মানবতন্ত্রী গৌরকিশোর ঘোষ

গৌ রকিশোর ঘোষের জন্ম যশোরে ১৯২৩ সালে। বাবার কর্মসূত্রে হাতেখড়ি হয়েছিল সিলেটের চা-বাগানে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক নবদ্বীপে। তারপর কর্মের অন্বেষণে পা বাড়ান নগর কলকাতায়।

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সর্বোপরি জনপ্রিয় হয়েছিলেন মানুষ গৌরকিশোর। যে-মানুষ জীবনের প্রতিটি কাজে জড়িয়ে ছিলেন তাঁর মহৎ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। তাঁর জীবনের মন্ত্র ছিল ‘বন্দে মানবম’। তিনি লিখেছেন, ÔI believe in love, for love and only love makes a man humanÕ (সোহিনী ঘোষ, ‘লোকটা’, দেশ, ২০ জানুয়ারি ২০০১)। এই বোধ তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা থেকে। গৌরকিশোর ঘোষের বিখ্যাত উপন্যাস প্রেম নেই গ্রন্থে তাঁর পরিচয় মুদ্রিত হয়েছিল, সেখানে ১৯৪১-৫২ সাল পর্যন্ত তাঁর পেশার উল্লেখ ছিল : ‘প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ফিটার। ও-আর-পি রেস্কিউ সার্ভিসের খালাসি, রেস্তোরাঁর বয়, কাঠের কনট্রাক্টর, রোড সরকার, বিমান জাহাজের ফিটার, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, রেশন দোকানের কেরানি, ইস্কুল মাস্টার, ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট, ভ্রাম্যমাণ নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার, সর্বোপরি মোসাহেব।’ বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ করে খুব কাছ থেকে নানা রঙের নানা বর্ণের মানুষকে দেখেছেন, তাদের ভালোবাসা পেয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন। এ-কারণেই ‘বন্দে মানবম’ তাঁর জীবনের মন্ত্র হয়ে উঠেছে। মোসাহেবির উল্লেখে নিজেকে নিয়ে কৌতুকের

ব্যাপারটি ফুটে উঠেছে। কৌতুকপ্রিয়তা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অম্লান দত্তের মতে, ‘প্রেম, সদিচ্ছা, কৌতুকবোধ, নির্ভীকতা, এই ছিল গৌরের ব্যক্তিত্বের মূল উপাদান।’ (‘ওকে যেমন দেখেছি’, দেশ, ২০ জানুয়ারি ২০০১)।

গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কলকাতায়, ১৯৮১ সালের বইমেলায়। তাঁর সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের কবি দাউদ হায়দার। আমি এবং আমার স্বামী ভূঁইয়া ইকবাল মেলার মাঠের মধ্য দিয়ে স্টলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, মুখোমুখি গৌরকিশোর ঘোষ। ইকবালকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আমি শুনেছি তুমি কলকাতায় এসেছো, কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করোনি। ভাবছিলাম পুলিশ দিয়ে ধরে আনবো কি না।’ ওঁর কথার রসটুকু প্রথম আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। মানুষটির সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে ওঁকে চিনেছিলাম। ইকবালের সঙ্গে ওঁর ’৭২ সাল থেকে পরিচয়। ওকে স্নেহ করেন এবং প্রশ্রয়ও দেন টের পেলাম। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। রবিবারের এক সকালে ওঁর চুনিবাবু বাজারের পাশে সরকারি আবাসনে গেলাম। ছুটির দিন বলে পরিবারের সবাই বাড়িতে ছিলেন। সাদর অভ্যর্থনার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী, কন্যাদ্বয়, পুত্র – সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শাহানা, সোহিনী, আপ্পা, ওদের মা শীলা ঘোষ – সবাই মিলে এমনভাবে আমাদের গ্রহণ করলেন যে আমরা এমনটি আশা করিনি। শীলা বউদির আতিথেয়তা এতটা আন্তরিক, প্রথমদিন থেকে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একই রকম উষ্ণতা পেয়েছি। তাঁর হাসি-হাসি মুখটা আমার এখনো চোখে ভাসে। গৌরদার বাড়িতে প্রথম দিনের গল্পটা  ছিল দাউদের। কথক গৌরদা। দাউদ ১৯৭৪ সালে সংবাদ পত্রিকার পাতায় একটা কবিতা ছাপিয়ে সারাদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল, মৌলবাদীরা মিছিল করে ওর মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কলকাতায় গৌরদার বাড়িতে আশ্রয় নেবে। দাউদ বাড়ি চেনে না, পরিবারের সবাই ব্যালকনিতে ঝুঁকে পড়েছে ওকে পথ দেখানোর ইচ্ছায়। ওরা দাউদকে চেনে না, দাউদ ওদের চেনে না। বাস থেকে নামছে এমন প্রতিটি লোককে খুঁটিয়ে দেখেন দাউদ কি না। এমন সময় বাংলাদেশের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান মৌচাকের প্যাকেট হাতে এক ব্যক্তি নামে, ওরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে এবং পথ দেখাতে সাহায্য করে। গৌরদা এমনভাবে গল্পটা বলেছিলেন আমরা মজা পেয়েছিলাম। রবিবার গৌরদার বাড়িতে যাঁরা যেতেন, মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরে আসতেন। ওটাই বোধহয় ওই বাড়ির রীতি। রীতি অনুযায়ী আমরাও দুপুরে খেয়ে বাড়ি ফিরলাম।

