’৭১-এর গান : জানা-অজানা

একাত্তর সালে মার্চের উত্তাল সময়। সমগ্র দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের প্রমত্ত চেতনায় বলীয়ান হয়ে মিটিং, মিছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষকে উদ্দীপ্ত করছে স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষায়। এই আন্দোলনই কিছুদিনের মধ্যে আরো খরপ্রবাহিনী হয়ে পৌঁছে গেল মুক্তিযুদ্ধে। 

বরিশাল শহরে জেলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আমি। ঢাকায় তখনো সাধারণ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়নি। বরিশালের প্রথম সারির গানের স্কুল প্রান্তিক সংগীত বিদ্যালয়ের আমি কনিষ্ঠতম ছাত্র। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সে-সময় নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পাড়ার মাঠে সন্ধ্যায় গণসংগীত পরিবেশন করে আসন্ন সংগ্রামের জন্য সবাইকে উদ্দীপিত করতে সচেষ্ট। কনিষ্ঠ বলে তাঁদের সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ না হলেও মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানের মঞ্চে তাঁদের কাছাকাছি বসা হতো। বেশির ভাগ সময় যে-গানটি তাঁরা ধরতেন সেটি হলো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। এ-গানটি আমিও স্কুলে শিখেছিলাম। আমার কিশোরমনকে তা আলোড়িত করেছিল।

এর পরের কিছু ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। সারাদেশে সে-খবর দ্রুত ছড়িয়েও পড়ে। বরিশালে সব মানুষ তখন প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অনেকের মতো আমাদের পরিবারও শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। কারণ তখন বরিশালে পাকবাহিনীর আগমন ও আক্রমণ শুধু সময়ের ব্যাপার। সবার সঙ্গে সরাসরি গ্রামে না গিয়ে শহর থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে আমি আমার বোনের সঙ্গে রায়াপুর গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে প্রায় দু-সপ্তাহ অবস্থান করি। ঠিক হলো, সেখান থেকে আমার দুলাভাই আমাকে ও আমার বোনকে আমাদের দাদাবাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এই দু-সপ্তাহে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যা আমাকে আজো আপ্লুত ও গর্বিত করে। বোনের শ্বশুরবাড়ির সামনে বরিশাল-ঝালকাঠি রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে খোলা মাঠের সঙ্গেই রায়াপুর স্কুল। সেখানে ওই এলাকার তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রতিদিন বিকেলে গ্রামের এক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তাঁর সাধারণ একটি বন্দুক দিয়ে এসব ছেলেকে প্রশিক্ষণ দিতেন। আমি আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদিন সেখানে হাজির হতাম। প্রশিক্ষণ নয়, সেখানে আমার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। প্রতিদিন প্রশিক্ষণশেষে যখন সবাই খোলা মাঠে গোল হয়ে বসতো তখন প্রশিক্ষক সৈনিক আমাকে বলতেন, শামীম শুরু করো, আর আমি কচিকণ্ঠে ধরতাম ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়, হবে হবে হবে নিশ্চয়’। আমার গাওয়া সেই গান সবাই জড়ো হয়ে শুনতেন। বিদ্রোহের ওই একটি গানই আমার জানা ছিল। যে-কদিন রায়াপুরে ছিলাম ওই একই গান আমি তাঁদের প্রতিদিন শোনাতাম আর তাঁরাও একইভাবে নিশ্চুপ হয়ে তা শুনতেন। আজ অবাক হয়ে ভাবি, কী এমন শক্তি ছিল ওই গানে যা শুনে মুক্তিপাগল মানুষগুলো আবেগতাড়িত হতেন।

