স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

\ ১১ \

 

তারপর আরেকটা শীত গেছে। বসন্ত, গ্রীষ্মের পর এখন তুমুল বর্ষা। শ্যামলা আগের মতোই আছে। কাশেম মিয়া হালে স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। খবরটা জেনেও সাবিনার নির্লিপ্তি, নীহার বানুর ভাষায় – সিমারের নিষ্ঠুরতার কাছাকাছি। সে কাশেম মিয়ার তত্ত্বতালাশের কথা একবারও ভাবে নাই। ভেবেছে হয়তো লোকটা প্যারালাইজড যখন, ওর কী কাজে দেবে? খোঁজ নিতে গিয়ে বেহুদা সময় নষ্ট! মোয়াজ্জেম হক ফের অসুস্থ হয়ে পড়লে, সাবিনার মনে হয়, এখানে আর আশা নেই। প্যারালাইজড হলেও কাশেম মিয়াই তাঁর শেষ ভরসা, যে ১৯৪৮ সালের বসমেত্ম মোয়াজ্জেম হককে প্রথম বাস থেকে নামতে দেখেছে।

তখন মোয়াজ্জেম হকের গাল ভাঙা, চোখ ডাবা। পেটটা পিঠের সঙ্গে মিশে গেছে। পিরহানের ওপর দিয়ে পঞ্জরের হাড় কখান একেক করে গোনা যায়। তাঁকে ঘরে তোলার আগে উঠানের কোণে কাঠের টুল পাতা হয়েছিল। এর ওপর রোগা-ঢ্যাঙা মানুষটা দাঁড়াতে মাথা ঠেকে বরইগাছের পাতাসমেত কাঁটাডালে। সেদিন ছেলের মাথায় দুধ ঢালতে বরইগাছে মই লাগাতে হয়েছিল বেঁটেখাটো সায়মা খাতুনকে। তাঁকে সাহায্য করছিলেন বোনের বাড়ি বেড়াতে আসা মোয়াজ্জেম হকের কোরানে হাফেজ মামুজান। আর দুধের ঘড়া, পানির কলসি এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিল বছর সাতেকের কাশেম মিয়া। তারপর ধীরে ধীরে মোয়াজ্জেম হকের গতরে মাংস লাগার কথাও তার মনে আছে।

‘এইডা তো হেই দিনের কতা, সাবু মা!’ তিরতিরে কাঁপা আঙুল আসমান পানে মেলে ধরে কাশেম মিয়া বলে, ‘চৈত-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গিয়া আষাঢ়। গতরে মাংস লাগলেও তোমার আববায় তহনো বেবোল। দশবার জিগাইলে এক-আধবার জওয়াব দেয় কি দেয় না। হে সোমায় তোমার দাদিআম্মায় উডানে কাডাল ভাইঙ্গা খাইতে দিছিল বেক্তেরে।’

সাবিনার অবাক লাগে, উঠানে কাঁঠাল ভেঙে কাদের খেতে দিয়েছিল দাদি? যারা ঘরের বেড়া ভেঙেছে? তবে আক্রোশে নয়, মোয়াজ্জেম হককে দেখতে আসা লোকের ভিড়ের চাপে ঘরের বেড়া ভেঙে যায় আর দুয়ারের মাটির পৈঠা উঠানে ধসে পড়ে। সাবিনাকে আশ্বস্ত করতে সানন্দে খবরটা জানায় কাশেম মিয়া। ‘তাই তো অদের ঘেন্না করত না তোমার দাদিআম্মায়। ইনি সবসোমায় কইত – আপন চেয়ে পর ভালো। পরের চেয়ে জঙ্গল।’

