রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রূপকার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০) তাঁর প্রজন্মের অন্যদের মতোই রাজনীতি-সচেতন না হয়ে পারেননি। তবে ঘরে রাজনীতিতে অংশী পিতা, বাইরে স্বদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন, আবার একই সঙ্গে সময়ে-অসময়ে রবীন্দ্রনাথের মতো এক জ্বলজ্বলে সূর্যের সরাসরি সংস্রব ও প্রভাব তাঁকে এমন এক বৈশিষ্ট্য দেয়, যা ছিল অন্যদের মধ্যে বিরল। ওই প্রজন্মের সন্তানদের বয়স কুড়ি পেরোনোর আগেই ঘটে রুশ বিপ্লব, যা দুনিয়াজুড়ে ঢেউ তোলে। বিশ শতকের ওই দুনিয়া-কাঁপানো মাথা-ঘোরানো ঘটনার মাহাত্ম্য এমনই যে, বিপ্লবের এই শতবর্ষে ও পরিপূর্ণ মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরেও তা এখনো আলোচনা ও বিবেচনায় অমলিন।
এক প্রতারক ধ্রুপদী ভিত্তিতে দাঁড়ানো মনেপ্রাণে রোমান্টিক কবি সুধীন দত্ত পারেননি এর ধাক্কা থেকে দূরে থাকতে। রুশ বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত সমাজ নিয়ে অনেক কথাই তাঁর ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে লেখা গদ্য-প্রবন্ধে এসেছে; আর বয়স যখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই বা তার বেশি, তখন যেসব বড় কবিতা লেখেন, তাতে রাজনীতির কথা বা ইঙ্গিত আসা শুরু হয় নিরুপদ্রবে। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে স্মর্তব্য তাঁর ১৬৬ পঙ্ক্তির ছয় অনুচ্ছেদের মহাকবিতা ‘সংবর্ত’। এর শেষ অনুচ্ছেদের শেষ কথাগুলো সুধীন দত্ত লিখেছেন এভাবে :
অন্তর্হিত আজ অন্তর্যামী :
রুষের রহসে লুপ্ত লেনিনের মামি,
হাতুড়িনিষ্পিষ্ট ট্রটস্কি, হিটলারের সুহৃদ স্টালিন,
মৃত স্পেন, ম্রিয়মাণ চীন,
কবন্ধ ফরাসীদেশ। সে এখনও বেঁচে আছে
কি না,
তা সুদ্ধ জানি না ।।
কবিতাটি তিনি শেষ করেন ১৯৪০-এর ৬ সেপ্টেম্বর। এর মাত্র ষোলো দিন আগে সুদূর মেক্সিকোতে নির্বাসনে গুপ্তঘাতকের হাতুড়ির আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অন্যতম প্রধান রূপকার ট্রটস্কি। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে ট্রটস্কি জানান, হয় হিটলার নতুবা স্টালিনের চরেরা এই আক্রমণ করে থাকতে পারে। এর বছরখানেক আগে ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট মস্কোতে স্বাক্ষরিত হয়েছে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি, যা বিস্ময়করভাবে নাৎসি হিটলার আর কমিউনিস্ট স্টালিনকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। ওই সময়টা ছিল অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এক মহা-উত্তাপের সময়। চুক্তিটি ঠিকভাবে যাতে সই হয়, সেজন্য স্বাক্ষরের কয়েক মাস আগে সোভিয়েতরা তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পাশ্চাত্য-ঘেঁষা ম্যাক্সিম লিতভিনভকে সরিয়ে সেখানে শক্ত আলাপী ভিয়াচেস্লাভ মলোটভকে বসান : তিনিই মস্কোতে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিম ফন রিবেনট্রপের সঙ্গে শর্তাদি নিয়ে দরকষাকষি করে চুক্তিটি চূড়ান্ত করেন। একটা গোপন অংশও ছিল চুক্তিটির মধ্যে, এমন ধারণা করা হয়।
ধারণা করা হয়, ওই অনাক্রমণ চুক্তির গোপন অংশ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানি পশ্চিম পোল্যান্ড দখল করে নেয়; অস্ত্র শানাতে শুরু করে আরো অগ্রসর হওয়ার ভবিষ্যৎ-স্বপ্নে। সোভিয়েত সেনারা পূর্ব পোল্যান্ডের পুরোটাই নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে নেয়। স্পেন-চীনের অবস্থা আরো খারাপ; ফরাসিরা লন্ডনে প্রবাসী সরকার গঠন করেছে। কিন্তু শেষ লাইনটিই কবিতার মূল বিষয় : এতকিছুর পরও এবং এসবের মধ্যেও কবির এই হাহাকার : ‘সে এখনও বেঁচে আছে কি না’,/ তা সুদ্ধ জানি না ।।’
ওপরের শেষ পঙক্তিগুলো থেকে ধারণা যা হোক, বাংলা ভাষার মহাকবির এই কবিতা তো রাজনীতির কবিতা নয়। সুধীন দত্ত তো, ধ্রুপদী কাঠামোর পরও, রক্তে-মজ্জায় এক পরম রোমান্টিক কবি এবং কবিতাটি মূলত বাংলাভাষীদের বর্ষাভিত্তিক কাব্যসম্ভারে এক অভিনব সংযোজন। এই ‘মহাকাব্যে’র ভেতরে বর্ষা মিশে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম পঙক্তি যেমন শুরু হয়েছে ‘এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে’ দিয়ে, তেমনি পরের অনুচ্ছেদগুলোতেও আসছে – ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে ভুলি সে-সকলই’ অথবা ‘বরঞ্চ বৃষ্টির দিনে স্তব্ধশোকে’ কিংবা ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে’ প্রভৃতি কথা। ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে’ কথাটি এই কবিতায় দুবার এসেছে : সুধীন দত্তে এটা খুব একটা সহজলভ্য নয়। ‘অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে’ কথাটি তাৎপর্যময়। জেমস জয়েসের স্ট্রিম অব কনশাসনেস কি মনে পড়বে?
