শিল্পের মহোৎসব

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

বিশ্বশিল্পকলার সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পকলার যোগসূত্র স্থাপনের ইতিহাস রচিত হয় বেশ আগেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাতে আবহমান বাংলার শিল্পকলার প্রাচুর্যপূর্ণ ভাণ্ডার বিশ্বশিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। কারণ শিল্পাচার্য মনে করতেন, একটি মানবগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহ, আশা-আকাঙক্ষা, সভ্যতার ধারা ওই দেশের শিল্পকলার স্বকীয়তার মাঝে প্রতিফলিত হয়, পৃথিবীর তাবৎ শিল্পকর্মে এভাবেই নানান জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহ, আশা-আকাঙক্ষা, সমাজ, পরিবেশ, প্রতিবেশ প্রকাশ পায়।

১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশে আয়োজিত হয়ে আসছে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী। এশীয় অঞ্চলে এ-আয়োজনটি সবচেয়ে পুরনো। ৫৪টি দেশের অংশগ্রহণে এবারের আয়োজনে আমরা খুঁজে পাই সেসব দেশের অতিসাম্প্রতিককালের ভাবনা, শিল্প-নির্মাণের মাধ্যমগত উদ্ভাবন, চিন্তা ও সৃষ্টির আধুনিকায়ন। বিশ্বশিল্পকলার নানামাত্রিক ভাবনার উত্থান ও নির্মাণকে আমরা কখনো শিল্পের স্থায়ী রূপ পেতে দেখি, আবার কখনো উদ্ভাবিত নতুন মাধ্যম ও বিষয় হারিয়ে যেতে দেখি। এ-উৎসবে বাংলাদেশের শিল্পীদের নতুন-নতুন ভাবনা ও মাধ্যমের সঙ্গে বিশ্বশিল্পকলার যোগসূত্র স্থাপিত হয় প্রদর্শনীর মাধ্যমে।

এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি। বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের ইতিহাসে কাইয়ুম চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। আধুনিক শিল্প-নির্মাণে আবহমান বাংলার রূপ, রংকে যুক্ত করে নিয়েছেন তিনি। ১৭তম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধার্ঘ্য এশীয় শিল্পকলার উৎসবকে গৌরবদীপ্ত করে তুলেছে।

উৎসবের ৫৪টি দেশের মধ্যে প্রথমেই বলা যায় পুরস্কারপ্রাপ্ত কাজগুলোর কথা। তিনটি গ্র্যান্ড প্রাইজের মধ্যে দুটি পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের দুজন শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন ও মো. হারুন-অর-রশীদ। অন্য গ্র্যান্ড প্রাইজটি পেয়েছেন চিলির দাগমারা আন্না উইসকেল।

কামরুজ্জামান স্বাধীনের কাজে আবহমান বাংলার লোকায়ত বিষয়কে দেখা যায়। কামরুজ্জামান এ-শিল্পকর্মে দেখিয়েছেন নিজ মৃত্তিকায় কীভাবে মানুষ ও প্রাণিকুলের বিচিত্র সম্পর্কের বসবাস। তাঁর প্রদর্শিত শিল্পকর্মের সৃষ্টিলগ্নে তিনি নিবিড়ভাবে একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাতে তিনি দেখতে পান মানুষ ও প্রাণিকুলের সহাবস্থান। তারা প্রকৃতিকে কখনো ধ্বংস করে না, ব্যাহত করে না প্রকৃতির স্বাধীন গতিপ্রকৃতিকে। মৃত্তিকালগ্ন জীবনযাপনকে কামরুজ্জামান শিল্পের বিষয় করে নিয়েছেন। বিশ্বশিল্পকলার সঙ্গে বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের একটি জনগোষ্ঠীর প্রাণী ও মানুষের এ-সম্পর্কের মুহূর্তকে তিনি শিল্পকর্মে মূর্ত করেছেন। মাটির দেয়ালের মাঝে বসবাসরত ইঁদুরের যাওয়া-আসা, দলবেঁধে খুঁটে খাওয়া ফসলি ধানের সত্মূপে ব্যস্ত থাকা ইঁদুরের দলকে ত্রিমাত্রিক নির্মাণশৈলীতে দর্শকদের আনন্দ দেয়। কামরুজ্জামানের শিল্পকর্মে মাটি আর প্রকৃতিলগ্ন সুর বেজে উঠেছে। দর্শক খুঁজে পান তাঁর প্রিয় বাংলাদেশকে।

গ্র্যান্ড প্রাইজ পাওয়া অন্য বাংলাদেশি শিল্পী মো. হারুন-অর-রশীদ তাঁর ‘দ্য রেস্টলেস ওয়েভ অব টাইম’ বা ‘অস্থির সময়ের স্রোত’ শিল্পকর্মে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ ও অসভ্যতার হিংস্রতায় মানুষের প্রতি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ বোঝা যায়। তাঁর শিল্পকর্মে দেখা যায় নানা মানুষের আবক্ষ মূর্তি একটি অন্ধকার ঘরে নানান শব্দ আর আলোর মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। অস্থিরতার মাঝে মানুষের মুখগুলো আলোর প্রত্যাশায় আছে। হারুন-অর-রশীদের স্থাপনাশিল্পের মানবিক চেতনার আকাঙক্ষা দর্শকদের প্রাণিত করে। গ্র্যান্ড প্রাইজ পাওয়া চিলির দাগমারা আন্না উইসকেল ভিডিওচিত্রে দেখিয়েছেন শব্দ ও ছবিতে পৃথিবীর চলমান ঘূর্ণায়মান অবস্থা। বিস্তর মরুভূমিতে বড় আকৃতির বৃত্ত। তার মাঝে অসংখ্য ছোট বৃত্তের সমাহার। দাগমারার শিল্পকর্মের শিরোনাম ‘জয়েন্ট গেইম’। মানুষ ও প্রকৃতির এ-খেলায় শিল্পী প্রতীকী পৃথিবীকে হাজির করেন। সঙ্গে জুড়ে দেন শব্দ ও আলো-আঁধারী।

