রায়েরবাজার পাল বংশের ইতিহাস

রায়েরবাজারে একসময় যখন ঘরে ঘরে পাল বংশের কুমার শিল্পীরা মাটি নিয়ে কাজ করেছে, তখন এরা কাদামাটির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকত। সে হিসাবে এদের গায়ে, ঘামে ও রক্তে কাদামাটি মিশে গিয়েছিল। এখন রায়েরবাজার শেরেবাংলা রোড তার ১৫ ফুট প্রশস্ত ক্ষতবিক্ষত বুক থেকে যে ধুলোবালির জন্ম দেয় তা দুই পাশের হাইরাইজ বিল্ডিং হাউস অ্যারেস্ট করে রাখে দিনের পর দিন। রোডের ধুলো অ্যাপার্টমেন্টের ফার্নিচার, দরজা, জানালা, সিলিং ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার, কিচেন ক্যাবিনেট, শোপিস, কাপড়-চোপড়, বই, ফাইলপত্রে, এমনকি আমরা যারা এসব বিল্ডিং-এ থাকি তাদের চিন্তা-ভাবনা, মেজাজ-মর্জিতে আরামসে জমা হয়। এভাবেই রায়েরবাজার পাল বংশের ইতিহাস কি চাপা পড়ে যায়?

‘শ্যামের পুঁতা খাইবেন ফারুক ভাই’, রায়েরবাজার পাল বংশের সন্তান শান্তি আমাকে জিজ্ঞেস করে। ‘এটা আবার কী জিনিস?’ আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি। ‘মশলা বাটার পাটা-পুঁতার নাম শুনেছি, শ্যামের পুঁতা কী চিনি না।’ ‘আমারে শরম দিলেন, আপনে এহনো শ্যামের পুঁতা খান নাই, কন কী ভাই? আপনে রায়েরবাজার আছেন অনেকদিন হইছে না?’

আমরা যখন রায়েরবাজারে কুমার বা পালপাড়ায় জায়গা কিনে থাকা শুরু করি, তখন থেকে শান্তির সঙ্গে পরিচয়-বন্ধুত্ব। আমাদের জায়গার দলিল প্রদানকারী ছিল প্রফুল্ল পাল, আশেপাশে সবাই ছিল পাল। শান্তির কথাবার্তা অনেকটা ঢাকাইয়াদের মতো ছিল। আমিও ওর সঙ্গে থেকে পালদের ঢাকাইয়া বোলচাল কিছুটা রপ্ত করেছিলাম।

‘চলেন আইজকা আপনেরে শ্যামের পুঁতা খাওয়ামুনে’, শান্তি পীড়াপীড়ি করে। ‘তুমি শ্যামের পুঁতার নামে কী খাওয়াইবা, আল্লাহই জানে।’ আমার দুশ্চিন্তা হয়। ‘আল্লাহর কিরা ফারুক ভাই, কী যে কন আপনে। আপনের লগে আমি মশকরা করতে পারি? চলেন আহেন দেহি।’ শান্তি আমারে টানাটানি করে। কিন্তু ও বলতে চায় না, শ্যামের পুঁতা আসলে কী জিনিস। আমি ভেবেছিলাম এটা শান্তির দুষ্টবুদ্ধির কোনো চক্রান্ত কি না। ও একবার আমাকে খেজুরের রস বলে তালের রস খাইয়েছিল। খেয়ে মাথা ঝিমঝিম করছিল।

‘শান্তি তুমি ফাল পাড়তাছ কেন? আগে আমারে কও শ্যামের পুঁতাডা কী?’ ‘ভাই এইডা মুখে কইলে অইব না। আপনারে খাওয়াইয়া দেখাইতে হইব।’ আমি শেষ পর্যন্ত শান্তির চক্রান্তে ধরা দিলাম। খেয়েই দেখি না কি হয়!

‘আগে দেখি তোমার শ্যামের পুঁতা কী জিনিস?’ শেরেবাংলা রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে রায়েরবাজার পুলপারে যাই। সেখানে খালের ওপর একটা কালভার্ট ছিল, তাই জায়গার নাম পুলপার, এখন রাস্তা। একটা মিষ্টির দোকান ‘শ্যামলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ দেখিয়ে শান্তি বলে, ‘এইহানে আহেন নাই আপনে?’ আমার তখন মিষ্টি খাওয়া বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে চা খাওয়ার অভ্যাস হয়নি।