‘সংবর্ত’ বর্ষা নিয়ে লেখা তাঁর আরেক মহান কবিতা অর্কেস্ট্রা কাব্যভুক্ত ‘শাশ্বতী’র মতোই। ‘শাশ্বতী’তে আছে ‘শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে’ আর ‘একদা এমনই বাদলশেষের রাতে’। আর নায়িকা তো অবশ্যই বিদেশিনী কেউ – ‘সেদিনও এমন ফসলবিলাসী হাওয়া/ মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে’; অথবা, ‘স্বপ্নালু নিশা নীল তাঁরি আঁখিসম’। অর্কেস্ট্রা কাব্যের নাম-কবিতায়ও আছে ‘ওই মত্ত মেঘের মাদলে’ বা, ‘আজি সহসা অকাল বাদলে’ : ‘অকাল’ কথাটি এজন্যেই যে, এটি লেখা ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অসময়ে বৃষ্টি নামছে। আর নায়িকাও সেই ইউরোপীয় বা পশ্চিমি কেউ : ‘ক্ষৌম কেশ’, আছে ‘কুন্তলে তব শরৎ সাঁঝের ঋদ্ধি,/ পাকা দ্রাক্ষার মদির কান্তি অঙ্গে’, অথবা ‘স্বর্ণভারে তোমার মাথা লুটিছে মম ঊরুতে/ নিবিড় নীল নয়ন-কোণে সজল স্মৃতি অঙ্কিত’। আর ‘সংবর্তে’ পাই :
…তার বভ্রু কেশে অস্তগত সবিতার উত্তরাধিকার, সংহত শরীরে
দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি, নীলাঞ্জন চোখের গভীরে
তাচ্ছিল্যের দামিনীবিলাস;
নারীর দেহ-বর্ণনায় ‘সংহত শরীর’ আর কবে কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে? এ কি সেই বিদেশিনী, যাকে তিনি সম্ভবত যৌবনে জার্মানিতে দেখেছিলেন এবং কখনো ভুলতে পারেননি; প্রথম দিককার কবিতায় যেমন তিনি আছেন, তেমনি এই পরিণত বয়সেও তাকে ভোলা যাচ্ছে না। তার চুল সোনালি, নীল চোখ। বভ্রু কেশে ‘অস্তগত সবিতার উত্তরাধিকার’। এ-ধরনের ছবি তৈরি বাংলা ভাষায় বিরল। সুধীন দত্তের কোথাও কি অন্ধকার কেশ বা কালো চোখ আছে?
‘সংবর্ত’ কবিতাটি রাজনীতির কবিতা নয়, প্রেমের কবিতা। সীমিত পরিসরে এক মহাকাব্য। চল্লিশের ওই সময়ের পৃথিবী, তাঁর স্বদেশ, তাঁর প্রিয় শহর কলকাতা, এমনকি ‘বন্ধকীর নিলামে বিক্রয়/ মারোয়ারীদের গ্রাসে তুলে দেয় বাঙালীর দায়।’ এসব কথাসহ অনেক কিছুই আছে এই কবিতায়। আর একটা বিশ্বজনীন ক্যানভাসে প্রেয়সীর (হয়তো একসময়ের প্রেয়সী) স্মরণ। বিশিষ্ট লেখক অমিয় দেব এই কবিতায় ঈশোপনিষদকে প্রত্যক্ষ করেন।
গত শতকের বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হয়ে আমেরিকা ভ্রমণের পর কিছু কাল ইউরোপে ছিলেন সুধীন দত্ত। তিনি কি তখন কোনো দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি নীল নয়নার তাচ্ছিল্যভরা চাহনির মুখোমুখি হয়েছিলেন? অমিয় দেব সুনিশ্চিত, এমন কিছু ঘটেছিল। অন্য সুধীন্দ্রবিদেরাও বিষয়টির সত্যায়ন করেন। তবে একবার যে ‘হাইল হিটলার’ না বলাতে নাৎসি যুবকরা তাঁর ওপর চড়াও হলে তিনি এই অকাট্য যুক্তি দিয়ে তাদেরকে নিবৃত্ত করেছিলেন যে, তিনিই তো আদি আর্য; তাঁর জন্য এটা দরকার নেই, এ-তথ্য দিচ্ছেন সুধীন দত্তের ইংরেজি লেখার অন্যতম সম্পাদক এডওয়ার্ড শিলস।
কবিতার শেষে যার চিন্তায় কবি উদ্বিগ্ন, সে কি ওই ইউরোপেই দেখা সেই ‘অস্তগামী সবিতার উত্তরাধিকার’ যার ‘বভ্রু কেশে’ সেই মানবী সত্তা। কবিতার মূলকথা একেবারে শেষে – যুদ্ধরত ইউরোপে ‘সে এখনও বেঁচে আছে কি না,/ তা সুদ্ধ জানি না ।।’ এই তাকেই প্রথম লাইনে শুরুতে যাকে বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে, সে-ই। মূল কবিতা লেখার কয়েক মাস পরে সুধীন দত্ত নিজেই কবিতাটির ‘সাইক্লোন’ নামে ইংরেজি অনুবাদ করেন। তার শেষ লাইন দুটি এমন : ‘Alas I have no means of finding out/ If she is still alive or bombed to dust’। ওই ইংরেজি অনুবাদে স্টালিনের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে ‘triumphant Stalin’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে; মূল বাংলায় আছে শুধুই ‘স্টালিন’। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্টির অন্তর্কলহে (‘ইনার পার্টি স্ট্রাগল’) ও তাঁর বিরোধীদের বিরুদ্ধে আনা মস্কোর সব মামলায় স্টালিনের বিজয়েরই কথা বলা হয়েছে ইংরেজি ভাষ্যে। ইংরেজি কবিতায় ট্রটস্কির নামের আগেও একটি বিশেষণ ব্যবহার করে লেখা হয়েছে ‘undaunted Trotsky’। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত হওয়া থেকে শুরু করে তুরস্ক, ফ্রান্স, নরওয়ে হয়ে মেক্সিকোতে শেষ আশ্রয় পাওয়া পর্যন্ত ট্রটস্কি যেসব নরকতুল্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন, তা মহাভারত লেখার উপকরণই জোগান দেয়। এরপরও তিনি ‘ফোর্থ ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিষ্ঠা করেন, এর মেনিফেস্টো লেখেন : আর দিন চালাতেন লেখা হতে যে-আয় হতো তা দিয়ে। শক্তিশালী সোভিয়েত রাষ্ট্র, তার সম্পদ, সামরিক বাহিনী, কূটনীতিক বহর, গোয়েন্দা-সমাবেশ, পত্রপত্রিকা-বেতার – এসবের বিরুদ্ধে ট্রটস্কির অবস্থান নিশ্চয়ই ছিল নিত্য-পরাজয়মুখীন। তবু তিনি হার মানেননি। অদম্যই বটে। স্বপ্ন উঁচুতে রেখেছেন, এমনই উঁচুতে যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, ভবিষ্যতের কমিউনিস্ট সমাজে সাধারণ মানুষই হবে অ্যারিস্টটল, গ্যেটে আর মার্কসের সমান, আর সে-সমাজের মহামানবেরা হবেন আরো অতিকায় বড়মাপের (তাঁর সাহিত্য ও বিপ্লব বইটির শেষ বাক্য দ্রষ্টব্য)।
দুই
প্রায় ষাট বছরের জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ, দুটি প্রবন্ধসংগ্রহ আর মরণোত্তর প্রকাশিত ইংরেজি লেখা নিয়ে প্রকাশিত দুটি বই (একটিতে আছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, অন্যটি তাঁর পত্রপত্রিকায় লেখা, বেতার-কথিকা ও পাণ্ডুলিপির খসড়া) ও একটি বাংলা গল্পসংগ্রহ (এটিও মরণোত্তর প্রকাশিত), এই তো সুধীন দত্তের রেখে-যাওয়া সম্পদ। এর বাইরেও কিছু অগ্রন্থিত অনুবাদ ও লেখা রয়েছে তাঁর। তাঁর লেখার ধরনই ছিল ধীরগতির, যা দেখে একবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘অতো আসেত্ম লিখলে লেখা বন্ধ হয়ে যাবে।’ কিন্তু এ-সত্ত্বেও সুধীন দত্ত মূলত লেখক বা কবি এবং সাহিত্যচর্চায় বিঘ্ন হচ্ছে সেজন্য বছরচারেকের করা স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলেন, যেমনটা করেছিলেন অন্য সময়ে বুদ্ধদেব বসু।
মূলত রোমান্টিক কবিতার লেখক সুধীন দত্ত কতটা রাজনৈতিক ছিলেন বা আদৌ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন কি-না, এ-প্রসঙ্গে বিষয়টি উঠে আসতে পারে। পিতার কারণে বা রুশ বিপ্লব বা ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর সঙ্গে সংস্রবেই হোক বা অন্য কোনো হেতুতে, তিনি ছিলেন এক রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিত্ব। চল্লিশ পেরোনোর পরে এসেছিলেন বিপ্লবী থেকে মানবতাবাদীতে রূপান্তরিত এমএন রায়ের সংস্রবে। দুজনে মিলে বের করেন দি মার্কসিয়ান ওয়ে, যাতে সুধীন দত্তের লেখার মূল প্রতিপাদ্য ছিল উদারনীতির স্তুতি। আর যে পরিচয় পত্রিকার তাঁরই হাত ধরে যাত্রা শুরু, তাও তিনি ছেড়ে দেন কমিউনিস্টদের হাতে। একটা লেখায় পড়েছি (নিরঞ্জন হালদার, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়’, পরিচয়, সুধীন্দ্রনাথ শতবর্ষ সংখ্যা), এমএন রায়ের সঙ্গে পরিচিতি ও পত্রিকা বের হওয়ার পরে সুধীন দত্ত পরিচয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। সুধীন দত্তের আরেক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব লেখক ও চিন্তাবিদ শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন, হাজারটা সম্পর্ক থাকার পরও সুধীন দত্ত এমএন রায়ের আদর্শ বা মতামত কোনোটিই গ্রহণ করেননি।
