অনুজ হাসনাতকে

২রা অগ্রহায়ণ ১৪২৭

১৭ই নভেম্বর ২০২০

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

প্রিয় হাসনাত

চিঠিটা তো খোলাই থাকবে। ভদ্রতার মোড়ক ব্যবহার করতে হবে না। কালি ও কলমের মেরুদণ্ড ছিলে তুমি। কয়েক মাস আগে গেল পত্রিকার প্রধান মস্তিষ্ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমার তো এখন ভয় হচ্ছে সিরিয়ালি সার দিয়ে নামছে। প্রার্থনা – এবার যেন বাকিরা রেহাই পায়। এত বড় উৎসর্গের পর ছোটদের ওপর নজর না পড়লেই বাঁচি।

কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলী : এ জেড এম আবদুল আলী, রুবী রহমান ও সবশেষে লুভা নাহিদ চৌধুরী। জানি না এঁদের মধ্যে কার ঘাড়ে প্রধান বোঝা বর্তাবে। আর আবদুল আলী সাহেব তো আগেই ধরাধাম ছেড়ে গেছেন। রুবী রহমানও বয়সী। এখন লুভা একমাত্র সচল-সতেজ। বন্ধুবর সুব্রত বড়ুয়া এখন কাঁধ দিচ্ছে। আশা করি কালি ও কলম বহনে তেমন বড় সমস্যা হবে না।

নিয়তি মানি আর না মানি শব্দটি বড় নিষ্ঠুর। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে। কিন্তু মানুষ তো নিয়তিকে দ্বন্দ্বে আহ্বান জানিয়ে এ-ধরায় আগমনিত। এ-কারণেই তো স্বর্গ হইতে পতন। আমাদের আদি মাতা-পিতা স্রষ্টার নিষেধ অমান্য করে নিজেদের কামনা-বাসনায় সাড়া দিয়েছেন। আদি পাপ খণ্ডাবে কে! যে-কারণে ব্রজের রাখালকে ধরাধামে আসতে হয়েছে জগৎকে প্রেম শেখাতে।

তুমি ছিলে আমার চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের কনিষ্ঠ। সম্পর্কটা তৈরি হয় ছাত্র ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকের আগ থেকেই তরুণদের মধ্যে মার্কসবাদী চিন্তাধারা বেশ দানা বাঁধতে থাকে। ধর্মীয় বা জাতীয়তাবাদকে টপকে। পূর্বে ধর্মভিত্তিক জাতির প্রতি মানুষের নজর ছিল কড়া। পরবর্তীকালে মার্কসবাদ প্রচারিত হবার ফলে এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে বিশ্ব-সাম্রাজ্য বা একরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাজ গঠনের চিন্তা আসে। তখন ধ্বনি ওঠে : দুনিয়ার মজদুর এক হও। শ্রেণিবিভেদ খুঁচিয়ে সাম্যবাদী দুনিয়া গড়ার স্বপ্ন পৃথিবীর দিকে দিকে সাড়া ফেলতে শুরু করে। আমরাও এর বাইরে ছিলাম না।

সাম্যবাদ দিয়ে মানব-সমাজের যাত্রা। পরবর্তীকালে ধনসম্পদ জমা রাখার ফলে শ্রেণিবিভাগ। ধনী-গরিব। এই সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে নির্মিত হয় শিক্ষাব্যবস্থা ও দর্শন। শিল্প-সাহিত্য। সমাজ-কাঠামো যেন বিপরীত চিন্তায় বদল না ঘটে। তার জন্যে শাসনব্যবস্থা। মুক্তচিন্তা ততটাই গ্রহণযোগ্য যা মৌলিক কাঠামোকে আঘাত না করে।