এক রবিবার গিয়ে দেখি বেশ ক’জন নামিদামি ব্যক্তি বসার ঘরের শতরঞ্চিতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আজকাল পত্রিকার প্রকাশক প্রতাপকুমার রায় ও তাঁর স্ত্রীও ছিলেন। তিনি সে-সময় ‘সুখাদ্য সুবচন’ নামে কলকাতার বিভিন্ন রেস্তোরাঁর ভালো ভালো খাবারের হদিস দিয়ে আজকালের পাতায় একটি জনপ্রিয় কলাম লিখতেন। ঘরে ঢুকে শতরঞ্জির একপাশে আমরাও বসে পড়লাম। আজকের আড্ডার বিষয় ছিল সাম্প্রতিক সময়ের সমস্যাসঙ্কুল কলকাতা। নানা কথার মাঝে হঠাৎ গৌরকিশোর ঘোষ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কলকাতায় খাবার জলের পাইপের মধ্যে সুয়েরেজের পাইপ ঢুকে গেছে, এখন কী হবে?’ আমি কিছু না ভেবেই হঠকারী উত্তর দিলাম, ‘শহরটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেই হয়।’ কথাটা শুনে বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমার মতো অর্বাচীনকে কিছু বললেন না। পরে বুঝেছি আমার এই কথায় মানবহিতৈষী, দেশপ্রেমিক লোকটা কতটা আহত হয়েছিলেন। আমার ধারণা, বয়সের কারণে (আমার তখন সাতাশ বছর) আমি তখন তিরস্কৃত হইনি। কলকাতায় তখন মেট্রোর কারণে রাস্তা খোঁড়া, প্রচণ্ড যানজট, জ্বালানির অভাব, বাজারে তেল পাওয়া যায় না ও টেলিফোনের অব্যবস্থা –  এসব দেখেই আমার এই মন্তব্য। অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যেই কলকাতা এই সংকটগুলো কাটিয়ে উঠেছিল। এখন ভেবে দেখি, সংকটপূর্ণ কলকাতাও আমার প্রিয় ছিল, না হলে বারবার আমি কেন যেতাম। যাবার কারণ কলকাতার মানুষগুলো। লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী বা যাঁরা কোনো পেশায় জড়িত নন, যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছি, তাঁদের আন্তরিকতায় আমরা এতটাই আবিষ্ট যে, দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তাবে আমরা এখনো কলকাতাকেই বেছে নিই।

পরের বার বাড়িতে গেলে গৌরদা আমাকে দুটো জিনিস উপহার দিয়েছিলেন। একটা দুর্লভ রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন। রেকর্ডটি ছিল ’৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কালে বাংলাদেশি গায়ক আবদুল আলীমের গাওয়া দুটি গানের রেকর্ড। প্রায় দুশো রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল তাঁর। রেকর্ড কীভাবে ভালো রাখা যায় তার কৌশলগুলো জানিয়েছিলেন। এছাড়া তিরিশের দশকের মোহাম্মদী পত্রিকার বাঁধানো দুটো সেট আমাকে  উপহার  দিয়েছিলেন, যা আমার থিসিসের কাজে সহায়ক হয়েছিল। প্রেম নেই উপন্যাস লেখার সময়ে তিনি ওগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। আমায় বলেছিলেন, আমার থিসিসের উপাদান আমি ঠাকুরপুকুর লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করতে পারব। কারণ প্রেম নেই উপন্যাস লেখার সময় তিনি ঠাকুরপুকুর লাইব্রেরি ব্যবহার করেছেন, ওখানে প্রচুর পুরনো পত্রিকার সংগ্রহ দেখেছেন।

গৌরদার বড় মেয়ে শাহানার বিয়ে হয়েছিল চুনিবাবু বাজারের পাশে সরকারি আবাসনের চত্বরে। আমরাও আমন্ত্রিত ছিলাম। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের ভাষা অপ্রথাগত। ওতে একটা বাক্য ছিল, কোনোরকম ভোজ্যদ্রব্য থাকবে না এবং কোনো উপহার গ্রহণ করা হবে না। আমি খুব উপভোগ করেছিলাম। নিমন্ত্রিত অতিথিরা বিয়ের আসরে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। খাবার তাড়া নেই, বর-কনে সবার সামনে বিয়ে রেজিস্ট্রি করল। বিয়ের কোনো আচার ওখানে পালিত হয়নি। তবে অতিথিরা শুকনো মুখে গল্পগুজব করেনি। সামনে বিজলি গ্রিল ক্যাটারারের চা, কফি, পাকোড়া সাজানো ছিল। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে ওগুলোরও সদ্ব্যবহার হলো। অনেক চেনামুখের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার মনে পড়ে মীনাক্ষী দত্তের কথা (বুদ্ধদেব বসুর বড় মেয়ে), ওঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম। বেশ ছিমছাম বিয়ে, এমন বিয়ে আমি এর আগেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।