অন্যদিকে বিশিষ্ট লেখক, শিক্ষাবিদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুধীন দত্তের সরাসরি ছাত্র অমিয় দেবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুধীন দত্তের অসমাপ্ত ইংরেজি আত্মজীবনী নিয়ে লিখতে গিয়ে অমিয় দেব জানাচ্ছেন, ‘যৌবনে মার্কসবাদের সন্নিকটে এসে একবার বোধ করি প্রয়াস করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি মার্কসবাদী হয়ে উঠতে পারেননি। মার্কস নিয়ে সারাজীবন যত কথা বলেছেন আর কোনো দর্শন নিয়ে বলেননি।’ (অমিয় দেব, দুই তিরিশে অক্টোবর-নভেম্বর)। পারেননি এক কথা; হয়তো তাঁর সে-সংকল্পও ছিল না।
সুধীন দত্তের ইংরেজি আত্মজীবনীর সম্পাদক এডওয়ার্ড শিলস জানিয়েছেন, যৌবনে তাঁর দেশের সমবয়সীদের অন্যদের মতো সুধীন দত্তও রুশ বিপ্লবের দিকে আকৃষ্ট হন। এই নতুন বিপ্লবের কিছুটা তাঁর নিজ অনগ্রসর দেশে প্রয়োগ করা যায় কি-না, এমন একটা চিন্তা তাঁর ছিল। আমার বিশ্বাস, অন্যকিছুর সঙ্গে সেই আকর্ষণের একটা হেতু ছিলেন উঁচুমানের বুদ্ধিজীবী ট্রটস্কি আর বলশেভিকদের নেতা লেনিন। বিপ্লবের মূল নেতা লেনিন যতদিন জীবিত ছিলেন, ট্রটস্কিও ছিলেন উচ্চাসনে। পশ্চিমা দুনিয়ায় সোভিয়েত সরকারের একটা বিকল্প নাম ছিল লেনিন-ট্রটস্কি সরকার। লেনিনের মৃত্যুর পর ট্রটস্কির অবস্থানের দ্রুত পতন হতে শুরু করে; আর পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই বিতাড়িত হন। এসব আকর্ষণ সত্ত্বেও মার্কসবাদ বা জাতীয়তাবাদ কোনোটাই সুধীন দত্তকে তত্ত্বগত দিক দিয়ে কাছে টানেনি। তিনি ধরেছিলেন উদারনীতির পথ। এজন্য অনেকেই, পরিচয় গোষ্ঠীভুক্ত কট্টর কমিউনিস্টরা বা বাইরের জাতীয়তাবাদীরা, তাঁকে ভুল বুঝেছেন।
অমিয় দেব আরো মনে করেন, সুধীন দত্তের গদ্যের যে বিশিষ্ট ভঙ্গি, তা তাঁর উদারনৈতিক মনোভাব প্রকাশেরই যথাযথ বহিঃপ্রকাশের প্রয়োজনে তৈরি; কোনো বক্তব্য বা সম্ভাবনাকেই বাদ রাখা যাবে না, এ-থেকেই ওই রীতির উদ্ভব। ‘প্রত্যেক প্রস্তাবেরই এক প্রতি-প্রস্তাব থাকত তাঁর কাছে।’ সুধীন দত্তের ইংরেজি লেখাও ওই একই ঢংয়ে মোড়ানো। সুধীন দত্তের ইংরেজিতে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী সংবলিত মরণোত্তর প্রকাশিত বই দি ওয়ার্ল্ড অব টোআইলাইটের সম্পাদক এডওয়ার্ড শিলসও কথাটি জানিয়েছেন অন্যভাবে : ‘তাঁর প্রকাশভঙ্গির বিরোধালঙ্কারপ্রবণ (অ্যান্টিথেটিকাল) গড়ন নিছক সাহিত্যিক কষ্টকল্পনা নয়। এসব তাঁর আত্মার গভীর থেকে উদ্গত অভিব্যক্তি, মানুষের অভিপ্রায় আর আকাঙ্ক্ষার সাথে অসমঞ্জস অস্তিত্বের ছাপযুক্ত মনেরও তা কথা।’ কলকাতার স্টেটসম্যানে সুধীন দত্তের লেখা সম্পাদকীয়গুলোর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে শিলস তাঁর ‘সযত্ন সুচিন্তিত ভারসাম্যময়’ বাক্যগঠন সম্পর্কে আরো জানিয়েছেন, এরা একদিকে যেমন তাঁর নৈতিক সততা ও নির্ভীকতার যথাযথ বাহন, অন্যদিকে মানুষী অস্তিত্বের অর্থহীনতা ও উন্মত্ততা সম্পর্কে তাঁর অন্তর্দৃষ্টিরও প্রমাণ। প্রখ্যাত লেখক ম্যালকম মাগারিজ, যিনি একসময়ে কলকাতার দি স্টেটসম্যানের সম্পাদক ছিলেন, তিনি বলেছেন, তাঁর জানা ভারতীয়দের মধ্যে সুধীন দত্ত সবচেয়ে ভালো ইংরেজি লিখতেন ও বলতেন। আর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অধ্যায়গুলোকে এডওয়ার্ড শিলস আখ্যা দিয়েছেন নীরদ চৌধুরীর ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ানে’র পর্যায়ভুক্ত ক্ল্যাসিক হিসেবে।
