গত বছরের জুলাই বিপ্লবকে উপজীব্য করে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গত ৩১শে জুলাই-৮ই আগস্ট পর্যন্ত আয়োজন করেছে ‘জুলাই পুনর্জাগরণ নাট্য উৎসব-২০২৫’। ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার দুটো মঞ্চে নয়দিনের এ-উৎসবে ১১টি নতুন নাটক পরিবেশিত হয়। প্রদর্শনীগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয় – জুলাই বিপ্লব বা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকার যখন ধীরে ধীরে একনায়কতন্ত্র কায়েম, বিরোধী মতকে রুদ্ধ, দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাসবাদী আচরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল; সাধারণের অধিকার ও মেধাকে ছাপিয়ে তাদের কোটাকে প্রধান করে নিজেদেরই ক্ষমতায়ন করছিল, সে-পটভূমিকায় কয়েক বছরের অসন্তোষের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর জুলাই মাসে ছাত্ররা বিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল। ধীরে ধীরে দেশের সকল স্তরের মানুষ কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছাড়াই রাস্তায় নেমে এসেছিল দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে। ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই-৫ই আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করতে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (পুলিশ ও র্যাব) ও অঙ্গসংগঠন (ছাত্রলীগ ও যুবলীগ) ব্যাপকভাবে দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। আন্দোলনে অসংখ্য আহত ও প্রাণহানির ঘটনায় জনরোষ ক্রমশ বেড়ে চলে। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ২১শে ডিসেম্বর সরকারের বিশেষ সেল এ-অভ্যুত্থানে প্রাথমিকভাবে ৮৫৮ জন শহিদ ও ১১ হাজার ৫৫১ জন আহতের তালিকা প্রকাশ করে। শিল্পকলা একাডেমির এই ‘জুলাই পুনর্জাগরণ নাট্যোৎসব-২০০৫’-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল জুলাই বিপ্লবকে স্মরণ করা; নাট্যভাষায় জুলাই বিপ্লবকে দেখা।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উৎসব আয়োজন সম্পর্কে জানায় – ‘এই উৎসবের উদ্দেশ্য শুধু নাট্যশিল্পের চর্চা নয়; এটি এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা – তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানায় তাদের সাংস্কৃতিক চেতনা, গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে। এখানে থিয়েটার হয়ে উঠবে প্রতিবাদের ভাষা; প্রতিটি দৃশ্য ও সংলাপ হয়ে উঠবে ইতিহাসের পুনর্লিখন।’ (প্রেরিত ইমেইল)
৩১শে জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ছিল নাট্যোৎসবের উদ্বোধনী দিন। সেদিন সন্ধ্যা ৬টায় উদ্বোধন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ কারণে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী উপস্থিত হতে পারেননি। ফলে সন্ধ্যা ৭টায় কোনো প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একাডেমির সচিব ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনের উপস্থিতিতে নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহিরের সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে উৎসব আরম্ভ হয়। ৩১শে জুলাই প্রথমদিন শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে পরিবেশিত হয় নায়লা আজাদ নূপুরের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় নাটক রি-রিভোল্ট।
রি-রিভোল্ট নাটকটি বিপ্লবের ২১ দিনের রাস্তায় বিক্ষোভ ও সহিংসতার নৃত্য। জুলাই বিপ্লবকে আশ্রয় করে হিপহপ র্যাপ নৃত্যের আঙ্গিকে রিভোল্ট উপস্থাপিত হয়। হিপহপ এমন এক ধরনের নৃত্য যা নৃত্যের শাস্ত্রীয় কোনো বিধিনিষেধের আওতাধীন নয়। হিপহপ নৃত্যকে অনেকে ফ্রিস্টাইল ড্যান্সও বলে থাকেন। নিজের মতো করে শরীর ভেঙে ও চালনা করে গতিশীল অভিব্যক্তিপূর্ণ ক্রিয়া থাকে এতে। এ-নৃত্য ১৯৬০-৭০ সালের দিকে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে উদ্ভব হয়, যা সম্প্রতি সারাবিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে। এ হিপহপ র্যাপকে আশ্রয় করে নাটকটিতে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবকে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণে বিদ্রোহী চেতনার পটভূমিকায় উপস্থাপিত। সংলাপহীন, টানটান শারীরিক ভাষা ও নৃত্যনির্ভর গল্পের গাঁথুনি। তবে এ-পরিবেশনায় কোনো চরিত্র বা ঘটনার আলাদা বিকাশ লক্ষ করা যায়নি। সামগ্রিকতার মধ্য দিয়ে বিপ্লবকালীন রাস্তার বাস্তবতা তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে। অনেকের হয়তো প্রশ্ন হতে পারে – জুলাই বিপ্লব উত্তেজনার হলেও এটি একটি করুণগাথা। এখানে হিপহপ ড্যান্সের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ কি সম্ভব? কিন্তু নির্দেশক ড্যান্স-কোরিওগ্রাফিতে সেই আবেগীয় সুরকেই ধরতে নিরীক্ষা করেছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ-বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে অন্য নির্দেশক হয়তো চরিত্র-ঘটনা কিংবা বাঙালির জাতিগত ও ঐতিহ্যবাহী উপকরণকে প্রধান করে দেখতেন। কারণ জুলাই বিপ্লব বাঙালির জাতীয় বিষয়। আর বাঙালি সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু নির্দেশক নায়লা আজাদ হিপহপ ড্যান্স মাধ্যমকেই বড় করে দেখেছেন। এটা প্রথাগত কোনো নাট্য নয়। এটি ড্যান্সনির্ভর এক ধরনের উপস্থাপনা। শুরুতেই মঞ্চে প্রতীকী লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বুঝতে বাকি থাকে না এগুলো আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের লাশ। মিউজিক বেজে উঠলে লাশগুলো উঠে দাঁড়ায়। আর প্রতীকী অশুভ মানুষের দল শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। শুরু হয় সংঘাত। কোরিওগ্রাফি