মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পভাবনা ও শিল্পদৃষ্টির স্বরূপ

নাসরীন জেবিন

জীবনবঞ্চিত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঔদার্য আর চিত্তমহত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবন কোনো চেতনার চলমান বিবৃতি নয়, বরং তা অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ। তাই সত্য ও সুন্দর জীবনের শৈল্পিক অপরিমিতিবোধ সাহিত্যের রসনিষ্পত্তিতে কখনো লেখককে বঞ্চিত করেনি। বিজ্ঞানমনস্কতা আর জীবনের প্রতি একনিষ্ঠ তৃষ্ণায় তাই বৈপরীত্যজনিত কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। কিশোর বয়স থেকেই মানিক সাহিত্যের শিল্পোৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। সে-সময় ভারতবর্ষের শিল্পবিপ্লব, ইউরোপীয় রেনেসাঁস রোমান্টিসিজমের উদ্ভব, বাংলার নবজাগৃতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মানুষের বিপর্যয় মনোবিকিরণ – এসবই মানিক মানববৃত্তি-বেষ্টিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেছেন। এ জন্য তাঁর অভিজ্ঞতা পরিম-লের জীবনতৃষ্ণা আর সাহিত্যচর্চা এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল। একদিকে তিনি মধ্যবিত্ত শিক্ষেত শ্রেণির জীবনকোষে যেমন গস্নানি, টানাপড়েন, ক্লেদকে দেখেছেন অন্যদিকে বিপন্ন-বিধ্বসত্ম শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়ের সুস্থতা ও প্রাণময় দক্ষতাও লক্ষ করেছেন।

পরাজয় স্বীকারে কুণ্ঠিতচিত্ত শ্রমজীবী মানুষ জীবনত্রয়ী সংগ্রামে সমগ্রতা দিয়ে আজীবন লড়ে যায় – এই বোধ মানিক তাঁর দৈন্যক্লিষ্ট বেদনামথিত অন্ত:সারশূন্য জীবন থেকেই উপলব্ধি করেছেন। আর এই জীবনদর্শন ও উপলব্ধিজাত অনুভূতিই মানিক-সাহিত্যের শিল্পকর্মকে উজ্জ্বল ও দৃষ্টিগ্রাহ্য করেছে। আবাল্য লালিত জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা আর প্রেরণাই তাঁর উদ্ভাসিত মানবশক্তির মূল উৎস। নিম্নঅধ্যুষিত মানবের জীবন-যন্ত্রণার প্রাবল্যও তিনি বিজ্ঞানপ্রীতি দিয়ে বিচার করেছেন। বিজ্ঞানের প্রত্যয়ই তাঁর চেতনাশ্রয়ী মূল্যবোধ শিল্পসমগ্রতা দান করেছে। ভাববাদ আর বস্ত্তবাদের ব্যবধান তাঁর সৃষ্টিকে গভীর দ্বন্দ্বে আস্থাহীন করে তুলেছিল। পরবর্তীকালে অতীত চিমত্মা-চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে বস্ত্তনিষ্ঠ সমাজ-সচেতনতাই তাঁর সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানিকের বস্ত্ত জাগতিক চিমত্মা-চেতনা অপ্রাপ্তির মহা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েও বিষয় অন্বেষণ, শিল্পদৃষ্টি ও শিল্পরীতিতে প্রোজ্জ্বল এবং আধুনিক হয়েছে। নৈঃসঙ্গ্যবোধের বেদনায় তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলেও যুক্তিশৃঙ্খল চেতনামগ্ন বাসত্মবতার রহস্য উন্মোচনে তাঁর মনের গভীরতম প্রদেশে বিজ্ঞানবোধ আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অধিক ক্রিয়াশীল ছিল। মানুষ ও মানুষের জীবনচিত্রই ছিল মানিক-সাহিত্যের মুখ্য বিষয়। সেখানে অবচেতন মনের বেদনার্ত অনুভূতি-অনুসারিত কল্পনার ঐশ্বর্য সর্বাত্মক হয়ে ওঠেনি। বস্ত্তজগৎ ও মনোজগৎ, হৃদয়জাত অনুভূতি, মননশীলতা, সর্বোপরি মানুষ – এগুলো নিয়েই তাঁর লেখকসত্তা আলাদা মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। তাঁর সামগ্রিক নৈতিকতাবোধ, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমসাময়িক যুগ, ধর্ম প্রতিটি সৃষ্টির শরীরে অনুভবময় আনুগত্য প্রকাশই মানিকের শিল্পবোধকে রসাশ্রিত করেছে। আমৃত্যু মানিক বেদনার্ত অনুভূতিপুঞ্জের অন্তর্গূঢ়তায় জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজেছেন। তাই সাহিত্য তাঁর কাছে ছিল সাধনা আর তপস্যার বিষয়।

যন্ত্রণা, সাধনা, কষ্ট আর বিদগ্ধতার মধ্যেই জীবনকে দেখতে হবে পরিশ্রমের দ্বারা। মানুষের মনোময় মনস্তাত্ত্বিক জগৎ-দর্শনেও লেখককে বিরামহীন শ্রম দিতে হবে – এটাই ছিল তাঁর উপলব্ধিজাত অনুভূতি। জীবন-সমষ্টিকে অন্বেষণ, ক্ষুদ্রকে নিয়ে বৃহৎ জীবনোপলব্ধির নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসেই লেখক সার্থকতার মূলসত্মম্ভ নিহিত। তত্ত্বাশ্রয়ী সুস্থির পরিমিত চেতনালোকের শৈথিল্যও লেখকের অসফলতার জন্য দায়ী হতে পারে। এখানে মানিকের অভিজ্ঞতাপুষ্ট বক্তব্য আমরা এভাবেই দেখেছি –

ঘরে শিল্প-সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুঁজিপাটা আর ঘরে-বাইরে সর্বত্র সবসময় মানুষকে আর জীবনকে তন্ন-তন্ন করে দেখা ও জানা এবং মনের মধ্যে তাই নিয়ে তোলপাড় করা, যোগ-বিয়োগ করা, মিলিয়ে দেখা আর অমিল খোঁজা ও সব কিছুর মানে বোঝার চেষ্টা – লেখকের বিরামহীন এই শ্রম… শ্রমটা লেখকের ধাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু সাধনা ধাতস্থ হলেও সেটা শ্রম বইকি।… যত বড় প্রতিভা থাক সাধনায় ঢিল পড়ার অর্থই লেখক ও লেখার অধঃপতন।

জীবনীশক্তির সাধনার ওপর দাঁড়িয়েই একজন লেখক দায়িত্ববান ও প্রতিশ্রম্নতিশীল হয়ে ওঠেন। তাই শুধু রসনিঃসৃত আনন্দ অনুধাবন করাই শিল্পের মূল উদ্দেশ্য নয়। সাহিত্যিককে সর্বদাই সমাজ-সতর্ক হতে হয়। প্রত্যেক লেখকেরই শিল্প-সাধনার মূল বিবেচ্য মাধ্যম হচ্ছে পাঠক। পাঠকের অভিরুচির ওপর আত্তীকৃত লেখক কখনোই হবেন না। লেখক তাঁর তত্ত্বাশ্রয়ী সুস্থির পরিমিত চেতনালোকে উত্থিত প্রবল হৃদয়াবেগের সমৃদ্ধিতে অবনতিশীল পাঠককুলকে সতর্ক করে তুলবেন। আর এটাই লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা। যে-কোনো সৃষ্টিশীল লেখক তাঁর চারপাশের সামাজিক অসংগতিকে চিহ্নিত করে পাঠকের চেতনালোককে উদ্দীপ্ত করেন। আর পাঠক তাঁর বোধ-বিবেচনা ও মননশীলতায় নিজেকে আরো পরিশীলিত করেন। তাই লেখক এখানে পাঠকের প্রতি শিক্ষাদাতার ভূমিকাই পালন করেন। এ-সম্পর্কিত মানিকের উপলব্ধিজাত অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে –

লেখক কে? পিতার মতো যিনি দেশের মানুষকে সমত্মানের মতো জীবনাদর্শ বুঝিয়ে-শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করার ব্রত নিয়েছেন। পিতার মতো, গুরুর মতো জীবনের নিয়ম-অনিয়ম, বাঁচার নিয়ম অনিয়ম শেখান বলেই অল্পবয়সী লেখক-শিল্পীও জাতির কাছে পিতার মতো, গুরুর মতো সম্মান পান। এটাই আসল কথা। দেশের লোকের সত্তা খাতিরকে লেখক-শিল্পী খাতির করেন না। দরকার হলে দেশের মানুষকে কান মলে শাসন করার অধিকার খাটাতে লেখক-শিল্পীর দ্বিধা বা ভয় হওয়ার কথা নয়।