এ-ধরনের একজন ব্যক্তি/ মনীষী বিপুল বিশ্বপরিস্থিতি তথা সীমিত বিষয় ট্রটস্কি বা স্টালিন সম্পর্কে যা বলবেন, তা তাঁর সাহিত্য-চিন্তার মতোই গুরুভার ও অন্তর্দৃষ্টিজাত। একইসঙ্গে খেয়াল রাখতেন, কোনো বক্তব্যেই কেউ যাতে আহত না হন। এরপরও অনেকেই, এমনকি পরিচয়ের আড্ডার সুহৃদরাও দু-একজন তাঁকে ভুল বুঝেছেন। কমিউনিস্টদের অনেকে তাঁকে বিচারের চেষ্টা করেছেন একেবারে দলীয় চিকিৎসাপত্রের নিরিখে। কিন্তু দুনিয়াটা এত সহজ ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়ানো নয়। আর এখন ১৯৯১ সালের পরে, এসব কি নিতান্তই নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়নি?
সুকান্ত চৌধুরী-সম্পাদিত ও অমিয় দেবের ভূমিকা-সংবলিত সুধীন দত্তের মরণোত্তর প্রকাশিত বই দি আর্ট অব দি ইনটেলেক্টের একটা অংশ তাঁর রাজনৈতিক সব লেখা নিয়ে। অনেকগুলোই আকারে ছোট, কয়েকটি পাণ্ডুলিপির আকারে। এর একটা অবজারভেশনস অন দি রাশান সিচুয়েশন, যার শুরুর বাক্যেই রুশ বিপ্লবে ট্রটস্কির কেন্দ্রীয় অবস্থানের কথা উল্লিখিত হয়েছে। একই বইয়ের ‘কমেন্টারি অন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’ আর ‘দি ইন্টারন্যাশনাল সিচুয়েশন’ শীর্ষক লেখাদুটিতে ‘মি. স্টালিন’ সম্পর্কে উল্লেখ আছে বেশ কয়েকবার, তাঁর দক্ষতা ও বুদ্ধির ইঙ্গিতসহ। তবে সুধীন দত্ত ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন স্টালিন জীবিত নেই, খ্রুশ্চোভের কাল। ওই সময়ে কবি বিষ্ণু দে-কে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন : ‘আমার স্টালিনবিদ্বেষ বরাবর উগ্র’ (অমিয় দেব, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ২০০১, প্রকাশক : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি)।
কুলায় ও কালপুরুষের ভূমিকায় দেখা যায়, সুধীন দত্ত ‘একদা’ ভাবতেনও যে, ‘মনুষ্যধর্মের শাশ্বত সমস্যা মার্কসীয় ডায়ালেকটিক -এর সাহায্যে সমাধানসাধ্য।’ তারপর বলছেন, ‘তবে বামাচারে উদ্দেশ্য ও উপায়ের বৈপরীত্য তখনও আমাকে দুঃখ দিত; এবং বরাবরই আমার সন্দেহ ছিল যে সে-বিরোধের শেষ নেই।’ ‘বামাচার’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয় : এই সনাতন হিন্দুধর্মীয় তান্ত্রিক আচার-সংক্রান্ত শব্দটিকে এর আগে বামপন্থার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার সম্ভবত আর কেউ করেননি।
তিন
সুধীন দত্ত-প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকা পরিচয় ঘিরে সাপ্তাহিক আড্ডা ছিল সাহিত্য বাদেও সমাজ, দর্শন, রাজনীতি, চিত্রকলা, বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে সবধরনের আলোচনার কেন্দ্রস্থল। সেখানে কে না আসতেন – বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, যামিনী রায়, সাহেদ সোহরাওয়ার্দী, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হীরেন মুখার্জি, সরোজিনী নাইডু, বিদেশ থেকে আসা ম্যালকম মাগারিজ, হামফ্রে হাউস এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য। দুটি তথ্যভরা বই আছে পরিচয় পত্রিকার আড্ডা নিয়ে – পরিচয়ের আড্ডা (শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ) ও পরিচয়ের কুড়ি বছর (হিরণকুমার সান্যাল)। এই দুজন লেখক ছিলেন সুধীন দত্তের মতোই নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। বইদুটি শুধু সুধীন দত্তই নয়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটা
প্রভাবশালী অংশের চিন্তাধারার বিবর্তন ও গড়ন-সম্পর্কিত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
