শিকড়ে ফেরার নিবিড় তাগিদ

অনুশ্রী সাহা

‘দেশ’ শব্দটি আপাতভাবে বেশ ভারি একটি শব্দ। শহুরে বুদ্ধিজীবী মহলে এই ‘দেশ’ শব্দের এক বৃহৎ অভিঘাত রয়েছে। কিন্তু আপামর জনসাধারণের মনে দেশ শব্দের বিসত্মৃতি ঠিক কতটা! অনেক ক্ষেত্রেই জনগণ এই ‘দেশ’ শব্দটিকে একটি আইডিয়ার মধ্য দিয়ে জেনে এসেছে। দেশ বলতে তারা যা অনুভব করে, পুঁথিবদ্ধ দেশের আইডিয়া তার সঙ্গে মেলে না। কজন ভারতবাসীই-বা দেশ বলতে সমগ্র ভারতবর্ষকে বোঝে! আসলে আমাদের প্রত্যেকের মনেই দেশ সম্পর্কে খুব
সরল-অনাড়ম্বর একটি ধারণা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যে-ধারণার একেবারে গভীরে সম্পৃক্ত হয়ে আছে হয়তো কিছু চেনামুখ, বেশকিছু চেনা গাছগাছালি, দু-এক টুকরো কমলালেবু রোদ্দুর, কয়েকটা চেনাপথ আর কিছু হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা। দেশ নামক মহৎ এক ধারণার বাইরেও এসব টুকরো দেশের স্মৃতি আমাদের মনের মণিকোঠায় সযত্নে তোলা থাকে। তাই যত দূরেই যাই, স্মৃতির ডানায় ভর করে আমরা ঠিক ফিরে আসতে চাই দেশের কাছাকাছি। শহুরে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা শিউলিগাছটাকে দেখে তাই আচমকা চোখের সামনে ভেসে ওঠে দূরদেশের কোনো এক শিউলিগাছের ছবি। চোখ বন্ধ করলেই সেই গাছ থেকে ঝরে পড়তে থাকে গুচ্ছ গুচ্ছ শিউলিফুল। তাদের কোমল স্পর্শ দেহে-মনে এক স্বপ্নময় আদর ঢেলে দেয়।

লেখিকা শামত্মা সেন তার পিতামহী উপন্যাসে নিজের দেশের এমনি এক মর্মস্পর্শী চিত্র উপহার দিয়েছেন পাঠককে। ১৯৩৬ সালে, বরিশালের জয়শিরকাঠি (জসুরকাঠি) নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর জন্ম। শৈশবেই পিতার কর্মসূত্রে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। পিতামহীর পরবর্তী খ- জন্মের মাটি উপন্যাসে রয়েছে এই গ্রামে ফিরে আসার এক বেদনাবিদ্ধ আকুতি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই উপন্যাসদুটি একত্রে গ্রন্থাকারে ‘গাঙচিল’ থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির নামকরণ করা হয় জন্ম ও জন্মান্ত

