধের প্রকাশ মোটেই কম নয়। এ-প্রবণতা ধূসর চিমত্মার প্রকাশ বলেই কি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগানের পঙ্ক্তির ঢংয়ে জীবনানন্দীয় কাব্য-পঙ্ক্তির প্রকাশ :

‘আমি প্রণয়িনী, – তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী!’ পরবর্তী ছত্রগুলোতে একই ভাবের প্রকাশ। ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’ কিংবা বৈষ্ণবীয় ধারায় রবীন্দ্রনাথের স্বয়ম্বরা বা ‘জেনানা ইমেজারি’র (যা রবীন্দ্রচরিত রচয়িতা টমসন সাহেবের খুবই অপছন্দের), কাব্য প্রকাশের মতো পুরোপুরি না হলেও অনেকটা যেন জীবনানন্দের প্রণয়কাব্যে মাঝেমধ্যে পরিস্ফুট। এর ক্ল্যাসিক চরিত্র পরবর্তী পর্যায়ে অতি-আধুনিকতার বিচ্ছিন্ন, ভাঙা পঙ্ক্তির বাক্যবন্ধে বা শব্দব্যবহারে লক্ষ করা যায়। শেষোক্ত প্রকাশ পাঠকের জন্য খুব একটা সহজবোধ্য নয়।

সনেট চরিত্রের সংহত বিন্যাসে লেখা জীবন শীর্ষক কাব্যমালার চৌত্রিশটি ফুল বা স্তবক একই চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে জীবনানন্দীয় বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। জীবনকে নিয়ে কাটাছেঁড়ার ‘নির্জন পাতা’ নান্দনিক বিচারে উপভোগ্য হলেও ‘শিশিরের গুহা’ নিয়ে ভাবতে হয়। অথবা

আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে, –

অথবা গ্রহের ’পরে – ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে ভাসে। –

কমা, ড্যাশ ইত্যাদির প্রাচুর্যে পঙ্ক্তি দুটো বোধের জগতে প্রশ্ন তোলে। ‘ভূত’ যদি অতীতও হয়ে থাকে, তবু কি তা পাঠকের কাছে খুব একটা সহজবোধ্য বিষয়?

কবি জীবনানন্দ বরাবর এ-ধরনের শব্দ ও বাক্যবন্ধবিলাসী, তাঁর কাব্যভুবনের বৃহৎ অংশে; কোথাও মৃত্যুবিলাসী, ক্বচিৎ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ভিন্ন উচ্চারণ। আবার এ-কথাও সত্য যে, যেমন উদ্ভিদজীবন তেমনি পাখি ও প্রাণিকুল নিয়ে জীবনানন্দের কবিতা জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে ‘মৃত্যুর আগে’ও বুঝতে চেয়েছে জীবন কতটা মহার্ঘ্য, প্রেম কতটা ইতিবাচক, মৃত্যু কতটা অবধারিত।

তাঁর কবিতার মিল যতটা ইয়েটসের সঙ্গে, বেশ কিছুটা মিল বোদলেয়ারের অবক্ষয়বোধের সঙ্গে, বিশেষত নারীদেহের সৌন্দর্যের কদর্যবাস্তবতায়, তেমনি কিছু মিল হয়তো-বা অ্যাডগার অ্যালেন পোর আঁধার-দার্শনিকতার সঙ্গে। যদিও পোর দাঁড়কাক ও জীবনানন্দের ‘সোনালী ডানার চিল’ কিংবা ‘আকাশে আকাশে’ বিচরণরত শকুনের সঙ্গে বিস্তর তফাত।

জীবনানন্দের শকুন বিস্তর ওড়াউড়ি করে, পাঠককে যথেষ্ট উপভোগ্য প্রাকরণিক সৌন্দর্য উপহার দিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘মৃত্যুর ওপারে’ পৌঁছে যায়। সেখানেই বুঝি তার শেষ গতি। এই মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা। আর তা হলো :

আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ;

