শহীদুল জহিরের তিনটি গল্পে জাদুবাস্তবতার অন্বেষণ

তাশরিক-ই-হাবিব

শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাস পড়তে গেলে জাদুবাস্তবতার মুখোমুখি না হয়ে পাঠকের গত্যন্তর থাকে না। প্রথম গল্পগ্রন্থ পারাপার এবং চতুর্থ উপন্যাস আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু বাদে এ-অভিমত তাঁর বাকি বইগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমনটি নয় যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তাঁর পূর্বে বা সমকালে এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি বা অন্য কারো লেখায় এ-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। ষাটের দশকের কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সচেতনভাবেই গল্পে, উপন্যাসে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আবার জহিরের সহযাত্রী নাসরীন জাহানের একাধিক উপন্যাসেও এর  বিন্যাস ভাষ্যরূপ পেয়েছে। হাল আমলের অনেক  লেখকই একে নিজেদের লেখনীতে আত্তীকৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবু, এখন পর্যন্ত জহিরের লেখনীতে জাদুবাস্তবতা যে প্রাতিস্বিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে, এর নজির এদেশের অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। পাশ্চাত্য পরিম-লে জাদুবাস্তবতার কথা উঠলেই যেমন কলম্বিয়ান নোবেলবিজয়ী কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাম এবং তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড উলিস্ন­খিত হয়, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জহিরের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তদনুরূপ। জাদুবাস্তবতার ধারণা আয়ত্ত করা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কয়েকটি সাক্ষাৎকারে মার্কেজের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রাম, নগর, পাড়া-মহলস্না নির্বিশেষে তাঁর কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার যে-ভুবন গড়ে ওঠে, তা একান্তই এদেশীয় জনমানুষের প্রাত্যহিকতা ও শিকড়ঘেঁষা জীবনের স্বাদ, আবহ, গন্ধ ও সৌকর্যকে ধারণ করে বিচিত্র গল্পকথা, আখ্যান, গুজব ও কিংবদন্তিযোগে। উত্তরাধুনিক সাহিত্য-রচনার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জহির জাদুবাস্তবতাকে গল্প ও উপন্যাসের আধার ও আধেয় – উভয় দিকের উৎকর্ষ সাধনের হাতিয়ার করে তুলেছেন। আমরা এ-প্রবন্ধে জহিরের তিনটি গল্প নিবিড় পাঠের আলোকে তাঁর লেখনীতে বিদ্যমান জাদুবাস্তবতার স্বরূপ বুঝে উঠতে চাইব।

‘আমাদের বকুল’ গল্পে পরিবার ও সমাজে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যপ্রবণ মানসিকতার দাপটে নারীর অসিত্মত্বহীনতার বৃত্তান্ত রচনায় লেখক জাদুবাস্তবতাকে প্রয়োগ করেছেন। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের অনাবিল প্রশান্তি ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের যে-খ্যাতি বাঙালি সমাজে সুবিদিত, এরই বিপ্রতীপ চিত্রকে এ-গল্পে তিনি নির্মম বাস্তবতাযোগে নারীর সম্ভাবনাহীনতার রূপায়ণে গ্রন্থনায় অন্বিষ্ট। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিকে নারীর প্রতীকী আবহে উপস্থাপনের যৌক্তিকতা গল্পটিতে সঞ্চার করেছে পরিশ্রমী পাঠকের গভীর অভিনিবেশের দাবি। সুহাসিনী গ্রামের ভূমিহীন দিনমজুর আকালু শেখ ফাতেমাকে বিয়ের পর যৌতুক হিসেবে প্রাপ্য ধূসর রঙের একটি বাছুর নিয়ে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর গ্রামের কৃষক ও ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের মধ্যে ঈর্ষাবোধ প্রবল হয়ে ওঠে, যার মূলে রয়েছে তার নববিবাহিত স্ত্রী ফাতেমার অনিন্দ্য যৌবনদীপ্ত সৌন্দর্য। সংসারের সব কাজেই তার নিপুণতা সত্ত্বেও গ্রামবাসীর পরশ্রীকাতরতা ও স্বামীর নির্মম আচরণের পরিণতিতে অচিরেই তাদের দাম্পত্যজীবনে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রাপ্ত গাভিটি একবছর পরও গর্ভধারণ না করার পাশাপাশি আকালুও ইতোমধ্যে সন্তানের জনক না হওয়ায় গ্রামবাসী এ-নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য করে। তাদের প্ররোচনায় আকালু স্ত্রী ফাতেমাকে বন্ধ্যত্বের দায়ে অভিযুক্ত করেই ক্ষান্ত হয় না, সেইসঙ্গে সেই গাইটির সঙ্গে তার প্রতিতুলনা করে। ফাতেমা এ-অপমানের প্রতিবাদ জানানো অর্থহীন জেনে চুপ করে থাকে। কারণ যে-পুরুষ স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব পোষণে অসমর্থ, তাকে বোঝানোর সামর্থ্য ফাতেমার নেই। স্ত্রীর প্রতি অশস্নীল সম্বোধন, শ্বশুরের প্রতি অযৌক্তিক অভিযোগ উত্থাপন প্রভৃতি ঘটনায় বারবার প্রতিপন্ন হয় সংসারে ফাতেমার লাঞ্ছিত অবস্থার স্বরূপ। তবে এ-অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে আকস্মিকভাবেই কাজলা গাই ও ফাতেমার একই সময়ে গর্ভবতী হওয়ার ও নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে যমজ সন্তান প্রসবের ঘটনায়। এসব ঘটনায় লেখক সচেতনভাবেই জাদুবাস্তবতাকে প্রয়োগ করেন এ-উদ্দেশ্যে যে, যখন নারীর কাছে কোনো প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটে, তখন উন্মোচিত হয় তার প্রতি পরিবার ও সমাজের ছদ্মবেশী রূপ। একসময়ে যে-নারীর ও তার পালিত গাভির সন্তান ধারণে অসামর্থ্যের দোহাই দিয়ে আকালুর কাছে তার শ্বশুরের প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করেছিল গ্রামবাসী, এখন তাদের মুখেই ঠিক বিপরীত কথা শোনা যায়। স্মর্তব্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি তাদের চিন্তায়ও যথারীতি বিদ্যমান থাকে কদর্যতা ও কামনাসিক্ত নোংরামি। সে-কারণেই আকস্মিকভাবে একদিন সম্ভবত কারো চৌর্যবৃত্তির পরিণতিতেই যখন ফাতেমার কাজলা গাই ও দুটি বাছুর হারিয়ে যায়, এরপর একদিন সমাজ ও সংসারের প্রতি অভিমানবশত সন্তানের মায়া-মমতা ছেড়ে সেই নারী হয় নিরুদ্দিষ্ট। তিনদিন ধরে তাকে সর্বত্র খুঁজেও ব্যর্থ আকালুর প্রতি গ্রামবাসীর অবিরাম সংশয় ও
শ্লেষ-বিদ্রূপের খোঁচা অব্যাহত থাকে। ফাতেমাকে পাওয়ার সব প্রচেষ্টাই অসার প্রতিপন্ন হওয়ায় অবশেষে গ্রামবাসীর সন্দেহের তালিকায় যুক্ত হয় গ্রামের মসজিদের প্রাক্তন মুয়াজ্জিন ও দাখিল শ্রেণির ছাত্র রফিকুল ইসলামের নাম, যে ফাতেমার প্রতি বড় বোনের মতো শ্রদ্ধাশীল। দুই ছেলেমেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিত করতে ফাতেমা গোপনে তাকে দিয়ে ধান বিক্রি করিয়েছিল। আকালু এ-বৃত্তান্ত জেনে তাকে চরম অপমানজনক মন্তব্য করায় ক্রুদ্ধ ফাতেমা ক্ষিপ্ত হয়ে তার হাতে থাকা ভাতের হাঁড়ি স্বামীর দিকে ছুড়ে মারে। বর্ষাকালে বাড়ির ভিটায় জমে থাকা বন্যার জলে সেই সময়ে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত বড় একটি বোয়াল মাছের ওপর সেটি আছড়ে পড়লে সেটি ধরে বাজারে বিক্রির পর আকালু আধমণ চালসহ পিঠা তৈরির সরঞ্জাম কিনে বাড়ি আসে। এ-ঘটনায় স্পষ্টতই জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ লক্ষণীয়। লেখক দেখিয়েছেন, যে-ঘটনাকে কেন্দ্র করে আকালুর সঙ্গে ফাতেমার বিরোধের সূত্রপাত, সে-ঘটনার পরিণতিতে বিষয়টির মীমাংসাও ঘটে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি ঘটনাংশের সহায়তায়। পাঠক পুরো ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য ভাবলেও সমগ্র গল্প পাঠের অভিজ্ঞতায় তা মেনে নিতে বাধ্য হয় এর যৌক্তিকতা বিচারের মানদ–। বাস্তবের সঙ্গে অতিবাস্তবের সংযোগে এভাবেই সমগ্র আখ্যানে সংযোজন ঘটে নতুন মাত্রার। একটি বিষয় লক্ষণীয়, কাজলা গাই ও তার দুই বাছুর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পেছনে গ্রামবাসীর ভূমিকা পরোক্ষ। সেই তুলনায় ফাতেমার অন্তর্ধান মূলত সমাজ-সংসার-পরিবারের প্রতি তার চরম বিতৃষ্ণ মনোভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ, এবং এ-সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হয়েছে। কেননা স্ত্রী হিসেবে সে স্বামীর কাছে প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা পায়নি। এমনকি একজন নারীর জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রসঙ্গ অর্থাৎ মাতৃত্বের অক্ষমতা নিয়েও তাকে পরিবার ও সমাজে চরমভাবে অপমানিত হতে হয়। উপরন্তু ফাতেমা এ-সমাজ পরিত্যাগ করেও রেহাই পায় না। কারণ, গ্রামবাসীর ধারণা হলো, হয়তো অর্থের প্রলোভনে আকালু তাকে সিরাজগঞ্জের পতিতাপলিস্নতে বিক্রি করেছে। অর্থাৎ অন্তিম বিবেচনায় নারীর মূল্য পুরুষতন্ত্রের কাছে মানুষ হিসেবে নয়, বরং ভোগের প্রয়োজন মেটাতেই সীমাবদ্ধ। ফাতেমার দুই অবুঝ সন্তানকে সান্তবনা জ্ঞাপনে গ্রামের বৃদ্ধ ইমাম মোহসিন আলির রোপিত বিচিকলার চারাটি যখন বর্ষায় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তখন গাছের সুগোল ও স্ফীত গুঁড়ি, সুগঠিত ও সতেজ পত্রপলস্নবের বিসত্মারের দৃশ্য তাদের অবচেতনলোকে বারবার পুনরুদ্রেক