বইটি আগাগোড়া এক মাধুর্যপূর্ণ নস্টালজিয়ায় মোড়া। বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি দুর্গাপুজোয় যে গ্রাম ছিল টুলটুলির একমাত্র ঠিকানা, দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গায় আচমকা যেন দূরে সরে গিয়েছিল সেই গ্রাম। ‘দেশভাগ’ শব্দের অর্থ উপলব্ধি করার আগেই এক সরলা বালিকার জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল একটা চেনাপথ। পাড়াগাঁয়ে কাটানো শৈশবের সারল্যের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে পিতামহী উপন্যাসে। পুজোর কটা দিন নিয়ম করে ফুল তুলে আনা কিংবা নবমীর সকালে মেজদার সঙ্গে ‘শু– শাপলা’ তুলতে যাওয়া, এসব যেন টুলটুলির মেয়েবেলাকে বিভোর করে রেখেছিল। আর তাঁর সমগ্র শৈশব জুড়ে পরম স্নেহে মমতায় তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এক নারী, ‘মাগো’ (বরিশালের কোনো অঞ্চলে ঠাকুমাকে মাগো বলে ডাকার প্রচলন রয়েছে), আজীবন যিনি ভিটে আঁকড়ে থেকে গিয়েছিলেন বরিশালের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে।
আটচল্লিশ-পরবর্তী দাঙ্গার কারণে তাঁকেও চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায় তাঁর ছেলের কাছে। শুধু ধর্মীয় অনিরাপত্তা ভিটেছাড়া করেছিল এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে। ভাঙাচোরা শরীর আর মন নিয়ে তাঁকে আপন করে নিতে হয়েছিল ‘ছিন্নমূল’ তকমা। মাগোর বরিশাল থেকে কলকাতা আসার এই যাত্রাপথ মোটেও সুখকর ছিল না। পথে তাঁকে সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয় খোয়াতে হয়। মাগো যখন টুলটুলির কাছে এসে পৌঁছেন, তখন তাঁর হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ থাকে শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে যাওয়া কয়েকটি লিচু। চরম খেদে তিনি বলে ওঠেন ‘এই দুইডা গাছের লিচু। আনছি, তোমাগো হাতে নিয়া কি দিমু… এই দুইডা লিচু খালি আনছি।… আর ব্যাবাক জিনিসপত্তর… পথে তো খোয়া গ্যাছে।… আর যা আনছিলাম, কিচ্ছু তো নাই।’ পিতামহীর দেওয়া সেই জরাজীর্ণ লিচু যেন সমকালীন এবং তৎপরবর্তী ভাঙাচোরা বাংলারই প্রতিরূপ।

খুব সচেতনভাবে না হলেও পিতামহী উপন্যাসে সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ এসেছে। শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে ‘সৈজা-র বউয়ের’ ছোঁয়া বাঁচিয়ে ডোয়া লেপা কিংবা হিন্দুবাড়ির দুধের পাত্রে অনেকটা ওপর থেকে গোয়ালার দুধ ঢেলে দেওয়া, এসব প্রসঙ্গ তৎকালীন সমাজে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবস্থান সূচিত করে। এক প্রবল আশ্বিনের ঝড়ের দুপুরে প্রতিবেশী এক কিশোর ললিত টুলটুলিদের বাড়ির অন্দরে আশ্রয় নিতে পারে না। জাতপাতের নিষ্ঠুর থাবা যে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দুদেরও রেয়াত করেনি, তা আমরা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করতে পারি। লেখিকা শামত্মা সেনের ভাষায় – ‘সেদিন ঠান্ডায় বেঁকে যাওয়া ললিতের শরীরটা আজও আমাকে একইভাবে পীড়া দেয়।’

টুলটুলিদের অখ্যাত গ্রামের দুর্গাপুজোয় হয়তো আড়ম্বর ছিল না, কিন্তু যা ছিল তা অযথা আড়ম্বরের চেয়ে অনেক বেশি। সেদিনের পুজোয় এক পবিত্র বিশ্বাস ছিল। লেখিকার ভাষায়, ‘দশমীর দিন সত্যিই আমরা কাঁদতাম, ভাবতাম মা দুর্গা বুঝি সত্যি সত্যি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবেন।’ এরপরেই শুরু হয়ে যেত বাড়ি বাড়ি বিজয়ার প্রণাম করতে যাওয়ার ধুম। এসব নিপাট সারল্যের মধ্য দিয়ে কেটে যেত টুলটুলির এক-একটা দুর্গাপুজো। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাগোর মন্ত্রপড়া, চিনেজোঁকের ভয়, গাছের মগডালে বসে বাজকুড়ালের কান্না কিংবা ঠোক্কর (তক্ষক) তীক্ষন গলার কর্কশ স্বর –  এসবই টুলটুলির শৈশবে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল।

সম্পূর্ণ অন্যরকম এক আবেদন নিয়ে উপন্যাসে এসেছেন ‘সীতানাথদা’ চরিত্রটি। শামত্মা সেনের মতে, ‘সীতানাথদা আমার সবচেয়ে ছোটবেলার স্মৃতি, তখন আমার বয়স তিন কি চার, সীতানাথদা আমাকে হাত ধরে উঠোন পার করে দিতেন।’ আর টুলটুলি সীতানাথদাকে একের পর এক প্রশ্ন করে তার সমস্ত কৌতূহল মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেত। তার প্রশ্নের বাণে এক-একদিন ধৈর্য হারিয়ে সীতানাথদা বলে উঠতেন – ‘বউদি, টুলুরে আপনে ডাকেন দেহি! টুলু মোর মুহে ফ্যাৎরা উডায়ে দিলে… মোর কানের পোক খওয়াইয়া দিলে!… ধরেন দেহি আপনে এটটু অরে!’

