রহস্যের আগের স্টেশন

সিন্দুকের চাবি (পরিমার্জিত সংস্করণ)

মঞ্জু সরকার – আগামী প্রকাশনী

ঢাকা, ২০২০ – ২৫০ টাকা

দু হাজার সালে যেবার আমরা কয়েকজন লেখক-বন্ধু প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে যাই, একদিন সন্ধের পর ঢাকায় আমাদের হোটেলের ঘরে ঢাকার কয়েকজন তরুণ লেখক এসেছিলেন আলাপ করতে, আড্ডা হয়েছিল অনেক রাত পর্যন্ত, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মঞ্জু সরকার। মিতভাষী অথচ বুদ্ধিমান মঞ্জুর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল সাহিত্য নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে বেশ অভিনবত্ব আছে।

যে-বইটি পদ্মা পেরিয়ে আমার কাছে এসেছে, সেটি তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। একজন ধনী মানুষের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ঘিরে যে-পারিবারিক সংঘর্ষের আখ্যান পাঠক পেলেন তা থেকে মঞ্জু সরকারের লেখনীর ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারা যায়।

মঞ্জু সরকারের সিন্দুকের চাবি শুরু করার পর পাঠকের মনে হতে পারে এটি রহস্যোপন্যাস, কিন্তু তা নয়, একেবারেই পারিবারিক উপন্যাস, অথচ রহস্যের আবর্তে টানটান কাহিনি। উপন্যাসের দু-তিন পৃষ্ঠা পর থেকে একটি সিন্দুকের চাবি নিয়ে ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। বিশাল সম্পত্তির মালিক আব্বাস তালুকদারের খুবই আকস্মিকভাবে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে তাঁর ভরভরন্ত সংসারে শুরু হয়ে গেল এক বিশাল বিপর্যয়।

অব্বাস তালুকদার নিজেও ঠিকঠাক জানতেন না তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ কত, কোন দাগে কত জমি আছে, কোথায় কত বাগবাগিচা। তবে তাঁর একটি সিন্দুক ছিল, সবাই অনুমান করত তার ভেতরে ভর্তি অজস্র সোনাদানা, প্রচুর নগদ টাকা, ব্যাংকের বহু সার্টিফিকেট ইত্যাদি।

আব্বাস তালুকদার মানুষটি খুব উদ্যোগী, কিন্তু সেই পরিমাণে বৈষয়িক নন। খুব খুঁতখুঁতে মনের, তাঁর উদারমনা স্ত্রীকেও বিশ্বাস করে কখনো দেননি সিন্দুকের চাবি। তাঁর পুত্র-কন্যাদের সবারই বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেছে, তারা সবাই বাইরে থাকে, কেউ ঢাকা, কেউ রাজশাহী, কিন্তু তালুকদারের সম্পত্তির হদিস কেউই জানে না। একমাত্র কনিষ্ঠ পুত্র রতন ছাড়া বাকি সবাই প্রতিষ্ঠিত, তারা বাবার সম্পত্তি নিয়ে খুব ভাবিত ছিলেন না কখনো। হঠাৎ বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর সিন্দুকের চাবি মায়ের হাতে যাওয়ার পর সবার টনক নড়ে। কেননা, তার মায়ের মধ্যে অকস্মাৎ বিপুল পরিবর্তন লক্ষিত হয়। বাবার দাফন-কাফনের সময় সব পুত্রকন্যা একজায়গায় হতে সবাই বেশি চিন্তিত তার মায়ের এই হঠাৎ পরিবর্তনে। তালুকদার জানতেন তাঁর স্ত্রী সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে মোটেই বিচক্ষণ নন, তাঁর মৃত্যুর পর তালুকদার-গিন্নি একতরফাভাবে ঘোষণা করলেন দাফন-কাফনের খরচ-খরচায় একটুও কার্পণ্য করা হবে না, গ্রামের প্রচুর মানুষকে তৃপ্তি করে খাওয়ানো হবে। তাতে যত টাকা খরচ হয় হবে।

তালুকদারের পুত্রকন্যারা বেজায় ভাবিত হয়ে পড়ে ও উপলব্ধি করে, মায়ের কাছে সিন্দুকের চাবি থাকলে অচিরেই শূন্য হয়ে যাবে সিন্দুক।

কনিষ্ঠ পুত্র রতন ঢাকায় সাংবাদিকতা করে সংসার চালাতে পারছিল না, বাবার মৃত্যুর পর ঠিক করে সে-ই নিজবাড়িতে ফিরে এসে বাবার সম্পত্তি দেখাশোনা করবে, সেইসঙ্গে একটি স্কুল গড়বে ও সেখানে তার স্ত্রী শরিফাকে বহাল করবে মোটা মাইনের চাকরিতে।