এ-কবিতার শেষ পঙ্ক্তি কটি কি খুব সুবোধ্য? জীবনানন্দের কবিতায় সুবোধ্য-দুর্বোধ্যের সীমারেখা নির্ণয় করা খুব কঠিন। তবু যেমন তাঁর পেঁচা জাগে, তেমনি ব্যতিক্রমও যথেষ্ট। ‘পচা শসা – পচা চালকুমড়ার’ পাশে ‘অবসরের গান’-এ বিস্তর উপভোগের আয়োজন কিছুটা হলেও ইয়েটসকে স্মরণে রেখে। তেমনি ইমপ্রেশনিস্ট যুগের চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাস স্মরণে।

তাই আশ্চর্য যে, উপভোগের আয়োজনে মদ আর ভাঁড়ের এবং নৃত্যগীতের উপস্থিতিতে মাঠের ফসল আর শস্যের সুগন্ধের মধ্যে ‘রোদ – ক্ষুদ – কুঁড়া – কার্তিকের ভিড়’-এ ভিন্ন এক দৃশ্যের জন্ম হয়। রোদ পড়ে গিয়ে ছায়া, এবং অন্ধকারে পুরনো পেঁচারা ঠিকই বেরিয়ে আসে বিশেষ প্রতীকী তাৎপর্যে।

প্রতীকী তাৎপর্যে অসাধারণ ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতা, আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুষঙ্গে হরিণ-হরিণীর প্রণয়বিষয়ক কথকতায় কবি জীবনানন্দের চিরাচরিত সত্যই প্রকাশ পায় : জীবনের মধ্যে মৃত্যুর প্রাধান্য, মানবীয় নিষ্ঠুরতা, লোভ-লালসা, প্রতারণা অদ্ভুত সত্য হয়ে থাকে কবির অনুভবে :

এই ব্যথা, – এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে, –

কোথাও ফড়িঙে – কীটে – মানুষের বুকের ভিতরে,

আমাদের সবের জীবনে।

বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো

আমরা সবাই।

কবির উপলব্ধির সারকথা : মানবজীবনের, জীবজগতের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-অপ্রেম, সর্বোপরি জীবন-মৃত্যুর বাস্তবতা। এই বাস্তবতার বয়ানই জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সর্বাধিক গুরুত্বে পরিবেশিত। পরিস্ফুট আলো-আঁধারের অধিকল্প সত্যে।

 

তিন

বৈপরীত্যের মধ্যেই পূর্ণতা বা সার্থকতার সন্ধান করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর উত্তরসূরি, কিন্তু রচনাকাল বিচারে সমসাময়িক কথাসাহিত্যিকের সৃষ্ট নায়কেরও চোখ খুঁজে ফেরে মানুষ – যারা ছিল, আর যারা আছে। রূপসী বাংলার রূপায়ণে জীবনানন্দের অভিজ্ঞতা :

আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক –  পুকুরের জলে

বহুদিন মুখ দেখে গেছে… হৃদয়ের গভীর উৎসবে

খেলা ক’রে গেছে তারা কতদিন –

…অনেক কুকুর আজ পথেঘাটে নড়াচড়া করে

তবু আঁধারে ঢের মৃত কুকুরে মুখ – মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে;

কোথায় গিয়েছে তারা?…

শুধালাম… উত্তর দিল না কেউ অসীম আকাশে।

জীবন-মৃত্যুর বিস্ময় ও রহস্য নিয়ে বিচার-বিশেস্নষণেও জীবনানন্দের নান্দনিক আগ্রহ অপরিসীম। সেখানে অধিকল্প বৈপরীত্য তাঁর কাব্য-ভুবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে। তাই রূপসী বাংলার সোনালি-রুপালি চিত্রায়ণের মধ্যেই অবাঞ্ছিত হানা দেয়। অমোঘ সত্যের স্বীকৃতি কাব্যপঙ্ক্তিতে ভাষা পায় এই বলে :

‘হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় – চিতা শুধু পড়ে থাকে তার’, ভাবা যায় বিলম্বিত লয়ে ছাবিবশ মাত্রার একটি পয়ার-পঙ্ক্তির শেষ?

