সরলাবালা ও কেশবের যুদ্ধ

হাসনাত আবদুল হাই

উত্তরের শীতের বাতাস ভাঙা জানালার বন্ধ কপাট দুফাঁক করে ভেতরে ঢুকে আপাদমস্তক আধময়লা ছেঁড়া-ফোঁড়া কম্বলের নিচে নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে থাকা কেশবের ওপর বাঘের মতো হামলে পড়তেই কাশতে-কাশতে তার শরীর ওপরে-নিচে খিঁচুনি দিয়ে ওঠানামা করে। প্রচ- আলোড়নে পুরনো চৌকিতে ঝরেপড়া শুকনো গাছের ডালপালার মতো মচমচ শব্দ ওঠে। তরজার বেড়ার দেয়াল দেওয়া ঘরটা খোঁড়া মানুষের মতো একদিকে হেলে আছে, ওপরে খড়ের চালের ভেতর দিয়ে মাঝে-মাঝে আকাশ উঁকি দেয়। মাটির মেঝেটা স্যাঁতসেঁতে, সেখানে ঠান্ডা ঘাপটি মেরে আছে।

কেশব অনেক্ষণ ধরে কাশে, কাশির গমকে শরীর ধনুকের মতো বাঁকিয়ে ওপরে কিছুদূর তুলে কেটে-ফেলা গাছের গুঁড়ির মতো ধপাস করে বিছানার চাটাইয়ের ওপর পড়ে। তার স্ত্রী সরলাবালা হাতে গরম সরষের তেলের বাটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। কেশবের মাথার কাছে একটুখানি জায়গা করে নিয়ে বসে সে কাশি থামার অপেক্ষা করে। একটা হাত কেশবের মাথায় রেখে এলোমেলো রুক্ষ চুলের ভেতর আঙুল বোলায় সে। ময়লা শাড়ির আঁচল পিঠে ছড়ানো, তার ওপর মাথার চুল লেপ্টে আছে, যেন এইমাত্র সণান করে এসেছে।

কেশবের কাশি থামতে সময় নেয়। ততক্ষণ সরলা তার মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে চলে, যেন ওইভাবে সে কাশির দাপট সামাল দিতে চায়। কাশি বেড়েই চলে, ভাঙা জানালাটার কপাট বাতাসে খটাস-খট শব্দ তোলে। হাতে তেলের বাটিটা বিছানার একপাশে রেখে সরলা জানালার কাছে গিয়ে এক টুকরো পাটের রশি দিয়ে কপাটদুটো বাঁধবার চেষ্টা করে। উদোম হাওয়া এসে কপাটদুটো বারবার আলগা করে দেয়। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত জানালার কপাট বন্ধ হয়। সরলা ফিরে এসে কেশবের পাশে বসে। একটু পর কাশির বেগ কমে আসে। কেশব চোখ বিস্ফারিত করে হাঁপাতে থাকে। সরলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে মুখটা নামিয়ে এনে বলে, কষ্ট হতিছে? খাড়াও। গরম তেল আনিছি। বুকে মালিশ করে দেই। আরাম পাবা।

কেশবের মুখ থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের হয়, যেন বেড়ালের গোঙানি। সে ফ্যাসফেসে গলায় বলে, হাঁ। আরাম! আরাম কি কপালে লেখা আছে? এই বুড়ো বয়সে কষ্ট বাড়বে ছাড়া কমবে না। বুঝলা?

সরলা জোরে-জোরে ডান হাত দিয়ে কেশবের বুকে তেল মালিশ করতে থাকে। তেল ততক্ষণে বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঘরে বাতাস নেই, ছায়া ঝিম মেরে আছে, যেন লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। একটু পর রাশভারী লোকের মতো পা ফেলে সন্ধ্যা নামবে। বাড়ির চারপাশে     পাখ-পাখালির ডাক বাড়ছে। গোয়ালে গরুটা হাম্বা করে ডাক দিলো কয়েকটা। বাঁশঝাড়ের পথ দিয়ে কারা যেন কথা বলতে-বলতে যাচ্ছে। সরলার মনে পড়ে আজ হাটবার।

উঠোনে এসে হাঁক দিলো, নারায়ণচন্দ্র, কেশব আছো নাহি? ও কেশব?