২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী বরিশাল আক্রমণ করে। আমাকে আর আমার বোনকে দাদাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রায়াপুরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকরা নিশ্চয়ই যার যার মতো মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন।  অনেকেই স্বাধীনতার পর ফিরে এসেছেন, কেউ কেউ হয়তো ফিরে আসেননি। কিন্তু একাত্তরের গানের সেই উপলব্ধি আগের মতোই আমাকে এখনো নাড়া দেয়।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল অনন্যসাধারণ। শুধু সামরিক ফ্রন্টে নয়, যুদ্ধ হয়েছিল নানা অঙ্গনে, একটা বড় পরিধি জুড়ে। সেই সংগ্রামের অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, নাটক ও চিত্রকলা চর্চা এবং বেতার সম্প্রচার, হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ, মিছিল ও সভা আয়োজন এবং বিমান ছিনতাইসহ আরো অনেক ঘটনা। এই সবকিছুর মধ্যে একাত্তরের সংগীত অর্জন করেছিল এক বিশেষ মাত্রা এবং প্রবাহিত হয়েছিল স্বতন্ত্র ধারায়। স্বাধীনতা অর্জনে সংগীতের ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিল না।  

বিষণ্ন চোখে বন্ধু এসেছিল আমার কাছে

ষাটের দশকের বিখ্যাত সংগীতগোষ্ঠী বিটলসের সদস্য জর্জ হ্যারিসন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের বন্ধু ছিলেন। হ্যারিসন রবিশঙ্করের কাছে সেতার বাদন শিখেছিলেন। একাত্তর সালে হ্যারিসন লস অ্যাঞ্জেলসে ‘রাগা’ (RAGA) শীর্ষক অ্যালবাম নিয়ে কাজ করছিলেন। রবিশঙ্কর সে-সময় হ্যারিসনকে জানালেন তিনি বাংলাদেশের নিপীড়িত ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি কনসার্ট আয়োজন করতে চান এবং এর জন্য তিনি হ্যারিসনের সহযোগিতা চাইলেন। এমন একটি কনসার্ট হবে যা সাধারণ কনসার্টের চেয়ে অনেক বড়। অন্তত পঁচিশ হাজার ডলার অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। রবিশঙ্কর চাচ্ছিলেন হ্যারিসন যেন অন্য শিল্পীদের এ-কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশের মানুষের অসহায়ত্ব, যুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে সে-সময় পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে যা খবর বেরিয়েছিল রবিশঙ্কর সেসব কাটিং সংগ্রহ করে হ্যারিসনকে দেখালেন, যাতে তিনি সংকটাকীর্ণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত হন। হ্যারিসন পুরো বিষয়টি অনুধাবন করে ভাবলেন, এই অসহায় মানুষের জন্য তাঁর কিছু একটা করা উচিত।

এরপর যা হলো তা হ্যারিসনের নিজের লেখাতেই আছে – 

… তিন মাস আমি টেলিফোন নিয়ে বসে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের জন্য এরিকসহ (এরিক ক্লাপটন) সকলের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা এটাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়েছিল। … আমরা খুব সামান্যই রিহার্সাল করতে পেরেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে একটি রিহার্সালে সবাই উপস্থিত – এমনটা কখনোই হয়ে ওঠেনি। নানা সমস্যার মধ্যে ভেঙে ভেঙে ছোট আকারে এটা  করতাম। অনুষ্ঠানটির জন্য একটি পিরিয়ড বেছে নিলাম, যার মধ্য থেকে একটি দিন বেছে নিতে হবে। একজন ভারতীয় জ্যোতিষী বললেন, এখন সময়টি শুভ এবং আগস্টের শুরুতে হতে পারে। তখন আগস্টের সঠিক দিনটি বেছে নিলাম, যেদিন ম্যাডিসন স্কয়ার খালি পাওয়া গেল এবং আমরা ওইদিনের জন্য ভাড়া করলাম।

[আই, মি, মাইন, জর্জ হ্যারিসন]