ঘটায় ফাতেমার যৌবনদীপ্ত দেহবলস্নরীর অনিন্দ্য স্মৃতি। নারী ও প্রকৃতির অভিন্নতা রূপায়ণে লেখক গ্রামবাসীর সমষ্টিচেতনায় পুঞ্জীভূত স্মৃতিচারণার মাধ্যমে জাদুবাস্তবতাকে ভাষ্যরূপ দিয়েছেন। এর ক্রমবিসত্মার ঘটেছে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে ফাতেমার উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী কন্যা বকুলের নারীত্বের প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার সমান্তরালে তার সঙ্গে সেই গাছটির দেহসুষমাগত সাদৃশ্য আবিষ্কারের ঘটনায়। এভাবেই ফাতেমা, তার মেয়ে বকুল ও তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে রোপিত কলাগাছের আপাত যোগসাযুজ্যে গ্রামবাসীর চেতনায় নারীর স্বতন্ত্র অসিত্মত্ব স্বীকৃত হলেও তা যে নিতান্তই আপেক্ষিক, বিষয়টিকে লেখক নির্দেশ করেছেন লাল পিঁপড়ার ঝাঁকের আক্রমণে বকুলের মৃত্যুর ঘটনায়। হয়তো এ-ঘটনা গল্পের সচেতন পাঠকের কাছে যতটা বিস্ময়কর, ততটা যুক্তিনিষ্ঠ বিবেচিত হয় না। তবু বকুলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাহীনতাকে উপস্থাপনের অভিপ্রায়েই লেখক তাঁর বীভৎস মৃত্যুকে রূপায়িত করেন। কারণ বাংলাদেশের গ্রামীণ আবহে প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ফাতেমার চেয়ে বকুলের ভবিষ্যৎ পরিণতি অভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা এ-গল্পে অনুপস্থিত। এভাবেই সমগ্র গল্পে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জাদুবাস্তবতার বৈচিত্রম–ত প্রয়োগের সামর্থ্যগুণে পাঠকের মন্থর-গতানুগতিক চিন্তাস্রোতে লেখক নতুন অভিঘাত সঞ্চারে অনুধ্যানী।

‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ গল্পে রূপকথার আবহে সমাজের প্রান্তবাসী এক দম্পতির সঙ্গে কাকের বিচিত্র সম্পৃক্ততার ভাষ্য নির্মাণে লেখকের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে জাদুবাস্তবতাধর্মী আখ্যান ও ঘটনাংশ, অবিশ্বাস্য লোককথা ও গুজব, সর্বোপরি গল্পের ব্যাখ্যাতীত পরিসমাপ্তি। বহুদিন আগে ঢাকা শহর কাকশূন্য হওয়ার বৃত্তান্তকে ঘিরে এ-গল্পের ঘটনাবিন্যাসের সূত্রপাত। সেই ইতিবৃত্ত নির্মাণে বাস্তবতা ও রূপকথার অলৌকিক-অতিলৌকিক সমাবেশের মাধ্যমে পাঠককেও এক পরাবাস্তব জগতে লেখকের আহবান গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। ঢাকার অদূরবর্তী সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র কাঠুরে আকালু ও তার স্ত্রী টেপি গ্রামের মিয়াদের পরিত্যক্ত ভিটায় ঝুপড়ি বেঁধে বাস করে। সন্তানের প্রতি টেপির অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত না হলেও অবচেতনে এর রূপায়ণ ঘটে নিজের খেয়ালে কখনো নিজের সঙ্গে, কখনো গাছ, পাখি ও বাতাসের সঙ্গে কথা বলার অসচেতন প্রবণতায়। এক সকালে এ-ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলাকালে তাদের ভিটাসংলগ্ন আমগাছে একজোড়া দাঁড়কাক এসে বসলে পুনরায় তাদের সঙ্গে শুরু হয় টেপির বাক্যালাপ। সেই সময়ে জববার আলির প্রদত্ত কাঠ কাটার প্রসত্মাব আকালু প্রত্যাখ্যান করলেও শেষ পর্যন্ত টেপির জেদের কারণে তাকে এতে সম্মতি দিতে হয়। এক্ষেত্রে কাকের ডাক শুনে
টেপির মনে হয়েছিল, আকালু এ-কাজ করুক। আকালু বটগাছের গুঁড়ি কাটার কাজ শেষে আকস্মিকভাবে এর কোটরে টাকা পাওয়ার পর টেপির প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতীয়মান হয় – নিজেদের ভালো-মন্দের সঙ্গে তারা কাককেও সমসূত্রে সম্পৃক্ত করতে সচেষ্ট। অথচ বাস্তবতা হলো, সেই সকালে বাড়িসংলগ্ন আমগাছের ডালে কাক না থাকলেও একই ঘটনা ঘটতে পারত। আকালুর অতিমাত্রিক সরলতা ও মূর্খামির জন্যই শেষ পর্যন্ত সেই অর্থ ভোগ তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে এবং তা অন্যের করায়ত্ত হয়। আকস্মিকভাবে আকালুর ঝুপড়িতে গভীর রাতে ডাকাতের আক্রমণও সম্ভবত জনৈক উকিল বা পান-সিগারেট বিক্রেতার পরিচিত ব্যক্তিদের পরিকল্পিত অপপ্রয়াস। পরদিন সকালে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় ওই দম্পতির অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ, এ-সংবাদ সম্পর্কে পুলিশের অবহিতির পরিণতিতে কারাগারে বন্দি হওয়ার শঙ্কায় রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে তাদের ঢাকায় আগমন প্রভৃতি ঘটনায় প্রমাণিত, ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য ও কা-জ্ঞান আকালুর নেই। তাই সে বারবার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত হয়। ঢাকায় নাটকীয়ভাবেই রিকশাচালক চান্দুর সঙ্গে এ-দম্পতির পরিচয় ঘটে। এর সুবাদে একই বসিত্মতে আশ্রয় নিয়ে আকালুর জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হয়ে ওঠে রিকশা চালনা।  