গৌরদার বিয়েরও একটা গল্প আছে। নিজেই বলেছিলেন গল্পটা। ওঁর বিয়েতে বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাঁরা উপস্থিত থাকবেন দু-টাকা দিয়ে কুপন কিনে খাবেন, ওঁর এক কাকা বিয়েতে উপস্থিত হয়ে ওই ব্যবস্থা দেখে খুব ক্ষেপে গেছেন। গৌরকিশোর তাড়াতাড়ি একটা কুপন কিনে কাকার হাতে গুঁজে দেন।

গৌরকিশোর ঘোষের নতুন বাড়ি বিধান নিবাস, বিধান শিশু সরণিতে, নতুন বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তিনি চট্টগ্রামে ইকবালকে একটা চিঠি লিখেছিলেন ১১ আগস্ট, ১৯৮৬ সালে।

প্রিয়বরেষু ভূঁইয়া,

… যে কয়েকজনের সঙ্গ ভাল লাগে এবং পেতে ইচ্ছে করে তার মধ্যে তুমি ও টুকু আছ। এখন একটা মাথা গোঁজবার ঠাঁই আমাদের হয়েছে। এটাকে তোমরা ঠেক হিসেবে ব্যবহার করলে খুশি হব।

ভালবাসা জেনো

গৌরদা

কলকাতায় গৌরদা আইসিসিআরের অতিথি ভবনে এসেছেন।  দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে খুলে আমি তো অবাক। গৌরদা দাঁড়িয়ে আছেন। আনিস স্যারের খোঁজে এসেছেন। পাশের ঘর থেকে স্যারকে ডেকে আনি। দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। স্যারের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য বইটি ওঁর প্রেম নেই উপন্যাস লেখায় সহায়ক হয়েছে। ফিরে যাওয়ার সময় স্যারকে ওঁর বাড়িতে রাতের খাবারের নিয়ন্ত্রণ করলেন, সঙ্গে আমাদেরও। খাবার টেবিলেও গল্পগুজবে জমে উঠেছিল। ম্যানিলায় ম্যাগসেসে পুরস্কার দেওয়ার সময় উপস্থাপক ‘গরুকিশোর ঘোষ’ নামে তাঁকে মঞ্চে ওঠার আহ্বান করেন। বউদিও কথাটির সমর্থন জানান। গৌরদার বলার ভঙ্গিতে আমরা সবাই হেসে ফেলি। বউদি ওঁদের বাড়ির দশ-এগারো বছরের কাজের ছেলেটাকে দেখিয়ে স্যারকে বলেন, ‘ও গল্প লেখে।’ স্যার বললেন, ‘এক ঘরমে দো পির।’ হাসি-গল্পে ওই সন্ধেটা আমাদের বেশ ভালো কেটেছিল।

গৌরদার পরিবারের সবাই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। ছোটবড় সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতো। ‘বাড়িতে প্রচলিত ছিল ‘বাঙালি প্রথা, বাঙালি আড্ডা ও আতিথেয়তা এবং ইউরোপীয় স্বাধীনতার মিশ্রণ ছিল তাদের জীবনে।’ (মীনাক্ষী দত্ত, ‘অ্যালবাম থেকে কয়েকজন’, কলকাতা ২০০৭, পৃ ১৪২)

দিনক্ষণ ঠিক করে গৌরদা চট্টগ্রামে আসবেন ও আমাদের বাড়িতে উঠবেন বলে  ইকবালকে চিঠি লিখেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সম্ভবত ডাকের গোলযোগের কারণেই চিঠিটি আমাদের হাতে পৌঁছোয়নি। গৌরদা চট্টগ্রামে এসে পৌঁছে শোনেন আমরা ঢাকা গেছি। ছড়াকার এখলাসউদ্দিন সাহেব ওঁকে আর্ট প্রেসের শফি সাহেবের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। মিসেস শফির আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় গৌরদা ভালোই ছিলেন। চট্টগ্রামে ফিরে লজ্জিত হয়ে  ওঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। ওঁর তখন চট্টগ্রামবাসের সময় শেষ। পরদিন ঢাকা চলে গেলেন। আমরা কুণ্ঠিত হলেও ওঁর ভাবখানা ছিল ‘এমন তো হতেই পারে’। সেবার তিনি ঢাকা থেকে খুলনা গেছিলেন স্টিমারে। খুলনা থেকে একই স্টিমারে ফিরে আসেন। পদ্মা, মেঘনা ও অন্যান্য নদী ছাড়াও নদীপাড়ের মানুষগুলোকে নিবিড়ভাবে দেখেছিলেন তিনি।