এর পরের ঘটনায় ইতিহাস রচিত হলো। দিনটি ছিল রোববার পয়লা আগস্ট। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে দুটো অনুষ্ঠানে হয়েছিল। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে ও রাত ৮টায়। অনুষ্ঠানের নাম রাখা হলো ‘The Concert for Bangladesh’। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লারাখ্খা, কমলা চক্রবর্তী প্রমুখ। এছাড়া ছিলেন এরিক ক্লাপটন, বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রেস্টন, লিয়ন রাসেল, রিংগো স্টার। পুরো অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আলী আকবর খাঁর সরোদ ও রবিশঙ্করের সেতার এবং সঙ্গে আল্লারাখ্খার তবলা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। তানপুরা বাজিয়েছিলেন কমলা চক্রবর্তী। দর্শক ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। যা ভাবা হয়েছিল তার অনেকগুণ বেশি দর্শকসমাগম হয়েছিল। দর্শক চাহিদার কথা ভেবে একই দিনে দুটো অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। শুরুতে রবিশঙ্কর ভেবেছিলেন ২৫ হাজার ডলার কনসার্ট থেকে তুলবেন; কিন্তু ঐতিহাসিক ওই কনসার্ট থেকে শেষ পর্যন্ত দুই লক্ষ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার ৫০ পেনি সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পুরো চেক তিনি বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্যার্থে ইউনিসেফের (United Nations Children’s Fund) কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। 

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নিয়ে তিনটি রেকর্ড সংবলিত যে অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছিল তা বিখ্যাত গ্র্যামি পুরস্কার অর্জন করে এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়, যা ইউনিসেফ-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। (সে-সময়ের গণনায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার) সেদিনের সেই কনসার্টে আর্থিক সহায়তা ছাড়াও এক প্রাপ্তি ছিল একটি নতুন দেশ ও তার সংগ্রামের কথা সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরা।

[from Raga Mala, The Autobiography of Ravi Shankar, edited and introduced by George Harrison; Pub Genesis Publications Ltd, Australia. 1997]

এ-কনসার্টে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের কিছু মন্তব্য থেকে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাফল্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় – 

এটা ছিল একটা চমৎকার বিষয় যা সবাইকে আলোড়িত করেছিল। একটা নিছক অনুষ্ঠান করার বিষয়টি পেরিয়ে সবার মধ্যে একটা বিশেষ অনুভূতি কাজ করছিল। রাতারাতি বিশ্বের সবাই বাংলাদেশের নামটির সঙ্গে পরিচিতি হলো।

– পণ্ডিত রবিশঙ্কর

ঘটনার মাধুর্য ছড়িয়ে পড়লো এবং দর্শক ছিল অভূতপূর্ব।

– রিংগো স্টার

এমন একটা সময়ে আমরা এখানে সংগীতশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলাম, এটা ভেবে সবসময় গর্ববোধ করবো। আমরা অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও নিছক নিজেদের নিয়ে ভাবিনি।

– এরিক ক্লাপটন

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা ছিল এক মহান অভিজ্ঞতা।

– লিয়ন রাসেল

জর্জ হ্যারিসনের বড় সাফল্য যে, এই মহৎকাজে তিনি সব নামী শিল্পীকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। হ্যারিসনের ভাষায় –

সংগীতশিল্পীরা তাদের নিজস্ব অহংবোধ সরিয়ে রেখে সবাই একত্রিত হয়েছিল। সবার মাঝে কনসার্টের মূল অনুভূতি হিসেবে এমন ভাবনা কাজ করছিল যে, এটা তাদের সমষ্টির চেয়ে অনেক বড় মহান কিছু তারা করছে।

বিষয়টা আমেরিকার সাধারণ জনগণকে এতোটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, হ্যারিসনের ভাষায় –

শিশুরা ও জনগণ এতোটাই অনুপ্রাণিত হলো যে, তারা একটা কিছু করতে চাইছিল। তারা টাকা সংগ্রহ করতে লাগলো এবং ইউনিসেফের দফতরে তা জমা করলো। তারা জানতে চাইছিল যে, সাহায্যের জন্য তারা আর কী করতে পারে।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান (Kofi Annan) এ-সম্পর্কে মন্তব্য করেন ‘এটা ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা এবং এর পর থেকে এমন আয়োজন খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও সেই সময় সেটা ছিল অতুলনীয় এবং সাহসী পদক্ষেপ। তাঁরা ছিলেন পথিকৃৎ।’

জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন উল্লেখ করেছেন – ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ রক সংগীতের ইতিহাসে ছিল একটা অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী মানবিক কার্যক্রম।’

‘The Concert for Bangladesh’ শিরোনামে কনসার্টটির প্রথম অ্যালবাম আমেরিকাতে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। পরের বছর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অ্যালবামটি যুক্তরাজ্যে বের হয়। অনন্যসাধারণ এই কনসার্ট পরবর্তীকালে সিডি, ডিভিডি আকারেও প্রকাশিত হয়।

কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘ইধহমষধ উবংয’-এর কয়েকটি লাইন ছিল এরকম –

My friend came to me,  
with sadness in his eyes

Told me that he wanted help

Before his country dies

Although I couldn’t feel the pain, I knew I had to try 

Now I’m asking all of you

To help us save some lives

      Bangla Desh, Bangla Desh.

যখন সূর্য পশ্চিমে অস্তমিত – বাংলাদেশ : নিউইয়র্কের জোয়ান বায়েজ, লিভারপুলের লিব্রোনান ও এসেনের জুলিয়ান ওয়ারডিং

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমে অন্তত তিনজন সংগীতশিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে তাঁদের রেকর্ড বের করেন। আমেরিকার বিখ্যাত ফোক সংগীতশিল্পী জোয়ান বায়েজের ‘সং অব বাংলাদেশ’ গানটি সেই সময়ে বিশ্বের সাধারণ জনগণের সমর্থনপ্রাপ্তিতে একটি ভালো ভূমিকা রেখেছিল।  

জোয়ান শ্যান্দজ বায়েজ (Joan Chandos Baez) ১৯৪১ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত-ইতিহাসে ‘ফোক সিঙ্গার’ হিসেবে তিনি বিশেষ এক মর্যাদায় আসীন। বিশ্বশান্তি ও মানবতার পক্ষে তিনি কাজ করেছেন, গান গেয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা ও তাদের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বায়েজ। 

বাংলাদেশের জন্মলগ্নে অবিচার আর আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশের মধ্যে ও বাইরে যে-সশস্ত্র যুদ্ধ চলছিল, তার পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে সংগীতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ আর মুক্তিসংগ্রামী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার আরেক যুদ্ধ। ‘জোয়ান বায়েজের গাওয়া ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি সাত কোটি বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধকালে কষ্ট, ত্যাগ, মৃত্যু এবং সংগ্রামের মধ্যে করেছিল অনুপ্রাণিত; জুগিয়েছিল মানসিক শক্তি।’

জোয়ান বায়েজের ‘Song of Bangladesh’-এর প্রথম কয়েকটি লাইন এরকম –  

Bangladesh, Bangladesh

Bangladesh, Bangladesh

When the sun sinks in the

                                      west

Die a million people of the Bangladesh.

একাত্তর নিয়ে বিদেশে যেসব গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল তার মধ্যে তিনটি খুব নাম করেছিল –  ‘Concert for Bangladesh’, জোয়ান বায়েজের ‘Song of Bangladesh’ এবং জর্জ হ্যারিসনের ‘Bangladesh’।

বিখ্যাত এই গায়কদের পাশাপাশি আরো অন্তত দুজন ইউরোপীয় সংগীতশিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে গান গেয়েছিলেন এবং সেগুলোর রেকর্ডও বেরিয়েছিল। একজন হচ্ছেন লিভারপুলের (Liverpool) গায়ক ও কবি লি ব্রেনান (Lee Brennan)। একাত্তরের মার্চে ঢাকায় নিরীহ জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ ব্রেনানকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করার একটা পথ খুঁজতে তিনি লিভারপুলের বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ  করেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক মাহবুবুর রহমান ব্রেনানের পূর্বপরিচিত ছিলেন। তিনি পরামর্শ দেন যে, একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে ব্রেনান গান গেয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করতে পারেন। আর ব্রেনান ঠিক তা-ই করেছিলেন। বাংলাদেশের জন্য তিনি চারটি গান রচনা করেন এবং সেগুলোর একটি রেকর্ডও প্রকাশ করেন। সেখানেই তাঁর কাজ থেমে থাকেনি। তিনি তাঁর দল নিয়ে লিভারপুলের বিভিন্ন পাব (চঁন) ও রেস্টুরেন্টে গানগুলো গেয়ে বাংলাদেশের দুর্দশার প্রতি মানুষকে সচেতন করতে সচেষ্ট ছিলেন।  তাঁর একটি গানের পঙ্ক্তি – 

Come brothers and sisters

 
                    of Bangladesh

Unite together and stay

 
                             that way.