পুনরায় একদিন স্ত্রীকে কাকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে আকালু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ নিজেদের বিবিধ দুর্ভোগের জন্য সে কাককেই দায়ী করে। প্রকৃতপক্ষে আকালুর বিড়ম্বনার জন্য দায়ী তার অতিসরল মনোভঙ্গি, যা বুঝে অন্যরা তাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। এর আরেকটি দৃষ্টান্ত গল্পে উলিস্নখিত। একদিন জনৈক আরোহী প্রাপ্য ভাড়া না মিটিয়েই তার রিকশা থেকে লাফিয়ে ওঠে চলন্ত বাসে। তার মানিব্যাগ পড়ে গেলে আকালু প্রাপ্য ভাড়া রেখে সেটি থানায় জমা দেয়। তার সততা ও সারল্যের সুযোগ গ্রহণে তৎপর হতে দেখা যায় থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে। দুই কনস্টেবলকে নিয়ে সে আকালুকে মারপিট করে মানিব্যাগ চুরির অভিযোগে এবং হুমকি দেয় আরো টাকা উপার্জন করে এনে থানায় জমা দিতে। এ-হুমকিতে ভীতসন্ত্রস্ত আকালু চান্দুর কাছে কাকের কারণে দুর্ভোগের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে। কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায়, কাক নয়, বরং তার দুর্ভোগের জন্য দায়ী অবক্ষয়িত এ-সমাজ; যেখানে গরিব মানুষ ক্রমশ সমাজের প্রান্তবাসীতে অবনমিত হয়, আর কর্তৃত্বশালীরা দুর্নীতির আশ্রয়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তোলে। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আকালু চান্দুর সহায়তায় ভাস্কর জ্যোতিষীর পরামর্শে চড়ামূল্যে কিংবদন্তির সোলেমান বাদশার দেশের নীলা কিনে পরিধান করে। এর দুদিন পর নাজিরাবাজারের জ্যোতিষী ভাস্করের ভা-ার থেকে রত্নচুরির অভিযোগে স্ত্রীসহ আকালুকে চোদ্দ মাস কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। সেখানে একদিন তার কক্ষের আলো-বাতাস নির্গমনকারী প্রকোষ্ঠে খড়কুটোয় সজ্জিত বাসায় কাকের উপস্থিতিতে সন্ত্রস্ত আকালু মরিয়া হয়ে কারারক্ষককে তার কক্ষ পরিবর্তনের মিনতি জানালেও এতে কোনো ফল হয়নি। কিছুদিন পর জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন আকালু বিছানায় স্বর্ণের একটি আংটি পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে। কারণ তার শঙ্কা ছিল, এ-ঘটনার জন্য তাকে আবার কোনো সমস্যায় পড়তে হবে।  সে-কারণেই সে অবলীলায় প্রাপ্ত আংটির বৃত্তান্ত গোপন করার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় তার কক্ষসঙ্গীকে জানায়। অবশেষে কারাভোগের পালা শেষ হলে মগবাজারের নয়াটোলায় কারারক্ষকের পরিত্যক্ত ভিটায় ঝুপড়ি বানিয়ে আকালু ও টেপি শুরু করে নতুন জীবন। তার কামলা খাটার পাশাপাশি টেপির ঝি-গিরির অর্থে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর তারা এই সিদ্ধামেত্ম উপনীত হয়, পুনরায় তাদের জীবনে আবির্ভাব ঘটেছে কাকের। কারণ সেখানকার তালগাছে অজস্র কাক বাসা বানিয়ে বাস করত। ক্রমশই তাদের কুঁড়েঘরের ছাদেও তারা নীড় গড়ে তোলে। এ পর্যায়ে আকালু নিজের অর্থে বাঁশ কিনে কাকের জন্য গড়ে তোলে স্থায়ী আবাস। নয়াটোলার মহলস্নাবাসী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, যখন আকালু কয়েক মাস পর কাকের বাসা ভেঙে সাড়ে আঠারো মণ সাইকেলের স্পোক, লোহার তার, ইস্পাতখ- বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামায়। এ-পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রবল ঈর্ষাকাতরতা ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইতোমধ্যে  নিমফল দাসীকে টেপির কাকের বাসা থেকে আহৃত স্বর্ণের দুল উপহার প্রদানে যেন আগুনে ঘি পড়ে। পাশাপাশি মহলস্নাবাসী কবুতরের বাসাকে কাকের বাসায় রূপান্তরের ছয় মাসেও সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আকালু ও টেপির ওপর রীতিমতো মারমুখী আচরণ করে। বর্জ্য নিক্ষেপ, পথে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া প্রভৃতি ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে মহলস্নাবাসী আকালু ও টেপিকে ঝুপড়িতে অবরুদ্ধ করে। এমতাবস্থায় তাদের প্রাণধারণের মাধ্যম হয়ে ওঠে কাকের ডিম আর চাপকলের পানি। তাদের অন্তরীণ অবস্থার ত্রিশতম রাতে মহলস্নাবাসী ঝুপড়িটি আগুনে পুড়িয়েও এর ভেতর কোনো মৃতদেহ পায়নি। ফলে অচিরেই আকালু-টেপির অন্তর্ধানের রহস্য উদ্ধারে অসমর্থ মহল­vবাসীর মধ্যে এ-প্রসঙ্গে মতভেদ দেখা দেয়। এভাবেই জন্ম হয় কাকের ঠোঁটে ভর করে তাদের উড়ে যাওয়া সংক্রান্ত কিংবদন্তির। এ-ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রামপুরা ঝিলে নৌকায় রাত্রিযাপনকারী মাঝিদের কথনকে প্রামাণ্য বিবেচনা করা হয়, যাদের বর্ণনায় রয়েছে অসম্ভব ঘটনারাজির প্রাধান্য। স্বাভাবিকভাবেই এ-বৃত্তান্ত গল্পপাঠকের ভাবনায় যথেষ্টই অবিশ্বাস্য বিবেচিত,