শান্তি আমার হাত ধরে টেনে দোকানের ভেতর নিয়ে টেবিলের সঙ্গে পাতা এক বেঞ্চে বসায়। তারপর অর্ডার করে, ‘একটা শ্যামের পুঁতা দেন তো কাকা।’ কয়েকটা মাছি টেবিলে লেগে থাকা মিষ্টির সিরায় বসার জন্য ওড়াউড়ি করছিল। শান্তির ইশারায় এক ছোকরা ওয়েটার এসে ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে।

আমি মিষ্টির কাচের ক্যাবিনেটের ভেতরের দিকে তাকালাম। একটা বোলে সিরায় ডুবে থাকা একদম পুঁতার সাইজের মতো বিরাট কালোজাম দেখে আঁতকে উঠি। আমি বুঝলাম, এটাই সেই শ্যামের পুঁতা, যা আমাদের খেতে হবে। দেখতে না দেখতে সেই ছোকরা ওয়েটার টেবিলে পুঁতা হাজির করে।

‘এই পুঁতা কে খায় শান্তি?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘খাওনের লোক আছে বস, বাজি ধইরা অনেকে খায়।’

‘তুমি আগে খেয়েছ?’

‘না বস। ওইজন্যই তো আপনারে নিয়া আইছি, একসঙ্গে খামু। আসেন, আমরা দুইজন হাত লাগাই।’ শান্তির তর সইছিল না।

পুঁতার সামান্য অংশই আমি খেলাম, বাকিটা শান্তি। সে আরেকটা পুঁতা নিল, দ্বিতীয় পুঁতা খেল ধীরে ধীরে, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ভবিষ্যতে খোদা না খাস্তা যদি শ্যামের পাটা বাজারে আসে, আমি নিশ্চিত তখন শান্তি ট্রিকস করে শ্যামলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে আমাকে নিয়ে আসবে।

শান্তি হঠাৎ কেন আমাকে শ্যামের পুঁতা খাওয়াতে নিয়ে এলো? শান্তি মনে হয় বাজি ধরেছিল কারো সঙ্গে। এর চেয়ে কঠিন বাজি ছিল যখন হিন্দু অধ্যুষিত পাল সমাজে থেকে শান্তি স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয় এবং এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে, নাকি সে সংস্কারের দেয়াল ভাঙতে চেয়েছিল?

‘তুমি মুসলমান হলে কোন খুশিতে, শান্তি?’

‘তাইলে আমার স্টোরি হুনেন।’

‘সংক্ষেপে বলো, আমি হিস্টোরি শুনতে চাই না। তুমি প্যাঁচাল শুরু করলে শেষ হয় না।’

‘বস আমি হিন্দু ছিলাম, কারণ বাপ-মা হিন্দু আছিল। যেমনে আপনে মুসলমান। এইডা তো কোনো ব্যাপার না। আমার বাপ-মা ইন্ডিয়া চইলা গেল আমাগো নিয়া। আমার কাকা আগেই গেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, আর ফিরা আসে নাই, সে আমাগো ফুসলাইয়া নিয়া গেল। ওইখানে মন টিকে নাই, তিন মাস পর কাউরে না বইলা আমি দেশে ফিরা আইলাম।’ শান্তি একটু জিরিয়ে নেয়।

‘কী করি, কী করি? শেরেবাংলা রোড আর চিপাচাপা গলিতে ফাও ঘুইরা বেড়াই। একদিন রায়েরবাজার মুক্তি হলের টিকিট ম্যানেজার ফরহাদ চাচার সামনে পইড়া গেলাম। চাচা কইল, তর বাপেরে যাইতে মানা করছিলাম, আমার কথা হুনল না। শেষে চাচা হলের প্রজেক্টরম্যানের চাকরি জোগাড় কইরা দেয়। তার বাসায় আসমারে দেখি। চাচা শর্ত দিলো, আসমারে বিয়া করতে অইলে আমার মুসলমান অইতে অইব। মসজিদে যাইয়া কলেমা পইড়া মুসলমান অইয়া গেলাম, ব্যস। মুসলমান হওয়া কঠিন কিছু না। শ্বশুর আর আসমার চাপাচাপিতে সুন্নতে খৎনাও করাইলাম। খরচ শ্বশুর দিছিল।’ আমার আক্কেল গুড়ুম, ছেলে বলে কী?

