শুভবুদ্ধি ও মুক্তজ্ঞানের কিংবদন্তি এক সাধকের কথা

বিশ্বজিৎ ঘোষ
কাজী মোতাহার হোসেন : মুক্তজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ
আবুল আহসান চৌধুরী
শোভা প্রকাশ
ঢাকা, ২০১৯
৪০০ টাকা

বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিজ্ঞানসাধনা আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার ইতিহাসে চিরকালের উজ্বল এক নাম কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১)। মনীষী এই জ্ঞানতাপস প্রকৃত প্রস্তাবেই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং সর্বসংস্কারমুক্ত একজন আধুনিক মানুষ। জ্ঞানস্পৃহা ছিল তাঁর মজ্জাগত। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিল তাঁর সংযোগ। সাহিত্য ও বিজ্ঞানসাধনায় তাঁর অবদান দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রসারিত। সংখ্যাবিজ্ঞানে তাঁর সন্দর্ভ ‘Hussain’s Chain Rule’ জগৎজোড়া স্বীকৃতি পেয়েছে। সাহিত্য ও সংগীত সাধনায় কাজী মোতাহার হোসেনের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা সবিশেষ লক্ষণীয়। নিজস্ব মত প্রকাশে তিনি সর্বদা ছিলেন নির্ভীক। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও ভালোবাসা আমাদের ইতিহাসের অনুষঙ্গ। স্মরণ করা যায়, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা – না উর্দু? শীর্ষক পুস্তিকায় আজ থেকে তিহাত্তর বছর পূর্বে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি লিখছেন এই কথা :
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবশ্যই দুটি রাষ্ট্রভাষা হতে পারে, এবং তাই স্বাভাবিক। রাশিয়ায় জনমতের প্রাধান্য আছে, অর্থাৎ জনগণই প্রকৃত রাজা, তাই জোর করে ভিন্ন প্রদেশের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার মতো মনোবৃত্তি সেখানে মাথা তুলতে পারে না। আমাদের দেশেও নূতন পাকিস্তান রাষ্ট্রে, জনগণ প্রমাণ করবে যে রাজা-উপাধিধারীদের জনশোষণ আর বেশি দিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে। জনমতের দিকে লক্ষ্য রেখে ন্যায়সঙ্গত এবং সমগ্র রাষ্ট্রের উন্নতির সহায়ক নীতি ও ব্যবস্থা অবলম্বন করাই দূরদর্শী রাজনীতিকের কর্তব্য।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের আরবি হরফে বাংলা লেখার তীব্র বিরোধিতা করেছেন কাজী মোতাহার হোসেন। বাংলা ভাষার উন্নতি এবং সমৃদ্ধির জন্য তাঁর ভাবনা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে তাঁকে একজন সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও সহজেই শনাক্ত করা যায়। কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন : ‘…পণ্ডিতদের হোক, সমাজপতিদেরই হোক অথবা রাজনীতিকদেরই হোক, কারও নির্দেশমত ভাষার কোনও স্থায়ী সংশোধন বা সমৃদ্ধি লাভ হয় না – হবে না। এরূপ অবাঞ্ছিত ও আত্মঘাতী হস্তক্ষেপের ফলে দেশবাসীর চিন্তাশক্তিতে বাধা পড়বে, ভাবের স্বাধীনতা ব্যাহত হবে, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যজনিত আনন্দের অভাব হবে।’
আকৈশোর সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক কাজী মোতাহার হোসেন একজন লেখক হিসেবেও রেখেছেন অনন্য কৃতির স্বাক্ষর। তাঁর পাঠের পরিধি ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ – লেখার বিষয়ও ছিল বহুমুখী। প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, স্মৃতিগদ্য লেখক, ক্রীড়া-গবেষক – এভাবে সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে। বিজ্ঞান-বিষয়ক তাঁর বই Collected Volume of Statistical Works দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও তাঁর জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। দাবা এবং লন টেনিস খেলায় তাঁর দক্ষতা কিংবদন্তিতুল্য। এদেশে দাবা খেলাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংগীতসাধনায় কাজী মোতাহার হোসেন রেখেছেন অতুল কীর্তির স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম – বাংলা সাহিত্যের এইসব প্রধান লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করেন কাজী মোতাহার হোসেন। অনেক লেখকের সঙ্গেই ছিল নিবিড় সখ্য। সামাজিক মনস্বিতা বলতে যা বোঝায়, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তার উজ্জ্বল প্রতিনিধি।