যুক্তি-বুদ্ধি ও কার্যকারণের শৃঙ্খলে উন্নীত না হওয়ায়। গল্পে বিবৃত ঘটনারাজি থেকে স্পষ্টতই পরিস্ফুট হয়, নয়াটোলার মহলস্নাবাসীর সঙ্গে আকালু-টেপি দম্পতির সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে কাককুল। মূলত গল্পের এ-অংশে লেখক বিভিন্ন জাদুবাস্তব ঘটনা, কৌশল ও প্রকরণকে সন্নিবিষ্ট করে সমগ্র গল্পকে ভিন্ন মাত্রায় উত্তরণে আগ্রহী। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় কাকের প্রতি আকালুর পরিবর্তিত মনোভঙ্গির স্বরূপ। যখন সে নিজ উদ্যোগে কাকের স্থান সংকুলানের জন্য কষ্টার্জিত অর্থে বাঁশের কাঠামো বেঁধে দেয়, তারপর থেকেই আকালু কাকের দ্বারা বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। পাখিজগতে কাক অবাঞ্ছিত হলেও ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে শিল্পে, সাহিত্যে কাক সর্বদাই অশুভ, অমঙ্গল ও অকল্যাণের প্রতীক হলেও এ-গল্পে কাকের ভূমিকা যেন সুস্পষ্টভাবেই বিপন্ন মানুষকে সহায়তা ও লোভী-স্বার্থপরের প্রতি বিরূপতায় উত্তীর্ণ। মানবসমাজের তলদেশে অবস্থানরত প্রান্তবাসী আকালু-টেপির মতোই পাখিজগতে ব্রাত্য কাকের অবস্থান একাত্মতাসূচক হওয়ার কারণেই সম্ভবত রূপকথার পাত্রপাত্রীদের অনুসরণে কাকের ঠোঁটে ভর করে সভ্যজগৎ থেকে তাদের প্রস্থান ঘটাতে হয়। ঢাকাবাসীর প্রতি অভিমানবশত এ-শহর দীর্ঘদিন কাকশূন্য হয়ে পড়লে তাদের পরিবর্তে আবির্ভাব ঘটে মফস্বলের সমগোত্রীয়দের। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে শূন্যস্থান এভাবেই পূর্ণ হয়। কিন্তু চিরাচরিতের ব্যতিক্রমও যে জনসমাজে বিশিষ্ট মাত্রায় উত্তীর্ণ হতে পারে, দাঁড়কাকগোষ্ঠী ও কাঠুরে দম্পতির সমবেত নিরুদ্দেশ যাত্রা সে-ভাবনাকেই আভাসিত করে।

‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্পে লেখক এক নকশালপন্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শের সমান্তরালে তার ব্যক্তিচিত্তের প্রেম, স্বপ্ন, রোমান্টিকতাজাত বিচিত্র উপলব্ধির বৃত্তান্ত বয়ানে অভিনিবিষ্ট। উনিশ বছর বয়সে আবদুল করিম মিয়ার সবচেয়ে মেধাবী সন্তান ও মেজ ছেলে ওয়াহিদ সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে বি.এ পাশের পর মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছর ঢাকায় এম.এ পড়তে যায়। তারুণ্যের রঙিন স্বপ্ন ও ভেদাভেদহীন সমতাপূর্ণ সমাজভাবনা বাস্তবায়নে একক প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতাগত উপলব্ধি তাকে উদ্বুদ্ধ করে সংঘবদ্ধভাবে রাজনৈতিক আদর্শের বাস্তবায়নে। তাই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত গোপন পার্টিতে যোগদানের পরিণতিতে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার পরও যখন গ্রামে তার প্রত্যাবর্তন ঘটে না এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল হোসেনের কাছ থেকে এ-ব্যাপারে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না, তখন ওয়াহিদের নকশালপন্থী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা সম্পর্কে গ্রামবাসীর সংশয় সত্য প্রতিপন্ন হয়। দরিদ্র কৃষক ও ভাগচাষিদের শোষণ, নিপীড়নকারী অর্থ-বিত্তের অধিকারী ধনী কৃষকদের অপহরণ ও নিধনের ঘটনা সুহাসিনীর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছিল। ব্যাঙনাই গ্রামে ইয়াসিন বিশ্বাসের বাড়িতে ডাকাতির মাধ্যমে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের পর তাকে ও তার বড় ছেলেকে আততায়ীরা হত্যার পাশাপাশি হুলিয়া প্রদান করে। ইয়াসিন বিশ্বাসের স্ত্রী ও ছোট ছেলে এ-ঘটনায় সম্পৃক্ত ওয়াহিদকে চিনে ফেললে তার নকশালপন্থী কর্মকা- সম্পর্কে গ্রামবাসী অবহিত হয়। অবস্থাপন্ন কৃষক আবদুর রশিদ প্রামাণিকের নাটকীয়ভাবে অপ্রকৃতিস্থ হওয়ার পাশাপাশি তার বাঁধা কামলা আকালুর আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রতীয়মান