সমাজ আর জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতাই মানিকের দৃষ্টিশক্তিকে সমগ্রতা দান করেছে। তাই মানিকের চিমত্মা-চেতনা, ভাবনা, চেতনালোক, কর্ম ও বিশ্বাসে কখনো আমরা অবহেলা বা প্রবঞ্চনা দেখিনি। মানবসভ্যতার প্রতি তাঁর আস্থা, জীবনানুভূতির রসআস্বাদন, ব্যক্তি-জীবনোপলব্ধি, শিল্পবোধের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা আমরা বারবার স্মরণ করি। ব্রিটিশশৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের অসিত্মত্ব বিপন্ন শ্রেণিসত্মরের বেদনার্ত জীবনাচরণের সত্যনিষ্ঠ পথ অনুধাবনও এ-ক্ষেত্রে মানিককে সাহায্য করেছে। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন, যন্ত্রণা, বিকারগ্রসত্মতা মানিকের শিল্পবোধকে অনেক বেশি শাণিত করেছে। সমসাময়িক মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলেই আমরা তাঁর সৃষ্টির একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার উন্মীলন লক্ষ করি। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন – ‘তার বীক্ষা তাঁকে এই উপলব্ধিতে নিয়ে গিয়েছিল যে, মধ্যবিত্ত সত্তা বিপর্যসত্ম, ভবিষ্যৎহীন, নানা কানাগলিতে বদ্ধ।’

এই মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি মানিকের ঘৃণা, অবিশ্বাস, যন্ত্রণা ও কষ্ট অনেক বেশি ছিল। অন্যদিকে ভদ্র-জীবনের প্রতি লক্ষ্য নিবিষ্ট করে তিনি দেখেছেন আদিম অশিক্ষেত জীবনে অসাধারণ প্রাণপ্রাচুর্য ও পেশিশক্তির সজীব বলিষ্ঠতা। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে বলেছেন – ‘আদিম ও বলিষ্ঠ মানুষের শক্তি সম্বন্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি পক্ষপাত ও সমগ্র চেতনা ছিল। প্রাগৈতিহাসিক শক্তির সন্ধানী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই শক্তির অপরিমিত সম্ভাবনার সন্ধান পেয়েছিলেন।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্যন্ত্রণার মধ্যেই সমাজসভ্যতার বীজ মূলীভূত হতে দেখেছেন। তাই তিনি তাঁর নিজের সংগ্রামদগ্ধ জীবনে পরাভব না মেনে জীবনযুদ্ধে আস্থাশীল থেকেছেন। মধ্য বিশ শতকের অস্থির জীবনপ্রবাহেই তিনি লক্ষ করেছেন অমিত সম্ভাবনার তেজোদীপ্ত প্রাণের আকাঙ্ক্ষা। অসহায় শ্রমজীবী মানুষ, অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়হীন প্রাণের আর্তনাদ। তাদের মহত্ত্ব ও শক্তিকে শাণিত রূপ দিতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