সায়মা খাতুনকে কি মা ডাকত কাশেম মিয়া? সাবিনার মনে পড়ে না। না ডাকলেও সায়মা খাতুনের মনে এ-নিয়ে কোনো খেদ ছিল না। সাবিনার বরং অবাক লাগে স্ট্রোকে হাত-পা নিয়ে নিলেও কাশেম মিয়ার মাথাটা দিব্যি পরিষ্কার। গু-মুতে তলানো কাঁথার পি- থেকে কথাও বলে টট্টরিয়ে। বাড়ি ঢোকার মুখে ঘরের পিছে সাবিনার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ‘কেডায় রে’ বলে বেদম জোরে হাঁক দিয়েছিল। সাবিনা যখন কাশেম মিয়ার তালাশে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তখন ভূতের মতো ঘরের ভাঙা বেড়া দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাক দেয়, ‘সাবু মা না? কই যাও? বাড়িত কবে আইছ গো মা?’ সাবিনা তো ভাবতেই পারে নাই, গোয়ালঘর থেকে গরুর হাম্বা ডাকের বদলে মানুষের গলা শুনতে পাবে। ওখানে কীভাবে মানুষ থাকে, যে আবার কঠিন রোগে শয্যাশায়ী! আরো তাজ্জব ব্যাপার, ওকে এক লহমায় চিনে ফেলল কাশেম মিয়া! সাবিনা ঘরের পেছন থেকে ঘুরে আসে উঠানে। ও কি ছাগল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকবে? ঘরের দরজার মুখে একটা দড়িবাঁধা মদ্দা খাসি। তারপর দুটি বাঁশ আড়াআড়ি বেঁধে আরেক পাশে পঙ্গু কাশেম মিয়ার থাকার ব্যবস্থা। খড়ের ওপর নোংরা কাঁথা মুড়ে যেন রাজার হালে শুয়ে আছে। পেশাব-পায়খানাও ওই কাঁথায়। জুমাবার জুমাবার কাঁথা-কুঁথি ধুয়ে ঘর ঝাঁটপাট দেয় ছেলের বউ আসমানি। সেই একদিনই তাকে উঠানে নামিয়ে নাওয়ানো হয়।

চিলকন্যার সংসারের এ হাল! সাবিনাদের বাড়িতে যখন দিনচুক্তি ঝিয়ের কাজ করত তখনো বাড়িটা অনেক সাফ সফা ছিল। তখন হয়তো রাতে ফিরে (তার কল্পিত মায়ের মতো) উঠানে গোবর ছড়া দিত, ঘটি-বাটি ছাই বা তেঁতুলগোলা দিয়ে মাজত। চিলকন্যা মারা গেলে নীহার বানু বলেছিলেন – ‘ঘরের লক্ষ্মী গেছে তো! এইবার গেলে নীহার বানু বলেছিলেন – ‘ঘরের লক্ষ্মী গেছে তো! এইবার কাশেম মিয়া বুঝব কত ধানে কত চাল।’

সাবিনাকে গোয়ালঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাশেম মিয়ার ছেলেবউ আসমানি এগিয়ে আসে। সে বোধহয় কোথাও পাতা কুড়াতে গিয়েছিল। ভেজা পাতার ঝাঁকাটা মাটিতে নামিয়ে তাজিম করে পিঁড়ি পেতে দেয়। সাবিনা বসে না। ঘরে এত দুর্গন্ধ যে, দুয়ারেও টেকা মুশকিল।

তারপরও দরজায় দাঁড়িয়ে কাশেম মিয়ার সঙ্গে যেটুকু কথাবার্তা হয়েছে, তা একদিনের জন্য যথেষ্টই। সাবিনা জানত না যে, বাড়ি ফিরে এলে মোয়াজ্জেম হককে মাথায় দুধ ঢেলে সোনা-রুপার পানি দিয়ে গোসল করানো হয়েছিল। এ নিশ্চয় পূতপবিত্র করতে বা বালা-মুসিবত তাড়ানোর ফিকিরে হয়তো! উঠানে কাঁঠাল ভেঙে খেতে দেওয়ার তথ্যটা নতুন হলেও অভিনব কিছু নয়। আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমে কাঁঠাল তো কাঁঠাল জ্যান্ত মানুষের শরীরও যেন ঘেমে পচে ওঠে। বাইরে তারস্বরে ব্যাঙের ডাক। ঘরে ডেঁয়ো পিঁপড়া আর ঝাঁকে ঝাঁকে নীল মাছি। পাকা কাঁঠাল ঘিরে মাছিগুলি আরো সরব, আরো বেপরোয়া। সাবিনার মনে হয় এমন ফল ঘরে রাখাটাই গেরস্থের জন্য শাসিত্ম। অথচ সে-খাবারের কথা এত বছর মনে রেখেছে কাশেম মিয়া!