কিন্তু সিন্দুকের চাবি খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল সেটি তাদের মায়ের কাছে নেই। তাহলে চাবি গেল কোথায়! এই চাবি-রহস্যই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু, চাবিকে কেন্দ্র করে যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত।

তালুকদারগিন্নিও তাঁর পুত্রকন্যদের কাউকে বিশ্বাস করেন না, তিনি বিশ্বাস করেন তাঁদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে আলোকে। আলোর কাছে চাবিটি দিতে আলোও ফাঁপরে, প্রথমে ব্লাউজের মধ্যে, পরে কোমরের নিচে অন্তর্বাসে লুকিয়ে রেখে, আরো পরে তার স্বামীর হাত থেকে বাঁচাতে পুঁতে রাখে মাটির নিচে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর চাবি বের করে দিতে দেখা যায় সিন্দুকের ভেতর কিচ্ছুটি নেই।

সব সন্দেহ গিয়ে পড়ে আলোর ওপর।

বিষয়টি নিয়ে তখন তোলপাড় চলছে ঘরে, আলোকে ঘিরে যাবতীয় আলোচনা। ঠিক এরকম মুহূর্তে এক সন্ধেয় রতন হঠাৎ যায় আলোর ঘরে, তাকে একা পেয়ে ঘটিয়ে ফেলে এক অঘটন। আগেও একবার ঢাকা থাকতে আলো এসে কয়েকদিন ছিল তাদের বাসায়, একদিন রতনের স্ত্রী শরিফা হঠাৎ বাইরে গিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি, আলোকে ঘরে একা পেয়ে বলাৎকার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল আলোর উপস্থিতবুদ্ধিতে। কিন্তু এখন আবার সেই একই অপকর্ম করতে গিয়ে অনিচ্ছায় হোক, বা ইচ্ছায় হোক, শ্বাসরোধ হওয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যায় আলো। সিন্দুকের চাবি আলোর কাছে থাকা ও আলোর খুন হওয়া – সব মিলিয়ে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়। রতন ভেবেছিল, তাকে কেউ দেখতে পায়নি; কিন্তু শরিফা বলল, তাকে আলোর ঘর থেকে বেরোতে দেখেছে হনুফার মা।

পুলিশ অবশ্য গ্রেফতার করে আলোর স্বামী বাটল ও বাবা উমেদ আলিকে। সন্দেহের তির তাদের ওপরই চাপায় তালুকদারবাড়ির কেউ কেউ, তবে তাদের ছাড়িয়েও নিয়ে আসে কিছু পরে।

দাফন-কাফনের পর বাকি ভাইবোনেরা যার যার আবাসে ফিরে গেলেও রতন থেকে যায় সম্পত্তির টানে। কিছু মূল্যবান সম্পত্তি বিক্রিও করে দেয় অন্য কাউকে না-বলে। শুরু হয় ভাইবোনদের মধ্যে অশান্তি। এরই মধ্যে রতনের স্ত্রী শরিফা গ্রামে থাকতে রাজি না-হওয়ায় সন্তান নিয়ে চলে যায় ঢাকার বাসায়।

রতনের নজর গিয়ে পড়ে এক স্বামীবিচ্ছিন্ন যুবতী সাহানার ওপর। উপন্যাস তখন গতি নিয়েছে নানা জট-জটিলতার আবর্তে। পারস্পরিক দোষারোপ চলতেই থাকে, একই সঙ্গে উপন্যাস পৌঁছাতে থাকে পরিণতির দিকে। উপন্যাসের শেষদিকে উন্মোচিত হয় সিন্দুকের রহস্য।

মঞ্জু সরকারের কিছু গল্প আগে পড়া থাকলেও উপন্যাস পড়লাম এই প্রথম। এক কথায় নির্দ্বিধায় বলা যায়, উপন্যাসটির ভাষা গতিময় ও অতিঝরঝরে, কাহিনিও চুম্বকের মতো টেনে রাখে পাঠককে, তার ফলে উপন্যাস শেষ না-করা পর্যন্ত ছাড়া যায় না। উপন্যাসটি খুব বড় নয়, মাত্র ১১২ পৃষ্ঠার, কিন্তু এই স্বল্প পরিসরে বেশ আঁটসাঁট কাহিনি লিখেছেন লেখক। ছোট উপন্যাস, কিন্তু চরিত্র অনেক – প্রতিটি চরিত্র বেশ দক্ষতায় আঁকতে পেরেছেন মঞ্জু। তালুকদারগিন্নির চরিত্রটি বেশ চমৎকার, তার স্বামী তাকে যতটা অন্ধকারে রেখেছিলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে ততটাই আলোয় এনেছেন মঞ্জু। স্বামী তাকে যতটা নির্বোধ ভাবতেন, তিনি সেরকমটি নন, তবে বহু টাকা হাতে পেয়ে হঠাৎ দিলদরিয়া হয়ে শুরু করলেন দেদার খরচ করতে।

