শতবর্ষে ট্রাকটেটাস এবং ল্যুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের একটি চমৎকার জীবন

তীক্ষè ঈগলচঞ্চু নাসা, অল্পবয়সী ছোটখাটো একজন মানুষ যুদ্ধে যাচ্ছেন। তিনি সংস্কৃতিমনা অপরিমেয় ঐশ^র্যের অধিকারী একটি অস্ট্রিয়ান পরিবারের সন্তান। তিনি কথা বলেন ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকদের মতো করে উচ্চস্বরে, যদিও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো খ্যাতনামা দার্শনিকের সঙ্গে তর্ক করার মতো ইংরেজিটাও তাঁর আয়ত্তে। এ-কারণেই তিনি আশা করেন যে, রাসেল তাঁকে দর্শনের জগতে পা রাখার জন্য জায়গা করে দেবেন। সদ্যপ্রয়াত একটি ইস্পাত সাম্রাজ্যের গোত্রপতি, যিনি আশা করতেন যে, তাঁর সন্তানেরা কর্তব্যের শক্তি দিয়ে চালিত হবে, সেই কার্ল ভিটগেনস্টাইনের এই কনিষ্ঠ পুত্রটির নাম ল্যুডভিগ জোসেফ জোহান ভিটগেনস্টাইন।

পিতা ইউরোপের একজন ধনকুবের ইস্পাতসম্রাট হলেও ল্যুডভিগ নিজে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবেই গোলন্দাজ বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হয়েছেন। তাঁর পিঠের ঝোলায় রয়েছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে দর্শনশাস্ত্রের একটি বই, হাতে-লেখা কিছু নোট – যা প্রধানত প্রতিজ্ঞা বা বিবৃতির যৌক্তিক ভাষা (Logical form of proposition) সংক্রান্ত।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন তা প্রকাশিত হয়, তখন খুব কম লোকই তা পড়ে দেখে। অবশ্য এর লেখক নিজেও ঠিক এমনটাই হবে বলে নিশ্চিত ছিলেন। তবে মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এই বইটি, যার নাম Tractatus Logicus Philosophicus – তাঁকে সুধীসমাজে পরিচিত করায় একজন জিনিয়াস হিসেবে। দর্শনজগতের অনেক বোদ্ধার মতে, ক্ষীণতনু এ-বইটি বিশ শতকের দর্শনবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই এবং ল্যুডভিগ ভিটগেনস্টাইন হচ্ছেন এ-শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন দার্শনিক।

ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাস জার্মান ভাষায় প্রথমবার প্রকাশ পায় ১৯২১ সালে, যা আধুনিক দর্শনের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি কাজ, হয়তো বা তারও চেয়ে আরো বেশি কিছু। এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ বের হয় এক বছর পর, অর্থাৎ ১৯২২ সালে, যেটি খ্যাতনামা দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ভূমিকাসহ র‌্যামসে ও ওগডেনের একটি দ্বিভাষিক সংস্করণ। একই বছরে প্রকাশিত হয় আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই – ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের ইউলিসিস এবং কবি টি. এস. এলিয়টের কাব্যগ্রন্থ দ্য ওয়েস্টল্যান্ড। কাজেই বছরটি শুধু ট্রাকটেটাসই নয়, সে দুটো বইয়েরও শতবর্ষ।

অনেকেই মনে করেন যে, ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাসকে খুব সহজেই একটি ‘যুদ্ধ কবিতা’ বলে অভিহিত করা যায়, যার গঠনে আমলাতন্ত্র ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন রয়েছে ব্যঙ্গ-পরিহাস, তেমনি অন্যদিকে এর ভাষায় রয়েছে একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের যুদ্ধকালীন অনুভূতি ও উপলব্ধিজাত অপ্রকাশ্যযোগ্য ধ্যান। ট্রাকটেটাসের ক্ষীণ কলেবর সম্পর্কে ভিটগেনস্টাইনের অনুবাদক ওগভেনকে বলেছিলেন – ‘বইটির ছোট কলেবর নিয়ে আমি বলতে চাই যে, আমি এজন্যে সত্যি দুঃখিত। যদি আপনি আমাকে লেবুর মতো আরো চাপতে থাকেন, তবু আমার থেকে এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাবেন না।’ এতে মূল সাতটি ভাষ্য রয়েছে, যেগুলি আবার কতগুলি উপ-ভাগে বিভক্ত (১, ১.১, ১.১১ ইত্যাদি)। এর শুরুর বাক্যটি হচ্ছে – ‘বিশ^ই সব, আর এই হচ্ছে ঘটনা।’ শেষ বাক্যটি হচ্ছে – ‘যখন একজন কিছুই বলতে পারে না, তখন তার চুপ করে থাকাই শ্রেয়।’

দুই

ল্যুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের পিতা কার্ল ভিটগেনস্টাইন ছিলেন নিজের কঠোর পরিশ্রমে একটি ইস্পাত-সাম্রাজ্য গড়ে তোলা ইউরোপের সবচেয়ে ধনী পরিবারের গোত্রপতি। তৎকালীন ইউরোপে একমাত্র রথটাইল্ড পরিবার ছাড়া আর কেউই ভিটগেনস্টাইন পরিবারের মতো সম্পদশালী ছিল না। শুধু সম্পদে নয়, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষেও তাঁদের পরিবারের অর্জন ছিল ঈর্ষণীয়। ভিয়েনা শহরের বেশ কিছু শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক – যেমন কার্ল ক্রাউস, গুপ্তাভ ক্লিমেট, অস্কার কোকোশকা, সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তি এই পরিবারে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতেন। আবার রাতে গানের জলসায় সেখানে যোগ দিতেন জোহানেস ব্রাহমস্, গুপ্তাভ মাহলার, ব্রুনো ওয়াল্টার প্রমুখ গুণী সংগীত-ব্যক্তিত্ব।

