ওপারের কণ্ঠ থেমে গেলেও রিসিভার হাতে বসে থাকে জীবক। বুকের মধ্যে খুশির তুফান সত্ত্বেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ভুল শুনেছে বা ভুল বুঝেছে এমনও মনে করার কোনো সুযোগ নেই। অপালা একাধিকবার বলেছে। বলার মধ্যে আন্তরিকতা তো ছিলই; আরো কিছু বেশিও যেন ছিল। আবেদন? নাকি অনুনয়? সেজন্যেই প্রশ্ন জাগছে মনে। এত বছর হাজার বলেও যা হয়নি আজ অবিশ্বাস্যভাবে অপালা নিজেই আহ্বান করবে, তা কি দূর-স্বপ্নেও কল্পনা করা যায়! আহ্বানের আর্জেন্সিও অনুভাবনীয়। এক ঝাঁক নৃত্যপর তিতিরের মতো টেলিফোনের শব্দগুলো জীবকের আনন্দ-বিহ্বল অনুভবে কলকল করছে। অথচ অভিমানবশত গত দেড়-দুমাসে ও একটা ফোনও করেনি অপালাকে। ওর ফোন পেয়ে তাই আরো বেশি অবাক লেগেছে। অপালা নিজে থেকে এর আগে কবে ফোন করেছিল তার হদিস পেতে প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণার দরকার। যদিও গত দশ বছর নিশ্চিতভাবে মানসিক প্রতিবেশীর সম্পর্কে যথেষ্ট উষ্ণতা ও প্রশ্রয় ছিল। অপালার চেয়ে সুন্দরী আরো দেখে জীবক। কিন্তু এমন বহু রুচির ও সংবেদনশীল রমণী আর দেখেনি। সে-কারণেই সম্ভবত প্রথম দেখার পর থেকেই জীবক অপালার প্রতি এক অরোধ্য আকর্ষণে তাড়িত হয়েছে। সাহিত্য-সংগীতের আসরে, জনকল্যাণের কর্মসূচিতে এক সঙ্গে অনেক যোজন পেরিয়েছে। অপালার উচ্ছল প্রাণময়তা ও কর্মনিষ্ঠা দেখে অন্যদের মতো নিজেও মুগ্ধ হয়েছে বারবার। তবু অন্তর্লীন অসিধারা অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি তখনো। মিষ্টি হেসে চোখের তারায় মৃদু প্রশ্রয়ের আভাস ফুটিয়ে জীবকের সব প্রত্যাশার দাবি হিমঘরে পাঠানোর এক অপরূপ কুশলতায় অপালা অতুলনীয়া।
সেই অপালা আজ ফোনে প্রথমেই বলল, এমন বিষণœ দিনে অফিসে বসে আছ?
-যখন ঢুকেছিলাম আকাশে প্রসন্নতা দেখেছি। এসি ঘরে বাইরের বদলের আঁচড় বা আদল কোনোটাই পৌঁছায় না। তা হঠাৎ তোমার দিন বিষণœ কেন?
-কতদিন দেখি না তোমায়। একটা ফোনও করোনি। এমন নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত থাক কী করে? অথচ দেখা হলেই বলো, তুমি কত আন্তরিক বন্ধু আমার।
-ভুল বলেছি বলে মনে হয়েছে কখনো? তুমিই তো শীতল ঔদাস্যে আমাকে রেখেছ দিগন্তের অন্যপারে।
-ঔদাস্য নয়, জীবক। অপারগতা বলতে পারো। কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা। এখন বুঝি, ওসব শব্দে লুকিয়ে রাখতাম আত্মপ্রবঞ্চনার গ্লানি। জীবক, এ-লাইনগুলো শুনেছ, ‘অনেক শব্দ, কাজ নেই আমাকে আর বলে;/পারো তো আমার দিকে ফেরো/ সেই যথেষ্ট বেঁচে থাকতে।’
-না, পড়িনি বা শুনিনি। কার লাইন?
-হোসে মার্তি। কদিন ধরে খুব পড়ছি। আরেকটা শোনো, ‘তোমার গোলাপঝাড় থেকে যে গোলাপ/ তুমি দাও আমাকে সে তো এক ফুল; / তেমনি আমার এ ছন্দিত কথাগুলি/ আমার ব্যথার কিংশুক।’
-কী ব্যাপার, অপালা, কী হয়েছে তোমার?
-তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কি ঘটনার ঘনঘটা দরকার? আমি তোমাকে খুব মিস করছি, জীবক।
-রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা-
-না, জীবক। আমি সত্যি বলছি। তোমাকে আসতে বলার জন্যই আসলে ফোন করেছি।
-সত্যি বলছ?
-হ্যাঁ। এক্ষুনি চলে এসো।
-এক্ষুনি?
-হ্যাঁ, এক্ষুনি। এলে তোমার ইচ্ছাপূরণ হতে পারে। না-এলে পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। বলতে পারবে না যে, অপালা কথা রাখেনি।
-অফিস ছেড়ে এখন কী করে যাই বলো তো!