আবার গত শতকের ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি ভিন্ন জায়গায় সমান্তরাল আরেকটা আসরও বসত, যাতে এই পাঁচজন যোগ দিতেন – তুলসী গোস্বামী, অপূর্ব চন্দ, সাহেদ সোহরাওয়ার্দী, সুধীন দত্ত আর ম্যালকম মাগারিজ। শেষের জন ছিলেন সুধীন দত্তের একাগ্র ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী। পরিচয়ের আড্ডায় যাঁরা আসতেন তাঁদের মধ্যে যেমন নীরেন্দ্রনাথ রায় ও হীরেন মুখার্জির মতো স্টালিনপন্থীরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন তুলসী গোস্বামীর মতো ট্রটস্কিভক্তরাও (পরিচয়ের কুড়ি বছর, হিরণকুমার সান্যাল)। শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের পরিচয়ের আড্ডা বই থেকে দেখা যায়, ওই অনাক্রমণ চুক্তি নিয়ে সুধীন দত্তের তেমন আপত্তি ছিল না শুরুতে। পরিচয়ের আড্ডার ১৯৩৯ সালের ২৫ আগস্টের আলোচনায় আইসিএস রাজকর্তা মজিদ রহিমের সঙ্গে সুধীন দত্তের মৃদু বিতর্ক হয় এ নিয়ে। রহিম হিটলারকে ‘জিনিয়াস’ বলছিলেন এজন্য যে, তিনি স্টালিনকে বাগে এনে এক চুক্তি করে ফেলেছেন। সুধীন দত্ত কমিউনিস্ট না হয়েও রহিমের কথার প্রতিবাদ করে তাঁদের বক্তব্যই বললেন, ‘রাশিয়া জার্মানীর সঙ্গে রফা করেছে আত্মরক্ষার তাগিদে। পারতপক্ষে তারা কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না।’
সোভিয়েত বিপ্লবের দুই নায়ক সম্পর্কে সুধীন দত্তের শ্রদ্ধাভরা বক্তব্যের সাক্ষ্য মেলে পরিচয়ের আড্ডার ১৯৩৮-এর ২৯ জুলাইয়ের আলোচনায় : একপর্যায়ে রুশ বিপ্লব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপ্লবে অবদান সম্পর্কে কথা উঠলে হীরেন মুখার্জির কথার জের টেনে সুধীন দত্ত বলেন : ‘লেনিন-এর কথা আলাদা – তিনি ছিলেন অনন্য।… (আরেক পর্যায়ে) ট্রটস্কি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ছিলেন না – ছেলেবেলা থেকে কষ্ট করে মানুষ হন…।’ লেনিন সম্পর্কে সুধীন দত্তের উচ্চ ধারণার আরেক পরিচয় মেলে ‘ড্রাফট অন মার্কসিজম’ নামে তাঁর এক ইংরেজি লেখা থেকে (সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মরণোত্তর প্রকাশিত বই দি আর্ট অফ দি ইনটেলেক্টে অন্তর্ভুক্ত) : সেখানে অক্টোবর বিপ্লবের নায়ককে এই বলে প্রশংসা করেছেন যে, তিনি সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে অনুগামীদের কার্যসিদ্ধির জন্য ডাক দিতে পেরেছিলেন।
স্টালিনের দক্ষতা সম্পর্কেও সুধীন দত্তের স্পষ্ট ধারণা ছিল : একই বছরের শুরুতে ২১ জানুয়ারির আলোচনায় এ. কে. ফজলুল হক-শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি-সংক্রান্ত কথা উঠলে সুধীন দত্ত বলেন : ‘স্টালিনের মতো মানুষ কপট চূড়ামণি হয়েও কাজের ক্ষেত্রে দক্ষ, কিন্তু আমাদের হক সাহেবের ত কর্মক্ষমতাও নেই।’ উল্লেখ্য, সুধীন দত্তও নিজেকে ‘কপট বিনয়ী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন কুলায় ও কালপুরুষ গদ্যগ্রন্থের মুখবন্ধে।
কিন্তু ট্রটস্কির ‘হাতুড়িনিষ্পিষ্ট’ হওয়া সুধীন দত্তের চিমত্মাভাবনার অনেক কিছু পালটে দেয়। এই হত্যাকাণ্ড তাঁকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে। এক বছর আগে যিনি মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তিকে খুব একটা সমালোচনা করেননি বা গ্রহণই করেছিলেন; কমিউনিস্টদের লাইনেই কথা বলেছেন, কিন্তু ট্রটস্কির ওই হত্যাকাণ্ডের পরই তিনি স্টালিনকে ‘হিটলারের সুহৃদ’ আখ্যা দিয়ে ‘সংবর্ত’ কবিতাটি শেষ করেন ঘটনার সতেরো দিন পরে। যদি কবিতাটি ২২ জুন ১৯৪১ তারিখের পরে অর্থাৎ জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার পর লিখতেন, ‘হিটলারের সুহৃদ স্টালিন’ কথাটি কি সেখানে আসত?