পরেরবার কলকাতায় গিয়ে শুনি গৌরদা অসুস্থ। হার্টের অপারেশনের পর তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। ওঁর বাড়িতে ফোন করলে বউদি কথা বলে ফোনটা ওঁকে ধরিয়ে দেন, জড়িয়ে কথা বলছিলেন গৌরদা, তবুও তিনি ওঁর বাড়িতে যেতে এবং খেতে বললেন। একে তো রোগীর সেবা, তার ওপরে খাওয়ার আয়োজন, বউদির এই অবস্থায় আমরা তাঁকে বিব্রত করতে চাইনি। আমাদের দ্বিধা দেখে উৎপলদার (সম্প্রতি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন) অভিজ্ঞ মন কী ভেবেছিল জানি না। আমরা উৎপলদার জন্য বাধ্য হয়েই গেলাম গৌরদার বাড়িতে। প্রায় সারাদিন ছিলাম। হাত দিয়ে দেখিয়ে বিছানায় ওঁর পাশটিতে বসতে বললেন। অস্পষ্ট উচ্চারণে কত কথা বললেন। দুপুরে খেয়ে আবার ওঁর পাশটাতে বসলাম। পড়ন্ত বেলায় আমাদের বিশ বছরের চেনা উৎপলদা ও ইলা বউদির পার্ক সার্কাসের ‘অনন্যা’ নামের বাড়িটাতে ফিরে এলাম। তখনো জানি না এটাই গৌরদার সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা, আর কোনোদিন তিনি তাঁর বাড়িতে আমাদের ডাকবেন না।

গৌরদা চলে যাওয়ার পরও আমরা ঘনিষ্ঠতার সুতোটুকু ছেঁটে ফেলিনি। আবার গেছি ওই বাড়িতে, এবার বউদির সঙ্গে দেখা করতে। বউদি আগের মতন হাসিমুখেই অভ্যর্থনা জানালেন। ছেলে  আপ্পা, ছেলের বউ পত্রালি, নাতনি ফুলটুশির সঙ্গেও দেখা হলো।  মেয়েরা নিজ নিজ বাড়িতে। ছোট মেয়েকে ফোন করে যা বললেন ‘বাড়িতে কেউ এলে তোমরা বল গেস্ট, আমরা বলি আপন মানুষ’, আমাদের আগমনের বার্তাটুকু জানালেন। ‘স্বয়ম্ভরা নারী’ নামের খেটে খাওয়া নারীদের একটি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন বউদি, আরো একটি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন – নদীয়ার ‘শ্রীমা মহিলা সমিতি’র। প্রতিবারই ‘স্বয়ম্ভরা নারী’র কর্মীদের হাতেবোনা আসন, তাদের তৈরি ব্যাগ আমাদের উপহার দিতেন। এবারো দিলেন, সঙ্গে দিলেন গৌরকিশোর ঘোষের আশি বছরের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁরই সদ্য প্রকাশিত গল্প সমগ্র।

আমরা বউদির সঙ্গে দেখা করতে যাব, সেই দিনটিতে বউদি মেয়ে, জামাই, নাতনিদের ডেকেছেন, বাড়িতে ছিল ছেলে, বউ আরেক নাতনি। সেবার আসর খুব জমে ছিল। সাংবাদিক মেয়ে ও অধ্যাপক মেয়ে ওদের বিষয়ের গল্প করছিল, মাঝে মাঝে আমাদের দেশের সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিল। ছেলের বউ পত্রালি ওর অধ্যাপনার কথা জানিয়েছিল। আমরা যাওয়ার আগের দিন হোলি ছিল, বউ পত্রিকায় প্রকাশিত ওদের রং খেলার ছবিটি দেখিয়েছিল। হাসিমুখে আপ্পাও আমাদের গল্পে যোগ দিয়েছিল। আমার এখনো মনে পড়ে চমৎকার একটি হাসিখুশি মাখা আমাদের সে-দিনটির কথা।

ইকবালের হাতে বউদির জন্য আমাদের দেশের একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ি পাঠিয়েছিলাম। পরের দিন ইকবাল সোহিনীর বাড়ি গেছে। খবর পেয়ে বউদি ঝটপট শাড়িখানা পরে ইকবালকে দেখাতে এসেছিলেন; কিন্তু তার আগেই ইকবাল ও-বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর পরের খবর ইকবাল আর বউদিকে দেখবে না, আমিও না। বউদি পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখ ছেড়ে অপার্থিব জগতে চলে গেছেন। এঁদের ভুলি কেমনে?

