কবি মাহবুব সাদিকের জন্ম ১৯৪৭ সালে, যখন ভারতবর্ষ ধর্মভিত্তিক পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। পূর্ববাংলা হয়ে উঠল রাতারাতি পূর্ব পাকিস্তান! পাকিস্তানের অপর অংশ – পশ্চিম পাকিস্তান, যা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন ও হাজার মাইল দূরবর্তী আর এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভিন্ন এক ভূখ-! বিভিন্ন দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ছিল বিস্তর ব্যবধান, আলাদা – ভাষা, জীবনপদ্ধতি এবং অন্যান্য সামাজিক ও জীবনাচরণও। ১৯৭১-এর আগ পর্যন্ত পুরো পাকিস্তান শাসনামলে এই ভূখ–র মানুষ বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হয়, তা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক, যার ভয়াবহতা এই ভূখ–র মানুষ শুধু উপলব্ধিই করেনি, বিভিন্ন সময়ে যার প্রতিবাদীও হয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। এই পরিস্থিতির কণ্ঠলগ্ন হয়ে কবি মাহবুব সাদিক তাঁর শৈশব ও কৈশোর থেকে তারুণ্যে উপনীত হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বদেশের ভিন্ন এক চেহারা দেখেন, দেখেন বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী আরেক দেশ। এমন সময়ে বেড়ে ওঠা কবি মাহবুব সাদিকের কবিতায় ধরা পড়েছে সময়খ-, ইতিহাস। ষাটের শেষ ও সত্তরের গোড়া থেকে অদ্যাবধি বিশিষ্ট কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি। করেছেন সাহিত্যের অধ্যাপনা। শুধু কবিতা নয়, ছোটগল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক কাজেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি বিশেষভাবে বিবেচনা ও আবিষ্কারের দাবি রাখে।
কবি মাহবুব সাদিকের লেখার জগৎ বহুবর্ণিল ও বিভিন্ন ভূগোল নিয়ে বিসত্মৃত। একজন পাঠক হিসেবে তাঁর কিছুটা দিগন্ত স্পর্শ করে আমি নিজেও অনেকটা উৎপিপাসু হয়ে উঠেছি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অনেক, সেগুলোর মধ্য থেকে এখন আমার অবলোকনে রয়েছে – সন্ধ্যার স্বভাব (১৯৭৬), স্বপ্নচৈতন্যের ডালপালা (১৯৮৩), সুন্দর, তোমার নির্জনে (১৯৮৫), যায় কল্পান্তের কাল (১৯৮৬), আদিগন্ত রোদের তিমির (১৯৯৫), অনন্ত নক্ষত্র চোখ (১৯৯৯), অতৃপ্ত ঈশ্বর (২০০৩), নিরালোকে জলঝর্নার ধ্বনি (২০০৬), এখন অপর বেলা (২০০৮)। এসব কাব্যগ্রন্থের কবিতায় রয়েছে বিভিন্ন ব্যঞ্জনা, অনুরণন ও বোধ। তারই কিছুটা ব্যক্ত করার প্রয়াসে এ-লেখা।
দুই
কবি মাহবুব সাদিক চার দশকের বেশি সময় ধরে কবিতা লিখছেন। তাঁর কবিতার কূলকিনারা খুঁজতে গিয়ে স্বপ্নচৈতন্যের ডালপালা একাধিক গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘জীবন’ বেছে নিলে তাতে চৈতন্যের বহু স্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এই কবিতাটি ১০১ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা। ‘জীবন’ নামের কবিতাটির প্রথম স্তবক :
তোমার সঙ্গেই দেখা হয় প্রতিদিন
প্রতিটি মুহূর্ত প্রেমে ও অপ্রেমে বাঁধা পড়ে আছি –
ঘূর্ণিহাওয়ার পাকে ঝিমকালো মেঘের মতন
কুকুরের মাথার ঘায়ে নাছোড় মাছির মতো