‘হরবক্ত খালি খাওনের বায়না! পারলে দুনিয়াডাই গরাশে গরাশে খাইয়া লায়।’ উঠানে ভেজা পাতা বিছিয়ে দিতে দিতে সাবিনার কাছে শ্বশুরের বিরুদ্ধে নালিশ জানায় আসমানি।

 

‘ও মনে হয় সাহায্য চায়।’ রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আসমানির কথাটা পাড়ে সাবিনা। মাকে সবিস্তারে জানালে বাৎসরিক জাকাত থেকে কাশেম মিয়ার জন্য মাসিক বরাদ্দ হতে পারে কিছু টাকাকড়ি। কিন্তু নীহার বানু নির্লিপ্ত। এ নিয়ে তখনই কোনো কড়াল করেন না। আচমকা তজবি জপায় ক্ষান্তি দিয়ে তেড়ে ওঠেন – ‘তোর পশ্চিম দিকে ঠ্যাং ক্যা?’ অহ্ ওদিকে তো কাবাশরিফ! সাবিনা পা গুটিয়ে উঠে বসে। কাশেম মিয়ার বাড়ি ওকে আবার যেতেই হবে; কিন্তু তার আসমানির মতলবটা কী? বরাবরই কি কাশেম মিয়ার খোরাকি বেশি? আর তাই নীহার বানু তাকে খেতাব দিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষের সন্তান?

‘দুর্ভিক্ষের সন্তান!’ নীহার বানু মুচকি হেসে কোলে তজবিমালা নামিয়ে রাখেন। এ-ব্যাপারে মুখ ফুটে বাড়তি কিছু বলেন না। তাঁর মনে তখন অতীতের দিনগুলির আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য তেতালিস্নশের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি নীহার বানুর ছাড়া ছাড়া। যা শুনতে শুনতে মনে হয় বিচিত্র সব শাড়ির পাড়ের দস্তরখানার মতো ফোঁড় দিয়ে জুড়ে দিচ্ছেন। এসব কারদানি এজন্য যে, তখন তাঁদের অনাহারে থাকতে হয় নাই, সে বীজধানের চালে ভাত রেঁধে খেলেও। তাছাড়া সে-বছরই উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নীহার বানুর ইস্কুলে পড়ার সমাপ্তি। তারপর হাশমত বানুর মতো ঘরের ভেতর বন্দিজীবন। সেই ঘরের ভারী পর্দা সরালে ঢাকা বারান্দার ঝুলন্ত পাখির জিঞ্জির, তারপরই চৌকোনা মাটির উঠান। যেখানে ক্ষুধার্ত কি ভরাপেটের কোনো আনলোকের প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সেই নিয়ম ভেঙে বাড়তি চাল কেনার জন্য কন্ট্রাকটরের লোক আসে বাড়িতে। তাদের কানে কলম গোঁজা, হাতে খেরোখাতা। লোকগুলি চালের মটকা, ধানের ডুলির ঢাকনা খুলে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছিল। বাড়তি চালের হদিস পেয়েছিল কিনা নীহার বানুর মনে নেই। শুধু মনে আছে, তাঁর বাবা হাজি চান তখন ঢাকায়। ফিরে এসে বলছিলেন – রাস্তাঘাটে লাশ আর লাশ। লাশ সরাতেই একটা স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। ওদিকে আমোদ-প্রমোদের খামতি নাই। গোরা সৈন্যদের ব্যারাকগুলিতে ফুর্তির ফোয়ারা। ‘এইডা খোদাই গজব ছাড়া আবার কি!’ নীহার বানুর মা অজুর পানি এগিয়ে দিলে, উঠানের কোণে জলচৌকিতে বসে কুলি করার ফাঁকে বলছিলেন হাজি চান, ‘বাঙালি জাত বড়াই করত – তাগো ভাতের কষ্ট নাই। এহন খোদার গজবের লাহান দুর্ভিক্ষ নাজেল অইছে। খরা-বন্যা ছাড়া এরহম আকালের কথা তুমি হুনছ কোনো দিন?’ নীহার বানুর মা মাথা নেড়ে সায় দিলে, ভেজা আঙুলে দাড়ি খিলাল করতে করতে গজবের আরেক পিঠও তুরন্ত ভেবে নিয়ে বয়ান করতে শুরু করেন হাজি চান। ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে এক রাত এক দিনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। তার মধ্যে জলযানেই বেশি। মুন্সিগঞ্জে এসে শিলচরগামী আইজিএন কোম্পানির স্টিমারে বসেই এক যাত্রীর মুখে শোনেন – বাঙালির বেয়াদবির শায়েস্তা করতে ব্রিটিশরাজ সমস্ত চাল বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়েছে। কথাটা অর্ধেক প্যাসেঞ্জার বিশ্বাস করেছে, অর্ধেক করেনি। ‘তবে এ-ও ঠিক’ অবিশ্বাসীদের একজন বলছিল, ‘এ দুর্ভিক্ষ ম্যানমেইড।’

