সুহৃদ আবুল হাসনাতকে স্মরণ

এক

শোকাচ্ছন্ন মন নিয়ে সদ্যপ্রয়াত কোনো ঘনিষ্ঠ গুণীজন সম্বন্ধে কিছু লেখা কোনো দিনই সহজ মনে হয়নি আমার। ভারাক্রান্ত আবেগ আর তীব্র তাগিদের ব্যাপার অনুভূত হলেও তেমন লেখালেখি থেকে বিরত থাকারই চেষ্টা করি। অথচ চাপে আর অনুরোধে লিখতে বাধ্যও হতে হয়েছে বহুবার।

সেই চাপটি থাকত অতি ঘনিষ্ঠজন কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাহিত্য পত্রিকার খ্যাতিমান সম্পাদক আবুল হাসনাতের পক্ষ থেকে। লেখা না পাওয়া পর্যন্ত নাছোড় ভূমিকা তাঁর অব্যাহত থাকত। মনে আছে প্রথম এই কাণ্ড ঘটিয়ে ১৯৭৩-এ শিল্পী পাবলো পিকাসোকে নিয়ে লেখা আদায় করে ছেড়েছিলেন তাঁর সম্পাদনার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা গণসাহিত্যের জন্য। সেই থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালি ও কলমে অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকের মৃত্যু-পরবর্তী লেখা লিখতে হয়েছে তাঁর অনুরোধে। তবে এই লেখাটি লিখতে বসে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে। কারণ এই প্রথম তাঁর অনুরোধবিহীন একটি লেখা লিখছি একান্তই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আর এবার বিষয় তিনি নিজেই। গত ১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে তিনি পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করে চলে গেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুকে বিশ্বাস করতেই মন চায় না। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির আগের দিনও তাঁর প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা বলেছেন। আক্ষেপও করেছেন করোনার কারণে সৃষ্ট দিনকালের বিপর্যস্ততা নিয়ে। বাঁচা-মরার অনিশ্চয়তা নিয়েও কথা বলেছেন স্বভাবসুলভ হাসি ছড়িয়ে। সাবধান করতেও ভোলেননি। সবটা ভেবে ঘটনাটি মেনে নিতে কষ্ট হয়।

মনে পড়ছে তাঁর সর্বশেষ ফোনালাপটি।

‘নবীভাই, কেমন আছেন সুস্থ আছেন তো? এমনি ফোন করলাম। কাছের সবাই যেভাবে মারা যাচ্ছে, ভয়ই লাগে – কে কখন করোনার কবলে পড়ে।’ – ফোনে হাসনাতের কথা শুরুর ‘এমনি’ শব্দটি ব্যবহারের ব্যাপার চিরকালই একই রকম ছিল। তবে বুঝে নিতাম যে ‘এমনি’ বলাটা আসলে এমনি-এমনি নয়। কিছু একটা বায়নার ব্যাপার রয়েছে। হয় তাঁর পত্রিকাটির ইলাস্ট্রেশন-প্রচ্ছদ, কিংবা পরবর্তী সংখ্যার কোনো নতুন প্ল্যানের কথা পাড়বেন মতামত জানতে। সেইটি শোনার অপেক্ষায় থাকতাম।

 সেদিনও একই কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই প্রথম পত্রিকা বা প্রকাশনা নিয়ে কিছু না বলায় অবাক হয়েছিলাম। বলেছিলেন, ‘অনেকদিন কারো সাথে কারো দেখাসাক্ষাৎ নাই। কবে যে দেখা হবে তারও নিশ্চয়তা নাই। কার যে কখন আগে ডাক আসে কে জানে! কোভিড-১৯ রোগটা তো কাউকেই ছাড় দেবে না মনে হচ্ছে। আর শিল্প-সাহিত্যের মানুষরাই তো দেখছি টার্গেট।’

তাঁর শেষ বাক্যটি শুনে একটু ক্রুড ধরনের রসিকতা করার ইচ্ছা হয়েছিল। সাক্ষাতে বা ফোনে কথোপকথনে প্রায়শই রসিকতা মেশাতাম। তেমনটা করতাম কারণ তিনি উপভোগ করতেন। যদিও তাঁকে কখনো রসিকতা করতে শুনিনি। খুব জোর ‘বেশ আছেন ভাই, নিরানন্দের বিষয়েও দিব্যি আনন্দিত হবার কথা বলতে পারছেন।’ – এই ধরনের কথা বলতেন।

