আমাদের আবুল হাসনাত

আমরা আছি হাসনাত নেই, এটা কোনোদিন কল্পনা করিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা, তাঁদের কেউ চলে গেলে কষ্ট পেয়েছি। কারো কারো তিরোধানে ক্ষতি অপূরণীয়। আমরা অসহায় বোধ করেছি। কিন্তু আমার জায়গা থেকে এটা মেনে নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছি, তাঁরা তো আমার চেয়ে বয়সে বড়। এগিয়ে যাবার পথ তাঁরা তৈরি করেছেন। অনুসরণের দায় আমাদের। কিন্তু হাসনাত তো বেশ ছোট। বহুমুখী কাজ। কী অসাধারণ দক্ষতায় নীরবে সামলান। বাড়াবাড়ি নেই এতটুকু। সবার কাছে আস্থার প্রতীক। স্থির বিশ্বাস ছিল, এমনটিই দেখে যাব আজীবন। তা হলো না। আকস্মিক বজ্রাঘাত! এখন এভাবে তাঁকে নিয়ে লেখা। কিছুতে কলম সরে না। মনে হয়, তাঁর স্মৃতির পবিত্রতা বুঝি ক্ষুণ্ন করছি। এ-সময়েও নিজেকে জাহির করছি।

হঠাৎ মনে জাগে অন্যদিকও তো একটা আছে। এটা ভাবা অস্বাভাবিক নয় আমি উদাসীন। আরো অসংখ্যজনের মতো আমিও তাঁর ওপর নির্ভর করেছি। অথচ এই মর্মান্তিক মুহূর্তে সামান্য শ্রদ্ধাটুকু জানাতেও বিরত থাকছি। কেউ যদি বলেন, এ আমার সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, অকৃতজ্ঞ অসংবেদনশীলতা, তবে তার জবাব কী?

এটা কথাকাটাকাটির সময় নয়। বিষয়ও নয়। তাই আমার কথাও দুটো যোগ করি। অবশ্যই যথেষ্ট নয়। এবং এই মুহূর্তে কিছু গুছিয়ে লিখি, তার ভরসাও পাই না। আক্ষেপই শুধু সার। অনুমান, এ-আক্ষেপ আমার মতো আর সবারও। কেন তিনি নেই? জানি বেঁচে থাকা মানেই অনিবার্য মৃত্যুর দিকে চলা। কিন্তু তাকে আরো কিছুদিন কি ঠেকানো যেত না? দিন-রাত কাজ। সম্ভবত একাই দশজনের। সবাই তারিফ করেছে। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ কেউ নিয়েছে কি না জানি না। অনেক দেশে জানি, বাধ্যতামূলক, যাকে বলে, ইনস্টিটিউশনাল অবলিগেশন, তাঁর মতো যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের নিয়ম করে খুঁটিনাটি সব রকম স্বাস্থ্য-পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে সুচিকিৎসার আয়োজন নিশ্চিত রাখা। জানতে পারি, তাঁর পিত্তথলিতে পাথর জমেছিল। এবং তা বড় আকার নেবার সময় পেয়েছে। অনেক আগেই আমাদের দেশেও এটা সারানো সম্ভব। তিনি হয়তো কাজের চাপে ফেলে রেখেছেন। আফসোস, এদিকে কারো নজর পড়েনি। শরীরে এক অঙ্গ বিকল হতে থাকলে অন্যান্য কলকব্জার ওপর চাপ পড়ে। হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলে বিপদ এড়ানোর সম্ভাবনা উবে যাওয়া হয়তো ঠেকানো যায় না। তাঁর বেলায় যদি এমন কিছু ঘটে থাকে, তবে আমাদের অনুশোচনা নিজেদেরই অপরাধী করে। তাঁর কাজ আমাদের বিস্ময় বাড়িয়েছে, গুণমুগ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু কেউই তাঁর সুস্থ থাকার দিকে নজর দিইনি। নিজেদের নাম-যশ নিয়ে মশগুল থেকেছি।

প্রায় পাঁচ দশক আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার দায়িত্বে। আমি থাকি ঢাকা থেকে বেশ দূরে। চিঠিতেই পরিচয়। আতিশয্যহীন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ একটিও না। তাও মনে হতো, কত আন্তরিক! এবং কতটা দায়িত্বশীল। এই দায়িত্ব শুধুই পেশাদারি নয়। একই সঙ্গে মূল্যবোধেও। বলা যায় তাঁকে নিঃশর্ত মানবিক। প্রচারধর্মী নয়। আপসকামীও না। সভ্য, ভদ্র, বিনয়ী, কিন্তু নিজের জায়গায় স্থির। আমি যে ঘন ঘন এমন চিরকুট পেয়েছি, তা নয়। তবে আমাকে তারা প্রেরণা দিয়েছে। আমার মনের জোর বেড়েছে। শেষদিকে তাঁর কালি ও কলম পর্বে অবশ্য বেশিরভাগ যোগাযোগ মোবাইল ফোনে। তাও টুকটাক কথা। কিন্তু একই রকম আত্মবিশ্বাসী, আন্তরিক। তাঁর বৃত্তে আমিও আছি, এটা ছিল আমার অশেষ তৃপ্তির।