হাজি চান যেমন পঞ্চায়েতের সালিশ-দরবারে আসনের দিকটা তুলে ধরেন, সেভাবে স্টিমারের যাত্রীদেরও বলতে যাচ্ছিলেন – আগামী ধানের মৌসুমে খাদ্যগোলা তৈয়ার করা আবশ্যক, যেমন মিশর দেশে পয়গম্বর ইউসুফ করেছিলেন। বলার আগেই তাঁর ভাবনাটা চুরি হয়ে গেল। ‘গোলা বানায় নাই আবার!’ ভাবনা-চোর যাত্রীটি অন্যদের বাদ দিয়ে শুধু তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, ‘বানাইছে আমজনতার পেটে লাথি মাইর‌্যা, তাগো সেনাদের উদরপূর্তির জন্য।’ এমন খর মেজাজের প্যাসেঞ্জার মুন্সিগঞ্জ-শিলচর রুটে কমই দেখেছেন হাজি চান। লোকটা তখনো তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে, তিনি বাধ্য হয়ে খিন্ন স্বরে বলেন – ‘সুভানালস্না, দুর্ভিক্ষের নামে হাতে ধইরা মানুষ খুন! খোদাতালার সহ্য হইব!’ তারপর তাড়াতাড়ি জাহাজের পাটাতনে জায়নামাজ পেতে নামাজে বসে যান। যদিও তখন কোনো নামাজের ওক্ত ছিল না।

রাস্তার অহেতু বিড়ম্বনায় হাজি চানের মাথাটা এমনিই ঝাঁ ঝাঁ করছিল, ঢাকা থেকে আনা ফিতা পাড়ের মিলের শাড়ি দেখে মেয়ে দুটি নখরা করায় তিনি রেগে যান খুব। এ তাদের রুচবে কেন – জোরে জোরে বিবিকে বলেন, পরে তো রেশমের কাজের শান্তিপুরি শাদা শাড়ি, যা হাশমত বানুকে মানিয়ে গেলেও নীহার বানুকে দেখায় রণপেয়ে ভূতের মতো। এ-মেয়ের কপালে কী লেখা আছে খোদাই জানে।

আববাজানের এ-কিসিমের বেদরদ কথন ততদিনে গা-সওয়া হয়ে গেছে নীহার বানুর। দু-বোন তখন পাশের ঘরে শাড়িদুটি বিলানোর ফন্দি আঁটছিল। বাড়িতে ভিক্ষুক এলে কাজটা অবশ্যই লুকিয়ে করতে হবে; কিন্তু বিধি বাম। এ মিলের শাড়ি ছিঁড়ে গেলে রিফু করে তাদের পরতে হয়েছিল। কারণ ভাতের আকালের পর আসে কাপড়ের দুর্ভিক্ষ, যা হাজি চানের তালুকে ফলে না বলে অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। তা বলে দেশে তখন কাপড়ের মিল বন্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। যুদ্ধের বছরগুলিতে যে-পরিমাণ থান কাপড় তৈয়ার হয়, তা দিয়ে দুনিয়াটারে চবিবশ বার আড়াআড়ি পেঁচিয়ে ফেলা যেত। সেসব কাপড়ের সিংহভাগ গেছে ফৌজের জন্য উর্দি আর উড়োজাহাজ থেকে রসদ নামানোর প্যারাশুট বানাতে।