-ভেবে দেখো, তোমার এক জীবনের আকাক্সক্ষা-না প্রাত্যহিকের পাঁচালি, কোনটা তোমার বেশি কাম্য।
তারপরই ফোন রেখে দিয়েছে অপালা। কথাগুলো আরো একবার নাড়াচাড়া করে জীবক টেবিল ছেড়ে ওঠে। পিএ-কে ডেকে বলল, আমি এখনই বেরুব। আজ আর না-ও ফিরতে পারি। সই করার কাগজপত্র থাকলে নিয়ে আসুন।
কয়েকটা চেক ও চিঠি সই করিয়ে পিএ সদাশিব বলল, সন্ধেবেলা তাজে শ্রীনিবাসদের পার্টিতে যাবেন তো?
জীবক মুখ তুলে বলল, পার্টিটা যেন কটায়?
-কার্ডে আটটা লিখেছে। ককটেল অ্যান্ড ডিনার। ওঁরা আপনার কনফার্মেশন চেয়েছেন।
-ঠিক আছে, কনফার্ম করে দিন।
ইদানীং ট্যাক্সি পাওয়া সহজ হয়েছে। কিন্তু রাস্তার জ্যাম আর তজ্জনিত যানজট অসহ। মনে হয় যেন থেমে থাকার জন্যই গাড়িতে ওঠা। গতির বদলে যতি শব্দটাই কলকাতার রাস্তায় প্রযোজ্য। গনেশ এভিনিউ থেকে সুইনহো স্ট্রিটে আসতে লাগল ঠিক পঞ্চাশ মিনিট। পোড়া ডিজেলের গন্ধ আর দূষণক্লিষ্ট বাতাসে ভারি বুক নিয়ে ট্যাক্সি থেকে অপালাদের বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে নামল জীবক। নেমেই মনে পড়ল, পরাশরের কথা তো জিজ্ঞেস করা হয়নি। ও কি কলকাতায় নেই? থাকলে এমন অসময়ে ওকে অবশ্যই আসতে বলত না। এতদিন কখনোই বলেনি। আজ আচমকা কী হলো? মাথায় সূক্ষ্ম কাঁটা নিয়েই সাত তলার ফ্ল্যাটের ডোরবেলে হাত রাখল জীবক। মনে আছে পরাশরই সিসিএফসি ক্লাব থেকে জোর করে এই ফ্ল্যাটে ধরে এনেছিল প্রথমবার। পানচর্যায় সঙ্গ দেবার জন্যে। তারপর আরো অনেকবার এসেছে। পার্টি, আড্ডা, লোকজন ডেকে আমোদ-আহ্লাদ পরাশরও খুব উপভোগ করে। পরাশরের প্রিয় মানুষের তালিকায় জীবক অন্যতম হলেও অপালার প্রিয়জনের তালিকায় ওর স্থান ঠিক শীর্ষে না-হলেও কাছাকাছি নিশ্চয়। নইলে এত আমন্ত্রণ পেত কি! আজকের আহ্বানের কাছে আর সবই অবশ্য তুচ্ছ।
দরজা খুলেই অপালা বলল, এত দেরি করলে কেন?
ভিতরে ঢুকে জীবক বলল, তুমি জানতে আমি আসব?
অপালা গাঢ় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, না-এলে তোমার এত বছর ধরে আমাকে বলা কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যেত না?
অভিমানী গলায় জীবক বলল, তুমি তো কখনো মানতে চাওনি। সব সময় ফিরিয়ে দিয়েছ।
কৌতুকের স্বরে অপালা বলল, ফিরিয়ে দিয়েছি তোমার আগ্রাসী আবেদন। প্রাণের নিবেদন রেখেছি প্রাণের অনেক গভীরে।
জীবক বলল, সরোবরের গহনে গোপন কুঠুরিতে সোনার কৌটায় রাখা প্রাণ-ভোমরার মতো?
দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল। অপালা জীবকের বুকে ছোট্ট কিল মেরে বলল, ঠিক তাই।
জীবক বলল, পরাশর কোথায়?
তীর্যক চোখে অপালা বলল, ডেকেছি আমি। ওর খোঁজ করছ কেন? ও থাকলে সুবিধে হতো? মাল খাবে তো, আমিও দিতে পারব।
-কী যে বলো না! আসলে বেশ অনেকদিন পরাশরের সঙ্গে কথা হয়নি, দেখাও হয়নি-তাই।
-ও মুম্বাই গেছে তিন দিন আগে। আজ রাতে ফিরবে। এবার বলো কী খাবে?
-যা চাইব দেবে?
-চেয়ে দেখ।
-অনেক-অনেকবার চেয়েছি। কখনো দাওনি।
-যদ্দুর জানি স্কুলের পরে আর ইতিহাস পড়নি। স্কুলে কত নম্বর পেতে? টেনেটুনে পাশ করতে নিশ্চয়। না-পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ মনে হলে পাওয়ার অঙ্কে ভুল হয়। অনেক মানুষ ইচ্ছে করেই পাওয়াটা ভুলে যেতে চায়। আমি তা পারি না। আমি পাওয়াটুকুই মনে রাখি। ভাবি এ-ও তো না-ও পেতে পারতাম।
-হঠাৎ এত ফিলজফিক্যাল! ব্যাপার কী?