ল্যুডভিগের মা লিওপোল্ডিন যেমন ছিলেন উঁচুদরের পিয়ানোশিল্পী, তেমনি তাঁর সন্তানদেরকেও তিনি তা শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদের এক ছেলে পল হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত পিয়ানোশিল্পী, অন্যজন হ্যান্স তো প্রায় মোজার্টের মতোই সংগীত-জগতের বিস্ময়বালক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তবে নানা দুর্যোগও তাঁদের পরিবারে নিষ্ঠুর হাত প্রসারিত করেছিল – ভিটগেনস্টাইন-ভ্রাতৃদের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন – হ্যান্স, রুডলক ও কূর্ট অপমৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছেন। এর একটি বড় কারণ অবশ্য ছিল ছেলেদের ইচ্ছেমতো পেশা বেছে নেওয়ার পরিবর্তে পিতার ব্যবসায় লেগে যেতে জোর-জবরদস্তি, এতে পিতার প্রতি বিরক্ত হয়ে হতাশ পুত্ররা শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হয়।

তরুণ ল্যুডভিগের চিন্তায় গভীর প্রভাব রেখেছে যে-বইটি, তা হচ্ছে Sex and Character (১৯০৩), যা মনোজাগতিক অন্তর্দৃষ্টি ও পূর্ব-সংস্কারের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এর লেখক হচ্ছেন তরুণ অস্ট্রিয়ান দার্শনিক অটো উইনিগার, যিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন। এ-বইয়ের প্রভাব থেকেই ল্যুডভিগ এমন একটি জীবনদর্শন আত্মস্থ করেন, যার ফলে বিপুল সম্পদের লোভ ত্যাগ করে তিনি একজন নির্লোভ সন্তের জীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন। বিশ শতকের প্রথম কয়েকটি দশকে প্রায় সবকিছুই যখন বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়ে গেছে, ভিটগেনস্টাইন তখন বলেছেন যে, আসলে কিছুই ব্যাখ্যা করা হয়নি। জীবনের ধাঁধার প্রকৃত উত্তরটি হচ্ছে – এর কোনো উত্তর নেই।

সংগীতে যথেষ্ট আসক্তি থাকলেও ভিটগেনস্টাইনের প্রকৃত উৎসাহ ছিল প্রকৌশলে, যার ফলে তিনি বিমানচালনা বিদ্যা (aeronautics) শিখতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে যান। সেখানেই তিনি জেট প্রপেলারের ডিজাইন শিখতে গিয়ে গভীরভাবে নিমগ্ন হন গাণিতিক সমস্যাবলি সমাধানে। বার্ট্রান্ড রাসেলের Principles of Mathematics ও গটলের প্যেগের Foundations of Arithmetic বইগুলি পাঠ করে গণিত ও যুক্তিবিদ্যার সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন।

তিন

ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে যখন রাসেলের সঙ্গে ভিটগেনস্টাইনের প্রথমবার দেখা হয়, তখন ভিটগেনস্টাইন নাকি রাসেলকে বলেছিলেন  –  ‘আপনি কি মনে করেন আমি এতোটাই মাথামোটা যে, আমার অ্যারোনটিক্স নিয়েই পড়ে থাকা উচিত, নাকি আমি দর্শনের জগতে পা রাখার ক্ষমতা রাখি?’ রাসেল তখন তাঁকে বললেন সামনের ছুটিতে দর্শনের কোন একটি বিষয় নিয়ে কিছু একটা লিখে আনতে, যাতে তিনি তা পড়তে পারেন। ভিটগেনস্টাইন ঠিক সে-কাজটিই করলেন এবং তা রাসেলের হাতে তুলে দিলেন। লেখাটির প্রথম লাইনটি পড়েই রাসেল নাকি চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন – ‘ল্যুডভিগ! তোমার আর বিমান-প্রকৌশলী হওয়া হয়ে উঠছে না।’

দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নিয়ে রাসেলের সঙ্গে ভিটগেনস্টাইন এতো গভীরভাবে কাজ করেন যে, এক বছরের মাথায় এসেই গুরু তাঁর শিষ্যকে বললেন – ‘তোমাকে শেখানোর মতো আর কোনো বিদ্যা আমার ঝুলিতে নেই।’ কিছুদিন পর ভিটগেনস্টাইনের নিজেরও যখন এই একই উপলব্ধি হলো, তখন তিনি ক্যামব্রিজ ছেড়ে নরওয়েতে একটি খাঁড়ির ধারে নির্জন একটি গ্রীষ্মবাসে চলে গেলেন। এখানেই নির্জন পরিবেশে তাঁর নিজের মনে দার্শনিক চিন্তার ভ্রƒণ জন্ম নেয়, যাকে পরে Picture theory of Meaning নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর এ-চিন্তায় যে-বইটি তাঁকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, তা হচ্ছে উইলিয়াম জেমসের লেখা ভ্যারাইটিস অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স (Varieties of Religious Experience)। যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর এই ধারণা তিনি তখনো কোথাও লিপিবদ্ধ করেননি, কেবল চিঠিতে রাসেল ও জি. ই. ম্যুরকে শুধু তাঁর চিন্তার রূপরেখাটি তুলে ধরেছিলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তটিতে, অর্থাৎ ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে ল্যুডভিগ তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ভিয়েনা এসেছিলেন। সে-সময়ে আবার নরওয়ে ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি অস্ট্রিয়ান সেনাদলে যোগ দেন – এটি হয়তোবা শুধু নিছক কর্তব্যবোধ থেকেই। কেন তিনি যুদ্ধে যোগ দিলেন, তা একটি জটিল প্রশ্ন এবং তার উত্তর এককথায় দেওয়া মুশকিল। একজন হার্নিয়া রোগী হিসেবে সহজেই তিনি যুদ্ধের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারতেন, তা না হলেও সামান্য পারিবারিক প্রচেষ্টাই তাঁকে এ-দায়িত্ব থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারত। যুদ্ধে যাওয়াটা  ছিল তাঁর কাছে একটি পরীক্ষা, আর মৃত্যুর মুখোমুখি হলে কী হবে, তা দেখতে পাওয়ার আকাক্সক্ষাও এতে মিশে ছিল। তাই যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু-মাসের মধ্যেই সৈনিক এল. জে. জে. ভিটগেনস্টাইনকে দেখা গেল দখলকৃত একটি রাশিয়ান গানবোটে চড়ে তিনি পোল্যান্ড সীমান্তে ভিস্তুলা নদী পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। যুদ্ধের প্রথম দু-বছর ফ্রন্টে পেছনের দিকে থাকলেও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন সম্মুখযুদ্ধে অগ্রবর্তী লাইনে পাঠানো হয়। এভাবেই তিনি রুশ ফ্রন্টে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে বিপজ্জনক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

‘মৃত্যু জীবনের কোনো ঘটনার অংশ নয়, আর আমরা কেউই মৃত্যুকে আবাহন করতে বেঁচে থাকি না। আমার ভাষার সীমাবদ্ধতাই আমার পৃথিবীর সীমা নির্ধারণ করে। জীবনের সমস্যাগুলির সমাধান হিসেবে দেখা হয় সমস্যাগুলিকে মুছে দেওয়া।’ মার্জোরি পারলফ, যিনি ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাসের একজন মনোযোগী পাঠক, তিনি দাবি করেন যে, Varieties of Religious Experience সমাধান করা যাবে না – এমন কিছু রহস্যের স্বীকৃতি এ-বইটিকে আধুনিকতার একটি ভিত্তিপুস্তক হিসেবে তুলে ধরেছে। ভিটগেনস্টাইনের জীবনীকার রে মঙ্ক দেখিয়েছেন যে, নীতিবিদ্যা, নান্দনিকতা, আত্মা ও জীবনের উদ্দেশ্য বা অর্থ ইত্যাদি বিষয়ে ভিটগেনস্টাইনের চিন্তার প্রতিফলন সে-অংশটিতে অনুপস্থিত, যে-বইটির খসড়া নিয়ে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। তাই ১৯২১ সালে প্রকাশিত ট্রাকটেটাস বইটিতে তিনটি স্রোতের মিলন লক্ষ করা যায় –  ভিটগেনস্টাইনের ক্ষতবিক্ষত কর্তব্যবোধ, যুক্তিবিদ্যার ওপর রাসেলের কাজ এবং পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধফ্রন্টে গোলন্দাজ বাহিনীর সদস্য হিসেবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর গভীর প্রত্যক্ষণ। যুদ্ধশেষে দীর্ঘদিন পর তিনি তাঁর ভাগিনেয়কে লিখেছিলেন – ‘যুদ্ধ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, আমি জানি না এটি না হলে আমি কী করতাম!’

ভিটগেনস্টাইন বেড়ে উঠেছেন কর্তব্যের জগতে। তিনি ও তাঁর সমবয়সীরা এটি বুঝে উঠতে সংগ্রাম করছিলেন যে, একজন অস্ট্রিয়ান হিসেবে, সন্তান ও পূর্ণবয়স্ক হিসেবে তাঁরা কীভাবে পৃথিবীতে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে বেঁচে থাকতে পারেন? ল্যুডভিগের পিতা কার্ল কর্তব্যকে মনে করতেন সংগ্রাম ও বিশ^স্ততা, যিনি তাঁর নিজের সংগ্রামী জীবনের প্রতিরূপেই সন্তানদের মানুষ করতে চাইতেন। তাঁর সন্তানদের ওপর তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন যে খুব একটা সুখকর হয়নি, তা আমরা জানি। কনিষ্ঠতম সন্তান হিসেবে ল্যুডভিগ তাঁর বাল্যবয়সে পিতৃশাসনের লৌহমুষ্টি থেকে কিছুটা রেহাই পেলেও তাঁর ওপরও তা গভীর প্রভাব রেখে গেছে। ল্যুডভিগকে তাঁর পরিবার একজন কর্তব্যপরায়ণ সন্তান বলেই মনে করত, তবে অন্য সন্তানদের চেয়ে তুলনামূলক নিষ্প্রভ হলেও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির কলাকৌশলে তাঁর উৎসাহ ছিল।