প্রবন্ধের বই স্বগততে অন্তর্ভুক্ত ‘মাকসিম গোর্কি’ লেখাটি ১৯৩৭ সালে রুশ লেখকের মৃত্যুর এক বছর পরে লেখা। গোর্কিকে তিনি ‘হিংসাব্রত বলশেভিকদের সমপাঙক্তেয় ভাবা’ অসাধ্য মনে করেছিলেন। ওই লেখায় আরো লিখেছেন, গোর্কি ‘বিজয়ী বিপ্লবের শৃগালী ঐকতানে সুর মেলাতে পারেননি’। আবার একই সঙ্গে এ-ও বলছেন যে, ‘বর্তমান বিধি-ব্যবস্থা গোর্কির সামনে কেবল ফুলই ছড়িয়েছে।’
একইভাবে কুলায় ও কালপুরুষ গ্রন্থভুক্ত ‘বিজ্ঞানের আদর্শ’ প্রবন্ধটিও লেখা ১৯৩৭ সালে : বিজ্ঞানী ইভান পাভলোভকে নিয়ে, পাভলোভের মৃত্যুর পরের বছরে। এখানেও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, ‘পাভলোভের মন যুগিয়ে চলে বোলশেভিক দলপতিরা অসামান্য বিজ্ঞানভক্তির দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন’, তেমনি ওই দলপতিদের ‘নরবলি তাঁর মুখে ফোটাত দুরুক্তি’। ওই দলপতিদের মধ্যে তো স্টালিন সর্বাগ্রে।
পরিচয়ের আড্ডার আরেক আলোচনায় (১৯৪০-এর ১৫ নভেম্বর) সুধীন দত্ত অপূর্ব চন্দকে বলছেন : ‘নাৎসি বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো নজির মানুষের ইতিহাস থেকে দেখাতে পারবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যারা দেশকে গড়ে তুলেছে তাদের বড় অংশকে ভালোমন্দ নির্বিচারে ঝেঁটিয়ে বার করে দেবার মত নিষ্ঠুরতা কী হতে পারে – অপরাধের মধ্যে ওরা হচ্ছে ইহুদি- সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীদের সব কিছু কেড়ে কুড়ে নিয়ে একেবারে নিঃস্ব করে তাড়িয়ে ছেড়েছে… আমার সঙ্গে চল এই সহরেই ডক্টর-এর কাছে নিয়ে যাচ্ছি – নির্বিরোধী পণ্ডিত মানুষ, রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় নি – একমাত্র বিলাস ছিল ছবি কেনা। দশখানা ছবিই কেড়ে নিয়ে বিদায় করেছে – এর চেয়ে বর্বরতা কোথায় ঘটেছে।’
অমিয় দেবের লেখায় আছে সুধীন দত্ত ট্রটস্কির প্রতি নমনীয় ছিলেন। অমিয় দেব লিখেছেন : ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর মার্কসবাদী বন্ধুদের সঙ্গে তিনটি বিষয়ে তাঁর দ্বিমত থেকে যায়, সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি, সোভিয়েতের ফিনল্যান্ড আক্রমণ ও ট্রটস্কি-হত্যা।’ (‘সুধীন্দ্রনাথের ব্যক্তিসত্তা’, পরিচয়, সুধীন্দ্রনাথ শতবর্ষ সংখ্যা ২০০১; পরে তাঁর দুই তিরিশে অক্টোবর-নভেম্বর বইতে অন্তর্ভুক্ত)।
ওপরে বর্ণিত ‘সংবর্ত’ কবিতায় আরেক জায়গায় পাই :
এবং উদ্বাস্ত্ত ট্রটস্কি ইতিমধ্যে দেশে
দেশান্তরে
ঘুরে মরেছিল, পুরাকালীন শহরে
গলঘন্ট কুষ্ঠরোগী, যত দ্বার সব বন্ধ
দেখে,
যেমন নির্জনে যেত ভিক্ষা ব্যতিরেকে।
যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গেই সুধীন দত্ত সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান। তাঁর বয়স বিবেচনায় তাঁকে সেখানে না নিয়ে এয়ার রেইড প্রোটেকশনে জোটে তাঁর কাজ। উপমহাদেশের বামপন্থীরা যখন স্থির করতেই পারেননি হিটলারের জার্মানি সম্পর্কে কী অবস্থান নেবেন, তার অনেক আগেই সুধীন দত্ত সামরিক বাহিনীতে নামভুক্তির চেষ্টা করেন। এটা এক বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। অনেকেরই মনে পড়তে পারে, স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে জীবন দেওয়া ২৯ বছর বয়স্ক উদ্দীপ্ত-জ্বলজ্বলে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী-লেখক ক্রিস্টোফার কডওয়েলের কথা। কডওয়েলের উল্লেখ সুধীন দত্তের ইংরেজি লেখাতে আছে।
সংবর্ত কাব্যের ‘১৯৪৫’ নামের কবিতায় আছে এ-কথা :
তথাচ গ্রীসের ট্রটস্কীয় বামাচারী
বিনষ্ট চার্চিলের বাক্যবাণে;
ধরে তুরস্ক বিশ্রম্নত তরবারি;
আর্জেন্টিনা প্রগতির রথ টানে ।।
