সাম্প্রতিক পারস্য নিয়ে একটি হৃদয়গ্রাহী বই

আবুল হাসনাত

 

ন্ধুর উপরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে আমি হুমায়ুন কবির-লিখিত পারস্য প্রবাসে গ্রন্থটি আলোচনায় সম্মত হয়েছি। আমি বিচ্ছিন্নভাবে বইটি সম্পর্কে  দু-একটি কথা বলব। সামগ্রিকভাবে নয়। বইটি পাঠ করছিলাম খুবই অনাগ্রহ নিয়ে; ভেবেছিলাম এটি হয়তো ভ্রমণকাহিনি। হালকা ও লঘু। যদিও রবীন্দ্রনাথ ও পারস্য আমার অন্যতম আগ্রহের বিষয়; সেজন্যে এক পর্যায়ে বইটি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। কিন্তু যতই বইটির ভেতরে প্রবেশ করেছি, পাঠক হিসেবে আমাকে এ-বই ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গেছে। এ-গ্রন্থটি পাঠ করে আমি ঋদ্ধ হয়েছি। ইরানের রাজা রেজা শাহের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সে-দেশে গিয়েছিলেন সত্তর বছর বয়সে; ১৯৩২ সালে। রবীন্দ্রনাথ-লিখিত পারস্যে গ্রন্থে তিনি এই ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি ভ্রমণ করেছেন পারস্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। পারস্যের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সামগ্রিক জীবনধারা। তিনি বলেছেন, পারস্যের শাশ্বত স্বরূপটি জানতেই আগ্রহী ছিলাম, পারস্য আপন প্রতিভায় স্বপ্রতিষ্ঠিত। ঐতিহ্যধারায় অবগাহন করে এই প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথকে সত্যিকার অর্থেই কিছুটা মুগ্ধ করেছিল। শুধু আতিথেয়তা এবং সম্মানজ্ঞাপনের জন্য

নয়, রবীন্দ্রনাথ পারস্য-সংস্কৃতির মধ্যে ঔদার্যের অনুষঙ্গ লক্ষ করে দীপিত বোধ করেছিলেন।  দীর্ঘদিন পরে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে এই ভ্রমণ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে বলেছেন, –

‘পারস্যে তুমি আমার ভ্রমণসঙ্গী ছিলে। সেখানকার রাজা বহুব্যয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমি আতিথ্য পেয়েছিলুম সমস্ত পারস্যদেশের। সে কথা তুমি জানো। কেবল রাজা নন, রাষ্ট্রপারিষদেরাও সকলেই অভ্যর্থনার কাজে নিয়ত মনোযোগী ছিলেন। আমি ছিলেম বিদেশী, আমার রচনার সঙ্গে পারস্যের পরিচয় নিতান্ত অসম্পূর্ণ; আমার খ্যাতিকে পারসিকেরা কেবল বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন মাত্র। সেই বিশ্বাসের প্রতি নির্ভর করে তাঁরা আমাকে যে সম্মান দিয়েছিলেন, সে সম্মান সেই মানবচিত্তের উদ্দেশে যে-চিত্ত দেশকালের আশু প্রয়োজনীয় সীমা অতিক্রম করে বিরাট ইতিহাসের মধ্যে পরিব্যাপ্ত।’

কবি অমিয় চক্রবর্তী এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে ইস্পাহান, সিরাজ ও তেহরান সফর করেছিলেন তিনি। সেখানে কাটিয়েছিলেন ৭১তম জন্মদিনটি এবং ইরানবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন একটি কবিতা। আমরা অনেকেই জানি যে, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এই পারস্যভ্রমণ তাঁর সংস্কৃতি ও ধর্মবোধে প্রভাময় হয়ে উঠেছিল। তাঁর মানস ও মননে পারস্যের সংস্কৃতি খুবই প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত ফারসি কবিতা ও কবি হাফিজের প্রেমবোধ ও আধ্যাত্মিকতা এবং রুমির প্রসঙ্গ তিনি প্রবন্ধে ও চিঠিপত্রে বারংবার উল্লেখ করেছেন। আমরা তাঁর ধর্মবোধ বা