পারিবারিক সূত্রে ঘনিষ্ঠতার ফলে জার্মান গণিতবিদ গটলব ফ্রেগের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, যিনি তাঁকে বার্ট্রান্ড রাসেলের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগটি করে দিয়েছিলেন। উনিশশো এগারো সালের অক্টোবরে প্রথমবার যখন ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ে ভিটগেনস্টাইন ও রাসেলের দেখা হয়, তখন তরুণ ও বয়স্ক এই দুই ব্যক্তি একে অন্যকে যেমন চমৎকৃত করেছিলেন, তেমনি একই সঙ্গে হয়েছিলেন বিরক্ত ও হতাশ। রাসেল উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, কারণ তাঁর নিজের বৌদ্ধিক ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু, যেজন্য তিনি একজন যথার্থ উত্তরাধিকারী খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। অন্যদিকে নিজের সামর্থ্যরে ওপর সন্দিহান ভিটগেনস্টাইন শুধু জানতে আগ্রহী ছিলেন দর্শন তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হতে পারে কি না!

রাসেলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই, ম্যানচেস্টারে বিমান চালন-প্রকৌশল শেখার সময় থেকেই তিনি তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরে ঘুড়ি ওড়াতেন এবং রাসেলের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা পাঠ করতেন – যা যুক্তিবিদ্যার ভিত্তির ওপর গণিতকে পুনর্নির্মাণ করার একটি অসফল প্রয়াস। ক্যামব্রিজে এসে তিনি তাঁর হবু তত্ত্বাবধায়ককে কিছুটা নাজেহাল করেছিলেন এবং গণিতের স্নাতক ছাত্র ডেভিড হিউম পিনসেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ইংরেজ বন্ধু এবং সম্ভবত তাঁর পরবর্তী জীবনের প্রথম প্রেমাস্পদ। তবে ক্যামব্রিজে আসার দুই বছরের মধ্যেই অ্যাকাডেমিক দর্শনের বদ্ধ, গুমোট পরিবেশ তাঁকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। এভাবেই তিনি আলিঙ্গন করে নেন নিঃসঙ্গতাকে, যা তাঁকে স্থান করে দিয়েছে চিন্তা করতে ও লিখতে। এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে নরওয়েতে একটি নির্জন খাঁড়ির পাশে স্বনির্মিত একটি কুটিরে তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসনে এবং সেখান থেকে প্রথম মহাযুদ্ধে সৈনিক-ব্রত পালনের মহাযজ্ঞে যাত্রায়।

পাঁচ

ভিটগেনস্টাইনের যুদ্ধ-কার্যক্রম সম্বন্ধে দুটি ইতিহাস লেখা সম্ভব – এর একটি তাঁর কর্মস্থল ও পদায়ন, আক্রমণ ও পশ্চাদপসারণ নিয়ে; অন্যটি তাঁর নিজের সত্তার ভেতরের যুদ্ধ – শিষ্টাচার, শুদ্ধতা ও স্থিতি অর্জনে তাঁর অবিরাম প্রয়াস। যুদ্ধের প্রথম কয়েকটি মাস জুড়ে তাঁর চাকরিটি ছিল একজন সন্তের মতো, যিনি তাঁর নিজের ভীরুতা ও আত্মতুষ্টি দেখে ভীত হয়েছেন। যারা তাঁর সঙ্গে বাহিনীতে একই কাতারে ছিল, সহযোদ্ধা সেই চাষি সেনাদলের সদস্যদের প্রতি তিনি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। তলস্তয়ের একমাত্র যে-বইটি দিনরাত তাঁর সাথি ছিল, তা তিনি পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলেন এবং তলস্তয়ের এই গস্পেল সম্ভবত তাঁকে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিতও করে ফেলেছিল। এটি তাঁকে এনে দিত ইন্দ্রিয়াতীত একটি সুখানুভূতি – ‘আমি হচ্ছি চেতনা, সুতরাং আমি মুক্ত। আমার আত্মার বিশুদ্ধতার তুলনায় আমার চারপাশে ঘটা বৈশি^ক ঘটনাসমূহ খুবই অকিঞ্চিৎকর।’

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কর্তব্য হচ্ছে স্বার্থহীনভাবে বাঁচা, তলস্তয়ের তীর্থযাত্রী অবশ্যই মৃত্যুর মুখোমুখি ঘনিষ্ঠ একটি মোকাবিলা প্রত্যক্ষ করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে যখন নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয়েছিল, তখন তিনি বিরক্ত হয়ে সম্মুখসারির যুদ্ধফ্রন্টে যাওয়ার জন্য নিজেই আবেদন করেন এবং ১৯১৬ সালের বসন্তে পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধফ্রন্টে একটি গোলন্দাজ দলে বিপজ্জনক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এমনকি নিজ দলের ব্যূহেরও একেবারে সামনে থেকে তিনি তাঁর এই প্রাণসংশয়ী দায়িত্বটি পালন করেন। তাঁর নিযুক্তির মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই রুশ সেনাবাহিনী সে সীমান্তস্থলে তাদের সবচেয়ে ভয়ানক আক্রমণটি শুরু করে দেয়। দীর্ঘসময় ধরে তিনি তাঁর পরিখায় বসে দিন ও রাত কাটিয়েছেন, গোলাবর্ষণে আহত হয়েছেন, প্রবল বোমাবর্ষণের সময় তাঁর মূল্যবান প্রতিবেদনের জন্য সাহসিকতার পদকও পেয়েছেন। রে মঙ্ক যেমনটা লক্ষ করেছেন – ভিটগেনস্টাইনের জীবন-দর্শন ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও এ-সময়টিতে বদলে গেছে। উদ্বেগ, ভয় ও পৌনঃপুনিক বেদনা একসময়ে অবশ্য প্রতিস্থাপিত হয়েছিল নিরাপত্তার একটি অনুভূতি দিয়ে – ‘আমি হচ্ছি চেতনা, তাই আমি মুক্ত।’ মৃত্যু, নীরবতা, ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য অন্যান্য অনুভূতি ইত্যাদি নিয়ে এই কঠিন নীতিপরায়ণ যুক্তিবাদী ব্যক্তিটি প্রতিটি মুহূর্তে ভাঙাগড়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ‘আমরা নৈতিক, নান্দনিক, এমনকি ধর্মীয় সত্যকেও দেখতে পাই, কিন্তু আমরা বলতে পারি না সেগুলি কী এবং সেগুলি সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে আমরা প্রায়শই বাজে বকি।’