১৭তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সম্মান পুরস্কারপ্রাপ্ত ছয়জন শিল্পীর সবাই বাংলাদেশের। যথাক্রমে কুন্তল বাড়ৈ, বিপাশা হায়াত, রাজীব কুমার রায়, জিহান করিম, শ্যামল চন্দ্র সরকার ও দিলীপ কুমার কর্মকার। কুন্তল বাড়ৈ ঢাকার রাস্তা নিয়ে নির্মাণ করেছেন স্থাপনাশিল্প। আলো, শব্দ ও ক্যানভাসের আবহ দিয়ে কুন্তল কাজ সাজিয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় অগণিত মোটরগাড়ির সঙ্গে জমতে থাকা শব্দের উৎসবকে উপস্থাপন করেছেন কুন্তল।

বিপাশা হায়াত অভিনব নির্মাণ-কৌশলে দেখিয়েছেন তাঁর স্মৃতিসত্তা। বিপাশার কাজের শিরোনাম ‘মেমোর ২০১৬-২’ কার্ডবোর্ডের ওপর অ্যাক্রেলিক ও পস্নাস্টিক রঙে তিনি কালো রংকে প্রধান করে নিয়েছেন।

রাজীব কুমার রায় স্থাপনাশিল্পের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন চিত্রকর্ম। শিরোনাম ‘গেস্নাবালাইজেশন অব পলিটিক্স – পলিটিক্স অব গেস্নাবালাইজেশন’। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান অবস্থাকে তিনি বোঝাতে গিয়ে হাজির করেছেন কালো অ্যাক্রেলিক শিট, বায়োস্কোপের বাক্স ও ক্যানভাসের চিত্রকর্ম।

জিহান করিমের ভিডিও স্থাপনাশিল্পে বৃত্তের ভেতরে ঘূর্ণায়মান ছবি দৃষ্টিকে বিস্মিত করে। জিহানের শিল্পকর্মের শিরোনাম ‘সেভেন সেন্সেস’।

শ্যামল চন্দ্র সরকার ত্রিমাত্রিক ঢঙে গড়েছেন চারটি প্রাণীর চাররকম ভঙ্গি। শ্যামলের ভাস্কর্যে বাস্তবধর্মী প্রাণীর ভঙ্গি দেখা গেলেও তাতে বিশেষ ধরনের ভঙ্গি উপস্থাপনের চেষ্টা দেখা যায়। দিলীপ কুমার কর্মকারের ক্যানভাসে দেখা যায় কালো আর ধূসর রঙের উপস্থিতি। মানুষগুলো বিশেষ করে তোলার জন্য সোনালি রঙের বুনটে মানুষের মুখ গড়ে তুলেছেন। দিলীপের শিল্পকর্মের শিরোনাম ‘প্রকৃতি’। প্রদর্শনীর ভিডিও আর্ট, স্থাপনাশিল্প, ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম সব মিলিয়ে এবারে দেশভিত্তিক আলাদা গ্যালারি বা প্রদর্শনকক্ষ রাখা হয়নি। এতে দর্শক বিভিন্ন অঞ্চলের কথা মনে রেখে শিল্পকর্ম দেখার অভ্যাস থেকে সরে এসেছেন। এদিকে সুবিধা বা অসুবিধা কোনো কিছুই বলা যায় না। এ-মাত্রা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী দেখার ক্ষেত্রে বিভ্রম তৈরি করে।

সমকালীন বিশ্বশিল্পকলার পরিক্রমায় বাংলাদেশে আসা উল্লেখযোগ্য দেশ ও তার শিল্পকর্মগুলোকে আলোচনায় আনা যায় বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে।  এক দেখাতে প্রদর্শনীর কাজগুলো দেখতে গেলে বেশি চোখে পড়বে চিত্রকর্ম। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার এডওয়ার্ড গ্রাহাম বোথার ‘গ্রম্নপিজম’ ও ‘ফুল সার্কেল’ শিল্পকর্ম। ছবিতে অসংখ্য মানুষের সারি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মানুষের বিচিত্র জনগোষ্ঠী, বিচিত্র জীবন-বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা তাদের শিল্পকর্মে উঠে এসেছে। অস্ট্রিয়ার শিল্পী ইবা চৌং ফাক্স ক্যানভাসে তেলরঙে কালো রঙের রেখায় ‘ইকুয়েশন’ শিরোনামের কাজ করেছেন। রেখাগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত।

ভুটানি শিল্পকলার ধ্যানী আধ্যাত্মিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য জিমপু ওয়াংচুকের ‘চার বন্ধু’ বা ‘ফোর ফ্রেন্ডস’ শিরোনামের কাজে হাতি, বানর, খরগোশ, বাঘের সঙ্গে সবার ওপরে বৌদ্ধমূর্তি স্থাপন নির্দেশ করে শান্তির বার্তা। শান্তি, সৌহার্দ্যকে উপলক্ষ করেই ভুটানের শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়। এ-প্রদর্শনীতে ভুটানের দুজন শিল্পীর তিনটি শিল্পকর্ম দেখা যায়।