-কিচ্ছু না। তোমার জন্য কত যতœ করে সাজলাম, তুমি একবারও বললে না আমাকে কেমন দেখাচ্ছে।
জীবক চোখ ঘুরিয়ে অপালাকে দেখে, যেন ক্যামেরা ফোকাস করছে। সামান্যই প্রসাধন করেছে। লাল পেড়ে শাড়িতে সুন্দর নকশা। নিশ্চয় কোনো বুটিকের। মধ্য তিরিশ পেরিয়েও ওর শরীরে খাজুরাহোর ভাস্কর্যের সুষমা। ওর বুকের ঔদ্ধত্য থেকে জীবকের চোখের নিঃশব্দ নিরুপায়তা সেভাবেই ঝরে পড়ে যে-ভাবে পর্বতারোহী শৃঙ্গ থেকে নেমে আসে। জানালার পর্দার ফাঁক গলে আসা রৌদ্রের আলোকসম্পাতে অসম্ভব রূপবতী লাগে। প্রকৃতই মনে হয় অপালাকে এত সুন্দর আগে আর কখনো দেখেনি।
মুগ্ধ জীবক বলল, এত অপরূপ দেখাচ্ছে, তোমার আর সাজের দরকার কী! তোমাকে আমার মিস একজিসটেন্স বলতে ইচ্ছে করছে।
-ইচ্ছে করছে, কিন্তু বলছ না। তাই তো?
-না। বলছি, সত্যি করে বলছি।
-মনে থাকবে? নাকি এখান থেকে বেরিয়েই ভুলে যাবে!
-সারা জীবন মনে থাকবে, অপালা।
-উরে বাব্বা, এক্কেবারে সারা জীবন? তেমন অসমীচীন আশা করা উচিত নয়। আমি অল্পেই খুশি।
-আমার কিন্তু অল্পে হবে না।
ঠোঁটের ভাঁজে হাসি ফুটিয়ে অপালা বলল, কতটা হলে হবে?
অপালাকে দুহাতে জড়িয়ে জীবক বলল, সবটা। স-ব-টা।
অপালা বসার ঘর থেকে আশ্লিষ্ট জীবককে নিয়ে পাশের ঘরে বিছানায় বসে বলল, তোমরা দস্যুতা না-করে থাকতে পারো না বুঝি!
জীবক বলল, তোমাকে আজ দস্যুতা শব্দের ব্যুৎপত্তি শেখাব।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের তীব্রতা কমলে অপালা বলল, চা খাবে, না ড্রিঙ্ক নেবে?
জীবক আরো একবার ওষ্ঠ চুষে বলল, তোমার কী ইচ্ছে?
লীঢ় ওষ্ঠ আঁচলে মুছে অপালা বলল, তুমি ড্রিঙ্ক নিলে আমি সঙ্গ দেবো।
জীবক বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, সূয্যিমামা ডুবুডুবু, হুইস্কিই হোক।
অপালা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। মুখ মুছে চুল ঠিক করে। ওর মুখের ব্যাখ্যারহিত দীপ্তির ভাষা বোবা মুকুর কখনোই বুঝবে না।
বাথরুম থেকে ফিরে জীবক আবার ড্রইং রুমে বসার উদ্যোগ করলে অপালা বলল, ওখানে কেন? এখানে এসো। জীবক বলল, কাজের লোক বা অন্য কেউ যদি আসে, তাই-
অপালা বলল, কেউ আসবে না। আজ শুধু তুমি-শুধু তুমি।
জীবক আগের ঘরে ঢুকে দেখল, ট্রলিতে পানের পূর্ণ আয়োজন।
-বরফ লাগবে?-অপালা জানতে চায়।
জীবক জলের বোতল হাতে ধরে বলল, বেশ ঠান্ডা, বরফ লাগবে না।
অপালার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে জীবক বলল, তুমি?
নিজের গ্লাস বাড়িয়ে অপালা বলল, বিস্মরণীয়তার উদ্দেশে-
চমকিত জীবক বলল, এ-কথা কেন বললে?
অপালা বলল, দেখ যতই যা বলি না কেন, জীবনে অবিস্মরণীয় বলে কিছু হয় না। বিস্মরণই সত্য। বিস্মরণেই মাধুর্য। বিস্মরণ না-থাকলে মানুষের বাঁচা সম্ভব হতো না।
জীবক ওর গলার কাছে মুখ গুঁজে বলল, দারুণ সব কথা বলছ আজ। করুণাময়ী, অধমের প্রতি আজ এত করুণা কেন?
অপালা জীবকের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, করুণা নয় মোটেই। ঋণ শোধ করছি। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম। পারছিলাম না বলে নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতো।
-মাঝে মাঝেই কী যে বলছ কিছু বুঝতে পারছিনা।-বলে জীবক অপালার বাম স্তনে হাত রাখে।
অপালা ওর চুল টেনে বলে, জেন্টলি। ভঙ্গুর জিনিসের গায়ে হ্যান্ডেল-উইথ-কেয়ার লেখা থাকে, দেখোনি?
-তুমি কি ভঙ্গুর?
-সব নারীই ভঙ্গুর। ওদের শরীর তো আরো।
-শুধু তুমি ছাড়া। তুমি তো স্থিরযৌবনা-আমার হৃদয়নন্দনকাননবাসিনী।
নিজের আনন্দ খোঁজায় ব্যস্ত থাকায় জীবক দেখতে পেল না অপালার চোখে উজিয়ে ওঠা বাষ্পের ঢেউ, ঠোঁটের কাঁপুনি। বুকের মধ্যে ঘুলিয়ে-ওঠা যন্ত্রণা গিলে অতি ধীরে দীর্ঘশ্বাস ফেলাকে জীবক যৌন-শিহরণ ভেবে ভুল করে। অপালা সময় নিয়ে গ্লাসের ঠা-া তরলে জিভের ডগা চুবিয়ে নাড়ে। একটু পরে জীবক অপালার বুক থেকে মুখ সরিয়ে হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে বলল, ঋণের কথা কী বলছিলে?