মানুষ গৌরকিশোরকে আমরা খুঁজে পাই তাঁর জীবনাচরণের মধ্যে, তাঁর সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ায়, পরিবারের সদস্যদের  অভিজ্ঞতায়, বিবরণে। ছোট মেয়ে সোহিনী বাবার জীবনদর্শন তুলে ধরেছে তার একটি রচনায়। পরিবার নিয়ে গৌরকিশোর স্নানে যেতেন গঙ্গায়। বড় মেয়ের জলে ভয়, তাই সে টুপ করে ডুব মেরে উঠে যেত পাড়ে। বাবার ইচ্ছে ছেলেমেয়ে জলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কেটে নদীর সঙ্গে যুঝুক। তাই ভীতু মেয়েটাকে পানিতে ছুঁড়ে দেন। মেয়ে খাবি খেতে খেতে হাত-পা ছুড়ে ডাঙায় এসে পৌঁছে। ধীরে ধীরে তার ভয় ভাঙে, বাবার মতে, ‘ভালোবাসো বা ঘৃণা করো, সম্পর্ক তৈরি করতে হবেই হবে জলের সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে।’

ছোট মেয়ে ঋতুমতী হলে মা বাবাকে জানিয়েছিলেন। বাবা তাকে পাশে নিয়ে শুয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ মেয়ে হলে বাবা। এখন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার। ভালোমন্দের সব দায়দায়িত্ব নিজের।’

ছেলে নরেন্দ্রপুর মিশন স্কুলে পড়ত। ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি হলে মা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তিনি নির্দ্বিধায় মস্তক মুণ্ডন করেন। লোকজনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তর দেন এইভাবে, ‘আমার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মাতৃবিয়োগের চেয়ে কম কি?’ তাঁর মতে, দেশের স্বাধীনতার মৃত্যু মায়ের মত্যুর শামিল। বাবার মুণ্ডিত মস্তক দেখে কিশোর ছেলে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। বাবা বাড়ি ফিরে চিঠিতে এর উত্তর দেন, ‘পিতার পত্র’। ‘আবার ছুঁড়ে জলে ফেলে দিল ছেলেটাকে লোকটা। জানে হাত-পা ছুড়বে, জল খাবে, খাবি খাবে, কিন্তু ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করবেই ছেলে। জলের সঙ্গে – স্রোতের সঙ্গে পরিচয় হবে তার। … এইভাবে লোকটা পরিচয় করালো জীবনের সঙ্গে তার আত্মজা-আত্মজদের। তার শিক্ষা দেওয়া হয়ে গেল, মন্ত্র দেওয়াও, দীক্ষা দেওয়া।’ (সোহিনী ঘোষ, ‘লোকটা’, দেশ, ২০ জানুয়ারি ২০০১, পৃ ৩৫)

শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, তপন সিংহ, বিমল কর, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মানসী দাশগুপ্ত, আবদুর রউফ, হোসেনুর রহমান, গৌরী আইয়ুব এবং মীনাক্ষী দত্ত নানা পরিচয়ের গৌরকিশোর ঘোষকে তুলে ধরেছেন তাঁদের রচনায়। মীনাক্ষী দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ১৯৬৬ সালে গৌরকিশোর ঘোষ ওঁদের শিকাগো-নিবাসে আসবেন। খ্যাতিমান ব্যক্তি ওঁদের ছোট ফ্ল্যাটে উঠবেন, এক দ্বিধায় পড়েছিলেন। ‘গৌরদা কিন্তু আক্ষরিক অর্থে এলেন, দেখলেন ও জয় করে নিলেন।’ স্থান সংকুলানের কথা ভেবে মীনাক্ষী তাঁদের ওপরতলার বিদেশি বন্ধুর অতিথিকক্ষে গৌরকিশোরের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যবস্থা তিনি ‘দূর’ বলে বাদ দিয়ে ওঁদের ফ্ল্যাটের পেছন দিক কাঁচের জানালা ঘেরা বারান্দাটি বেছে নিয়েছিলেন। বারান্দায় একটা দরজা ছিল বাড়ির পেছনের ঘাসজমিতে যাওয়ার, ওটাই তাঁর পছন্দ। মীনাক্ষী রঙিন চাদর, কুশন, টেবিল ল্যাম্প, সরু লেখার টেবিল দিয়ে ঘরটি সাজিয়ে দিলেন। মীনাক্ষী লিখেছেন, ‘সেখানেই গৌরদাকে ঘিরে আমাদের শিকাগোর গ্রীষ্ম মনোরম হয়ে উঠলো। … গৌরদা ছিলেন বুদ্ধিমান, সুরসিক, পরিশ্রমে যেমন আড্ডাতেও তেমনি অক্লান্ত। ঘরে তিনি উপস্থিত থাকলে সকলে চুম্বকের মতো তাঁর প্রতি ধাবিত হয়। গৌরী (আইয়ুব) একবার বলেছিল, ‘গৌর যখন ঘরে ঢোকেন তখন বোঝা যায় না তিনি কত সুন্দর, কিন্তু তিনি যখন চলে যান তখন উপস্থিত সকলের কাছে তিনি সুন্দরতম মানুষ’।’ (মীনাক্ষী দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ : অ্যালবাম থেকে কয়েকজন, কলকাতা, ২০০৭, পৃ ১৪১)