ব্রাহ্ম-আন্দোলনে এবং সমন্বিত মানবিক চেতনার যে-সাক্ষাৎ পাই সেখানে পারস্যের সুফিবাদ কতই না গুরুত্ব বহন করেছে! এছাড়া এ-কথা আর অবিদিত নেই যে, মোগল মিনিয়েচার পেইন্টিং নিয়ে আজ ভারতের যে-গর্ব তা প্রধানত সম্রাট আকবরের অবদান হলেও

পারস্য-প্রভাবিত; এবং তাঁর দরবারে প্রাথমিকভাবে পারস্যশিল্পীদের প্রযত্ন ও অনুশীলনেই এটি চর্চিত হয়েছিল। তাঁরাই দীক্ষিত করেন ভারতীয় শিল্পীদের এবং এ-শৈলীকে এক উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যান।

হুমায়ুন কবির চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত কাজে পারস্যে গিয়েছিলেন এক  সংকটজর্জরিতকালে – যখন ইরানে খোমেনি-পরিচালিত ইসলামিক বিপ্লবের আলোড়নে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আন্দোলিত হচ্ছিল। প্রথমেই আমরা দেখি, বিমানবন্দরে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিসারদের কড়া নজরদারি এবং দুর্ব্যবহার লেখককে খুবই আশাহত করছে। সময়টা ছিল ভিন্ন দিক থেকে কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত। খোমেনি-পরিচালিত ইসলামিক বিপ্লব-পূর্ববর্তী সরকারের সব নীতি ও জীবনবোধকে হটিয়ে দিয়ে তখন থেকে ইসলামি মূল্যবোধ এবং অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সমাজজীবনে চাপিয়ে দেওয়া শাহের আধুনিকতা, শিক্ষাব্যবস্থা, জীবনসাধনা ও সাংস্কৃতিক বোধ তখন ভেঙে পড়ছে। এই ভেঙে পড়ার কারণও ছিল। শাহ-প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় ধর্ম ও সমাজের মূল্যবোধ উপেক্ষিত হওয়ায় মানুষের রুচিকে আহত করছিল। মানুষের আশা ও আকাক্সক্ষায় এক দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ায় অগণিত মানুষ খোমেনি-পরিচালিত ইসলামিক বিপ্লবকে হৃদয় ও মন দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। লেখক এই বিপ্লবের মর্ম উপলব্ধির আকাক্সক্ষা থেকে ইরানে গিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থায় নিমজ্জন হয়েছিল লেখকের। সেজন্যে ইরানের পরিবর্তনপ্রয়াসী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লব জানার জন্য, বিপ্লবের অন্তর্নিহিত আবেদন উপলব্ধির জন্য তাঁর মধ্যে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এ-বিপ্লবের মর্মবাণী এবং সাধারণ মানুষ কেন এ-বিপ্লব সমর্থন করেছিল, তা উপলব্ধির প্রয়াস