তো সেদিন বলেছিলাম, ‘ঠিকই বলেছেন। শিল্প-সাহিত্যের মানুষরাই যেন টার্গেট – এই করোনা কোভিড-১৯-এর। সিনিয়রদের প্রায় সবাই তো চলে গেলেন একে একে, রোগটার কবলে পড়ে। এই ভাইরাসটা নির্ঘাৎ একাত্তরের রাজাকারদের সাঙাত। বুদ্ধিজীবী নিধনে নেমেছে মনে হয়।’

অন্যদিন হলে রসিকতা শুনে হাসতেন, কমেন্টও করতেন। সেদিন তেমন কিছু না করে বলেছিলেন, ‘আনিস স্যারেরটার মতো বশীরভাইয়ের ওপরে বড় একটা সংখ্যা করব ভাবছি। গুছিয়েই উঠতে পারছি না। তাঁকে নিয়ে গত সংখ্যায় কিছু লেখা ছাপা হয়েছে। আপনাকে বলিনি তখন। বিশেষ সংখ্যার জন্যে কিন্তু লিখতেই হবে। এখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরর সংখ্যা নিয়ে কাজ হচ্ছে তা তো জানেনই। পোর্ট্রেটটা ভালো হয়েছে।’

কথা শেষ করার আগে স্বভাবসুলভ বিনয় করে বলেছিলেন, ‘নবীভাই, আমার স্মৃতিকথার বইটি পড়েছেন কি? কষ্ট করে পড়বেন। খুব শঙ্কিত আছি। ইমোশনাল হয়ে কী না কী সব লিখে ফেলেছি হুজুগে। আপত্তিকর বা অবান্তর কিছু চোখে পড়লে বলবেন। সিনসিয়ারলি বলবেন কিন্তু। তারিক সুজাত খুব যত্ন নিয়ে ছেপেছে অবশ্য। দিনকাল খারাপ। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। জীবনে বড় কিছু তো করা হয়ে উঠল না। তাই এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। ঠিক বললাম কি?’

তারপর কথা সংক্ষেপ করে হঠাৎ ফোন কেটে দিয়েছিলেন। আমার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই। এর দুদিন পরই শুনলাম পিত্তথলির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফোনে জানার চেষ্টা করলাম। ফোন বন্ধ। তাঁর সহধর্মিণী মিনুর ফোন নম্বর জানা ছিল না। অতএব সরাসরি কিছু জানা হলো না। তবে করোনার ব্যাপার নয় ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলাম। যদিও হাসপাতালে ভর্তি মানেই তো সিরিয়াস সমস্যা – এমন শঙ্কাটি মন থেকে হটানো যায়নি। তারও দুদিন পর শুনলাম  নিউমোনিয়ায়ও আক্রান্ত হয়েছেন। খবর পেলাম অবস্থাটা খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। শঙ্কা বাড়তে থাকল ক্রমশ।

ইদানীং হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারটি ঘটলেই আতঙ্কিত হতে হয়। কারণ সাধারণ বা অন্য কোনো অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হলেও করোনার কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে শুনতে পাই। আর আইসিইউতে ঢোকালেই নিউমোনিয়ায় ধরা যেন প্রায় নিয়মই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানীসহ অনেকের ব্যাপারে নাকি তাই ঘটেছিল। অতএব সেই দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। যদিও মন বলছিল হাসনাতের ক্ষেত্রে তেমন ঘটবে না। তাঁর মতো সুস্থ-সবল, হাসিখুশি, শান্তিপ্রিয়, নির্ভেজাল ভালো মানুষটিকে বড়সড় রোগবালাই ধরতেই পারে না।