নিম্নঅধ্যুষিত জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করে দিয়ে তিনি সাহিত্য-সাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন এবং এ-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রান্ত উন্মোচন করেছেন। সাহিত্যাঙ্গনে অতলস্পর্শী সফলতা তাকে কখনো আত্ম-অহংকারী করে তোলেনি। বৈজ্ঞানিক মানবিকতাবোধসম্পন্ন মানিক তাঁর জীবনবোধের বিশেস্নষণেও বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের আশ্রয় নিয়েছেন। ‘কেনবোধক’ জীবনজিজ্ঞাসায় আবাল্য তিনি আক্রান্ত ছিলেন। বৈজ্ঞানিক জীবনদৃষ্টি থেকে আমরা তাঁর জীবনবোধকে আলাদা করতে পারি না। তিনি মনে করতেন, এ-যুগে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে সাহিত্য লেখা অসম্ভব। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্বন্ধ এ-যুগে অতিপ্রয়োজনীয়। যুগধর্ম সাহিত্যিকেরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে বর্তমান যুগে, কারণ তাতে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের অনেক চোরা মোহের স্বরূপ চিনে সেগুলো কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান-প্রভাবিত মন উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজন, কেননা সাহিত্যের ক্ষেত্রে উপন্যাস হলো সভ্যতার অগ্রগতি। মানিকের শিল্পসত্তার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চিমত্মা-চেতনা একই সূত্রে গ্রথিত ছিল। জীবন-অনুসন্ধিৎসাকে বৈজ্ঞানিক জীবন-জিজ্ঞাসায় মানিক আরো চেতনাস্পর্শী ও শাণিত করেছেন। জীবন-রহস্য উন্মোচনে মানিক সর্বদা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। সার্থক কথাশিল্পীর পরিণামী চেতনার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চিমত্মা-চেতনার মেলবন্ধনের মধ্যেও তিনি মিল খুঁজে পেয়েছেন। তিনি সর্বদাই এই বোধে আক্রান্ত ছিলেন যে, বিজ্ঞানবোধ ছাড়া জীবনের সমগ্রতা অর্জন সম্ভব নয়। মানিকের সাহিত্যে ও সংবেদনশীল মননশীলতায় এই বিজ্ঞানবোধ সর্বদাই সক্রিয় ছিল। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের ব্যবহার-বৈচিত্রে তাঁর সাহিত্যভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে। মানিক নিজেই এ-বিষয়ে মন্তব্য করেছেন –

কবিতা লেখাও কাজ, ছবি আঁকাও কাজ, গান করাও কাজ, চাকা ঘোরানোও কাজ, তাঁত চালানোও কাজ এবং কাজের দক্ষতা শুধু কাজেরই দক্ষতা – মানুষ হয়ে জন্মে কারো সাধ্য নেই অমানুষিক প্রতিভার পরিচয় দিয়ে অতিমানব হয়ে যাবে।… তবে হ্যাঁ, কাজের তারতম্য আছে। দক্ষতারও তারতম্য আছে। শুধু এইটুকু। প্রতিভা ওই দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা। আর কিছুই নয়। কোনো বিশেষ প্রতিভা নিয়ে কেউ জন্মায় না।

মানিক বস্ত্তবাদী চিমত্মা-চেতনার ধারক ও বাহক ছিলেন। তাঁর ভাববাদ ও বস্ত্তবাদের দ্বন্দ্বও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত। দারিদ্রে্যর সত্তাময় পীড়ন, অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়ের বৈষম্যময় চিত্র, পারিবারিক জীবনের যন্ত্রণাদগ্ধ অসংগতি, শ্রমনির্ভর জীবন – এগুলো থেকেই তাঁর সাহিত্যে এ-দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়েছে। কিশোর বয়স থেকেই মানিকের চৈতন্যে নিজ জীবনসত্মরের সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও প্রয়োগ-নৈপুণ্যে অসংগতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। মানিকের জীবনবোধ ও সাহিত্যিক জীবনের সত্মরগত অসমতা তাঁকে আরো সংকটময় করে তুলেছিল। সাহিত্য ও জীবন – এ-দুয়ের স্নিগ্ধ-সজীব ও চলমান প্রেক্ষাপটে কোথায় রহস্যময় বিভেদ – মানিক তা বৈজ্ঞানিক চেতনা দিয়ে নিগূঢ় সন্ধান করেছেন। বৈজ্ঞানিক চেতনাসম্পন্ন সমাজদৃষ্টি মানিকের মনোজগৎকে যুক্তিনিষ্ঠ ও বস্ত্তনিষ্ঠ করেছে। তাঁর চেতনাসৃজিত মানবতা শাশ্বত কোনো অনুভবের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শিল্প-বিপ্লবোত্তরকালে অসহায় মানবসত্তা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য প্রকৃতি-বিরোধিতা থেকে যখন অন্তর্বিরোধে পরিবর্তিত হয় – তখন মানবতাবোধগুলোও বহুমাত্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। বস্ত্তবাদী মানিক এ-বিষয়ে সূক্ষ্ম রীতিনৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন।

