স্মৃতিগদ্যের টান অথবা স্বদেশাত্মার পুনরাবিষ্কার

শঙ্খ ঘোষের এই স্মৃতিগদ্যটি একটানা পড়া যায় না, নিজের অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে ওঠে। আমরা যারা কিছুটা স্বেচ্ছায়, খানিকটা পরিস্থিতির চাপে দেশত্যাগ করেছি, তাদের কাছে জন্মভূমির টান এক অনন্য মায়াময় স্মৃতিমেদুরতায় ভরা। নাড়িছেঁড়া এ এক অদৃশ্য বন্ধন। তাই তো দেশ ছেড়ে এলেও দেশের স্মৃতি আমাদের ছাড়ে না। এ যেন সেই অনপনেয় টান, উন্মূল মানুষের অন্তরাত্মার কান্নাভেজা এক অবধারিত কষ্ট। লেখক এই গ্রন্থের আত্মপ্রসঙ্গ শিরোনামের এক জায়গায় বলেন, ‘… বাংলাদেশ নিয়ে আমার লেখার সংকলন যদি হয় তবে তো আমার প্রায় সমস্ত রচনাই এর অন্তর্গত করতে হবে। এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে – শব্দে বা প্রতিমায় – রাখেনি। এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশেরই মধ্যে।’

এই অকপট বয়ান যাঁর, তাঁর বাংলাদেশ নিয়ে এই গ্রন্থে যে ওই দেশের অন্তরাত্মার অনুসন্ধান ফিরে ফিরে আসবে তাতে আর আশ্চর্য কী! বস্তুত হয়েছেও তাই। এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে তাই উঠে এসেছে নিজের হারানো অতীতের এক নিবিড় অনুসন্ধান, সেই সঙ্গে ওই দেশের পুনর্জাগরণের কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তথা রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে ধারণ করার মহান ব্রতযাপনে ওই দেশের মানুষ যে কতটা তৎপর, তারই অনুপুঙ্খ বর্ণনা। এই গ্রন্থ তাই স্মৃতিকথা হয়েও অন্যতর। এই বইয়ের লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে যেন হয় এক নতুন দেশের আবিষ্কার, যার অন্তরে নিরন্তর বহমান বাংলা ও বাঙালি চেতনার এক চিরন্তন ধারা।

পাঁচটি ছোট ছোট পর্বে বিন্যস্ত এই বইয়ের সূচি। এগুলো হলো – ‘একুশে, একাত্তর ও নববর্ষ’, ‘ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান’, ‘গানের ভিতর দিয়ে’, ‘শিক্ষা-আন্দোলন’ ও ‘স্মৃতি, ভ্রমণ’। শিরোনাম থেকেই বুঝে নেওয়া যায় লেখকের মনোজগৎ ঘিরে রয়েছে ভিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে ওঠার এক সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি। শেষ পর্বের লেখাগুলোর মধ্যে আছে একজন দেশহারানো মানুষের নাভিমূলে ফিরে যাবার এক আকুল আর্তি। দেশকে ভালোবাসার এ এক অপরূপ মানসিকতা, যা সবার ঠিক সেইভাবে থাকে না। অনেকেই দেশত্যাগ করে তার সমস্ত স্মৃতিকে মুছে দেন। ফিরে দেখার সমস্ত অনুভবকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁরা চান এগিয়ে যেতে। অবশ্য আমরা চাই বা না চাই স্মৃতি আঁকড়ে স্থবির হয়ে তো থাকতে পারি না। এগিয়ে যাওয়াই তো জীবনের ধর্ম, এগিয়ে আমাদের যেতেই হয়। তবে সত্যসন্ধ মানুষ পেছন ফিরে তাকান মাঝে মাঝে। তাই যত দূরেই যান না কেন, তাঁর সমস্ত সত্তা জুড়ে থাকে তাঁর জন্মভূমি, তাঁর হয়ে ওঠার সেই স্মৃতিময় মায়াময় দিনগুলো-রাতগুলো।

