আবুল হাসনাত : শিল্পলেখক ও সম্পাদক

হাসনাতকে নিয়ে আমাকে এরকমভাবে লিখতে হবে ভাবতেও পারিনি, বরং উলটোটাই মনে হতো ইদানীং মাঝে মাঝে। গত কয়েক মাসে হাসনাতের আহ্বানে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও শিল্পী মুর্তজা বশীরের মৃত্যুতে। দুজনেই এক পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুজনেরই বয়স আশি পেরিয়েছিল, আনিসুজ্জামান ৮৩, মুর্তজা বশীর ৮৮। তবে বেঁচে থাকলে তাঁরা দুজনেই এদেশের সাহিত্য ও শিল্প জগতে আরো অনেক অবদান রাখতে পারতেন। আমি নিজে আশিতে পদার্পণ করেছি বছর-দেড়েক আগে। পুরোপুরি সুস্থ থাকি না, এপ্রিলের শেষ দিকে করোনার অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম। তখন মনে হতো আমার মৃত্যু হলে হাসনাত হয়তো কালি ও কলমে আমার উদ্দেশ্যে একটি ছোটখাটো রচনা লিখবে। এ-বছরই ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশিত পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়জনদের নিয়ে আমার লেখা শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শুভেচ্ছা প্রবন্ধ সংকলনটি (এপিপিএল, ২০২০) উৎসর্গ করেছিলাম এক প্রিয় বাল্যবন্ধু আবদুল হামিদ ও স্নেহভাজন আবুল হাসনাতকে। হাসনাত বইটি হাতে পেয়ে অতিবিনয়ের সঙ্গে ছোট করে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অল্পকথার মানুষ।

মোবাইলে কথা হয়েছিল। তাঁকে আরো বলেছিলাম, ‘হাসনাত আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার সম্পাদনায় দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী, গণসাহিত্য, কালি ও কলম, শিল্প ও শিল্পী ও একাধিক প্রবন্ধ সংকলনে প্রকাশিত আমার রচনাগুলো নিয়ে একটি সংকলন করবো। গোটা পঁচিশ-তিরিশ হয়তো হবে। প্রায় সবই শিল্পকলা বিষয়ক, কয়েকটি নগরায়ণ নিয়ে।’ ‘কি যে বলেন, নজরুল ভাই’, ছিল হাসনাতের সলজ্জ প্রতিক্রিয়া।

আবুল হাসনাত আমার অনুজপ্রতিম, অত্যন্ত স্নেহভাজন। ওঁর জন্ম ১৯৪৫, পুরনো ঢাকায়, আমার জন্ম ১৯৩৯-এর এপ্রিল মাসে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার ভেদরগঞ্জের চরাঞ্চলের এক অজগ্রামে। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে থেকে আমিও ঢাকাবাসী, পুরনো ঢাকার ঠাটারীবাজার এলাকার কাপ্তানবাজার দিয়ে শুরু। ১৯৫১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম তৎকালীন প্রিয়নাথ স্কুলে, দু-মাসের মধ্যে সেটি সরকারি হয়ে যায়, নতুন নামকরণ হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট স্কুল। হাসনাতও এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন, বোধহয় ১৯৫৩ সাল থেকে, তখন তৃতীয় শ্রেণিতে। হাসনাতের প্রিয় বন্ধু এখনকার প্রখ্যাত সম্পাদক মতিউর রহমান তার সহপাঠী। মতিও আমার অতিপ্রিয় একজন। ওর বড় দু-ভাই রেজাউর ও (অকাল প্রয়াত) লুৎফর, ওরাও এই স্কুলেই পড়ত। লুৎফর ছিল আমার বন্ধু। স্কুলে হাসনাত ও মতিউর আমার পাঁচ বছরের জুনিয়র, আনিসভাই (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) ছিলেন এই স্কুলেই আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র, তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৫১ সালে। আনিসভাই, আমি ও হাসনাত আমরা তিনজনই একই মহল্লাবাসী ছিলাম, ঠাটারীবাজার মহল্লার, অবশ্য তখন আমাদের তিনজনের মধ্যে সেরকম যোগাযোগ ছিল না, হাসনাত তো তখন খুবই ছোট। আনিসভাই থাকতেন বিসিসি রোডে, আমি কাপ্তানবাজার রোডে, হাসনাত যোগীনগর লেনে। এসবের  খুব কাছেই ছিল প্রিয়নাথ/ নবাবপুর স্কুল।