হয় গ্রামবাসীর ওপর নকশালপন্থীদের প্রভাব ও সমীহ অর্জনের বিষয়টি। এ-ঘটনার রূপায়ণে লেখক জাদুবাস্তব কৌশল প্রয়োগে আগ্রহী। সুহাসিনী গ্রামের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোয় নকশালদের দৌরাত্ম্যে কামলা আকালুর প্রতি সম্পন্ন কৃষক রশিদ প্রামাণিকের শোষকসুলভ ব্যবহার নাটকীয়ভাবেই কোমল হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রামাণিকের এ-আচরণ আকালুর কাছে অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর বিবেচিত হওয়ায় সে একপর্যায়ে প্রবল ভীত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জ্বরের ঘোরে প্রামাণিকের ডান হাত উত্থিত করে কাতরকণ্ঠে বিলাপ থেকে আভাসিত হয় তার মনোবৈকল্যের স্বরূপ, যা আরো বিসত্মৃত হয় জ্বরের প্রকোপে আকালুর মৃত্যুর ঘটনায়। প্রবল উত্তেজনা ও আতঙ্কে বিছানা ছেড়ে শুধু গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় মাচার বাঁশের খুঁটি জড়িয়ে বসে থাকা, উন্মাদ অবস্থার চরম পর্যায়ে মাচার তল থেকে বেরিয়ে নগ্ন হয়ে ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়া প্রভৃতি ঘটনার পরিণতিতে আকালুর মৃত্যু ও প্রামাণিকের মনোজাগতিক বৈকল্য বাস্তবতার গ–কে অতিক্রম করে গ্রামবাসীর কাছে রীতিমতো চমক ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হয়। এসব ঘটনায় প্রচ্ছন্ন রয়েছে নকশালপন্থী আন্দোলনের প্রতি লেখকের প্রচ্ছন্ন সমর্থন, যা জাদুবাস্তবতার স্পর্শে গল্পে রাজনৈতিক বক্তব্যের ঊর্ধ্বে স্বতন্ত্র আবেদন সঞ্চারের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত। ওয়াহিদের প্রেমাখ্যানও এ-গল্পের তাৎপর্যপূর্ণ প্রসঙ্গ, যার বয়ানে জাদুবাস্তবতার সন্নিবেশ লক্ষণীয়। দশ-এগারো বছরের বালিকা ও সম্পর্কে চাচাতো বোন নূরজাহানকে উনিশ বছরের স্বপ্নালু তরুণ ওয়াহিদ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যাওয়ার সময় একটি শালিকের ছানাকে ময়নার বাচ্চা বলে উপহার দিয়েছিল। এটি ছিল নূরজাহানের প্রতি তার অপ্রকাশিত ভালোবাসার প্রতীক। বালিকা নূরজাহান সেই প্রেমের গূঢ়ার্থ অনুধাবনে তখন সমর্থ না হলেও শালিকছানার প্রতি তার পরিচর্যায় ঘাটতি ছিল না। সময়ের ব্যবধানে যখন সে অবহিত হয় যে, এটি ময়না নয়, বরং শালিক এবং তার শেখানো বুলি আয়ত্ত করতে সেটি অসমর্থ, তখনো এর প্রতি তার যত্নে অনীহা পরিলক্ষিত হয়নি। ওয়াহিদেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল হোসেনের সঙ্গে চতুর্দশী নূরজাহানের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হওয়ার পর শালিকের কথা তার আকস্মিকভাবে ভুলে যাওয়া বিস্ময়কর। পাশাপাশি বিয়ের পরদিন খাঁচায় বন্দি শালিকের অনাহারে মৃত্যুর পর সেটিকে বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ে তার নিক্ষেপের ঘটনাও প্রতীকী, যাতে ওয়াহিদের প্রতি কিশোরী নূরজাহানের ভালোলাগার প্রচ্ছন্ন অনুভবের আপাত অর্থহীনতা প্রতীয়মান। অবশেষে সুদীর্ঘ একুশ বছর পর গ্রামবাসীর চেতনালোকে অসিত্মত্বহীন ওয়াহিদের সুহাসিনীতে প্রত্যাবর্তন যথেষ্ট নাটকীয় হলেও তা নূরজাহানের পরিণত চিত্তে বালিকা বয়সের অব্যক্ত প্রেমানুভূতিকে এতদিন পর পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই নূরজাহানের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতেই বালিকা বয়সে ওয়াহিদের প্রদত্ত শালিক-শাবকের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার সরল আক্ষেপ প্রতিধ্বনিত হয় তার সংলাপে। তখন ওয়াহিদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে নূরজাহানের নারীসুলভ পূর্ণবিকশিত রূপ ও যৌবনস্নাত সৌন্দর্য, যার প্রতিক্রিয়ায় তার অবচেতনেও সংগুপ্ত ভালোবাসা এতদিন পর জেগে ওঠে। নূরজাহান এখন ওয়াহিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল হোসেনের স্ত্রী, অথচ তার প্রথম যৌবনের প্রেমিকা; এই রূঢ় সত্যের তীব্রতায় সেই নারীর প্রতি দৃষ্টিপাতে তার মনোজগতে সঞ্চারিত হয় দ্বিধা ও অস্বসিত্ম। অথচ প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে তাকে বিস্মৃত হওয়া ওয়াহিদের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ফলে যৌবনের দুর্বার উন্মাদনায় নূরজাহানকে রেখে রাজনৈতিক আদর্শের মায়ামোহে জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ সময়ের বিনষ্টিগত আক্ষেপ এতদিন পর তার চেতনালোকে প্রবল হয়ে ওঠে। বালিকা কীভাবে একুশ বছর পর শ্যামল ও সুশ্রী ভরা নদীর মতো নারী হয়ে ওঠে, সেই রহস্য উদ্ঘাটনের আকাঙ্ক্ষায় পুনরায় তার মনোজগতে জাগ্রত হয় নূরজাহানের প্রতি প্রেম, যদিও এক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সে সচেতন। অন্যদিকে আবুল হোসেনের স্ত্রী হিসেবে এতদিন নূরজাহান তার প্রেমিকা সত্তা সম্পর্কে বিস্মৃত হলেও ওয়াহিদের গ্রামে প্রত্যাবর্তনের ঘটনায় তার অবচেতনে সুপ্ত হৃদয়েও জাগ্রত হয় বেদনার প্রগাঢ়তা। স্বামী হিসেবে আবুল হোসেন সাংসারিক হলেও পাখি এবং নারীর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয় তার কাছে দুর্বোধ্যই থেকে যায়। একদিন আকস্মিকভাবে কুয়োতলায় পানি তোলার কাজে ব্যস্ত নূরজাহানের নীরব অশ্রম্নপাতের ঘটনা দেখে ওয়াহিদ বিষণ্ণতায় ভোগে। নূরজাহান এ নিয়ে মৃদু ভৎর্সনা করায় তার বিভ্রান্তি আরো বেড়ে যায়। তাই ওয়াহিদ তার বন্ধুর বাড়ি যেতে অনাগ্রহী হলেও সে স্পষ্টতই উপলব্ধি করে, তার প্রতি নূরজাহানের ভালোবাসা ক্রমশই গভীরতর হচ্ছে; যার পরিণতি ভয়ানক। এই উদ্বেগ তাকে ক্রমশ বিপর্যস্ত করে তোলে। এর পাশাপাশি প্রতিপক্ষের আক্রমণে মৃত্যুর শঙ্কা ভুলতে সে মনোযোগী হয় পাখি ও ফুলের প্রতি, যা মূলত নূরজাহানের প্রতি তার অনুচ্চারিত অথচ সুতীব্র ও গভীর ভালোবাসার প্রতীক। বগুড়া থেকে সে একজোড়া ময়নাপাখি কিনে আনে এবং দুটি পৃথক খাঁচায় কালো কাপড়ে আবৃত পাখিদের পরিচর্যার পাশাপাশি কথা শেখাতে উদ্যোগী হয়। এক্ষেত্রে সে পাখিদুটিকে ভিন্ন বুলি শেখায়। কিন্তু ওয়াহিদের এ-প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হয় তার মৃত্যুর পর নূরজাহানের আন্তরিক প্রচেষ্টায়। নিজের বাড়িতে পাখিদুটিকে এনে সে পরম মমতায় সুদীর্ঘ এক মাসের অধিক সময় কথা শেখাতে সচেষ্ট হলেও সে বিস্ময়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় একদিন আকস্মিকভাবে পুরুষ পাখিটির বুলি শুনে (‘কান্দেন ক্যা?’)। এর জবাবে নিজের অজামেত্মই সে জানায় ‘কান্দি না তো’। নূরজাহান অচিরেই নিজের ভুল বুঝে উঠলে স্ত্রী পাখিটির ‘সুখ নাই জীবনে’ বাক্য উচ্চারণের ঘটনায় সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আবদুল ওয়াহিদ ও নূরজাহানের পারস্পরিক প্রেমের অনুভব কোনো সফল পরিণতিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে ব্যর্থতার নীরব হাহাকার ও অপূর্ণতার অনিকেত উপলব্ধিকেই প্রকটিত করে। মৃত্যুর ক্লান্তিকর ও প্রলম্বিত প্রতীক্ষার অবসানকল্পে ওয়াহিদ ময়নাপাখিদের কথা শেখাতে আগ্রহী হলেও দুই নর-নারীর অন্তর্যন্ত্রণার স্বরূপকে উপলব্ধির ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই পাখির নেই। তবু তাদের মুখে উচ্চারিত বুলি যে বিভ্রম নয়, তার প্রমাণ নূরজাহানের বেদনার্ত প্রতিক্রিয়া। এ-গল্পে জাদুবাস্তবতার আরো বৈচিত্রময় প্রয়োগ ঘটেছে গোলাপ ফুলের প্রতীকে নূরজাহানের প্রতি ওয়াহিদের অব্যক্ত প্রেমের নীরব উচ্চারণে। সিরাজগঞ্জের আজিমুদ্দিনের বাড়ির টকটকে লাল গোলাপ সম্পর্কে সে একপর্যায়ে অবহিত হয়। সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর সে জানতে পারে, বর্তমানে জীবিত এ-পরিবারের কেউ কখনো গাছটির ফুল দেখেনি। পরিত্যক্ত ধ্বংসসত্মূপে পরিণত সেই ভিটায় বসবাসরত একমাত্র বৃদ্ধ প্রহরী দানেশ আলির কাছে সে শোনে সেই রহস্যময় গোলাপ গাছের কিংবদন্তি। আজিমুদ্দিনের ভাই আমিনুদ্দিন ছিল আসামের চা বাগানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের পৈতৃক দালানের ভেতরের বাড়িতে পূর্বমুখী সিঁড়ির পাশে একটি গোলাপ চারা লাগানো হলেও এতে বিগত সত্তর-আশি বছরে কোনো ফুল ফোটেনি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমিনুদ্দিন পোষা বিড়ালকে নিয়ে আসাম থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানোর পর সে বিড়ালটির সঙ্গে কথা বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এক নির্জন রাতে গোলাপঝাড়ের কাছে ইজিচেয়ারে অর্ধশোয়া অবস্থায় প্রবল দমকা হাওয়ার তোড়ে গোলাপের একটি ডাল তার মুখে আঘাত করে কাঁটার আঁচড়ে লম্বা করে চিরে দেয়। এ-ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গোলাপ গাছের কাছে অভিযোগের পাশাপাশি এর সঙ্গে কথা বলার অদ্ভুত প্রবণতা তার মধ্যে সৃষ্টি হয়। পরদিন সকালে দেখা যায়, ঘুমন্ত আমিনুদ্দিনের মুখের কাছে ঝুঁকে আসা গাছটি টকটকে লাল গোলাপে আবৃত। তবে তিন মাস পর সে কর্মস্থলে ফিরে গেলে গাছটি পুনরায় ফুলশূন্য হয়ে