ছোট্ট চুমুক দিয়ে অপালা বলে, তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ। সবটা হয়তো শোধ করতে পারব না। তবু যতটা পারি।
-আমার কাছে তো তোমার কোনো ঋণ নেই অপা।
-আছে বৈকি! এত বছর ধরে তুমি আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছ, আমাকে নিবিড় করে পেতে চেয়েছ, আমি সাড়া না-দিলেও মুখ ফিরিয়ে দূরে সরে যাওনি। তোমার স্তুতি বা আবেদন-নিবেদন যাই বলো, আমি যে নীরব অহংকারে গ্রহণ করিনি তা-ও তো নয়। দিনে দিনে তার সঞ্চয়ও বিপুল। তারপর গত নিউ-ইয়ার্স ইভের রাতটার কথা তো ভুলতেই পারি না। সেদিন তুমি যা খুশি করতে পারতে, অথচ কিচ্ছু করোনি। ভুল বললাম। অতি যতœ আর মমতায় আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলে। মনে আছে?
সে-রাতের কথা জীবক কখনোই ভুলবে না। মধ্যরাত পেরিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব থেকে বেরিয়েছিল। ক্লাব-বন্ধু রাকেশ রাওয়াত নাছোড় অনুরোধ করে ধরে নিয়ে গেল ওর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ফ্ল্যাটে। ক্লাবে উদ্দাম নাচানাচি করে অপালা খুবই ক্লান্ত। মদও খেয়েছিল অনেকটা। পরাশর তখনই প্রায় বেঁহুশ। ওই অবস্থায় মাতালদের আরো খাবার ঝোঁক চাপে। তাই রাকেশের প্রস্তাবে পরাশর সোৎসাহে রাজি। রাকেশের ফ্ল্যাটে দু-রাউন্ড পানের পর জীবক লক্ষ করে অপালা আর নিজেকে সম্ভ্রম-সম্মত রাখতে পারছে না। পরাশর সোফায় আধ-ঘুমন্ত। রাকেশ আরো নাচের অছিলায় অপালার শিথিল শরীরের অনুচিত খোঁজ নেওয়ার চেষ্টায় ব্যাপৃত। ক্রমে জীবকের মধ্যে সঞ্চারিত উষ্মা অসহনীয় হয়ে ওঠে। ও ঝাঁকুনি দিয়ে পরাশরকে দাঁড় করিয়ে অপালাকে বাড়ি ফেরার জন্য ডাকে। অপালাও তখন দাঁড়াতে পারছিল না। তবু বলল, চলো। চলতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার মুখে জীবক ওর বাহু ধরে টানলে অপালা বলে, জাস্ট ধরে রাখো, তাহলেই আমি যেতে পারব। পরাশরকে প্রায় আলুর বস্তার মতো গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে জীবক কোনোক্রমে অপালাকে সামনের সিটে বসিয়ে নিজেই গাড়ি চালায়। এক-এক বার চোখ খুলে অপালা খালি বলছিল, আমরা কি নিঝুমপুর যাচ্ছি, জীবক? তুমি গেছ নিঝুমপুর? আমার বহুদিনের ইচ্ছে নিঝুমপুর যাব। কেন যে বারবার ঐ কথাগুলো বলছিল, বুঝতে পারছিল না জীবক। অনেক পরে একদিন জিজ্ঞেস করায় অপালা নির্মল মুখে বলেছিল, নিঝুমপুর যাবার কথা বলেছিলাম বুঝি! কেমন করে বললাম বলো তো? কতকাল আগে তারাপদ রায়ের কবিতায় পড়েছিলাম, নিঝুমপুর। ঐ অবস্থায় কী করে মনে পড়ল!
ফ্ল্যাটে দুজনকে ওঠানোও ছিল বেশ আয়াসসাধ্য। অথচ ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়াতেই অপালা স্খলিত হাতে ব্যাগ খুলে চাবি বের করে জীবকের হাতে দিয়েছিল। পরাশর ড্রইংরুমের সোফাতেই শুয়ে পড়ল। জীবক অপালাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে আসার সময় ওর গলা জড়িয়ে অপালা বলেছিল, তুমি চলে যাচ্ছ কেন? ঘুমুবে? আর মদ খাবে না?