এই কলকাতায় (১৯৫২) গল্পগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যভুবনে গৌরকিশোর ঘোষের আত্মপ্রকাশ। তাঁর সাহিত্য-দর্শন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক যে নিবিড়, এই কথাটা শুনি অন্নদাশংকর রায়ের মুখে ৩৬-৩৭ বছর আগে। … তরুণ বয়সে কথাটা শুনেছিলাম বলেই হোক কিংবা অন্নদাশঙ্কর কথাটা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন বলেই হোক, আমার কাছে ওটা লেখক জীবনের মন্ত্র হয়েই রয়ে গেল।’ (গৌরকিশোর ঘোষ, ‘জীবন, সত্য, সাহিত্য’, জিজ্ঞাসা,    শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৯০, পৃ ১১৭)

এই কলকাতায় গল্পগ্রন্থটি নামহীন দশটি কাহিনিতে বিধৃত লেখকের কলকাতা-দর্শন। দ্বিতীয় গ্রন্থ মন মানে না (১৩৬৬); পরেরগুলো সাগিনা মাহাতো (১৯৬৯), আমরা সেখানে (১৯৭০), পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী হা হা (১৩৭৮)। সাগিনা মাহাতো গল্পগ্রন্থের ‘সাগিনা মাহাতো’ গল্পটি নিয়ে তপন সিংহের পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নামভূমিকায় দিলীপ কুমার অভিনয় করেন। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পের সঙ্গে চলচ্চিত্রটির তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘গল্পটা এত ভাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু লেখার দোষে একটা ভাল গল্প হয়ে দাঁড়াল না। অথচ এই গল্পেই আমি প্রথম আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে অনেকটাই মেলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। সত্যকে অনেক স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সাগিনার চরিত্রে যে একটা ভাব ছিল, দুর্দান্ত নেতৃত্ব ছিল, যৌনতৃপ্তিতে তার কোনো বাছবিচার ছিল না, তার বিচার বিবেচনা বাহ্য জগতের শৃঙ্খলার ধার ধারেও না, মদের নেশা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত এবং মারদাঙ্গায় সে পিছপা হত না, এই সব নিয়েই সাগিনা ছিল অতিবিশ্বস্ত এবং স্নেহপরায়ণ বন্ধু এবং একটা নিটোল মানুষ; এই ব্যাপারটা আমার গল্পে যতটা গভীরতা নিয়ে ফুটে ওঠা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে, আমার গল্পটায় ঠিক তেমনভাবে এই চরিত্রটা ফুটে ওঠেনি।

‘আমার এই গল্প নিয়ে তপন সিংহ যে ফিল্মটা করেছিলেন … অভিনেতা দিলীপকুমার আশ্চর্য দক্ষতায় আমার খামতি মিটিয়ে দিয়ে সাগিনার চরিত্র অনেকটা কাছাকাছি চিত্রিত করে তুলেছেন। মজা এই যে, সাগিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমারই ছিল। তপন বা দিলীপ তাকে চোখেও দেখেননি। সৃষ্টি যে কোথায় কেমনভাবে হয় সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে।’ (জিজ্ঞাসা, পূর্বোক্ত, পৃ ১১৩)

আমরা সেখানে গ্রন্থে দুটি গল্প ‘বাঘবন্দী’ ও ‘তলিয়ে যাবার আগে’। গ্রন্থের শুরুতে লেখকের বক্তব্য : এ কাহিনীর নায়িকা কলকাতা –    যে কলকাতায় এখন প্রচণ্ড হিংস্রতা আর অন্ধ আতঙ্ক, এ দুটি প্রবৃত্তিই প্রবল। আর নায়ক : সময়, ১৯৬৯-৭০। বাকি সবাই পার্শ্বচরিত্র। গ্রন্থটি আরতি সেন ও গৌরী আইয়ুবকে উৎসর্গীকৃত।

পশ্চিমবঙ্গ প্রমোদ তরণী হা হা সাতটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলোতে সমকালের চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

এছাড়া বারোটি অগ্রন্থিত গল্প রয়েছে গৌরকিশোর ঘোষের। গল্পগুলি পূর্বে উল্লিখিত গল্পের মতো নয়। অগ্রন্থিত গল্পগুলো ‘অন্তর্মুখী’, ‘ঘটনাবিরল’, ‘নিম্নকণ্ঠ’, ‘অল্প কয়েকটি রেখার সুসম্পূর্ণ’। (অলোক রায়, ভূমিকা, গল্প সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৩)

উপন্যাসের ধারায় গৌরকিশোর ঘোষের অত্যন্ত মূল্যবান রচনা দেশ মাটি মানুষ। দেশ মাটি মানুষ কোনো নির্দিষ্ট উপন্যাসের নাম নয়, তিন খণ্ডে লেখা এপিক ট্রিলজি।