তাঁকে চাকরি নিয়ে ইরানে যাওয়ায় আগ্রহী করে তোলে। নানাদিক থেকে তিনি এ-বিপ্লবের চেতনাকে পর্যবেক্ষণ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। লেখকের সুবিধা ছিল, তিনি পেশায় চিকিৎসক; এই পেশা মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দেয়। লেখক এ-সুযোগ গ্রহণ করে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব-উত্তর জীবনধারা ও চেতনাবোধ উপলব্ধি করতে প্রয়াসী হয়েছেন। নানা অনুপুঙ্খ ঘটনার মধ্য দিয়েও মানুষের হৃদয়যন্ত্রণার নানাদিক উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন লেখক। অন্যদিকে ইরাকের সঙ্গে এক অনমনীয় যুদ্ধে ইরানের সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজের বিন্যাস বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে তখন। যুবক ও পরিণতবয়স্ক শতসহস্র মানুষ ফ্রন্টে প্রতিদিন মারা পড়ছে। বৃহৎ শহরে প্রায় প্রতিদিন বিমান হামলার সংকেত শুনে মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিচ্ছে। এই যুদ্ধে লাখ লাখ যুবকের মৃত্যুতে ইরান প্রায় যুবকশূন্য হয়ে পড়েছে। স্ত্রী, মা ও বোনেরা যুদ্ধরতদের কল্যাণকামনায় প্রার্থনা এবং আহাজারি করছেন। এই যুদ্ধে নিত্যদিন মৃত্যু ছিল অনিবার্য। এই মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেননি তাঁরা। যুদ্ধকে ঘৃণা করেছে জনগণ। ফ্রন্ট থেকে যখন সজ্জিত কফিন আসত, তাঁদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। যুদ্ধজনিত কারণে অর্থনীতিও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। হুমায়ূন কবির এ-গ্রন্থে সেই সময়টিকে, ইরান-ইরাক যুদ্ধকালকে, অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

এ-সময়ে চিকিৎসক হিসেবে কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে ইরানি এক শিক্ষিত তরুণী আনুশেহর প্রেম-ছোঁয়া সখ্য হয়েছিল। বইটিতে তার বিবরণ রয়েছে। সেই মেয়েটির জীবনদৃষ্টি, নানা বিষয়ে উদার আধুনিক বোধ উজ্জীবিত করেছিল হুমায়ূনকে। তাঁকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন এ-নারী। এ-নারীর কথা পাঠ করতে করতে মনে হয়, হুমায়ূনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্য বোধকরি এক পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, প্রথার শাসন এবং পর্দাপ্রথা সত্ত্বেও আধুনিক এ-নারী লেখকের হৃদয় ও মন জুড়েই ছিলেন। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গি, মানবিক বোধ, উদার জীবনদৃষ্টি ইরানি শিক্ষিত নারীদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ পালটে দেয়। ভিনদেশি চিকিৎসকের সঙ্গে সখ্য ও তাঁকে সাহায্য করার জন্য সবসময় মেয়েটির ব্যস্ততা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই মেয়েটি আধুনিকা, তিনি নানা জনের সঙ্গে লেখকের পরিচয় করিয়ে দেন ও বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে এই নারীর প্রেমিক, ইরানি এক যুবক, দেশপ্রেমে দীপিত হয়ে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছিল, তখন তাঁর কষ্ট, মর্মযাতনা আমাদের মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। মেয়েটি জানেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কেউ ফেরেন না। তাঁর এই চেতনা ও উপলব্ধি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই নারীর পরিবারের সঙ্গে নৈকট্যও আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। মেয়েটির পিতা ইরানে খোমেনি-পরিচালিত ইসলামি বিপ্লবের শুধু সমর্থক ছিলেন না, তিনি দলের উচ্চপদস্থ নেতাও ছিলেন। হুমায়ূন কবিরের বর্ণনায় পাই, পাশ্চাত্যে দীক্ষিত এই মানুষটি কেন খোমেনি-পরিচালিত বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, সে-কথা বলছেন।  ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের অন্বিষ্ট ছিল হাজার বছরের সংস্কৃতি ও জীবনধারায় উজ্জীবন। সেখানে ধর্মবোধ প্রধান বিষয় হয়ে পড়েছিল। ইসলামি বিপ্লবের সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, শাহ ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সংস্কৃতির মর্মকে ভূলুণ্ঠিত শুধু করেননি, চাপানো আধুনিকতা দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধকে বিনষ্ট করেছেন। সেজন্যেই সমগ্র ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ডাকে সাধারণ মানুষ অনুকূল সাড়া দিয়েছিল। বইটিতে আছে ইরানের নিসর্গ-বৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ ও মানুষের নিসর্গপ্রীতির কথা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের কথাও লেখকের জবানিতে উঠে এসেছে।

তাঁর লেখনীতে পাই – ‘রোগীদের বেশিরভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। চেহারায় আর পোশাক-আশাকে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। এরা গাধায় চড়ে পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসে। এদের বাড়িতে পানি নেই। দূরের ঝরনা থেকে কিংবা নিচের নদী থেকে পানি আনতে হয়। তাই কাপড়চোপড় বেশ মলিন থাকে। খুব সরল মানুষ এরা। বাইরের দুনিয়া সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই নেই। আমি ফার্সি জানি না শুনে অবাক হয়।’

তাঁর একটি বিবরণ মনকে বিষাদগ্রস্ত করে। হুমায়ূনের বিবরণে আছে, ইসলামি বিপ্লববিরোধী ভূমিকা গ্রহণের কারণে দুজনের প্রকাশ্যে ও উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি হয়। এ-ফাঁসির সমর্থনে প্রচুর জনসমাগম হয়। জনগণের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অনুকম্পা তিনি লক্ষ করেননি। বরং তাদের মধ্যে এক চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখা দেয়। জনগণ ওই দুজনের কৃতকর্মের জন্য তাদের ফাঁসিকে সমর্থন করে।

আনুশেহ ছাড়াও ইরানি কয়েকটি পরিবার, যুবকদের দেশাত্মচেতনা ও ধর্মের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এ-গ্রন্থে। আনুশেহের এক বান্ধবীর প্রসঙ্গে লেখক যখন হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দেন, তখন তা পাঠকের হৃদয়কেও স্পর্শ করে। লেখক জানতে পারেন, যুদ্ধে বাবা-ভাইকে হারিয়ে একটি নারী (মোশতারি) তাঁর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন এবং স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন। তাঁকে সুস্থ করার জন্য যে-চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তাতে লেখক সত্যিকার অর্থেই কষ্ট পান। তাঁর বিবরণে জানা যায় –

ভীষণ হোঁচট খেলাম। ইসিটি দেখেছি মাত্র গোটা কয়েক, তাও দর্শক হিসেবে। বিশদ ধারণা নেই মোটেও। দেখেছি অ্যানেস্থেসিয়ার পর টেবিলে বেঁধে ফেলা হয় শরীর। মাথায় ইলেকট্রোড লাগিয়ে ওতে বিদ্যুৎ চালান দেয়া হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সমস্ত শরীর প্রচ- খিঁচুনি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে মুহুর্মুহু। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। এরপর নিস্তেজ হয়ে যায় আবার। এনেস্থেসিয়ার কারণে রোগী কিচ্ছুই টের পায় না। কিন্তু অসহ্য কষ্টকর এই দৃশ্যটা আমার মনে গেঁথে আছে দুঃস্বপ্নের মতো। মোশতারির চেহারার সাথে দৃশ্যটা মিলিয়ে হাহাকার করে উঠছে মন থেকে থেকে। এখন এই স্মৃতিলুপ্তির কথা শুনে হাঁ হয়ে গেলাম।

– হ্যাঁ, এমন পারে। কিন্তু নতুন করে চেনা। আগের বন্ধুত্ব আর সখ্যের কোনো স্মৃতি নেই মনে। গোড়া থেকে শুরু করা আবার। মোশতারির মা সারাক্ষণ কোরান পড়েন আর কাঁদেন। চিন্তা করেছ এই মায়ের বেদনাটার কথা! স্বামী আর ছেলে মারা গেল পরপর। এখন একমাত্র মেয়েটার এই অবস্থা। আমার মনে ঘৃণা জন্মাচ্ছে, আগায়ে দকতর, যুদ্ধকে ঘৃণা করি, ন্যায়যুদ্ধ হলেও আমি একে ঘৃণা করি। ঘৃণা করি।

যুদ্ধে মৃতদের স্মরণে জুমার নামাজের পর কবরস্থানে গিয়ে নারীরা কোরান পাঠ করেন। বোরখার আড়ালেও তাঁদের অশ্রুসজল চোখ দেখা যায়। বোরখা ভিজে যায় অশ্রুর ধারায়।