‘রূপসী বাংলা’কে যদি প্রক্ষিপ্ত ভিন্ন পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায় তাহলেও বাংলা, প্রাকৃত বাংলা ও তার ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাস সত্ত্বেও সেখানে জীবন-মৃত্যুর দুর্বোধ্য দার্শনিকতায় কাতর জীবনানন্দের গভীর প্রশ্নের প্রকাশ কোনো অংশে কম নয়। উত্তর অন্বেষাও মোটেই গুরুত্বহীন নয়।

পূর্বোক্ত ধারাবাহিকতার মধ্যেই ভিন্ন এক পর্বে তাঁর বহুউচ্চারিত, পাঠকপ্রিয় ‘বনলতা সেন’ প্রেমের গভীর বার্তায় ভর করে সময় ও ইতিহাস-চেতনার প্রকাশ ঘটায়। এখানেও কবিতা ধূসর পান্ডুলিপির ক্লান্তি থেকে মুক্ত নয়। প্রেমিকার সার্থক রূপচিত্র আঁকার পরও মুখোমুখি বসার পক্ষে ‘অন্ধকার’ই প্রধান হয়ে জেগে থাকে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ পয়ারের বিলম্বিত তাললয় সুপ্ত সুরের ধ্বনিময়তা মাঝেমধ্যে একাধিক ধ্বনিমিলের শ্রম্নতিশোভন উপভোগ্যতা :

‘তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;’ ইত্যাদি।

অবশ্য এ-বৈশিষ্ট্যে বাংলা কবিতার সম্রাট রবীন্দ্রনাথেও মিলের পর মিলে ধ্বনিময়তার প্রতি প্রবল আগ্রহ। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যেরও যাত্রী, যদিও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতাটির ইতি টানেন মধ্যমিলে। প্রচুর কারুকার্যখচিত এ-কবিতাটির সুবাদে জীবনানন্দকে নিয়ে একাধিক লেখক-সমালোচক ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে বিচার-ব্যাখ্যা করেছেন। সে-বিচার জীবনানন্দ-অনুরাগী পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক।

অস্বীকারের উপায় নেই যে, ‘বনলতা সেন’ বহু আলোচিত, সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় কবিতা হওয়া সত্ত্বেও এটি ওই গ্রন্থের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সৃষ্টি নয়। এখানে রয়েছে একাধিক বোধ ও ভাবনার কবিতা। যেমন ‘হাওয়ার রাত’, ‘অন্ধকার’ বা ‘বিড়াল’। কিংবা ‘আমি যদি হতাম’, ‘হায় চিল’ ও ‘বুনো হাঁস’।

‘ক্যাম্পে’ কবিতার মৃগ ও মৃগীদের মতো বনহংস ও বনহংসীর জীবনেও জেগে থাকে মানুষের জান্তব নিষ্ঠুরতা। ‘গুলির শব্দে স্তব্ধতা’ আর চিরস্থায়ী ‘শান্তি’ যেন জীবনের অপ্রতিরোধ্য সত্য, সভ্যতার নিয়ামক শক্তি। সভ্যতা নামক হমত্মারক ইতিহাস নিয়ে তাই প্রতিবাদী ইতিহাসের পালটা প্রশ্ন : এ-সভ্যতা, ঘাতক সভ্যতাকে কতটা সভ্য বলা যায়? মৃত্যু ও রক্ত নিয়ে যার পথ চলা শুরু, এখনো যে-ধারা চলছে?