জল পড়ে পাতা নড়ে (১৯৬০), প্রেম নেই (১৯৮১) আর প্রতিবেশী (১৯৯৫) তিনটি স্বতন্ত্র উপন্যাস। কিন্তু আদতে একই উপন্যাসের পৃথক খণ্ড মাত্র। তিনটিতে গৌরকিশোরের অভিপ্রায় ছিল দেশবিভাগের ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরা। ট্রিলজির প্রথম খণ্ডের কাহিনির শুরু ১৯২২-এ, তৃতীয় খণ্ড শেষ হয়েছে ১৯৪৬-এ। ২৫ বছরের সময়সীমায় এই তিনটি গ্রন্থের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। প্রথম খণ্ড জল পড়ে পাতা নড়ের কাহিনির সঙ্গে দ্বিতীয়  খণ্ড প্রেম নেই’-এর কাহিনির  কিছুটা ধারাবাহিকতা আছে, কিন্তু তৃতীয় খণ্ডের কাহিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে ‘তিনটি খণ্ডেরই মূল বিষয়টি একই, অর্থাৎ বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং পঁচিশ বছরে তার বিবর্তন। যা গোড়ায় ছিল ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত সেটাই কী করে ক্রমে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পৌঁছে দেশকে খণ্ড খণ্ড করল তারই বস্তুনিষ্ঠ সহৃদয় চিত্রণ। ভারত-ইতিহাসের এই সুপরিচিত ট্র্যাজিডি গৌরের উপন্যাসেও দুটি মানব-মানবীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজিডিতে পরিণত হয়েছে তৃতীয় খণ্ডে এসে।’ (গৌরী আইয়ুব, ‘ভূমিকা’, প্রতিবেশী, ১৯৯৫)

গৌরকিশোরের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মনের বাঘ (১৯৬২), এই দাহ (১৯৩২), লোকটা (১৯৬৬), গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে (১৯৭২), এক ধরনের বিপন্নতা (১৯৮১), কমলা কেমন আছে (১৯৮৫)।

এই দাহ উপন্যাসে জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন গৌরকিশোর। উপন্যাসের নায়ক গোলক ছিলেন শিল্পী। ছন্নছাড়া এই শিল্পীর একদা যক্ষ্মা ধরা পড়ে। যক্ষ্মার চিকিৎসা করে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সে নীরোগ, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযুক্ত। কিন্তু বাদুড়ে মুখ দিলে যেমন ভালো ফলও পচে যায়, তেমনি টিবি স্যানাটোরিয়াম ফেরত মানুষ সম্পর্কে টিবিমুক্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি – সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গোলকের অন্তর্দাহের উপস্থাপনা।’ (রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘এই দাহ’, বিতর্কিকা, শীত ১৩৯০, পৃ ৪৩)

গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে উপন্যাসে গৌরকিশোর ঘোষের মতে, তিনি এবং তাঁর স্ত্রীর ছায়া পড়েছে। সংসারে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে একঘেয়েমি আসে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিত্বের টানাপড়েনে তিক্ততা আসে। বাইরের ঘটনার চাপ বা সময়ের প্রবল পীড়ন দুজনকে কাছে টানে বা দূরে ছুড়ে দেয়। নায়কের ব্যক্তিত্বের সংকট লোকটা উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এক ধরনের বিপন্নতা উপন্যাসে এক নারীর সঙ্গে প্রেমের অভিজ্ঞতা বর্ণিত। উপন্যাসে তিনটি নারী চরিত্র সৃষ্টি হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের একই সত্তা : লেখকের ভাষায় ‘আদতে তা একজনেরই চেহারা।’

সংস্কৃতি সম্পর্কে গৌরকিশোর ঘোষ বলেছেন, ‘গঙ্গা, পদ্মা এবং বাংলা ভাষা – এই তিনটি আদি প্রবাহ বাংলার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলার সংস্কৃতি আজও বাঙালি তৈরি করতে পারেনি। বাঙালি আজও নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে আছে। রাজনীতির কারণে ভৌগোলিক বিভাগকে আমি কখনোই বড়ো বলে মনে করিনি। আমাদের বড় ব্যর্থতা বহুধা-বিভক্ত আমাদের মনে। আমরা আমাদের নিজস্ব ধারায় আজও সংস্কৃত হতে পারিনি।’ (‘গঙ্গা, পদ্মা, বাংলা ভাষা’, সাহিত্যমেলা, ১৯৮২)

বাঙালি সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে হলে সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তার মধ্যে বিয়ে একটি উত্তম পন্থা। বিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয় সম্বন্ধ বিস্তার করে। অসম সম্প্রদায়ের বিয়ে দুটি সংস্কৃতির ধারার মিলন ঘটায়। পরস্পরের ভাব বিনিময়ে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়।