ভাতের দুর্ভিক্ষের সময়টায় ছোট্ট তিতুমীর রোজ রোজ একই তরকারি দিয়ে ভাত খেতে চাইত না বলে ওর বয়সী বাচ্চারা যে না খেতে পেয়ে পথেঘাটে মারা যাচ্ছে, তা গল্পের আঙ্গিকে বলতেন নীহার বানু আর হাশমত বানু। ‘মরলে যুদ্ধ করা যায় না?’ যেন মৃত্যুর একমাত্র ক্ষতি এটি, ভাতের লোকমা গিলে চোখে পানি নিয়ে জানতে চাইত তিতুমীর। কারণ কলার ডোগার পিস্তল আর বাঁশের কঞ্চির তিরের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা তার কাছে তখন আর শুধু খেলা ছিল না। সত্যিকারের মহড়া। যুদ্ধে যোগদানের প্রস্ত্ততি। তা এমন এক শিশুর, যে মৃত্যু কী জানে না।

নীহার বানুর মনে আছে তাঁর বাবা হাজি চান বলতেন – যে-যুদ্ধ বাধছে, তা কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। ছেলে না চাইলেও তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে যুদ্ধের ময়দানে।

 

মন্বন্তরের গল্পগুজবশেষে সাবিনা যখন নীহার বানুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, ততক্ষণে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ওর কামরার একশ ওয়াটের বাল্ব ঘিরে অজস্র পোকামাকড়। তার মধ্যে একটা বোলতা বোঁ-বোঁ করছে। ও জানালা খুলে দিলেও বোলতাটা বেরিয়ে যায় না, ধারাবৃষ্টির রুপালি দেয়ালে ঘরের বাল্বের প্রতিফলিত আলোটাও যেন ধাক্কা খেয়ে ঘরে ফিরে আসে।

সকালেও বৃষ্টি। সাবিনা যখন কাশেম মিয়ার বাড়ি যায়, বৃষ্টিটা মুষলধারায় নয়, ঝিরিঝিরি। যদিও পুকুরের এপার-ওপার, নীহার বানুর হুকুম – শাড়ি পরে যাও। শাড়ি সে পরেছিল, তবে মায়ের কথামতো সঙ্গে ছাতা নেয় নেই। তাই যেতে যেতে একেবারে কাকভেজা। বৃষ্টির পানি আর কাদা ঠেলে এগোতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়।

খালি পায়ে কাশেম মিয়ার বৃষ্টিভেজা উঠানে দাঁড়িয়ে সাবিনার মনে হয় – ওর ছোটবেলায় দেখা বাড়িটা কে যেন চারপাশ থেকে ঠেসে চেপে ধরে ছোট করে দিয়েছে। ঘর ছোট, উঠান ছোট, পুঁইয়ের মাচা ছোট। কাশেম মিয়ার কাঁথামোড়া-দেহটাও ছোট। শুধু কাশেম মিয়ার নাতি আলি হোসেনই লায়েক হয়েছে। ধুমসে নেশা করে। আর নেশার টাকা জোটাতে না পারলে মায়ের গায়ে হাত তোলাসহ নানাবিধ জুলুম চালায়।

সাবিনা আলি হোসেনকে দেখে নাই। ওর বাবা রতন মিয়া ছিল সাবিনার সমবয়সী। কোমরের ঘুনসি বাজিয়ে ঝুনঝুন শব্দে দৌড়াত। পুকুরপাড়ে বাড়ি। ছেলের পানিতে পড়ার ভয়ে কোমরের কালো কাইতনে তামার ঘুনসি বেঁধে দিয়েছিল চিলকন্যা, যাতে বাজনা শুনে ওর গতিবিধি টের পাওয়া যায়। সেই ছেলের বিধবা বউ আসমানি যখন কাঁঠাল নিতে সাবিনার সঙ্গে রওনা দেয়, পেছনে শোনা যায় কাশেম মিয়ার তাকদি আর সুরেলা কণ্ঠ। সে ততক্ষণে নাতির আনা তামাকে দম নিয়ে জুড়ে দিয়েছে জিকির-আসকার – গাউসুল আজম ভাণ্ডারি/ রহমান বাবা ভাণ্ডারি/ ফানায়ে ওয়াসিল ভাণ্ডারি/ দেলা বাবা ভাণ্ডারি…