And rememeber the good

 
                                  times

Are coming at last

The freedom fighters are

 
                      on their way

শ্রোতাদের ব্রেনান অনুরোধ করতেন, যদি গান ভালো লাগে তবে তারা যেন রেকর্ডটি সংগ্রহ করেন। রেকর্ড বিক্রির টাকা নিজেই সংগ্রহ করে তুলে দেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর হাতে। আবু সাইদ চৌধুরী সে-সময় লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।   

ব্রেনানেন গানসংবলিত রেকর্ডটি দুষ্প্রাপ্য। বাংলাদেশে তাঁর একটিমাত্র কপি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত আছে। সেটি দান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মাহবুরর রহমান। ৪৫ আরপিএমের রেকর্ডটিতে মোট চারটি গান ছিল।    

(Side A) : Freedom Fighters

এবং Mr. Human

(Side B) : Fight, fight

এবং We will survive

রেকর্ডটির খোলসে (Sleeve) বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর একটি বার্তা মুদ্রিত আছে – 

বাংলাদেশের জনগণ সত্য ও ন্যায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে। বিজয় আমাদের হবেই। আমাদের চরম সংগ্রামে লি ব্রেনান, ডন, পেট থমাস, জন ব্রাউন, জিমি সেফ্টন – তাঁদের সহানুভূতি ও সহযোগিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

– আবু সাইদ চৌধুরী

বিশেষ প্রতিনিধি

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

লি ব্রেনানের পাশাপাশি জার্মান তরুণী জুলিয়ান ওয়ারডিং (Juliane Werding) একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে গান গেয়েছিলেন। ওয়ারডিং জার্মানির এসেন (Essen)-এ ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সত্তরে গায়ক হিসেবে সবেমাত্র তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। পরবর্তীকালে অবশ্য জার্মান পপগানের একজন জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তাঁর একটি গান জার্মান পপগানের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে এবং পরে প্রায় চৌদ্দ সপ্তাহ ধরে শীর্ষ দশের তালিকায় স্থান করে নেয়। ওয়ারডিংয়ের ‘বাংলাদেশ’ গানটি রেকর্ড আকারে প্রথমে ১৯৭২ সালে জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়।  

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র  

একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বেতার থেকে প্রচারিত অগ্নিঝরা গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল মানুষকে করেছিল সংঘবদ্ধ ও প্রাণিত। সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি গান-বাজনাকে ভরসা করে চলেছিল রাজনৈতিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার আরেক সংগ্রাম। 

সে-সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকে কেন্দ্র করে বহু অমর গান রচিত হয়। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ – এসব গান গোবিন্দ হালদারের অমর সৃষ্টি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে তোলার পেছনে রয়েছে রেডিও কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, সংগঠক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, কলাকুশলী ও সাধারণ মানুষের অক্লান্ত শ্রম।