হাসনাত তাঁর আত্মজীবনী হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে (জার্নিম্যান, ২০২০) গ্রন্থে যোগীনগর, বনগ্রাম ও ঠাটারীবাজার এলাকার অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। সত্যিই অতুলনীয়। বোধহয় বনগ্রাম লেনেই একসময়ে বসবাস করতেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু, সেখানে কাজী নজরুল আসতেন, গানের আসর বসাতেন, এক রাতে তাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি মহল্লার গুণ্ডাদের মুখোমুখি হন ও তাদেরই লাঠি কেড়ে নিয়ে আচ্ছা করে শায়েস্তা করেছিলেন। হাসনাতের বর্ণনায় পঞ্চাশের দশকের বনগ্রাম, যোগীনগর, ঠাটারীবাজার আমার কাছে খুবই জীবন্ত হয়ে ওঠে।

মুর্তজা বশীর নবাবপুর স্কুলের ড্রইং টিচার হয়ে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে, বছরখানেক ছিলেন। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। হাসনাত বোধহয় চতুর্থ শ্রেণিতে। মুর্তজা বশীর করোনাকালে মারা গেলেন (কি আশ্চর্য, ১৫ আগস্টে)। করোনাকালেই মৃত্যুবরণ করেন নবাবপুর স্কুলের আরেক (স্বল্পকালীন প্রাক্তন) ছাত্র (জাতীয় অধ্যাপক) জামিলুর রেজা চৌধুরী। জামিল স্কুলে আমার এক বছর জুনিয়র ছিলেন, মতির ভাই লুৎফরের সহপাঠী। পরে প্রকৌশল কলেজেও তাঁরা সতীর্থ। জামিলুর রেজা করোনাকালে, তবে কোভিডে নয়, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন, ২৮ এপ্রিল। জামিলুর রেজা চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও মুর্তজা বশীর – এই তিন জাতীয় ব্যক্তিত্বকেই আমি নবাবপুর স্কুলে পেয়েছিলাম, তিনজনকে নিয়েই আমি তাঁদের মৃত্যুপরবর্তী স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ লিখেছি, দুজনকে নিয়ে কালি ও কলমেই। নবাবপুরের  আরেক কৃতী ছাত্র আবুল হাসনাতকে নিয়েও লিখতে হচ্ছে। হাসনাতের মৃত্যু আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, ওঁর তো করোনা ছিল না। ছিল অন্য সমস্যা।

আমি হাসনাতের কাছে ঋণী। শিল্পকলা নিয়ে আমার লেখালেখির মূল তাগিদ হাসনাতের। স্বাধীনতার আগেও আমি লিখতাম। বস্তুত এ-বিষয়ে আমার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে, শিল্পী অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আর লিখতাম ইংরেজিতে, তৎকালীন আর্ট জার্নালে। স্বাধীনতার পরে তাগিদ মূলতই হাসনাতের। ১৯৭৩ সাল থেকে হাসনাত-সম্পাদিত গণসাহিত্যে, সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীতে, তারপর প্রায় নিয়মিতভাবে কালি ও কলমশিল্প ও শিল্পী সাময়িকীতে। শিল্পীদের নিয়ে হাসনাত-সম্পাদিত বেশ কয়েকটি বিশেষ সংকলনেও লিখেছি।

হাসনাতের লেখা সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল খুব সহজ। প্রথমে ফোনে অনুরোধ, কদিন পর মনে করিয়ে দেওয়া ও সর্বশেষে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। আমি কখনোই হাসনাতকে হতাশ করিনি। ফোনে আমাদের কথা হতো খুব সংক্ষিপ্ত। হাসনাতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। মোটেও আড্ডার নয়। আমাকে বড়ভাইয়ের মতো মনে করতেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের নানা অনুষ্ঠানে দেখা তো হতোই, কিন্তু পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা থাকত সংক্ষিপ্ত।

আবুল হাসনাত প্রতিভাবান মানুষ, তাঁর প্রতিভা নানামুখী। তারুণ্যে ছিলেন কৃতী ক্রিকেটার, যৌবনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, ধৈর্যশীল সংগঠক ও বাম নেতা, সংস্কৃতিকর্মী, উদ্যোগী সংস্কৃতি-সংগঠক ও নেতা, কবি, প্রাবন্ধিক, শিল্পলেখক ও সমালোচক এবং দীর্ঘ মেয়াদে ও শেষ অবধি অত্যন্ত ধীমান সম্পাদক।

আমার সঙ্গে হাসনাতের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা তাঁর শেষের দুটো অবতারে। শিল্পলেখক ও সম্পাদক হিসেবে।