জীবক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ঘুমিয়ে পড়ো তুমি। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
ঘর ছেড়ে বেরুবার আগে জীবক অপালার জড়িত কণ্ঠ শোনে, ‘ফুরালো দিন ফুরালো মেলা/সকল অর্থে ভাঙলো খেলা’-
অপালা শরীর এলিয়ে জীবকের বুকে মাথা রেখে বলল, সেদিন নেশা হলেও আমি কিন্তু বেহুঁশ হইনি। সকালে সবই মনে পড়েছিল। এমনকি তুমি যে ক্রুদ্ধ চোখে রাকেশের দিকে চেয়েছিলে, তা-ও। আমার জন্যে তোমার তীব্র আকাক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও সেদিন তুমি একটা চুমু খাওয়ারও চেষ্টা করোনি। অথচ সবই করতে পারতে। আমি বাধাও দিতাম না। হয়তো পারতামও না। বুঝেছিলাম তোমার মধ্যে লোভ-লালসার বদলে আছে অন্য এক অঙ্গীকার-ভালোবাসার অভিমান। তুমি ছাড়া এত ভালোবাসা আমাকে আর কেউ দেয়নি। এরপরও বলবে তোমার কাছে আমার ঋণ নেই?
-আমি তো জানি পরাশরের প্রেমে তুমি এমন মগ্ন, যে আর কারো অর্চণা তোমার চোখে ধরা পড়ে না।
-ভুল। খুব ভুল জানো তুমি।
-তাই?-বলে খালি গ্লাস ভরে নিয়ে জীবক আবার অপালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অপালা বলল, আস্তে। বলেছি না জেন্টলি। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। শোনো না, তোমাকে কত কিছু বলার আছে। কতবার ভেবেছি বলব। বলা আর হয়ে ওঠেনি।
জীবক ওর অনাবৃত বুকের সুঢৌল গোলকে মুখ ডুবিয়ে বলল, তুমি বলো, আমি শুনছি।
অপালা বলল, তুমি বোধহয় জানো না, আমাদের সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল। ওর ডাক্তার বাবা আমার বাবার চিকিৎসা করতে এসে আমাকে পছন্দ করে ফেলেন। আমি তখন ইংলিশ অনার্স করে ফিফথ ইয়ারে। তড়িঘড়ি বিয়ের পর আর পড়া হলো না। পরাশরের সঙ্গে ইন্দোর যেতে হলো। তারপর ছেলে হলো। ছেলেকে নিয়ে মেতে রইলাম। হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাকে আর কারো প্রয়োজন নেই। ছেলে হোস্টেলে। আগামী বছর ওর বাবা ওকে স্টেটসে পাঠাবে। নইলে নাকি স্টেটাস থাকবে না। ছেলেরা স্টেটসে গেলে কী হয় আমরা সবাই জানি। দেখছিও। তবুও পাঠাবে।
ব্যস্ত মুখ তুলে জীবক বলল, বড় হলে ছেলেমেয়েদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অবধারিত। চাকরির জন্যও তো বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়। আমি বাড়ি ছেড়েছি সতেরো বছর বয়সে। গত তিন বছর মার কাছে বিলাসপুরে যাওয়াও হয়নি। ওজন্য মন খারাপ করলে চলে! সবচেয়ে
বড় কথা পরাশর আছে-শুধুই তোমারই জন্যে।
অপালা জানতে চায়, বিয়ের ক-বছর পর তোমাদের ডিভোর্স হয়েছিল?
-চার।
-কেন?
বিরক্তির স্বরে জীবক বলে, তৃষার মনে হয়েছিল, আমাদের আর পরস্পরকে দেবার কিচ্ছু নেই এবং ও যেন একটা ডোবায় আটকে আছে। ও বৃহত্তর জগৎ দেখতে চেয়েছিল। দিল্লি গিয়ে আবার বিয়ে করেছিল, শুনেছি সেটাও টেকেনি। আনফরচুনেট!
অপালা বলল, তাহলে বোঝ, আমাদের বিয়ে হয়েছে ষোলো বছর। ব্যবহৃত হতে-হতে এখন আমাদের পরস্পরকে আর কিছু দেবারও নেই, চাওয়ারও নেই, শুধু অতৃপ্তি আর অশান্তি ছাড়া। যদি বলো, তাহলেও আছি কেন, তার কারণ মূলত আর্থ-সামাজিক বাধ্যকতা। বাকিটা অভ্যাস। আর, এ বয়সে নতুন করে রিস্ক নেবার সাহসের অভাব।
একটু থেমে অপালা গাঢ় আশ্লেষে জীবককে আঁকড়ে বলল, তুমি আমার দিগন্ত অবাধ করে দিয়েছিল। আমার আর কোনো দুঃখ নেই।
জীবক আবার তোলপাড় তুলে ইচ্ছামতো অপালাকে তছনছ করে। শ্রান্ত জীবক বাথরুম থেকে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে ঘড়ি দেখে। সাড়ে সাতটা। ও যাবার জন্য তৈরি হয়। অপালা শাড়ি-জামা বদলে ম্যাক্সি পরে আসে। দেখে মনে হয়, সারাদেহে সূর্যমুখীর বর্ণাঢ্য প্লাবন। জীবক এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে মুগ্ধ চোখে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অপালা বলল, কী দেখছ?
জীবক বলল, সর্বনাশ নয়, এক জীবনের উপঢৌকন।
ভিতর থেকে উঠে-আসা আবেগ চাপা দিয়ে ঈষৎ ভারি গলায় অপালা বলল, ভালো লেগেছে তোমার? খুশি হয়েছ?
জীবক ওর ওষ্ঠে জিভ ঘষে বলল, এই অনুভবের অনুবাদ হয় না।
অপালা বলল, মনে থাকবে?
শ্বাস ফেলে আবার বলে, এখন পার্টিতে গিয়ে তো আকণ্ঠ গিলবে। সকালে মনে পড়বে আমাকে?