সংকলক পিয়াস মজিদ এই গ্রন্থের শুরুতেই ‘সংকলন প্রসঙ্গে’ গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত লেখাগুলোর সুন্দর এক সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন, যা এতে বিন্যস্ত বিষয় সম্পর্কে পাঠকের একটা ধারণা জন্মাতে সাহায্য করে। পড়া শুরু করলে অবশ্য পাঠক পেয়ে যান একজন উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষকে, যিনি তাঁর হারানো দেশটার সর্বত্র দেখেন তার এক অনন্য অভিযাত্রা, অপরূপ সেই বর্ণনা। এই দেখার চোখও সবার থাকে না। আমরা তাই তাঁর এই গ্রন্থের হাত ধরে পৌঁছে যাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক সেরা পীঠস্থানে, স্বাধীন বাংলাদেশে।

আমরা জানি, বক্তৃতাবিমুখ এই মানুষটি প্রায় সব সভাতেই মৌন থাকতেন। অনুরোধে-উপরোধে কখনো কখনো কোথাও দু-একটি কথা বললেও বোঝা যেত সেই কথাগুলো স্বতোৎসারিত নয়। সেই মানুষটিই ঢাকায় একুশের এক আয়োজনে কিছু কথা বলার জন্যে আবেদন করেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। বয়স তখন তাঁর চুরাশি। তিনি বলেন, ‘… একুশে যে একুশে ফেব্রুয়ারি, সেটা উল্লেখ করবার আর দরকার পড়ে না আজ, শব্দটি এমনই প্রতীক মর্যাদা পেয়ে গেছে। পঁচিশে বৈশাখকেও আমরা পঁচিশে বলে বোঝাতে পারি না, কিংবা পনেরোই আগস্টকে শুধু পনেরো। কিন্তু একুশ বললেই যেন যথেষ্ট, সঙ্গে সঙ্গে সকলের মনে জেগে ওঠে ভাষার জন্যে একটা আত্মদানের মুহূর্ত।’ প্রসঙ্গত তিনি অমøান দত্তের একটি লেখার কয়েক পঙ্ক্তি এইভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘… সব ভালবাসারই দুঃখ আছে। ভাষাকে ভালবাসার দুঃখও কম নয়। … সব সাধনারই গৌরব আছে। ভাষার সাধনার গৌরবও কারো চেয়ে কম নয়।’ বাংলাদেশে একুশে উদ্যাপনকে তিনি এইভাবে দেখেছেন।

বাংলাদেশের কথা লিখতে গিয়ে লেখকের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে ওই দেশের মানুষের কথা, যাঁরা ওই দেশের জল-হাওয়ায় শুধু বড় হয়েই ওঠেননি, ওখানকার অণু-পরমাণুর মধ্যে নিজস্ব সত্তাকে বিলিয়ে দিয়েছেন। সেই মানুষদের কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার কথা, আদ্যন্ত সংস্কৃতিসেবী এক কর্মী ওয়াহিদুল হকের কথা। সেই সঙ্গে তিনি বিবৃত করেন একজন অখ্যাত মানুষ মুজিবুর রহমানের বিবরণ, যিনি তাঁর গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সমীপে আসেন তাঁর হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে। ইনি সেই শিক্ষক যাঁর নির্দেশে ওখানকার প্রার্থনা সংগীত ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘অন্তর মম বিকশিত করো’, যা আজো আছে। লেখক উল্লেখ না করলেও আমরা জানি সেই প্রধান শিক্ষকের নাম মণীন্দ্র ঘোষ, শঙ্খ ঘোষের পিতৃদেব।

