আবুল হাসনাত : স্মৃতি সততই সুখের

আবুল হাসনাতকে নিয়ে শোকগাথা লিখতে হবে, এমন কথা কখনো ভাবিনি। কলম হাতে নিয়ে অনেকদিনের স্মৃতি মনে পড়েছে আজ। বিগত ষাটের দশকের প্রথম দিকে দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া কয়েকটি পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে দেখা গেল লেখা ছাপা হচ্ছে না। অবশেষে একটা ফন্দি আটলাম। মাহবুব নামটিতে একটা আকার যুক্ত করে ‘মাহবুবা’ করে ফেললাম। এতে লেখা বেশ ভালোই ছাপা হতে থাকল। একসময়ে ভেবেছিলাম আসল নাম বাদ দিয়ে নকল নামেই লেখা চালিয়ে যাব। অবশেষে দুই নামেই লেখা ছাপা হতে লাগল। যতদূর মনে পড়ে ষাটের দশকের শেষে দৈনিক সংবাদের সাহিত্যপাতায় আমার একটি গল্প মাহবুবা তালুকদার নামেই প্রকাশিত হয়েছিল। পরে যখন হাসনাতকে বিষয়টি জানালাম, তিনি বললেন, লেখা দেখেই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, নাম দেখে নয়। কথাটায় কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে নামের আকার তুলে দিয়ে আসল নামে আবির্ভূত হলাম।

ষাটের বা সত্তরের দশকে দৈনিক সংবাদে আমার কয়েকটি গল্প ছাপা হয়েছিল। সংবাদ অফিসে বজলুর রহমান ও সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই সুবাদে হাসনাতের সঙ্গে দেখা হতো। তবে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কমই হতো। তখন থেকেই দেখেছি হাসনাত প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা কথা বলেন না। টেলিফোনেও কখনো তাঁকে বাড়তি কথা বলতে দেখিনি। বলা বাহুল্য, এ-বিষয়টি আমার কাছে কাঠখোট্টা মনে হতো। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কিছু বলিনি। সংবাদের সাহিত্যপাতা আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় খুবই পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। হাসনাতের সাহিত্যপাতা সম্পাদনা ও লেখার মেকআপ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ছিল। আমার মনে হয়, দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে হাসনাত কেবল লেখকদের কাছে নয়, পত্রিকার সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে প্রশংসিত হন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রশংসা তিনি গ্রহণ করছেন কি না, তা বোঝা যেত না।

দীর্ঘকাল পরে আবুল হাসনাতকে আবিষ্কার করলাম কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে। এই পত্রিকায় তিনি তাঁর মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতার যে-পরিচয় দিয়েছেন, তা অসাধারণ। বাংলাভাষায় এ-ধরনের মাসিক পত্রিকা আর আছে বলে জানা নেই। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সৃষ্টিশীল লেখায় সমৃদ্ধ গল্প, কবিতা, ধারাবাহিক উপন্যাস, চিত্রকলা ইত্যাদি বিষয়ে কালি ও কলমের প্রতিটি সংখ্যাই অনবদ্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে-পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, আবুল হাসনাত যে-পত্রিকার সম্পাদক, তার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। আমি নিজে আগ্রহভরে কালি ও কলমে আমার সবচেয়ে ভালো গল্পগুলো পাঠাতাম। জানতাম, এখানে ছাপা হলে সুধীজনের কাছে তা পৌঁছাবে। হয়তো তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কারণ যত ভালো ম্যাগাজিনই হোক, তার সার্কুলেশন খুব বেশি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের কাছ থেকে যখন লেখা সম্পর্কে ভালো-মন্দ জানা যেত, তখন মন ভরে যেত।

মাঝে মাঝে হাসনাতের সঙ্গে পত্রিকার কোনো কোনো বিষয়ে কথা হতো। একবার আমি বললাম, ‘তোমার পত্রিকায় বিভিন্ন লেখায় বিশেষত গল্পের যাঁরা ইলাস্ট্রেশন করছেন, তাঁরা প্রায় সবাই চিত্রশিল্পী। তাঁরা ইলাস্ট্রেটর নন। অন্তত গল্পগুলো পেইন্টারদের দিয়ে না আঁকালে ভালো হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পত্রিকাগুলোতে পেইন্টারদের আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয় না।’ হাসনাত একটু চুপ থেকে বললেন, ‘আমরা যেভাবে যাঁদের দিয়ে ইলাস্ট্রেশন করাচ্ছি, তাদের আঁকাই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আপনি যা বলছেন, তা কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ বলেননি।’

১৯৬২ সাল থেকে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার অপ্রত্যক্ষ পরিচয় হলেও ১৯৭১ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নীরেনদা ২০১৪ সালে ঢাকায় এসেছিলেন কালি ও কলমের আমন্ত্রণে। স্বভাবতই তিনি আমার বাসায় আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আমি আনিসুজ্জামান স্যার ও আবুল হাসনাতকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ৫ এপ্রিল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা তাঁরা ছিলেন আমার ইস্কাটনের বাসায়। নীরেনদা ও আনিস স্যার মূলত বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলেন। হাসনাত ও আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁদের আলোচনা শুনছিলাম। আমাদের চারজনের ছবি তোলা হয়েছিল সেদিন। হাসনাতকে ছবির একটি কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল আজকের এই স্মৃতিচারণমূলক লেখার সঙ্গে ছবিটা ছাপতে দেব। কিন্তু বাড়ি বদলের ঝক্কি-ঝামেলায় ছবিটি আর খুঁজে পাওয়া গেল না। কালি ও কলমের আশফাককে বলেছিলাম হাসনাতের অফিস বা বাড়ি থেকে ছবিটা উদ্ধার করা যায় কি না। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। ছবি পেলে এ-লেখাটি অনেকখানি সচিত্র ও সরব করে তোলা যেত।

হাসনাতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনো তেমন ঘনিষ্ঠ হয়নি। লেখক ও সম্পাদকের ফরমাল সম্পর্ক বললেই বোধহয় ঠিক হয়। কিন্তু হাসনাত তো কেবল সম্পাদক ছিলেন না, একজন সৃষ্টিশীল লেখকও ছিলেন। তিনি লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। সেসব লেখা আমি যে খুব মনোযোগসহকারে পড়েছি, এমন নয়। কিন্তু জার্নিম্যান বুকস থেকে প্রকাশিত কবি ও প্রকাশক তারিক সুজাতের প্রকাশনা হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে রফিকুন নবীর আঁকা প্রচ্ছদসমৃদ্ধ বইটি হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উলটাবার পর বইটি পড়ায় মনোনিবেশ করা ছাড়া উপায় রইল না। এরকম স্মৃতিকথামূলক বই ইদানীংকালে আর পড়েছি বলে মনে হয় না। বইটি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য প্রকাশককে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল বইটি পুরো পড়ার পর হাসনাতকে জানাব। কিন্তু আমার সে-ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেল। আবুল হাসনাত লোকান্তরিত হলেন অতি অকালেই বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশে সম্পাদনা ক্ষেত্রে তিনি যে-শূন্যতা সৃষ্টি করেছেন, তা পূরণ করা সহজসাধ্য হবে না। আরেকজন আবুল হাসনাতের জন্য আমাদের দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে। আবুল হাসনাত একজন পরিশীলিত সজ্জন মানুষ ছিলেন। কালান্তরেও তিনি বেঁচে থাকবেন কালি ও কলমের সৃষ্টিশীল সম্পাদনার জন্য। তাঁর স্মৃতি সততই সুখের।