পড়ে। সে-গাছের একটি ডাল নিয়ে যখন ওয়াহিদ বাড়িতে আসে এবং কিছুদিন পরিচর্যা করে, তখনো সেই ডালে কোনো নতুন পাতা অঙ্কুরিত হয় না। আমিনুদ্দিনের কিংবদন্তি শোনার পর তার এ ধারণা হয়, গাছটি ঘুমিয়ে আছে এবং সেটির সঙ্গে সে কথা বললে তবেই গাছটি ফুলে বিকশিত হবে। তাই সে বিড়বিড় করে নিজের অজামেত্মই গাছের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। এর পরদিন সকালে গাছটিতে পানি দিতে গিয়ে সে লক্ষ করে, ডালটির কাটা অংশ থেকে নতুন অঙ্কুরের উদয় হয়েছে এবং হালকা বাদামি রঙের তিনটি কচিপাতা ভোরের বাতাসে দুলছে। তবে গাছটিতে গোলাপ ফোটার আগেই প্রতিপক্ষের আক্রমণে ঘটে তার নৃশংস মৃত্যু, যার জন্য গ্রামে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই সে ছিল প্রতীক্ষারত। তা প্রলম্বিত হওয়ায় নূরজাহানের প্রতি হৃদয়ে নবজাগ্রত প্রেমানুভবের পরিচর্যার বিকল্পে সে নতুন স্বপ্নের ভুবন গড়ে তুলতে গিয়ে বিস্মৃত হতে চেয়েছিল সেই রূঢ় বাস্তবকে। উপর্যুক্ত ঘটনাগুলোয় জাদুবাস্তবতার প্রভাবকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আমিনুদ্দিনের বাড়িতে পরিচর্যিত গোলাপ গাছটি নিঃসন্দেহে তার মৃত স্ত্রীর প্রতীকে আভাসিত, কারণ প্রেমিক স্বামীর চেতনালোকে সে তখনও জীবিত। প্রবল দমকা বাতাসে গাছটির একটি ডালের আঘাতে আমিনুদ্দিনের মুখম-ল রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে তার শোণিতার্দ্র হৃদয়ের প্রতীক। গোলাপ গাছের কাছে ফুলের জন্য তার অনুনয়ে প্রতীয়মান হয় সন্তানলাভের অব্যক্ত আকুতি; কারণ সে ছিল নিঃসন্তান, নিঃসঙ্গ। এ-কারণেই পোষা বিড়াল হয়ে উঠেছিল তার কথা বলার সঙ্গী। সর্বোপরি, এ-ঘটনার পরদিন সকালে তার মুখের কাছে ঝুঁকে আসা গোলাপ গাছের এক রাতের মধ্যেই রক্তাভ ফুলে আবৃত হওয়ার ঘটনা মূলত আমিনুদ্দিনের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন, যা ব্যাখ্যাতীত অথচ বাস্তব। কেননা শুধু সে নয়, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যও এ-ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ইতোপূর্বে তারা কখনো এমন টকটকে লাল রঙের গোলাপ দেখেনি। আমিনুদ্দিনের উপস্থিতিতে গাছটির এক রাতের পরিসরে ফুল ফোটানোর ঘটনায় ধারণা করা যায়, বাস্তবতার শর্তকে অস্বীকারপূর্বক পাঠকের কল্পনাকে বহুদূর প্রসারিত করতেই লেখক এরূপ ভাবনায় আগ্রহী। এছাড়া সঙ্গীর আন্তরিকতা ও তার সঙ্গে কথা বলার পরিণতিতেই গোলাপ গাছটির ফুলে বিকশিত হওয়া ও নতুন পত্রপলস্নব বিসত্মারের ঘটনা আমিনুদ্দিন এবং ওয়াহিদের কাছে চরম সত্য বিবেচিত হলেও স্মর্তব্য যে, ওই ব্যক্তিদ্বয়ের গোলাপ গাছ সম্পর্কিত উভয়ের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে তাদের অন্তর্গত প্রবল শূন্যতাবোধ। সম্ভবত সে-কারণেই ওয়াহিদ গড়ে তোলে এমন একটি পরাবাস্তব ভাবপরিম-ল। উপর্যুক্ত ঘটনাগুলোর সঙ্গে জাদুবাস্তবতার প্রাসঙ্গিক সমাহার ঘটিয়ে লেখক নকশালপন্থী আদর্শে আস্থাশীল ওয়াহিদের অন্তরলৌকিক স্বরূপকে এভাবে উন্মোচিত করেছেন।

পাঠককে বাস্তব, অতিবাস্তব ও অবাস্তবের দোলাচলে মোহাবিষ্ট করতে গল্পের আখ্যানভাগে ভিন্নতা আরোপের পাশাপাশি  কিংবদন্তি, অতিনাটকীয় ঘটনা, গুজব ও লোককাহিনিকে পরাবাস্তবতা, কল্পনা ও কুহেলিকার পরতে-পরতে সংযুক্তির সমান্তরালে  সময়ের উলস্নম্ফনধর্মী নিখুঁত বয়ান ও বুননে শহীদুল জহির জাদুবাস্তবতার অনন্য কারিগর। তাঁর রচিত এসব গল্পে বিবৃত ঘটনারাজি ও চরিত্রগুলোর মনসত্মাত্ত্বিক জটিলতাও বাঙ্ময় রূপ পেয়েছে এ-রীতির সংহত প্রয়োগে। তবে কখনো-কখনো অসচেতন ও পরিকল্পনাহীন ভাবনার অনুপ্রবেশ ক্ষুণ্ণ করে তাঁর কোনো-কোনো গল্পে প্রবহমান রসস্রোত ও কাহিনির তাৎপর্য। ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ গল্পের পরিণতি অংশে কাককুলের সঙ্গী হিসেবে তাদেরই নেতৃত্বে মানবসমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে কাঠুরে দম্পতির অন্তর্ধান স্মরণ করায় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির প্রসঙ্গ। কিন্তু সমগ্র গল্পের পরিসমাপ্তি নির্দেশে তাদের এ-ধরনের অযৌক্তিক পরিণতি বিকল্পহীন ছিল না। শহীদুল জহির এ-ঘটনার রূপায়ণে কল্পনাকে বাস্তবের আধারে উন্নীত করতে পারেননি। তবু, তাঁর গল্পগুলো বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারায় ওই সাহিত্যভাবনার সপ্রতিভ শিল্পসাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবেই মূল্যায়িত হবে, একথা অনস্বীকার্য। r