বিংশ শতাব্দীতে দিকে দিকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। কিন্তু সমাজতন্ত্রে যাতে সবাই যোগ দিতে না পারে তার প্রচেষ্টাও সচল থাকে। বলশেভিক বা রুশ বিপ্লব সবার নেতৃত্বদানকারী ঘটনা। রাশিয়ার দরিদ্র মানবের ত্রাণের ব্যবস্থা গ্রহণ। ক্রমে অন্যতম বৃহৎ শক্তি চীনের এই পথ অনুসরণ। সাম্রাজ্যবাদ সহজে তা মেনে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই শক্তির সফলতা আসে ১৯৯১ সালে। রুশ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ধনবাদে ফিরে যায়। চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়া এখনো টিকে আছে। মহাশক্তিধর চীন সময়ের সঙ্গে পালাবদলে সবার নেতৃত্বে। বিশেষ করে কনজিউমার গুডসে। সামরিক অস্ত্র উৎপাদনেও খুব পিছিয়ে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরাশক্তির কাছে ভীত। নানা ছলচাতুরী করে নেতৃত্ব বজায়ে ব্যস্ত।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। হাসনাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলা সাহিত্য কেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা সবসময় চিন্তার ক্ষেত্রে অগ্রগামী। কারণ সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। বিজ্ঞানের ছাত্ররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টেকনোক্র্যাট। তাদের মধ্যেও সমাজ-সচেতন শিক্ষার্থী থাকে না এমনটা নয়। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীগণ এক্ষেত্রে অগ্রপথিক। মানুষ নিয়ে তাদের কাজ। কান টানলে আসে মাথা। সুতরাং ব্যক্তি থেকে পুরো সমাজ। নগরে বস্তিতে বাস করে স্বস্তিতে থাকা চিন্তার বাতুলতা। মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি এখানে অচল। অধম হলো সমাজব্যবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মানা নৈব নৈব চ। জেল-জরিমানা দিয়ে কোনো ফল লাভ হবে না। সারা অঙ্গে ঘা, কোথায় ওষুধ লাগাবে? না আছে অত ওষুধ, না পরিচর্যাকারী। সবচেয়ে কঠোর জীবন দিন আনে দিন খায় যারা। উপোস তাদের কাছে নিয়তির লিখন। কাউকে দোষারোপ করে না। স্রষ্টার হাতে সবকিছু দেয় সঁপে। শেষ আশ্রয়। ঝাড়-ফুঁকদানকারীদের পোয়াবারো। আমার দেশে সমাজ পরিচালকবর্গ সব শিক্ষাকে ককটেল করার পক্ষে। শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এদেশে সাজে না। মানুষ ভাগ্যবাদী। যতদিন পারা যায় এ-অবস্থাটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া। আমাদের দেশে গৃহকর্মীদের সপ্তাহে একদিনও ছুটি দেওয়া হয় না। সরকারি ব্যক্তিরা দুদিন ছুটি ভোগ করে। আর এদের ২৪x৭ প্রায় ৩৬৫ দিন। বড় পরব এলে এদের দায় আরো বেড়ে যায়। সোজাসাপটা প্রশ্ন, তুই চলে গেলে আমাদের চলবে কী করে? ঠিকই তো! কী করে চলবে! আধুনিক দাস-ব্যবসা এখন নতুন রূপে ফিরে এসেছে বিদেশে পাঠানো মহিলা হোম-মেকার নামে।

বাংলাদেশে একমাত্র বামচিন্তার প্রতিভূ দৈনিক সংবাদ। খুব স্বাভাবিকভাবে হাসনাত তুমি ওই পত্রিকায় যোগ দাও। সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী তো একটা প্রতিষ্ঠান। তাঁর সহকর্মী রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ সেনগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিকপাল। তুমি দেখতে সাপ্তাহিক সাহিত্যের পাতা। প্রকাশ হতো বৃহস্পতিবার। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার হকারকে এই কাগজ দেবার নির্দেশ দিয়ে রাখি। বিষয় ও অঙ্গসৌষ্ঠবে এই পাতা জোড়া সবার মন ও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। সাহিত্য সম্পাদনা তোমার রক্তে ছিল। সমান্তরালভাবে ছিল মাহমুদ আল জামান নামে কাব্যচর্চা। শিল্পকলার ওপরও ছিল আকর্ষণ ও রিভিউ লেখা।

এরপর তোমাকে দেখি মাসিক গণসাহিত্য সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত হতে। তোমার তাড়ায় আমার লোকশিল্পের গোড়ার কথা বইটি সম্পূর্ণ করতে পারি। লেখক-সম্পাদক বড় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বড় সম্পাদক অনেক লেখক তৈরিতে সহায়ক। আমরা দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের উদাহরণ টানতে পারি। তেমনি পারি মাসিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের ভূমিকা। তিনি সরকারবিরোধী অনেক লেখা ছাপতেন। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অনুসন্ধানকালে তিনি বলতেন, মফস্বল থেকে কে লেখা পাঠিয়েছে তাকে আমি চিনি না।