দুবার ডাক দেবার পর সরলা মাথার ঘোমটা টেনে ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল, শরীলটা ভালো নাই। সারাদিন

কাশতেছে।

ও। হাঁপানিটা বেড়ে গেল বুঝি? এই পাজি রোগটা একবার ধরলে আর ছাড়ে না। বড় ভোগায়। তারপর একটু থেমে নারায়ণচন্দ্র বলে, খুব কষ্ট পাতিছে বুঝি?

হ। বলে সরলা বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়ায়।

ঠান্ডা পড়তিছে তাই অসুখটা জাপটে ধরিছে। ঠান্ডা মৌসুমই হলো হাঁপানির কাল। তারপর একটু থেমে বলল, গঞ্জে তোমাদের মুদির দোকানটা দুদিন ধরি বন্ধ দেখতে পাই। ভাবলাম, কি হলো কেশবের? সে দোকান খোলে না কেন? হ। অসুখ-বিসুখের কথাই মনে আইছে তারপর। তাই দেখতে আলাম। ভেতরে ঢোকব? বলে সে ঘরের দিকে এগিয়ে আসে। সরলা দরজার সামনে থেকে সরে এসে বলে, যান। আমি কুপিটা জ্বালায়ে নিয়ে আসি। ভেতরে অন্ধকার জমতি শুরু করিছে।

মাথার ওপর দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে-ডাকতে উড়ে-যাওয়া কাকগুলো দেখতে-দেখতে নারায়ণচন্দ্র বলে, হ। সন্ধ্যা হয়ে আইল। আজ আবার আমাবস্যা।

ঘরের দাওয়ায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল নারায়ণচন্দ্র। ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, এহহে। ঘরটার তো পড়ো-পড়ো অবস্থা। এতো বছর হলো শিবচর গ্রামে আসি বাসা বাঁধলা তোমরা। একটা ভালো ঘর তৈরি করি নিতে পারলা না এতোদিনে। গঞ্জের দোকানে কি রোজগার কম হয় আজকাল? ভালোই তো চইলে আসিছে। তারপর গোয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, দুধেল গাইও আছে দুইটা। দুধ বিক্রি করেও উপার্জন হয় তোমাদের। অবস্থা খুব খারাপ হওনের কথা না।

সরলা উঠোনে নামতে-নামতে বলে, ছেলে দুটোরে মানুষ করলাম। মেয়েটারে বিয়ে দিলাম। উপার্জনের টাকা ওদের পেছনেই গেল। ঘরটার দিকে হাত দেওয়ার সময় হলো না।

নারায়ণচন্দ্র হাতের আঙুল গুনতে-গুনতে বলে, কতো বছর হলো তোমরা আসিছ শিবচর, মনে আছে? প্রায় পঁয়তালিস্নশ বছর হবে। এই এতো বছরে ঘরে টিনের চালা উঠলো না, এ বড় তাজ্জবের ব্যাপার। তা ছেলেদুটো শহরে ভালোই রোজগার করে বলে শুনি। টাক-পয়সা পাঠায় না? সরলা চুপ করে থাকে। একটা সাদা বেড়াল তার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়।

গরুটা আবার হাম্বা ডাক দেয়। চারিদিক থেকে অন্ধকার মারমার কাটকাট করে দৌড়ে আসতে থাকে। মাঝে-মাঝে দমকা বাতাস আসে উত্তর থেকে। হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়, এমন ঠান্ডা। নারায়ণচন্দ্র সরলার দিকে তাকিয়ে বলে, পাঠায় না। বুঝতে পারি। টাকা পাঠালি ঘরটার এমন শ্রী থাকতো না।

সরলা নিচু স্বরে বলে, ওদের সংসার আছে। খরচের পর কিছু থাকে না মনে হয়।

কী করে জানো থাকে না? হিসেব দিয়েছে কোনদিন। ছেলেরা অমনই। বড় হলি বাপ-মায়ের খবর নেয় না। এ তো পুরনো কথা। তা মেয়েটা ঠিকঠাক আছে তো শ্বশুরবাড়ি? শাশুড়ি কি জ্বালায়?