দুই
কাজী মোতাহার হোসেনের ১২০তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে তাঁর জীবন ও সাধনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণাগ্রন্থ কাজী মোতাহার হোসেন : মুক্তজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ (২০১৯)। ‘জীবন ও কৃতির সন্ধানে’, ‘মুক্তচিন্তার মনস্বী’, ‘বিজ্ঞানের ভুবনে’, ‘মননচেতনার ভাষ্য’, ‘মার্জিনে মন্তব্য ও আরজ-দর্শন’, ‘স্মৃতিকথন অথবা রম্য জীবনভাষ্য’, ‘অন্তরঙ্গ-আলাপ’, ‘পত্রালির স্মৃতি’, ‘একটি গ্রন্থ-ভূমিকা ও তার টীকা-ভাষ্য’ – এসব লেখা নিয়ে গড়ে উঠেছে আলোচ্য গ্রন্থ। এই মূল লেখাগুলোর সঙ্গে আছে কাজী মোতাহার হোসেনের দশটি অগ্রন্থিত রচনা, তাঁর বিস্তৃত জীবনপঞ্জি এবং সংস্কৃতিসাধক-আত্মজা সন্‌জীদা খাতুন সংকলিত কাজী মোতাহার হোসেনের নানা খসড়া ও তথ্যদলিলের প্রতিলিপি।
‘জীবন ও কৃতির সন্ধানে’ শীর্ষক প্রথম রচনায় আবুল আহসান চৌধুরী নিপুণভাবে নয়া তথ্যের আলোকে কাজী মোতাহার হোসেনের জীবন ও সাধনার বিশদ পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই অংশ পাঠ করলে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কাজী মোতাহার হোসেনের সামূহিক পরিচয় পাঠকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কাজী মোতাহার হোসেন – এই নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একজন সরল, নির্মোহ, নিরহংকার, আত্মভোলা, জ্ঞানস্পৃহ, পাঠমগ্ন মানুষের প্রতিকৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মার্জিত-রুচির ও শান্ত-স্বভাবের সৌম্য দর্শন এই মনীষী জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানান্বেষণেই জীবন কাটিয়েছেন। এই আত্মসমাহিত রূপের পাশাপাশি সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার সূত্রে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকার পরিচয়ও মেলে। … এই অনলস বাণীসাধক জ্ঞানানুশীলনের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্বৎসমাজে আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। সৎ, সত্যপ্রিয়, গুণগ্রাহী, কর্তব্যপরায়ণ, মানবপ্রেমী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, আদর্শনিষ্ঠ – এ সমস্তই তাঁর চরিত্রের মহৎ গুণ।
সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দের সাধক এই আপনভোলা মানুষটি তাঁর অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে আমাদের সমাজে একজন সর্বপ্রিয় নিঃশত্রু জ্ঞানতাপস হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন।
গ্রন্থভুক্ত অন্য লেখাগুলোতে প্রথম লেখারই কোনো কোনো বিষয় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের লেখা বলে অনেক ক্ষেত্রে সামান্য পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে কাজী মোতাহার হোসেনের সক্রিয় ভূমিকার কথা গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ-বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য-উৎস উল্লেখ করেননি, কিংবা বিশদভাবে কিছু বলেননি। বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী মোতাহার হোসেনের যে-সাক্ষাৎকারটি এখানে গ্রথিত হয়েছে, তাতে একটি তথ্যভ্রান্তি রয়েছে। সাক্ষাৎকারে কাজী মোতাহার হোসেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষপাতী বলে উল্লেখ করেছেন, যা ঠিক নয়। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে যখন এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল পাকিস্তানি সরকার, তখন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। বিষয়টি গুরুতর এবং ইতিহাস-অনুষঙ্গ বিধায় এ-সম্পর্কে গ্রন্থকারের মন্তব্য খুব জরুরি ছিল। এটা তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে বলে বিবেচনা করি।
কাজী মোতাহার হোসেনের জীবন ও কর্মের নানা প্রান্ত জানতে আবুল আহসান চৌধুরীর এ-বই পাঠকের সামনে বিস্তার করবে সহযোগের হাত – এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এমন একটি গ্রন্থ রচনার জন্য নিষ্ঠ গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।