উপন্যাসটিতে অসম্ভব পারিবারিক জটিলতা, প্রায় প্রতি পরিচ্ছেদে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতি পাতায় সংঘাত, তার ফলে পাঠক নিবিষ্ট হয়ে অপেক্ষা করেন কোন পরিণতিতে পৌঁছায় কাহিনি! একই সঙ্গে সিন্দুকের সম্পত্তির কী হলো, আলোকেই বা খুন হতে হলো কেন, পারিবারিক দ্বন্দ্বের সুরাহাই বা হলো কী করে!

পরিবারের অন্য একটি চরিত্র, উমেদ আলি উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র, সে এখানেই থাকে তবু যেন বাইরের লোক। উমেদ আলিই একমাত্র লোক যে তালুকদারের জমিজমার খবর যত রাখে তা তালুকদারের পুত্রকন্যারা কেউই রাখে না। আসলে উমেদ আলিকে সহকারী হিসেবে নিয়ে তালুকদার সব কাজ একা হাতে করতে চাইতেন।

তালুকদারের মৃত্যুর পর একমাত্র রতনই দেশঘরে ফিরে জমিজমা রক্ষণাবেক্ষণ করে নিজেকে স্বয়ম্ভর করে তুলতে চায়, তখন উমেদ আলি হয়ে ওঠে প্রধান সাহায্যকারী।

উপন্যাসের শেষ পর্বে, তালুকদারের মৃত্যুবার্ষিকীর সময় আবার সবাই একত্র হয়, একমাত্র তখনই মেজোবউ বুলবুলি এতদিনকার গোপন তথ্যটি ফাঁস করে ও জানায়, তালুকদারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই চাবি হাতিয়ে গোপনে সমস্ত টাকা ও সোনাদানা আত্মসাৎ করেছে, তার সেই চুরির সময় দরজা খুলে বুলবুলি দেখে ফেলে ও তার মুখ বন্ধ করার জন্য বুলবুলিকে একটি সোনার কবচ ও ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন, পরিবারের স্বার্থেই তিনি এই কাজটা করছেন।

তার এই পাপকাজের ফলেই কিন্তু আলোকে প্রাণ দিতে হলো, যদিও রতন কেন আলোকে খুন করল, তার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাইনি। একবার মনে হলো, বলাৎকার করতে গিয়ে আলোর শ্বাসরোধ করে ফেলেছে, তাতেই মৃত্যু হলো আলোর। তা হতে পারে না এমন নয়, কিন্তু প্রায়-বিরল ঘটনা। আমি নিজে গোয়েন্দাকাহিনি লিখি বলে মনে হলো, আলোর হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারতেন আইনরক্ষকরা যদি পোস্টমর্টেম করা হতো আলোর মৃতদেহ।

তবে এই উপন্যাস যেহেতু গোয়েন্দাকাহিনি নয়, উপেক্ষা করা গেল এই প্রসঙ্গ। কিন্তু সিন্দুকের সত্যটা জানাজানি হওয়ার পরও জ্যেষ্ঠপুত্রকে কেউ তেমনভাবে অভিযুক্ত করেনি – তা মনে হলো অযৌক্তিক। হয়তো নিতান্তই পারিবারিক বিষয় বলে রেহাই পেলেন তিনি।

এই প্রসঙ্গ দুটি উপেক্ষা করলে সিন্দুকের চাবি এক সুলিখিত উপন্যাস। দরিদ্র পরিবারের সংকট নিয়ে প্রচুর গল্প-উপন্যাস লেখা হয়, কিন্তু উচ্চবিত্ত পরিবারের সংকটের ধরন আলাদা, ব্যাপ্তিও কম নয়। লেখকের কৃতিত্ব এই যে, তিনি এত চরিত্রকে ঠিক ঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে ও স্পষ্ট করতে পেরেছেন একে অন্যের থেকে আলাদা মনের। উপন্যাস পাঠ শেষ হলে কাহিনিবৈচিত্র্যের রেশ পাকাপাকিভাবে রয়ে যায় মনে।