ভালোই আছে। মাঝে-মাঝে আসে।

হ। মেয়েরা আসে। বাপ-মায়ের খবরাখবর নেয়। ভোলে না। তারা আসে। তারপর একটু থেমে নারায়ণচন্দ্র বলে, যাই ভেতরে। কেশবরে একটু দেখি।

থানা সদরে বাস থেকে নেমে কেশব দেখে হাসপাতালের সামনে ছোটখাটো ভিড়। কৌতূহল নিয়ে সেদিকে এগোয় সে। তার খুব তাড়া নেই। কমলগঞ্জ গ্রাম এখান থেকে এক ঘণ্টার হাঁটা পথ। রিকশা নিলে পনেরো মিনিট। তার হাতের পুঁটুলিটা এমন কিছু ভারী না যে, রিকশা নিতে হবে। সে হেঁটেই যাবে। হাসপাতালের দিকে যেতে-যেতে সে চারিদিক দেখে। নয় মাসে কিছুই বদলায়নি। কয়েকটা দোকান ভাঙা দেখা যায়, শুধু এইমাত্র পরিবর্তন। তার পায়ে একটা ঘা হয়েছে, সেটা ব্যথা দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। হাসপাতালে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায় কি না, দেখবে সে। হাসপাতালে অরুণ নামে এক ওয়ার্ডবয় তার চেনা। সে এখন আছে কী না কে জানে। শেষ দেখা নয় মাস আগে। সে কি হাসপাতালে ছিল এই নয় মাস, না অন্যদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল?  ভাবতে-ভাবতে কেশব হাসপাতালের ভেতর ঢোকে। বারান্দায় বেশ কয়েকজন হেঁটে যাচ্ছে, ঘরের ভেতর ঢুকছে। তাদের মধ্যে অরুণ নেই। বারান্দার পাশের ঘরগুলোতে সাদা কাপড় পরা কয়েকজন বসে চা খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। ডাক্তার মনে হলো। তাদেরকে অরুণের কথা জিজ্ঞাসা করতে সাহস হলো না কেশবের। সে বারান্দা থেকে পাশের ওয়ার্ডে ঢোকে। ভেতরে দুদিকে সারি দিয়ে লোহার খাট পাতা। সাদা চাদর হলুদ হয়ে এসেছে। সবগুলোতেই রোগী শুয়ে, পুরুষ আর মেয়ে। মেয়েদের অনেকে চুপচাপ মুখ হাত দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছে। শুধু একটা মেয়ে মুখ খোলা রেখে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। দেখেই বোঝা যায় অল্প বয়স,   ষোলো-সতেরো হবে। শ্যামলা রং। চোখদুটো বড়। বেশ মায়া-জড়ানো চাউনি। কেশব মেয়েটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে। মেয়েটাও তাকে দেখে।

পিঠে হাত পড়তে কেশব পিছন দিকে তাকায়। অরুণ, সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে জাপটে ধরে বলে, কেশব, বাইচা আছো? কখন আইলা? এইখানে ক্যান?

কেশব বলে, বাইচা আছি। দেখতেই পাইতাছো। আইলাম এখনি। পায়ে একটা জখম। ওষুধ লাগায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায়?

খুব যায়। এ আর এমন কী কাজ? কতো বড়-বড় জখম নিয়া হাসপাতালে আসতিছে মানুষ।

পেছন ফিরে যেতে-যেতে কেশব বলে, ওই মেয়েটা, ওই যে তাকায়ে রইছে। কী হইছে তার?

অরুণ বলে, কার কথা কতিছ? তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে, ও। ওই মেয়েটা। ওর নাম সরলাবালা। লম্বা কাহিনি। বেশ দুঃখের। শুনতে চাও তো কবো তোমারে। এখন চলো, তোমার ব্যান্ডেজটা বাঁধার ব্যবস্থা করি।

কেশব যেতে-যেতে বলে, তুমি মেয়েটারে চেনো নাহি?

আগে চিনতাম না। এহন চিনি। হাসপাতালের রোগীদের আমাদের চেনা লাগে। তাদের অনেকের সম্মন্ধে জানা হয়ে যায়।

ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর অরুণ বলে, খাওয়া-দাওয়া কিছু করিছ?

না। এইতো বাস থেকে নামলাম।

চলো, তোমারে দোকানে নিয়া খাওয়াইয়া আনি। আমিও খাবো তোমার সঙ্গে। গ্রামে ফিরছো তো? কমলগঞ্জে?

হ্যাঁ। আর যাবো কোনঠাই। বাপ-দাদার ভিটে ছাড়া আর যাবার ঠিকানা কই?