ব্রম্ননাই দারুসসালামের শিল্পকর্মে সরল অলংকরণধর্মী মেজাজ পাওয়া যায়। হাজি মাহাদি বিন হাজি মাত জাইনের শিল্পকর্মে দেখা যায় কিশোরীর দোলনায় দোল খাওয়া ব্রম্ননাইয়ের শিল্পীরা সরল ব্রম্ননাইবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে শিল্পকর্মের বিষয় করে নেন। বুলগেরিয়ার শিল্পকর্মে সুনির্দিষ্ট কোনো শিল্প-নির্মাণরীতি অনুসরণের ঝোঁক দেখা যায় না। তাঁরা শিল্পকর্মে মৃৎশিল্পের বিচিত্র অনুষঙ্গ, মিহি কাচ ও কাচের উপকরণ, আগুন, আলো, তেল, তেলরং এভাবে বিচিত্র মাধ্যমের সাহায্যে কাজ করেন। আবার দেখা যায় একেবারে সরল অংকনরীতির অনুসরণ। যেমন, সেলমা এহাস্কেইল টোডোরোভার ‘ওল্ড পাকিস্তানি’ শিরোনামের আঁকা প্রতিকৃতি। কানাডার শিল্পকলা এখন ডিজিটাল শিল্পকলায় রূপ নিয়েছে। কাগজে ও অ্যাক্রেলিক মাধ্যমের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির প্রিন্ট যুক্ত করে তাঁরা শিল্প সৃষ্টি করেছেন। প্রদর্শনীর দুটি কাজ কেভিন হান্টের করা। শিরোনাম ‘ইউনিটি’ ও ‘প্রিজম’। চীনের প্রথাগত শিল্পভাবনা থেকে গত ৩০ বছরে আধুনিক শিল্পকলার নির্মাণে মনোযোগী হন শিল্পীরা। এ-প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে দেখা যায়, মাধ্যমের বিচিত্রতা, ভিডিও ইনস্টলেশন, প্রিন্ট, অ্যাক্রেলিক, তেলরং, মিশ্রমাধ্যম। এ-প্রদর্শনীর কাজে নতুন নিরীক্ষার খোঁজ মেলে। কলম্বিয়ান শিল্পী হুয়ান রদ্রিগো পিয়েদ্রাহিতো এস্কোবার ‘অ্যাটমোসফেয়ার’ শিরোনামের কাজে রঙের প্রফুল্লতা দেখিয়েছেন। কাজটিতে ক্যানভাস কয়েকটি ভাগে ভাগ করে মানুষ ও প্রাণিকুলের অভিব্যক্তি জোরালো করেছেন। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া তাদের সমকালীন চিত্রকলায় বিশুদ্ধ শিল্পের চর্চা, বাস্তবরীতির নির্মাণ-কৌশলকে গুরুত্ব দিয়ে শিল্প গড়েছেন। তাঁরা শিল্পকর্মে আনন্দের রূপকেই প্রধান করে দেখেন। মিশরে শিল্পের ভার বয়ে বেড়ান শিল্পীরা রঙে, রেখায়, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে। গৌরবান্বিত অতীতকে মিশরের শিল্পীরা সঙ্গে রাখতে চান। মরমি ও অধ্যাত্মবাদ মিশরের শিল্পীদের কাজে দেখা যায়। মোহাম্মদ ইব্রাহিম এলমাস্রির ‘ইজিপ্ট বিটুইন দ্য ফার্স্ট ইয়ার এডি টু ২০১৫ এডি’ শিরোনামের কাজে একজন কিশোরীর দুটি প্রতিকৃতি। একটি মুখ ওড়নায় ঢাকা, আরেকটি মিশরের নেফারতিতির ভঙ্গিতে আঁকা। মিশরের শিল্পীরা অতীতকে সঙ্গে নিয়ে আধুনিক শিল্প নির্মাণ করতে চান।

ফিনল্যান্ড রাষ্ট্র হিসেবে একশ বছর পূর্ণ করবে এক বছর পর। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পচর্চার পরিধি কম হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে শিল্পচর্চা অব্যাহত রয়েছে। এ-প্রদর্শনীতে একটি মাত্র আলোকচিত্র দেখা যায়, যার শিল্পী ছিলেন ইঙ্কেরি জাঁটি। তাঁর আলোকচিত্রের শিরোনাম হলো ‘ইউ আর ওয়েটিং ফর অ্যা ট্রেন’। তিনটি আলোকচিত্রে দেখা যায় ভূমি থেকে উঁচুতে শূন্যে একজন মানুষ অবস্থান করছে, যা একরকম অপেক্ষার চিহ্ন বলে বোঝা যায়। শিল্পের তীর্থভূমি ফ্রান্সের এ-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। মাত্র দুজন শিল্পীর এগারোটি কাজ দেখে সমসাময়িক ফ্রান্সের শিল্প সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। ক্যামিলি ফনটেইন ছয়টি কাজ রেখেছেন ‘ডেড ট্রি’ বা ‘মৃত গাছ’ শিরোনামে। গাছের গুঁড়ির একটি অংশকে বেছে নিয়ে তিনি তেলরঙে ক্যানভাসে এঁকেছেন। অন্য শিল্পী গ্রেগরি ডি গুলেই এঁকেছেন ‘ইন্ট্রোজেকশন’ শিরোনামে পাঁচটি ছবি। নারীদেহের বিচিত্র ভঙ্গিকে পাঁচ রকমে তিনি উপস্থাপন করেছেন। প্রদর্শনীতে জার্মানি হাজির করেছে দুজন শিল্পীর ছয়টি কাজ। নিরীক্ষাধর্মী আলোকচিত্রে দেখা যায়, জ্যামিতিক আকৃতি ও মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা।

এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর শুরু থেকেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ভারতের গুরুশিল্পীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, কলাপতি জ্ঞানপতি সুব্রহ্মণ্যন, সোমনাথ হোর, অমৃতা শেরগিল, কেসিএম পানিকর, গোপাল ঘোষ, মকবুল ফিদা হুসেন, বিনোদবিহারী মুখার্জি, বাসুদেব এসগাইতোনদে, ডিপি রায়চৌধুরী, কান্তিজেরি কৃষ্ণ হেবার, রামকিঙ্কর বেইজ, সতীশ গুজরাল, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মুন্সী প্রেমচাঁদ, মুলকরাজ আনন্দ প্রমুখ শিল্পী-লেখক ভারতের শিল্পকলাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের গুরুশিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, এসএম সুলতান প্রমুখ শিল্পী ভারতের কলকাতায়ই শিল্পশিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ভারতের শিল্পীরা আধুনিক ধারার শিল্পভাবনা দেখাতে চেয়েছেন। ক্যানভাসে তেল, ডিজিটাল প্রিন্ট, এচিং-মিশ্রমাধ্যম, স্থাপনাশিল্প ও পারফরম্যান্সসহ নানামাত্রিক উপস্থাপনায় একেবারে সমকালীন শিল্পমাত্রার কথা বোঝা যায়। সঞ্চয়ন ঘোষের পারফরমিং আর্টের বিষয় হলো ‘রিডিং ফ্রম জেন্ডারড ল্যান্ড’ – নয়জন নারীর বই পাঠ করার ভঙ্গিতে অভিনয় করার আয়োজনে যুক্ত হয়েছে সাদা কাপড়, ৪০ বস্তা বালি। এ ছাড়া অমিত বিশ্বাসের ‘দ্য ব্যাচেলর’ শিল্পকর্মে রশিতে শুকোতে দেওয়া জামার উপস্থিতিকে শূন্যতা হিসেবে দেখা যায়। ভারতের ১৩ জন শিল্পীর কাজে রয়েছে নিজস্ব শৈলী।

প্রদর্শনীতে ইন্দোনেশিয়ার শিল্পকর্মে দেখা যায় তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব। প্রদর্শনীর দুজন শিল্পীর একজন অ্যামেত্মানিয়াস খো এঁকেছেন ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যম। অ্যামেত্মানিয়াসের বিষয় হলো অতীতকে স্মরণ করা। মানুষের মুখের অভিব্যক্তির সাহায্যে তিনি দেখাতে চেয়েছেন অতীতের স্মৃতি। ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় শিল্পী হলেন তিয়ারমা ডেম রুথ সিরাত; ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা তাঁর শিল্পকর্মের শিরোনাম ‘উ’নট এভার বি-২২’।