ও র্যাপের মতো ড্যান্সের একরৈখিকতায় আন্দোলনের নানা প্রসঙ্গ, নানা ঘটনা ফুটে উঠতে থাকে। জুলাই বিপ্লবের স্লোগান, টেলিভিশনের নিউজ, সাক্ষাৎকারকে আশ্রয় করে ব্রেক ড্যান্সিং, ডিজে এবং ভয়েজওভারে সাংকেতিক শব্দ-নিনাদকে আশ্রয় করেই এর অডিও। বিপ্লব মানেই ধ্বংস নয়, সৃষ্টির প্রসব বেদনা। নৃত্যে জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদীর অত্যাচার ক্রমশ বাড়তেই থাকে। তাই জুলাই দীর্ঘতর হতে থাকে। ৩৬ জুলাই পর্যন্ত গিয়ে মৃত্যুর মিছিল থামতে শুরু করে। শরীরের বহুধা ভঙ্গিমা, চলনবিন্যাস ও প্রতীকী নানা অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠতে থাকে মুগ্ধসহ নানা চরিত্র ও ঘটনা। কিন্তু আবু সাঈদের দু-হাত প্রসারিত করে বীরত্বের প্রতীকগাথা লক্ষ করা যায়নি। শুধু র্যাপ মিউজিকে আবু সাঈদের মায়ের কণ্ঠ ভেসে এসেছে – ‘হামার ছেলেক মারলু কেনে?’ বিপ্লবকালীন শেখ হাসিনার বিতর্কিত সে-কণ্ঠগুলোও পাওয়া গেছে।
পরিবেশনা শেষে নির্দেশক নায়লা আজাদ নূপুর জানান, আমেরিকার রাস্তায় হিপহপ ড্যান্স দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য যে, বাংলাদেশের রাস্তাতেও সেরকমের দেখা যায়। আমি স্ট্রিট পারফরম্যান্সকেই মেইন স্ট্রিমে আনার জন্য এ হিপহপ ড্যান্সকে বেছে নিয়েছি। বাংলাদেশের রাস্তার এমন পরিবেশনা দিয়ে থিয়েটার নির্মাণ করা যায়, তা দেখাতে চেয়েছি। জুলাই বিপ্লবের বাস্তবতাকে নাটকে ধরতে চেয়েছি।
নৃত্যে ছিলেন উম্মে হাবিবা, মাইশা আহমেদ রোজা, রামিস যাহার, আনিকা বারই, সনিয়া পারভীন, মেহরান আফনান জামান, সাফিয়া সারওয়ার শ্রেষ্ঠা, তাহিয়া তারান্নুম খান, হিয়া মেহজাবিন, গৌতম রায়, সাজিদ এহসান, নুজহাত বিনতে রেজা পুষ্পিতা, শাহ মোহসিন, গোপাল রায়, প্রাণকৃষ্ণ বণিক কেশ, হালিমা তুস সাদিয়া নিশা, এমডি নাহিয়ান কাবির, অপূর্ব চক্রবর্তী, মিতু রহমান, হৃদয় হালদার, আসিমা কামাল নমী এবং সাদিয়া জোর্দাই আয়েশা। নেপথ্য কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন উম্মে হাবিবা ও স্বাগত মজুমদার। আলো নির্দেশনায় পলাশ হেনডি সেন। গ্রাফিতিতে বিজয় দাস। পোশাকে হালিমা তুজ সাদিয়া ও তাসনুভা সানজিদা। নির্দেশনায় লায়লা আজাদ নূপুর এবং পরিবেশনায় ছিল টিম কালারস।
উৎসবের দ্বিতীয়দিন ১ আগস্ট প্রদর্শিত হয় দুটো নাটক। নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় শুভঙ্কর হাত ধরতে চেয়েছিল এবং এক্সপেরিমেন্টাল হলে দেয়াল সব জানে।
শুভঙ্কর হাত ধরতে চেয়েছিল নাটকের গল্প নিয়েছেন আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার প্রেরণা থেকে। নির্দেশনা দিয়েছেন দীপক সুমন। দেড় ঘণ্টার অধিক ব্যাপ্তির এ-নাটকটি হলভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতায় উপভোগ করেন। রোমান্সের সঙ্গে জুলাইয়ের সংগ্রাম যেন এক হয়ে গিয়েছিল। এ-নাটকের গল্পে দেখা যায় – পার্বতীপুর স্টেশনে একটি মেয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় আরেক যাত্রীকে দেখা যায়। দুজনের পরিচয়ে গল্প শুরু করে। গল্পটি মধ্যবিত্ত স্বপ্নচারী এক শুভঙ্করের। বুর্জোয়া শ্রেণি যে-সময় শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আধিপত্যবাদী সরকার যখন সাধারণ মানুষের অধিকারকে খর্ব করছিল। মেধাবীকে অবহেলা করে নিজেদের ক্ষমতাকে কোটার নামে সংরক্ষিত করছিল। জুলাইয়ের সে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভঙ্করকে নামতে হয়েছিল রাজপথে। মেধাকে আশ্রয় করেই যে শুভঙ্করের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ’২৪-এর বিপ্লবে পিতৃহীন শুভঙ্কর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ মেয়েটির হাত ধরা তার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রতিবাদের সেøাগান ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের হাতে হাতে।
নাটকটি প্রসেনিয়াম ধারায় উপস্থাপিত। দুটো চরিত্র প্রধান। সংলাপনির্ভর। ফ্ল্যাশব্যাকেই কাহিনির প্রবহমানতা। নাটকের দলের রিহার্সালকে কেন্দ্র করে গল্পের সিংহভাগ আবর্তিত।
সে-পরিপ্রেক্ষিতে কিছু চরিত্রের পোশাক সাজেস্টিক করা হয়েছে। সাজেস্টিক উপকরণে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। তবে নাটকটি খুব সুখদর্শনীয় নয়। নাটকটিতে ঘটনার প্রবাহ মূলকে ছাড়িয়ে অনেক সময়ই ভিন্ন দিকে চলে গেছে। তাছাড়া পোশাকেও পারম্পর্যহীনতা লক্ষ করা গেছে। তারপরও নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
অভিনয়ে ছিলেন – নিলয় কুমার বিশ্বাস, সারাহ মীম, সাগর মৈত্রী, ফারজানা মেহেজাবীন, কৌশিক আহমেদ, মাহিমা সাদিক লিমা, সাদিয়া শাহীন অন্তু, মানসিফ তাজরিয়ান, বাপ্পি হায়দার, সোনালী কবির, মো. আবদুল্লাহ আল নোমান, মো. সাজাওয়ার হোসেন অরণ্য, সানজিদ ইসলাম তূর্য, সামিয়া চৌধুরী, আল ওয়ালীদ জিয়ান, বাপ্পী হায়দার, দীপক সুমন। নেপথ্যে নাট্যরূপ ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, সংগীত রবিউল ইসলাম শশী, কোরিওগ্রাফি সারাহ মীম, আলো মোখলেসুর রহমান, পোশাক এনাম তারা সাকি ও নির্দেশনায় দীপক সুমন। এটি তীরন্দাজ রেপার্টরির প্রযোজনা।