পিতামহী রচনার প্রায় ছ-বছর পরে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ তথা নিজের গ্রামের ভিটে দেখতে যান লেখিকা ওরফে গায়ত্রী। শৈশবে হারিয়ে ফেলা সমস্ত চিহ্ন এক এক করে খুঁজে পেতে চান তিনি। কিন্তু যে-দেশ একবার হারিয়ে যায়, তাকে কি তেমন করে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব! তিনি উপলব্ধি করেন, পিতামহীর মৃত্যুতেই চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেছে এদেশের পথ। আর সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি রচনা করেন জন্মের মাটি উপন্যাসটি। স্বদেশের মাটিতে ফিরে যাওয়ার এক বেদনাবিধুর আকুতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে সমগ্র উপন্যাসটিকে। সবকিছুই আছে, অথচ কিছুই যে আর আগের মতো নেই, এই বোধ উপন্যাসটির পাতায় পাতায় সম্পৃক্ত। একসময় হয়তো এই ঘটনাই স্থান পায় ইতিহাসের পাতায় কিংবা হয়ে ওঠে গবেষকদের বহু মূল্যবান গবেষণার বিষয়। কিন্তু এ-ঘটনার গহিনে যে-যন্ত্রণা নিহিত, তার কথা চাপা পড়েই থাকে।

গ্রামের সকলেই গায়ত্রীদের সাদর সম্ভাষণ জানায়। গ্রামেরই এক গৃহবধূ কনক তাদের ভাত রেঁধে খাওয়ায়। সর্বোপরি গায়ত্রী ওই গ্রামে এক বিশিষ্ট শহুরে অতিথি হিসেবে পরিচিতি পায়। নিজের গ্রামে অতিথি হয়ে ওঠার মর্মবেদনা তাকে পদে পদে পীড়িত করে। তার বাল্যবন্ধু, খেলার সাথি ‘সুজনে’র কথা সে বারবার জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর পায় না। পরিশেষে জানা যায়, সুজন নাকি রাজাকারদের দলে নাম লিখিয়েছিল! তাই মুজিববাহিনীর ছেলেরা তাকে হত্যা করেছে। আসলে উপন্যাসে সুজন একটি টাইপ ক্যারেক্টার হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন অনেক যুবকই রাজাকার হয়ে গিয়েছিল, কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো-বা পরিস্থিতির চাপে। আসলে আমরা সকলেই তো কমবেশি সময়ের শিকার।

গ্রন্থের সূচনায় এই লেখার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখিকা শামত্মা সেন লিখছেন – ‘একদিন ইচ্ছে হয়েছিল হারানো দেশের কিছু ছবি কিছু কথাকে বাঁচিয়ে রাখতে। বাল্যজীবনের সেই যে জগৎ ছিল ইন্দ্রিয়বোধের আনন্দে মধুর, পিতামহীর আকুল স্নেহে সিক্ত – বারে বারে তার দিকে ফিরে তাকানো তো আজীবন। বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল শব্দবন্ধে তার চেহারা। কিছু সাক্ষ্য থাকুক এই জীবনের, এই সময়ের – সেই ইচ্ছাতে অনভ্যস্ত কলমে একদিন শাদা কাগজের বুকে কিছু কালির আঁচড় কাটা – মনের মধ্যে জমে থাকা হাওয়াকে মুক্তি দিতে।’ যে-মাটির সঙ্গে নাড়ির যোগ, শুধু এক হটকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি পারে সেই নিবিড় যোগ ছিন্ন করতে! সেই চিরন্তন দেশমাতৃকার অশ্রম্নসিক্ত মুখ আমাদের ভেতর অবান্তর স্মৃতি হয়েও বেঁচে থাকে আমরণ। কিছু কিছু স্মৃতি এক-একটা গোটা জীবনের মতো। যে-দেশ হারিয়ে গেছে চিরতরে, যাকে আর কখনো ছোঁয়া যাবে না, যে-দেশের পথ ধরে আর হাঁটা হবে না কোনোদিন, সেই দেশের স্মৃতি তো আরো অকপট হয়ে মথিত থাকে আমাদের স্মৃতিপটে। সেই স্মৃতিকেই আখরবদ্ধ করতে জন্ম হয় আলোচ্য দুটি উপন্যাসের।