বিচিত্র এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গানগুলো সৃষ্ট হয়। প্রথমদিকে বেতার কেন্দ্রে, যুদ্ধের আগে ধারণ করা (Recorded Songs) গানই বেশিরভাগ সম্প্রচার করা হতো। রেডিও কর্তৃপক্ষ ভাবলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের উপযোগী নতুন কিছু গান প্রয়োজন। দায়িত্ব দেওয়া হলো বার্তা সম্পাদক কামাল লোহানীকে। তিনি বিষয়টি তাঁর কলকাতাবাসী বন্ধু কামাল আহমেদকে জানালেন আর তার কিছুদিন পর আহমেদ তরুণ গীতিকার গোবিন্দ হালদারকে নিয়ে বেতার কেন্দ্রে এলেন। হালদার স-সংকোচে তাঁর গানের দুটি ডায়েরি লোহানীর হাতে তুলে দিলেন। লোহানীর ভাষায়, গোবিন্দ যেন ‘সেভিয়ার’-রূপে আবির্ভূত হলেন। গোবিন্দ হালদারের সাদা গানের খাতার মলাটে বড় করে লেখা ছিল ‘জয় বাংলার গান’। গানের কথাগুলো যেন যুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। এরপর যা ঘটেছিল তা তো ইতিহাস, যার সাক্ষী ভাগ্যবান কিছু মানুষ, যাঁরা একাত্তরের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। লোহানী শিল্পী ও সুরকার আপেল মাহমুদ এবং সংগীত পরিচালক সমর দাসকে অনুরোধ করলেন গোবিন্দ হালদারের গানগুলো নিয়ে কিছু করার জন্য। আপেল মাহমুদ তাৎক্ষণিক সুরারোপ করে গাইলেন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’ কিছুদিনের মধ্যেই রেডিও তরঙ্গে ভেসে এলো গানটি। মুখে, মনে, আবেগে সে-গান উচ্চারিত হলো রণাঙ্গনে থেকে রণাঙ্গনে, সারা বাংলায়। জাগিয়ে তুললো সবাইকে। সমর দাসের সুরে সৃষ্ট হলো কালজয়ী গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’। একের পর গাওয়া হলো মোহনীয় সব গান। ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ বিজয়ের পরই যুদ্ধে শহিদদের স্মরণে গোবিন্দ হালদার লিখলেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।’ বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরের প্রারম্ভিক-সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই গানটি এখনো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। প্রয়াত শিল্পী আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহিদ স্মরণে’ ও ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে’ গানগুলোর সঙ্গে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পরপরই বেজে ওঠে সুজেয় শ্যামের সুর করা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। গানটির প্রথম প্রচারের মুহূর্তের স্মৃতি সুজেয় শ্যামকে আজো আবেগতাড়িত করে। সময়ের সঙ্গে এসব ঐতিহাসিক গানের আবেদন একটুও ক্ষুণ্ন হয়নি। সেই সময় সর্বাধিক প্রচারিত হয় যে-গানটি তা সম্ভবত ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। গানটি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের প্রারম্ভিক-সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’ এবং অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’, গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ও ‘চল্ চল্ চল্’, নাঈম গওহরের লেখা ‘নোঙ্গর তোল তোল’, সমর দাসের সুরে ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’, আবুল কাসেম সন্দীপের লেখা ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান’ – আগ্নিঝরা সময়ের এই অনবদ্য গীত-সৃজনের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক শক্তিশালী উপাখ্যান।

আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফুর রহমান, অজিত রায়, সুখেন্দু চক্রবর্তী, মাহমুদুন নবী, ইকবাল আহমেদ প্রমুখ বহু গানে সুর দিয়ে জনগণের সংগ্রামে উদ্দীপিত এক বোধ সৃষ্টি করেছিলেন। কিছু গান ছিল সলিল চৌধুরীর ও গণনাট্য সংঘের সুরারোপিত। কালের প্রবাহে গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংগ্রামকে দীপিত করার জন্য এই গান সে-সময় সত্যিকার অর্থে এক মাত্রা সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ও নজরুলের গানও সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই পূর্ণতা পেত না।  

পথের গান 

সীমান্ত এলাকায় ও পশ্চিম বাংলায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নানা শ্রেণির মানুষ এবং যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীকে অনুপ্রেরণা জোগাতে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। শিল্পী শাহীন সামাদ তাঁর একটি নিবন্ধে লিখেছেন –