তবে দেখা হয়েছে কালেভদ্রে। সবশেষে বোধহয় বছর তিনেক আগে। তিনি এখানে এসেছিলেন। হাসান আজিজুল হকের বাড়িতে আড্ডা। সেখানেও হুল্লুড়ে নন। উচ্চকণ্ঠ নন। কিন্তু আছেন, এটা সবসময় জানান দেন। কিছু আগে কালি ও কলমের আয়োজনে সিলেটে যে বসেছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির মহাযজ্ঞ – আসাম ও কলকাতার সেরা ব্যক্তিত্বরাও ছিলেন – তাতে হাসনাতের সাংগঠনিক প্রতিভাও এক ঝলক টের পাই। ধীর-স্থির, শান্ত, কিন্তু একই সঙ্গে সামলাচ্ছেন তিনটে মঞ্চ। মেজাজি প্রতিভাবান দেশি-বিদেশি তারকা-ব্যক্তিত্বদের আড্ডাতেও হাজির। এতটুকু ছন্দপতন ঘটে না। আর আলাপ স্বভাবের মৃদু দৃঢ়তা কিন্তু অটুট থাকে। চোখে পড়ে।

এছাড়া দূরে থাকি বলে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ বেশি মেলেনি। হয়তো সব মিলিয়ে বিশ-পঁচিশ বার – ছায়ানটের কোনো কোনো অনুষ্ঠানে, বাংলা একাডেমিতে, প্রথম আলোর আয়োজনে সাহিত্যসভায় – এই রকম। তাঁর সান্নিধ্যে, মনে হয়েছে, আমিও যেন পরিচ্ছন্ন হচ্ছি। নিজের ভেতরে ছোট ছোট লোভের তাড়নাগুলো যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি যে ডেকে-হেঁকে নিজেকে জাহির করতেন, তা নয়। বরং ঠিক তার উলটো। মনে হতো, ব্যক্তিত্বে সততা ও সাহসের নীরব তর্জনীর প্রভাবও ওইরকম পরিবেশে কম নয়। আমি মুগ্ধ হতাম। আশা বাঁচিয়ে রাখার একটা আশ্রয় যেন মিলত। নিজের অজান্তেই তাঁর ওপর নির্ভরতা আরো বেড়ে যেত। তা শুধু আমার কথা ভেবে নয়, আমার মতো আর সবার কথা মনে করেও।

সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে নিঃশব্দে এক কাণ্ডারি হয়ে উঠেছেন তিনি কালি ও কলমের দায়িত্ব নেবার আগেই। সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীর ভার তাঁর ওপর পড়ার পর দীর্ঘ-দীর্ঘকাল আমাদের ছিল ত্র্যহস্পর্শের  ছোবলে দীর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে এসে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার আশংকা, নৈরাজ্যের পদধ্বনি, চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস, পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিধন, উপর্যুপরি প্রত্যক্ষে ও প্রচ্ছন্নে সেনাশাসন, এসবের অন্ধ তামসিকতার পর্বে মানবভাগ্যে সুস্থতার কল্যাণ এষণার ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এক মঙ্গলদীপ্ত অহর্নিশ জ্বেলে রাখার উদ্যোগে স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে অলিখিত দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল সংবাদ। সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় বিরতিহীন বেজে চলেছিল তারই অনুরণন। বিপথগামী হবার সব পথ আগলে রাখার ব্রত সে নিরন্তর পালন করে চলেছিল। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত বিতাড়িত। শূন্যতার গহ্বর একটা মুখ হাঁ করে তেড়ে আসতে পাঁয়তারা করছিল। তিনি হাল ধরেন।

ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়। কিন্তু ঐকান্তিক নিষ্ঠায়। আর পূর্ণ মানবিক মূল্যবোধে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে। সন্দেহ নেই গোটা সংবাদ পরিবারই এমন ছিল। জহুর আহমদ চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত – এঁরা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে রাখতেন। তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহিত্য সাময়িকীর পাতা মেধা ও কল্পনা প্রতিভার পূর্ণ মানবিক বিকাশের ও সমাজ-সংসারের বিবিধ প্রশ্নের অনর্গল বিবেচনার এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অনেকে, জানি, সপ্তাহের বিশেষ দিনে এই পাতাটির আগ্রহে আলাদা করে সংবাদ রাখতেন। চোখে পড়ত শিল্পকলার নানা দিক নিয়ে গুণীজনের লেখা। আর প্রতিভাময়ী নারী-লেখকদের গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আনা। শাহীন আখতারের ধারাবাহিক উপন্যাস প্রথম এই পাতাতেই পড়ি। হাসনাত কিন্তু আড়ালেই থাকতেন। কখনো সামনে এসে ওই নামে নিজেকে জাহির করেননি।

আমরা তখন এই পাতাতেই পড়েছি শামসুর রাহমানের একাধিক স্মরণীয় কবিতা; সৈয়দ শামসুল হকের বিশেষ বিশেষ কবিতা ছাড়াও ভাষার নানা ব্যঞ্জনা নিয়ে ধারাবাহিক মার্জিনে মন্তব্য; একই রকম আর এক প্রধান কবি মোহাম্মদ রফিকের ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে গণমুখী বৈপ্লবিক ধারা নিয়ে বহু সংখ্যাজুড়ে ক্রমশ প্রকাশিত আত্মরক্ষার প্রতিবেদন, সেলিম জাহানের সমাজ-অর্থনীতির বুদ্ধিদীপ্ত চর্চাক্রম। আর প্রতিশ্রুতিশীল নবীন লেখকদের জন্যে অবারিত দ্বার। এও ছিল এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ, ওই সময়ের সুযোগসন্ধানী চরিত্রভ্রষ্ট ওপরচালাকদের খবরদারি আর তোষামোদির বিরুদ্ধে, কিন্তু শিল্প-সাহিত্য বিচারের মান এতটুকু নত না করে। আবুল হাসনাতের এই সম্পাদনা ওই সংশয়দীর্ণ পর্বে আমাদের প্রগতি ও কল্যাণমুখী মানসযাত্রার সক্ষম ও সার্থক চলমান প্রতিবেদনে এক প্রত্যয়দৃঢ় নেতৃত্বের নিদর্শন। এর দ্যুতি ম্লান হবার নয়। এও অবশ্য মনে রাখি, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, হাসান আজিজুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, ওয়াহিদুল হক – এঁরা বাইরে থেকে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। তাঁদের সৃষ্টিসম্ভারের প্রকাশও ঘটে চলেছে সেই পাতায়। সংবাদের স্বত্বাধিকারী আহমদুল কবির গত হলে কাগজটির পরিচালনায় নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনিশ্চয়তাও একটা তৈরি হয়। এই সময় ২০০৩-এ কালি ও কলম প্রকাশের উদ্যোগকালে এর কর্তৃপক্ষ হাসনাতকে প্রকাশিতব্য মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানান। তিনি তা গ্রহণ করেন। সংবাদে সফল একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এবার আরেক পর্বের সূচনা।

উদার মুক্তদৃষ্টি ও সংবাদে সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর কালি ও কলম-যাত্রা শুরু। দৃষ্টি কিন্তু আরো প্রসারিত। বাংলা ও বাঙালি সবাইকে নিয়ে, সবার কাছে এর আবেদন। বিষয়সীমা অবাধ। জীবন-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তেরই হোক, আমাদের আগ্রহ জাগালে, চেতনায় আলো ছড়ালে, অখণ্ড মানবিক বোধ জাগ্রত করলে এখানে তার সাদর আহ্বান। শুরু থেকেই চোখে পড়ে, বাংলা ও বাঙালি পরিচয় নিয়ে তিনি কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের সীমারেখা টানেননি। অখণ্ড বিশ্বভাবনা ও জ্ঞান যেমন এখানে চর্চার বিষয়, তেমনি বাংলাভাষায় মনকে জাগিয়ে তোলে এমন লেখা যেখান থেকেই হোক, স্বাগত। বাঙালি বলতে শুধু ভাষার ঐক্যই যথেষ্ট নয়, মনের মুক্তিও প্রত্যাশিত। অন্ধ সংস্কার, জাত-পাত-বিধিনিষেধ, অহংকার বা হীনমন্যতা, কোনোটিই এখানে গ্রাহ্য নয়। ‘বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার’ – এই কথাটিরই পুনরুক্তি যেন করে যায় এ প্রতিবার। ‘অধিকার’ মানে জবরদখল নয়। তা সব জায়গার সব মানুষের সঙ্গে সমদৃষ্টিতে সমমর্যাদায় পূর্ণ সম্মানে একাত্ম হওয়া। অচিরেই তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমমনা সব সচেতন বাঙালির। তাই অবাক হই না, যখন দেখি, ঢাকা ও কলকাতাকেন্দ্রিক পাঠকসমাজ সমস্বরে একে স্বাগত জানাচ্ছে। কিছুকাল কলকাতা থেকেও এর আলাদা সংস্করণ বেরোয়। সেখানেও ব্যবস্থাপনায় হাসনাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। অন্যদিকে কলকাতার খ্যাতিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকেরা ঢাকা সংস্করণে সাগ্রহে অবদান রাখছেন।