খেতে-খেতে অরুণ সরলাবালার সব কথা বলে কেশবকে।

শুনতে-শুনতে কেশবের মুখ হাঁ হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময় এবং ক্রোধ জড়ো হয়। একটু পর সে বলে, এসব কী কও? সত্যি নাহি?

সত্যি না তো মিথ্যা কথা কতি যাবো কেন? আমার তাতে লাভ?

মেয়েটার আত্মীয়স্বজন আসে নাই হাসপাতালে?

না। কেউ আসে নাই। মনে হয় কেউ নাই। অরুণ বলে।

আহা রে! অমন কচি মুখ মেয়েটা হাসপাতালে পড়ি রইছে। সে ভালো হয়ে উঠলি যাবে কোথায়?

কী করে কবো? জিগাই নাই তারে।

কেশব কিছুক্ষণ আনমনা থাকে। তারপর গম্ভীর মুখে বলে, আজ গ্রামে যাব না। তোর সঙ্গে থাকব।

বেশ তো। থাক। তা এতোদিন পর ফিরে আসি গ্রামের বাড়ি যাতি মন চায় না ক্যান?

বাড়িতে গিয়া কি দেখবো তা ভাবতিই বুক কাঁপতিছে। এতোদিন খুব অস্থির ছিলাম আসার জন্যি। এখন সে-অস্থিরতা নাই। মনে হতিছে ওই মেয়েটার মতো আমারো কেউ নাই। কেউ আমার লাগি অপেক্ষা করতিছে না। এই নয় মাস খালি পড়ে থাকলি কি ঘর-বাড়ি ঠিক থাহে? গিয়ে কী দেখবো কেডা জানে। বাপ-মা তো চোখের সামনে মরিছে। সংসারে আর তো কেউ নাই আমার।

তাও নিজের ভিটে-বাটি বলে কথা। তার টান কি অস্বীকার করা যায়? অরুণ বলে।

তা যায় না। সেই জন্যিই বাড়ি যাব। তবে একটু জিরোয়ে নিই তোর এখানে। সরলাবালা সম্বন্ধে আরো জানার ইচ্ছা হতিছে। হাসপাতাল ছাড়ার পর সে কোথায় যাবি তা জানবার চাই।

অরুণ অবাক হয়ে কেশবের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, তোর মনে বুঝি মেয়েটারে ধরিছে? কিন্তু ধরলি পর হবে কি? মেয়েটার এই ছোট্ট জীবনে যে মস্ত বড় দুঃখ। বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সরলাবালা অরুণের টিনের ঘরের মেঝেতে পিঁড়ায় বসে আছে। সামনে কেশব। সব শুনে সে প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। তার চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। অস্ফুটে কিছু বলে সে বারবার।

অরুণ বলে, কী কও সরলা? শোনা যায় না।

সরলা এবার স্বর উঁচু করে বলে, এ হয় না। আপনার বন্ধু আমার সম্বন্ধে কি জানে? এমন কথা কতিছে কেন অজানা-অচেনা একটা মেয়েকে? আমার সম্বন্ধে কি জানে সে?

অরুণ বলে, সব জানে। আমি তারে কয়িছি। কেশব জেনে-শুনেই প্রস্তাব দিতেছে তোমারে। বড় ভালো ছেলে সে। তার মনে কোনো কালো নেই। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওর স্বভাব আমার জানা। একবার গোঁ ধরলি ছাড়ন নাই।

কমলগঞ্জে সরলাকে নিয়ে কেশব যখন পৌঁছালো তখন দুপুর। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখল ভিটেটা আছে, তবে তরজার বেড়া, খড়ের চালঅলা ঘরদুটো নেই। গোয়াল খালি। সে তাকিয়ে দেখল আশেপাশের বাড়িতে মেরামতের কাজ চলছে। কেউ-কেউ নতুন করে বাড়ি তুলছে।

কেশব উঠোনে একটা ইটের ওপর সরলাকে বসতে দিয়ে বলল, বসো। দেখতিছো তো বাড়ির কী অবস্থা। আমি দেখি থাকার কী ব্যবস্থা করা যায়। নতুন ঘর বানতি সময় নেবে।

কয়েকজন পুরুষ তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলে, আরে কেশব না? তা একা কেন? বাপ-মা কই?

কেশব মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, তারা নাই। ক্যাম্পে মারা গেছেন।

শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্রামের মানুষগুলো। সরলাকে দেখে বলে, একে তো দেখি নাই আগে। এ কে বটে?