রাশিয়ার আক্রমণ যতই চাপ সৃষ্টি করে অস্ট্রিয়ার দিকে এগোতে থাকল, ভিটগেনস্টাইন ততই অন্য একটি বিবশকারী আক্রমণের মোকাবিলা করতে থাকলেন, যা তাঁর নিজের শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে। রাতের পর রাত পরিখায় গোপন অবস্থান তাঁকে ক্লান্ত করে তোলে – একবার ক্লান্তিতে তাঁর ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ারও উপক্রম হয়েছিল। তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধা ও শত্রুসেনাদের মতো তিনিও নিজেকে উপলব্ধি করলেন পশুতুল্য একটি বর্বর (brute) সত্তা হিসেবে। যুদ্ধের সময়টিতে সৈনিকরূপে তিনি এমন একটি সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন, যুদ্ধ শেষে যা ভেঙে পড়ে। অবশ্য তিনি তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত সামরিক জ্যাকেটটি সাম্রাজ্য ভেঙে না পড়া পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।

উনিশশো ষোলো সালের শীতকালে স্থপতি-সৈনিক পল এঙ্গেলমানের সঙ্গে ভিটগেনস্টাইনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তখন ল্যুডভিগ উহল্যান্ডের কবিতা ÔCount Eberhard’s HawthornÕ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ভিটগেনস্টাইন অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন – ‘এটা ঠিক এ রকমই, যা অপ্রকাশযোগ্য তা যদি তুমি প্রকাশ করতে না চাও, তাহলেও কিছুই হারিয়ে যায় না। এই অপ্রকাশযোগ্যতা সবসময়ই যা অপ্রকাশযোগ্যভাবে প্রকাশ করা হয়, তার মধ্যে থেকে যায়।’ বাইরের যুদ্ধে ভিটগেনস্টাইন ইতালিয়ান ফ্রন্টে নিয়োজিত ছিলেন, এরপর এক বছর যুদ্ধবন্দি হিসেবে বন্দিশিবিরে কাটিয়েছেন। বিমান দুর্ঘটনায় বন্ধু পিনসেন্টের মৃত্যুর সংবাদে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, একবার তিনি আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তবে তাঁর নিজের ভেতরে চলা যুদ্ধটিও প্রায় সমাপ্তির দিকে চলে এসেছিল – তিনি এর মধ্যেই আবিষ্কার করেছেন, যা অর্থপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায়, তা কীভাবে বলা যায়।

ছয়

যুদ্ধ থেকে ফেরা সে-ব্যক্তিটি যুদ্ধফেরত অন্য সৈনিকদের মতোই তাঁর বয়সের চেয়ে বেশি বুড়ো দেখতে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর সন্দেহপরায়ণ ভাইবোনদের মাঝে তাঁর নিজের সম্পত্তির অংশ সবটুকুই বণ্টন করে দিলেন। তারপর প্রায় এক দশক ধরে দর্শন ছাড়া অন্য অনেক কিছু নিয়ে ভিটগেনস্টাইন ব্যস্ত রইলেন – অস্ট্রিয়ার কয়েকটি পার্বত্য গ্রামে প্রাথমিক স্কুলে একজন মেধাবী শিক্ষক হিসেবে সময় কাটাতে লাগলেন, কনস্টেনবুর্গের গির্জায় বাগান পরিচর্যাকারী হিসেবে কাজ করলেন, তাঁর বোন মার্গারেটের জন্য ভিয়েনা শহরে একটি কেতাদুরস্ত ঋজুরেখ বাড়ি তৈরি করলেন। যুদ্ধের মতো শান্তির সময়ও তিনি নিজেকে জাগতিক কাজকর্মে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে জীবনের সমস্যাগুলিকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন। যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে, নীরবতা মানেই কখনো সবকিছুর শেষ বোঝায় না, তখনই তিনি আবার দর্শনের জগতে ফিরে এলেন।

মহাযুদ্ধ যখন শেষ হওয়ার পথে, তখন তিনি সলজবুর্গে তাঁর ছুটির দিনগুলি কাটাচ্ছিলেন। এখানেই তিনি তাঁর বই ট্রাকটেটাস শেষ করেন, যাতে তিনি তাঁর বিখ্যাত পিকচার থিয়োরি অব মিনিং তুলে ধরেন। বইটি অবশ্য শেষ হয় নীতিবিদ্যা, নন্দনতত্ত্ব, জীবনের অর্থ ইত্যাদির ওপর কিছু মন্তব্য দিয়ে। বইটির শেষ বাক্যটি হচ্ছে – ‘ভাষা যখন প্রকাশ করতে পারে না, তখন চুপ করে থাকাই বাঞ্ছনীয়।’ এভাবেই তিনি চিন্তা করলেন যে, বর্তমান দর্শনের সব সমস্যাই তিনি সমাধান করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। এরপর খুশি মনে অস্ট্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র গ্রাম ট্রাটেনবাখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে গেলেন।