দেয়াল সব জানে নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন শাকিল আহমেদ সনেট। দেয়াল সব জানে – বাঙালি সমাজে বাগধারার মতো ব্যবহৃত একটি সুভাষিত উক্তি। অপরাধের সাক্ষী মানুষের অজান্তেই থেকে যায়। কর্তৃত্ববাদী সরকারের বৈষম্যনীতি, অত্যাচার ও দমন-পীড়নের রাজসাক্ষী যেন সাধারণ মানুষেরই অগোচরে বিরাজমান। সময়ের এমনই মহাকাব্যিক বয়ান দেয়াল সব জানে। নাটকটিতে একক ঘটনার প্রবাহ নেই। জুলাই বিপ্লবের মৃত্যুমুখী নানা ঘটনার সমন্বিত উপস্থাপনা। নাটকের শুরুতেই দেখা যায় অনেকগুলো কফিন। একেকটা কফিনে একেকটি লাশ। লাশগুলো একে একে উঠে আসে। বর্ণনা করতে থাকে তার মৃত্যুকাহিনি। আর দেহ-চলন বিন্যাসে তা দৃশ্যরূপ পায়। রিকশাচালক রহিমুদ্দিনের মৃত্যু অনাকাক্সিক্ষত ছিল। বিশ^বিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র নাজিম অধিকার আদায়ের স্বপ্নে রাজপথে নেমেছিল; কিন্তু অধিকার কী আদায় হয়েছিল? নাজিম জানে না। পুলিশের গুলিতে বুকটা ঝাঝরা হয়ে গেছে। গার্মেন্টকর্মী আসমার ক্লান্ত শরীর নেতিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। আর শিশু নাইমের উড়তে চাওয়া খেলনা যেন হেলিকপ্টারের ছিন্নপাখা হয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আর স্তূপে স্তূপে পড়ে থাকা হাসপাতালের করিডোরে নিথর শয্যায় শায়িত আন্দোলনকারীরা যেন তখনো স্বপ্ন দেখে। এত নির্মমতা এত অত্যাচার কি গোপন থাকে। ইতিহাসের সত্যকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। দেয়ালই সব মনে রাখে। প্রতীকী নানা ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নির্মম বাস্তবতা। তবু সময় থেমে থাকে না। নাটকের প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি দৃশ্য-ইমেজের সঙ্গে আলো-শব্দ-সংগীতের অপূর্ব সমন্বয়ে দর্শকের হৃদয়ের গভীর অনুভূতিতে নাটকটি স্পর্শ করে।
নাটকটি সাজেস্টিক ধারায় প্রসেনিয়াম মঞ্চবিন্যাসে উপস্থাপিত। প্রতিটি দৃশ্য নির্মাণে নির্দেশক নানা প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন। এ-নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিতাদিত্য বড়ুয়া, জয়ন্ত ত্রিপুরা, আকাশ মিয়া, নুসরাত জাহান, কৃষ্ণ চন্দ্র বর্মণ, নারিন আফরোজ লিনসা, রাহুল, মো. সবুজ, আলিফ মাহমুদ, মেজবা মাহবুব রাফিল, সিয়াম শুভ, আসিফ হোসেন, সয়েম ও ফাহাদ। সেট ও প্রপস উৎপল নীল, গীত ও পোশাক শাকিল আহমেদ সনেট, সংগীত অর্পা খন্দকার চাঁদনী এবং কোরিওগ্রাফি কৃষ্ণ ও জয়ন্ত। এটি স্পন্দন থিয়েটার সার্কেলের পরিবেশনা।
গত ২ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় দ্রোহের রক্ত কদম। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা ইরা আহমেদের। দ্রোহের রক্ত কদম নাটকটি শরীরের ভাষানির্ভর সাইসেন্স অ্যাকটিং। মঞ্চে সারাক্ষণ শারীরিক কসরত, ইউরোপীয় মিউজিক ও ইংরেজি ভাষ্য ব্যবহার হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে শোষিতের প্রতি নিপীড়নকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে উপস্থিত দর্শকের অধিকাংশই ফিজিক্যাল অ্যাকটিং নির্ভর নাটকটি গ্রহণ করতে পারেননি। তাছাড়া শরীরের ভাষায় কী ঘটনা বোঝাচ্ছে তাও স্পষ্ট ছিল না। কিংবা মাইম অভিনয়ও ছিল না। পরিবেশনাটির শুরু থেকে মঞ্চের একপাশে দাবার রাজা-মন্ত্রী ও অন্য পাশে জাল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মাঝে গাজার বিধ্বস্ত বাস্তবতার ভিডিও পেছনে সায়াক্লোমায় প্রদর্শিত হয়েছিল। নির্দেশক ইরা ইয়াসমিন নৈর্ব্যক্তিক শরীরী মুভমেন্টের নাট্যভাষা ও অবচেতনীয় বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন।
নির্দেশক সুভ্যেনিরে উল্লেখ করেন, ‘দ্রোহের রক্ত কদম শুধু একটি নাটক নয়, প্রযোজনাটি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার একটি রূপ তুলে ধরবে। যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের অন্তর্নিহিত অসাম্য, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানুষের মধ্যেকার এক বিকৃত প্রতিযোগিতাকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে সংলাপের চেয়ে অধিকতর বলিষ্ঠ এক মাধ্যম শরীরের ভাষা। এখানে সংলাপ নয়, দেহ কথা বলে। প্রতিটি ভঙ্গিমা, প্রতিটি নৈঃশব্দ্য একেকটি হাহাকার।’
অভিনয়ে রাসিফ বিন ফাহিম, জেরিন আকতার নোশ্নি, সুমাইয়া তাবাসসুম, মো. মাহামুদুল ইসলাম বাঁধন, মো. মেহেদী হাসান মুন্না, পার্থ সেন, মো. শাহ্রিয়া শাকিল, ফাইরুয সাদেক, তানজীলা আক্তার এবং মো. মেহেদী হাসান সাদী। আলো আসলাম উদ্দিন, মঞ্চ ও সংগীত ইন্দ্রজিৎ শীল, নাট্যভাবনা ও নির্দেশনা ইরা আহমেদ। প্রযোজনা এথেরা।
উৎসবের চতুর্থ দিন ৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় ৪০৪ : নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন লাহুল মিয়া। প্রসেনিয়াম মঞ্চধারায় দর্শকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ানির্ভর নাটক। ব্রেখটীয় এলিনিয়েশনের মতো মোহাবিষ্টতার বিপরীতে দর্শকের অনুভূতির সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া। এ-নাটক দর্শককে জানায় না, দর্শককে জাগায়। কিছু পরিবেশনকর্মী মঞ্চে কিছু একটা করতে চায়। কিন্তু কী করবে? এমনই দর্শকীয় যোগাযোগ থেকে নাটকটি শুরু হয়। তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে যায় – তারা নাটক করবে না। কারণ বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় তারা উদ্বিগ্ন-অস্থির, মানসিকভাবে বিক্ষুব্ধ। তাহলে তারা কী করবে? এমন সময় মঞ্চে উপস্থিত হয় ফ্যাসিবাদী বিশ্বসাম্রাজ্যবাদিতার প্রতীক – হিটলার কিংবা অন্য কেউ। ফ্যাসিবাদী প্রতীকী চরিত্রটি যখন হাতে বিশে^র মানচিত্র ঘোরাতে ঘোরাতে মঞ্চে আসে, তখন আর প্রতিপাদ্য বিষয় বুঝতে বাকি থাকে না কারো। সেমিওটেক্সলি দেখা যায় ফ্যাসিবাদী বিশ্ববাস্তবতায় কর্তৃত্ব-ক্ষমতাবাদ ও শোষিতের যন্ত্রণার রূপ। একসময় উপস্থাপকণ্ডলী সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। দর্শকও আত্মজিজ্ঞাসায় প্রশ্নবিদ্ধ। এ এক নতুন প্যারাডক্স। তারা ফ্যাসিবাদী বীভৎসতার নাটক করবে না। তবে কী করবে? শুরু হয় টক শো। একজন সরকারি দলের নেতা ও আরেকজন বিরোধীদলীয় নেতার টক শো। সংযাত্রার কৌতুকাভিনয়ের মতো হাস্যাত্মকভাবে ফুটে উঠতে থাকে অন্তঃসারশূন্য রাজনীতি ও দেশের করুণ বাস্তবতা। টক শোর সঙ্গে রোমান্টিকতা দৃশ্যকল্প জড়িয়ে কৌতুকপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে তোলে। পরের স্কেচে মঞ্চে উঠে আসে জুলাই বিপ্লবে তূর্যের