ইরানের সমকালীন শিল্পকলায় মানবদেহের উপস্থিতি নতুন ধারণার জন্ম দেয়। ইরানের সমসাময়িক শিল্পকলা বিশেষ করে আলোকচিত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। একসময় নির্বস্ত্তক জ্যামিতি ইরানের শিল্পকলার মূল গন্তব্য ছিল। এখন সে-গণ্ডি পেরিয়ে এবারের প্রদর্শনীতে শিদা আজারি মারহাবি ‘বাহারে’ শিরোনামে শিল্পকর্ম এঁকেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে। এ ছাড়া অন্য দুজন শিল্পীর কাজে আমরা ক্যানভাস ব্যবস্থাপনায় কৌশলী হতে দেখি। জাহরা জাফরঘলি জেহতাবের ‘লাভ ইজ হোপ’ শিরোনামের কাজে মানুষ ও দেহের অভ্যন্তরের প্রত্যঙ্গকে আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে। ৩৪০০-র বেশি জাদুঘরের দেশ ইতালি। প্রায় ২০০০ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার এই দেশের শিল্পসৃষ্টি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ থাকে অনেক বেশি। এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে দুজন শিল্পী তিনটি কাজ এনেছেন। ব্রান্দুয়ার্দি মারিয়া লুইসা – ‘লাভ-৪’ ছবিতে রেখাচিত্রে নারীর চাহনি এঁকেছেন। কনস্ট্যানটিন মিগিলিওরিনি ‘ওয়েটিং’ শিরোনামে তেলরঙে এঁকেছেন নগ্ন নারীর অবয়ব। সমকালীন জাপানি শিল্পকলায় দেখা যায় ঐতিহ্যিক চিহ্নকে স্থান দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সমসাময়িক বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা। কেউ-কেউ প্রথাগত রীতি অনুসরণ করে তাঁদের শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন। জাপানের শিল্পী আকান তাজাই স্থাপনাশিল্প তৈরি করেছেন ‘ফ্রগ ন্যাচার’ শিরোনামে। পানিভর্তি পুকুরের মাঝে ভাসমান গাছের আকৃতিকে তিনি দেখিয়েছেন। শিল্পী হায়াসি চিহু ভিডিও স্থাপনাচিত্রে ‘আর্টিফিশিয়াল লাভার অ্যান্ড ট্রু লাভ’ শিরোনামে দেখান মুখোশপরা পুরুষ জাপানি নারীকে জড়িয়ে আছেন। মানবসত্তার মাঝে সত্য-অসত্যের দ্বন্দ্বের কথা তিনি ভিডিওচিত্রে দেখিয়েছেন। ভারত মহাসাগরের নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত মরিশাস। পর্যটনশিল্পকে প্রধান করে শিল্পকলায় বহুজাতির সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। এশীয় প্রদর্শনীতে দেব আনান্দ চোরামুন ‘আনস্পয়েলভ ন্যাচার’ ছবিতে দ্বীপের মাঝে সারি সারি নারিকেল-আপেলগাছের আকৃতি দিয়ে তৈরি করেছেন পাখির আকৃতি। সাভির আবদেল দিলশান হোসানি তেলরঙে এঁকেছেন ‘ফেচিং ওয়াটার’ শিরোনামের ছবি। ছবিতে দুজন নারী মাথায় জলের পাত্র নিয়ে সামনে যাত্রা করছে। ১৯৫০-এর দশকে মিয়ানমারের শিল্পচর্চার ভিত্তি রচিত হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সময়কালে মিয়ানমারে আধুনিক শিল্পকলা বিকাশ লাভ করে। ধর্মীয় আখ্যানধর্মী শিল্পরচনার গ– থেকে শিল্পীরা বেরিয়ে এসে নির্বস্ত্তক শিল্পরচনায় মনোযোগী হয়েছেন। এ-প্রদর্শনীতে জ্য উইন পের আঁকা ‘পিসিমিজম’ ছবিতে লাল ও মেটে হলুদের আভাস নতুন নিরীক্ষার ইঙ্গিত দেয়। নেপালি শিল্পকলার বহুবিচিত্র বিষয় ও আঙ্গিক তৈরির প্রবণতা বর্তমান শিল্পসৃষ্টিতে গুরুত্ব পেয়েছে। রবীন্দ্রকুমার শ্রেষ্ঠার ‘ওয়ার অর নো ওয়ার : উই আর কানেকটেড’ ছবিটি ২২৫ খ- ক্যানভাসে করা। একটি জমিনে সমানভাবে এই খ-গুলো বিছিয়ে শিল্পের বিষয়বস্ত্ত নির্মাণ করেছেন। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে ইসলামি আইন ও প্রথা সবসময় শিল্পীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। পাকিস্তানের যেসব চিত্রশিল্পী ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তাঁরা হলেন গুলগি শাকির আলী, আন্না মোলকা আহমেদ, রশিদ রানা, ইমরান কুরেশি, হুমামুলজি, সৈয়দ ফরিদাবাতুল, ওয়াসিম আহমেদ, সায়রা ওয়াসিম। তাঁদের মনন ভাবনাকে নিরীক্ষায় নিয়োজিত করে শিল্পনির্মাণে প্রথা ভেঙেছেন। প্রদর্শনীর শিল্পী সাদিয়া রিন্দ বালুচ হলুদ ও বাদামি রঙে এঁকেছেন ‘বিউটি অব রেভল্যুশন’। এ ছাড়া আয়েশা সিদ্দিকীর আঁকা ‘আনটাইটেলড’ নির্বস্ত্তক জ্যামিতিক বিন্যাস মনে করায়।