তাঁর বাল্যবন্ধু প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের লুভা নাহিদ চৌধুরী প্রতিনিয়ত তাঁর খোঁজখবর রাখছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই তাঁর খবর জানতে পারছিলাম। একসময় শুনতে পেলাম ভালো আছেন তিনি। অনেকটাই সুস্থ। নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাসায় ফিরলেই গিয়ে হাজির হবো। আবার শুনব তাঁর প্রিয় পত্রিকা কালি ও কলম নিয়ে নতুন সব পরিকল্পনার কথা। কিন্তু সবকিছুকে তুচ্ছ করে দিয়ে আচমকাই পরদিন চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে তাঁর পদচারণা আর থাকবে না, কালি ও কলম পত্রিকা দফতরে অসংখ্য বইপত্র এবং পাণ্ডুলিপিভর্তি টেবিলের পাশে তাঁর চেয়ারটি শূন্য চেহারা নিয়ে স্থির হয়ে থাকবে – এমনটা ভাবতে মান ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। ভাবতে কষ্ট হয় যে-কোনো আড্ডায় তাঁর চিরকালীন অবধারিত উপস্থিতি আর থাকবে না।

মৃত্যুর কদিন আগেও অন্য অনেকের চলে যাওয়া নিয়ে মন খারাপ করে স্মৃতিচারণ করছিলেন। বিশেষ করে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, শিল্পী সুবীর চৌধুরী এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ ছিলেন বিষয়। তাঁদের নিয়ে প্রায়শই আক্ষেপ করতেন। সেদিনও একই রকম দুঃখ-ভারাক্রান্ত কিছু স্মৃতি স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘মানুষগুলি যে নেই এটা ভাবলেই কেমন শূন্যতা অনুভব করি। ভুলতে পারি না। কোনো কিছু করতে গেলেই তাঁদের অনুপস্থিতিটার কথা মনে আসে।’ তাঁদের হারানোর শোক তিনি আসলে কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আলাপে বসলে তাঁদের প্রসঙ্গ টানতেনই এবং তা বলতে গিয়ে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। তাঁদের নিয়ে এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তিনিও চলে গেলেন।

দুই

আবুল হাসনাতের সঙ্গে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের। দিনক্ষণ মনে নেই, তবে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে যে তা নিশ্চিত। সে-সময়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উত্তাল আন্দোলনে নানাভাবে জড়িত থাকার মধ্য দিয়ে পরিচয়টি ঘটেছিল, সে-কথা মনে আছে। খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র রাজনৈতিক পোস্টার আঁকিয়ে নিতে আসত! মতিউর রহমান এবং আবুল হাসনাত ছিলেন এই কাজে প্রধান ভূমিকায়। তাঁদের সুবাদে আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাঁদের বন্ধু মফিদুল হক, মাহফুজ আনাম, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ এখন দেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

কিছুদিন ধরে তাঁকে প্রায়শই স্মৃতিকাতর হতে দেখতাম। দৈনিক সংবাদে কাজের কথা, ছাত্রজীবনের কথা, তখনকার রাজনীতির মানুষদের কথা, বন্ধুদের কথা বলতেন খুব। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কর্মকাণ্ডের কথা বলতে বলতে ইমোশনাল হয়ে যেতেন। তরুণ প্রগতিশীল অংশের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়া, বড় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া, আলোকিত ব্যক্তিবর্গের স্নেহপ্রাপ্তি, সাংস্কৃতিক জগতে জড়িয়ে পড়া, এমনকি খেলাধুলায় আকৃষ্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন।

আড্ডায় বসলে হাসনাত ওই সময়টিকে বারবার মনে করিয়ে দিতেন। বলা যায়, স্মৃতির পাতা খুলে বসতেন। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসত তাঁকে। তা নিয়ে ঠাট্টাও করতাম। হাসনাত তা শুনে বলতেন, ‘নবীভাই, যা-ই বলেন না কেন, ওই দশকটি এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে আজকের জন্য তৈরি করে দিয়েছে। যে যে-ই ক্ষেত্রে রয়েছি, কিছু করছি, তার শিকড়টা তো সেই সময়টি।’

তাঁর কথা শুনে কয়েক দশকের নানা দিকের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার পরামর্শ দিতাম। হাসনাত বলতেন,  ‘মাঝে মাঝে ভাবি। কিন্তু সাহস হয় না। অত বড় কিছু তো নই, আত্মজীবনী লিখলে পড়বে কে?’ এভাবে কুণ্ঠা ব্যক্ত করতেন বটে কিন্তু পরে অন্তত দুটি স্মৃতিকথার মতো চমৎকার বই লিখেছেন। সেগুলো সুশীল পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।