সন্তানদের নামকরণও বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করে। মুসলমানদের আরবি-ফার্সি এবং হিন্দুদের সংস্কৃত নাম রাখা দুটো সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে। নামকরণের ক্ষেত্রে যে-কোনো ভাষার অর্থপূর্ণ সুন্দর শব্দটিই বেছে নেওয়া উচিত। নামকরণের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলা সম্ভব।

মানুষের জীবনে ধর্মের গুরুত্ব কতটা তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে আধুনিককালে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, বর্তমানে ‘রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক ব্যাপারে ধর্মের নির্দেশকে শেষ কথা বলবার অধিকার দেওয়া হয়’, তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস করা এই দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। তাই ধর্মকে ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় মনে করে সংস্কৃতিচর্চার মুক্তধারাকে বিকশিত করা উচিত।

গৌরকিশোর ঘোষের মতে, ‘আমরা যারা আজকের কালে সাহিত্যকর্মে নিযুক্ত তাদের উপর একটা দায় বর্তেছে। … বাঙালি    সংস্কৃতির  …  চরিত্রটি   বোঝা এবং সেটিকে প্রকাশ করার সাহস রাখা।’ (গৌরকিশোর ঘোষ, ‘গঙ্গা, পদ্মা, বাংলাভাষা’, সাহিত্যমেলা, ১৯৮২, পৃ ২৩)

সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর অবদানের জন্যে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর খ্যাতির মূলে ছিল সাংবাদিক ক্ষেত্রে তাঁর সত্যনিষ্ঠতা ও নির্ভীকতা। নববাণী পত্রিকায় যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু। পরের পত্রিকা সত্যযুগ। এরপর আনন্দবাজার। আনন্দবাজারে যুক্ত থাকাকালে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান। পরের পত্রিকা আজকাল। এখানে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজকাল ছেড়ে দিয়ে সরাসরি কোথাও যুক্ত হননি। আনন্দবাজারে সম্পাদকীয় লিখতেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কলকাতার দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার খবর সংগ্রহ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দাঙ্গা-বিধ্বস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। একটা সময় দেশ পত্রিকায় গৌরকিশোর ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে নিয়মিত নকশা জাতীয় রচনা লিখতেন। কলকাতা শহরের বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সন্ধান করতেন। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে তিনি কলামটি লিখতেন। বিমল কর তাঁকে ডেডিকেটেড সাংবাদিক বলেছেন। তাঁর মতে, গৌরকিশোরের বিদ্যাবুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা, সবই মানবিক ও আদর্শবাদী। (বিমল কর, ‘গৌরকিশোর’, দিনক্ষণ, ১৪০১, পৃ ৩২)

‘রূপদর্শী’র মতো গৌড়ানন্দ কবি ছদ্মনামে গৌরকিশোর দীর্ঘদিন একটা কলাম লিখেছিলেন। এই রচনাগুলির বিষয় রাষ্ট্রনীতি অথবা রাজনীতি, সামাজিক অসংগতির চিত্র এখানে নেই। ‘স্বভাবতই রূপদর্শীর রচনায় কৌতুকের সঙ্গে যে সহানুভূতি ও মর্মবেদনার স্পর্শ পাওয়া যেত, গৌড়ানন্দ কবির রচনায় সেটা মেলে না। তার বদলে যা পাওয়া যায় তা শানিত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ।’ (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ‘গৌরকিশোর’, দিনক্ষণ, ১৪০১, পৃ ৩৮)

গৌড়ানন্দ কবি ছাড়া গজমূর্খ, বেতালভট্ট, কনকন গৌরতান মোল্লা প্রভৃতি ছদ্মনামে নকশা লিখেছেন গৌরকিশোর ঘোষ।

আজকাল সম্পাদক গৌরকিশোর স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি একটি দলনিরপেক্ষ সংবাদপত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার পেশায় মেয়েদের যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। এর আগে কলকাতার পত্রিকায় নারী সাংবাদিক নিয়োগের ইতিহাস নেই। সম্পাদক হিসেবে গৌরকিশোর ঘোষ দৈনিক আজকালকে যথার্থই একটি আধুনিক নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।

২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর পরিসমাপ্ত হয় এই মানবপ্রেমিক সত্যভাষণে অকপট সাহসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিকের গল্প-প্রতিম জীবনের। গৌরকিশোর ঘোষ যে জীবনযাপন করেছেন তা ছিল ব্যতিক্রমী ও অনাড়ম্বর। তিনি কেবল সফল সাংবাদিক ও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সর্বব্যাপী সহানুভূতি ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের জটিল রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি সব ধর্মের, সব পেশার মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাই ভাগলপুরের দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় বারবার ছুটে গেছেন উৎস খুঁজে বের করার জন্য এবং দাঙ্গায় আক্রান্তদের সেবাদানের উদ্দেশ্যে। সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর এই সহানুভূতি ও সহমর্মিতার জন্য বন্ধুরা তাঁকে ‘মৌলভী গৌরকিশোর’ বলে রসিকতা করতেন। বহু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আমৃত্যু তিনি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।