অফিসারগণ সিকান্দার আবু জাফরকে চিনতেন। দুরন্ত ব্যক্তিত্ব। সমাজের প্রবীণদের তিনি তুই-তোকারি সম্বোধন করতেন। ওরা ভয়ে ভয়ে প্রত্যাবর্তন করত। কখনো ঘাঁটাত না। কে জেনেশুনে বিপদ ডাকবে। সম্পাদক একটা বিশাল দায়িত্ব। আমাদের দেশে বড়মাপের সম্পাদকমণ্ডলী হলেন : মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, ওবায়দুল হক, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবদুস সালাম, আহমেদুল কবির, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, সরদার জয়েনউদ্দিন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, বজলুর রহমান, তোয়াব খান, গোলাম সারওয়ার – জীবিত বর্ষীয়ানদের মধ্যে বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,  আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রয়াত এনায়েতউল্লাহ খান, এস.এম আলী,  রোকনুজ্জামান খান, ফয়েজ আহমদ, গোলাম রহমান, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, হাসান জান প্রমুখ। বিনোদন পত্রিকার পারভেজ হোসেন, গাজী শাহাবুদ্দিন, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ। মাসিক মাহে-নওয়ের সম্পাদক আবদুল কাদিরের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, ছিলেন বড়মাপের ছান্দসিক। সওগাতের মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন ও মাসিক পূবালী-সম্পাদক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ছিলেন পত্রিকা অন্তঃপ্রাণ। আরো অনেকের নাম করা যায়। যাঁদের নাম এলো না তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

সম্পাদনার ক্ষেত্রে তোমার বৈশিষ্ট্য হলো লেখা নির্বাচন। দৃষ্টিভঙ্গির সাবলীলতা। পত্রিকার প্রচ্ছদ তো নতুন হবেই অঙ্গসজ্জার জন্যে গল্পের শিরোনামে ইলাস্ট্রেশনে। তা-ও আবার নামী সব শিল্পীকে একসঙ্গে ধরার প্রচেষ্টা। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন। একবার শিল্পকলার জেলা অফিস উদ্বোধনের জন্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাই। আমরা যে-কজন ছিলাম তার মধ্যে রফিকুন নবী, আমি ও চারুকলার পরিচালক সুবীর চৌধুরীসহ সাংবাদিক হিসেবে হাসনাত তুমিও ছিলে সঙ্গী।

রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম্রকানন-ঘেরা সার্কিট হাউসে আমাদের রাতযাপন। আমি আর নবী এক রুমে। তুমি সময় কাটানোর জন্যে আমাদের কামরায় অবস্থান। খুবই দামি গ্রিক কারণবারি পাওয়া গেল। তুমি এ-অমৃত থেকে চিরবঞ্চিত। শেষ পর্যন্ত তোমাকে রাজি করান গেল। একটা শর্তে যে, আমরা বাড়িতে জানাব না। আজ শর্ত ভঙ্গ করে অপরাধী হয়ে গেলাম। তোমার স্ত্রী নাসিমুন আরা হক মিনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় মাস্টার্স। আমার একমাত্র বোন আনফিসা ছিল ওর এক বছরের জুনিয়র। বোনটি ২০১৪ সালে কানাডায় টরন্টো শহরে ক্যান্সারে মারা যায়। সব সময় তার কথা মনে পড়ে মিনুর সাক্ষাতে। গৃহাভিমুখিনতায় ভুগি। তোমরা দুজন অজান্তে কখন আমার ঘরের লোক হয়ে গেলে আমি নিজেও জানি না।

মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তোমার নম্বরে ফোন করি। মিনু ফোন ধরে। ডিটেইল খবর নিতে থাকি। ওকে খুব আশাবাদী মনে হলো। বললে, তবে ভালো হতে সময় লাগবে। আশ্বস্ত হই। লাগুক সময়। ভালো হলেই হলো।

কদিন পর খবর পেলাম তোমার মৃত্যুর। মুহূর্তে আশা ভস্মীভূত হয়ে গেল।

স্বল্পবাক, মিতভাষী, কাজপাগল হাসনাত, তুমি অনন্তের পথে পাড়ি জমালে। আমাদের শোকসাগরে ফেলে।

কাকতালীয়ভাবে আমার অ্যানালগ মোবাইলের প্রথম নামটি এ-আক্রান্ত : অর্থাৎ শুরু আবুল হাসনাতকে দিয়ে; এই নামটি পর্দায় প্রদর্শন করার পর যাই অন্যদের কাছে। ফোনটির আয়ুষ্কাল যতদিন আছে নামটি আমাকে রোজ তোমার কথা মনে করিয়ে দেবে। বড় বেদনার মতো বেজেছো, তুমি হে …

পত্রটি কীভাবে সমাপ্ত করব! বড় দ্বন্দ্ব। শেষে বাঙালি সংস্কৃতির দ্বারস্থ হয়ে বলি …

প্রীতিভাজনেষু হাসনাত –

তোমার স্মৃতি চিরজাগরূক থাক।

ইতি – তোমার বুলবনভাই