‘জিগিরের চোডে রাইতে ঘুমান যায় না।’ আসমানি ফের সাবিনার কাছে নালিশ জানাতে শুরু করে। ‘পেডে ভাত নাই। সহ্য অয় কন?’ তারপর কাপড় তুলে পুকুরপাড়ের হাঁটুপানি ভাঙতে ভাঙতে নানা কথা। বাপের বাড়িতে কোনো দিন না খেয়ে থাকে নাই। আলি হোসেন রিকশার মেকারি করে যা কামায়, নেশাপানির পেছনেই ওড়ায়। রিকশার মেকারি মানে, মা ব্যাখ্যা করে বলে – চাক্কায় পাম্প দেয়, নাট-বোল্ট টাইট করে প্লয়ার্স দিয়ে। হাতের কাজও বেশ ভালো ছেলেটার। রিকশার পেছনে ফুল, লতাপাতা আঁকে। হুডে প্লস্টিকের ফুল কেটে বসায়। সবই মর্জিমাফিক। নেশাখোরেরা যেমন হয়। কিসের নেশা? গাঞ্জা। শিল্পীমানুষ, তা একটু-আধটু খেতেই পারে। কথাটা বলেই সাবিনার মনে পড়ে কিন্তু ফয়েল পেপার, বাঘমার্কা সিকি – এসব উপকরণ তো গঞ্জিকাসেবনে আবশ্যক নয়! মা জানে না – নেশার বস্ত্তটা হেরোইন। আর তা গাঁও-গেরামেও পৌঁছে গেছে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রিক খাম্বার সঙ্গে। আসমানি এখনো ভাবছে, শ্বশুরের নেশার জোগান দিতে গিয়ে আলি হোসেনের এ-পরিণতি। আসমানি ছেলের নেশাখুরির জন্য ইশারায় কাশেম মিয়াকে দায়ী করতে চাইলে সাবিনা না বোঝার ভান করে। মনে মনে ভাবে, যা আধ্যাত্মিক উড্ডয়নের বেলায় কাশেম মিয়ার জন্য আবশ্যক, তাতে আলি হোসেনের বখরা বসানোর হেতু কী। আর ও তো শুধু গাঁজাতে তুষ্টও নয়।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন সাবিনার শাড়ির কুঁচি মুঠো থেকে খসে পড়ে। নোংরা পানিতে ভিজে তা বস্তার মতো ভারী। হাঁটার সময় পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। সাবিনাদের দরজার সামনের ক্যাঙারু আকৃতির বেতের সাদা বার্নিশের চেয়ারটা খালি পড়ে আছে। নীহার বানু নিশ্চয় আসরের নামাজে দাঁড়িয়েছেন। সাবিনা রান্নাঘরে ঢুকে টিপে টিপে পাকা কাঁঠাল পরখ করে। শ্যামলা ডালে ফোড়ন দিচ্ছিল, আধবোজা চোখে বিরক্তিসহকারে তাকায়। আসমানি কাঁখে ও মাথায় দুটি কাঁঠাল তুলে নেয়। আরেকটাও নিত, সাবিনা বলে – আগামীকাল। আসমানি চলে গেলে, ও ভেজা কাপড়ে দুয়ারের সামনের বেতের ক্যাঙারুর পেটে গা ডুবিয়ে বসে থাকে।

অনেক দিন আগের ভুলে-যাওয়া একটা ঘ্রাণ যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিসের গন্ধ সাবিনা বুঝতে পারে না। বাতাসে ফের নাক টানে। ওর নিজের শরীরের ভেজা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ এটা। অবিকল সায়মা খাতুনের গায়ের ঘ্রাণ। তিনিই কি লুকিয়ে কাশেম মিয়ার বাড়ি কাঁঠাল পাচারের কাজটা করালেন সাবিনাকে দিয়ে?