তোমার সঙ্গেই আজো জড়িয়ে আছি;
এই কবিতায় কবি তাঁর অভিজ্ঞতা আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনকে দেখেছেন বিসত্মৃত পটভূমিতে, কঠিন বাস্তবতায় যেমন, তেমনি
স্বপ্ন ও ভালোবাসায়, স্বদেশভূমির শৃঙ্খলমুক্তির আয়োজনে আর সংগ্রামে-আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে। জীবন যে কতভাবে প্রবহমান, তারই প্রতিভাস এই কবিতায় পরিস্ফুট।
উপমাপ্রধান এই কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে – কবিতা যেন উপমার মূল শক্তিতে দাঁড়িয়ে থাকে। উলিস্নখিত দুটি পঙ্ক্তি : ‘ঘূর্ণিহাওয়ার পাকে ঝিমকালো মেঘের মতন’ এবং ‘কুকুরের মাথার ঘায়ে নাছোড় মাছির মতো’ – এভাবেই কবি শুধু বলেননি, আরো বহু ধরনের উপমা দিয়ে এই কবিতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। আরো উদাহরণ :
‘মানুষ-জন্মেও নানা রঙ ও রেখার ধাঁধা চোরকাঁটার মতো’
‘বেদনার ঢেউ ভেঙে ডুবে যাবার মতন’
‘সমুদ্রপাখির শাদা পালকের ভাঁজে উজ্জ্বল রোদের মতন’
‘ঝুলে থাকে বাদুড়ের মতন বর্তমান’
‘হলুদ স্কার্ট-পরা কিশোরী প্রেমিকা মাছের চোখের মতো’
‘ঘূর্ণাবর্তের নিচে একরোখা দেবদারুর মতো’
এই কবিতাটি পড়তে পড়তে আরো মনে হলো উপমা হয়ে উঠতে পারে কাব্যধর্মিতার এক প্রধান ভিত্তি। সেই শক্তি ও সাহস দিয়ে এই কবিতাটি কবি খুব সচেতনভাবে নির্মাণ করেছেন। এখানে কবির নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
এই দীর্ঘ কবিতায় উপমা ও অলংকারের সান্নিধ্যকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন কবি, তেমনি খ- খ- অনুভাবনাকে গভীর ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করে দেশ-কালের ইতিহাসকে মূর্ত করে বিভিন্ন অভিব্যক্তির পরিচয় মেলে ধরেছেন। কবিতার এক অংশে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী এই কবির অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভব পেয়ে যাই, আর সে-কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতার এই অংশ ভিন্ন মাত্রায় পাঠককে অনুরণিত করে। উদাহরণ :
তোমার সঙ্গেই গেছি একাত্তরের শালবনে, তোমার সঙ্গেই –
রক্তরঙ আকাশের নিচে বারুদের গন্ধমাখা বাতাস শুঁকতে শুঁকতে
আমরা মুখোমুখি হয়েছি কতোবার –
তখন শালবন সাঁতরে গেছে সাইবেরিয়ার শাদা হাঁস
চোখ তুলে দেখার সময় ছিলো না –
ঘাসের ডগায় রোদ ভাঙচুর করে গেছে কাঠবেড়ালিরা
তাদের সুদূর চোখে সকালের রোদ ছিলো
দেখার সময় ছিলো না –
শালিকের ফেলে-যাওয়া খড়কুটোর মতো ছিলো তখন জীবন –
হাঁসের রাঙা পায়ে পায়ে ঘুরতো মৃত্যু
একাত্তরে, সেই কাছের ও দূরের শালবনে কতোবার
তোমার রক্তরাঙা চোখের মুখোমুখি মিইয়ে যাবার বদলে
‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়েছি;
এদেশের কবিতার মূলধারা স্বদেশ ও মানুষের সংগ্রাম-বিচ্ছিন্ন ভূভাগ হয়ে থাকেনি, বরং কবিতার মূলভূমির বিশেষ অংশ হয়ে থেকেছে। মাহবুব সাদিকের কবিতায়ও সেই বাস্তবতা ইশারায়-নিশানায় উলিস্নখিত থাকে। ‘জীবন’ নামের কবিতাটির আরেক অংশে পাই এমনই চিত্র :
অবিশ্রাম বৃষ্টির মতো বিপদের মধ্যে দিয়ে ছুটে গেছি
এক নৈরাজ্যের নিচে
জনতার সঙ্গে প্রবল হুংকারে ভেঙেছি কারফ্যু