কবি জীবনানন্দের ইতিহাস-চেতনায় তাই অমানবিক সভ্যতাবিরোধী কোনো কোনো সমাজ-সচেতন পর্যবেক্ষকের মতো একই ধারণার প্রকাশ। তাঁদের মতো জীবনানন্দেরও বিশ্বাস, সভ্যতা তার অবাঞ্ছিত চরিত্র অর্জন না করলে :

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না;

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা                                                                        ও অন্ধকার।

এমন সভ্যতাকে আধুনিক চেতনার মানুষ কীভাবে প্রকৃত সভ্যতা, মানবিক সভ্যতা বলে জ্ঞান করবে? জীবনানন্দও তা করেননি। কালবেলায় পৌঁছে তাঁর কবিতায় এমন বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে। তাই একদা তিমিরবিলাসী কবি জীবনানন্দ ‘তিমির বিনাশী’ হতে চেয়েছেন।

 

চার

সভ্যতা নিয়ে অহংকারী মানুষের নিষ্ঠুরতা কবিমাত্রকে, হার্দ্য চেতনার মানুষকে স্পর্শ করেছে, কখনো গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। সে নিষ্ঠুরতার, বেশি নয়, গুটিকয় ছবি এঁকেছেন জীবনানন্দ। ইতিপূর্বে দু-একটির উলেস্নখ করা হয়েছে। সেই উলেস্নখ বনলতার নমনীয় মাধুর্যে পূর্বোক্ত বৈপরীত্যের আভাস ঘটিয়ে। ‘শিকার’ কবিতাটি এক প্রামাণ্য উদাহরণ। তাই নদীর জল রক্তাক্ত হয় ‘মচকা-ফুলের মতো’ রং নিয়ে।

জীবনানন্দ গভীরভাবে প্রতীকাশ্রয়ী কবি। প্রতীকে-উপমায়-চিত্রকল্পে এই ত্রিধারার সার্থক কবি তিনি। যে যা ভাবুক, সমালোচনা করুক, তা তিনি গ্রাহ্য করেন না। তাঁর অভিনব উপমা, প্রতীক, বাক্যবন্ধ ও চিত্রকল্প নিয়ে কবিতার ভুবনে তাঁর বিচরণ, তাই হরিণ-হরিণীর প্রতীক ফিরে ফিরে আসে। ঐতিহ্যসন্ধানী পাঠকের স্মরণে আসতে পারে চর্যাপদের হরিণ-হরিণীর প্রতীকী ভাষ্য।

অতীত পৃথিবী, বর্তমান পৃথিবী ও তার সভ্যতার পর্যবেক্ষণে কবি জীবনানন্দ ক্বচিৎ উদ্দীপ্ত, অধিকাংশ সময় বিষণ্ণ, কখনো ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধচিত্তে মনে হয় ‘স্থবিরতা সবচেয়ে ভালো’। স্থবিরতার প্রতীকী অর্থ মৃত্যু। মৃত্যু-চেতনা জীবনানন্দের কবিতায় সর্বাধিক পরিস্ফুট। পৃথিবীকে একসময় যেমন ‘মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়’। সেখানে এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন। পৃথিবী ও তার সময়ক্ষণ নিয়ে এমন এক অভিভূত চেতনার প্রকাশ।

আবার একই সঙ্গে বিপরীত উপলব্ধি। ‘শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ…’ অসম্ভব বিষণ্ণতার প্রকাশ ঘটায়। তখন মনে হয় :

মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার

তখন অন্ধকার আর নান্দনিক উপভোগ্যতা সৃষ্টি করে না। নির্জনতা-নিঃসঙ্গতা বিষণ্ণতার প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘আমাকে তুমি’ কবিতাটি এভাবে আলো-আঁধারে, ইতি ও নেতিতে বিভাজিত। এমন এক দ্বৈত চেতনার বৈপরীত্য, যেমন আগে বলা হয়েছে, জীবনানন্দীয় কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এমন এক চেতনার সার্থক দার্শনিক প্রকাশ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আট বছর আগের একদিনে’। এই দর্শনচিমত্মায় জীবনের চেয়ে মৃত্যুর ভার অধিক। এখানে আত্মহননের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। অথচ জীবনের প্রতি আকর্ষণ আছে, আছে জীবনের প্রতি প্রাকৃতিক সমর্থন। এ-কবিতায় একাধিক বৈচিত্র্যময় ভাবব্যঞ্জনার প্রকাশ।