ট্রাকটেটাস নামে মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এ-বইটি অল্পসময়ের মধ্যেই দর্শনের জগতে আলোড়ন তোলে এবং এর লেখক ভিটগেনস্টাইনকে খ্যাতি এনে দেয়। এ-বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভাষার সীমাবদ্ধতার ধারণা। বিশ^চরাচরে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ এবং আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনার প্রতিনিধি শুধু আমাদের ভাষা হতে পারে না। এমন সব ভাব বা ঘটনা রয়েছে, যাদের সঠিক রূপ ব্যক্ত করা যায় না  – যেমন প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া সহজ-সরল ছোট ঘটনা, মনের বিক্ষিপ্ত ভাবনা, ইচ্ছা এবং কোনো চরম সত্যের অস্তিত্ব। এরকম বহু জিনিস আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাতেও আনতে পারি না। আর এটি হচ্ছে আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতা এবং চিন্তারও সীমাবদ্ধতা। যেহেতু এমন বহু জিনিস রয়েছে, যা আমরা ভাবতে পারি না কিংবা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না – তাই সেসব বিষয়ে আমাদের চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

ভাষার প্রকৃতি ছাড়াও ট্রাকটেটাসে রয়েছে ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক, দর্শন ও নীতিশাস্ত্র, কার্যকারণ সম্পর্ক, আরোহী ও অবরোহী যুক্তিপদ্ধতি, সত্তা এবং তার ইচ্ছা আকাক্সক্ষা, মৃত্যু ও তার রহস্যময়তা, শুভ-অশুভের ধারণা ইত্যাদি অনেক কিছু। তবে এর প্রধান প্রশ্নগুলো ছিল এরকম : কীভাবে ভাষা তৈরি হওয়া সম্ভব হয়? কী করে একজন মানুষ কয়েকটি মাত্র শব্দ ব্যবহার করে তা ভাষায় রূপান্তরিত করে? কী করে অন্য মানুষ তা বুঝতে পারে? ভিটগেনস্টাইনের মতামত অনুসারে, একজন  মানুষ যে-কথা আগে শোনেনি, এমন কথাও প্রথমবার শুনেই সে বুঝতে পারে। এর কারণ, বাক্য হলো এক একটি প্রতিজ্ঞা এবং বাস্তবতার ছবি। ভাষা এই ছবির বিশ^স্ত প্রতিনিধি এবং এর থেকে কাগজের কিছু অক্ষরের আঁকিবুঁকির সঙ্গে বাস্তবজগতের ঘটনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি ভাষায় প্রতিফলিত হয়।

ট্রাকটেটাস প্রকাশিত হওয়ার পর তা সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও তা অবশ্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক গ্রুপের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো – এর একটি হচ্ছে ক্যামব্রিজে, যাদের মধ্যে ছিলেন আর. বি. ব্রাইথ ওয়াইট, ফ্রাঙ্ক র‌্যামসে প্রমুখ। অন্য গ্রুপটি হচ্ছে ভিয়েনায়, যেখানে ছিলেন মরিস শ্লিক, ফ্রেডারিখ ওয়াইজম্যান এবং যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী (Logical positivist) নামে পরিচিত ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকেরা। এ দুটো দলই ট্রাকটেটাস পাঠ করে ভিটগেনস্টাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ফ্রাঙ্ক র‌্যামসে দুবার পুচবার্গে এসে স্কুলশিক্ষক ভিটগেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করলেন, শ্লিক তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন ভিয়েনা সার্কেলের নিয়মিত আলোচনা সভায় এসে যোগ দিতে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগে ভিটগেনস্টাইন আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন এবং তাঁর অসফল শিক্ষক-জীবন ত্যাগ করে দর্শনের জগতে আবার ফিরে আসতে উৎসাহী হয়ে উঠলেন।

সাত

ভিটগেনস্টাইন ১৯২৯ সালে আবার ট্রিনিটিতে ফিরে এলেন, প্রধানত র‌্যামসের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়। কিন্তু র‌্যামসে দুঃখজনকভাবে মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারাত্মক জন্ডিসে ভুগে অকালে মৃত্যুবরণ করলেন। ভিটগেনস্টাইন একজন প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে ক্যামব্রিজেই রয়ে গেলেন এবং একই সঙ্গে তাঁর ছুটির সময়টাতে ভিয়েনায় গিয়ে ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ বজায় রেখে চললেন। ভিটগেনস্টাইন মনে করতেন যে, দার্শনিকরা বিভ্রান্তিকর চিন্তার ফলে ভাবেন যে, তাঁদের বিষয়টি একটি বিজ্ঞান। আর এটাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁদের বিভ্রান্ত করে – যেমন শব্দার্থ, সত্যতা, মন, বিচার ইত্যাদির ব্যাখ্যা। দার্শনিক সমস্যাগুলি এভাবে বিচার করলেও চলবে না – সত্য কোনো মতাদর্শ নয়, বরং আমাদের প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ চিন্তা। এ নিয়ে বেশিরভাগ সমস্যাই দেখা দেয় ভাষা ও ভাষাগত অর্থ থেকে। দর্শন আমাদের নতুন কিছু শিক্ষা দিতে পারে না, যেমনটা পারে বিজ্ঞান। দর্শন থেকে আমরা যা পাই, তা অকিঞ্চিৎকর। তবে এই অকিঞ্চিৎকরতার যথাযথ সারাংশ করা খুবই কঠিন এবং প্রকৃত প্রস্তাবে দর্শন এই তুচ্ছতারই সারাংশ।