এ-লুকোচুরির অবশ্য দরকার ছিল না। আগের মতো তো অভাব নাই সংসারে। এখন পাকা কাঁঠাল ঘরের গাই দুটিকে খাওয়ানো হয়। তবু নীহার বানু জানতে পারলে অভ্যাসবশত হয়তো বলবেন – দাদির খাসলত! যার কাছে আপন চেয়ে পর ভালো। পরের চেয়ে জঙ্গল।

দাদির আমলে এ-বাড়ি থেকে দুস্থ মানুষ খালি মুখে ফিরে নেই। হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে আপ্যায়ন করতেন সায়মা খাতুন – সে ফ্যান, জাউ, গাছের কাঁঠাল বা ক্ষেতের বাঙ্গি। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেবউই সংসারের কর্ত্রী। তখন খোলা উঠানের পঙ্ক্তিভোজ উঠে গেলেও আড়ালে-আবডালে পাতিলের ভাত হামেশাই পাচার হতো। এ-কাজে সায়মা খাতুনের ডান হাত ছিল চিলকন্যা। তখন তো টানাটানির সংসার, ভাতেরও হিসাব ছিল। ধরা পড়ে গেলে নীহার বানু কড়া কড়া কথা শোনাতেন – অভাব যাবে কীভাবে, এক সংসারের টাকায় যদি দুই সংসার চলে! তাঁর লাই পেয়েই কাশেম মিয়া উচ্ছন্নে গেছে। সায়মা খাতুনের জীবনের শেষ দিকে, সাবিনাও দেখেছে, তিনি গাল ভাসিয়ে কাঁদছেন। হয়তো কাশেম মিয়ার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তাঁর কান্না আসত অথবা দুর্ভিক্ষের বছরের সেই শরতের কাকভোরের দৃশ্যটি হয়তো চোখের জলে ভেসে উঠে তাঁকে ফের কাঁদিয়ে মারত। তিনি মৃত বাপের পাশ থেকে তুলে নিয়েছেন যে নিরন্ন শিশুকে, ওর খাওয়া-পরার দায় তাঁর। সে-শিশুটি জোয়ান মরদ কি পলিত কেশের বৃদ্ধ হয়ে গেলেও। এ যেন অলিখিত চুক্তি বা দলিল, এখন যা রক্ষা করার তাঁর তৌফিক নাই।

রান্নাঘর থেকে উতলানো ভাতের গন্ধ নাকে লাগতে সাবিনা নড়েচড়ে বসে। গন্ধটা কেমন যেন নেশাধরা! যদিও তা আগে কখনো ওর মনে হয়নি। তার জন্য হয়তো মহাদুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা লাগে। গন্ধ শুঁকে সায়মা খাতুন পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতেন। মাটির মালসায় উপুড় করে ভাতের ফ্যান ঝরানো হচ্ছে। উতলানো ভাতের বাষ্পীভূত গন্ধটা তখনো ভেসে বেড়াচ্ছে বর্ষার ভারী বাতাসে। ঘরের বাতার বেড়া ধরে বেঁকে-চুরে দাঁড়িয়ে আছে চিলকন্যা। কাপড়ের তলার উলটে ধরা এনামেলের বাটিতে ওকে পোয়াতির মতো দেখায়। নীহার বানু মাগরিবের নামাজে দাঁড়ালেই দুজন সক্রিয় হয়ে উঠবেন।

সাবিনার মনে হয়, নিজের ঘরের ভাত চুরি করার গস্নানি সায়মা খাতুনের না হওয়ারই কথা। তিনি জানতেন – ভাত কী বস্ত্ত, তা খেতে না পেলে মানুষের কী হয়। তেতালিস্নশের মন্বন্তর কী করে ভুলে যাওয়া সম্ভব, যেখানে তাঁর সামনে রয়েছে কাশেম মিয়া – তাঁর দুর্ভিক্ষের সন্তান! r