তা সত্ত্বেও যুক্তিহীন আত্মহননের আকর্ষণ সব বাধা, প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। সে-আকর্ষণের নাম ‘বিপন্ন বিস্ময়’ যা আসলে আনন্দ-বেদনার দ্বিমাত্রিক জীবনযাপনের ভার, যা একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই কবির ভাষায়,

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো – জ্যোৎস্নায়, – জ্যোৎস্নায় তবু সে দেখিল

কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল –

জীবন এক দুর্বহ বোঝা – এমন প্রত্যয় কি জীবনানন্দ অর্জন করেছিলেন আপন দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতায় ভরা অভিজ্ঞতা থেকে, যেজন্য নিজেরও জীবন দিতে হলো ট্রামের চাকার নিচে?

একই কবিতায় মৃত্যুর অনিবার্য চরিত্রের পাশাপাশি জীবনের পক্ষেও উষ্ণ মমতার প্রকাশ :

গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায় – অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।… মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত                                                                                          ভালোবাসে।

…দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ

মরণের সাথে লড়িয়াছে;…

একদিকে মৃত্যুর অনিবার্য সত্য, অন্যদিকে জীবনের উষ্ণ পারিপার্শ্ব, এই দুয়ের টানাপড়েনে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন কবি জীবনানন্দ তাঁর কাব্যদর্শন-জীবনদর্শনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে। ‘কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে, মন মোর নহে রাজী’ এমন কথা বলতে পারেননি জীবনানন্দ। অভিশপ্ত পৃথিবী – তার সভ্যতা ও সমাজ, এমনকি সময় তাঁকে পীড়িত-দলিত-মথিত করেছে।

তাই ‘জীবনের স্বাদ’ (নিজে যে স্বাদ পাননি) তাঁর কাছে অসহ্যবোধ হয়েছে। পাখিকুলে, প্রাণিকুলে জীবনের উল্লাস তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। পারেনি পরমপ্রিয় প্রাকৃত বাংলার সৌন্দর্যভরা রূপ, পারেনি প্রিয় ধানসিঁড়ি নদী। ‘মহাপৃথিবী’ তাঁকে কেবলি আহত, রক্তাক্ত করেছে। পরিণামে জীবন-সম্পর্কে বিতৃষ্ণা।

তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা এই কবিতায় যেমন জীবনানন্দের জীবন-দর্শনের মর্মবস্তু পরিস্ফুট, তেমনি পাশাপাশি একটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা : ‘বলিল অশ্বত্থ সেই’ – একই কাব্যভাষ্যে বড় স্পষ্ট। আটপৌরে কথকতার, দেহাতি চরিত্রের এ-কবিতায় অন্তহীন জীবন ধারার যে শাশ্বত রূপচিত্রণ তা মোটেই সমৃদ্ধ চরিত্রের নয়। সভ্যতার যাযাবর বৃত্তিতেও জীবনের একই রূপ, একই চরিত্র যেন এক অমোঘ, অনড় দৃশ্যচিত্র। আর তা প্রকাশ করেছে অসাধারণ এই কবিতাটি, যা সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিযোগ্য। এর শেষ কথা :

যেখানেই যাও চ’লে, হয়নাক জীবনের কোনো রূপান্তর

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর

মস্নান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙক্ষার ঘর!