প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার পাঁচজন শিল্পী তাঁদের কাজে নিরীক্ষা চালিয়েছেন অভিনব মাধ্যমে। চুং ইয়ং কিমের ‘লাভার’ ছবিতে ঐতিহ্যবাহী ‘জাংজি’ নামের বিশেষ কোরিয়ান কাগজের ওপর ঔষধি তৃণ ও কালি দিয়ে এঁকেছেন। কোন সাংউন ‘স্মল কান্ট্রি, স্মল পিপল’ শিরোনামের ছবিতে ১২টি মুখাবয়বে অভিব্যক্তিকে মূর্ত করেছেন। রাশিয়া পৃথিবীর ক্ষমতাধর কয়েকটি রাষ্ট্রের একটি। সমকালীন শিল্পকলার বিষয়বস্ত্ততে সংবেদনশীল সামাজিক ইস্যু স্থান পেয়েছে। তিনজন শিল্পীর ছয়টি শিল্পকর্মে রুবিনা খোসেন ‘ইনকমপিস্নট’ শিরোনামে এঁকেছেন দুজন নারীর অবয়ব, একটি মেয়ের মুখ একেবারে বাস্তবানুগ রীতিতে করা। ছবিটি কাগজে চারকোল দিয়ে আঁকা। দক্ষিণ আফ্রিকা শিল্পের তীর্থভূমি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ, ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতা ও পারিপার্শিবকতার আলোকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পীরা শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। প্রদর্শনীতে পামেলা সিলভার দুটি কাজ হাজির করেছেন। একটি ‘আর্লি গ্রিন লিভস্’, অন্যটি ‘ট্যাপেস্ট্রি অফ ফিলিংস’। দুটি কাজই সুগার এচিং ও চায়নিজ চারকোলে আঁকা। দুটি কাজের ধরন একই। দ্রম্নতগতির রেখা ছুটে গিয়ে কেন্দ্রে অবস্থানের চেষ্টা করছে। ছড়িয়ে থাকা কালির ব্রাশ সাবলীলভাবে ছন্দ বিলাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকার কথা মনে উঠলেই একটি ছোট্ট দ্বীপের কথা মনে হয়। ভারত মহাসাগরের এ-দ্বীপের মানুষের নিজস্ব ধারার ঐতিহ্য রয়েছে। শ্রীলংকায় সমকালীন শিল্পচর্চার সূত্রপাত কলম্বোয়। নববইয়ের দশকে শ্রীলংকায় শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ত্রিশ বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ ও সংঘাত, নিদারুণ কষ্ট ও যন্ত্রণা শিল্পকলায় বিষয় হিসেবে উঠে আসে। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া চারজন শিল্পী চার ধরনের কাজ দেখিয়েছেন। শিল্পী চতুরঙ্গ সঞ্জয় বিজ্ঞামা গাঢ় ও উজ্জ্বল রঙে এঁকেছেন ‘কসমিক স্কাইস’। চামিলা মাহান্ত গোমেজ দ্বীপবাসী একজনের দেহভঙ্গি দিয়ে ক্যানভাস গড়েন। এমনি করেই নানা ধরনের নির্মাণ-কৌশল ও বিষয় শ্রীলংকার শিল্পীদের কাজে স্পষ্ট। প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য শিল্পকলায় ঐতিহাসিকভাবে নেতৃত্বদানকারী একটি রাষ্ট্র। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের শিল্প ইউরোপের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিল। প্রতিকৃতি, প্রকৃতি, আলংকারিক শিল্পসৃষ্টিতে যুক্তরাজ্য পৃথিবীসেরা। এক্ষেত্রে চিত্রকর উইলিয়াম বেস্নক, টার্নার, জন কনস্টেবল এবং স্যামুয়েল পালমার উল্লেখ করার মতো। বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা নানা আলোড়ন আর বিত্তবৈভবের জীবনযাপনের সময়কে শিল্পের বিষয় করে নিয়েছেন। শিল্পীরা কনসেপচুয়াল আর্টে মনোযোগী হয়েছেন। স্থাপনাশিল্পেও তাঁদের আগ্রহ দেখা যায়। এশীয় দ্বিবার্ষিকে শিল্পী অ্যান্ড্রেয়াস স্ট্যাভরোস  হেনরি টম্বলিন এঁকেছেন দুটি ছবি ‘সিক্রেট-১’ ও ‘সিক্রেট-২’। পিকাসোর কিউববাদী আচরণে মানুষের অবয়বের সঙ্গে জ্যামিতি যুক্ত করে তুলে ধরেছেন নতুন জমিন। আলট্রামেরিন বস্নু ও বেগুনি রঙের অধিক ব্যবহারে কাজগুলো হয়েছে দৃষ্টিগ্রাহ্য। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জাতি, গোষ্ঠী, সংস্কৃতি, ধর্ম ও মূল্যবোধের দেশ। এদেশের বিকাশ ও উৎসমূলের কোনো সন্ধান না পেলেও বলা যায় সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার পরিম-ল এ-দেশ। মার্কিন চিত্রকলায় সবসময় অনুসন্ধানী নতুন এক মাধ্যমের উদ্ভাসন হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, বিমূর্ত প্রকাশবাদ, অ্যাকশন পেইন্টিংয়ের ধারণার জন্যে মার্কিন শিল্পীরা শিল্পের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। দুজন মার্কিন শিল্পী অ্যাডাম মরিস ইলেশ ও সারাহ স্কুস্টার। একজন ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যমের কাজ উপস্থাপন করেছেন, শিরোনাম ‘প্যাসেঞ্জার’। ‘গড ইন দ্য নাম্বারস’। অন্য শিল্পী স্থাপনাশিল্প প্রদর্শন করেছেন।

ভিয়েতনামের শিল্পকলায় হিন্দু-শিল্পকলার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মীয় চেতনাবোধ যুক্ত হয়েছে। ১৯২৫ সালে অল্পসংখ্যক ফরাসি চিত্রকর ফাইন আর্টস কলেজে তেলরঙের কাজ শেখাতে শুরু করেন। এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পী ডাক ডাও সিল্ক কাপড়ের ওপর প্রিন্ট নিয়েছেন ‘দ্য লস্ট জেনারেশন ১-৪’ শিরোনামে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মুখ অনেকগুলো জ্যামিতিক আকৃতিতে বিভক্ত হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সূক্ষ্ম ও স্থূল আকৃতিতে গড়া মানুষের মুখাবয়বকে শিল্পী দেখিয়েছেন প্রজন্মের শূন্যতা হিসেবে।

দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজক দেশ বাংলাদেশ। ১৫৪ জন শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত অনুভূতি, দুঃখ-বেদনা, এসবকে বিষয় করে শিল্পীরা নানা মাধ্যমে শিল্পকর্ম গড়েছেন। ক্যানভাসে তেলরং, জলরং, অ্যাক্রেলিক, মিশ্রমাধ্যম, পস্নাস্টার, টিন, লোহা, তামা, ধাতব নানা উপাদান, ভিত্তিও আর্ট, আলোকরশ্মির প্রয়োগ ও স্থাপনাশিল্প দেখে বোঝা যায় বাংলাদেশের শিল্পীরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাধ্যমে নিরীক্ষা করছেন। এখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় – দুভাবেই শিল্পের উত্তরণ ও চর্চা হয়ে আসছে।