আমরা তখন মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াচ্ছি গান গেয়ে শোনাচ্ছি, দিন রাত ঘুরে বেড়ানো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন, নাওয়া-খাওয়া ঠিক নেই এমনি অবস্থা, সবাই আমাদের সানন্দে স্বাগত জানাচ্ছে। আমাদের মতো আর কয়েকটি দলও একই রকমভাবে কাজ করে যাচ্ছিল মুক্তাঞ্চলে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে কত ঝুটঝক্কি। তারপরও একেকটি অনুষ্ঠান কি যে অপরূপ জীবন্ত হয়ে উঠতো। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতো। বলতে গেলে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার ট্রাকই হয়ে উঠলো আমাদের জীবন ঘর-বাড়ি। ট্রাকেই খাওয়া, ঘুম, হাতমুখ ধোয়া, কাপড়-চোপড়ের করুণ দশা। ভ্রাম্যমাণ ক্যারাভানে শত সমস্যার মাঝেও ছিল অনাবিল এক আনন্দময় প্রেরণার জীবন। খোলা আকাশের নিচে এক চাদরে গা জড়িয়ে রাত যাপন যেন একটি পরিবার। এমনি করেই কাটছিল সময়, দিন, রাত্রি।

সেই সময় এই দলটির সঙ্গে আমেরিকান আলোকচিত্রী/ চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিনের (Lear Levine) পরিচয় হয়। লেভিন তখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন বলে ভারতে এসেছিলেন। ইতোমধ্যে দেশ স্বাধীনতা লাভ করায় লেভিন চলচ্চিত্রটি তৈরি না করলেও দীর্ঘকাল পর তাঁর সেসব ফুটেজ ব্যবহার করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার প্রয়াত তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছিলেন মুক্তির গান ছবিটি। এই অসামান্য আখ্যানে আছে ইতিহাসের সব উপাদান। কলকাতার ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’র চেষ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের নিয়ে কলকাতার ১৪৪ লেনিন সরণিতে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লেনিন সরণিতে জড়ো হয়ে এ-দেশের সংগীতশিল্পীরা রূপান্তরের গানের মহড়া শুরু করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে গণঅভ্যুথানকালে ও পরবর্তী সময়ে যে-সব গান হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের সঙ্গী সেসব গানকে আরো পরিশীলিতভাবে তাঁরা পরিবেশন করেন শরণার্থী শিবিরে ও পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় শিবিরে। উদ্বাস্তুরা এতে খুবই উজ্জীবিত হন। শুধু উদ্বাস্তু শিবির নয়, দলটি মুক্তঞ্চলেও গেছে। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা এই দলের সান্নিধ্যে ও গানে প্রেরণা পেয়েছেন। সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সন্জীদা খাতুন, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বেণু। শাহীন সামাদের  ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথম দিকে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৭, আর শেষ পর্যন্ত সেটা দাঁড়ায় ১১৭-তে। শান্তিনিকেতন ও কলকাতার মহাজাতি সদনসহ দলটি বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

নাট্যনির্দেশক ও চিত্রশিল্পী মোস্তফা মনোয়ার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, মহাজাতি সদনে বাংলাদেশের দলের পরিবেশনার পর কলকাতার প্রখ্যাত গণসংগীত গোষ্ঠী ক্যালকাটা কোয়ারের অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। বাংলাদেশের অংশের উপস্থাপনা এতটাই সার্থক ও মানসম্পন্ন হয়েছিল যে এর পর ক্যালকাটা কোয়ারের প্রধান রুমা গুহঠাকুরতা দল নিয়ে মঞ্চে উঠতে রীতিমতো দ্বিধা করছিলেন। মোস্তফা মনোয়ার দিল্লী টেলিভিশনে একটি সংগীতানুষ্ঠান আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে সংগীত পরিবেশনা, পেছনের ব্যাকড্রপ, সজ্জা ও আলোকসম্পাতের জন্য শিল্পী সংস্থা বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠনও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ব্যারিস্টার বাদল রশিদের নেতৃত্বে চৌদ্দ সদস্যের একটি সাংস্কৃতিক দল অর্থ সংগ্রহের জন্য ভারতের বোম্বে, গোয়া, পুনা, কানপুরসহ বিভিন্ন শহরে গণসংগীত পরিবেশন করে। এই দলের সদস্য ছিলেন আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, স্বপ্না রায় প্রমুখ। শিল্পী নমিতা ঘোষের লেখায় জানা যায়, এই অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেছিলেন বোম্বের বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান। সংগীত পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীসহ অনেকে। সংগীত পরিচালক বাপ্পী লাহিড়ীও বোম্বেতে বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে তবলা বাজিয়েছিলেন। সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ব্যানারেও অনেক সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