আমার বউ।

বউ? তোমার তো বউ ছিল না। একজন বলে।

ছিল না। এখন হয়িছে। বিয়ে করে ফেললাম। সংসার পাততি হবি না? বলে সে হাসিমুখে সবার দিকে তাকায়।

একজন বলে, সোন্দর বউ পাইছো। বেশ লক্ষ্মীমন্ত দেখতে।

উঠোনে বিচার বসেছে। সমাজের নেতৃস্থানীয় বয়স্ক লোকেরা গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। কেউ-কেউ হুঁকো টানছেন জোরে-জোরে। কেউ আবার চাপাস্বরে পাশের লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। সবাইকে বেশ উত্তেজিত দেখায়। সবাই একটু পরপর দেখছেন সরলাকে। সে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে উঠোনের মাঝখানে। পাশে কেশব। তার দুই হাত হাঁটুর ওপর রাখা। মুখ ভাবলেশহীন।

সমাজপতিদের একজন বলেন, গ্রামে ফিরে আসিছো, ভালো কথা। নিজের বাড়ি ফিরবা নাতো কোথায় যাবা? কিন্তু এই মেয়েকে তোমার সঙ্গে রাখা যাবি না। তার সম্বন্ধে সব আমাদের জানা হয়ি গেছে। তারে বিদায় করো। না হলি গ্রামের কলঙ্ক হবি।

কেশব বলে, সরলা আমার বিয়ে করা বউ। শাস্ত্রমতে বিয়ে করিছি। তারে তাড়াবো ক্যান?

জানি-শুনি এমন মেয়েরে বিয়ে করতি গেলা ক্যান? কাজটা ভালো হয় নাই। তোমার দুর্নাম হয়িছে। ও এহানে থাকলি গ্রামের দুর্নাম হবি। ওরে বিদায় করো।

কেশব কঠিন স্বরে বলে, না। সরলা যাবে না। এহানেই থাকবে।

সমাজপতিদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তার গলা এবার সপ্তমে চড়ে। তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, তোমাকে সমাজচ্যুত করা হবি যদি আমাদের কথা অমান্য করো।

বেশ তাই করেন। বলে, কেশব সরলার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।

সমাজপতিরা একসঙ্গে বলে ওঠেন, লক্ষ্মীছাড়া।

নারায়ণচন্দ্র রিকশা থেকে নেমে কেশব আর সরলার কাছে এসে বলে, নামে। আমরা পৌঁছে গেছি। এটাই শিবচর গ্রাম। আমাদের গ্রাম। তুমি তো জানোই কেশব। এই গ্রামে মনে হয় তোমার আরো কয়েকজন আমার মতো দূর-সম্পর্কের আত্মীয় আছে। চলো যাওয়া যাক।

সরলার হাতে পুঁটুলি, কেশবের কাঁধে একটা বস্তা। সংসারের জিনিসপত্র তার ভেতর। আমগাছ-ঘেরা একটা উঠোনের কাছে এসে নারায়ণচন্দ্র বলে, এই হলো গিয়ে আমাদের ভিটে। কেউ থাকে না এখন। দেখতেই পাচ্ছো চালা ঘরটা পড়ো-পড়ো। একটু মেরামত করে নিলেই হবে।

কেশব কাঁধ থেকে বস্তা নামিয়ে বলে, থাকার ব্যবস্থা হলো। কাজ, কাজের কি হবি?

নারায়ণচন্দ্র বলে, কাজের অভাব হবে না। গঞ্জে আমার গুদাম আছে। সেখানে কাজ করতি পারবা। তারপর একটু গুছায়া নিয়া নিজের পছন্দমতো রোজগারের ব্যবস্থা করবা।

কেশব আবেগ বিহবল হয়ে বলে, আপনি বড় ভালো মানুষ। বড় উপকার করলেন। তারপর চারদিকে তাকিয়ে বলে, এহানকার মানুষজন কেমুন?