তিনি যে শুধু নিজে লিখেছেন তাই নয়। অনেককে দিয়ে লিখিয়েছেন, তা থেকে আমিও বাদ যাইনি। প্রায় জোর করে লিখিয়ে বইও প্রকাশ করেছেন। তাঁর আবদারে লেখক না হয়েও লেখালেখিতে মন দিতে হয়েছে বহুবার। বয়সে কিছুটা কনিষ্ঠ হলেও বন্ধুর মতোই কয়েকটি দশক ধরে চলা দীর্ঘ পথযাত্রায় তাঁকে খুব আপন এবং সুহৃদ হিসেবে পেয়েছি। পরে তো অতি নিকট আত্মীয়তাও ঘটেছে। অতএব তাঁর আবদারগুলোকে কোনোভাবেই এড়ানোর উপায় থাকত না। তবে সবচেয়ে বড় দিক, অর্থাৎ তাঁর চমৎকার বিনয়ী স্বভাবটির কারণে তাঁর কোনো অনুরোধ অগ্রাহ্য করা যেত না।

ভাবলে অবাক হই যে আমি চিত্রকলা চর্চার একজন, আর হাসনাত সাহিত্যের। অথচ একসঙ্গে সংস্কৃতিজগতে জড়িয়ে থেকেছি চিরকাল নানাভাবে। এবং আবিষ্কার করি যে, সাহিত্যের জগৎটি আমার চেনার ব্যাপারটি তেমন গভীরতা না পেলেও শিল্পীদের জগৎ-শিল্পকলার দিকটিতে হাসনাত অত্যন্ত প্রিয় একজন হতে পেরেছিলেন। সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট-একনিষ্ঠ থেকেও শিল্পকলার প্রতি, বিশেষ করে চিত্রকলার প্রতি অপরিসীম দুর্বলতা কী করে ঘটে গিয়েছিল তাঁর, তা ভেবে বিস্মিত হই।

কোন শিল্পী কেমন কাজ করছেন, নতুনত্বের সন্ধান, তরুণ শিল্পীরা কী করছেন, ধরন-ধারণের দিকগুলিতে কেমন পরিবর্তন চলছে – এসব জানার চেষ্টা করতেন। নিজে এসব নিয়ে লিখতেন। অন্যদের দিয়ে লেখাতেনও। অবশ্য বলতেন যে, সাহিত্য নিয়ে, নাটক-থিয়েটার-সিনেমা নিয়ে যত লেখা হয়, লেখক তৈরি হয়েছে, চিত্রকলা-ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য নিয়ে লেখার দিকটি সে-তুলনায় পিছিয়ে আছে। অতএব শিল্পকলা নিয়ে লেখার জন্য অনেককে অনুরোধ করতেন এবং কাজটির ব্যাপারে তরুণ শিল্পীদেরই উৎসাহিত করতেন। শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটিতে আমিই শুধু নই, অন্য শিল্পীদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল চিরকাল। আমি বুঝেছি যে, শিল্পী এবং শিল্পকলার প্রতি অবাধ রুচির টানই জগৎটির উঠানে চোখ রাখায় তাঁর প্রধান সাঁকো ছিল।

পরবর্তীকালে সেই সুবাদে দেশের সম্ভ্রান্ত একজন শিল্প-সংগ্রাহকই হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু দেশের নামী শিল্পীদের শিল্পকর্মই নয়, ভারতীয় শিল্পীদের কাজের সংগ্রহও তাঁর বিশাল। কিছুদিন আগেও তাঁর সংগ্রহের বিপুলতা নিয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ‘আপনি তো বিলিওনিয়ার রে ভাই!’