রাস্তায় নামার গল্প। বাবা-মার আদরের সন্তান যখন শুনতে পায় অন্য ছাত্রকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে, তখন বাবা-মার আপত্তি সত্ত্বেও সে নেমে পড়ে রাজপথে। গুলি তার চোখে লাগে। তারপর তূর্যের মৃত্যু হয়। এভাবেই ছোট ছোট তিনটি গল্পের প্রতীকবাদী উপস্থাপনে নাটকটি এগিয়ে চলে। এই প্রযোজনায় সমকালীন বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদী ভাবনাকে তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু পোশাক ও সেটের কালার কনটেক্সট নিয়ে ভাবনার দরকার ছিল। একই রঙের হয়েছে। এতবড় ক্যানভাসে কোনটা যে মূলভাবনা তা বোঝা কঠিন। আর আবহমান বাংলার পরিবেশনারীতিতে বিশেষত সঙযাত্রা-পালানাট্যের মধ্যেই বিযুক্তিকরণ সূত্র আছে। অতএব, ব্রেখটকে এত বড় করে দেখানোর কিছু নেই। আর এ-ধরনের পারফরম্যান্সে প্রসেনিয়াম আর্চকে প্রধান মাধ্যম করার কিছু নেই।
মঞ্চে আব্দুল মুনিম তরফদার, অ্যাঞ্জেলিনা পিয়ানা রোজারিও, এ. এইচ. এম সাহেদুল আলম, ফারিহা তাসনীম হৃদি, হাদী আকাশ, শেখ সায়েম হোসেন, রাইসুল ইসলাম রোমান, তাসনোভ সানজিদা, ইসরাত মীম, মো. মাহাবুব আলম হৃদয়, জান্নাতুল ফেরদৌস তোয়া ও গোলাপ দাস। নেপথ্যে ড্রামাতুগ আব্দুল মুনিম তরফদার, মঞ্চ কাজী কালাম ও আশীষ, আলো সৈয়দ মো. যুবায়ের, পোশাক মো. খলিল, সংগীত – মীর মো. মাঞ্জারুল হক, কোরিওগ্রাফি অমিত চৌধুরী, রচনা ও নির্দেশনায় লাহুল মিয়া। পরিবেশনায় ফোর্থ ওয়াল থিয়েটার।
৪ আগস্ট, সোমবার জাতীয় নাট্যশালার মূলমঞ্চে সন্ধ্যা ৭টায় পরিবেশিত হয় নাটক অ্যানিমেল ফার্ম। জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ড. সাইদুর রহমান লিপন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত জর্জ অরওয়েলের ইংরেজি ভাষায় লেখা অ্যানিমেল ফার্ম সারা পৃথিবীতে বহুল পঠিত উপন্যাস। যে-সময় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সবচেয়ে পবিত্র বলে মনে করা হতো সে-সময় বিপ্লবের অন্তঃসারশূন্যতা ও করণকৌশলের নেতিবাচক দিকগুলো ব্যঙ্গ-বিদ্রোহের ছলে রূপকাশ্রিতভাবে অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসটি দেখিয়েছে। অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসটিতে প্রতীকী ঘটনাসূত্র হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী সরকার ও তাদের শাসন প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ-পীড়ন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ধারার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। উপন্যাসের গল্পটি একটি পশুর খামারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও আধিপত্য ও ক্ষমতার লড়াইয়ে মানুষের দাসত্বের স্বরূপই উন্মোচিত করে। উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছেন নজরুল সৈয়দ এবং নির্দেশনায় সাইদুর রহমান লিপন। এটি রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রযোজনা।
নাট্য আখ্যান শুরু হয় ম্যানোর ফার্মের পশুদের সংগঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। যেখানে পশুদের দুঃখ-দুর্দশা ও দাসত্ব নিত্যসঙ্গী। ঠিকমতো খাবার পায় না, নির্মম পরিশ্রম করতে হয়, প্রয়োজন ফুরোলেই জবাই হতে হয় কসাইখানায়। তাদের দুধ নিয়ে যায় মানুষ, নিজেদের ডিম ফুটানোর আগেই ডিম চলে যায় অন্যত্র, গরু-শূকর-মুরগি একটু বড় হলেই যেতে হয় ছুরির তলে। নির্মম জীবন সেখানে। অথচ এ-ফার্মের মালিক কোনো কষ্ট না করেই ফল ভোগ করে। সে দুধ দেয় না, ডিম পাড়ে না, লাঙল টানার শক্তি নেই, দ্রুত দৌড়ে খরগোশ পর্যন্ত ধরতে পারে না। অথচ এসব প্রাণীর প্রভু সেজে বসে আছে। তাই এই দুপেয়ে জীবের দাসত্ব থেকে মুক্তি প্রয়োজন। ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে পশুপাখিরা। তবে বিপ্লবের প্রথমদিকে অনেকেই রাজি হয়নি। যেমন ঘোটকী মলি – মলি – বিদ্রোহের পরও নিয়মিত চিনি পাওয়া যাবে? … আমি কি এখনকার মতো ফিতে পরতে পারবো আমার কেশরে?
স্নোবল : যে ফিতের জন্য তুমি এত পাগল, সেগুলো যে দাসত্বের পরিচায়ক – সেটা জানো? তুমি বুঝতে পারছ না, ওই ফিতেগুলোর চেয়ে স্বাধীনতার মূল্য কত বেশি?
পশুসংগীত তৈরি হয়, পশুনীতি তৈরি হয়, আদর্শবাণী তৈরি হয় – ‘চারপেয়েরা মন্দ, দুপেয়েরা ভালো’। একসময় খামারের মালিক মদ্যপ জোন্সের অত্যাচারের প্রতিবাদে বিদ্রোহ করে তাকে খামার থেকে বিতাড়িত করা হয়। পশুরা নিজেরা নিজেদের মতো নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। খামারটির নতুন নামকরণ করে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। নিজেদের মধ্যে সাম্যনীতির লক্ষ্যে পশুতন্ত্রের সাতটি মূলনীতি অবলম্বন করে। ধীরে ধীরে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তারা যে স্বাধীনতা অর্জন করে তা আসলেই কী স্বাধীনতা? নির্বাচিত তিন শূকর নেতার রূপ পাল্টে যেতে থাকে। তার মধ্যে নেপোলিয়ন অন্যতম। নানা কূটকৌশলে প্রতিপক্ষ শক্তির যেন উত্থান না ঘটতে পারে তা ধ্বংস করে দিয়ে নেপোলিয়ন ক্ষমতায়ন করতে থাকে। ধীরে ধীরে নেপোলিয়ন হয়ে ওঠে একচ্ছত্র অধিপতি। যে-স্বাধীনতার জন্য তারা বিপ্লব করেছিল, যে-স্বাধীনতা তারা পেয়েছিল, তার বাস্তবতা কী! উল্টো পশুদের কষ্ট আরো বেড়েছে। স্বাধীনতা মনে করে তারা এখন যা করে তা প্রকৃত দাসত্বের শৃঙ্খল। তাদের তৈরি সংবিধানে উল্লেখ ছিল পশুহত্যা করা যাবে না। অথচ তাদের নেতাই পশু হত্যা করে। নেপোলিয়ান ক্রমশ হয়ে ওঠে মহামতি নেপোলিয়ন। উইন্ডমিলের নাম হয় নেপোলিয়ন মিল। ফার্মে নানা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একসময় সকল পশু অনুভব করে তারা আরেক দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি। উপন্যাসের শেষ সংলাপটি এমন – কোনটি শূকর আর কোনটি মানুষ – আলাদা করে চিনে নেওয়াটা ইতোমধ্যে মুশকিল হয়ে গেছে।