টিয়ার গ্যাসের সেল উল্টে ফিরে গেছে
গনগনে কয়লার মতো গরম রক্তের ফোয়ারায় হাত রেখে
ঝনঝন করে উঠেছে আমার চার চৈতন্য
আমি টাল খেয়ে পড়ে গেছি
ঘূর্ণাবর্তের নিচে একরোখা দেবদারুর মতো
বিপদে-বারুদে আমি থেঁতলে-মুচড়ে গেছি,
তবু হেরে যাইনি;
আবার এই কবিতার পরের অংশে কবি বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ও কালচেতনায় রচনা করেন এমন পঙ্ক্তি, যেখানে দৃশ্যমান হয় আর এক রিয়ালিটি, যা কবির গোচরেই শুধু থাকে না, পাঠককেও আন্দোলিত করে –
আমি বেড়ে উঠেছি এই শতাব্দীর অন্ধকার অরণ্যের ভিতর
গ্লানি ও প্রতিশোধের ভেতর
আতুর ও আর্তের ভেতর
কয়েদি ও ধর্মঘটের ভেতর
তেল ও আণবিক বোমার সন্ত্রাসে কম্পমান পৃথিবীর ভেতর –
তবু আকাশের মতো অকপট আমার মনোরাজ্যে খেলা করে
ভিখিরির ভরাথলের স্বপ্ন, নুলো-ন্যাংটোর বালিশ-বিছানা,
শেষ বিকেলের মেঘভাঙা রোদ
সবুজ পাতার খোপে যে হিরণ্ময় স্বপ্ন বুনে রাখে
শতাব্দীর অন্ধকারে আমার হৃদয় সেই স্বপ্ন বুনেছে;
কবি মাহবুব সাদিকের কবিতা পাঠে উপলব্ধি করা যায়, তাঁর সৃজনের বেশিটা জুড়ে আছে দেশলগ্ন ও কাল-সচেতন কবিতা। শান্ত উপলব্ধির মধ্যেও গভীরভাবে দেশ ও তাঁর সময়কালকে তিনি উন্মোচন করেছেন।
এই কবির অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতা রয়েছে – মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে – এসব কবিতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা হিসেবে শুধু উজ্জ্বল নয়, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার আবেগ, স্বপ্ন, সংবেদনা ও অভিনবত্বও এতে ধরা পড়েছে।
‘যুদ্ধভাসান’ নামের কবিতায় দৃশ্যমান হয়েছে তাঁর প্রিয় এলাকা, যেখানে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, লিখেছেন এভাবে –
যেখানেই যাই, সখীপুর সঙ্গে সঙ্গে থাকে
স্বপ্নচৈতন্যের মাঝামাঝি সখীপুর
মধ্যবর্তী দূরত্বকে স্থানচ্যুত করেছিলো কালো যুদ্ধরাত –
খুব বেশি দূরে নয় সখীপুর
শহরের থেকে দূরে, সভ্যতার থেকে দূরে নয়;
গাঢ় সবুজ-মোড়ানো অই শান্ত বনভূমি
কবিতার বাইরে কেউ কোথাও দেখেনি;
পেঁয়াজ খোসার মতো মিহি রোদের পর্দায় ঢাকা শালবন
যুদ্ধদিনে উজ্জ্বল হলো আরো,
আমি নিঃশর্ত ভালোবাসায় তার কাছে গেছি –
তবু, সে বড়ো ভয়ঙ্কর ভালোবাসা
সেখানে, সেই তীব্র ভয়ঙ্করের বুকে বাঙালি সবুজের প্রেমে
আমি নিজেই ঝাঁপ দিয়েছি;
‘সখীপুর’ হয়েছে এমন এক ভূখ-, যা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার গৌরবের এক আত্মভূমি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দীর্ঘ কবিতার ‘তিন’ নং অংশে কবি এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার জীবনদানের ঘটনাকে আমাদের চৈতন্যে পৌঁছে দেন, যা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সকল কিশোর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে :
শুধু তোমার জন্যে
সান্দ্র সূর্যাস্তের নিচে গুলি খায় কিশোর কুদ্দুস
নিসর্গ কিছুটা কাঁপে শীতের পাতার মতো
জীবনের কোল থেকে পিছলে নেমে যায় কিশোর ছেলেটা –
শুধু তোমার জন্যে, শুধু
স্বপ্নমাতাল রাতে তোমার দুবাহু ছুঁয়ে দেবার জন্যে
