কাজী রোজী
ভালোবাসার আয়নাপথে আনিলা কী দেখতে পায় – আমি জানতে চেয়েছিলাম। বারো বছরের আনিলা এমন জবাব দেবে বুঝতে পারিনি। প্রতিবন্ধিতা দিয়ে যার সমস্ত অস্তিত্ব জড়ানো – মনন-মেধার সাথে সারাক্ষণ যুদ্ধ – দারুণ হুইল চেয়ার যার চলনশক্তির ধারাপাত – যার বলনের উৎসে অদ্ভুত অস্পষ্টতার এলোমেলো ভাব – যার উচ্চারণে ছবি কথা বলে – সাহস প্রজ্বালিত হয় – দাঁড়াবার নিজস্ব জায়গা করে দেয় – তার ভালোবাসার আয়নাপথে ভালোবাসাই তো থাকবে।
আনিলা : আন্টি আমি তোমাকে ছবি দেবো!
আমি : ছবি দেবে! কই দেখি!
আনিলা : এই তো দেখো – সবুজের বুকে লাল টিপ। সুন্দর হয়েছে না?
আমি : খুব সুন্দর হয়েছে আনিলা। তুমি আর কী অাঁকতে পারো?
আনিলা : পুলিশ – পুলিশ অাঁকতে পারি। ওরা আমাদের রাস্তা পার করে দেয় না। কেন দেয় না বলো তো। ওরা তো আমাদের বন্ধু।
আমি : বন্ধু! কে বলেছে?
আনিলা : কেন, বাবা বলেছেন। টিচার বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। আমি শুনেছি। জানো, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছি – আমাদের জন্যে সহজ রাস্তা বানিয়ে দিতে। বাবাকে জিগ্যেস করে দেখো – বাবা জানে। কি বাবা ঠিক না? আমি এখন একটা গান বলবো!
আমি : আনিলা, গান গাইবে। বেশ তো গাও। কোন গানটা বেশি পছন্দ?
আনিলা : আমরা করবো জয়…
আমি : বাহ্! খুব সুন্দর। আর কোনটা বলো –
আনিলা : এক সাগর রক্তের বিনিময়ে…
আমি : আর – আর কোনটা!
আনিলা : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…
আমি : আচ্ছা আনিলা – তুমি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাস? মাকে, বাবাকে, নাকি…
আনিলা : আরে না… না অ্যান্টি – আমি আমার নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
আনিলা ওর ডান হাতটা একটুখানি উঁচু করে বুকের ওপর রাখলো। ওর বাবা ওর মা ওর ভালোবাসার আয়নাপথে শুধু তাকিয়ে রইলেন।
বাবা : দুটি সন্তান হারানোর পর – আনিলা আমাদের তৃতীয় সন্তান।
আমি : ওর অস্বাভাবিকতা কবে থেকে টের পেলেন?
বাবা : জন্মের পর মাস তিনেকের মধ্যেই বুঝতে পারি।
মা : এরপর ওকে যা দিয়েছি তা হলো যত্ন, সাহস আর সচেতনবোধ।
আমি : আপনাদের অপরিসীম ধৈর্য এবং সততা আনিলাকে এখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর ভালোবাসা দিয়েছে।
বাবা : আমি আনিলার বিশ বছর বয়সের কালে বলবো – ‘তোমরা নিজেদের বিশ্বাস থেকে নিজেরা কথা বলো।’ ওরা মানিক মিয়া এভিনিউতে সারিবদ্ধ হুইল চেয়ারের মিছিল নিয়ে বলবে – ‘আমরা মানুষ। দারুণ মশাল হয়ে জ্বলছি। তোমরা আমাদের সবটা দেখ, জানো, বোঝো – তারপর গ্রহণ করো।’
আমি : নিশ্চয়ই ওদের কথা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
মা : আমরা ওদের সেই প্রত্যয়ী পথ তৈরি করে দেবো।
আমি : আপনাদের একনিষ্ঠতা ওদের সেই সোনালি সকাল এনে দিক – এই প্রত্যাশা।
আনিলা : আন্টি, আমি তোমাকে একটু আদর দেবো।
এসো কাছে এসো।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.