পাশ্চাত্যের শিল্পকলায় দীর্ঘ সময়ের যে পরিক্রমা – দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিক দৃশ্যপট রচনা, সে-অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ নিউ মিডিয়া অর্থাৎ স্থাপনাশিল্পের নিউ কনসেপচুয়াল আর্টে মনোযোগী হয়েছে। প্রদর্শনীর প্রথাগত শিল্পকর্মের মাঝে সূক্ষ্ম বোধে নির্মিত স্থাপনা ও ভিডিও শিল্পকলা আমাদের জানান দেয়, শিল্প মানেই চলমান বাস্তবতার প্রতিরূপ। অনুকূল চন্দ্র মজুমদার আড়াআড়ি চিত্রতলের বিরাট অংশ শূন্য রেখে কালো রেখায় একটি পরিবারের গল্প এঁকেছেন। রুহুল করিম রুমী ‘অজানা ঔৎসুক্য’ শিরোনামের কাজে তিনটি ভাগ করে জানিয়েছেন কালো ও বাদামি রঙের রেখার সমষ্টিকে। আতিয়া ইসলাম এ্যানী ‘সমকালীন শৈশব’ বা ‘কনটেম্পরারি চাইল্ডহুড’ ছবিতে সমকালীন শিশুদের খাবার চিকেন, কোমলপানীয়, বার্গার, পিৎজা উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বজিৎ গোস্বামী তিনটি শ্লেটের আকৃতিতে আলো জ্বালিয়ে শিরোনাম দিয়েছেন ‘এনলাইটেন’। আজমীর হোসেন ‘মাইন্ডস্কেপ’ ছবিটিকে ছোট-ছোট অনেক আকৃতিতে ভাগ করে নানান ফর্ম গড়ে তুলেছেন। ইফাত রেজওয়ানা রিয়ার ‘মোমেন্ট’ কাজে দেখা যায় ছয়টি বৃত্তের মাঝে ছয়টি মূহূর্তকে। উত্তম কুমার রায় বিশাল ক্যানভাসে মায়ের মুখের সঙ্গে অনেক মায়ের ছবি যুক্ত করে মাকে একটি স্মৃতির ক্যানভাসে তুলে এনেছেন। তাসাদ্দুক হোসেন দুলু এবারের কাজে সংবাদপত্রের ইমেজ যুক্ত করেছেন। সংবাদপত্রের ইমেজকে চিত্রতলের প্রধান ফর্ম ধরে নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ফর্ম তৈরি করে শিরোনাম দেন ‘এইসব দিনরাত্রি-২’। সুমন ওয়াহেদ প্রতিবারের মতো ‘পাওয়ার পলিটিক্স’ শিরোনামের কাজে অতীত ও বর্তমানের ক্ষমতার রাজনীতিকে উপস্থাপন করেছেন। সাদিয়া শামীম মনসুরের ‘অরণ্যে অবগাহন’ ছবিটি গতানুগতিক ক্যানভাসের চেয়ে ভিন্ন। ক্যানভাসের ওপরের দিকে ত্রিভুজের কোণ ওপরের দিকে ছুটছে। এতে ক্যানভাসের মূল ভূমি থেকে খানিক বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। সাবিরা শাহীনুরের ‘ফুটপ্রিন্ট-ওল্ডেন’ ছবিটিতে একটি পায়ের ছাপকে অনেকগুলো আড়াআড়ি ফর্ম ক্যানভাসকে ভাগ করেছে। এতে দৃষ্টিতে বিভ্রম তৈরি হয়ে খানিক স্বস্তি তৈরি হয়েছে। সামছুল আলম আজাদ দীর্ঘ সময় ধরে প্রকৃতির সবুজ ও ধূসর রং নিয়ে কাজ করছেন। এবারের প্রদর্শনীতে তিনি ‘ইভলভ অব নেচার’ শিরোনামে কাজ রেখেছেন। ভাস্কর্যের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক না হলেও যে-কয়েকটি ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে রয়েছে সবকটিতে নিরীক্ষা আছে। সামিনা এম করিমের ‘মাতৃকা’ গ্যালারির বাইরে প্রবেশপথের ডানে পাথরচূড়ায় রাখা হয়েছে। পুরো ভাস্কর্যে নারীর স্নেহময় ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকা শিশুর ভঙ্গি মাতৃকোড়ের স্নেহ মনে করিয়ে দেয়। উজ্জ্বল লালরঙা এ-ভাস্কর্যটি দর্শকদের নজরে আসে অতিসহজেই। সৈয়দ ফিদা হোসেনের ‘এনিগমা-৬’, সরকার নাহিদ নিয়াজীর ‘ন্যাচার-৪’, সুলেখা চৌধুরীর ‘প্রোডাক্ট নিউজ’ কাজগুলো ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। রশীদ আমিনের সাদাকালো রেখার ছাপচিত্র ফ্লোরাল ইমেজে রংরেখায় গতি সঞ্চার করে। মুসলিম মিয়ার ‘লুডু ফ্রম দ্য ব্রাইডাল রুম অব বেহুলা’ ছবিটিতে লুডুর ছক্কা ঘুঁটি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে একরকম টানাপড়েন দেখা যায়। অমিত নন্দীর ‘ইটারনাল বিউটি’ ছবিতে রঙে, রেখায় কোমল এক বন্ধন তৈরি করে। নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা ‘স্টোরিটেইলিং-২’ শিরোনামের কাজে গল্প বলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নির্দিষ্ট ছক, গ–, রং এসব না মেনে প্রতিনিয়ত এঁকে-যাওয়া প্রিমা দর্শকদের সুন্দরভাবে গল্পটি বলে দেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ফখরুল ইসলাম মজুমদারের ‘স্টোরি অব ডিফারেন্ট টাইম’, ফারহানা ইয়াসমিনের ‘মাই চাইল্ডহুড’, দেবাশীষ পালের ‘জার্নি ইন ফায়ার’, ফারজানা আহমেদ ঊর্মির কাজে নিরীক্ষার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