মুক্তি হলে রানিং সিনেমার বিরাট রঙিন পোস্টার দেখেছি অনেক : হিরো ভিলেনের সঙ্গে ফাইট করছে, বা হিরো হিরোইনকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে টগবগ ছুটে চলেছে। মুক্তি হল দর্শক ভালোই টানত, তবে হলে কোনোদিন আমি সিনেমা দেখিনি। সিনেমা হলের প্রজেক্টরম্যান ছিল সানোয়ার পাল, আমাদের শান্তি। ‘মুসলমান হওয়ার পরও তুমি পাল টাইটেল রেখেছ কেন?’ শান্তিকে জিজ্ঞেস করি। ‘আমার বাপ-ঠাকুরদা কুমার আছিল, বংশের পরিচয় আমি তো মুইছা ফেলতে পারি না।’

ষাটের দশক থেকে রায়েরবাজারে এক প্রভাবশালী পরিবার হিন্দুদের অনেক জায়গা দখল বা নামমাত্র দামে কিনে নেয়। এদের কারণে রায়েরবাজারে আমাদের কেনা প্লট খালি রাখা মুরব্বিরা নিরাপদ মনে করেননি। তাদের নির্দেশে আমি ও গ্রাম থেকে আসা এক চাচাতো ভাই রবিদা প্লটের এক মাটির ঘরে মাঝে মাঝে এসে থেকেছি; মাটির ফ্লোরে কাঁথা বিছিয়ে রাতে ঘুমিয়েছি, কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের পেছনের বাউন্ডারি দেয়াল-সংলগ্ন প্লটে এক পাল পরিবারে ছিল আমাদের বয়সী ছেলে শান্তি ও মেয়ে তাপসী। শান্তির সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। রবিদা আরেক ধাপ এগিয়ে তাপসীকে লাইন করে ফেলেছিল। রবিদা ব্যাপারটি গোপন রাখেনি। শান্তি ব্যাপারটার আভাস পেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সে রবিদার এত ভক্ত ছিল, মাইন্ড করেনি। আমাদের বর্তমান দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আনন্দ ভবনের পেছনেই ছিল শান্তিদের বাড়ি : মাটির ঘর, জংপড়া টিনের চাল, উঠানে মাটির ঢিবিতে তুলসীগাছ; বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের এক রাজনৈতিক নেতার অপরিকল্পিত দোতলা বাসভবন। ছাদের টবে তুলসীগাছ।

সর্দি-কাশি হলে পাতা চায়ে দিয়ে খায় নিশ্চয়।

‘তোরে নাড়ু-মোয়া খাওয়ামুনি চল’, এই বলে রবিদা একদিন আমাকে রাতের বেলা আমাদের প্লটের বাউন্ডারি দেয়ালের পাশে নিয়ে গেল। তাপসী কিছুক্ষণ পর আমাদের জন্য নাড়ু-মোয়া নিয়ে আসে। অন্ধকার রাত, দুই টিনএজড মুসলিম-হিন্দু

প্রেমিক-প্রেমিকা দাঁড়িয়ে কথা বলে, তাদের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া নয়, শ্যাওলাপড়া সুরকি ও লাল ইটের ১৫ ইঞ্চি পুরু দেয়াল। আমি দেয়াল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে কুড়কুড়ে মোয়া খাচ্ছি। মুড়ির নাকি চিড়ার মোয়া, এখন বলা সম্ভব নয়। সেই রাতে এরা কতটা কাছে এসেছিল? রবিদা নিশ্চয়ই তাপসীকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল বা করেছে। রবিদা বয়সের চেয়ে বেশি পেকে গিয়েছিল; বয়ঃসন্ধিক্ষণের নানা বিষয় নিয়ে গল্প করত। এরকম রাত এদের টিনএজ জীবনে আর কী এসেছিল? কীভাবে শুরু হলো, কতদূর গড়িয়েছিল ও কতদিন টিকেছিল এই প্রেম? ধর্মীয় বিধিনিষেধ? কুছ পরোয়া নেই।

সে-রাতে আমি কিছুটা রোমাঞ্চ বোধ করেছিলাম বইকি ফ্রি নাড়ু-মোয়া খেয়ে। নাড়ু-মোয়ার জন্য আমার তরফ থেকে তাপসীর ধন্যবাদ পাওনা ছিল। এখন মুড়ির মোয়া ডজন ১০০ টাকা, সোনার ভরি দেড় লাখ টাকা। পালদের অনেকেই এখন সোনারু।

রবিদা শেষ পর্যন্ত কুলকুচা করে মুখ ধুইয়ে ফেলার মতো তাপসীকে ভুলে যান, তারপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। পৃথিবীতে উঠতি বয়সের এমন কত আলগা প্রেম গজায়, আবার ঝরেও পড়ে। তাপসী কোথায় গেল, কার সঙ্গে বিয়ে হলো, কোথায় ঠাঁই হলো, সে এখন কার জন্য মোয়া বানায় – এটা নিয়ে একেবারে মাথা ঘামাইনি।