শুধু সর্বব্যাপী অবরোধ থেকে তোমার মুক্তির জন্যে;
এই অংশের কবিতার শেষে কবি তাঁর সংবেদ দিয়ে এক জিজ্ঞাসা আমাদের মাঝে জাগিয়ে দেন –
শুধু তোমার জন্যে হে কিশোরী, হে স্বদেশ
দশমিনিটের সান্ধ্যযুদ্ধে পার্বত্য ঝর্নার মতো কিশোর ছেলেটা
দশলাখ ফুট নিচে মিহিন মৃত্যুর কোলে আছড়ে পড়েছে –
শুধু তোমার জন্যে হে কিশোরী, হে স্বদেশ।
কবিতা তিনি নির্মাণ করেছেন শিল্পশর্ত মেনে, ছন্দ-মাত্রা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা আর অন্যান্য দিক দক্ষতার সঙ্গে বজায় রেখে। তাঁর কবিতার ভূগোল পরিব্যাপ্ত হয়েছে অগ্রসরমান মননশীলতায়, মানবতাবাদে আর যুক্তিবাদে। আধুনিকতা তো এই যুক্তিবাদ আর মানবিকতাবোধ নিয়েই, আর এর ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক চেতনা ও অভিজ্ঞান গড়ে উঠেছে এই সময়ের কবিদের, সে-কারণে এই সময়ের কবিরা থাকেন মানুষের পক্ষে – বিদ্রোহ ও প্রতিবাদে। কবি মাহবুব সাদিক তেমনই কবি, যিনি কুসংস্কার আর ভাবালুতা দিয়ে তাঁর চেতনাজগৎকে করেননি কূপম-ূকতায় জরাগ্রস্ত। সে-কারণে তাঁর কবিতায় আষাঢ়ে গল্প নেই, তাঁর কবিতায় যে-পার্থিবতা পাই – তা আমাদের সমাজ ও জীবনেরই কথকতা। সংহত বুননে পেয়ে যাই – সংকেত ও বৈজয়মত্মী।
আমাদেরও মনে আছে – মার্কিনিদের নাপাম বোমা বর্ষণে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছিল ভিয়েতনাম। ছোট একটি ভিয়েতনামি মেয়ে কিম একটি স্কোয়ার পার হওয়ার সময়ে নাপাম বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তার গায়ে আগুন লেগে যায়! সেই বীভৎসতার ছবি সারাবিশ্বের বিবেকবান মানুষকে বেদনায় ও প্রতিবাদে সচকিত করে। কিমকে অনুষঙ্গ করে ‘এশিয়া’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন মাহবুব সাদিক। কবির প্রশ্ন, যে ছোট মেয়েটি ‘কড়ের আঙুলে কোনো চিমটিও কাটেনি’ – তারপরও কেন ‘সন্ত্রাস ফেরি করে দেশে দেশে’ – কারা? আমাদের প্রশ্ন, কবির উচ্চকিত উচ্চারণ – ‘সভ্যতার প্রতিভূ কেউ স্ট্র্যাটেজির ছকে ফেলে/ লোকালয় ভস্মসাৎ করে ঠা-া মাথায়?’ এদের হাতে নিরাপদ থাকেনি ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ কত দেশ।
মাহবুব সাদিকের কবিতায় সাধারণ মানুষের আর্তস্বর গভীর ব্যঞ্জনায় ধরা পড়ে। তাঁর বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতা রয়েছে, তাতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সমাজসচেতন একজন তীক্ষন ধীশক্তির কবির পরিচয় পাই। ‘জানুয়ারি ২০০০’ নামক দীর্ঘ কবিতায় তিনি ক্ষোভ নিয়ে লিখেছেন –
এ কোনো কবিতা নয় – বলতে গেলে নিরেট গদ্য;
আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ককোষে ক্রোধের অগ্নিবাষ্প
কেবলই পাক খাচ্ছে; সন্ধ্যার ঘনিষ্ঠ আঁধারে বসে
আমি দেখছি তারাকান্দির কদবানুকে; ওদিকে, চৈতন্য জুড়ে
ড্রাম পিটছে তৃতীয় সহস্রাব্দ বরণের উন্মত্ত উৎসব;
বিশ্বজোড়া শ্যাম্পেন-আতশবাজি, বিরতিহীন চুম্বন ও নৃত্য –
আলিঙ্গন-আসঙ্গের অক্লান্ত আয়োজন; চোখের সামনে দেখছি
ক্ষুধা ও নৈরাশ্য কোলে বসে আছে কদবানু; এই বিপ্রতীপ
দৃশ্যকল্প আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না – আজ কোনো