নির্দেশক মূলগল্পের গাঁথুনি ও চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখে বিপ্লবোত্তর সমস্যাগুলোকে দেখাতে চেয়েছেন। প্রসেনিয়াম ধারায় দেড় ঘণ্টার টানটান শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশনা। প্রায় প্রত্যেকেরই অসাধারণ মেধাদীপ্ত অভিনয়। চরিত্রের হাবভাব ও সংলাপ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। নাট্যদৃশ্যে চরিত্র ও চরিত্রের সংলাপের অ্যামফেসিসগুলো খুব নান্দনিক। মূল উপন্যাসে মিছরির পাহাড়ের লোভ দেখানো মোজেসের সংলাপ ছিল ‘সেখানে প্রতিদিনই রবিবার’, যা ধর্মীয় ভণ্ডামিকে ইঙ্গিত করে। নাট্যকার এখানে রোববারের জায়গায় শুক্রবার জুড়ে দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরুতে বিপ্লব দানা বাঁধার অসাধারণ যুক্তি আছে, কিন্তু নাটকে তা নেই। হঠাৎ করেই বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। আর বিষয়গত, ঘটনাগত, চরিত্রগত কিছু কিছু জায়গায় পরিবর্তন থাকলেও অনবদ্য নান্দনিক প্রযোজনা।
এতে অভিনয় করেছেন – মো. হাবিবুল্লাহ, আবির খান অন্তু, অলফেয়ার্ড এলিশায় জয়, সাইফুল ইসলাম, মো. সজীব হোসেন, নাজিম উদ-দৌলা, প্রীতি সূত্রধর, পলক চক্রবর্তী, রিফাত আরা জুঁই, মেহেদী হাসান, অদ্রিতা দাস, সুমন মিয়া রানা, মাইশা মাসফিকা তানিসা, আশরাফুর দৌলা সোহেল, মৃদুল জাহান (হৃদয়), আল্লামা মেহেদী হাসান, মো. রেজাউল করিম, শর্মী চাকমা, মেমোরী চাকমা, মীর তৌসিফ, কনন কুমার দেবনাথ ও নাজমুল আহসান। পোশাক মহসিনা আক্তার, সেট ও প্রপস আব্দুর রাজ্জাক, আলো ধীমান চন্দ্র বর্মণ, সংগীত অসীম কুমার নট্র, কোরিওগ্রাফি অমিত চৌধুরী, মুখোশ সাজজিত সুপ্ত। পরিবেশনায় ছিল রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়।
৫ আগস্ট মঙ্গলবার ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস। এদিন সরকারি ছুটি ছিল। ছুটির দিনে দুটো নাটক প্রদর্শিত হয়। শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার মূল হলে পরিবেশিত হয় জহির রায়হানের উপন্যাস অবলম্বনে আর কত দিন। নির্দেশনা খন্দকার রাকিবুল হক। পরীক্ষণ হলে পরিবেশিত হয় অগ্নি শ্রাবণ। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় ইলিয়াস নবী ফয়সাল।
আর কত দিন যুদ্ধের বীভৎসতা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উপন্যাস। মাত্র চারটি পর্বের ক্ষুদ্রায়তনের এ-উপন্যাস জহির রায়হান ১৯৭০ সালে রচনা করেন। যখন এ-ভূখণ্ডে পাকিস্তানি আদর্শ বাস্তবায়নের নামে চলেছে শোষণ-নিপীড়ন-গণহত্যা। আকারে ছোট হলেও উপন্যাসের গভীরে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ততা-গণহত্যায় বিপন্ন শরণার্থীদের একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যাকুলতা। উপন্যাসটির শুরু হয় একদল মানুষের অনিশ্চিত যাত্রা দিয়ে – ‘তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই। শেষ নেই মৃত্যুরও। তবু মানুষ মানুষকে হত্যা করে। ধর্মের নামে। বর্ণের নামে। জাতীয়তার নামে। সংস্কৃতির নামে।’ উপন্যাসটি অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানুষের প্রতিবাদ। লেখক রূপকধর্মিতাকে আশ্রয় করে একক চরিত্র বিকাশের চেয়ে সামগ্রিক চরিত্র ও চরিত্রের মানবিক
অনুভূতি-আবেগের দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। পাশবিকতা ও ভীতি-সন্ত্রস্ততায় মানুষের যাত্রা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে গল্পে উঠে আসে বুড়িমা, ইভা, তপু চরিত্র। এ-উপন্যাসে কোনো স্থানের উল্লেখ নেই। প্রতীকীভাবে মানবতাহীন বিধ্বস্ত জনসমষ্টিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। চিত্রকল্পের ঢঙে ছোট ছোট ঘটনা ফুটে উঠেছে। খ্রিষ্টান ধর্মের মহত্ত্ব এখানে চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে। বর্ণনার ঢঙে ফুটে উঠেছে বিশে^র হিংস্র মানসিকতার প্রেক্ষাপট। এমনকি বর্ণবাদও। তারপরও ঔপন্যাসিক জহির রায়হান তপু ও ইভা চরিত্রের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন।
খন্দকার রাকিবুল হক-নির্দেশিত আর কত দিন নাটকটি একধরনের অভিব্যক্তিবাদী নাটক। সামাজিক বিপন্ন অসংগত মানবতাহীন বাস্তবতার আবেগিক অভিনয়নির্ভর নাটক। মঞ্চসজ্জা নেই, পোশাকের বাহুল্য নেই, দৃশ্যকল্প তৈরি করার প্রবণতা নেই; আছে অভিনয়নির্ভর বিধ্বস্ত মানবিকতাহীন জুলাই বিপ্লব বাস্তবতার প্রতীকীরূপ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জার্মানিতে এ-অভিব্যক্তিবাদী ধারার নাটকের উদ্ভব হয়, যাতে সামাজিক অসংগতিগুলো বিকৃত করে শুধু অভিনয়নির্ভর আবেগিক উপস্থাপন হতে দেখা যায়। আর কত দিন নাটকেও নিরাভরণ প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনয় আবেগই প্রধান হয়ে উঠেছে। বর্ণনাত্মক ধারায় ফুটে উঠেছে তার প্রেক্ষাপট। নাটকটিতে চরিত্রাভিনয়ের চেয়ে দলগত কোরাসই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতীক বা নৈর্ব্যক্তিকতা প্রধান হয়ে উঠেছে। মিউজিকের তালে শরীরের ভঙ্গিমা, কোরাসের বর্ণনা, তপু-ইভার আবেগিক সম্পর্ক ও স্বপ্নের বহুমাত্রিক উপস্থাপন নাটকটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। আলো-মিউজিক-আবহ-কোরিওগ্রাফি-অভিনয়ের সমন্বয়ের টান টান গতিশীলতায় পৃথিবীর তাবৎ নিপীড়নের বাস্তবতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
নির্দেশক বলেন, ‘বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের চিত্র, প্রশ্ন এবং সংকট উত্তরণের ধারণা উপন্যাসের মননে রয়েছে। গল্পটি সামগ্রিক অর্থে গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চব্বিশের আন্দোলনে নিহত ও আহত মানুষেরা পৃথিবীর সকল দেশের সকল কালের স্বাধীনতাকামী মানুষের সমুদ্রের সঙ্গে মিলেছে চেতনাগতভাবে। পৃথিবীর যেখানেই মানুষ অধিকারের জন্য লড়ছে, সেখানেই তাকে অত্যাচারিত হতে হয়েছে।’