শরণার্থীদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ ও ভারতের সংগীতশিল্পীরা যৌথভাবে কলকাতার জোড়াবাগান পার্ক, স্কুল কলেজ, পার্ক সার্কাস মাঠে এবং রবীন্দ্রসদনে বিচিত্রানুুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বাংলাদেশের শিল্পীদের পাশে ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলামের দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনুরুদ্ধসহ আরো অনেকে।

নমিতা ঘোষ একাত্তরের জন্য শেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল ১০টায়, প্রিয়া সিনেমা হলে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী-নিবেদিত বিক্ষুব্ধ বাংলা বিচিত্রানুুষ্ঠানের মাধ্যমে তা শেষ হয়। বুলবুল মহলানবীশ একাত্তরের জন্য সমবেত কণ্ঠে গাওয়া তাঁর শেষ গানটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন – ‘সবার ভেতরেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। চারটা কখন বাজবে। আমাদের গানও রেকর্ড করতে হবে তার আগে। বিজয় ঘোষণার প্রথম মুহূর্তেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাজানো হবে সেই গান।

বিজয় নিশান উড়ছে ঐ

খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে।

বাংলার ঘরে ঘরে

মুক্তির আলো ঐ ঝরছে।’

এই গানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইলেন শহীদুল ইসলাম, সুজেয় শ্যাম ও অজিত রায়। 

একাত্তরে সাধারণ মানুষের মনে সংগীতের প্রভাব কেমন ছিল?  একাত্তরে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কলকাতায় শরণার্থী শিবিরে কর্মরত অক্সফামের (ঙীভধস) কর্মকর্তা জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে ২০১২ সালে ঋৎরবহফং ড়ভ খরনবৎধঃরড়হ ডধৎ ঐড়হড়ঁৎ সম্মানে ভূষিত করে। শরণার্থী শিবিরে কর্মরত ডাক্তাররা ফ্রান্সিসকে জানিয়েছিলেন, হতাশা ও দুঃখ-দুর্দশায় দিন দিন শরণার্থীদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। ডাক্তারদের ধারণা ছিল, শরণার্থী ক্যাম্পে একটি করে হারমোনিয়াম ও একজোড়া তবলা দিলে হয়তো ক্যাম্পবাসীর মন উৎফুল্ল থাকবে আর সেইসঙ্গে তাঁদের শারীরিক অবস্থারও উন্নতি ঘটবে। ক্যাম্পের বাসিন্দা বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমীর পাল ফ্রান্সিসকে কিছু বাদ্যযন্ত্র জোগাড় করার জন্য অনুরোধ করলেন। ফ্রান্সিস ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শ না নিয়ে সরাসরি নিজেই প্রতিটি ক্যাম্পে একটি হারমোনিয়াম ও এক জোড়া তবলার ব্যবস্থা করেন। সমীর পালের কাছে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের উৎস আর তাই সমগ্র যুদ্ধের চেয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ কোনো অংশেই কম নয়। 

কোনো এক বর্ষার দিনে সমীর পাল জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে বললেন, ‘চারদিকে তাকিয়ে দেখুন জুলিয়ান ভাই, আমাদের কিছুই নেই, আবার আমাদের সবই আছে। আমাদের আছে সংগীত, স্বপ্ন আর শ্রদ্ধা। আমাদের প্রতি আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং আমাদের প্রতি আপনপা আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

এর কয়েক মাস পর কলকাতার গোবরডাঙ্গা ক্যাম্পের ডাক্তাররা ফ্রান্সিসকে জানান যে, শরণার্থীদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।