নারায়ণচন্দ্র একটু ভেবে বলে, দেশের অন্য জায়গায় যেমন এখানেও তাই। খুব একটা তফাৎ নাই। তাই সতর্ক থাকতি হবে। কারো সঙ্গে বেশি কথা কবা না। নিজেদের সম্বন্ধে বেশি বলার দরকার নাই। জিজ্ঞেস করলে বলবা আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। সবাই আমাকে চেনে এই গ্রামে। কেউ ঝামেলা করবে না। আমি গঞ্জ থেকে এসে মাঝে-মাঝে দেখে যাবো তোমাদের।

নাম বদলাতি হবি? কেশব একটু কেশে জিজ্ঞেস করে।

না, না। নাম বদলাবা ক্যান? নাম ঠিকই আছে। তোমাদের কেইবা চেনে এই গ্রামে। কেউ দেখে নাই আগে। তারপর একটু থেমে বলে, কেউ কিছু শোনে নাই।

কেশব রাতের বেলা সরলাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে, আমাদের নতুন সংসার শুরু হলো। এরপর ছেলেমেয়ে হবে। তারা উঠোনে খেলবে।

শুনে সরলা লজ্জায় মুখ ঢাকে।

কেশব বলে, ছেলেমেয়েদের কাউকে তোমার সব কথা কবা না। দরকার পড়লি মিথ্যা কথা কবা। এমন মিথ্যায় পাপ নাই।

গঞ্জের মানুষদের মধ্যে সেদিন বেশ উত্তেজনা। তারা টেলিভিশনে খবরটা শুনেছে। খবরের কাগজ পাওয়ার পর অনেকেই কাগজ থেকে খবরটা পড়ে শোনাচ্ছে। সবাই বেশ উত্তেজিত। কেশবও তাদের কথা শুনতে পায়। কিন্তু উত্তেজনার কারণ কি তা না জানার জন্য সে বেশ অস্থির হয়ে থাকে। তারপর যখন খবরটা সে পায় তার ভেতর দারুণ এক ক্রোধ দেখা দেয়। সে কাউকে কিছু বলে না। প্রায় দৌড়ে গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। উত্তেজিত হয়ে সরলাকে দুহাতে ধরে বলে, কাল সকালে ঢাকা যাবো আমরা। তার প্রৌঢ় মুখ উত্তেজনায় থরথর করে।

ঢাকা? সে কোনখানে? সরলা কপালে এসে পড়া পাকা চুলের গোছা সরাতে-সরাতে বলে।

আমাদের দেশের রাজধানী। কেশব বলে।

সেখানে যাবো ক্যান আমরা? কোনোদিন যাই নাই। তোমার হাঁপানির অসুখ। এই অসুখ নিয়া ভাঙা শরীরে রাজধানী যাবা ক্যান?

কেশব হুংকার দিয়ে বলে, প্রতিশোধ নিতে। তুমি সব বলবা বিচারকদের। তোমার ওপর পঁয়তালিস্নশ বছর আগে যতো অত্যাচার হয়িছে, তোমার ইজ্জত যেভাবে হারায়েছো, সব কথা বলবা তুমি।

সরলা বলে, এই এতো বছর পর কবার কি দরকার হলো? শুনতে পেয়ে আবার না গ্রামছাড়া করে এরা। তা ছাড়া ছেলেমেয়েরাও জানতি পারবে। তাদের কিছু কওয়া হয় নাই এতোদিন। সব কথা লুকায়ে রাখিছি।

কেশব উঠোনে উত্তেজিত হয়ে এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটে। তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এসেছে। সে হুংকার দিয়ে বলে, পঁয়তালিস্নশ বছর পর দুশমনরা কতিছে এদেশের মানুষের ওপর তারা কোনো জুলুম করে নাই। কাউরে মারা হয় নাই। মেয়েদের ইজ্জত লোটে নাই কেউ। তুমি সাক্ষী দেবা। কবা সব কথা। পঁয়তালিস্নশ বছর যে জখম বুকের ভেতর ঢাকি রাখিছ সেডা বাইর করি দেখাও সবাইরে। অন্যায়ের বিচার হোক, জানুক সবাই। জানুক পৃথিবীর লোক। অন্যায়ের বিচার হতিছে এতোদিন পর। এ্যাহোন চুপ করি থাকা যায় না। অ্যাহন ভয়ের কিছু নাই। সবাই বোঝবে।

সরলা কেশবের পাশে এসে বলে, বেশ। তুমি যা কও তাই হবি। আমি রাজধানী যাবো। সেখানে সব কথা কবো।

তখন মাথার ওপর দিয়ে একদল টিয়া পাখি উড়ে যায়। হঠাৎ দেখে মনে হয় সবুজ একটা কাপড়, তার ভেতর গাঢ় লাল রঙের ছোপ।