সুস্পষ্টভাবে একটি পঙ্ক্তিতেই জীবনভাষ্য, তার অমোঘ, নির্মম চরিত্র নিয়ে দেখা গিয়েছে, এবং তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, ‘তোমরা’ শব্দটির ব্যবহারে। এই প্রেক্ষাপট আরো একাধিকই নয়, বহুসংখ্যক কবিতায় ‘আমরা’ শব্দটির প্রয়োগে পরিস্ফুট। এ-বৈশিষ্ট্য তাঁর ইতিহাস-চেতনার অংশবিশেষ। এবং তা বৈশ্বিক চরিত্রের।

পাশাপাশি আরেকটি কবিতা ‘শীত রাতে’র প্রথম পঙ্ক্তিটিই হলো মৃত্যু নিয়ে। শহর-গ্রাম নিয়ে, মানুষ, প্রাণী, অরণ্য নিয়ে পুরোপুরি নেতিবাচক চেতনার প্রকাশ। এবং তা কবির প্রিয় শীত রাতে :

এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

 

পাঁচ

এমন এক নেতি ও ইতিবাচক চেতনানির্ভর জীবন-মৃত্যুর পর্যালোচনায় সাতটি তারা যে তিমির ছড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে নগর-সভ্যতা ও নগর-সংস্কৃতির নির্মম রূপটিই সত্য হয়ে দাঁড়ায়। তার সঠিক রূপ প্রকাশ পায় নাগরিক রাত্রিতে। নিশ্চয়ই কবির মনে তুলনা জেগেছে বহু চেনা গ্রামীণ প্রাকৃত পরিবেশের সঙ্গে। তাই তির্যক কথকতা শেষ হয় নগর-সভ্যতার মুখোশ উন্মোচনে :

নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়

লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।

তবু জন্তুগুলো আনুপূর্ব – অতিবৈতনিক

বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।

নিগ্রোর অনুভবে কথা কটি বলা হলেও এত ইতিহাস-চেতনার কবি জীবনানন্দেরই উপলব্ধিজাত, তাঁর জীবনদর্শন বিশ্বসভ্যতা দর্শনের পরিশ্রম্নত পরিণাম। এবং তা ট্রাম-বাসের শহর কলকাতার প্রতীকে।

মাঝেমধ্যে গ্রাম, গ্রামীণ প্রকৃতি ‘হৃদয়ে হানা’ দিলেও এ-পর্বে, স্বতন্ত্র এক পর্বে নাগরিক সমাজ ও জীবন নিয়ে শল্যচেরা অনুভূতির প্রকাশ, নাগরিক মধ্যবিত্তের রূপকার কবি সমর সেনকে মনে করিয়ে দিলেও জীবনানন্দের তীক্ষ্ন পর্যালোচনার চরিত্রই আলাদা – যেমন নান্দনিক, তেমনি ধারালো, ধাতব।

কিন্তু বিচিত্র অভিজ্ঞতার তীক্ষ্ন তির্যক প্রকাশ ঘটাতে ঘটাতে এই পর্বেই কালবেলাপর্বের সূচনা। জীবনানন্দ যে বিষণ্ণ নেতিবাদীই নন, কেবল শীত আর অন্ধকার ও মৃত্যুর কবিই নন, তার প্রমাণ মেলে এ-পর্বের শেষার্ধে এসে, ‘অনুসূর্যের গান’ কবিতাটি থেকে। সমাজকে কাটাছেঁড়া করে অবশেষে কবি চেতনায় ‘তিমির বিদারী উদার অভ্যুদয়’, বলতে হয় রৌদ্রকরোজ্জ্বল মানবিক চেতনার জয়। প্রশ্নবোধক বক্তব্যে তার শুরু :

আজকের সমাজ

সকলের কাছে থেকে চেয়েছে কি নিরন্তর

তিমির বিদারী অনুসূর্যের গান।

শেষ পঙ্ক্তিটিতে কিন্তু প্রশ্নবোধক চিহ্নের বদলে দাড়ির আবির্ভাব। দীর্ঘ বিশ্বপরিক্রমা শেষে কবি জীবনানন্দের কাব্যদর্শনের পার্শ্বপরিবর্তন – শীতার্তি থেকে উষ্ণতা-উত্তাপ আহরণের আন্তরিক প্রয়াস ও প্রকাশ।