ট্রাকটেটাস বইটি লেখা শেষ হয়ে গেলে ভিটগেনস্টাইন মনে করতেন যে, দর্শনে ভাষা ও যুক্তির যে সমস্যাগুলি রয়েছে, সেগুলির সবই তিনি সমাধান করে ফেলেছেন। কিন্তু তাঁর এ-ধারণা একটি দশক পার না হতেই বদলাতে থাকে। আগে যে ধারণাগুলিতে তিনি আস্থা রাখতেন, সেগুলির অনেকটাতেই তিনি আস্থাহীন হয়ে পড়েন। যেমন ১. প্রতিটি প্রতিজ্ঞার কেবল একটি মাত্র বিশ্লেষণ থাকা সম্ভব, ২. প্রতিটি প্রতিজ্ঞার একটি নির্দিষ্ট অর্থবহতা আছে, ৩. বাস্তবতা ও ভাষা তৈরি হয় সহজ-সরল উপাদান দিয়ে, ৪. ভাষা, চিন্তা, প্রতিজ্ঞা – ইত্যাদির একটি করে সারাৎসার আছে, ৫. বিশ^জগতের মধ্যে অভিজ্ঞতাপূর্ব (a priori) কোনো ধারা আছে, ৬. প্রতিনিধিত্বকারী সব ঘটনার একটি সাধারণ যুক্তিগ্রাহ্য রূপ রয়েছে। এগুলি বাতিল করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ‘অন্তর্নিহিত বাণীর’ ধারণাটিও উবে যায়।

ট্রাকটেটাসে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, ভাষার বৈচিত্র্য ও সীমাহীন বিমূর্ত ধরন সত্ত্বেও এমন একটি সাধারণ মিলের জায়গা রয়েছে, যার সারাৎসার একজন দার্শনিকের উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু তিনি তাঁর পরবর্তী সময়ে সংকলিত বই Philosophical Investigation-এ এই ধারণা অনেকটাই পাল্টে ফেলেন। তিনি বলেন যে, আমাদের দেখা ভাষার বিভিন্ন রূপ হচ্ছে এক ধরনের বিভ্রম। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য আমরা যে-ভাষা ব্যবহার করি, তাকে উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করতে পারলেই ভাষার সারবস্তু ধরা পড়বে – এছাড়া ভাষার মধ্যে আলাদা কোনো সারবস্তু লুকিয়ে নেই। আর এজন্যই এটি নিয়ে দার্শনিক চিন্তা করাটা অর্থহীন। এটি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি বিভিন্ন ক্রীড়াকে উদাহরণ হিসেবে নিলেন এবং তাদের সাদৃশ্যের জায়গাকে সামনে এনে তা ভাষার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

ভিটগেনস্টাইনের এই পরিবর্তিত দার্শনিক অবস্থানের বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ কীভাবে তার ‘ধারণা’ গঠনকে প্রভাবিত করে, সে-সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। তিনি মনে করতেন যে, মানব সমাজের ইতিহাসে স্বাগতিকভাবে যা ঘটে চলেছে, তা বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের প্রধান কাজ। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর অন্তর্মুখী নির্জন জীবনের বাইরে এসে সূর্যালোকিত জীবনকে অনুভব করলেন এবং বাইরের জগৎ ‘মন’কে দিয়ে কী কথা বলাচ্ছে, তা-ই তাঁর বিচার্য বিষয় হয়ে উঠল। ট্রাকটেটাসের মতো এ-বইটিও একটি ধ্রুপদী দর্শনগ্রন্থ হিসেবে দার্শনিক মহলে প্রশংসিত।

ভিটগেনস্টাইনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বই Philosophical Investigation এমন একটি বই, যা নিয়ে তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিকের দুটো দশক ধরে ব্যস্ত ছিলেন। বহুবার তিনি চেষ্টা করেছেন এর একটি মনোমতো ভাষ্য প্রস্তুত করতে; কিন্তু এর কোনো ভাষ্যই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এজন্যে তিনি তাঁর জীবৎকালে এটি আর প্রকাশ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা যায় যে, তিনি ২০ হাজার পৃষ্ঠারও অধিক নোট রেখে গেছেন, যার মধ্যে রয়েছে পাণ্ডুলিপি, ডিকটেশন, টাইপস্ক্রিপ্ট ইত্যাদি। এগুলির মধ্য থেকে বেছে নিয়ে আরো কিছু গ্রন্থ তাঁর নামে প্রকাশ করা হয়েছে, যেগুলির মধ্যে রয়েছে  Philosophical Remarks (১৯৬৪), Philosophical Grammer (১৯৬৯), Remarks on the Foundations of Mathematics (১৯৫৬), On certainty (১৯৬৯) ইত্যাদি। এসব বইয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যে-প্রশ্নগুলি নিয়ে, সেগুলি হচ্ছে – গাণিতিক সত্য কী? সংখ্যা কী? চেতনা কী? আত্মা কী? ভিটগেনস্টাইন অবশ্য এগুলি নিয়ে দার্শনিকদের মতামতের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি, শুধু ভাষাতে তাদের যে বিভ্রান্তিগুলি দেখা যায়, সে-সংক্রান্ত আলোচনাই করেছেন। এর জন্য তিনি একটি পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন, যার নাম তিনি দিয়েছেন ভাষা-ক্রীড়া (Language Game)।