ঐতিহ্যবাহী নওরোজ বা নববর্ষ উৎসবের বিবরণ আছে একটি অধ্যায়ে। মর্মের দিক থেকে এ-উৎসব যে ইসলামিক মূল্যবোধে পুষ্ট, তা বলা যাবে না, তবে দীর্ঘদিনের

সাংস্কৃতিক ধারায় যে পুষ্ট, তা লেখকের  জবানিতে উঠে এসেছে। এ-উৎসব ঐতিহ্যকে এতটুকু প্রত্যাখ্যান করেনি বা মøান হয়নি ইসলামিক নীতিবোধের নামে।

পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য, টিউলিপ ফুল ও দিগন্তবিস্তৃত এই ফুলের সমারোহের বিবরণ আমাদের মনকে প্রশান্ত করে। টিউলিপ যে ইরানের ফুল এবং এ-ফুলকে ঘিরে তাঁদের গর্বের যে অন্ত নেই তা উল্লিখিত হয়েছে হুমায়ূনের লেখনীতে। অন্যদিকে যখন দেখি তাঁর বর্ণনায়, যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে লাশ হয়ে ফিরে আসে অগণিত যুবকের মৃতদেহ, তখন নারীদের বেদনা, কষ্ট, মর্মযাতনা ও আহাজারি সত্যিকার অর্থেই মনকে বিষণœ করে তোলে। যুদ্ধ যে মানবসভ্যতার জন্য কত বড় অভিশাপ, সে-বোধও হৃদয়কে আর্দ্র করে। তিনি চিকিৎসক হিসেবে ইরানের প্রত্যন্ত, অবহেলিত ও অনগ্রসর অঞ্চলে গেছেন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্যে। সেখানেও সাধারণ নারীদের অপার

সৌন্দর্য, উচ্ছলতা ও সারল্য তাঁকে মুগ্ধ করেছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের নিরাভরণ জীবন লেখকের চোখ এড়ায়নি।

এক একটি বই তখনই আমাদের ভালো লাগে, যখন দেখি বইটির অন্তর্নিহিত চেতনার ভেতর মানবিক সম্পর্ক ও মানবিক দিকের উন্মোচন নবমাত্রা অর্জন করেছে। হুমায়ূন কবির-লিখিত এ-বই তেমনি একটি বই, যা মানবিক সম্পর্কের সুতোগুলো নিয়ে জীবনকে নবমাত্রায় উন্মোচিত করেছে। যেখানে মানুষ এবং মানবিক বোধই মুখ্য।

বইটি পাঠ করতে করতে মনে হয় – এ কি উপন্যাস? না ভ্রমণকাহিনি? বোধকরি এ দুইয়ের মিশ্রণে তিনি এমন এক গ্রন্থ  রচনা করেছেন, যা নতুন প্রকরণ না হলেও এ-রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আশ্চর্য এক সিদ্ধি লাভ করেছেন। মনে পড়ে যায়, সতীনাথ ভাদুরীর সত্যি ভ্রমণকাহিনীর এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে গ্রন্থটির প্রসঙ্গ। অনেক চরিত্র ও মানুষের আনাগোনা আছে গ্রন্থে। আছে স্বদেশীয় কয়েকটি চরিত্র ও তাদের জীবনযুদ্ধ ও স্বপ্নেরও প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের স্বদেশীয়রাও ভাগ্য-অন্বেষণে ইরানে গিয়ে কীভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন সে-প্রসঙ্গও ঘুরেফিরে এসেছে। গ্রন্থে লেখকের ভাষা অতিশয় প্রসাদগুণসম্পন্ন; ঝরঝরে। যে-কোনো পাঠক শুরু করলে গ্রন্থটি পাঠ শেষ না করে পারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। পাঠক, আমি আপনাদের বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করব। একই সঙ্গে আমি বইটির বহুল প্রচার আশা করি।