জীবক বলল, প্রথম দেখার পরই তো আর ভুলতে পারিনি। এতকাল শুধু তোমার রূপ দেখতাম, দুর্গান্ত ফিগার দেখে লোভী হতাম। আজ আবিষ্কার করলাম, তুমি একই সঙ্গে দ্রৌপদী, অহল্যা এবং উর্বশীও।
-মনে রাখবে, যা যা বললে?
-নিশ্চয় রাখব।
দুই
কতক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছিল বলা কঠিন। ঘুম চোখে রিসিভার তুলে হ্যালো বলার আগেই লাইন কেটে গেল। মাথার কাছে টেবিলে টাইমপিসে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠল জীবক। সাড়ে নটা বেজে গেছে। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে! গতরাতে খুবই বেশি মদ্যপান হয়েছিল। তাজ থেকে যে কখন ফিরেছে মনে নেই। নামিয়ে দিয়েছিল কে? দেবাংশু, না জ্যোতিপ্রকাশ? মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরুতেই আবার ফোন বাজল। দ্রুতপায়ে গিয়ে রিসিভার তুলল জীবক। -হ্যালো-
-কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? সকাল থেকে কতবার যে আপনাকে ফোন করেছে। না-পেয়ে বেরিয়ে গেল। আমাকে বলল, আপনাকে ধরার চেষ্টা করতে।-জ্যোতির স্ত্রী রিণির গলা বুঝতে ভুল হলো না।
-কী ব্যাপার বলো তো? জ্যোতি গেছে কোথায়?
-আপনি এক্ষুনি একবার পরাশরদার বাড়ি যান। ও সেখানেই গেছে। আমিও বাবিনকে স্কুলে পাঠিয়ে যাচ্ছি।
রিণি পরাশরের দূর-সম্পর্কের বোন। গাঢ় ঘনিষ্ঠতা না-থাকলেও যাওয়া-আসা আছে।
জীবক ব্যগ্র স্বরে বলল, কী হয়েছে পরাশরের?
-আমি ঠিক জানি না। তবে সিরিয়াস কিছু। আপনি একদম দেরি করবেন না।
টেলিফোনের লাইন কেটে জীবক পরাশরের নম্বর ডায়াল করে। এনগেজড। যতবার ডায়াল করে এনগেজড পায়। ওর বুকের মধ্যে আলোড়ন, মাথায় অজস্র চিন্তা। কী হতে পারে! রিণি বলল, সিরিয়াস। মুম্বাই থেকে ফেরার পথে কিছু হয়েছে পরাশরের? অপালা ওকে কেন ফোন করল না? নাকি ও নেশার ঘোরে শুনতে পায়নি? সার্ট-প্যান্ট পরার মধ্যে ও আবারও পরাশরের নম্বর ডায়াল করে। এনগেজড। না, আর দেরি করা যায় না। জীবক ছুটন্ত পায়ে চার তলা থেকে নেমে আসে। এখন ট্যাক্সি পেলে হয়। পেলেও গল্ফগ্রিন থেকে পৌঁছাতে যে কতক্ষণ লাগবে!
টিভি সেন্টার থেকে একটা ট্যাক্সি বেরোচ্ছিল। জীবক প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, সুইনহো স্ট্রিট। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি যাবেন।
কোনো হাউজিং কমপ্লেক্সে ঢুকে বোঝার উপায় থাকে না কোথাও কারো বিপদ ঘটেছে কি-না। টাওয়ারের মতো বাড়িগুলো ঘিরে থাকে মৌন নৈর্ব্যক্তিকতা। সাত তলায় লিফট থেকে বেরুতেই কিছু মানুষের ভিড় দেখা গেল। মৃদু শব্দের হুতাশ। উদভ্রান্ত পায়ে জীবক পরাশরের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে যায়। খোলা ফ্ল্যাটের দরজায় জ্যোতিপ্রকাশ। মুখে রুমাল চাপা।
জীবক জ্যোতির কাঁধে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে?
জবাব না-দিয়ে জ্যোতি ভিতরের ঘরের দিকে আঙুল দেখাল। করিডোরে অনেক স্ত্রী-পুরুষ। জীবক ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল, বিছানায় শায়িত অপালাকে। বিয়ের কনের মতো কেউ সাজিয়ে দিয়েছে। বিছানা ভরে আছে ফুলে। বিছানার পাশে নিঃস্পন্দ পরাশর। জীবককে দেখে চোখের ইঙ্গিতে কাছে ডাকে। স্তম্ভিত জীবক সম্বিৎহারা, চলচ্ছক্তিহীন। এই দৃশ্য সত্যি হতে পারে না। ও নিশ্চয় ভুল দেখছে। কিংবা কোনো সিনেমার শ্যুটিং। কে যেন বলল, পুলিশে খবর দিয়েছ? উত্তর শুনতে পারার আগেই কেউ যেন মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল জীবককে। ও এখন বিছানার পাশে। হাত বাড়ালেই অপালা। এই বিছানাতে ওদের শরীরের স্বেদ ও উত্তাপ এখনো কি মিশে নেই? অপালার মুখ চিরদিনের মতো অমলিন। গোলাপি লিপস্টিকে যেন আঁকা আছে ‘মনে থাকবে’ উচ্চারণের স্ফুরণ। জীবক রোবটের মতো পরাশরের ঘাড়ে হাত রাখে। মুখে কোনো শব্দ যোগায় না। চোখের ভিতরে অনন্ত দাহ।
পরাশরের ছোট ভাই দিবাকর এসে নিচু গলায় বলল, দাদা, সিপির সঙ্গে কথা বললাম। পোস্টমর্টেম করাতে হবেই। বললেন, যাতে বেশি ঝামেলা না হয়, আর যত শীঘ্র সম্ভব বডি রিলিজ করে দেয় সেজন্যে বলে দেবেন। রবিনদাকেও খবর দিয়েছি। উনি এসে পড়লে মনে হয় না পুলিশ বেশি হুজ্জোত করার সাহস পাবে।
রবিনদা যে এমএলএ তা বুঝতে পারলেও জীবক পুলিশ, পোস্টমর্টেম, বডি রিলিজ শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে পারে না। কার বডি? কেন রিলিজ? কেন হুজ্জোত? এসব ডায়ালগ কে লিখেছে? কেন?