অভিনয়ে ছিলেন শাহজাদা সম্রাট চৌধুরী, শৌমিক বাগটা, সাজ্জাদুল আলম শুভ, অর্ণব মল্লিক, উথিতা চৌধুরী, ঐন্দ্রিলা মজুমদার অর্পা, ইশতিয়াক আহমেদ, অথৈ দাস মেঘলা, শাফায়েত জামিল লিজান, দেবাদ্রীতা সরকার অহনা, মিথিলা তাসফিয়া, স্নেহা, আতিকুজ্জামান শিবলু, উম্মে মারিয়াম, অথৈ সরকার আঁচল, মো. সাব্বির হাসান, সোহান, অনিক সাহা সোহাগ, মো. নাঈম হোসেন, আনিসুর রহমান আনিস, মারিয়া আক্তার রায়শা, মুস্তাফিজুল ইসলাম সিফাত, উদ্বিতা চৌধুরী, সপ্তর্ষী বিশ্বাস ও মুনতাহানা ফিজা। আলো অম্লান বিশ্বাস, মঞ্চ রাসেল ইসলাম, পোশাক শাহীনুর আক্তার প্রীতি, সংগীত অর্ণব মল্লিক, সংগীত ও নির্দেশনায় খন্দকার রাকিবুল হক। পরিবেশনায় ‘অন্তর্যাত্রা’।
একই দিনে পরীক্ষণ হলে পরিবেশিত অগ্নি শ্রাবণ একটি গীতনৃত্যনির্ভর প্রতীকী নাটক। যেখানে পাখি ও মানুষ চরিত্রে মিলে অনবদ্য এক আখ্যান সৃষ্টি হয়েছে। নাটকটি নৈর্ব্যক্তিকভাবে জুলাই বিপ্লবের ভাষা বোঝাতে অত্যন্ত কার্যকর। নাটকে জুলাই বিপ্লবের ঘটনাকে আক্ষরিক উপস্থাপন না করলেও প্রতীকী চরিত্র, ঘটনা ও সংলাপে অনবদ্যভাবে বিপ্লবের বাস্তবতা ও চেতনা ফুটে উঠেছে। নাটকে দেখা যায়, পাখিদের রাজা বেজায় কৌশলী। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে উন্নয়নের নামে চোখ-ধাঁধানো সব কাজ করেন। পাখিদের কাঁঠালের রেসিপি দেন, প্লাস্টিকের গাছ স্থাপন করেন। প্রকৃত অর্থে পাখিদের স্বার্থে নয়, সবই নিজের ক্ষমতা ও আধিপত্যর জন্য করেন। কিন্তু সবাই তা বোঝে না। তার সভাসদও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে নানা কৌশলী আচরণ করে। নৃত্য-গীত-অভিনয়ে এভাবে কাহিনি এগিয়ে চলে। শেষে ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতি। নাটকের প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ঘটনাবিন্যাস অত্যন্ত গতিশীল। অভিনয়-নৃত্য-গীত-কোরিওগ্রাফির অনবদ্য চলনে পরিমিতি মাত্রায় উপস্থাপন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের আদলে চতুর্দিকে দর্শকবেষ্টিত মঞ্চ, বর্ণনা, চলনবিন্যাস, গীতলাস্য পরিবেশনা। থ্রু লাইনের টানটান উত্তেজনায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শক উন্মুখ হয়ে উপভোগ করেন। নাটকের চরিত্রগুলো প্রতীকী। কোথাও তাদের নাম নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খানকে চিনতে কোনো দর্শকের বেগ পেতে হয় না। আন্দোলনকারী তরুণ প্রজন্মকে সাধারণ পাখির প্রতীকে তুলে ধরা হয়েছে। মঞ্চে অভিনেতার চলন-বচন ও আচরণে সবার কাছেই স্পষ্ট যে এঁরাই তাঁরা। তাই পরিচিত সব সংলাপে দর্শকের হাততালিতে হল মুখর হয়ে ওঠে। এ-নাটকের অভিনয়শিল্পীদের আন্তরিকতা, চেষ্টা ও পরিশ্রমে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নির্দেশক ইলিয়াস নবী ফয়সাল সামগ্রিক উপস্থাপনায় যে-নাট্যভাষা তৈরি করেছেন তা অনবদ্য গতিশীল। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সামগ্রিকতার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক শিল্পসত্য নির্মাণ করেছেন। নাটকটি গীতনৃত্যনির্ভর। অনবদ্য তার সুর ও ছন্দ। নাটকে সংগীত তো বিশেষভাবে আছেই তারপরও সামগ্রিকতার মধ্য দিয়ে একধরনের সাংগীতিক সুখকর বোধ তৈরি করে। স্বতন্ত্র বা নিজস্ব সৃজনশীলতার ছাপ আছে উপস্থাপনায়।
নির্দেশক বলেন, অগ্নি শ্রাবণ একটি ঐতিহাসিক উপাখ্যান, যেখানে ক্ষমতার পালাবদলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে আসে না কোনো পরিবর্তন। স্বৈরশাসক বিদায় নেয়, আসে নতুন শাসক; কিন্তু থেকে যায় নিপীড়নের কণ্ঠস্বর, ক্ষোভের শব্দ আর দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর, চক্রবদ্ধ পুনরাবৃত্তির বিপরীতে যে সাহসী কণ্ঠস্বরই উঠে দাঁড়ায় – সেই কণ্ঠস্বরই এই নাটকের মূলসুর।’
অভিনয় করেছেন অর্পিতা, অপরিজিতা, অতনু, আয়রা, বিপ্লব, ধ্রুব, দীপ্ত, ফাহমিদা, ইকরা, রাজিব, লাবণ্য, নন্দিতা, পারমিতা, প্রীতম, নদী, লামিয়া, সিফাত, সোহা, অংকন, স্বপ্নীল, তোমো, প্রত্যাশা, রম্য, অর্থী, নোবেল, রিয়া, জিতু, আরিফ, আয়রিন, হিমেল, ইশান, আতিশা, জ্যোতি, নাজমুল, পিনাকী, ফাল্গুনী ও পার্থ। মঞ্চ ও আলো ফজলে রাব্বি সুকর্ণ, পোশাক অতনু, আয়রা মৌ ও অর্পিতা, শব্দচয়ন ও শব্দবিন্যাসে ধ্রুব ব্যাপারী ও জিন্নাতুল ইসলাম প্রত্যাশা। প্রযোজনায় ভৈরবী।
উৎসবের সপ্তম দিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় নাটক মুখোমুখি। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন ধীমান চন্দ্র বর্মণ। পরিবেশনায় থিয়েটার ওয়েব।
মুখোমুখি নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গণহত্যা। ফ্যাসিবাদী শাসকের কাছে মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য নেই। চারদিকে দর্শকবেষ্টিত মঞ্চে নাট্যটি উপস্থাপিত। শুরুতে দেখা যায়, অন্ধকারে একটি লাশ ফেলা হচ্ছে। ডোমকে তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। কেন তাড়াতাড়ি লাশগুলো ফেলা শেষ হচ্ছে না – এমন আতঙ্কের সময় হঠাৎ একটি লাশ নড়ে ওঠে। শুরু হয় শোষকের আতঙ্ক। মঞ্চে আলো স্পষ্টভাবে জ¦লে উঠলে দেখা যায়
এ-গণকবরে যেন মৃত্যুর মিছিল। এক দম্পত্তিকে প্রতিবারই সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়। গণকবরে এক মা তার সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু গণকবরে কোনটা কার কবর তা পাহারাদারও জানে না। মায়ের বিশ্বাস, তার সন্তান মারা যায়নি, এখানে শুয়ে আছে। প্রবাদ আছে – পাপের ঘট যখন পূর্ণ হয়, তখন পটলাও কথা বলে ওঠে। তাই যেন শেষ পর্যন্ত মৃত মানুষেরাও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। ভাবনার সূত্র সুন্দর হলেও মঞ্চের উপরের পাটাতন থেকে প্রতীকী শিশুর লাশ বারবার ছুড়ে ফেলার মধ্যে নির্দেশকের শিল্পবোধগত জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আবার থিমের থ্রু লাইন অর্থাৎ গল্পপ্রবাহের গাঁথুনিতেও সুস্পষ্ট ভাবগত গতিশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন – তাই সত্য, যা রচিবে তুমি। রামের জন্মস্থান অযোদ্ধার চেয়েও সত্য জেনো। নাটকের শিল্পসত্য তৈরিতে আরো পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিল। দায়সারা দিয়ে শিল্প হয় না, শিল্প হয় ভালোবাসায়।