স্বাধীনতার পর আমরা পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী থেকে পাকাপোক্ত রায়েরবাজারে চলে আসি। এসে উড়ো কথা শুনি, শান্তি এক মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে মুসলমান হয়েছে। আরো শুনলাম সে রায়েরবাজার মুক্তি সিনেমা হলে প্রজেক্টর চালায়।

শেরেবাংলা রোড দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কখনো শান্তির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সিনেমা ব্রেকের সময় হলের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তি সিগারেট টানছে। ‘ফারুক ভাই’, আমাকে দেখে বলেছে, ‘আমার লগে প্রজেক্টর রুমে বইয়া একদিন সিনেমা দেহেন। আমরা চা খামু আর সিনেমা লইয়া প্যাচাল দিমু।’ শান্তি জানত এইসব ধুমধাড়াক্কা বাংলা সিনেমা আমি দেখি না, তারপরও সে আমাকে সিনেমা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমাকে উসকানোর চেষ্টা করেছে।

‘ফারুক ভাই, আপনারে আসল সিনেমার লগে কাট পিস দেহামুনে’, শান্তি আমার জন্য টোপ ফেলে। ‘শালা, তুমি প্রজেক্টর রুমে বইসা কাট পিস মারাও না! দাঁড়াও’, এই বলে আমি ওকে মারার কপট ভঙ্গি করি। ‘আমারে মাইরেন না বস, মাফ চাই’ – এরকম একটা অ্যাক্টিংয়ের সিন করে শান্তি আবার হলে ঢুকে পড়ে।

অনেক বছর পর মুক্তি সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তি বলে, ‘ফারুক ভাই আইজকা মুক্তি হলে আমার লাস্ট শো, এইডা অন্তত আমার লগে দেহেন।’ ঘটনা কী জানতে চাইলাম।

‘আপনে হুনেন নাই, মুক্তি সিনেমা হল ভাইঙ্গা মার্কেট বানাইব?’

‘তুমি কী করবা এখন?’

‘আমি এহন ঘরজামাই অইয়া যামু’, শান্তি মুচকি হাসে। ‘আমার শ্বশুর অনেকদিন ধইরা চাইতাছে’, এই বলে সিনেমার পোস্টার আঙুল দিয়ে দেখায়। হলে তখন ‘শ্বশুর কেন ঘরজামাই’ নামে একটা সিনেমা চলছিল। মুক্তি সিনেমা হল আসলে বন্ধ হয়নি তখন, এর অর্থ দাঁড়ায় শান্তি আমাকে ব্লাফ দিয়েছে, কিন্তু শান্তিকে আর দেখিনি। সে হয়তো পরিকল্পনা করে রায়েরবাজারের সিন থেকে ফেড আউট হয়ে গেল।

মুক্তি সিনেমা হল শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয় কোভিডের সময়। পরিত্যক্ত হলের সামনে যেখানে সিনেমার দর্শকের ভিড় দেখা যেত, বিশেষ করে সিঁথিতে সিঁদুর, সাড়ে তেরো হাত লাল পেড়ে শাড়ি পরা হিন্দু মহিলা, সেখানে এখন একাধিক দোকানপাট, আছে গরুর গোশতের এক জমজমাট দোকান। এ কসাইয়ের দোকানটি উৎকৃষ্ট গরুর মাংসের জন্য এখন বিখ্যাত। আমি একদিন  দোকানে ঢুকে বোকার মতো কসাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মহিষের মাংস আছে?’ আমার কেন জানি না তখন মহিষের মাংস খাওয়ার শখ হয়েছিল।

‘কী বলেন স্যার?’ কসাই আমার দিকে অবাক হয়ে বলল, ‘আমি মহিষের মাংস বিক্রি করি না। দেখছেন না সাইনবোর্ডে লেখা : গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজি ৭২০ টাকা।’ কসাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে ধারণা হলো, এই কসাই অনেক বছর আগে একসময় গরুর মাংসের সঙ্গে মহিষের মাংস মিশিয়ে বিক্রি করেছে। সে-সময় মহিষের মাংসের মূল্য গরুর মাংসের চেয়ে কম ছিল। একইভাবে খাসির মাংসে বকরির মাংস ভেজাল দেওয়া হতো। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা; আমি দরাদরি করে ৭০০ টাকায় এক কেজি ভেজালমুক্ত গরুর মাংস কিনলাম।

শেরেবাংলা রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম, যেখানে আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মুক্তি সিনেমা হলের কাছেই এই এলাকার একমাত্র ওষুধের দোকান তরণী পাল ফার্মেসি ছিল। ফার্মেসির ফার্মাসিস্ট এবং কম্পাউন্ডার ছিলেন স্বয়ং তরণী পাল।