এইভাবে তাঁর লেখায় উঠে আসে আলোকচিত্র গ্রাহক নওয়াজেশ আহমদের কথা, যাঁর ক্যামেরায় ধরা দেয় বাংলাদেশের প্রকৃতি, জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদী-তীরবর্তী উন্মুক্ত উদার আকাশ, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বর্ণিত বাংলার নিসর্গ। অকালপ্রয়াত এই মানুষটির ক্যামেরায় ধরা থাকে বাংলার ফুল ও পাখি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে তিনি তুলেছেন সেই সব ছবি, যা বই হয়ে বেরিয়েছে একসময়। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের এ এক অনন্য অবদান। আরেকটি লেখায় তিনি বর্ণনা করেন ঢাকার ‘ছায়ানট’ সংগীতায়তনের অবদানের কথা, যার প্রভাব এখন দেশব্যাপী। এইভাবে তিনি লেখেন সংগীতে নিবেদিতপ্রাণ ইফফাত আরা খানের কথা, সন্জীদা খাতুনের কথা, এমনকি এই প্রজন্মের লাইসা আহমেদ লিসার কথা।

এইভাবে তাঁর লেখায় উঠে আসে আলোকচিত্র গ্রাহক নওয়াজেশ আহমদের কথা, যাঁর ক্যামেরায় ধরা দেয় বাংলাদেশের

প্রকৃতি, জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদী-তীরবর্তী উন্মুক্ত উদার আকাশ, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বর্ণিত বাংলার নিসর্গ। অকালপ্রয়াত এই মানুষটির ক্যামেরায় ধরা থাকে বাংলার ফুল ও পাখি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে তিনি তুলেছেন সেই সব ছবি, যা বই হয়ে বেরিয়েছে একসময়। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের এ এক অনন্য অবদান। আরেকটি লেখায় তিনি বর্ণনা করেন ঢাকার ‘ছায়ানট’ সংগীতায়তনের অবদানের কথা, যার প্রভাব এখন দেশব্যাপী। এইভাবে তিনি লেখেন সংগীতে নিবেদিতপ্রাণ ইফফাত আরা খানের কথা, সন্জীদা খাতুনের কথা, এমনকি এই প্রজন্মের লাইসা আহমেদ লিসার কথা।

প্রসঙ্গত চলে আসে ওই দেশের শিক্ষা-আন্দোলনের কথা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা। দেশব্যাপী গ্রন্থাগার আন্দোলনে এই সংস্থার অবদান অসামান্য। পাশাপাশি বিস্তীর্ণ চলনবিলে অভিনব ভ্রাম্যমাণ নৌকাস্কুলের কথা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে জানান লেখক। স্বতঃপ্রণোদিত কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুলে স্কুলে যায় ছাত্র পড়াতে, বিনা পারিশ্রমিকে। সেই কয়েকজন এখন কয়েক হাজারে পরিণত হয়েছে। দেশের অনেক অনেক বিপথগামিতার মধ্যেও এ এক আশার আলো। কেননা আমরা জানি, শিক্ষায় জাগে প্রকৃত চেতনা।

গ্রন্থের শেষাংশে বর্ণিত হয়েছে লেখকের বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণের কথা। সেইসঙ্গে এসে যায় তাঁর বাল্য, কৈশোর আর তরুণ বেলার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। জন্মেছিলেন চাঁদপুরে মাতুলালয়ে, দেশের বাড়ি বরিশালে, তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে পাবনার পাকশীতে। যে-স্কুলে পড়েছেন, তার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা। সেই স্কুলজীবনের কথা আমরা জেনেছি লেখকের ছোট একটা স্কুল গ্রন্থে। সেই গ্রন্থের কোনো কোনো অংশ এই বইয়ে থাকতেই পারত। তাঁর বাল্যস্মৃতির দুটি অসামান্য গ্রন্থ সকালবেলার আলো কিংবা সুপুরিবনের সারির কথাও মনে পড়ে এই গ্রন্থের পরিপূরক হিসেবে।