নাটকে অভিনয় করেছেন আল মামুন, পলি চৌধুরী, ফৌজিয়া আফরিন তিলু, মুজাহিদুল ইসলাম রিফাত, শ্রীকান্ত মন্ডল, সঞ্জিত কুমার দে, সায়মা সেলিম আনিকা, স্বরূপ রতন লালন ও হাসিব উর ইসলাম। পোশাক মহসিনা আক্তার, মঞ্চ ও আলো ধীমান চন্দ্র বর্মণ, শব্দ ও সংগীত রাগীব নাঈম।
৭ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ হলে প্রাচ্যনাট পরিবেশন করে বের্টোল্ট ব্রেখ্টের দ্য এক্সপেশন অ্যান্ড দ্য রুল অনুসারে ব্যতিক্রম ও নিয়ম নাটকটি। নাটকটি শহীদুল মামুনের অনুবাদে নির্দেশনা দিয়েছেন আজাদ আবুল কালাম। ব্রেখট নাটকটি ১৯২৯ সালের দিকে রচনা করেন। নাটকটি বুর্জোয়া শ্রেণির চরিত্র ও সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উপলব্ধির নিরীক্ষা। নাটকে দেখা যায় – এক ব্যবসায়ী একজন কুলি ও গাইড নিয়ে ব্যবসার জন্য রওনা দেয় বাহারস্থানের উদ্দেশে। যেখানে তেলের খনি আছে। টাকার লোভ তাকে ঘিরে রাখে। তার উদ্দেশ্যের স্বার্থে যাত্রাপথে গাইড ও কুলির ওপর অত্যাচার করতে থাকে। একসময় গাইডকে সন্দেহ করা শুরু করে। তাই চাকরি থেকে তাকে বিদায় করে দেয়। নিজেকে মহৎ সাজাতে গাইডকে মজুরিও দিয়ে দেয়। একসময় কুলিকে নিয়েও তার সন্দেহ শুরু হয়। কুলি বেইমানি করতে পারে, তাই তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা কৌশল চালায়। চাবুক দিয়ে পেটানোসহ অত্যাচারও চরম পর্যায়ে করতে থাকে। কিন্তু কুলি চাকরিচ্যুতির ভয়ে নীরবে তা সহ্য করতে থাকে। একসময় ব্যবসায়ীর পানির পিপাসা পায়। কুলি পানির পাত্র এগিয়ে দেয়। কিন্তু কুলির পানি দেওয়াকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। পানির পাত্রকে তার পাথর বলে মনে হয়। সে মনে করে, পাথর দিয়ে কুলি তাকে মেরে ফেলতে চাইছে। তাই তৎক্ষণাৎ কুলিকে গুলি করে হত্যা করে। বিষয়টি আদালতে গড়ায়। বিচারে কুলি একজন তৃতীয় শ্রেণির মানুষ ও শ্রমিক, অপরপক্ষে একজন ব্যবসায়ী আত্মরক্ষায় তা করতেই পারে বলে বেকসুর খালাস পায়। কবি ও নাট্যকার ব্রেখটের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণ, শাসন-কৌশল কীভাবে শ্রমিকদের নির্যাতন করে, বুর্জোয়া পুঁজি গড়ে তোলে ও সমাজ-বিচারব্যবস্থা কার স্বার্থে কাজ করে তা স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন।
নাটকটি দর্শকবেষ্টিত মধ্যমঞ্চে উপস্থাপিত হয়। প্রদর্শনীগৃহে প্রবেশ করতেই দেখা যায় চারদিকে দর্শকের আসন আর মধ্যমঞ্চে এলোপাতাড়ি কিছু পাথরের টুকরো পড়ে আছে। বুঝতে পারা যায়, দুর্গম কোনো রাস্তার প্রতীক। মঞ্চের একপাশে সংগীত দল। মিউজিক বাজছে। শুরুর ঘণ্টা বাজলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মধ্যমঞ্চে গান গাইতে গাইতে হাঁটতে থাকে। গান ও সংগীতের অর্কেস্ট্রা থামতেই শুরু হয় সংলাপ। রাস্তার সাজেশনে সমস্ত নাট্যক্রিয়া মধ্যমঞ্চেই সংঘটিত হয়। শুধু বিচারের দৃশ্যে এ-পাশে উঁচুতে তিনজন বিচারকের আসন দেখা যায়। নাটকে সংগীত, সংলাপ, অভিনয় ও চলন বিন্যাসে অনবদ্য। বাংলাদেশে ব্রেখ্ট চর্চায় সংগীত, অভিনয় ও বিযুক্তিকরণকে অনেকে প্রধান মনে করেন; কিন্তু ব্রেখ্টের নাটকে বিনোদনের চেয়ে মার্কসীয় শিল্পবোধ থাকা বেশি জরুরি। মার্কসবাদ পাঠ ছাড়া ব্রেখ্টের শিল্পভাবনা অনুধাবন যে সম্ভব নয় তা অনেকেই জানেন না। কারণ ব্রেখ্ট ছিলেন মার্কসবাদী রাজনীতির সংক্রিয় কর্মী বা বিপ্লবী। নাটক দিয়ে কীভাবে মার্কসবাদী সাম্যবাদ চেতনায় সমাজ পরিবর্তন করা যায়, তার চর্চাই তিনি করতেন। তাই ব্রেখ্টের অ্যালিনিয়েশন, এপিক থিয়েটার ইত্যাদিকে শুধু নাট্যপ্রযুক্তি হিসেব আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজভাবনায় মার্কসীয় সাহিত্য-শিল্পনন্দনের চর্চা মানবসভ্যতার জন্য ইতিবাচক।
অভিনয় করেছেন সাখাওয়াত হোসেন রেজভী, শতাব্দী ওয়াদুদ, ইয়াদ খোরশিদ ঈশান, মো. রফিকুল ইসলাম, অদ্রীজা আমিন, ডায়না ম্যারেলিন, পরশ লোদী, ফয়সাল কবির সাদি, তাসনুভা আদিতা, ফুয়াদ বিন ইদ্রিস, শ্রাবণ শামীম, ডায়না ম্যারেলিন। মঞ্চ ও আলো মো. সাইফুল ইসলাম, সংগীত নীল কামরুল, পোশাক বিলকিস জাহান জবা।
৮ আগস্ট, ২০২৫ শুক্রবার ছিল উৎসবের সমাপনী দিন। সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির। তারপর শিল্পকলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনের সমাপনী ভাষণের মধ্য দিয়ে সমাপনী দিবসের নাটক আগুনি শুরু হয়। নাটক শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হয়।
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের ছায়া অনুসরণে ফ্যাসিবাদী রাজার নিপীড়ন-নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নাটক আগুনি। প্রসেনিয়াম মঞ্চবিন্যাসে পাপেট, শ্যাডো, ভিডিও, মিউজিক, নৃত্য-গীত-অভিনয়, কোরিওগ্রাফি ইত্যাদি নানা কলাবিদ্যার সমন্বিত প্রয়োগে নাট্যটি উপস্থাপিত। শুরুতেই মঞ্চে আসে নন্দিনী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের কণ্ঠস্বর নন্দিনী। শিশুর আর্তনাদ, কৃষকের কান্না, শোষণ-নিপীড়ন ও সমাজের অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে খোঁজে আলোর পথ। নানা শিল্প উপকরণে নাট্যটি অনবদ্য হয়ে উঠেছে। উপস্থাপনায় এত বৈচিত্র্য উৎসবের অন্য কোনো নাটকে লক্ষ করা যায়নি। প্রায় দেড় ঘণ্টার এ-নাটক হলভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতায় উপভোগ করেন। এ-নাটকের অধিকাংশ অভিনেতাই রংপুর থেকে আগত বাস্তবের জুলাই বিপ্লবী। রঞ্জন চরিত্রের অভিনেতা একজন আহত জুলাই যোদ্ধা। এ-নাটকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও ব্যবহার করা হয়েছে। আগুনি নাটকটির পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন কাজী নওশাবা আহমেদ।