কবিতা হবে না;
এই কবির কবিতা বিভাবন দিয়ে তৈরি, কল্পনাবিলাস নেই। তিনি এমন এক বৈষম্যের পৃথিবীকে উন্মোচন করেন তিনি, যা আমাদের চৈতন্যোদয় ঘটায়, আমরাও যেন কবির সঙ্গে ঘোর কাটিয়ে স্তব্ধতা ভাঙি। এই দীর্ঘ কবিতার আরেকটি অংশ –
দু’হাতে যত্নে সরিয়ে সে বন পেরিয়ে এসে পড়েছে পুঁজিপতিদের
কঠিন ডেরায়; পথে পথে কদবানু খেয়েছে ফুটি-বাঙ্গি,
বৈচি-বেতফল – আকণ্ঠ গিলেছে কলকলে ঝর্নার জল;
আকাশনীল হ্রদে স্নান করে জুড়িয়েছে হৃদয়তাপ; তার শরীরের
অবশিষ্ট তাপটুকু নগরের শীতের বাতাস ঝাপটা মেরে
নেবাতে চাইছে; কদবানুর চারপাশে ক্ষুধা নাচছে ধেই ধেই;
তৃষ্ণার জল তিন মাইল দূরে – আর অবগাহনের জল নেই
কবি যেন মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় ‘কদবানু’ নামের চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন, যার মাধ্যমে আমাদের সমাজের বৈষম্যপীড়িত জীবনের আর্ত-হাহাকার তুলে ধরেছেন বড় ক্যানভাসে। এই দীর্ঘ কবিতার আরেক অংশে তিনি উচ্চকিত করেন এমনই প্রতিভাস –
তারাকান্দির কদবানু ফি-বছর ট্যাক্স দিতো তিন টাকা –
পোষমানা গণতন্ত্রের ধ্বজা-ওড়ানো এই নগরের
পুলিশ-মাস্তানরাও
ট্যাক্স হিসেবে ঈগল-নখে ছিঁড়ে খায় কদবানুর দেহ – তাকে
দেয় পিতৃহীন এক ক্ষুধার্ত সন্তান; এদিকে, একালের কর্পোরেট
মালিকেরা সমস্বরে গায় অটোমেশনের জয়গান – কারখানা
থেকে ছাঁটাই করে পুরানো শ্রমিক, পশুপ্রেমী সেজে তারা
বেড়ালের থুতনি মোছে নিজের রুমালে; ষড়যন্ত্রীর মতো
নিশ্ছিদ্র গোপনে তারা মুনাফা পাচার করে দেশ থেকে দেশান্তরে –
পোল্যান্ড থেকে জার্মানিতে, ফ্রান্স থেকে কানাডায়, অষ্ট্রেলিয়া
থেকে মায়ামির গোপন ক্যাসলে; পুঁজি-পাচারের ফাঁকে
তারা ফাঁকি দেয় ট্যাক্স; ঘূর্ণিবাতাসের চাপে ফুলেফেঁপে-ওঠা
জলোচ্ছ্বাসের মতো তাদের পকেট স্ফীততর হতে থাকে
নানারঙ সুদৃশ্য টাকায়; তারাই জন্ম দেয় নষ্ট শসার মতো
হাতে-গোনা পেটমোটা নতুন ধনিক; বিশ্বব্যাপী তারাই ছড়ায়
যুদ্ধের পর যুদ্ধ, হত্যা ও ধর্ষণ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এবং
ক্ষুধা এবং ক্ষুধা;
কেন ক্ষুধা, কেন এত বৈষম্য, কেন যুদ্ধের দামামা – এই পৃথিবীতে – তারই সারাৎসার তুলে ধরে কবি এই সময়ের চরণগুচ্ছ রচনা করেছেন – এই দীর্ঘ কবিতায়।
দীর্ঘ কবিতা থেকে উদাহরণ দিয়েছি, তাঁর ছোট কবিতার মধ্যেও জীবনের উদ্ভাস, করুণ পরিণতি, ভালোবাসা, ক্লান্তি, অভিজ্ঞান ও বিচিত্রমুখী বিলোকনের দেখা পাই। ‘প্রিজন ভ্যান’ নিয়ে লেখা ভিন্ন এক স্বাদের কবিতা পাঠক হিসেবে পেয়ে যাই।
লাউয়ের আকশির মতো জালি-কাটা লোহার গরাদ
আঁকড়ে ধরে আছে শুধু মানুষের জীবন্ত আঙুল
মুখ নেই – ঘাড় গলা নেই
অস্পষ্ট আঁধারে শুধু কিমাকার মুখের আদল