বিজ্ঞানের এই যুগে আমাদের আরো বেশি করে কবিতা, সংগীত, শিল্প ইত্যাদি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, যেগুলিকে এই বিজ্ঞানের যুগে খাটো করে দেখা হয় – এমনটাই ছিল তাঁর মত। সেইসঙ্গে দর্শনের পেশাদারিত্ব নিয়েও তাঁর ছিল প্রচণ্ড বিরাগ। কোনো সৎ দার্শনিকই দর্শনকে জীবিকা হিসেবে নিতে পারেন না বলেই তিনি ভাবতেন। এজন্যে তিনি তাঁর উজ্জ্বল ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক হতে নিষেধ করতেন। তাঁরা যেন চিকিৎসাবিদ্যা, বাগান পরিচর্যা অথবা দোকানদারি – এরকম একটা কিছুতে নিয়োজিত হয়, যাতে অ্যাকাডেমিক জীবন থেকে দূরে থাকতে পারে। তিনি নিজেও তাঁর পেশা ছেড়ে মনোচিকিৎসক হতে একাধিকবার চেষ্টা করেছেন।

কৃষি খামারে কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৩৫ সালে তিনি একবার সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত না করে তাঁকে দর্শনের অধ্যাপক হতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। এটি তাঁর মনঃপূত না হওয়ায় তিনি ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৩৯ সালে তাঁকে যখন ক্যামব্রিজে দর্শনের অধ্যাপক পদে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়, তখন অনেক দ্বিধা ও সন্দেহ নিয়ে তা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে তিনি লন্ডনের গাইস হাসপাতালে একজন আর্দালি হিসেবে কাজ করেছেন, পরে একটি রিসার্চ টিমে গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি তাঁর অধ্যাপক পদ থেকে ১৯৪৭ সালে পদত্যাগ করেন, যাতে তাঁর অপ্রকাশিত লেখাগুলিতে মনোনিবেশ করতে পারেন। এরপর তিনি আয়ারল্যান্ড গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে একটি নির্জন পরিবেশে কাজ করতে থাকেন, যেখানে গাঙচিলগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এ সময়ে তিনি তাঁর প্রাক্তন ছাত্র নর্মান ম্যালকমের আমন্ত্রণে নিউইয়র্কের ইথাকায় কিছুটা সময় অতিবাহিত করেন।

ডাবলিনে থাকার সময়ই একজন চিকিৎসক তাঁর মারাত্মক রক্তশূন্যতা আবিষ্কার করেন, যার জন্য তিনি তাঁকে আয়রন ও লিভার পিল প্রদান করেন। লন্ডনে ফিরে এসে আরো ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ধরা পড়ে যে, তিনি প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সারে ভুগছেন, যা এর মধ্যেই তাঁর অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ অসুস্থতা নিয়েই তিনি কিছুটা সময় ভিয়েনা ও নরওয়েতে কাটান এবং এরপর আবার ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন। উনিশশো পঞ্চাশ সালের নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর চিকিৎসক এডওয়ার্ড বিভানের বাসায় একটি ছোট রুমে উঠে আসেন – কারণ তিনি কোনো হাসপাতালে মরতে রাজি ছিলেন না। এতে বিভানের স্ত্রী জেন প্রথমে ভীত হলেও পরে অবশ্য তাঁরা ভালো বন্ধুতে পরিণত হন। জীবনের শেষ মুহূর্তগুলিতেও তিনি তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলি নিয়ে ব্যস্ত রইলেন। যখন তাঁর চিকিৎসক ভিটগেনস্টাইনকে জানালেন যে, তাঁর হাতে আর মাত্র কয়েকটি দিন অবশিষ্ট আছে, তখন চুপ করে তা শুনে তিনি শুধু বললেন – ‘আচ্ছা’। ১৯৫১ সালের ২৮শে এপ্রিল রাতে সংজ্ঞা হারানোর আগে তাঁর চিকিৎসক বিভানের স্ত্রী জেনকে বলা তাঁর শেষ বাক্যটি ছিল – ‘ওদেরকে বলো, আমি একটি চমৎকার জীবন কাটিয়ে গেছি।’

কোন ধর্মীয় রীতিতে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে, এটি নিয়ে তাঁর ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীরা একমত হতে পারছিলেন না। এ সময় ভিটগেনস্টাইনের একজন ছাত্র সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, একদিন তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ক্যাথলিক বন্ধুরা নিশ্চয়ই তাঁর জন্য প্রার্থনা করবে। তাই ক্যাথলিক ধর্মমতেই ক্যামব্রিজের আসেনশান প্যারিস ব্যুরিয়াল গ্রাউন্ডে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগে দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের অনুরোধ ছিল যে, তাঁর শেষকৃত্যের যাজকটি যেন কোনো দার্শনিক না হন। সেই অনুরোধ অবশ্যই রক্ষিত হয়েছিল।