ওই সময়ে ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানই লিখেছিল ব্রিটেনের অবস্থান ছিল শঠতা ও নৃশংসতায় ভরা। নাৎসিবিরোধী গ্রিক প্রতিরোধের বা ইএএমের অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিল গ্রিক কমিউনিস্ট পার্টি। চার্চিল এএমকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু যখন দেখেন প্রতিরোধের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, চার্চিল তখন ভোল পালটান : ব্রিটিশ সৈন্যদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় গ্রিক কমিউনিস্টরা, ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে ওই হত্যাকাণ্ডে যোগ দেয় গ্রিসের পরাজিত হিটলারপন্থীরাও। বিভিন্ন কারণে গ্রিসে ট্রটস্কিপন্থী বামেদের যথেষ্ট সংখ্যায় সবসময় উপস্থিতি ছিল এবং যুদ্ধশেষে প্রভাববলয় ভাগাভাগির পর্বে সোভিয়েতরা গ্রিসকে পশ্চিমাদের মর্জিতে ছেড়ে দিয়েছিল।
ওই একই ‘১৯৪৫’ নামের কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদে আছে :
অন্তত রুষ বাহিনী বন্যাবেগে
কবলিত করে শোষিত দেশের মাটি;
বিভীষণদের উচ্ছেদে ওঠে জেগে
স্বাধীন প্যারিস, যথারীতি পরিপাটী।
এই ‘রুষ বাহিনী’ কথাটি স্টালিনের প্রতি পরোক্ষ সাধুবাদ বলতেই হয়। অন্য সময়েও স্টালিনের কর্মদক্ষতা নিয়ে সুধীন দত্ত সরব ছিলেন। সাহিত্যের বাইরেও সারা দুনিয়ার সবধরনের রাজনীতির খোঁজখবর রাখতেন সুধীন দত্ত।
মনে রাখার মতো যে, ট্রটস্কি বা স্টালিন এ-দুজনের কেউই মূল রুশ জনগোষ্ঠীর নন। ট্রটস্কি ইউক্রেনের ইহুদি; যে-কারণে বিপ্লবের পরে লেনিন তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ সাধলেও তিনি তা নেননি এজন্য যে, কমিউনিস্টরা ইহুদি-প্রভাবে বিপ্লব করেছে, এই প্রচলিত দুর্নাম আরো বাড়বে। হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তারপর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে পুরো রেড-আর্মি গড়ে তুললেন, বিপ্লবোত্তর গৃহযুদ্ধে অপূর্ব কর্মদক্ষতা দেখালেন। এরপরও বিরোধীরা তাঁকে রুটলেস বা অনিকেত বলতে পিছপা হয়নি এবং গত শতকের তিরিশের দশকজুড়ে নানা ধরনের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকত। স্টালিনোত্তর যুগে প্রায় পঁচিশ হাজার প্রাক্তন কমিউনিস্টের পুনর্বাসন সম্পন্ন হয়। ট্রটস্কির পুনর্বাসনে আরো সময় লাগে : ২০০১ সালের ১৬ জুন চূড়ান্তভাবে রুশ রাষ্ট্র থেকে সবধরনের অভিযোগের দায় থেকে মুক্ত হন (পুনর্বাসন সার্টিফিকেট নং ১৩/২১৮২-৯০)। অবশ্য ট্রটস্কির বই প্রকাশনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সাল থেকেই।
আর স্টালিন ছিলেন জর্জিয়ান; কিন্তু সম্ভবত মাতৃকুল বিশুদ্ধ জর্জীয় জাতিগোষ্ঠীরও নন, জর্জিয়ায় বসবাসরত ওসেটিয়ান জনগোষ্ঠীর, যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে ইরানীয়দের। এ-ধরনের একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে স্টালিনের উত্থান ও প্রায় তিন দশক দেশ-পার্টির হালধরা এক অচিন্তনীয় উপাখ্যানই বটে। তিনিই হিটলারের বিরোধী জোটের ছিলেন মূল নায়ক। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি এমন এক উন্নত দেশে পরিণত করেন, যেখানে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার সুফল পায় প্রতিটি নাগরিক। তবে তাঁকেও বিরোধীদের কাছ থেকে ‘এশিয়াটিক’ আখ্যার ভাগীদার হতে হয়েছে।
আর সুধীন দত্ত তো বাংলা ভাষার কবি, সুদূর কলকাতা-নিবাসী, স্বগোত্রের জন্য এক নতুন ভাষা তৈরিতে তৎপর, মূলত কবি, কিন্তু গদ্য-পদ্যের বিভাজনরোধে আজীবন প্রত্যয়ী ও সচেষ্ট। ভাষাই তাঁর কাছে পূজ্য। ট্রটস্কি, স্টালিন – এসব প্রসঙ্গ তাঁর কাছে মুখ্য নয়; কিন্তু ষোলো বছর বয়সে যিনি রুশ বিপ্লব ঘটতে দেখেছেন আর চোখের সামনে এতকিছু হয়ে গেছে, তাঁর মনে এসবের প্রতিক্রিয়া হবে না, এটা আশা করা সংগত নয়। এবং ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবোর সঙ্গে তুলনা করতে নিজের সম্বন্ধে মূল কথা হয়তো বলে গেছেন তাঁর আরেক মহান কবিতা ‘যযাতি’তে :
…আমি বিংশ শতাব্দীর
সমান বয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে; বীর
নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে যত না পশ্চাদপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.