জীবক ডাকল, দিবাকর-
-কখন এলেন জীবুদা? আমি এসেই আপনাকে ফোনে ট্রাই করেছিলাম। কেউ ধরল না।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, দিবাকর।
-আমরাও পারছি না। বৌদি যে এভাবে আচমকা সুইসাইড করবে, কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি। জানেন কাল রাতে আমাকে ফোন করে বলেছিল যেন সকালে আসি। কী যেন দরকার আছে। এসে দেখি, এই।
-সুইসাইড! কেন? কীভাবে?-রোবটের মতো যান্ত্রিক জিজ্ঞাসা।
-কেন, সেটা তো আমরাও ভেবে পাচ্ছি না। দাদাও কিছু বলতে পারছে না। হাইডোজ স্লিপিং পিল খেয়েছে। দিবাকর বলল, জীবুদা, আপনি দাদাকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যান। জ্যোতিদাকেও বলছি। আমি চা দিতে বলেছি। দেখুন দাদাকে খাওয়াতে পারেন কি-না। ও সকাল থেকে এক ভাবে বসে আছে।
উদ্যোগটা জ্যোতিই নিল। পরাশরকে হাত ধরে টেনে উঠিয়ে পেছনের ব্যালকনিতে এনে বসাল। জীবকও অনুসরণ করে এল। একটি মেয়ে কয়েক কাপ চা ট্রে-তে নিয়ে এলে জ্যোতি এক কাপ পরাশরের হাতে দিয়ে বলল, এটা খাও।
জীবকও একটা কাপ নিয়ে বলল, কাল কখন ফিরেছিলে?
পরাশর ভাষাহীন চোখ জীবকের মুখের ওপর রেখে বলল, আমাকে কিচ্ছু বলার সুযোগ না-দিয়ে অপু এ-ভাবে চলে গেল! সামান্য আভাসও পেলাম না।
জ্যোতি বলল, তোমাদের মধ্যে কিছু হয়েছিল? ঝগড়া বা তর্ক, কথা কাটাকাটি গোছের কিছু?
পরাশর মাথা নাড়ে-সুযোগই ছিল না। বরং ও খুব ভালো ভালো কথা বলছিল। খাবার টেবিলে অপু এমন করছিল যে আমার হানিমুনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল। আমি কারণ জানতে চাইলে বলল, তুমি কতদিন ছিলে না, আমার ভালো লাগছিল না। তোমার আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় না, আমার হয়। ভীষণ কষ্ট হয়।
জীবক জিজ্ঞাসা করে, অত স্লিপিং ট্যাবলেট পেল কী করে?
ম্লান স্বরে পরাশর বলে, তোমাদের বলা হয়নি, অপুর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ব্যথা কমানো আর ঘুমের জন্য ডাক্তার দিয়েছিল। মনে হচ্ছে একই প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ও প্রচুর ঐ কিলিং ট্যাবলেট যোগাড় করেছে। ওর জন্যই মুম্বাইতে টাটা ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। আগামী সপ্তাহেই ওর অপারেশনের ব্যবস্থা হয়েছে। গতকাল ফোন করে ওকে জানিয়েও দিয়েছিলাম।
জ্যোতি বলে, মনে করে দেখ তো, আনইউজুয়াল কিছু বলেছিল বা করেছিল কি-না।
পরাশর বলল, আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। খেয়ে-দেয়ে শুয়েও পড়েছিলাম। তখনো ঘুম আসেনি। অপু এসে বলল, দেখো তো আমাকে কেমন দেখাচ্ছে। আমি দেখি ও প্রায় নববধূর মতো সেজেছে। যে-সাজে এখন ও শুয়ে আছে ওখানে।
-মানে?-আর্তনাদের মতো শোনায় জীবকের স্বর।
পরাশর মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। ওকে কেউ সাজায়নি। নিজেই সেজেছিল। আমি বলেছিলাম, চমৎকার দেখাচ্ছে। এত রাতে হঠাৎ এই সাজ কেন? ও বলল, তোমার জন্য। আজকাল তুমি তো আমাকে দেখোও না। আমি বলি, বিয়ের পর থেকে তো শুধু তোমাকেই দেখে আসছি। ও বলল, থাক, আজ আর মিথ্যে বলতে হবে না। শুধু বলো, আমাকে আগের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে? আমি করতলে ওর মুখ ধরে আন্তরিকভাবে বলেছিলাম, অপু, তোমাকে এত সুন্দর আর কখনো দেখিনি। অদ্ভুত হেসে ও বলল, যা বললে মনে রাখবে তো! -এটাই ওর শেষ কথা।
জীবকের মাথায় জাহাজের বিকট ভোঁ বাজে। কণ্ঠায় মরু-তৃষ্ণা। ওর জিভ ভারি হয়ে আসে।
-কখন টের পেলে?