এমন দুটি উপন্যাসকে একটি গ্রন্থমধ্যে মুদ্রিত করে একত্রে প্রকাশ, এই কাজ সত্যিই প্রশংসাসূচক। পৃষ্ঠার মান, মুদ্রণের পদ্ধতি, প্রচ্ছদসহ সমগ্র গ্রন্থের উপস্থাপনের মধ্যেই যত্নের ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে বইটিতে উপন্যাসদুটি মুদ্রণের ক্ষেত্রে প্রকাশকালের ক্রম অনুসরণ করা হয়নি। অর্থাৎ গ্রন্থে প্রথমে জন্মের মাটি এবং তারপর পিতামহী মুদ্রিত হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে আমার মনে বেশ একটা কৌতূহল জন্মায়। তবে লেখিকা শামত্মা সেনকে প্রশ্ন করে আমার কৌতূহলের নিরসন ঘটে। তিনি আমাদের জানান, ‘এটা আসলে আমার এক বন্ধুর suggestion। যে বাস্তবে আমরা বাস করছি, তাকে ফেলে আমরা অতীতে চলে যেতে চাইছি। আর সেই ফেলে আসা অতীতটাই আমার কাছে প্রধান। সেই ফেলে আসা দেশ, দেশভাগের যে-যন্ত্রণা, তা তো ‘পিতামহী’তেই বেশি করে ছড়িয়ে আছে। যে-দেশ হারিয়ে গেছে, সেই দেশ যে কী ছিল, তা কিন্তু ‘পিতামহী’ পড়লেই আমরা বেশি করে উপলব্ধি করি। মনের মধ্যে সেই ফেলে আসা দেশের স্মৃতিকে স্থায়ী করাই আমার উদ্দেশ্য। তাই এই পরিবর্তন।’ কী সরল অথচ স্পষ্ট ব্যাখ্যা! আসলে যে-দেশ আমার নিজের, সেই দেশের মাটিতে পা রাখতে গেলে আজ পাসপোর্ট বা ভিসার মতো নিষ্ঠুর কিছু নিয়মকে অতিক্রম করতে হয়। এই যন্ত্রণা থেকেই হয়তো জন্ম নেয় এ-উপলব্ধি। বাস্তবে যাকে নিজের করে পাওয়া যায় না, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তাকে আরো নিবিড় করে পাওয়ার, এ এক অভিনব প্রয়াস।

জন্মান্তর থেকে জন্মে ফেরারে এই দুর্বার টান সমগ্র গ্রন্থটিকে এক অপরিসীম গভীরতা দিয়েছে। আসলে দেশভাগের অভিঘাত তো এক-একজনের কাছে এক-একরকম। কেউ কেউ হয়তো দাদু-ঠাকুমার কাছে দেশভাগের গল্প শুনেছেন, আবার কোনো ব্যক্তি শুধু বইতেই পড়েছেন দেশভাগের ইতিহাস, আর কিছু মানুষ সত্যিই চোখের সামনে দু-টুকরো হয়ে যেতে দেখেছেন একটি স্বপ্নের দেশকে। এই তিন শ্রেণির পাঠকের কাছেই জন্ম ও জন্মান্তর গ্রন্থটি বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করবে। সভাকক্ষের আলোচনাচক্রের গাম্ভীর্য বা গবেষকের গবেষণাপত্রের বিসত্মৃতিকে অতিক্রম করে, এই গ্রন্থটি আপন সারল্যেই পাঠকহৃদয় জয় করে নেবে।