হাসনাত লজ্জায় কাঁচুমাঁচু হয়ে বলেছিলেন, ‘নবীভাই, শেষে আপনিও খোঁচাটা দিলেন? শখে শখে এতদূর জোগাড় করা। ভালো লাগা থেকে সরতে পারি না। সংগ্রহ করাটাই আসল। বাকিটা ভাবিনি কখনো।’

বলেছিলাম, ‘আরে না, অন্যভাবে নিয়েন না। আর্থিক সংখ্যাটা এমনিই উল্লেখ করলাম। নামিদামি শিল্পীদের মূল্যবান সব কাজ রয়েছে। তাতে সংগ্রহটি যে কত ‘রিচ’ সেইটা মিন করতে চাচ্ছি।’

হাসনাত সবটা শুনে হা-হা করে হেসেছিলেন। বইয়ের সংগ্রহটি তো আরো বিশাল। বাড়িভর্তি – সব আলমারিতে ঠাসা বই। এইটি তাঁর নিজের আসল জগৎ। প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রকাশিত বই-পুস্তকের বিশাল সম্ভার। তাতে দুর্লভ বইপত্রের সংখ্যাও অনেক। বলতেন, ‘এই নিয়ে বেশ আছি নবীভাই। পাশে মিনু আছে (স্ত্রী)। আছে কন্যা দিঠি এবং নাতনি। ওরাও তো অবশ্য দূরে বিদেশে থাকছে আমেরিকায়। আর আছে এইসব। এসব নিয়েই তো সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম।’

তাঁর শিল্পকলায় এবং বইপত্রে দুর্বলতার অগাধ গভীরত্ব ছিল বিস্মিত হওয়ার মতো। আসলে তো সাহিত্য তাঁর নিজ চর্চাক্ষেত্র। পেশাগতভাবেও এই ক্ষেত্রটিই তাঁকে চিরকাল চলমানতা দিয়েছে। কিন্তু শিল্পকলা এবং শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগকেও তিনি বিশেষ মর্যাদা দিতেন। এই বিষয়ের উৎস তাঁর স্কুলজীবনে, দেশের তিন খ্যাতিমান শিল্পীকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া। এঁরা হলেন – মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর এবং কাজী আবদুল বাসেত। হাসনাতকে গর্ব করে বলতে শুনতাম যে, সাহিত্যে মনোনিবেশেরও অনেক-অনেক আগে শিল্পকলা নিয়ে, শিল্পীদের নিয়ে তাঁর ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল এই তিনজনের সান্নিধ্যে এসে।

পরবর্তীকালে তো শিল্পীদের সান্নিধ্যের, তাঁদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারটি আরো বিস্তৃত হয়েছিল। তখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রমুখ থেকে শুরু করে তাঁদের পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের বহু শিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভালো লাগত দেখে যে হাসনাত জ্যেষ্ঠ সব শিল্পীর খুব প্রিয় ছিলেন, স্নেহভাজন ছিলেন। যেমনটা ছিলেন দেশের সব জ্যেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকেরও। দেখেজি সারাজীবন তাঁদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জানানোর দিকটিও। নিজের লেখালেখিতে তো বটেই, আন্তরিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সম্মান জানাতে দেখেছি। শুধু দেশ এবং উপমহাদেশের সাহিত্যাঙ্গনই নয়, শিল্পকলার চর্চার গতিপ্রকৃতি, সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক ধরন-ধারণের নিত্যনতুন পর্যায়গুলিকে পত্রিকায় নিয়মিত তুলে ধরতেন। এসবের জন্যে শিল্পীমহলে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার আসনটিতে আসীন ছিলেন। চিরকাল স্মরণীয়ও হয়ে থাকবেন।

মনে পড়ছে শিল্পকলার প্রতি তাঁর প্রবল টানটি একসঙ্গে বিদেশ-ভ্রমণে গিয়ে দেখেছি। গত দশকের দিকে একটি প্রদর্শনী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে। তাঁকে দেখেছি সেখানে দিন-দশেকের অবস্থানকালে, বিশেষ করে নিউইয়র্কের মোসার্ত এবং গাগেনহেইম মিউজিয়ামে বেশিরভাগ সময় কাটাতে। তাঁর এই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে আমি সঙ্গী হয়েছিলাম। যদিও সেগুলো আগেও আমার দেখা ছিল।

খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে শিল্পকর্মগুলিকে দেখতে সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। একই ব্যাপার ঘটত সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। বইপত্রের দোকানেও অঢেল সময় কাটাতেন। পছন্দসই বই পেলে এতটাই উত্তেজিত হতেন যে একগাদা ভারি ভারি বই কিনতেন। উড়োজাহাজের নির্ধারিত ওজনের কথা বেমালুম ভুলে যেতেন।