মজার ব্যাপার, তরণী পালের আরেকটা পেশা ছিল, গরু এবং ছাগলের গর্ভধারণের জন্য প্রজননসেবা প্রদান করা। ফার্মেসির পেছনে ছিল আস্তাবল, যেখানে সবার দৃষ্টিগোচরের মধ্যে এই প্রজনন ব্যবসা চলত। আস্তাবলে বিশাল ষাঁড় এবং রামছাগল সবসময় প্রজননসেবা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকত। এটি স্পষ্ট, প্রজননসেবাই ছিল তার মূল ব্যবসা, ফার্মেসি তার সাইড বিজনেস হিসেবে এসেছিল।

গরুর মাংস নিয়ে আমাদের দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে আমার ফ্ল্যাটে ফিরে যাই। কাছের গলিতে শ্রী মহাপ্রভু আখড়া মন্দিরে হোলি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী মেলা ও কীর্তন উৎসব চলছে, আমি ঢোল আর মাদলের শব্দ শুনছিলাম। আবার তরণী পাল এবং তার পূর্ববর্তী প্রজনন ব্যবসা, আমার বন্ধু শান্তিরঞ্জন পাল ওরফে সানোয়ার পাল নিয়ে ভাবনায় ডুবে যাই।

তরণী পালের ফার্মেসি একসময় এলাকার বৃদ্ধদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যারা ওষুধ কিনতে এসে আড্ডায় জমে যেতেন, তারা ফার্মেসির পেছনের আস্তাবলে প্রজননসেবার দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে গেছেন বছরের পর বছর। অবশেষে কৃত্রিম প্রজনন প্রথাগুলো পুরনো প্রজনন পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করে এবং আস্তাবল ও কুমার পেশা দখল করে নেয় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ইট-কাঠ-কংক্রিটের বাক্স।

শান্তি আমার কাছে একবার গোমাংস ভক্ষণের ইচ্ছা পোষণ করে। আমি তাকে কঠিন ভাষায় সতর্ক করি এ-ধরনের হঠকারিতা না করতে। তবে আমি তাকে পরামর্শ দিই, সে যেন তাদের শাস্ত্রবিদদের কাছে জিজ্ঞেস করে, মহিষের মাংস তার জন্য জায়েজ কি না? যদি জায়েজ হয় তবে মহিষের মাংস খেয়ে দেখতে পারে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট থেকে আসা এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা জানায়, পশ্চিমবঙ্গে তারা সুখে আছে। তারা কেজি ২০০-২৫০ টাকায় গরুর গোশত কিনে খায়, যেখানে বাংলাদেশে গরুর গোশত ৭২০-৭৫০ টাকা কেজি।

মুক্তি সিনেমা হলের প্রজেক্টরম্যান হিসেবে শান্তির শেষ কর্মদিবসে তাকে বলি, ‘তুমি এত সিনেমা পর্দায় প্রজেক্ট করেছ, কত ড্রামা ও ফাইট দেখেছ, তুমি দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর মতো একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলো।’

‘বস দেইখাই মানুষ ওস্তাদ হইয়া গেলে কোনো কথা ছিল না। আমার কুমার বাপেরে দেইখাও আমি তো হাঁড়ি-পাতিল বানাইবার চাক্কি ঘুরাইবার পারি নাই, খালি হাত পিছলাইয়া যাইত। আমি নামেই আছিলাম পাল।’ ‘পাল’ শব্দের আরেকটি অর্থ আছে – গবাদিপশুর প্রজননসেবা প্রদান, যা আমি বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানে আবিষ্কার করি।

শুনেছি তরণী পালের প্রজনন ব্যবসা উঠে গেলে আস্তাবলের প্রজননসেবায় নিয়োজিত বিশাল ষাঁড় ও রামছাগল গাজীপুর সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে তারা মহানন্দে ভারত থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে আসা কয়েকটি মাদি নীল গাইয়ের সঙ্গে প্রজনন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় এবং তা থেকে নতুন প্রজাতির গবাদিপশুর উদ্ভব হয়, যার গোশত গরু বা ছাগলের গোশতের চেয়ে বেশি সুস্বাদু এবং কম ক্লোরেস্টেরলযুক্ত।

এভাবে রায়েরবাজারের কুমার বা পাল বংশ থেকে উদ্ভূত শান্তিরঞ্জন পাল মুক্তি সিনেমা হলের শেষ প্রজেক্টরম্যান হিসেবে এবং ফার্মাসিস্ট তরণী পাল নতুন এক উন্নত জাতের গবাদিপশু উদ্ভাবনে অবদান রাখার জন্য রায়েরবাজারের মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে বছরের পর বছর।