এ-প্রদর্শনীর গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক হলো, আমন্ত্রিত শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনী। একযোগে নবীন ও অগ্রজ শিল্পীদের কাজের এ-প্রদর্শনী তরুণদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। আমন্ত্রিত শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সের আকিরা আবে, হেক্টর সাউনিয়র, হিরোকো ইয়ামামোটো, শি লিন চেন, ভার্সা ব্যাপটিস্ট, ধীরাজ চৌধুরী (ভারত), জাপানের হোশিনা টয়োমি, প্রফেসর টেটসুয়া নোদা, পোল্যান্ডের রাফাল স্ট্রেন্ট, থাইল্যান্ডের প্যানপিমন সোয়ান্নাপংসে, ইউএসএর মোস্তফা টি আরশাদ, সুজান বেনটনসহ বাংলাদেশের আবু তাহের, আবদুল মান্নান, আবদুস সাত্তার, আবদুস শাকুর, অলোক রায়, হাশেম খান, জামাল আহমেদ, কালিদাস কর্মকার, কেএমএ কাইয়ূম, কনক চাঁপা চাকমা, খালিদ মাহমুদ মিঠু, মাহমুদুল হক, মোহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ ইকবাল, মোখলেসুর রহমান, মনিরুল ইসলাম, মনসুর-উল-করিম, মোস্তাফিজুল হক, মনিরুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, মুস্তাফা মনোয়ার, মুস্তাফা খালিদ পলাশ, নাসিম আহমদ নাদভী, নাইমা হক, নাসরীন বেগম, নাজলী লায়লা মনসুর, নিসার হোসেন, রফিকুন নবী, রণজিৎ দাশ, অলকেশ ঘোষ, আহমেদ শামসুদ্দোহা, বীরেন সোম, চন্দ্রশেখর দে, ফরিদা জামান, গোলাম ফারুক বেবুল, গৌতম চক্রবর্তী, হামিদুজ্জামান খান, রাসা, রেজাউল করিম, রোকেয়া সুলতানা, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সাহাবুদ্দিন আহমেদ, শহিদ কবীর, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, শেখ আফজাল, শিশির ভট্টাচার্য, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, সৈয়দ হাসান মাহমুদ, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, স্বপন চৌধুরী, তাজুল ইসলাম প্রমুখ অগ্রজ শিল্পীর কাজ প্রদর্শনীতে রাখায় প্রদর্শনী অতি উচ্চতায় পৌঁছেছে। দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর প্রথম সপ্তাহে শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারির মুক্ত আঙিনায় ১২ জন শিল্পী পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেন। বিষয়ভিত্তিক শরীরী ভঙ্গিতে এ-পরিবেশনা শিল্পকলার নতুন এক মাধ্যম হিসেবে স্থানীয়-আন্তর্জাতিক শিল্পপরিম-লে পরিচিতি পায়। পারফর্মে অংশগ্রহণকারী শিল্পী অমল আকাশের বিষয় হলো – ‘সেভ সুন্দরবন’, ইফাত রেজওয়ানা রিয়ার ‘আননোন ডেস্টিনেশন’, ফারাহ নাজমুনের ‘জার্নি বিহাইন্ড দ্য ট্রুথ’, জুয়েল এ রবের ‘ইটারনাল মোমেন্ট, ‘অ্যা কনটেম্পরারি লাইফ’, ঋতু সাত্তারের ‘১১৩৪ নাম্বারস নট লাইভস’, অসীম হালদার সাগরের ‘এক্সিসটেন্স অব আইডেনটিটি’, সানজিদ মাহমুদের ‘স্ক্র্যাচ ইন সিটি’, সরকার নাসরিন টুনটুনের ‘কন্ডিশনস অ্যাপস্নাই’, আফসানা শারমিনের ‘অ্যান্ড দ্য ফেমিনিন’, সুজন মাহবুবের ‘ম্যান দ্য সেস্নভ অব টাইম’ ও অর্পিতা স্নিগ্ধা লোপার ‘সার্চিং এসেন্স বিফোর মি’। বারোটি পারফরম্যান্সে বারো ধরনের বিষয় বেছে নিয়ে শরীরী ভঙ্গিতে বিষয় বর্ণনা করেছেন। বিষয় বর্ণনার সঙ্গে দর্শক সরাসরি যুক্ত হন। অতি অল্প সময়কালের এ-নতুন শিল্পমাধ্যমটি তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে।

দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর মাসব্যাপী এ-আয়োজনে বাংলাদেশসহ এশীয় অঞ্চলের শিল্পবোদ্ধা, দর্শকের মাঝে নতুন বন্ধন সূচিত হয়। কিন্তু ৫৩টি দেশের স্বল্পসংখ্যক কাজে কতটা সেসব দেশের সাম্প্রতিক শিল্পচর্চার অবস্থা অবগত হওয়া যায়, সে-প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এ-আয়োজন থেকে শিল্পের দর্শকরা এ-বার্তা পেয়ে যান যে, শিল্পকলা কোনো স্থানীয় ভাষা নয়, এটি বিশ্ববাসীর অভিন্ন ও একক ভাষা। শিল্পকলাই পারে পৃথিবীবাসীকে একমঞ্চে টেনে আনতে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় গত ১ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর। 