স্বগত উক্তির মতো পরাশর বলে, রোজ সকালে ও-ই চা করে আমায় ডাকে। চা না-পেয়ে আমি জেগে উঠে ওকে ডাকলাম। কোনো সাড়া না-পেয়ে উঠে এসে দেখি ঐ বিছানায় রাতের সাজেই শুয়ে আছে। অবাক লাগল। কেননা নাইটি ছাড়া ও শুতো না। কাছে এসে আবার ডাকলাম। সাড়া নেই। হাতে হাত দিতেই বুঝলাম-।
দিবাকর এসে বলল, দাদা, ওসি এসেছেন। তুমি একবার এসো।
পরাশর বলল, আমি গিয়ে আর কী করব! তোরা যা পারিস কর।
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে বলল, এটা ওসিকে দিস।
দিবাকর আর জ্যোতি একসঙ্গে বলে ওঠে, কী এটা?
-পড়ে দেখো।
কাগজটা নিয়ে জ্যোতি পড়ে, ‘রোগ-যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছিল না বলে স্বেচ্ছায় নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছি। আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী ক্যান্সার।’ নিচে তারিখসহ অপালার স্পষ্ট স্বাক্ষর।
-দাদা, আগে তো বলোনি। কোথায় ছিল এটা?
-বিছানার পাশের টেবিলে। যাবার সময়ও অপু কর্তব্য ভোলেনি।
দিবাকর জ্যোতিকে নিয়ে উঠে গেলে পরাশর বলল, জীবক দেখো তো এটা পড়ে অর্থ উদ্ধার করতে পারো কি-না। বন্ধ খামে আমার নাম লিখে রেখে গেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
-তোমার চিঠি, আমি পড়ব?
-পড়ো। আমিই তো দিচ্ছি। এটা তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখাতে পারব না।
নিরুচ্চারে জীবক পড়ে, ‘প্রিয় আমার, এভাবে চলে যাওয়াটা হয়তো তোমার ওপর অবিচার করা হলো। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়। তুমি আমার অনেক পাগলামি, খেয়াল এমনকি অপরাধও নিজ গুণে ক্ষমা করেছ। এবারও করো। তুমি খুব ভালো স্বামী। আমার কোনো অভিযোগ নেই-তোমার বিরুদ্ধে না, অন্য কারো বিরুদ্ধেও না। আজ ফোনে যখন জানালে অপারেশন করে আমার দুটি ব্রেস্টই বাদ দিতে হবে, তখন শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল, তারপরও কি আমার তোমার স্ত্রী সেজে থাকা উচিত! অনেক ভেবে ভেবে স্থির করি, এত বড় অন্যায় আমি করতে পারি না, করার কোনো অধিকার নেই আমার। স্তনহীন আমি হয়ে যাব নারীর এক বীভৎস ক্যারিকেচার। এক বিকৃত বিকলাঙ্গ স্ত্রী। সুন্দরী বলে আমার অহংকার না-থাকলেও, তৃপ্তির গরিমা তো নিশ্চয় ছিল। তোমার স্মৃতিতে আমার চিরচেনা রূপই যেন থাকে। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ।
আর শোনো, বেশি কষ্ট পেও না। মন খারাপ করে থেকো না। তুমি দুঃখী থাকলে আমি ভালো থাকতে পারব না, মনে রেখ। তোমার দুষ্টু বউ, অপু।
পুনশ্চ: আমি তো থাকছি না, বাবিনকে আর আমেরিকা পাঠিও না। নিজের কাছে রেখ। ওকে বলো, বিচ্ছিরি
মা-টা, তারার মতো ঝরে গেছে। আর কোনোদিন বকবে না। তিন সত্যি করে বলছি, আর বকব না। কোনো দিনও না।’
চিঠিটা পরাশরের হাতে ফেরত দিয়ে উঠে দাঁড়ায় জীবক। আর এক মিনিটও এখানে থাকা সম্ভব নয়। গাঢ় চোখে পরাশরের দিকে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বাধাবন্ধহীন নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ে জীবক। সংবেদনশীল স্নেহশীলা প্রাণোচ্ছল অপালার পক্ষে এমন নিষ্ঠুর লুণ্ঠন সম্ভব, চরম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না।
অপালার শব ঘিরে পর্যাপ্ত প্রাণের শব্দ। সরগরম জীবনের স্পন্দন। কোলাহল। অব্যাহত জগৎ ও জীবন। ভেজা চোখে জীবক দেখে, নিবেদিত অফুরন্ত ফুলের প্লাবনে অপালা যেন সম্পন্ন একটি ডালিয়ার পরিতৃপ্ত গরিমা নিয়ে অপরূপ হাসছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.