অভিনয়ে কাজী নওশাবা আহমেদ, বর্ষা, অয়নিকা, মীম, তৌনিক, শুভ, আবদুল্লাহ, সৌরভ, জান্নাতি, ভূপেন, তাসনিয়া, জামিল, জেমস, রায়হান, জিহাদ, সিফাত, তাহমিদ, এনামুল, শাহরিয়ার, সৌমিত্র, হীরু, এস বি সুমন, শহিদুল, নাহাদ, রাসেল, আবীর, বাপন, বীথি, আফিয়া ও জুলাই যোদ্ধারা। রচনা হাসান রুবায়েত ও এজাজ ফারাহ, সংগীত গোপী দেবনাথ, নীল, এজাজ ফারাহ ও অভিষেক ভট্টাচার্য, নৃত্য তন্ময়, পাপেট চয়ন দাস, পোশাক আফসানা শারমিন ঝুম্পা ও ফারজানা আহমেদ উর্মি। পরিবেশনায় ‘টুগেদার উই ক্যান’।
উৎসবে প্রদর্শিত নাটকগুলোর বিষয়, চরিত্র, ভাষা-সংলাপের ধরন ও উপস্থাপন প্রক্রিয়ায় জুলাই বিপ্লব ও তার আদর্শ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে তা একটু খেয়াল করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ১১টি নাটক নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে উপজীব্য ‘মনসুন রেভলিউশন স্পিরিট’ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি নাট্যনির্মাণের জন্য ছয় লক্ষ করে টাকা অনুদান দিয়েছেন। সরকারি নিয়মে অনুসারে তা থেকে ভ্যাট কর্তন করা হয়েছে। আবার নির্মাণ শেষে ‘জুলাই পুনর্জাগরণ নাট্য উৎসব ২০২৫’-এ তাদের প্রদর্শনীর জন্য আলাদাভাবেও সম্মানী দিয়েছেন।
প্রযোজনা সংস্থা ‘টিম কালারস’, ‘এথেরা’, ‘ফোর্থওয়াল থিয়েটার’, ‘থিয়েটার ওয়েভ’, ‘টুগেদার উই ক্যান’ বাংলাদেশে নাট্যচর্চারত কোনো নাট্যদল নয়। কারণ ইতোপূর্বে তাদের কোনো নাট্য পরিবেশন করতে দেখা যায়নি। অনুদানপ্রাপ্ত নির্দেশকগণ সরকারি অনুদানের টাকা গ্রহণ করে কিছু ছেলেমেয়ে অর্থাৎ কিছু কর্মী সংগ্রহ করে দলের নামকরণ করে নাট্য উপস্থাপন করেছেন। উপরিউক্ত নাট্য-পর্যালোচনায় স্পষ্ট যে, অনুদানগ্রহীতার অনেকেই দায়সারাগোছের নাটক করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। এগুলোতে বিষয়গত ভিন্নমুখিতা, মানহীনতা, উপস্থাপনাগত বা কারিগরি জটিলতা রয়েছে। তাছাড়া অনেক প্রযোজনারই সেট, পোশাক, আলো, অভিনয় ও উপস্থাপন দেখে নাট্য নির্মাণ ব্যয় এক লক্ষ টাকার অধিক বলেও মনে হয়নি। কিন্তু সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অনুদান ছিল ছয় লাখ টাকা করে। যা হোক, নির্মিত নাটকগুলোর নিয়মিত শো হতে পারবে কি না সন্দেহ। অপরপক্ষে নিয়মিত দলকে সিকিভাগ অনুদান দিলেই শিল্পমানসম্পন্ন প্রযোজনা নির্মিত হতো এবং নিয়মিত প্রদর্শনীও হতো বলে মনে হয়।
সত্যিকার সাংস্কৃতিক উন্নয়ন করতে হলে শুধু অনুদান দিলেই হবে না। শিল্পী-অভিনেতা-লেখকদের জন্য রাষ্ট্রীয় গ্র্যান্ড বা বেতন চালু করা উচিত। রাষ্ট্রীয় পেশাদার খেলোয়াড় থাকতে পারলে পেশাদার অভিনেতা-শিল্পী-লেখক কেন থাকবে না। সেইসঙ্গে প্রয়োজন জাতীয় পরিচয় সৃষ্টি হয় এমন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ। বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী ধারার কোনো মঞ্চ নেই। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে যা আছে তা সবই ইউরোপীয় আদলের প্রসেনিয়াম নাট্যমঞ্চ। এমনকি শিল্পকলায় ঐতিহ্যবাহী ধারার চারদিকের দর্শকবেষ্টিত মঞ্চে নাটক করতে গেলে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয়। উপনিবেশরীতি এখনো সমভাবেই কার্যকর। বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার চর্চা বা বিকাশ যেন অদৃশ্য এক বাধা। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা প্রয়োজন। তাই জেলায় জেলায় ঐতিহ্যবাহী দেশজ ধারার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত চারদিকে দর্শকবেষ্টিত ‘জাতীয় বাংলা নাট্যমঞ্চ’ তৈরি করা জরুরি। যেখানে পালা, জারি, যাত্রা নিরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এছাড়া সভা-সেমিনার কিংবা ভিন্ন কোনো কৌশলে ‘সবার জন্য সংস্কৃতি’ ধারায় এগিয়ে যেতে হবে।
উৎসবে দর্শকের উপস্থিতি ছিল অভূতপূর্ব। প্রায় প্রতিদিনই নাট্যমঞ্চ ছিল দর্শকপূর্ণ। শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ, নানা পেশাজীবী মানুষ এসেছেন। এক অপূর্ব পরিবেশ! গত ত্রিশ বছরে নাটকে যাদের দেখা গেছে, এ উৎসবে তাদের কাউকে দেখা যায়নি। প্রায় সবই নতুন। মনে হয়েছে, নতুন প্রজন্মই হয়ে উঠছে জাতির বহমান উত্তরসূরি। উৎসবে প্রযোজনা সূত্রে প্রায় ৩০০-এর অধিক কলাকুশলীও যুক্ত ছিলেন।
জুলাই বিপ্লব জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১ হয়ে ২০২৪, বাঙালির জাতিসত্তার মুক্তিরই আন্দোলন। ফলে এ-আন্দোলন জাতিগত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির জাগরণেও গুরুত্ববহ। কিন্তু এ উৎসবের অধিকাংশ নাটকেই বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো ছাপ ছিল না। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। তার আবেগ, তার দ্রোহ প্রকাশের নিজস্ব রূপ আছে। সংস্কৃতির মধ্যেই কোনো দেশের আত্মপরিচয় লুকিয়ে থাকে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশ আজো বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে ব্যাপৃত। তাই ভিন্নদেশি সংস্কৃতি চিহ্নিত ও পরিত্যাগ করে দেশজ সংস্কৃতির বিকাশ করতে হবে। প্রকৃত দেশজ বিষয়, দেশজ শিল্পচর্চার ধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা বা দেশজ শিল্পের বিকাশ ঘটে – এমন উদ্যোগী সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আত্মপরিচয়ের মর্যাদায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। যা হোক, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ-উৎসবটি হয়ে উঠেছে জুলাইয়ের ইতিহাসচর্চার উৎসব।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.