শিল্পলেখক বা শিল্পসমালোচক হিসেবে আবুল হাসনাতের পরিচয় ছদ্মনামে, মাহমুদ আল জামান নামে। এটি তাঁর কবিনামও বটে। তবে আবুল হাসনাত নামেও তিনি শিল্পীদের নিয়ে লিখেছেন, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ও ইতালির SKIRA পাবলিকেশনের অসাধারণ যৌথ প্রকাশনা Zainul Abedin (২০১২)-এর কথা। এতে যৌথ লেখক ছিলেন আবুল মনসুর, নজরুল ইসলাম (বর্তমান নিবন্ধকার) ও আবুল হাসনাত। সম্পাদক, রোসা মারিয়া ফালভো। হাসনাতের প্রবন্ধটি জয়নুলের দুর্ভিক্ষ চিত্রবিষয়ক। ‘দুর্ভিক্ষ ও জয়নুল’ শীর্ষক হাসনাতের একটি বাংলা প্রবন্ধের (আবুল হাসনাত নামে লিখিত) ওপর নির্ভর করে রচিত। এতে হাসনাত ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পটভূমি চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আবুল হাসনাতের মাহমুদ আল জামান নামে একটি গবেষণানির্ভর দীর্ঘ রচনা সফিউদ্দীন আহমেদ (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ডিসেম্বর  ২০০২)। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই টেক্সট রচিত। শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদের জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ।

আবুল হাসনাত/ মাহমুদ আল জামান জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরসহ অন্যান্য অনেক চিত্রশিল্পী ও মাজহারুল ইসলাম, রবিউল হুসাইন প্রমুখ স্থপতিকে নিয়ে লিখেছেন। অবশ্যই তাঁর অত্যন্ত মূল্যবান অবদান গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের নিয়ে প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনার কাজ। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এ-ধরনের অধিকাংশ সংকলনে নিবন্ধকার হবার। প্রতিটি সংকলনই প্রকাশনা সৌষ্ঠবে দৃষ্টিকাড়া।

আমি মনে করি বেঙ্গল পাবলিকেশন্স আবুল হাসনাত/ মাহমুদ আল জামানের লেখা শিল্পকলাবিষয়ক রচনার একটি সংকলন প্রকাশনায় উদ্যোগী হতে পারে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করতে চাইছি, হাসনাতের সাম্প্রতিক একটি চমৎকার প্রবন্ধ সংকলন প্রত্যয়ী স্মৃতি অন্যান্যতে (জার্নিম্যান, ২০১৯) দুই বাংলার ২০ জন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বকে নিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মূল্যায়ন স্থান পেলেও এতে কোনো চিত্রশিল্পী বা ভাস্করকে নিয়ে আলোচনা নেই। সুবীর চৌধুরী আলোচিত হয়েছেন শিল্প-আন্দোলনের ব্যক্তিত্ব হিসেবে।

২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল আমার ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে প্রকাশিত নজরুল ইসলাম : শুভেচ্ছা স্মারকে (সম্পাদক কাজী মদীনা, প্রকাশক চন্দ্রাবতী একাডেমি, ২০১৪) আবুল হাসনাত ‘শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, তাতে তিনি আমার শিল্পসমালোচক পরিচয় তুলে ধরার সঙ্গে আমার নগর গবেষণা তৎপরতা ও নগর উন্নয়ন চিন্তার প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি তাঁর প্রিয় শহর ঢাকা নিয়ে কিছু কথা লিখেছিলেন : ‘ঢাকা এখন একটি দুঃস্বপ্নের নগর। নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত ও অপরিকল্পিত। যত্রতত্র উঁচু উঁচু ভবন, অপরিসর অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, জঞ্জালে ভরা রাস্তা। হাঁটবার জন্য ফুটপাত নেই। রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ভবন নির্মাণের ন্যূনতম বিধি কেউ মান্যগণ্য করে না। এ নগরীর উন্নয়নে কোনো দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার কারণে এ হয়ে উঠেছে ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য। কোনোভাবেই মেট্রোপলিটান চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারেনি এ শহর। উদ্যান ও বৃক্ষের অভাবে দৈনন্দিন জীবন হয়ে উঠছে দুঃসহ।’ (পৃ ২৪৪)

আমাদের কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদদের কাছ থেকে নগর সমস্যা নিয়ে এত স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য সচরাচর পাইনি। তাঁর ৭৫ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ঢাকা শহরকে চিনেছিলেন ঢাকার আদিবাসী আবুল হাসনাত। এই চেনা শুরু হয়েছিল পুরনো ঢাকার যোগীনগর লেন থেকে, হারানো সিঁড়ির চাবি খোঁজা থেকে। ১ নভেম্বর ২০২০ আবুল হাসনাত চিরবিদায় নিয়েছেন, তবে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনেক কিছুই, বস্তুগত ও আদর্শগত। তাঁর না-থাকাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে আমাকে। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। তাঁর প্রিয় পত্রিকা, কালি ও কলমশিল্প ও শিল্পীর দীর্ঘায়ু কামনা করি।