মানিকের পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত বস্ত্তর চেতনার রূপান্তরও তাঁর জীবনের উলেস্নখযোগ্য অধ্যায়। মানবসত্তার মনোকেন্দ্রিক জীবন-রহস্য অন্বেষণই মানিকের প্রথম দিকের রচনায় স্থান পেয়েছে। পরবর্তীকালে জীবন সমগ্রতার সংগ্রামশীলতায় বেদনাবৃত ক্ষোভাশ্রয়ী নির্ভরতা – দুটোই তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতার ফল। জীবনবোধে বাসত্মবই ছিল তাঁর কাছে সংযমমার্জিত পরম সূক্ষ্ম সত্য। তাই তাঁর আবেগ-উচ্চারিত অনুভূতি, আনন্দ, অসিত্মত্ববিনাশী বেদনা এবং তার সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্রের নৈতিক অবক্ষয়, অন্তর্বিরোধ-বিভাজন – শিল্পী হিসেবে মানিকের কাছে এবং তাঁর কথাসাহিত্যে অত্যন্ত সত্য ও মূল্যবহ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বনির্ভর মানসিকতা, সমাজ-সচেতনতা, মহৎ মানবতাবোধ, মঙ্গলময়তা, বিশ্বানুভূতি, চিরন্তন কল্যাণকামিতায়  মানিক সর্বাংশে আধুনিক ছিলেন। সাহিত্যের অসিত্মত্বগত সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ, বিষয়-উপকরণ, গঠনশৈলী, অলংকারসজ্জা – সর্বক্ষেত্রেই মানিক আধুনিক চিমত্মা-চেতনার অগ্রপথিক ছিলেন। তাঁর জীবনসত্যের স্বরূপ সন্ধান ও আধুনিকতা একই সূত্রে গাঁথা। তাঁর ব্যক্তিজীবনের দারিদ্র্যপীড়িত অপ্রাপ্তির বেদনা, মৃত্যুস্পর্শী ব্যাধি, আলোকবঞ্চিত ব্যক্তিজীবন, অতিরিক্ত মদ্যপান সবই তাঁর অসিত্মত্বকে ক্লেদাক্ত করে তোলে। মানিক সাহিত্যের প্রতিটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যেও যে এর প্রচ্ছন্ন আলো পড়েছে সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি। মানুষের অন্তর্জগতের রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞান-চেতনাসংযুক্ত মানিক বেশি উৎসাহী থেকেছেন সর্বদা। মানুষের বাহ্যিক আনন্দবোধ সুখ-দুঃখ তাঁর কাছে গুরুত্ব বহন করেনি, বরং মানুষের মানসতলবর্তী আকাঙ্ক্ষা, মধ্যবিত্তের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, তাদের মানস দ্বন্দ্ব, ক্ষয়িষ্ণু দারিদ্র্যপীড়িত মানবসত্তার হাহাকারই তাঁর কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করেছে।

মানিক সাহিত্যে মৃত্যু-চিমত্মা, রোমান্টিকতা, বিরহ প্রেমানুভূতির সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক, নারী-সৌন্দর্যের ধ্যান, প্রবৃত্তিতাড়িত বোধ সবকিছুর পশ্চাতে থেকেছে তাঁর নিগূঢ় রহস্যতাড়িত জীবনানুভূতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পদৃষ্টির স্বরূপ উন্মোচন করতে গেলে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার বহুমুখী বৈচিত্রকে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আনতে হবে। মানিক-সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক তাঁর সাহিত্যের পর্বকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পূর্বে (১৯৪৪) আর উত্তরকালের সাহিত্যের দুটি রূপের কথা বলেছেন। আবার কোনো-কোনো সমালোচক তাঁর উত্তরপর্বকে ১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর এই দুভাগে ভাগ করেছে। একদল বলেছে, মানিকের প্রথম পর্বের রচনার চেয়ে উত্তরপর্বের রচনা উৎকৃষ্টমানের – এরা মার্কসীয়। আরেক দল বলেছেন, প্রথম পর্বের রচনাই শ্রেষ্ঠ, উত্তর পর্বের সাহিত্যের শিল্পমান নিকৃষ্ট – এরা সাধারণত অমার্কসীয়। তৃতীয় দলের সমালোচকরা অধিকতর দায়িত্বশীল ও মুক্তমনের। এঁরা মানিকের প্রথম পর্বের বেশির ভাগ রচনার সমৃদ্ধ শিল্পরীতি সম্পর্কে প্রশংসামূলক মন্তব্য করেও তাঁর উত্তরপর্বের সৃষ্টিকর্মের তাৎপর্যকে অস্বীকার করেননি। মানিকের মার্কসীয় চিমত্মা-চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাঁর উত্তরপর্বের রচনার মূল্যায়ন করেছেন। কেউ-কেউ বলেছেন, বিভাগোত্তর কালের মার্কসীয় সাহিত্য-বিতর্কসূত্রে পারস্পরিক মতান্তর ও মনান্তর মানিকের অনেক মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল – এরূপ মানসিকতা এবং পরিবেশে ভালো কিছু সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল। সবাই এ-যুক্তির পক্ষেও ছিলেন না। পর্ববিভাজনগুলো মানিকের শিল্পরীতির সম্পূর্ণ রূপসন্ধানে পুরোপুরি ব্যর্থ – এমন উক্তিও অনেকে করেছেন।