‘প্রিজন ভ্যানে’র সংখ্যা যেন আমাদের দেশে দিন দিন বাড়ছে। অথচ সাম্প্রতিক খবরে আমরা জানতে পারছি – অপরাধী না থাকার কারণে এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নেদারল্যান্ডসের সব কারাগার। অপরাধীর সংকটে এ-পর্যন্ত মোট ১৮টি কারাগার বন্ধ করে দিয়েছে সেদেশের সরকার। আশ্চর্য মনে হলেও এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস! আমাদের দেশে নতুন নতুন কারাগার তৈরি করেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না কয়েদির! বন্দির সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের উলিস্নখিত এই একটিমাত্র পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, আমাদের দেশে অপরাধপ্রবণতা কতটা সামাজিক ক্ষত হিসেবে জায়গা দখল করে আছে! আমরা কতটা সভ্য ও উন্নত হয়ে এখানে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করছি। আমাদের নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গাটা কতটা নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সমাজের অন্যান্য সংগঠন আমরা কতটা আমাদের মতো করে গড়ে তুলছি – সুসভ্য মানুষ হিসেবে! নেদারল্যান্ডসে এমনি এমনি এটা হয়নি। এর পেছনে দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্যোগ রয়েছে। জেলে পচিয়ে শাস্তি দেওয়ার দিকে না ঝুঁকে বরং দোষীকে সামাজিক কাজে ব্যবহার করে তাকে মূলস্রোতে ফেরানো হয়। নেদারল্যান্ডসে প্রযুক্তির সাহায্যে অপরাধীদের ওপর নজর রাখা হয়। অন্যদিকে সামাজিক এবং দৈনন্দিন কাজে উৎসাহ দেওয়া হয় দোষীদের। শুধু তাই নয়, নেদারল্যান্ডসের মানুষের মধ্যে সামাজিক অভিন্ন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে তৈরি হয়েছে, নৈতিকবোধ তাঁদের মধ্যে উন্নত ও দৃঢ়, যা তাঁদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে ফেলেছে। এছাড়া ব্যক্তির শৃঙ্খলাবোধ ও ব্যক্তির স্বাধিকারবোধ এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের দায়, ঠিক তেমনি ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্রের দায়, যা সমন্বিতভাবে একীভূত হয়ে সামগ্রিকভাবে মানুষের কল্যাণের পথকে প্রশস্ত করেছে।
‘প্রিজন ভ্যান’ কবিতার আরেক অংশে কবি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গভীর বোধে আর চিত্রকল্পে বলেছেন –
শিরীষ গাছের নিচে নড়ে ওঠে ভিড়ের শরীর
ভোঁতা-মুখ গাড়িটিও নড়ে –
মনে হয় শাসকের মাথার ভেতরে খড়গাদা
এপাশে-ওপাশে শুধু দোল খায় – কুক পারে
তার পস্নাস্টিক পেন্ট করা ঠোঁট;
অন্যদিকে শতাব্দীর গালে চুনকালি মাখে খালি
দুর্বিনীত নীতিহীন আনমনা আমার স্বদেশ;
জালি-কাটা গারদ আঁকড়ে আছে শুধুই আঙুল –
কবি তো চেতনারহিত ও অরণ্যজীবী হয়ে থাকতে পারেন না, সময়ের কণ্ঠলগ্ন হয়ে সমাজের গভীরে প্রবেশ করে সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করে বাস্তবতাকে তুলে ধরেন তিনি। কবি মাহবুব সাদিকও তাঁর কবিতায় এই কাজটি করতে চেয়েছেন বারবার।
বাংলাদেশের কবিতার মূলধারায় রয়েছে স্বদেশ-চেতনা, গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর মানবতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ। এরই পরম্পরা নিয়ে এদেশের কবিরা কবিতা নির্মাণ করেন। সে-কারণে আমাদের কবিতাও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন কবির সৃজনশীলতায় সমুজ্জ্বল। কবি মাহবুব সাদিক আমাদের মূলধারার শুধু একজন বিশিষ্ট কবি নন, তাঁর কবিতা আরো অনুসন্ধানের ও মনোযোগের দাবি রাখে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.