এত কিছুর মধ্যেও তাঁর প্রিয় খ্যাতিমান কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে পুরো এক সন্ধ্যা কাটাতে ভোলেননি। বাংলাদেশের সমসাময়িক কবি, কবিতা, কথাসাহিত্যের চর্চা নিয়ে আন্তরিক আলাপচারিতা আর বিশ্লেষণ – বিদেশে আছেন যে সে-কথা যেন মনেই ছিল না। জ্যাকসন হাইটসে বাঙালিদের বইয়ের দোকান মুক্তধারাতেও গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন। আলোচনা করেছিলেন শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক পত্র-পত্রিকা এবং বইপত্র নিয়ে। মূল বিষয় ছিল কালি ও কলম এবং শিল্প ও শিল্পীর প্রচার-প্রসারে করণীয় নিয়ে।

আসলে পত্রিকাগুলিকে নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না। মান সম্পর্কে ভাবতেন। নতুন আর কী সংযোজন করা যায় বা উচিত তা নিয়ে পরামর্শ করতেন। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর পরিচিতি এবং সম্মান ছিল অভিভূত হওয়ার মতো। আমি তাঁর সঙ্গে কয়েকবার কলকাতা যাওয়ার সুযোগে তা প্রত্যক্ষ করেছি। খ্যাতিমান প্রবীণ, নবীন কিংবা উঠতি কবি-সাহিত্যকদের সঙ্গে হাসনাতের ঘনিষ্ঠতা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। দেখেছি কলকাতায় পৌঁছামাত্রই কবি-সাহিত্যিকদের অঢেল নিমন্ত্রণ পাওয়া শুরু হতে। প্রবীণরা তাঁকে স্নেহ করতেন এতটাই যে কালি ও কলমের জন্যে লেখা দিয়ে দিতেন অবলীলায়, বই ছাপার জন্যে পাণ্ডুলিপিও দিয়ে দিতেন। শুধু যে পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবেই সম্মানীয় ছিলেন তা নয়, তাঁর লেখালিখির জন্যও তিনি সেখানে সুনামের অধিকারী হতে পেরেছিলেন।

কলকাতায় তাঁর এই পরিচিতি এবং ভারতে শিল্পসাহিত্যের পীঠস্থান এই শহরটিকে ভালো লাগার পর্যায়টির শুরু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। তখন নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শিল্প-সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সবার প্রিয়ভাজন হতে পেরেছিলেন। সেইসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে লেখালেখির দিকটি সামলাতেন। আমি ১৯৭৯ সালে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কলকাতা-ভ্রমণে গিয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিকের মুখে তাঁর কথা শুনেছিলাম। অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর কথা।

হাসনাত গল্প করতে বসলে পৃথিবীর দুটি জায়গা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে স্মৃতিতাড়িত হতেন, উচ্ছ্বসিত হয়ে জায়গা-দুটির অভিজ্ঞতা যে তাঁর জীবনে নানাভাবে অনুপ্রেরণা হয়েছে তা ব্যক্ত করতেন। জায়গা-দুটি পৃথিবীর অন্যতম দুটি শহর। একটি কলকাতা, অন্যটি মস্কো। দুই শহরের দুরকমের শিল্প-সাহিত্যের এবং সাংস্কৃতিক দিকের পরিবেশ হলেও দুটি থেকেই নির্যাসপ্রাপ্তির ব্যাপারটিকে গণ্য করতেন।

তিন হাসনাতের আকস্মিক চলে যাওয়ায় লেখাটি লিখতে বসে অনেক স্মৃতিই মনে ভিড় করছে। সংক্ষিপ্ত এই লেখাটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খতায় যাওয়া সম্ভব হলো না। তিনি নিজে সুলেখক ছিলেন। তাই নিজের জীবনের খুঁটিনাটি তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন তাঁর স্মৃতিকথা গ্রন্থে। আমি আশা করব, গদ্য এবং কবিতার বইগুলোসহ তাঁর যাবতীয় সাহিত্যকর্ম সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে পুস্তকাকারে এবং তা সম্ভব করতে এগিয়ে আসবে তাঁর শুভানুধ্যায়ী প্রকাশকবৃন্দের কেউ না কেউ। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।