মানিকের উপন্যাসে যে-পরিবর্তন – ফ্রয়েডীয় যৌন বাসত্মবতা থেকে অর্থনৈতিক ও সমাজবাদী বাসত্মবতার দিকে এটাকে বিশেষ এক কালসীমার দ্বারা চিহ্নিত করে, বা তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের ঘটনার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা তাঁর হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়, এটা তাঁর পথভ্রষ্টতাও নয়, এটা তাঁর জীবনবোধের এক স্বাভাবিক সত্য পরিণতি।

দারিদ্র্য, আসক্তি, রোগ – এই তিন যন্ত্রণাময় শত্রম্নর সঙ্গে মানিক আজীবন সংগ্রাম করেছেন; আবার বারবার জয়ীও হয়েছেন। তাঁর শেষ জীবনে বয়োবৃদ্ধি ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই তিন শত্রম্ন তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। কিন্তু তিনি হেরে গেছেন এই তিন শত্রম্নর আক্রমণে এমনটি নয়। তিনি পরাসত্ম হলেন যাঁদের তিনি সহকর্মী ও সহযোদ্ধা জেনেছিলেন তাঁদের আক্রমণে।

চলিস্নলশ দশকের শুরুতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, কাঙিক্ষত স্বাধীনতা-আন্দোলনের পটভূমিতে মানিক নতুন সত্তায় ও আকাঙক্ষায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন, যা তাঁর শিল্পসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নতুন সমাজ-দর্শন তাঁর শিল্প-মানসকে অনেক পরিমার্জিত ও সংযত করেছে। তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে ধরাতলবাসী করেছে মূলত ১৯৪৮-৫০-এর অস্বাস্থ্যকর মার্কসীয় সাহিত্যযুদ্ধ এবং বন্ধুদের মধ্যে অনৈক্যের পীড়ন, এর সঙ্গে ১৯৪৯ থেকে ভাড়াবাড়ির জীবনে দারিদ্রে্যর অসহনীয় পীড়ন, রোগব্যাধি-আসক্তির আক্রমণ। এসব কারণই তাঁর জীবন-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। শিল্পীজীবনের সমগ্রতায় সৃষ্টিশক্তির পূর্ণ বিকশিত দুর্লভতায় উচ্ছ্বসিত রূপ বর্তমান – এমন প্রতিভা বাংলা আধুনিক সাহিত্যে বিরল, বরং বেশির ভাগ সময় সৃষ্টির বিপন্ন-বিধ্বসত্ম হ্রাস-বৃদ্ধির রূপই আমরা লক্ষ করি। মানিকের জীবনোপলব্ধির স্বাতন্ত্র্য, রুচিবোধ, চৈতন্যের সূক্ষ্ম রূপান্তরধর্মিতা অধিকতর প্রশংসাযোগ্য। আর তা তাঁর ছোটগল্পের সমাজসত্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রযোজ্য। মানিকের সাহিত্যসৃষ্টি বিশুদ্ধতা-যুক্তির অভিযাত্রায় তাঁর সাহিত্যভা-ারের প্রতিটি সত্মরকে চিহ্নিত করতে পারলেই আমরা তাঁর সৃষ্টির শিল্পরীতির মহত্ত্বকে আবিষ্কার করতে পারব। তাই বাংলা সাহিত্যে মানিকের জীবনাগ্রহ ও তাঁর সূক্ষ্ম আত্মসজাগতা আমাদের অধিকতর মর্যাদা-সতর্ক করে তোলে।