এই সমদৃষ্টি শুধু কালি ও কলমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। একই প্রতিষ্ঠান শিল্প ও শিল্পী নামে চারুকলা বিষয়ে আর একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রকাশ শুরু করে। তার সম্পাদকও আবুল হাসনাত। দীর্ঘায়ু হয়নি। কোনো দেশেই এমন পত্রিকার দীর্ঘায়ু হওয়া বিরল। বোম্বাই থেকে মূলকরাজ আনন্দের সম্পাদনায় মার্গ নামে একটি পত্রিকা একসময়ে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তার প্রকাশনাও ছিল তুলনায় ক্ষণস্থায়ী। মার্গের মতোই শিল্প ও শিল্পী ছিল সমৃদ্ধ। তবে এ-জাতীয় পত্রিকার একটা সমস্যা, এর গ্রাহকসংখ্যা অতিসীমিত। বিশিষ্ট বোদ্ধা বা প্রতিশ্রুতিশীল উৎসাহীরাই কেবল এতে আগ্রহী হতে পারেন। বিশেষ পৃষ্ঠপোষণা না থাকলে একে টিকিয়ে রাখা মুশকিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হাসনাত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন। কোনো ক্ষণিকের উত্তেজনা বা আত্মপ্রদর্শনী এতে মদদ জোগায়নি। তাঁর অন্তর্জাত মানবিক বোধ ও ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির স্বপ্ন তাঁকে এ-পথে টেনেছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ওই আদর্শের প্রেরণাতেই। সে- সময় কলকাতায় সাংগঠনিক উদ্যোগে তাঁর দিনরাত একাকার। তার ভেতরেই ওখানকার প্রগতিশীল মেধার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। পরে তাঁর সম্পাদকজীবনে এর সুফল একটা মেলে। ওখানে যাঁরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, তাঁদের অনেককে তিনি পান সৌহার্দ্যে ও সহযোগিতায়। যোগ্য যাঁরা, তাঁরা লেখা দিতে কার্পণ্য করেন না। অন্যরা মহাউৎসাহে তাঁর কৃতিত্বকে সবার সামনে তুলে ধরেন। দেশে। বিদেশেও। সব জায়গাতেই যোগ্য সমাদর তিনি পান। মেধা, আত্মবিশ্বাস ও গুণগ্রাহিতা সবগুলোই ছিল তাঁর সহজাত। এবং শান্ত অনসূয় স্থিতধী বিনয়। কোনো জাঁকজমক না করেই তিনি সফল হন। সফল থাকেন। যদিও দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন আজীবন। এতেও তাঁর কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের ইতিবাচক প্রতিফলন। যখন ধরাধামে কমিউনিজম আর নেই তখনো। তার প্রাথমিক শর্ত, সব মানব-মানবীর সমাজ-অধিকার। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের নামে কোনো বিভাজন বা বৈষম্য অপরাধ। এই প্রাথমিক শর্ত পূরণ না হলে কর্মফলে যোগ্যতাভিত্তিক সমতা-বিধান অধরাই থেকে যায়।

শিল্প-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে পত্র-পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর অনন্য সাফল্যও তাঁকে আজ বিরল খ্যাতি ও কালজয়ী প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। পাশাপাশি নিজের সাহিত্যকর্মেও তাঁর কৃতিত্ব মুগ্ধ করে। স্বভাবলাজুক নীতিবান মানুষটি কখনো নিজের লেখালেখি নিয়ে কোনো আলোচনায় উৎসাহ দেখাননি। অথচ অন্যদের ভালো লেখার প্রশংসা করতেন প্রাণ খুলে। হাতের পত্র-পত্রিকায় এ-বিষয়ে পক্ষপাতহীন দক্ষ সমালোচনার জন্যে জায়গার অভাব কখনো হয়নি। তাঁর নিজের লেখা এ-কারণে কদাচিৎ সামনে আসে। সাহিত্যমূল্য তাদের যদিও অনুপেক্ষণীয়। কোনো কোনো বইয়ে তাঁর কীর্তি অসামান্য। তাঁর সম্পাদকখ্যাতি এখানে বরং তাঁকে আড়ালই করেছে।