স্মৃতিকাতরতা যে কতখানি দুঃখের, সে যাঁরা সারাজীবন তাকে মনের মধ্যে লালন করে তাঁরাই জানে। এ এক অনপনেয় রক্তমোক্ষণের জ্বালা। তবে জন্মভূমির টান এমন এক অমোঘ ব্যাপার, সেখানে বুঝি কমবেশি সবার অনুভব এক হয়ে যায়। তাই তো শঙ্খ ঘোষের এই স্মৃতিচারণ আমাদের মতো দেশহারানো মানুষের কাছে এক অন্যরকম বেদনার বার্তা নিয়ে আসে। মনে হয়, এ যেন সব আমারই কথা, কেবল নামগুলো একটু অন্যরকম। তাঁর নদীর নাম সন্ধ্যা আর আমার নবগঙ্গা, তাঁর গ্রামের নাম বানারিপাড়া তো আমার গ্রামের নাম কুলশুর। তাঁর স্কুল পাকশীতে আর আমারটা খুলনায়। সব কেমন একাকার। পড়তে পড়তে মনে হয়, এ যেন আমার গতজন্মের কথা, আমারই ফেলে আসা অতীতের বর্ণনা। কবির গদ্যের জোর এখানেই।

এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় হলো এর ‘স্মৃতি, ভ্রমণ’ অংশটুকু। সংকলক অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচন করেছেন দেশহারানো একজন মানুষের বেশ কয়েকটি লেখা। নিজের দেশে যখন এক মানুষ ভ্রামণিকের মতো ঘুরে ঘুরে দেখেন, মেলাতে চান নিজের হারানো অতীতের সঙ্গে, তখন তা যে-কোনো পাঠককে অশ্রুকাতর করে তোলে। কষ্ট হয় যখন আমরা দেখি একজন মানুষ পঞ্চাশ বছর পরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন নিজের ফেলে আসা জায়গাটাকে, নিজের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে উন্মোচন করছেন অতীতের সেই কষ্টকর স্মৃতিমেদুরতাকে। আবার সেই মানুষটাই যখন তাঁর স্কুলপ্রাঙ্গণের গাছটাকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করেন ‘… বুকের মধ্যে কতজন্মের ছোঁয়া এসে লাগে। আর আশ্চর্য, গাছটাকে কিন্তু একেবারেই ছোট মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বরং বড়। গুঁড়িটার বেড় আরও বেড়ে গেছে মনে হয়।’ আমাদের চোখও জলে ভরে আসে। আমরাও যেন আমাদের ফেলে আসা অতীতের অন্ধকার পথ ধরে হেঁটে আসি। খুঁজে পাই নিজের সত্তাকে অতীতের সেই অন্ধকারে।

এতসব স্মৃতিগদ্যের মধ্যে তাঁর একটি কবিতার কথা বারবার মনে পড়ছে। সেই কবিতার নামও যে ‘সন্ধ্যানদীজল’! কবিতার মধ্য দিয়ে কবি যে অনুচ্চারিত অনেক কথাই বলে দেন। তাই এই লেখার পরিশেষে সেই কবিতাটির উল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না। মাত্র কয়েকটি পঙ্ক্তির মধ্যে কী অসীম ব্যঞ্জনা ধরা পড়েছে।

সন্ধ্যানদীজল

দুহাত তোমার স্রোতে, সাক্ষী থাকো, সন্ধ্যানদীজল।

এমন তর্পণদিনে বহু মঠ পেরিয়ে পেরিয়ে

তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি এই ভোরবেলা।

আরো যারা এ-মুহূর্তে নেই হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে

আমার শরীর ঘিরে এমন সম্পূর্ণ যবনিকা –

তাদের সবার শ্বাস দুহাতে অঞ্জলি দিয়ে আজ

এইখানে বসে ভাবি আমার সম্বল স্থির থাকা।

আমার সম্বল শুধু ঝুমকোঘেরা মঠ অবিকল

আমার নদীর নাম সন্ধ্যানদী, তুমি তার জল।