তাই ‘তিমির হননের গান’-এ বহুউদ্ধৃত পঙ্ক্তি যেখানে পরিস্ফুট তিমির বিলাসীর তিমির বিনাশী হয়ে ওঠার আকাঙক্ষা। এমনকি ভাবনা : ‘কোথাও নতুন দিন রয়ে গেছে নাকি।’ এমন অনুষঙ্গে কবিতাগুলো ‘রোদ্রের’ আলো আর উত্তাপমাখা – যেন অন্য এক কবি জীবনানন্দ। নামেই এদের এক ও অনন্য চরিত্রের প্রকাশ। যেমন ‘সৌর করোজ্জ্বল’, ‘সূর্যতামমী’, ‘সূর্যপ্রতিম’ ইত্যাদি কবিতায়।

চলিস্নশের দশকের দ্বিমাত্রিক বাস্তবতা, সমাজ-রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা ইতি ও নেতির টানে জীবনানন্দের শৈল্পিক-চেতনায় কি ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটায়? দূষিত সমাজের লক্ষণ চোখে পড়ে (‘বিপস্নবী কি স্বর্ণ জমায়’)। চেতনায় ‘জেগে ওঠে উনিশশো তেতালিস্নশ, চুয়ালিস্নশ’। এখানেও সমাজ আলো-আঁধারে বিভাজিত। তবে কবি-চেতনায় আলোর প্রাধান্য।

এমন এক সময়-পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ‘কালবেলা’য় প্রবেশ। এবং তার নান্দীপাঠের সেত্মাত্র ‘মাঘসংক্রান্তির রাতে’ – যেখানে এক ভিন্ন প্রত্যয়ের উচ্চারণ :

হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে

তোমার পবিত্র অগ্নিজ্বলে।

আর নয় অন্ধকার। এখন সূর্যতপস্যার সময়। ‘সূর্য নক্ষত্র নারী’দের নিয়ে তাঁর যাত্রা ‘মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে’ মুহূর্তকে ‘অনন্ত’ করে তোলার বাসনায়। তাই ভিন্ন প্রত্যয় : ‘বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই – আমি বলি না তা’। এ-পর্বে সর্বত্রই সূর্যবন্দনা, ‘উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে’ যাত্রা, তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা, জীবনদর্শনে ভিন্ন ইতিবাচক মাত্রা, কিন্তু সমাজদূষণকে বাদ দিয়ে নয়। সেখানে কবির পর্যবেক্ষণ বরাবরের মতোই তীক্ষ্ন। কিন্তু রয়েছে ‘সৃষ্টির বিষের বিন্দু’ অতিক্রম করার চেষ্টা।

সংক্ষিপ্ত বিচারে বলতে হয়, জীবনানন্দ দাশ আলো-আঁধার, জীবন-মৃত্যু, প্রেম-অপ্রেম, শীত-হেমন্তের স্বাদেশিক ও বৈশ্বিক চেতনার কবি হয়েই একান্তভাবে মানবিক বোধের, সুস্থ সমাজ ও তেমনি সুস্থ মানব-মানবীর সহযাত্রী। নারীর প্রতি আর বিতৃষ্ণা নয়। উদার ও মুক্তচেতনার কবি, কালবেলার কবি জীবনানন্দ দাশ।

বিপুলসংখ্যক অগ্রন্থিত কবিতা জীবনানন্দের এই দ্বৈত-চেতনা ও বৈপরীত্যের প্রমাণ ধরে রেখেছে। ‘ডায়ালেকটিক্স’ শব্দটি তাঁর কাব্যভুবনে প্রবেশ করেছে যথাযথ তাৎপর্যে। তবু শেষ মূল্যায়নে জীবনানন্দের কবিতায় মনে হয় একাকিত্ব, বিষণ্ণতা, অপ্রাপ্তির ক্ষোভ ও মৃত্যু-চেতনার ভার হয়তো-বা বেশি। এ হলো সমাজ-বাস্তবতা ও জীবন-বাস্তবতার দান। r