কবিতা লিখতেন তিনি ‘মাহমুদ আল জামান’ এই ছদ্মনামে। ভালো কবিতা। তাঁর অন্তর্জগৎ সেসবে আভা ফেলত। তাঁকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা সেসবে তাঁর সত্য স্বরূপটি ঠিক চিনে নিতে পারতেন। অমলিন সুন্দরের জন্যে আকুতি, বীভৎসার বিকৃত থাবায় মর্মবেদনা, আলোকিত আগামীর আশা, এসব তাঁর কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনায় পূর্ণতা পায়। উচ্চকণ্ঠ কদাপি নন। সব মিলিয়ে কবিতার শান্তি হৃদয় স্পর্শ করে। ‘ভুবনডাঙা’ তাঁর এলডোরাডো। উচ্চারণেই রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যের স্বপ্ন-বাস্তবতার পূর্ণ মায়া মেশে। ‘নধর কালো বেড়াল’ তাকে ছিন্নভিন্ন করে। তবু জেগে থাকে সুন্দরের আশা। তাঁর নির্বাচিত কবিতা-সংকলনও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কালের নৃত্যে যখন ছিন্নমস্তা রূপ, তখন মাহমুদ আল জামান নামের আড়ালে হাসনাত আমাদের ‘দুদণ্ড শান্তি’ শুধু নয়, এক ফালি ‘জ্যোৎস্না’র স্বপ্নও রেখে যান। আমরা হয়তো নিত্যদিনের খিটিমিটিতে ব্যতিব্যস্ত থেকে তাদের দিকে চোখ ফেরাবার অবকাশ তেমন পাই না। পেলে মনের বিকার কিছুটা হলেও কাটার সুযোগ মেলে।

শিশু ও কিশোর সাহিত্যেও তাঁর হাত ছিল প্রসন্ন। সম্ভবত তাঁর মেজাজেই এক নিষ্পাপ সারল্য আজীবন থেকে যায়। বাচ্চাদের জন্যে লেখায় তা স্ফূর্তি পায়। সমাদরও জোটে। তবে সম্পাদনায় তিনি মহীরুহ হয়ে ওঠায় এদিকে আমাদের তেমন নজর যায় না। সাধারণ গদ্যও তাঁর একই রকম আকর্ষণীয়। সম্প্রতি হাতে পেলাম তাঁর স্মৃতিচারণমূলক দুটো বই : প্রত্যয়ী স্মৃতি অন্যান্য এবং হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। দুটোই অসাধারণ। বিশেষ করে দ্বিতীয়টি। তাঁর দেখায় তাঁর সময় এখানে এক পক্ষপাতহীন সমগ্রতা পেয়েছে। অবশ্য তাঁর সংবাদ-পূর্ব পর্যন্তই এর বিস্তার। শুনেছিলাম, আর এক খণ্ড তিনি লিখছেন। তাঁর যাপিত জীবনের বাকি অংশ তাতে ধরা পড়বে। তা আর হবে না। এ-কষ্ট আমাকে কুরে কুরে খায়। এমন পূর্ণ দৃষ্টিতে সব মানুষকে দেখা, বিক্ষুব্ধ সময়েও লক্ষ্যে স্থির থাকা, অভিজ্ঞতার নিরাসক্ত বর্ণনা, শ্রেয় ভাবনায় সামষ্টিক মূল্যবোধের সমন্বয়, বিনয় ও আত্মমর্যাদার স্বাভাবিক সংমিশ্রণ, – এমনটি একত্রে আপন জীবনের কথকতায় সমস্ত অহংকার দূরে ঠেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সরল সত্যে ফুটিয়ে তোলা, এ এক বিরল কীর্তি। পড়ে আমরাও শুদ্ধ মানুষের মুখোমুখি হবার পুণ্য সঞ্চয় করি। নিতান্তই সাধারণ থেকে হাসনাতের হয়ে ওঠা। শুরুতে মেধার জগতে থেকেও মেধাবীদের অলক্ষেই। তবে তাঁর সংবেদনা সব সময়ে সজাগ। এবং তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ সততা। এমনটি সারাজীবন। তাঁর থাকা আমাদের নির্ভার-নিশ্চিন্ত রেখেছে। এখন বড় অসহায় লাগে। আমার তো বটেই। মনে হয়, আমার মতো অন্যদেরও।